স্রোতস্বিনী পর্ব-০১

0
248

#স্রোতস্বিনী
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#সূচনা_পর্ব

“ক্যান্সারে আক্রান্ত বলে, প্রিয় মানুষটা ৩বছরের সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে। আর সেই ক্যান্সারে আক্রান্ত মেয়েকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন আপনি? তাও মাত্র দুই ঘন্টার পরিচয়ে! কয়েক মাস পর যেই মেয়েটা এই পৃথিবীতেই থাকবে না, তাকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন! বিষয়টা হাস্যকর মনে হচ্ছে না আপনার, মিস্টার স্রোত?
অবাক স্বরে কথাগুলো বলে উঠল ধারা। বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ স্রোতের দিকে। তারপর আচমকাই হা হা করে হেসে উঠল। কোনো মেয়ের হাসি কি আদৌ এত সুন্দর হয়! হয়ত হয়। আগে কোনো মেয়েকে এত কাছের থেকে দেখা হয়নি বলে খেয়াল করেনি সেভাবে। ধারা হেসেই যাচ্ছে। যেন কোনো একটা মজার জোক্সস শুনেছে। তাই হাসি যেন থামছেই না। স্রোত এক নজরে ধারার দিকে তাকিয়ে আছে। দমকা হাওয়ায় চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। শীতের সকালে এই শীতল বাতাস সাথে পছন্দের মানুষটার মিষ্টি হাসি। ইস! এক মিষ্টি অনুভূতিতে স্রোত ডুবে যাচ্ছে। মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছে মন প্রেমে পড়েছে। অচেনা, অজানা মেয়েটার প্রেমে পড়েছে। তাও কি না কয়েক ঘন্টা পরিচয়ে! অদ্ভুত! এত তাড়াতাড়ি কেউ কারোর প্রেমে পড়তে পারে? প্রশ্নের উত্তরটা খুঁজে পেলো না স্রোত। হাসির মাঝে ধারা খেয়াল করল স্রোত ওর দিকে তাকিয়ে আছে। হুট করেই লজ্জা পেয়ে হাসি বন্ধ করে দিলো। দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো অন্যদিকে। আমতা আমতা করে প্রশ্ন করল,
” কী দেখছেন ওভাবে?”
স্রোত সময় নিলো না। ছোট করে উত্তর দিলো,
“দেখছি…।”
“কী…?”
ধারার পাল্টা প্রশ্নে স্রোত আগের ন্যায় উত্তর দিলো,
“আমার স্রোতস্বিনী কে…।”
এহেতুক কথায় ধারা চমকে গেলো। বিস্মিত চাহনী দিলো। আঁখি জোড়া ছোট ছোট করে ঠোঁট উল্টে প্রশ্ন করল,
“স্বোতস্বিনী! এই স্বোতস্বিনীটা আবার কে?”
“কে আবার? আপনি। আপনি আমার স্রোতস্বিনী।”
স্রোতের এমন ঝটপট, সহজ, সরল স্বীকারোক্তিতে ধারা অবাকের শেষ সীমানায়। বিস্ময়ে চোখের পাতা পড়ছে না। ধারাকে এমন গোল গোল চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্রোত খানিকটা হাসল। শান্ত, শীতল কণ্ঠে বলে উঠল,
“আমি স্রোত। আপনি ধারা। তাহলে দুজনের নাম মিলিয়ে কি হলো, বলেন তো?”
স্রোতের এমন প্রশ্নে ধারা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। প্রশ্নত্তুর নয়নে তাকিয়ে রইল। স্রোত বুঝতে পারল। হাসল একটুখানি। ছেলেটা শুধুই হাসে। আচ্ছা, ছেলেদের কী হাসলে ভালো লাগে না-কী গম্ভীর মুখশ্রীতে ভালো লাগে? ধারার মস্তিষ্ক সাথে সাথে জানান দিল, ‘ছেলেদের হাসিটা ঠিক মুক্তোর মতো। হাসিতে চারদিক আলোকিত হয়’। মেয়েরা স্বভাবতই খুব বেশি হাসে। মেয়েদের হাসির সৌন্দর্য খুঁজতে হলে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়না। কিন্তু ছেলেদের হাসির সৌন্দর্য সবসময় প্রকাশ হয় না। আর যখন প্রকাশ হয় তখন তার থেকে সুন্দর দৃশ্য আর হয়না। ধারা নিজের এইসব ভাবনায় নিজেই অবাক হলো। মুহূর্তেই কত কী খুঁজে বের করে ফেলল। আসলেই কী এই ভাবনা গুলো সঠিক? না-কী শুধু ধারার কাছেই এই ভাবনাগুলো সঠিক ও সুন্দর মনে হচ্ছে? কে জানে? উত্তরটা এবার আর পেল না। মস্তিষ্ক বলছে,’ অল্প পরিচয়ে কাউকে এতটা সুন্দর ভাবা উচিত না’। আর মন বলছে, ‘ভাবনা গুলোর মতো ছেলেটাও সুন্দর ও নিঁখুত হৃদয়ের মানুষ। এবার মন আর মস্তিষ্কের মধ্যে লড়াই শুরু হলো। মস্তিষ্ক বলছে,’ছেলেটা তোকে পটানোর চেষ্টা করছে’। আর মন বলছে,’ছেলেটা যা বলছে সত্যি বলছে’। এবার ধারা কার কথা শুনবে? মন না-কী মস্তিষ্কের? কার কথা শোনা উচিত? নিজের মন, মস্তিষ্কের সাথে যখন ধারা যুদ্ধ করতে ব্যস্ত। তখন স্রোত ধারার ভাবুক চেহারা দেখতে ব্যস্ত। ধারা ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষণ পর পর ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলছে হয়ত? মোটা ফ্রেমের চশমার কাচ ভেদ করে ধারার চোখের দৃষ্টি জানান দিচ্ছে এই মুহূর্তে ধারা স্রোতকে নিয়ে ভাবছে। ধারা ভাবতে ভাবতে আনমনে বলে উঠল,
“আমি ধারা। আপনি স্রোত। দুজনের নাম মিলিয়ে হয় ‘ধারাস্রোত’।”
ধারার কথায় স্রোত শব্দ করে হেসে উঠে। স্রোতকে হাসতে দেখে ধারা ছোটো ছোটো চোখ করে তাকিয়ে বলে উঠল,
“হাসছেন কেন?”
স্রোত এবার একটু জোরেই হেসে উঠল। স্রোতের হাসি দেখে ধারার বড্ড রাগ হলো। রাগে চোখ, মুখ কুঁচকে তাকিয়ে রইল স্রোতের দিকে। স্রোত হাসতে হাসতে ধারার রাগী চেহারার দিকে থমকে গেলো। মেয়েটা মাঝে মাঝে এমন সুন্দর করে এক্সপ্রেশন দেয় যে, স্রোত থমকে যেতে বাধ্য হয়। ধারা স্রোতকে এমন ‘হা’ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে, স্রোতের মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলে উঠল,
“ও মশাই! এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আমার মুখে কি আপনার প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে?”
স্রোত একটু নড়েচড়ে বসল। মাথা চুলকাতে চুলকাতে লাজুক হেসে নিঁচু স্বরে বলতে লাগল,
“আপনার মাঝে তো আমি নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছি। আর প্রশ্নের উত্তর হারিয়ে যাওয়া তো সামান্য ব্যাপার।”
ধারা হাসল। তবে সামান্য। স্রোতের কথাটুকু তার কান অব্দি পৌঁছালেও ধারা মুখে এমন একটা ভাব করল যেন সে কিছুই শুনতে পায়নি৷ তাই একটু কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“কী বললেন আপনি?”
ধারার কণ্ঠস্বরে স্রোত মেঁকি হাসি দিয়ে সাথে সাথে বলল,
“না না কিছু না। আমি তখন হাসছিলাম আপনার উত্তর শুনে। ওটা ধারাস্রোত হবে না। স্রোতের ধারা হবে। কিন্তু আপনাকে আমি ‘স্রোতস্বিনী’ বলেই ডাকব। আপনার তাতে আপত্তি আছে?”
ধারা হেসে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল। একটু থেমে উত্তর দিলো,
“না। আপনার যা খুশি ডাকতে পারেন।”
স্রোত এবার মজার সুরে বলে উঠল,
“হুহ! আপনার আপত্তি থাকলেই কি? আমি তো বলবো। একশো বার বলব। ”
বলেই দুজনে একসাথে হেসে উঠল। “ঢাকা টু চট্রগ্রাম” বাসের লং জার্নিতে স্রোতের পাশের সিটে ধারার মতো একজন থাকলে, স্রোতের দিন ভালো তো যাবারেই কথা। দুজনের মাঝেই হঠাৎ নিরবতা নেমে আসল। আর কথা খুঁজে পেল না স্রোত। ওইদিকে ধারাও চুপ। ধারার কেন যেন, চুপ থাকতে মন চাচ্ছে না। তাই নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করল,
“আচ্ছা, আপনি চট্রগ্রাম কোথায় থাকেন?”
স্রোত সাথে সাথেই উত্তর দিল,
“আমি চট্রগ্রাম থাকি না।”
“তাহলে চট্রগ্রাম কি ঘুরতে যাচ্ছেন?”
“না কোনটাই না।”
এবার ধারা একটু বিরক্তি নিয়েই বলল,
“তাহলে কি বিয়ে করতে যাচ্ছেন?”
“এটাও না।”
ধারার রাগ উঠল এবার। রাগী স্বরেই বলল,
“তাহলে, কি ঘোড়ার ঘাস কা’টতে যাচ্ছেন?”
স্রোত ঠোঁট চে’পে হেসে বলল,
“উঁহু! এটাও না।”
ধারার রাগে নিজের মাথায় নিজেরেই বাড়ি দিতে মন চাইল। রাগে দাঁতে দাঁত চে’পে বলে উঠল,
“তাহলে, কি হাওয়া খেতে যাচ্ছেন?”
স্রোত আগের ন্যায় উত্তর দিল,
“একদম না।”
ধারা এবার রাগে উচ্চস্বরে বলে উঠল,
“উফফ! স্রোতের বাচ্চা ক্রোধ…।”
ধারাকে সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে না দিয়ে স্রোত বলে উঠল,
“এই, এই আমার আবার বাচ্চা আসল কই থেকে? আমি তো বিয়েই করিনি। আর আপনি আমাকে বাচ্চার বাবা বানিয়ে দিলেন। আবার বাচ্চার নাম ও ঠিক করে ফেললেন৷ তবে ক্রোধ নামটা আমার বড্ড পছন্দ হলো। একটা আ’গুন আ’গুন ভাব আছে। আপনাকে ধন্যবাদ, এত সুন্দর একটা নাম ঠিক করে দেওয়ার জন্য। ”
ধারা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে চুপ হয়ে গেল। জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইল। স্রোত ধারার অভিমানী মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে, বলল,
“আমি ঢাকা থাকি। আপনাদের চট্রগ্রাম শহরে একটা গানের প্রোগ্রামে যাচ্ছি।”
ধারা সাথে সাথে অবাক স্বরে প্রশ্ন করল,
“আপনি গান জানেন?”
স্রোত সাথে সাথে একটু জোরেই বলে উঠল,
“আস্তাগফিরুল্লাহ! আস্তাগফিরুল্লাহ! কী বলছেন? আমি গাঞ্জা নিব কেন? আমি অনেক ভদ্র একটা ছেলে। আমাকে দেখে কি আপনার গাঞ্জাখোর মনে হয়? ”
স্রোতের এমন কথায় ধারার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে বড় গাঁধা মনে হলো। রাগে, ক্ষোভে চোখ বন্ধ করে একটা বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। এই ছেলেটাকে কিছু বলা আর না বলা সমান। বিরক্ত লাগল এবার সত্যি সত্যি। তাই চুপ করে রইল। স্রোত ধারার চুপসানো মুখটা দেখে হাসল খানিকটা। শান্ত, মোলায়েম স্বরে ধারার কানে কানে বলল,
“আপনাকে রাগলে কিন্তু বেশ লাগে, স্রোতস্বিনী।”

#চলবে