স্রোতস্বিনী পর্ব-৩১

0
120

#স্রোতস্বিনী
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
পর্ব ৩১

মাথার উপরের সূর্যটা ধরণীতে নিজের দাপট দেখাতে ব্যস্ত।
এতোদিন সব ঠিক থাকলেও বিপত্তি বাঁধে আজকে।আজ রান্নার মহিলা আসে নি।সে নাকি অসুস্থ।আজ স্রোতকে রান্না করতে হবে।রান্না করতে গিয়ে স্রোত দেখলো প্রয়োজনীয় অনেক দ্রব্যই নেই।তাকে দোকানে যেতে হবে।মেহরাদ ঘুমোচ্ছে বিধায় তাকে না ডেকেই স্রোত তাদের ভবনের সামনের দোকানটায় চলে যায়।এর মধ্যেই মেহরাদের ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে হাঁপাতে থাকে।দেখে মনে হচ্ছে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছে।তার প্রচন্ড পানির তেষ্টা পায়।সে অনবরত স্রোতকে ডাকতে থাকে।কিন্তু স্রোত তো বাহিরে।বিছানার পাশের ট্রি টেবিলটা খানিকটা দূরে হওয়ায় বিছানা থেকে নেমে পানির জগটা নিতে হয়।এক পর্যায়ে মেহরাদ নিজেই পানি নেওয়ার জন্য নামার চেষ্টা করে।ততক্ষণে স্রোত লিফ্টে উঠে গেছে।মেহরাদ ভাঙ্গা পায়ে ভর দিতে গিয়ে মেঝেতে পরে যায়।”স্রোত” বলে চিৎকার করে উঠে।স্রোত তখন সদর দরজা খুলছিলো।মেহরাদের চিৎকার শুনে সে দৌড়ে ঘরে গিয়ে দেখে মেহরাদ মেঝেতে পরে আছে।পাশে পানির জগ ভাঙ্গা।সে মেহরাদকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দেয়।কোথায় ব্যাথা পেয়েছে,কোথায় কষ্ট হচ্ছে বারবার জিজ্ঞাসা করতে থাকে।আর “স্যরি” বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠে।সে বুঝতে পারে নি এতোকম সময়ের মধ্যে মেহরাদের ঘুম ভেঙে যাবে।

অবাক করা বিষয় হলো স্রোতের এতোগুলা কথার বিপরীতে মেহরাদ শুধু কাঠ কাঠ গলায় বললো,
“আমি ঠিক আছি।যাও এখান থেকে।”

স্রোত আবার কিছু বলতে নিলে সে চিৎকার করে বলে,
“যেতে বলেছি না তোমায়?যাও!”

স্রোত প্রতিত্তোরে কিছু না বলে চলে যায়।সে মেহরাদের মনের অবস্থাটা বুঝতে পারে।তাই একা থাকতে দেয়।

মেহরাদের মাথায় শুধু ঘুরছে একটা বিষয়।সামান্য পানির জন্যেও তার স্রোতের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।পানি টাও সে নিজে নিয়ে খেতে পারছে না।স্রোতের কতটা পরিশ্রম হচ্ছে প্রতিদিন।বিষয়টা মেহরাদের মনে দাগ কাটে, হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে সে।বারবার মাথায় আসে তার জন্য স্রোতের ক্যারিয়ারে প্রভাব পড়েছে,তার জন্য স্রোতের এতো বছরের সাধনা,পরিশ্রম,স্বপ্ন সব পূরণ হতে গিয়েও হলো না।মাঝপথে সব বিসর্জন দিয়েছে।সব হয়েছে তার জন্য,সব দোষ তার!

অন্যদিকে,কান্নার চোটে সারারাত ঘুমায় নাই।সকালে সূর্যের আলো ফোটবার পর চোখ লেগেছে।আজ ভার্সিটিও যায় নি,ইচ্ছে করে নি।আজ নাহয় একা বাসায় বসে দুঃখবিলাস করুক!ফোনের কর্কশ ধ্বনিতে আলোড়িত হচ্ছে ঘরের প্রতিটি কোণা।সারারাত কান্না করায় মাথা ধরে আছে,ঘুমে মগ্ন সে।কয়েকবার রিং বাজার পর সে ধরফরিয়ে উঠলো।ঘুম ঘুম কন্ঠেই ফোন রিসিভ করে সালাম দিলো সে।তখনই ঐ পাশ থেকে জাহানারা বেগম অস্থির কন্ঠে আতংকিত হয়ে বললেন,
“মান্ধবী!রায়হান এক্সিডেন্ট করেছে।এখন হসপিটালে ভর্তি।তুমি তাড়াতাড়ি পপুলার হাসপাতালে চলে এসো।”

ঘুম উবে গেলো।চেহারায় আঁধার নেমে নেলো।ঘুমের কারণে নিষ্ক্রিয় মস্তিষ্ক আরো নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলো।মাথা যেনো বুদ্ধিশূন্য হয়ে গেলো।কোনোমতে বিছানা নামলো সে।আবার মাথা ঘুরিয়ে পরে গেলো।দেহ অসাড় হয়ে আসছে।কিন্তু তাকে যেতে হবে।মানুষটাকে দেখতে হবে।কালকে সব জানার পর থেকে ঘৃণা উবে গেছে।বরং নিজের খারাপ ব্যবহারে নিজে অনুতপ্ত। রায়হান অনেকবার তাকে কিছু বলার চেষ্টা করেছিলো,কিন্তু সে শোনে নি,সবসময় এড়িয়ে গেছে।

হাসপাতালের কেবিনে প্রবেশ করতেই দেখলো রায়হান বেডে হেলান দিয়ে বসে বসে প্লেট থেকে আঙ্গুর খাচ্ছে।মাথায় ছোট একটা ব্যান্ডেজ।তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না তার এক্সিডেন্ট হয়েছে।

মান্ধবীকে দেখে জাহানারা বেগম এগিয়ে গেলেন।বললেন,
“জ্বরের ঘোরে বাসা থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়।আর যা হওয়ার হলো!সামলাও তুমি‌!”

বলে বেরিয়ে গেলেন তিনি।মান্ধবী কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো।অবাকও হলো!গাড়ি এক্সিডেন্ট করলে কেউ এতো আয়েশ করে আঙ্গুর খেতে পারে!চোট তো দেখা যাচ্ছে না।

রায়হান মান্ধবীকে দেখলে তার মধ্য দিয়ে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেলো,অধর প্রসারিত হলো।মেয়েটা বাসার কাপড়েই চলে এসেছে,পায়ে বাসার স্যান্ডেল। চুল গুলো ক্ল্য ক্লিপ দিয়ে আটকানো হলেও কয়েকদিক দিয়ে খুলে উড়ছে।চোখগুলো ফোলা ফোলা,মেয়েটা কি কান্না করেছে!

এতোকিছু লক্ষ্য করেও সে আঙ্গুর খাওয়া থামালো না।আজ যেনো পৃথিবীর সব আঙ্গুর সে শেষ করে ফেলবে।এতো ভাল্লাগছে তার আঙ্গুরগুলো। আয়েশি ভঙ্গিতে খেতেই আছে।আর মনে মনে ভাবছে,মায়ের বুদ্ধি কাজে দিয়েছে।

মান্ধবী ধীর পায়ে রায়হানের দিকে এগিয়ে গেলো।শক্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলো,
“এসব কিভাবে হলো?”

রায়হান মান্ধবীর দিকে না তাকিয়েই আঙ্গুর খেতে খেতে বললো,
“তোমাকে বলতে বাধ্য নই।”
“আমাকে বলতে আপনি বাধ্য!”কিড়মিড়িয়ে বলে মান্ধবী।

এবার রায়হান তাকালো মান্ধবীর দিকে।ভ্রু কুঁচকিয়ে একটা আঙ্গুর টপ করে মুখে দিয়ে শোধালো,
“কেনো?আমি কি তোমার বয়ফ্রেন্ড লাগি?তোমার বয়ফ্রেন্ডের কাছে যাও।তার খোঁজখবর নাও।”

মান্ধবী করুণ চোখে তাকালো রায়হানের দিকে।নতমুখে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মেঝে খুটতে খুটতে ধীরে ধীরে বললো,
“আমার বয়ফ্রেন্ড নেই।ওটা আমার ডিপার্টমেন্ট সিনিয়র ছিলো।আমি ঐদিন আপনাকে মিথ্যাে বলেছিলাম।”

রায়হান চমৎকার হাসলো। এবার সে তার স্বাদের আঙ্গুরের প্লেটটা পাশে রেখে দিলো।মান্ধবী তখনও নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।তার চোখ ছলছল করছে।যেকোনো সময় কান্না করে দিবে।রায়হানের ঠোঁটে দূর্বোধ্য হাসি।সে কিছু না বলেই মান্ধবীর কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসলো।আচমকা আক্রমণে মান্ধবী ধরফরিয়ে উঠলো।সে নিজেকে ছাড়াতে চাইলো, কিন্তু সুঠামদেহী পুরুষের কাছ থেকে ছাড়াতে ব্যর্থ সে।
রায়হান মান্ধবীর দিকে ঝুঁকে ঘোরলাগা গাঢ় কন্ঠে বলতে শুরু করলো,
“মেয়ে তোমার একটা ছোট্ট মিথ্যার জন্য আমি পাঁচদিন জ্বরে শয্যাশায়ী ছিলাম।এর শাস্তি তো তোমার পেতেই হবে।”

মান্ধবী আঁতকে উঠলো।ছলছল চোখে তাকালো রায়হানের দিকে।রায়হানের দৃষ্টিতে নিজের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট দেখতে পেলো।সেই চোখে প্রতীক্ষা,উন্মাদনা।মান্ধবী ঢোক গিলে বললো,
“এটা হসপিটাল।ছাড়ুন,যে কেউ চলে আসবে!”

রায়হান হাসলো,দূর্বোধ্য হাসি।বললো,
“কেউ আসবে না।মা আসতে দিবে না কাউকে।”
“মানে?”অবাক হয়ে শোধালো মান্ধবী।
” মানে!”
আরেকটু ঝুঁকে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলতেই মান্ধবী শিউরে উঠলো,তিড়তিড় করে কাঁপতে লাগলো তার চিকন অধরযুগল।রায়হানের নজর এড়ালো না।সে মান্ধবীর কোমড় জড়িয়ে আরেকটু উঁচু করলো।মান্ধবী চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে।আজ যেনো তার অবাক হওয়ার দিন!যেই বিস্ময় আরো বেড়ে গেলো যখন এক জোড়া পুরুষালি ঠোঁট তার চিকন অধরযুগলে নিজের দাপট দেখাতে শুরু করলো।

পৃথিবীতে সন্ধ্যা নেমে এসেছে বহুক্ষণ পূর্বেই।এখন চারিদিকে ঘটা করে অন্ধকার তার রাজত্ব দেখাচ্ছে।দুপুরের পরে মেহরাদ স্রোতের সাথে কথা বলে নি।দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় স্রোত কথা বলতে চাইলেও মেহরাদ তাকে একা থাকতে দিতে বলেছে।স্রোতও আর তাকে ঘাটায় নি।তারপর থেকে দরজার বাহির থেকেই মেহরাদের উপর নজর রেখেছে।

ইদানীং প্রচুর গরম পড়েছে।সারাদিনের পরিশ্রমে স্রোত গোসল করার সময় পায় নি।ইচ্ছে করেই যায় নি,যদি মেহরাদের প্রয়োজন হয়!স্রোত রুম থেকে কাপড় নিয়ে চলে যায় পাশের রুমে।মেহরাদ ঘর অন্ধকার করে হুইল চেয়ারে বসে আছে।ড্রিম লাইটের আবছা আলোতে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে মাথায় রক্ত চেপে যায় মেহরাদের।সব মনে পড়তে থাকে।নিজেকে দোষারোপ করতে থাকে।এক পর্যায়ে ফুলদানিটা আয়নায় ছুঁড়ে মারে সে।ঝনঝন শব্দ করে ভেঙ্গে যায় আয়নাটা।স্রোত সবেমাত্র গোসল করে বের হয়েছে।পাশের রুম থেকে গ্লাস ভাঙ্গার শব্দ আর মেহরাদের চিৎকারের শব্দ পেয়ে দৌড়ে নিজের রুম যায়।আলো জ্বালিয়ে দেখতে পায় নিজের রুমের বিধ্বস্ত অবস্থা।সেসবে পাত্তা না দিয়ে সে মেহরাদকে জড়িয়ে ধরে।শান্ত করার চেষ্টায় মেতে উঠে।মেহরাদের মাথাটা চেপে ধরে নিজের সাথে।তবুও শান্ত হচ্ছে না।পা গলা ষাঁড় ক্ষেপলে যেমনটা করে,সেও এমনটা করছে। স্রোত বুঝতে পারলো সবটা ডিপ্রেশন থেকে করছে।স্রোত তাড়াতাড়ি করে তাকে পাশের রুমে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসায়।মেহরাদ বারবার এক কথা-ই বলছে,
“স্রোত ছাড়ো আমাকে।সব শেষ করে দিবো সব।নিজেকেও শেষ করে দিবো।আমার জন্য তোমার স্বপ্নের বিসর্জন দিতে হয়েছে। সামান্য পানির জন্যেও আমার তোমাকে প্রয়োজন হচ্ছে।আমি ভুল করেছি তোমাকে নিজের সাথে জড়িয়ে।জোর করে তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছি।তুমি চলে যাও স্রোত। তুমি চলে যাও।”

স্রোত মেহরাদের মুখটা নিজের দু হাতের আজলে নিয়ে বলে,
“মেহরাদ শান্ত হোন।কিচ্ছু হয় নি।শান্ত হোন।আর কয়েকদিন তারপর আপনি ঠিক আগের মতো হয়ে যাবেন।”

স্রোতের চোখ দিয়ে অনবরত পানি গড়াচ্ছে। কোনোভাবেই শান্ত করতে পারছে না সে।কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না।মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে আছে।সে একটা সাংঘাতিক কাজ করে বসলো।একটু বেশিই নির্লজ্জ হলো সে।মেহরাদকে শান্ত করতে পুরুষালি ঠোঁট জোড়া দখল করে নিলো।নিজের স্বামীকে শান্ত করতে এর থেকে অভিনব উপায় তার মাথায় আপাতত আর আসে নি।অনেকটা সময় পরে ছেড়ে দিলো স্রোত।তার পদক্ষেপ সফল।

মেহরাদের মুখশ্রী নিজের হাতের আজলে নিয়ে বললো,
“কি হতো স্বপ্ন পূরণ করে?যেখানে আপনি না থাকলে আমার অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যেতো?”

মেহরাদ টকটকে লাল চোখে চেয়ে রইলো স্রোতস্বিনীর দিকে কিছু বললো না।স্রোত আবার বললো,

“পরীক্ষা তো পরের বছরও দিতে পারবো মেহরাদ।কিন্তু আপনাকে হারালে কোথা থেকে ফিরিয়ে আনতাম?”

এবারও চুপ রইলো মেহরাদ।
স্রোত এবার চিৎকার করে উঠলো,
“চুপ করে আছেন কেনো?বলুন!কথা বলুন মেহরাদ।”

মেহরাদ এবার নতমুখী হয়ে বাচ্চাদের মতো করে বললো,
“আমি স্যরি!এত্তোগুলা স্যরি।কিন্তু আমার মাথায় এই ভাবনাগুলা আসলে আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না।মাথায় রক্ত৷ চেপে যায়।আমি তোমাকে ভালবাসি স্রোত।প্রতিনিয়ত তোমার ক্লান্ত চেহারা আমি সহ্য করতে পারি না।”

এই মানুষটাই নাকি একটু আগে ক্ষেপে গেছিলো!এখন বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে নিজের দোষ স্বীকার করছে।স্রোত স্মিত হাসলো।মেহরাদকে শুইয়ে দিলো।পাশে বসে দুষ্টুমি করে বললো,
“ক্লান্ত চেহারায় বুঝি আমাকে দেখতে বিশ্রী লাগে?তাই সহ্য করতে পারেন না?আরেকটা বিয়ে করবেন?সুন্দরী কাউকে?”

মেহরাদ রাগী চোখে তাকালো যেনে এখনই চোখ থেকে আগুন বেরোবে,ভস্ম করে দিবে স্রোতকে।স্রোত দৃষ্টি দেখে শব্দ করে হেঁসে ফেললো।মেহরাদকে জড়িয়ে ধরে বললো,

“বিশ্রী হই,কালো হই,অন্ধ হই,যাই হই না কেনো, একবার যখন আপনাকে মন দিয়ে ফেলেছি,এই স্রোতস্বিনীর হাত থেকে আপনার রেহাই নেই।বলে দিলাম!আমার অতল গভীরেই ঠাঁই খুঁজতে হবে আপনার। আমার প্রবাহেই ভাসতে হবে আপনার।ভালোবাসি মেহরাদ।”

“আমিও ভালোবাসি আমার স্রোতস্বিনীকে।”

মেহরাদ এক হাতে আগলে নিলো নিজ স্রোতস্বিনীকে।সারারাত এভাবেই মেহরাদের বুকে লেপ্টে রইলো স্রোতস্বিনী।

#চলবে…..