স্রোতস্বিনী পর্ব-৩২

0
132

#স্রোতস্বিনী
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
পর্ব ৩২

দুই মাস পর..

মেহরাদ এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।আগের মতো চলা-ফেরা করতে পারে।তবে বুকের পাশ দিয়ে গু লি যাওয়ায় সাবধানে থাকতে হয়।স্রোত-মেহরাদের মধ্যে এখন সুন্দর একটা বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে।অন্যদিকে,রায়হান-মান্ধবীও এই দু’মাস চুটিয়ে প্রেম করেছে।একবছর আগে প্রস্ফুটিত না হওয়া প্রেমপুষ্প এখন পুরোদমে চারিদিকে নিজের সুভাস ছড়াচ্ছে।এখন প্রণয় পরিণয়ের অপেক্ষা।

আজ মান্ধবীর বাসায় রায়হানের পরিবারের সবাই আসবে ওদের বিয়ে নিয়ে কথা বলার জন্য।বলা বাহুল্য, এখন সবাই ওদের ব্যাপারে জেনে গেছে।কারো কোনো আপত্তি নেই।তবুও আনুষ্ঠানিকতা রক্ষা করতেই আজ দেখতে আসা।

স্রোত প্রথমে বড্ড অবাক হয়েছিলো যে এই সম্পর্কে সে কিছুই জানতো না।বোন একবছর এতো কষ্ট পেয়েছে অথচ ও বড়বোন হয়ে ছোটবোনের দিকে নজর রাখতে পারে নি, পাশে থাকতে পারে নি।বোন রায়হানকে ভালোবাসে শুনেই সে আর আপত্তি করে নি।সে এতোদিনে ভালোবাসার মর্ম বুঝে গেছে।ভালোবাসার মানুষহীন জীবন কেমন লাগে, এটা সে ঐ কালোরাতেই হাড়ে হাড়ে বুঝেছে।সে চায় তার বোনের জীবনটাও এমন ভালোবাসাময় হোক।সেখানে এতো ভালো শাশুড়ী বলার অবকাশ রাখে না।

সকাল থেকে পুরোদমে আয়োজন চলছে।মেহমানের আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখতে চাননা সিরাজ সাহেব।আবার,দুই মেয়ে একই পরিবারের বউ হবে,ব্যাপারটা যেমন আনন্দের,তেমনি অনেক দায়িত্বেরও।আজকের দায়িত্ব তিনি পুরো স্রোতের উপর দিয়েছেন।

মেহরাদ এইবার ঢাকায় এসে স্রোতের কাছে আবদার করে বসে বাবার সাথে সব ঠিক করে নিতে,যা হয়েছে ভুলে যেতে।স্রোত প্রথমে রাজি না হলেও মেহরাদের জোরাজোরিতে আবদার পূরণ করতে বাধ্য হয়।সে বুঝেছে,বাবা যতই বদমেজাজী হোক, মা-কে ভালোবাসতেন।কিন্তু প্রকাশ করতে পারেননি।সবাই ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারে না।

স্রোত গতকাল এই বাড়িতে চলে এসেছে।মেহরাদ ঐ বাড়িতে। তার কি বায়না!সে বউ ছাড়া থাকতে পারবে না।পাত্রের বড় ভাই হিসেবে তাকে আজকে সবার সাথে আসতে হবে।নাহয় কালই বউয়ের পেছন পেছন চলে আসতো।না আসলেও ঘন্টায় দুইবার করে কল করতে সে ভুলে নি।
স্রোত সকালে ঘুম থেকে উঠে একবার কথা বলে আর কল রিসিভ করে নি।কাজের সময়ও এই মানুষটার পাগলা মি।তার ভালোই লাগে।মাঝে মাঝে ভাবে এই মানুষটা জীবনে এসে কত তাড়াতাড়ি সবকিছু পরিবর্তন করে দিলো।ভাবতেই নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয় স্রোতের। জীবনে বিয়ে করবে না বলা মেয়েটাও এখন স্বামী বলতে অজ্ঞান।

কাজ শেষ করে সবাই সকালের খাবার খেতে বসেছে।স্রোতের মামা-মামী,বাবা,মান্ধবী সবাই উপস্থিত।তখনই ফোনটা নিজ ছন্দে বেজে উঠে।মেহরাদ কল করেছে।সবার নজর যায় স্রোতের দিকে।মান্ধবী মুচকি হেঁসে বললো,
“তাড়াতাড়ি ফোন ধরো।নাহয় এখনই বাসায় চলে আসবে।

সবার সামনে এমন বলায় স্রোত লজ্জা পায়।উপস্থিত সবাই জানে মেহরাদ স্রোতকে চোখে হারায়।স্রোত মান্ধবীর দিকে চোখ গরম করে তাকালে মান্ধবী হেঁসে খাবারে মনোযোগ দেয়।স্রোত কল রিসিভ করে না।কি লজ্জাটাই না পেলো সে।

তখনই মান্ধবীর ফোন বেজে উঠলে সবার নজর যায় ওর দিকে।সবাই ভাবে রায়হান কল দিয়েছে।কিন্তু সবার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দেয় মেহরাদ।স্রোতকে না পেয়ে মান্ধবীকে কল দিয়েছে।মান্ধবী হেঁসে সবার সামনেই ফোন রিসিভ করে।সালাম বিনিময় শেষে মেহরাদ জিজ্ঞাসা করে,
” তোমার বোন কোথায়?”
“এইতো আমার সামনে বসে খাচ্ছে।”বোনের দিকে তাকিয়ে বলে মান্ধবী।
“সে খাচ্ছে! আর এদিকে আমার শ্বাসবন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাকে চোখে হারিয়ে।তাড়াতাড়ি ফোনটা দাও তো আমার বউকে।”

মেহরাদের বাচ্চাদের মতো কথা শুনে উচ্চস্বরে হেঁসে ফেলে মান্ধবী।সবার সামনেই স্রোতকে ফোনটা দিয়ে দুষ্টুমি করে বলে,
“নে নে কথা বল।তোকে চোখে হারিয়ে নাকি শ্বাসবন্ধ হয়ে যাচ্ছে।”

স্রোতের কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হতে থাকে।সবার সামনে কি লজ্জা টাই না পেতে হচ্ছে।সে ফোন নিয়ে উঠে চলে যায় রুমে। কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“চব্বিশ ঘন্টাও হয়নি এসেছি মেহরাদ ।আপনি এখনই শুরু করে দিয়েছেন?”

মেহরাদ বাচ্চাদের মতো করে বললো,
“আমার ফুসফুস যদি তোমার অনুপস্থিতিতে প্রশ্বাস নিঃশ্বাস কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটায়, তাহলে আমার কি দোষ!দেখো তোমাকে শোনার পর থেকে কি সুন্দর শ্বাস নিতে পারছি।সব দোষ এই ব্যাটা বজ্জাত ফুসফুসের।”

স্রোত অবাক হলো না।সে এসব পাগ লামীতে অভ্যস্ত।চমৎকার হাসলো সে।তখনই ফোনের অপরপাশ থেকে মেহরাদের আর্তনাদ শুনতে পেলো।আঁতকে উঠে জিজ্ঞাসা করতে থাকলো,
“কি হয়েছে মেহরাদ!মেহরাদ!”
“বুকে ব্যাথা করছে।”

মেহরাদের আর্তনাদ শুনতেই ভয় পেয়ে যায় স্রোত।সে “আমি আসছি ” বলে ফোন কেটে দেয়।

মামিকে সব বলে স্রোত চলে যায়।

তড়িঘড়ি করে স্রোত বাসায় এসে পৌছায়।সে জানে বাসায় মেহরাদ শুধু একা।বনলতা বেগম রায়হানদের বাসায় চলে গেছেন।সারা রাস্তা স্রোত আতঙ্কে ছিলো।বাসায় এসে দেখে পুরো বাসা অন্ধকার করা।বাহির থেকে আবছা আলো আসছে।সে মেহরাদকে ডাকতে থাকে।কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ভয়েরা আরো বেশি করে ঘিরে ফেলে।সে আস্তে আস্তে নিজের ঘরের দিকে যায়।ঘর প্রবেশ করে দেখে এই ঘরটার দরজা-জানালা সব বন্ধ করা।মেহরাদের কোনো সাড়াশব্দ নেই।মেহরাদকে ডাকতে নিবে তখনই কেউ হেঁচকা টান দিলে স্রোত গিয়ে সুঠামদেহী পুরুষের বুকে ধাক্কা খায়।ওর মুখের উপর সেই পুরুষের গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে।এই স্পর্শ,এই নিঃশ্বাস,এই পারফিউমের ঘ্রাণ সব স্রোতের চেনা,খুবই চেনা,প্রিয়ও।
সে অস্থির হয়ে বলে,
“মেহরাদ ঠিক আছেন আপনি?কোথায় ব্যাথা হচ্ছে?”

স্রোতের কপালে পড়া চুলগুলোকে সরাতে সরাতে মেহরাদ বললো,
“ব্যাথা হচ্ছিলো।এখন তোমাকে পেয়ে ঠিক হয়ে গেছে।”
“মানে?আপনি মজা করছিলেন?”

শব্দ করে হেসে ফেললো মেহরাদ।স্রোত যা বুঝার বুঝে গেলো।ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো মেহরাদকে।রাগান্বিত স্বরে বললো,
“জানেন কতটা ভয় পেয়েছিলাম আমি?কলিজা শুকায় গেছিলো।একা বাসায় আপনি আছেন,কেউ সাহায্য করার নেই ভাবতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিলো।সব সময় মজা ভালো লাগে না।যাচ্ছি আমি।”

স্রোত চলে যেতে নিলেই মেহরাদ আটকে ফেললো।কানে হাত দিয়ে বললো,
“স্যরি বউ।আর এমন করবো না।কিন্তু তোমাকে অনেক মিস্ করছিলাম।আমার জন্য চিন্তা করলে তোমার চেহারায় যেই অস্থিরতা,ব্যাকূলতা দেখা যায় আমার ভালো লাগে।”

“সবসময় ফাজলামো আপনার।”কপট রাগ দেখালো স্রোত।

মেহরাদ বন্ধন আরেকটু দৃঢ় করে আদুরে স্বরে বললো,
“রাগ করে না বউ।আসো আদর করে দেই।”
“অ সভ্য পুরুষ মানুষ।” বলে মেহরাদকে জড়িয়ে ধরলো স্রোত।

দুই পরিবার সামনাসামনি বসে আছে।রায়হানের বাবা, মা, রিহানা,বনলতা বেগম এসেছেন।রায়হানের বাবা দেশের বাহিরে থাকেন।গত মাসেই দেশে ফিরেছেন।স্রোত-মেহরাদ পাশেই দাঁড়ানো।সবাই আলোচনা করছে।মান্ধবীকে রায়হানের বরাবর বসানো হয়েছে।রায়হানের দৃষ্টি যেনো সরছেই না।বেহায়ার মতো তাকিয়ে আছে মান্ধবীর দিকে।ব্যাপারটা মেহরাদ-স্রোত দু’জনই খেয়াল করলো।মেহরাদ রায়হানের দিকে ঝুঁকে কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
“ভাই দেখার আরো অনেক সময় পাবি।সারাজীবন পরে আছে দেখার জন্য।এখন নিজেকে সামলা।পরিবারের সবাই সামনে।”
মেহরাদের কথা শুনে রায়হান থতমত খেয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে।স্রোত ঠোঁট টিপে হাসছে।মেহরাদকে আস্তে আস্তে বললো,
“আপনার ভাই হিসেবে এমন করা স্বাভাবিক।”

মেহরাদ কটমট করে তাকালো স্রোতের দিকে।

আলোচনার এক পর্যায়ে স্রোতের বাবা বললেন,
“মান্ধবী তো এখনো ছোট।লেখাপড়া শেষ করে নাহয় বিয়ে হোক।”

রায়হান বিস্ময় দিকে তাকালো তার হবু শ্বশুরের দিকে।কেউ কিছু বলার আগেই সে তড়িঘড়ি করে বললো,
“না না আমি এতোবছর অপেক্ষা করতে পারবো না।পারলে বিয়েটা আজকেই হবে।আমি আমার বউ সাথে করে নিয়ে যাবো।”

উপস্থিত সবাই “হা” করে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।রায়হানের বাবা চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে।ছেলে তার থেকেও কয়েক কাঠি উপরে।নিজে তো শ্বশুরকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বিয়েতে রাজি করিয়েছিলেন।আর তার ছেলে কিনা সবার সামনেই এমন ঠোঁটকাটা কথা বলে ফেললো!জাহানারা বেগম,বনলতা বেগম হাসছেন।জাহানারা বেগম স্বামীকে ফিসফিস করে বললেন,
“দেখলে বাপের জেরক্স কপি।”

মান্ধবীর লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে।রায়হানকে ইতোমধ্যে “বেহায়া পুরুষমানুষ” নামে অ্যাখ্যায়িত করে ফেললো।
স্রোত মেহরাদকে বললো,
“আপনার বাড়ির সব পুরুষ মানুষই কি এমন ঠোঁটকাটা?”
“তা তো জানি না তবে শুনেছি বাবা পুরো দুই মাস নানাভাইয়ের পেছনে ঘুরে মাকে বিয়ের জন্য রাজি করিয়েছিলো।চাচ্চুও এমন করেছে।আমার ভবিষ্যৎ ছেলেটাও এমন করে বাপ-দাদার ঐতিহ্য বজায় রাখবে।”

অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো মেহরাদ।স্রোত বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে।সে তো মজা করে বলেছিলো।কিন্তু এটা সত্যি!

রায়হানের বাবা পরিবেশ পরিবর্তন করলেন।তিনি সিরাজ সাহেবকে বললেন,
“মান্ধবী আমাদের বাড়ি থেকেই লেখাপড়া করবে।স্রোত যেমন করছে।আপনি চিন্তা করবেন না।বিয়েটা কয়েকদিনের মধ্যে হয়ে গেলে ভালো হয়।আমাকে আবার সামনের উইকের ফিরে যেতে হবে।”

জাহানারা বেগম প্রস্তাব রাখলেন,
“ভাইজান বিয়েটা আজই হয়ে যাক।কাজী সাহেবকে ডেকে এনে বিয়ে পড়িয়ে দিলেই হবে।সন্ধ্যার পরে বিয়েটা হোক।কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই শুধু মান্ধবী বউ সাজুক।তাহলেই হবে।”

উপস্থিত সবাই এমন প্রস্তাবে অবাক হয়েছে তা সবার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।রায়হান মনে মনে মাকে কয়েকশবার “আই লাভ ইউ” বলে ফেলেছে।মান্ধবীর অবস্থা শোচনীয়।

সিরাজ সাহেব চিন্তিত ভাবে বললেন,
“স্রোতের বিয়েও ঘরোয়াভাবে হলো।এখন মান্ধবীর বিয়েও?আমার শখ ছিলো ধুমধাম করে মেয়েদের বিয়ে দিবো।”

বনলতা বেগম তখন মুখ খুললেন,
“ব্যাপার না ভাইজান।ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করে বিয়ে নাহয় দু’বোনকে আমরা পরে নিয়ে যাবো।এখন আপনি রাজি হয়ে যান।বিয়েটা আজকেই হোক।”

মায়ের কথা শুনে মেহরাদ স্রোতকে খুশী হয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“স্রোত,আরেকবার বিয়ে করবো!”
“তো?”
“তুমি বুঝতে পারছো না?আরেকবার বিয়ে, আরেকবার বাসর।আহা!”
স্রোত কটমট করে তাকালো মেহরাদের দিকে।মেহরাদ স্রোতের দৃষ্টিকে ভয় পেয়ে চোখ পিটপিট করে বললো,
“না মানে আমার জন্য তো প্রতিদিনই বাসর।”

মেহরাদের কথা শুনে স্রোত পাশ ফিরে হেঁসে ফেললো।

অবশেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে,বিয়েটা আজ সন্ধ্যায় হবে।বিয়ের পর মান্ধবী এখানেই থাকবে।প্রথম বর্ষের ফাইনাল শেষে বড় করে অনুষ্ঠান হবে।

#চলবে….