স্রোতস্বিনী পর্ব-৩৩ এবং শেষ পর্ব

0
142

#স্রোতস্বিনী
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
পর্ব ৩৩
শেষ পর্ব

মান্ধবী বউ সাজে বসে আছে বিছানায়।তার বিচ্ছু বাহিনী তাকে ঘিরে রেখেছে।তাদের আফসোসের শেষ নেই।এইতো বিকাল তিনটায় মান্ধবী গ্রুপ কলে জয়েন হয়ে জানায় সন্ধ্যায় আমার বিয়ে।সবাই ভেবেছিলো মান্ধবী প্র্যাঙ্ক করছে।তারা বিশ্বাসই করছিলো না।পরে মান্ধবী মামীর সাথে ওদের কথা বলিয়েছে,বাসার পরিবেশ দেখিয়েছে।তখন তারা বিশ্বাস করেছে।মজার ব্যাপার হলো,তখন দুইজন ঘুমাচ্ছিলো,একজন টিউশন পড়াচ্ছিলো,আরেকজন মায়ের সাথে শপিং এ গিয়েছিলো,আরেকজন বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে।অগত্যা সব ছেড়ে ছুঁড়ে কোনোমতে রেডি হয়ে সবাই মান্ধবীর বাসায় এসেছে।একেকজনের মুখশ্রীতে রাগ আর বিরক্তিতে ছেয়ে আছে।

নাহিদা তো বিরক্তিতে গিজগিজ করতে করতে বললো,
“কিরে তোদের বাড়ির সবাই কি হঠাৎ বিয়ের লগ্নে জন্মায়ছিস?স্রোত আপুর বিয়েতে তো তাও দুইদিন সময় পেয়েছিলাম!”

তানজি তো আরো বিরক্ত।সে বলে উঠলো,
“হ্যাঁ রে!কত শখ ছিলো সবাই মিলে ডান্স পারফর্ম করবো।সব আশায় জল ঢেলে দিলি।”

তিথি তৎক্ষনাৎ বললো,
“ভাই কোনোমতে ঘুম কাটিয়ে উঠেছি।মেকআপটাও করতে পারি নি ভালো করে।”

মহিমা তিথির সাথে তাল মেলালো।
“আমিও মেকআপ করতে পারি নি।আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের প্রথম কারো বিয়ে।কই একটু ব্যাচেলর পার্টি হবে,মেহেন্দি হবে,গায়ে হলুদ হবে!কিছুই হয় নি।টিউশন অর্ধেক পড়িয়ে চলে এসেছি।”

তামান্না বললো,
“আমি যে শপিং না করে আম্মুকে শপিংমলে ফেলে দিয়ে বাসায় চলে আসছি।তার বেলায়?”

তানজি আবার সেন্টি খেয়ে বললো,
“বফের সাথে একটু বেরিয়েছিলাম।বফকে রেখেই চলে এসেছি।”

সবার অভিযোগ শুনে মান্ধবী অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“আমি যে ব্রাইড, আমার যে বিয়ে আমার কোনো ইচ্ছা নাই, তাই না?”

নাহিদা তৎক্ষনাৎ বলে উঠলো,
“না বাবা তোর ইচ্ছে থাকার কথা না।জুটিয়েছিস তো একটা বেহায়া,ঠোঁটকাটা পুরুষ।যে দেখতে এসেই বিয়ে করতে চায়।”

সবাই উচ্চস্বরে হেঁসে ফেললো।মান্ধবী অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। সত্যিই তো সব দোষ ঐ মানুষটার।সব শখে এক বালতি, না না এক মহাসমুদ্র পরিমাণ পানি ঢেলে দিয়েছে।

তখনই জাহানারা বেগম, বনলতা বেগম, স্রোত রুমে প্রবেশ করলো।দুই জা মান্ধবীকে আদর করে বললেন,
“আমাদের বউমাকে তো খুব সুন্দর লাগছে।মাশাআল্লাহ।”

তখন স্রোত বলে উঠলো,
“ওওওওও!আমাকে বুঝি সুন্দর লাগছে না?আমি তো পুরোনো হয়ে গেছি!”

সবাই হেঁসে ফেললো।
জাহানারা বেগম আদুরে স্বরে বললেন,
“আমাদের বড় বউমা তো সবসময়ই সুন্দর। এর জন্যেই তো দেখা মাত্র নিয়ে গেছি আমাদের বাসায়।অপেক্ষা করি নি।”

বনলতা বেগম তাল মেলালেন তাতে।আরো বললেন,
“লাল শাড়ীতে আমার মেয়েকে একদম নতুন বউয়ের মতো লাগছে।ইচ্ছে করছে আমার মেয়ের আরেকবার বিয়ে দিয়ে দেই।”

স্রোত হেঁসে ফেললো।

রায়হান-মান্ধবী একসাথে বসা।কাজী সাহেব বিয়ে পড়াচ্ছেন।এক পর্যায়ে বিয়ে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলো।
একবছরের ঘৃণা,অপেক্ষা, ভালোবাসা,প্রণয় থেকে পরিণয়ে রূপ নিলো।

রায়হান ফিসফিসিয়ে বললো,
“এট লাস্ট তুমি আমার!”

মধ্যরাত।আকাশে আজ চাঁদ তার আধিপত্য খুব ভালোভাবেই বিস্তার করেছে।যতদূর চোখ যায় সব চাঁদের আলোয় স্পষ্ট, পরিষ্কার।চাঁদও হয়তো আজকে একটু বেশিই খুশী।তাই হয়তো নিজে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে নিজের সর্বোচ্চ আলোটা দিচ্ছে।

মান্ধবী বিছানায় বসে আছে।আজ নাকি বাসর!কিন্তু ফুল নেই।তবে সেটা কেউ খেয়াল করছে না।সে অপেক্ষা করছে সেই মানুষটার, যাকে দেখে সে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে প্রেমে ধপাস করে পড়েছিলো।তারপর প্রত্যাখ্যান,তারপর ঘৃণা,তারপর ভালোবাসা,তারপর পরিণয়।অপেক্ষা তার প্রেমিকপুরুষের।

রায়হান আসলো।বসলো মান্ধবীর পাশে।মান্ধবীর ডান গালে আলতো করে স্পর্শ করলো।মান্ধবী শিউরে উঠলো যেনো।
রায়হান বললো,
“এই জায়গাটায় একদিন মেরেছিলাম।তারজন্য আমি সারাজীবন অনুতপ্ত থাকবো।আজকে এখানে অনেকগুলা আদর দিয়ে দিবো।”

মান্ধবী স্মিত হেঁসে রায়হানের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে কাটা দাগটায় ইশারা করলো।রায়হান মাথা চুলকাতে চুলকাতে হাসলো।বললো,
“তুমি যেমন এই থাপ্পড়টা কখনো ভুলতে পারবে না,তেমন আমার অপরাধবোধও যাতে আমি কোনোদিন আমাকে না ছাড়ে, তাই এটা করা।এটা দেখলেই আমার মনে পড়বে আমি একদিন তোমার সাথে খুবই খারাপ আচরণ করেছিলাম। তাও সেদিন, যেদিন তুমি আমাকে প্রথম ভালোবাসি বলেছিলে।”

মান্ধবী রায়হানকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমরা এগুলা ভুলে যাই?সবটাই পরিস্থিতির চাপে।”

রায়হানও দৃঢ় বন্ধনে আটকে ফেললো প্রেয়সীকে।মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
“আমার প্রথম ভালোবাসা।”

মান্ধবী বলে উঠলো,
“আমার প্রথম প্রেম।”

তারপর তৃষ্ণার্ত একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকার অধীর অপেক্ষা শেষে সমীকরণ মিলে গেলো,সমীকরণ সিদ্ধ হলো।

স্রোত ছাঁদে রেলিং এর পাশে দাঁড়িয়ে আছে।আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদের হাসি দেখছে।একটু পর পর ঠান্ডা বাতাস তার শরীরে হিম করে দিচ্ছে।বাতাসে তার শাড়ির আঁচল উড়ছে।
ভাবছে আজ তার ছোটবোনটারও বিয়ে হয়ে গেলো। দুইজনের একবাসায় থাকার ইচ্ছে সারাজীবনই ছিলো।এখন এক প্রাসাদে না থাকলেও পাশাপাশি দুই প্রাসাদে দুই বোন রাণী হয়ে প্রবেশ করেছে।সে নিশ্চিন্ত বোনকে দুঃখ স্পর্শ করবে না।শ্বশুরবাড়ির মানুষকে এতো মাসে সে খুব ভালো করে চিনে ফেলেছে।

ভাবনার মাঝেই একজোড়া ঠান্ডা হাত আঁচল বেধ করে তার উদরে নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে নিলো।স্রোত প্রতিক্রিয়া দেখালো না,শুধু হাসলো।সে এই স্পর্শ চিনে।তার শরীরের প্রতিটা রন্ধ্র এই মানুষটার স্পর্শ চিনে।স্রোতও চায় এই মানুষটা সবসময় তার জন্য এমন পাগ লামী করুক,তাকে এমন ভালোবাসুক।সবকিছুর বিনিময়ে এই মানুষটাকে তার চাই।

স্রোতের কাঁধে নাক ঘষতে ঘষতে মেহরাদ বললো,
“আজকে লাল শাড়ীতে আমার বউকে অনেক সুন্দর লাগছিলো।ইচ্ছে করছিলো আজকে আরেকবার বিয়ে করে ফেলি।”
“আর কি ইচ্ছে করছিলো?”
“অনেককিছুই!কিন্তু বউ শুনলে রাগ করবে।”দুষ্টুমির স্বরে বললো মেহরাদ।

স্রোত এইকথা শুনে চমৎকার হাসলো।দৃষ্টি তার আকাশে,পিঠ মেহরাদের বুকে হেলান দেওয়া।
স্রোত জিজ্ঞাসা করলো,
” মেহরাদ!একটা আবদার করি?”
“অনেকগুলো করো।”
স্রোত হেঁসে বললো,
“আমাকে সবসময় এমন ভালোবাসবেন?
সবসময় এমন পাগ লামী করবেন?”
“আমৃত্যু।”
কাঁধে নাক ঘষতে ঘষতে গাঢ় কন্ঠে বলে মেহরাদ।

স্রোত বললো,
“আপনার পা গল করা ভালোবাসায় আমি আসক্ত।”
“আর আমি আমার স্রোতস্বিনীতে আসক্ত।”

তারপর অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বললো না।সময় চুপ,প্রকৃতি চুপ,তারা চুপ।এই যুগল যেনো এই পরিবেশটা অনুভব করতে ব্যস্ত।

মেহরাদ নিরবতা ভেঙ্গে ডাকলো স্রোতকে।

“স্রোতস্বিনী!”
“হুম?”
“আমি কি আপনার ভয় কাটাতে পেরেছি?আমি কি আমার কথা রাখতে সফল হয়েছি?”

প্রশ্ন শুনে চমৎকার হাসলো স্রোত।
বললো,
“হুম হুম,আপনি সফল।আর আপনার এই সফলতায় আমি কৃতজ্ঞ।”

মেহরাদ বন্ধন দৃঢ় করলো।বলতে শুরু করলো,

ওগো স্রোতস্বিনী, আমার প্রাণভোমরা,
আমার মনের আকাশের এক ফালি চাঁদ তুমি,
আমার আঁধারের আলো তুমি।
আমার মরুর মতো বুকের বৃষ্টি তুমি।
আমার খা খা হৃদয়ের এক পশলা বৃষ্টি তুমি।
আমার হৃদয়ারণ্যের একমাত্র স্রোতস্বিনী তুমি।
আমার রাত জাগা লাল চোখে এক সুন্দর ভোর তুমি।
তোমার ভালোবাসায় আমি সিক্ত।

ওগো স্রোতস্বিনী, আমার জীবনের সোনার কাঠি-রূপোর কাঠি,
তোমার স্নিগ্ধতায় পথ হারানো এক পথিক আমি।
তোমার স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া এক প্রেমিক পুরুষ আমি।
তোমার শান্ত চোখের মোহনায় দেখেছিলাম ভালোবাসা,
এনেছিলাম কাছে টেনে
আমার শূণ্য বুকে মাথা রেখে আমায় করেছো পরিপূর্ণ,
দিয়েছো আমার একপাক্ষিক প্রণয়ের পরিণয়।
আমি তোমাকে চাই স্রোতস্বিনী,
আমি তোমাকে ভালোবাসি স্রোতস্বিনী,
অনেক বেশিইইইই,
যার পরিমাণ পৃথিবীর কোনো পরিমাপকে পরিমাণ করা যাবে না,
যার পরিমাণ সমুদ্রের গভীরতার চেয়েও গভীর,
যার পরিমাণ খুঁজতে গিয়ে তুমি অতলে হারিয়ে যাবে,তবুও ঠাঁই পাবে না।
যার পরিমাণ ব্ল্যাকহোলের মতো,শুরু আছে শেষ জানা নেই,
হবে কি আমার বৃদ্ধ বয়সের সঙ্গী?
দেবে কি আমার সাথ শেষ নিঃশ্বাস অব্ধি?

উত্তরের অপেক্ষায় মেহরাদ স্রোতের দিকে চেয়ে আছে।স্রোত পেছনে ঘুরে মেহরাদের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলায়। চমৎকার হেঁসে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে সব দূরত্ব ঘুচিয়ে দিলো।মেহরাদের পায়ে ভর দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরলে, মেহরাদও নিজ স্রোতস্বিনীকে আগলে নেয়।স্রোত মেহরাদের কানে ফিসফিসিয়ে বলে,

“ভালোবেসে ফেলেছি তো,অনেকদিন আগেই,অনেক বেশিইইইইই,সাথ না দিলে যে আমারই মরণ।”

“সমাপ্ত”