সৎ মা পর্ব-০৮

0
212

#সৎ_মা (০৮)
#সামসুজ্জামান_সিফাত

বসে থাকতে থাকতে প্রায় ঘুমিয়ে ই গেলাম। হঠাৎ ট্রেনের শব্দে ঘুম কেটে গেল। আরেকটা পানির বোতল কিনে হাত মুখ ধুয়ে পানি খেয়ে নিলাম। আগে ই ট্রেনের টিকিট কিনেছিলাম। ট্রেন থামতেই ট্রেনে উঠে পড়লাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ই ট্রেন ছেড়ে দিল। শেষ বারের মত রাতের অন্ধকারে ই নিজের পরিচিত শহরের দিকে তাকিয়ে কয়েক ফোঁটা চোখের পানি ফেলে নিলাম। নিজের শহর আর আপন মানুষ গুলোর থেকে দূরে যেতে মন চাইছে না। কিন্তু কি আর করা ? মন না চাইলেও যে আমাকে আর এই শহরে থাকা যাবে না। এই শহরে থাকলেই তো মন চাইবে নিজের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। আর নিজের বাড়ি গেলে বাবা কি করে বসে তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। নিজের শহর আর আপন মানুষ সব কিছুর মায়া ত্যাগ করে এখন আমাকে জীবন যুদ্ধে নামতে হবে।

কোথায় যাবো ? কি করবো ? কীভাবে কি করবো ? এসব ভাবছি হঠাৎ আমার পাশে বসা এক বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করে উঠলেন,”কি বাবা, এই প্রথম আপন মানুষ গুলোর থেকে দূরে যাচ্ছো নাকি ?”
আমি মাথা নাড়িয়ে “হ্যাঁ” বললাম।
– এই জন্য ই তোমাকে এমন দেখাচ্ছে। কিছুদিন আপন মানুষ গুলোর থেকে দূরে থাকলে ই অভ্যাস হয়ে যাবে।
আমি কিছু বললাম না। ওনি আমাকে নীরব থাকতে দেখে বললেন,”মন খারাপ করো না বাবা, আমি ও ঠিক তোমার চেয়ে আরও কম বয়সেই শহরের বাহিরে পা রেখেছিলাম গিয়েছিলাম। তবে আমার ব্যাপার টা ছিল একটু ভিন্ন।”
ওনার মুখে ভিন্ন কথা টা শুনে আমার মন বলছিল, ওনার ভিন্ন কথার পেছনে অনেক কিছু লুকিয়ে আছে। তাই একটু আগ্রহ নিয়ে বললাম,”চাচা ভিন্ন বলতে কি বুঝালেন একটু খুলে বলতেন যদি।”
ওনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,”শুনবে তুমি ?”
– বলুন।
ওনি আমার দিকে ঘুরে বসে বলতে শুরু করলেন,”তখন সাল টা ছিল ১৯৭৭। মাত্র ১৫ বছর বয়সে পা রেখেছিলাম। আমি তখন দশম শ্রেনীতে উঠেছি কেবল। তখন আমার বাবা, মানুষের ক্ষেতে হাল চাষ করে সংসার চালাতো আর আমার লেখা পড়ার খরচ চালাতো। বাবার স্বপ্ন ছিল আমাকে বড় ডাক্তার বানাবে। আমি ও বাবার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে ই এগিয়ে চলছিলাম। হঠাৎ একদিন স্কুল থেকে বাড়ি গিয়ে দেখি, বাড়ি ভর্তি লোকজন। বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার শব্দ আসছিলো। লোকজনদের ঠেলে বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখি উঠোনে বাবার লাশ সামনে নিয়ে মা কান্না করছে।‌ আমি সেদিন কিছু ই বলতে পারিনি। যাইহোক বাবাকে দাফন করার ঠিক পনেরো দিন পর আমার মামা আর নানা মিলে মাকে আরেক জায়গায় বিয়ে দিয়ে দেয় কিন্তু মায়ের ওই স্বামী আমাকে মেনে নেয় নি। এমনকি নানা-নানী আমাকে ওদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। পরে বাড়ি আসলে দেখি মামা আমাদের বাড়ি দখলে নিয়ে নিয়েছে। দাদা-দাদি আর কাকা ও আমাকে বাড়ি জায়গা দেয়নি। ঠিক সেই দিন ই আমি বাড়ি ত্যাগ করে চলে আসি ঢাকা। তারপর প্রথম প্রথম কাগজ কুঁড়িয়ে খাবারের ব্যবস্থা করতাম। আস্তে আস্তে শহর টা চিলনাম এরপর ট্রাক থেকে চালের বস্তা আর চিনির বস্তা নামিয়ে টাকা রোজগার করতাম। কিছুদিন পর একটা স্কুলে ভর্তি হই। তখন আমার বয়স বেশি হয়ে গিয়েছিল বলে সবাই আমাকে অপমান করতো। স্যার রা ও ছাড় দিতেন না। কিন্তু আমি ওগুলো কানে নিতাম না। দিনের বেলা কাজ করতাম তারপর রাতে ল্যাম্প পোস্টের নিচে বসে পড়তাম। এখন আমি একজন নামি দামী ডাক্তার।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম,”আপনার বাবা মারা গিয়েছিল কীভাবে ?”
– বাবা মারা যায়নি।
– মানে!
– মানে হলো বাবা মারা যায়নি, বরং আমার মামা আর মা মিলে বাবার সাথে ছলনা করে বাবার সব সম্পত্তি মামার নামে নিয়ে মামা ই বাবাকে মেরে ফেলেছিলো।
– আপনার মামার শাস্তি হয়নি ?
– প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া কোনো বিচার ই হয় না আবার শাস্তি।

কথা বলার মধ্যে ই ট্রেন থেমে গেল। বৃদ্ধটি নেমে গেল। আমি ও নেমে পড়লাম। নেমে ত পড়েছি কিন্তু করবো কি এখানে ? স্টেশনে ই বসে রইলাম, কারণ আমার তো আর যাবার মত নির্দিষ্ট কোনো যায়গা নেই। বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোরে ফজরের আযানের শব্দে ঘুম ভাঙল। এখানে মসজিদ কোথায় আছে এইটা ও জানা নেই আমার। স্টেশনের পাশে একটা পাবলিক টয়লেট দেখতে পেলাম। ওটাতে গিয়ে কাজ সেরে নিলাম। পাশে ই কল ছিল। কল থেকে হাত মুখ ধুয়ে অযু করে রেল স্টেশনে ই একটা পরিষ্কার জায়গা খুঁজে নামাজ পড়ে নিলাম। তারপর বিসমিল্লাহ্ বলে কোনো একটা কাজের সন্ধানে বের হয়ে গেলাম।

হাঁটতে হাঁটতে একটা দোকানের সামনে চলে এলাম। দোকানের পিলারে দেখি একটা কাগজের মধ্যে লেখা দোকানের জন্য একটা কাজের ছেলে চাই। যেহেতু কাগজ টা এখনো টানানো আছে তারমানে কাজের ছেলে এখনো পায়নি। দেখি তাহলে এখানেই কাজ করতে পারি কি না। দোকানের মালিক এখনো আসেনি তাই আমি দোকানের পাশে বসে মালিকের আসার অপেক্ষা করতে লাগলাম।

প্রায় আটটার মতো বাজে দেখলাম পঁয়ত্রিশের মত বয়স হবে একজন এসে দোকান টা খুলছে। আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে ওনার কাছে আসলাম। আমাকে দেখে ওনি ই জিজ্ঞেস করলেন,”কিছু লাগবে নাকি ?”
আমি বললাম,”এই যে বাহিরে কাগজে লেখা কাজে ছেলে দরকার এটা কি এই দোকানের জন্য ই ?”
– হ্যাঁ। তুমি করবে নাকি ?
– হ্যাঁ করবো।
– আচ্ছা মালিক আসুক তারপর মালিকের সাথে কথা বলে দেখো।
– মালিক আসতে কতক্ষণ লাগবে ?
– এই ধরো ঘন্টা দেড়েক পর আসবে। আচ্ছা তুমি আমার আমার সাথে ভেতরে আসো দু’জনে মিলে কথা বলবো।
– ঠিক আছে।

এটা একটা মুদির দোকান। আমি ওনার সাথে দোকানের ভিতরে গিয়ে বসলাম। জনি আমায় জিজ্ঞেস করলেন,”তোমার নাম কি ?”
– সিফাত। আপনার নাম কি ?
– সাদ্দাম। লেখা পড়া করেছো কতটুকু ?
– অনার্সে পড়তাম।
– পড়তে মানে ? এখন পড়ো না কেন ?
– অনেক বড় কাহিনী ভাই পরে একসময় বলবনে।
– আচ্ছা ঠিক আছে বলিও। তোমার পরিবারে কে কে আছে ?
– কেউ নেই।
– এতিম নাকি ?
– আগে অর্ধেক এতিম ছিলাম কালকে একদম পুরো এতিম হয়ে গেছি।
– মানে বুঝলাম না।
– ছোট বেলায় মা মারা যায়, যেহেতু বাবা বেঁচে ছিল তাই অর্ধেক এতিম ছিলাম আর কালকে বাবা ও মারা যান তারপর হয়ে যাই পুরো এতিম।
– কীভাবে মারা গেছেন তোমার বাবা ?
– ওসব অনেক বড় কাহিনী বলবনে এক সময়।
– আচ্ছা। তোমার বাসা কোথায় ?
– নরসিংদী ছিল কিন্তু এখন কোনো বাসা বাড়ি নেই।
– তাহলে থাকো কোথায় ?
– রাতের ট্রেনে এসেছি এখানে আর আগে কখনো আসিনি তাই থাকার জায়গা নেই।‌
– ওহ্ আচ্ছা। তোমার তো তাহলে থাকার জায়গা প্রয়োজন।
– হ্যাঁ।
– আচ্ছা ঠিক আছে, মালিক আসুক আগে তোমাকে কাজ দিয়ে নিই তারপর না হয় থাকার জায়গার ব্যবস্থা করবো।
– ঠিক আছে।

দু’জনে বসে কথা বলছি আর ক্রেতা আসলে সাদ্দাম ভাইকে সাহায্য করছি‌। কিছুক্ষণ পর মালিক এলো। মালিক আমায় দেখে সাদ্দাম ভাইকে জিজ্ঞেস করল,”কি সাদ্দাম এটা আবার কে ?”
সাদ্দাম ভাই বললেন,”ওই যে ভাই কাজের ছেলে লাগবে বলে কাগজ টানিয়েছেন, ওটা দেখে সে কাজ করতে এসেছে।‌”
– ওহ্ আচ্ছা।
তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করল,”নাম কি তোমার ?”
– সিফাত ?
– পরিবারে কে কে আছে আর থাকো কোথায় ?
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সাদ্দাম ভাই ই বলল,”ভাই সে এতিম আর থাকার জায়গা নেই। আর ওর সাথে কথা বলে বুঝলাম কাজটা তার খুব দরকার। তাই বলছিলাম ওকে কাজ টা দিয়ে দিন।”
– ঠিক আছে তুমি যেহেতু বলছো তাহলে তাকে তুমি ই সব কিছু বুঝিয়ে দিও আর টাকার কথা ও বলে দিও।
– ঠিক আছে ভাই।
– আচ্ছা তাহলে তোমরা দুজন থাকো দোকানে আমি মোবাইলের দোকানে যাই।