সৎ মা পর্ব-১৭+১৮

0
303

#সৎ_মা
#পর্বঃ১৭
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

হঠাৎই কোনো কালো ছায়া দেখে ভয়ে আমার ভেতরটা কেঁপে উঠলো। একটু একটু ছায়াটা সামনে এগুতেই দেখলাম মা জ্বলন্ত এক মোমবাতি হাতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। মাকে দেখে যেন কলিজায় পানি আসলো। লম্বা শ্বাস ফেললাম আমি। নিস্তব্ধ নিরিবিলি পরিবেশে আচমকা দেয়ালঘড়ির ডংডং শব্দে আঁতকে উঠলাম। ঘড়ির কাঁটায় ঠিক বারোটা বাজছে। মা আমার কাছে এসে আলতো করে আমার কপালে চুমু আঁকলেন। আমার বা গালে হাত রেখে বললেন,

“শুভ জন্মদিন মা।”

অবাক হয়ে গেলাম আমি। আজ আমার জন্মদিন? মস্তিষ্ককে জোর দিতে লাগলাম জানার জন্য যে আজ কয় তারিখ। হুম আজ ১০ তারিখ আমার জন্মদিন। এই মানুষগুলো মনে রেখেছে সেটা? ভাবতেই কেমন কান্না পেয়ে গেলো। মা আমার মাথায় হাত রেখে আবারও বললেন,

“এই মোমবাতির আলো যেমন একটু একটু করে অন্ধকার দূরীভূত করেছে, দোয়া করি তেমন করে তুই আমাদের জীবনের সকল কষ্ট একটু একটু করে দূর করে দে। তুই যে মোমবাতির মতো প্রজ্জ্বলিত শিখা রে। মোমবাতি যেমন নিজে জ্বলে অন্যকে আলো দেয় তেমনি তুই নিজে দুঃখের সাগরে ভেসে অন্যকে সুখ দিস।”

মোমবাতিটা মা হাতে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। আরজা যে আমার পাশে নেই সেই কথাটা বেমালুম ভুলে গেলাম আমি। মনে পড়তেই বিছানা থেকে নামতে উদ্ধত হলাম আমি। ওমনি মা একটা বাটিতে পায়েস নিয়ে আসলেন। এক চামচ আমার মুখের সামনে তুলে ধরলেন। আমার চোখের পানি আজ বাঁধ ভেঙেছে। পায়েস মুখে নিয়ে বললাম,

“মা আরজা কই? ও তো আমার পাশেই ঘুমিয়ে ছিলো?”

মা আলতো হাতে আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,

“আরজার কথা তোকে চিন্তা করতে হবে না। আরজা আমার কাছে আছে। তুই ছাদে যা তোর জন্য সোলাইমান অপেক্ষা করছে।”

ন্যাকি গলায় বললাম,

“না আমি যাবো না। আপনার ছেলে এখন আমি ছাদ গেলে ছাদ থেকে ফেলে দিবে। যাতে যার সাথে গুটুর গুটুর করে তাকে বিয়ে করতে পারে।”

আমার কথা শুনে মা অট্ট হাসতে লাগলেন। হাসতে হাসতে বললেন,

“তুই আগে যাবি তো নাকি?”

“না যাবো না। আপনার ছেলে আগের থেকে খারাপ হয়ে গেছে। আমার সাথে ঠিকমতো কথা বলে না।”

কথার মাঝখানেই আমার মোবাইল বাজতে শুরু করলো। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি ইরফান ফোন করেছে। রিসিভ করে কানে ধরতেই ইরফান বললো,

“শুভ জন্মদিন আপু। মায়ের পরে আমার আরেক মা জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা।”

কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

“তোর মনে আছে আমার জন্মদিনের কথা?”

“তোর জন্মদিনের কথা আমি ভুলে যাবো? যে সৎ জেনেও কখনো সৎ ভাই মনে করেনি। নিরবে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করেছে।”

এরপর দু’জনেই নিরব।কেউ কোনো কথা বলছি না।
নিরবতার অবসান ঘটিয়ে ইরফান বললো,

“ছাদে যা আপু। ভাইয়া তোর জন্য অপেক্ষা করছে।”

মায়ের দিকে তাকালাম। মাও চোখের ইশারায় বললো ছাদে যাওয়ার জন্য।

____________________________________________

একটা একটা করে সিঁড়িতে পা দিচ্ছি আর আমার বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে। সিঁড়ি ঘরের দরজায় পা রাখতেই,

“ভালোবাসি ইনসিয়া”

ম্যাজিক্যাল এই শব্দটা শ্রবণ গ্রন্থিতে খুব জোরে সোরে ধাক্কা মা’র’লো।
শরীরে শীতল হাওয়া বয়ে গেলো আমার।নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। দেয়াল ঘেঁষে কোনোরকম দাঁড়ালাম। উনি আগের অবস্থানে দাঁড়িয়ে আবার বললেন,

“আমি আপনাকে একটু একটু করে ভালোবেসে ফেলেছি ইনসিয়া।মানুষ আবেগের বয়স পার করে যৌবনে পদার্পণ করলে তখন আর চেহেরার প্রেমে পড়ে না। ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়ে। ব্যবহারের প্রেমে পড়ে। চেহেরায় পরিবর্তন আসলেও মানুষের ব্যক্তিত্বে কোনো পরিবর্তন আসে না। আমি আপনার ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছি। আপনি বলেছিলেন না আগে আরজার মা হওয়ার চেষ্টা করবেন তারপর আমার স্ত্রী। আপনি আপনার চেষ্টায় সফল ইনসিয়া।”

উনার মুখ নিঃসৃত একের পর এক অকল্পনীয় কথা হজম করছি। কোনোরকম নিজেকে সামলে বললাম,

“বুঝলেন কি করে আমি এসেছি? অন্য কেউ তো হতে পারতো।”

উনি আমার দিকে ফিরে তাকালেন। আবছা আলোয় উনার দেহের আকৃতি বোঝা গেলেও মুখের প্রতিক্রিয়া আমার বোধগম্য হলো না। উনি বললেন,

“কারো কারো উপস্থিতি বোঝার তাকে চর্মচক্ষু দিয়ে দেখতে হয় না। সে কাছে আসলে এমনি অনুভব করা যায়।”

গুটি গুটি পায়ে উনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।

“তাহলে এতোদিনের এই অবহেলা এভয়েড কিসের জন্য ছিলো?”

উনি আমার কথা শুনে হাহু করে হাসতে লাগলেন। হাসি থামিয়ে বললেন,

“আপনার অভিমানের তীব্রতা দেখার জন্য।”

ভ্রু কুঁচকে বললাম,

“মানে?”

“মানেটা হলো আমার মনেও যেমন আপনার জন্য অনুভূতির অন্বেষণ হচ্ছে আপনার মনেও হচ্ছে কিনা তা জানার ক্ষুদ্র চেষ্টা। যদি দেখতাম যে আমার এসব ইগনোরেন্স আপনার মনে কোনো ভাবান্তর হচ্ছে না তাহলে আরো টাইম নিতাম। কিন্তু আমি তো দেখি বউ আমার দুইদিনে কেঁদে কেটে অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে। আবার আমার শার্টের কলার ধরে বলে আমি নাকি অন্য নারীতে আসক্ত। বিশ্বাস করুন আমার তখন হাসিও পাচ্ছিলো রাগও হচ্ছিলো। আচ্ছা আমাকে কি এমন মনে হয়? কখনো দেখেছেন আমি কারো সাথে ফ্লার্ট করেছি? ইনসিয়া আপনার আর আমার বিয়ের প্রথম শর্তই ছিলো আরজা। অন্যান্য স্বামী স্ত্রীর মতো সম্পর্ক না হয়ে যদি আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো তারপরও আমি অন্য নারীতে আসক্ত হতাম না। এমন একজন নারীকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার পরেও অন্য নারীতে আসক্ত হওয়া যায়? আমি যাকে ভালোবাসি সেও আমাকে ভালোবাসে এটাই সবচেয়ে আনন্দের। আমি সারাদিন ঘুমিয়েছি বলে ম্যাডাম বললেন কি? আমি নাকি সারারাত অন্য কোনো,,,,।”

“তো কি বলবো? সারারাত বাসায় আসলেন না।পরদিন বাসায় আসলেন এসে ঘুম। তারপর আমার সাথে কোনো কথা বলছেন। আমি কাছে গেলে এড়িয়ে গিয়েছেন।”

“ওহ তাই আপনি এতোকিছু ভেবে নিয়েছেন? সেদিন সারারাত আমি ছাদে ছিলাম। আর আপনারা সেদিন কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন কি কি খেয়েছেন সবই দেখেছি।”

ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললাম,

“সারারাত ছাদে মশার কামড় না খেয়ে মায়ের রুমে গেলেই পারতেন।”

“যেভাবে মায়ের রুমে দৌড়াদৌড়ি করেন সেখানে যাওয়া যায়?”

অতঃপর আমরা দু’জনেই নিরব। চাঁদের ঝলমলে আলোয় ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। দু’কদম এগিয়ে উনি আমার গাঁ ঘেঁষে দাঁড়ালেন। সামনের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“আপনার সাথে পরিচয়টা আমার স্বাভাবিকভাবে হলেও যেদিন আপনি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন, সেদিন ভেবেছিলাম আপনি আমার সাথে মজা করছেন নিছকই মজা। তারপর এতো কিছু করে হুট করে আমাদের বিয়ে সবটাই আমার কাছে স্বপ্ন মনে হয়। জানেন মাঝে মাঝে মনে হয় এতো সুখ আমার কপালে লিখা ছিলো বলেই হয়তো রিংকি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। রিংকি আজও আমার মনে আছে। তবে আমার অস্তিত্বে শুধু আপনার বিচরণ। আপনার কথা মনে হলে একরাশ ভালো লাগা অনুভব হয়। আর রিংকির কথা মনে পড়লে একরাশ ঘৃণা। রিংকির প্রতি আমার সকল অনুভূতি ওর কর্মকাণ্ডের জন্য ঘৃণায় পরিণত হয়েছে। মানুষ যা কিছু হারায় তার থেকেও বেশি কিছু পায়। হ্যা আমিও পেয়েছি।”

তারপর আমার হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে বললেন,

“এই হাত দুটো সারাজীবন ধরে রাখার অনুমতি দিবেন?”

উনার হাতের বন্ধনী থেকে আমার হাত দুটো ছাড়িয়ে নিলাম। উনি আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। উনার বুকের বাঁ পাশটায় মাথা রেখে বললাম,

“শুধু হাত ধরে রাখলে হবে না। এইখানটায়ও আমাকে আগলে রাখতে হবে। সারাজীবনের জন।”

উনি আলতো হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

“ইনশাআল্লাহ যতদিন বেঁচে আছি যত ঝড় ঝাপটাই আসুক না কেন আগলে রাখবো আমি।”

উনার বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছি। উনি বললেন,

“আজকের বাকি রাতটা আমার সাথে পিচঢালা রাস্তায় আমার হাতে হাত রেখে গন্তব্যহীন হাঁটবেন? আঁধার পেরিয়ে সূর্য উদয় হয়ে যেমন নতুন দিনের সূচনা হয় তেমনি আমরা সূর্য উদয় দেখে নতুন করে শুরু করলাম। আপনার জন্য একটা সাদা শাড়ি দুই মুঠ কাঁচের চুড়ি আর একটা বেলীফুলের মালা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে এসেছি।”

উনার বুক থেকে মাথা তুলে কোমড় জড়িয়ে ধরে বললাম,

“যথাআজ্ঞা মহারাজ। আচ্ছা এটা বলুন তো এতোদিনের এই নাটক সম্পর্কে মা জানতো?”

উনি একগাল হেঁসে জবাব দিলেন,

“সে আর বলতে? আপনার এই মন খারাপ আর শুকনো মুখ দেখে আমাকে কত বকেছে আপনার কোনো ধারণা আছে?”

“প্রথমদিন যে ফোন করায় আমার সাথে রাগারাগি করলেন। ওইদিন আপনার কাছে কল দেওয়ায় কল ওয়েটিং ছিলো কার সাথে কথা বলছিলেন?”

“ওরে বাপরে ম্যাডামের মনে আছে? সেদিন মাই কল দিয়েছিলো আরজা যে মা বলে ডেকেছে তা বলার জন্য। তখনই এই শয়তানি বুদ্ধি উদয় হয় আমার মাথায়”

দু’জন দু’জনের দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছি। উনি বললেন,

“আমি কিন্তু এখনো আমার জবাব পেলাম না।”

“কিসের জবাব জনাব?”

“ওই যে ভালোবাসি বললাম।”

“মেয়েরা মুখে কখনো ভালোবাসি বলে না। তাদের আচার-আচরণে বুঝে নিতে হয়।”

উনি আমার কপালের ছোট ছোট চুলগুলো সরিয়ে সেখানে উনার ঠোঁটের উষ্ণ পরশ দিয়ে বললেন,

“আপনার কপালে দেওয়া আমার দ্বিতীয় স্পর্শ এটা।”

আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,

“এতো কাছাকাছি তো আমরা আজই এসেছি। তাহলে?”

“আমি আপনাকে প্রথম স্পর্শ করেছি আপনার অনুমতি ছাড়াই আমাদের বিয়ের রাতে। আরজাকে খাওয়ানোর পরে আপনি যখন আমার রুমে এসে আরজাকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে গেলেন আমি তখনও সজাগ। পাশ ফিরে আপনাদের এমন দৃশ্য দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। টুক করে আপনার আর আরজার কপালে চুমু দিয়ে দিয়েছি। বিশ্বাস করুন আমার সেদিন মনে হয়েছিল এমনটা না করলে আমি অনেক কিছু মিস করবো। তাই আরকি,,,।”

উনার হাতের বেষ্টনী থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই উনি বললেন,

“আমি আপনার অনুমতি ব্যতীত আপনাকে স্পর্শ করেছি বলে রাগ করেছেন বুঝি?”

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

#সৎ_মা
#পর্বঃ১৮
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

আরজার বাবার এমন কথায় পা থেমে গেলো আমার। সিঁড়ির দিকে না গিয়ে উনার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালাম।পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে সামান্য উচু হয়ে আমার ঠোঁট ছুঁয়ালাম উনার কপালে। এক মুহূর্ত দেরি না করে দৌড় লাগালাম সিঁড়ি ঘরের দরজার দিকে। আবছা আলোয় উনার চেহেরা স্পষ্ট না হলেও এতটুকু বুঝেছি উনি ব্যপারটা ঠিক হজম করতে পারছে না। আহাম্মকের মতো একেবারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম,

“শোধবোধ মিস্টার সোলাইমান সাদিক। মিসেস সোলাইমান সাদিক তার ধার পরিশোধ করে দিয়েছে।”

____________________________________________

এলোমেলো শাড়ির কুঁচি ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। আরজার বাবা পাঞ্জাবির হাতা ফোল্ড করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বেশ বুঝতে পারছি। তখন ছাদের সেই ঘটনার জন্য চোখে চোখ মিলাতে পারছি না।

উনি আমার কাছে এগিয়ে এসে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। এবড়ো থেবড়ো কুঁচি গুলো ঠিক করতে করতে বললেন,

“মেয়ে মানুষ আসলেই অদ্ভুত। এরা ভাঙবে তবু মচকাবে না। শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে পারে না একবার বললেই হয়। না উনি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে লজ্জায় লাল নীল হচ্ছেন। আরে বাবা তুই কি পর পুরুষকে চুমু দিয়েছিস নাকি? নিজের বরকেই তো দিয়েছিস। এতে লজ্জা পাওয়ার কি আছে?”

উনার এমন লাগামহীন কথায় উনার পিঠে চাপড় মা’র’লা’ম আমি। শাড়ি ঠিক করে দিয়ে আমার হাতে রেমশি চুড়ি গুলো সযত্নে পড়িয়ে দিলেন উনি।

____________________________________________

সুনশান নিরিবিলি পরিবেশ। চারদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজমান। পিচঢালা রাস্তায় আমি আর আরজার বাবা হাঁটছি। গন্তব্য অজানা। মাঝে মাঝে গন্তব্যহীন হয়ে হাঁটতেও ভাল্লাগে। আজ পূর্ণিমা না হলেও আশেপাশের সবকিছু হালকা স্পষ্ট। মাঝে মাঝে দু একটা ট্রাক শাঁই শাঁই করে চলে যাচ্ছে। উনি হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ এগিয়ে গেলেন। আমি কোমড়ে হাত দিয়ে উনার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছি। আমার উপস্থিতি টের না পেয়ে ফিরে এলেন।
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

“আমার সাথে সাথে না হেঁটে আপনি এভাবে সং এর মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”

উনার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,

“আমাকে সাথে করে হাঁটতে বের হয়েছেন নিজে পাঁচ হাত সামনে আর আমি দশ হাত পিছনে হাঁটার জন্য? এতো দ্রুত হাঁটছে মনে হচ্ছে তাড়া আছে। হাঁটতে বের হয়েছে আস্তে ধীরে হাঁটবে। আশেপাশের নির্জন পরিবেশ উপভোগ করবে তা না।আনরোমান্টিক লোকটা।”

উনি আমাকে কপি করে কোমড় হাত দিয়ে বললেন,

“তাহলে কিভাবে হাঁটে ম্যাডাম?”

উনাকে বললাম,

“আপনার হাতটা দিন তো।”

উনি উনার হাতটা বাড়িয়ে দিতেই আমি উনার হাতটা জড়িয়ে ধরে বললাম,

“এভাবে হাঁটে স্যার।”

উনি আমার মাথায় চুমু দিয়ে বললেন,

“বেশ এবার তবে চলুন।”

দু’জন একসাথে তাল মিলিয়ে হাঁটছি। উনাকে শান্ত গলায় বললাম,

“জন্মদিনের উপহার হিসেবে কি দিবেন আরজার বাবা?”

“স্বয়ং আরজার বাবাই তো আপনার জন্মদিনের উপহার।”

আমি মুখ ভেঙচি দিয়ে বললাম,

“এ্যাহ্ এমন সেকেন্ড হ্যান্ড বুড়ো লোককে আমার জন্মদিনের গিফট হিসেবে চাই না।”

উনি গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,

“এই বুড়ো লোকটা দুইদিন এড়িয়ে থেকেছে বলেই তো নাকের জল চোখের জল একসাথে করেছেন।”

____________________________________________

একজন মায়ের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হলো তার সন্তানকে চোখের সামনে একটু একটু করে বড় হতে দেখা। এলোমেলো পায়ে সামনের দুটো দাঁত দেখিয়ে কিটকিটিয়ে হাসা সেই আরজা তিনবছর পেরিয়ে চার বছরে পা দিলো। দেখতে দেখতে কেমন বড় হয়ে গেলো আমার মেয়েটা। আমি জানি আরজাকে আমি জন্ম দেইনি কিন্তু আমি ওর মা। আমি ওর ভাগ কাউকে দিতে পারবো না। শুধুমাত্র ওর মা হবো বলে আমি অনেক কিছুর মুখোমুখি হয়েছি। পেট ধরেই যে মা হতে হয় এমন তো কোনো কথা নেই। কই ওর মা তো ওকে পেটে ধরেও মা হতে পারলো না।

আরজা এখন গোল গোল ফ্রক গায়ে দিয়ে সারা বাসা দৌড়ে বেড়ায়। মা আমার এটা লাগবে মা আমার ওটা লাগবে বলে পাগল করে দেয়। আরজার নজর আমার প্রসাধনীর দিকে। নিজে নিজে সেজে এসে বলবে,

“আম্মু দেকো আমি তোমাল মত কলে থেদেতি।”

বিকেলে দিকে আমি আর মা চা খেতে খেতে গল্প করছি। হঠাৎই মা শব্দ করে হাসতে শুরু করলো। মায়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতেই আমার চোখ ছানাবড়া। আমার সদ্য কিনে আনা পাউডার দিয়ে গোসল করে এসেছে আরজা। আর সারা মুখে লিপস্টিক তো আছেই। কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম,

“এসব কি করেছো মা?”

আরজা খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,

” আমি গুলতে দাবো তাই থেদেতি।”

“তা পাউডার কি আর রেখেছো নাকি সব শেষ করে ফেলেছো?”

চোখ মুখের ভঙ্গি দেখে বুঝলাম অবশিষ্ট আর কোনো পাউডার নেই। মা চায়ের কাপটা হাত থেকে রেখে বললেন,

“তা তোর মা হওয়ার শখ মিটেছে নাকি এখনো বাকি আছে?”

মাথা নেড়ে হ্যা বুঝালাম। মানে এখনো বাকি আছে। মা আরজাকে ইশারা করে বললেন,

“এটা এক পা’গ’ল।”

তারপর আমার দিকে ইশারা করে বললেন,

“এর মা আরো বড় পা’গ’ল। সব পা’গ’লে’র সাথে আমার বাস।”

____________________________________________

আরজার বাবা নিজের ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে বাসায় আসলেন রাত দশটার পর। দিনকে দিন উনার ব্যস্ততা যেন বেড়েই চলেছে। মা খেয়ে ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আরজাকে মাত্রই ঘুম পাড়ালাম। আরজার বাবা শার্টের বোতাম গুলো খুলছে। আমি লেবুর শরবত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। শার্টটা খুলে হাতে নিয়ে বলল,

“শুনলাম আজ নাকি আমার মেয়ে কার সদ্য কিনে আনা পাউডার দিয়ে গোসল করেছে?”

গাল ফুলিয়ে বললাম,

“আপনিও মজা নিচ্ছেন?”

উনি হাসতে হাসতে আমার হাত থেকে গ্লাসটা নিলেন। এক চুমুকে পুরোটা শরবত শেষ করে বলল,

“পরশুদিন রাতে কে যেন আমার বুকে মাথা রেখে আবার বাবুর জন্য আবদার করেছিলো?”

কোনো উত্তর দিলাম না আমি। উনি আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার কপালে উনার ঠোঁটের উষ্ণ পরশ দিয়ে বললেন,

“লেবুর শরবত অর্ধেক ক্লান্তি দূর করে। আর এই মানবীকে জড়িয়ে ধরে তার কপালে চুমু দিলে পুরো ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললেন,

“শোন আরজার আম্মু, আমি জানি এই সংসার আর আরজাকে সামলাতে গিয়ে তুমি হিমশিম খাও।আরজাই তো তোমাকে প্রচুর জ্বালায়। ও আরো একটু বড় হউক তখন আমরা বাচ্চার জন্য চেষ্টা করবো। আমাদের জন্য তুমি তোমার ক্যারিয়ার পর্যন্ত বাদ দিয়ে দিয়েছো। কিন্তু নিজের শরীরের দিকে তো নজর রাখবে নাকি?”

“হয়েছে হয়েছে আমাকে ছাড়ুন গাঁ থেকে ঘামের দুর্গন্ধ আসছে।”

আমাকে ছেড়ে দিয়ে উনি হাসতে হাসতে ওয়াশরুমে চলে গেলেন।

____________________________________________

দু’জনেই খাবার খাচ্ছি। ডালের বাটি থেকে এক চামচ ডাল নিয়ে উনি বললেন,

“তিনদিনের জন্য কক্সবাজার যাবো।”

“আমাদের নিয়ে?”

“না। একটা ডিল কনফার্ম করতে। তবে আমি ফ্যামিলি নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলাম। বস নিষেধ করলো। ভেজাল হয়ে যাবে নাকি।তবে ডিল কনফার্ম হলে নাকি আমাদের কয়েকজন কে উপহার হিসেবে ফ্যামিলি ট্রিপের ব্যবস্থা করে দিবেন।”

“তা যাচ্ছেন কবে?”

“এইতো কাল বিকেলে রওনা দিবো।”

“ওহ্ তাহলে তো এখনই গোছগাছ করতে হবে?”

উনি হাত ধুতে ধুতে জবাব দিলেন,

“এখন ঝামেলা করার দরকার নাই। কাল সকালে ঠান্ডা মাথায় গোছানো যাবে।”

উনার বাহুতে মাথা রেখে বুকে আঁকিবুঁকি করছি। মাথা তুলে উনাকে বললাম,

“তিনদিন আপনাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো আমি?”

উনি দুষ্টু হেসে জবাব দিলেন,

“আমাকে যখন এতোটাই মিস করবা তাহলে তো তিন রাতের আদর একরাতে করেই পুষিয়ে দিতে হয়।”

____________________________________________

পরদিন বিকেলে উনাকে বিদায় দেওয়ার জন্য দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। মায়ের কাছ থেকে উনি বিদায় নিয়ে চলে এসেছেন। উনি একহাত দিয়ে উনার বুকের সাথে আমাকে মিশিয়ে নিয়ে বললেন,

“দেখো আমি বাজার করে দিয়ে গিয়েছি। একদম বাসার বাহির হবে না।দিনকাল একদম ভালো না। আমি বাসায় না থাকলে তো তোমাদের শ্বাশুড়ি বউমার পাখা গজায়। কিছু একটা হয়ে গেলে কিন্তু কক্সবাজার থেকে আসতে পারবো না। রাস্তাটা কিন্তু দূরের।” বলেই সামনের দিকে পা বাড়ালেন।

দরজা আটকাতে যাবো দেখলাম উনি তড়িঘড়ি করে এদিকে আসছেন। উনাকে বললাম,

“কিছু ফেলে গিয়েছেন?”

আচমকা উনি আমার ঠোঁটে উনার উষ্ণ পরশ দিলেন। আর বললেন,

“আরে যেতে ফিল করলাম আমার চার্জ কমে যাচ্ছে। তাই ব্যাটারীফুল করতে এলাম। এখন একটু বল পাচ্ছি।”

কনুই দিয়ে উনার পেটে গুঁতো দিয়ে বললাম,

“যান তো।”

____________________________________________

উনি কক্সবাজার যাওয়ার একদিন একরাত পার হয়ে গিয়েছে। পরদিন রাতে আমি সবকিছু গোছগাছ করে শুয়েছি। খারাপ স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠলাম। ফুল স্পিডে পাখা ঘুরছে তারপরও সারা শরীর আমার ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছে। আরজার কপালে হাত রাখলাম। না তাপমাত্রা স্বাভাবিক। বিছানা ছেড়ে গুটি গুটি পায়ে মায়ের রুমে উঁকি দিতেই দেখলাম মা ঘুমোচ্ছে। বুকের ভেতরটা এখনো কেমন ধড়ফড় করছে। বালিশের নিচ থেকে মোবাইল নিয়ে ফোন দিলাম আরজার বাবাকে। মোবাইল বন্ধ বলছে। ভয়টা যেন জেঁকে বসলো। একের পর এক কল দিয়েই চলেছি।

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।