হক নিবাস পর্ব-১৩

0
236

#গল্প
#হক_নিবাস
#পর্ব_১৩
– শাতিল রাফিয়া
আমার বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। প্লাবনের জ্ঞান আসুক আর যাই হোক, তাকে আমি কখনোই মাফ করব না।ক্ষমা করব না আমার বাবাকে, আমার দাদীকে। আর আমার বাবার স্ত্রীকে! তার মানে মৌ আর মধু আপুর মাকে।
প্লাবনের কাছে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য সবাই তাড়াহুড়ো করছে। আর আমি একপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছি। আমি মানিক, আমার মূল্য কারো কাছেই নেই!

ফুপু হঠাৎই এগিয়ে এলেন।
আমাক জড়িয়ে ধরে বললেন, কাঁদিস না বাবা। আমি আছি তো! আর কেউ না থাকুক আমি আছি সোনা।

সমুদ্র ভাইয়া এসে আমাকে সরিয়ে নিলেন। আমি আর সমুদ্র ভাইয়া প্লাবন ভাইদের বাসায় যাচ্ছি। আমার আজ ভীষণ খারাপ লাগছে, কষ্ট হচ্ছে। কেন যেন নিজের বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না। আমাকে তো কেউ আদর করে না, কেউ ভালোবাসে না!

সমুদ্র ভাইয়া আমাকে ডাক দিল, মানিক!
আমি ধ্যান কেটে বললাম, হুমম…
– কী এত ভাবছ ভাইয়া?
আমি ধরা গলায় বললাম, কিছু না।
সমুদ্র ভাইয়া হাঁটতে হাঁটতে আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, মানিক! তোমার বয়স আমিও পার করে এসেছি। আর এই বয়সে তুমি এরকম একটা অন্ধকার সত্যের মুখোমুখি হয়েছ! তুমি অনেক সাহসী মানিক!
আমি ফুঁপিয়ে উঠে বললাম, আমাকে কেউ ভালোবাসে না!
আমার মাথায় হাত রেখে সমুদ্র ভাইয়া বলে, তোমাকে সবাই খুব ভালোবাসে মানিক। এই যে ছোট মামা জানতেন সব সত্যি কথা, তবুও কি তোমাকে কখনো বুঝতে দিয়েছেন? আমি, মৌ, মধু আমরা তো সব আগেই জেনেছি, আমরা কি এরপর তোমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছি? বা কোন কষ্ট দিয়েছি? এখানে তো তোমার কোনো দোষ নেই মানিক।
আমি হুট করে প্রশ্ন করলাম, আর মা?
– মানিক দেখো, তোমার মা জোহরা বেগম…
আমি ভাইয়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই বললাম, আমি তোমার বড় মামীর কথা বলছি!

সমুদ্র ভাইয়া হঠাৎই চুপ করে গেল।

এরপর বলল, মামী তোমাকে হয়তো কখনো ভালোবাসতে পারেননি! কিন্তু তোমাকে কিন্তু অত্যাচার বা অপমান করেননি, কোন কষ্ট দেননি। তিনি কিন্তু দায়িত্ব পালন করেছেন!
– কিন্তু মায়ের ভালোবাসা কি আমার প্রাপ্য ছিল না ভাইয়া?
– অবশ্যই ছিল। দেখো মামীর জায়গায় রেখে নিজেকে ভেবে দেখলে… এই কথাটা তুমি এখন বুঝবে না… কিন্তু একটা সময় হয়তো বুঝবে! তুমি অনেক বড় হবে মানিক একদিন।
আমি ডুকরে কেঁদে উঠে বললাম, আমি আর বড় হতে চাই না। আমি আর জটিলতা চাই না! আমি মরে যেতে চাই!
রাস্তার মধ্যেই আমাকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে সমুদ্র ভাইয়া বললেন, ছি! এসব কথা একদম বলবে না মানিক।
– আমি কার জন্য বাঁচবো ভাইয়া?
– তোমার বাবা নেই? কেন তোমার দুই আপু নেই? আমি নেই? তোমার ফুপু নেই? আমার মা কিন্তু আমার আর তোমার মধ্যে কখনো ভেদাভেদ করেননি, ভাইয়া। তুমি চাইলে এখন থেকে আমাদের সঙ্গেই থাকতে পারো।

আমি কিচ্ছুই বললাম না। অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই আমরা প্লাবনদের বাসায় পৌঁছে গেলাম। গিয়ে দেখি এনাম চাচা আর প্রতীক ভাইয়া এসেছেন। আমি প্লাবনকে আঘাত করার পরে তাদেরকে খবর দেওয়া হয়েছিল আমাদের-ই বাসা থেকে। তারা মাত্রই এসেছেন বোঝা যাচ্ছে। দরজা খুলছেন মাত্র।

আমাকে যেতে দেখে প্রতীক ভাইয়া জিজ্ঞেস করে, মানিক! কী শুনছি এসব? তুমি নাকী প্লাবনের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছ? কেন? কী করেছিল ও?
আমার পক্ষ থেকে সমুদ্র ভাইয়া জবাব দিল, করেছে তো অনেক কিছুই। কোনটা আগে শুনবে?

প্রতীক ভাইয়া অবাক হয়ে তাকাল! এনাম চাচা ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলেন লাগেজ নিয়ে ততক্ষণে। হঠাৎই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা না বললে মানিক প্লাবনের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে?

সমুদ্র ভাইয়া মাথা নাড়লো।

– তবে ভেতরে এত ধস্তাধস্তির চিহ্ন কেন?

সমুদ্র ভাইয়া চোখ কুঁচকে তাকায়।

এনাম চাচা দ্রুত এগিয়ে এসে সমুদ্র ভাইয়ার কলার চেপে ধরে তীব্র গলায় প্রশ্ন করলেন, এই! কী করেছ তোমরা আমার ছেলের সঙ্গে?

সমুদ্র ভাইয়া খুব স্বাভাবিক ভাবে নিজের কলার থেকে চাচার হাত সরিয়ে নিলেন। এরপর ভেতরে ঢুকে সব লক্ষ করলেন। আমিও ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরে ধস্তাধস্তির স্পষ্ট চিত্র দেখা যাচ্ছে। সোফার পিলো, গদি সব এলোমেলো। পানির গ্লাস ভাঙা, কাঁচ ছড়িয়ে আছে এখানে সেখানে। সেন্টার টেবিলটা উল্টে পড়ে আছে। সমুদ্র ভাইয়া সব পর্যবেক্ষণ করতে করতে বেডরুমে ঢুকে গেল।

চাচা কড়া গলায় বললেন, এই ছেলে! কোথায় যাচ্ছ তুমি? আর আমার প্লাবন কোথায়?

সমুদ্র ভাইয়া বেডরুমে ঢুকে কী যেন খুঁজতে লাগলেন। আলমারির দরজা টেনে দেখলেন সেটা লক করা।

চাচা অবাক হয়ে বললেন, এটার চাবি আমার কাছে থাকে। তুমি কী খুঁজছো বল তো!
দায়সারাভাব সমুদ্র ভাইয়া বলে, কিছু একটা!

এরপর খাটের সাইড টেবিলের ড্রয়ার টেনে সমুদ্র ভাইয়া চমকে ওঠে!
আমিও উঁকি দিলাম। একটা মোবাইল। এই মোবাইল আমি মজনুর হাতে বহুবার দেখেছি। তার মানে এটা মজনুর। সমুদ্র ভাইয়া একটা মানিব্যাগ বের করল।
সেটা খুলে দেখা গেল সেখানে মৌ আপুর একটা ছবি রাখা। তার নিচে মজনুর ছবি।

সমুদ্র ভাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, মজনু কাল এখান থেকে গায়েব হয়েছে। ওরা কিছু করেছে বলে মনে হচ্ছে। পুলিশকে জানাতে হবে। কিন্তু তার আগে…

প্রতীক ভাইয়া জিজ্ঞেস করে, কেউ আমাকে বলবে কী হচ্ছে এসব?
আমার দিকে আঙুল তুলে বললেন, পুলিশে তো এই ছেলেকে দেওয়া উচিৎ। আমার ভাইয়ের মাথা ফাটানোর জন্য।

সমুদ্র ভাইয়া আর কারো কথার পাত্তা না দিয়ে একটা ফোন করল।

এরপর বলল, হ্যাঁ মাধুরী? রাহাতের খোঁজ নিয়েছিলে?
ওপাশ থেকে আপুর উত্তর শুনে ভাইয়া বলে, ফোনে পাচ্ছ না? হুমম… আমি দেখছি।
আপু আবার কিছু বললে ভাইয়া বলে, পরে জানাচ্ছি।

ভাইয়া ফোন রেখে বলে, দু’য়ে দু’য়ে চার মিলে যাচ্ছে। পুলিশেই খবর দিতে হবে।

চাচা দড়াম করে টেবিলে বাড়ি মেরে চিৎকার করে বললেন, আর হেঁয়ালি করো না! আর নিতে পারছি না।
শান্ত গলায় সমুদ্র ভাইয়া বলে, সব বলছি। একটু ধৈর্য ধরুন মামা। আমি পুলিশস্টেশন থেকে আসছি।
– আবার পুলিশস্টেশন কেন?
– মামা আপনি হসপিটালে যান প্রতীককে নিয়ে। প্লাবনের জ্ঞান ফিরেছে। ওখানে সবকিছু বলার জন্য অনেকেই আছে। কিন্তু আমি আর মানিক এখন পুলিশের কাছে যাব।
প্রতীক ভাইয়া বিরক্ত হয়ে বলে, নাহ! পুলিশ আর পুলিশ করে যাচ্ছে কখন থেকে। কিন্তু কেন যাবেন আপনি পুলিশের কাছে?
থেমে থেমে সমুদ্র ভাইয়া জবাব দিল, তার কারণ তোমার গুণধর ভাই আর রাহাত মিলে মজনুর একটা ক্ষতি করে দিয়েছে বলে আমার মনে হচ্ছে। আর মজনুর এই ফোন, এই মানিব্যাগ আর এখানের এই ধস্তাধস্তির চিহ্ন তার প্রমাণ। এছাড়া মানিকও মজনুকে কালরাতে এখানেই দেখেছে। যাই হোক, আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। মানিক, এসো। আপনাদের সঙ্গে আমরা হসপিটালে দেখা করছি।
*

তিনঘণ্টা ধরে হাসপাতালে বসে আছি। প্লাবনের জ্ঞান ফিরলেও সে এখনো কোন কথা বলছে না। ডাক্তারও দেখা করতে দিচ্ছেন না। ইতিমধ্যেই এনাম চাচা আর প্রতীক ভাইয়া এসেছেন। তাদের সব খুলে বলা হয়েছে। চাচা সব শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। প্রতীক ভাইয়া হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে! মৌ আপু মানিককে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে যাচ্ছে। এই কান্না কি মজনু ভাইয়ের জন্য নাকী সমগ্র পরিস্থিতির জন্য সেটাও বোঝা যাচ্ছে না!

এমন সময় নার্স এসে বললেন, মানিক কে আছেন এখানে?

মানিক উঠে দাঁড়াল।

কাঁপা গলায় বলে, আমি।
– পেশেন্ট কথা বলছেন। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।
ধরা গলায় মানিক বলে, আ..আমি?
– হ্যাঁ। যান… আর পেশেন্ট উত্তেজিত হয় এমন কিছু বলবেন না।
মানিক হুট করেই আমার হাত ধরে বলল, মধু আপু… তুমি যাবে আমার সঙ্গে?
তার হাতটা শক্ত করে ধরে আমি বললাম, যাব।
এরপর নার্সকে প্রশ্ন করলাম, সিস্টার আমি যেতে পারি?
– ঠিক আছে। শুধু দুইজন যাবেন। আর কেউ না। আর উনাকে উত্তেজিত করবেন না।

আমি মাথা নেড়ে, মানিকের হাত ধরে প্লাবনের সাথে কথা বলার জন্য পা বাড়ালাম। কিছু প্রশ্নের উত্তর তো জানতেই হবে।

[চলবে]