হক নিবাস পর্ব-১৪

0
234

#গল্প
#হক_নিবাস
#পর্ব_১৪
– শাতিল রাফিয়া

আমরা ধীরে ধীরে প্লাবনের কেবিনে গেলাম। প্লাবনের সম্পূর্ণ মাথায় ব্যান্ডেজ করা। চোখ বন্ধ করে প্লাবন শুয়ে আছে। আমাদের পায়ের শব্দ পেয়ে সে চোখ মেলে তাকালো!
আমি আর মানিক গিয়ে তার বেডের পাশে দাঁড়ালাম। প্লাবনকে এভাবে দেখে মানিকের ঠোঁট কাঁপতে লাগলো! সে ফোঁপানো শুরু করলো।

প্লাবন শান্ত চোখে তাকিয়ে, শান্ত গলায় মানিককে জিজ্ঞেস করে, কেন এরকম করলি ভাই?

মানিক এবার জোরে কান্না শুরু করে।

সে কোন মতে বলল, তু… তুমি আমার বোনদেরকে অনেক কষ্ট দিচ্ছিলে। তাই… তাই রাগের মাথায়…

মানিক আবার ফোঁপাতে লাগলো।

প্লাবন আবার প্রশ্ন করে, সব সত্যি জেনে গিয়েছিস?
মানিক মাথা নেড়ে জবাব দিল, হুমম…
– গতকাল কি তুই ছিলি বারান্দায়?
– হ্যাঁ! তোমরা যখন বাইরে দেখতে এসেছিলে তখন পালিয়ে গিয়েছিলাম। এরপরেই চলে এসেছি।

প্লাবন তার স্যালাইন লাগানো হাতটা দিয়ে মানিকের হাত ধরার চেষ্টা করে। মানিক নিজেই প্লাবনের হাতটা তার হাতের মুঠোয় নিল।

মানিক ভেজা গলায় বলে, আমাকে তো তুমি অনেক ভালোবাসো, তাই না?

প্লাবন ম্লান হাসে!

মানিক বলে, আমাকে ক্ষমা করে দিও। তোমার এরকম অবস্থা আমি করতে চাইনি। রাগের মাথায়… আমি বুঝতে পারিনি… আ.. আমি…

মানিক কান্নার দমকে কথা বলতে পারল না।

আমি প্লাবনকে বললাম, তুই কেন এসব করতে গেলি প্লাবন? সত্যি কথাটা আমাদের জানাতে পারতি না? একবার আমাকে অন্তত বলতি?

প্লাবন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুপ করে রইল।

ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করে, আব্বু এসেছেন?
– এসেছেন। প্রতীক ভাইয়াও এসেছেন।
– উনাদের একবার আসতে বল।
আমি মানিককে বললাম, মানিক চল।

মানিক নড়লো না। সে প্লাবনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল। এমন সময় ডাক্তার আসলেন।

নার্স বললেন, আপনারা এখন যান। স্যার চেক করবেন।
আমি মানিককে ধরে বললাম, মানিক চল।

মানিক এবারে ধীরে ধীরে প্লাবনের হাত ছেড়ে দেয়।

বের হওয়ার আগে আমি হঠাৎ প্লাবনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মজনু ভাই কোথায়, প্লাবন?
প্লাবন ছোট করে জবাব দিল, জানি না।, বলেই সে অন্যদিকে তাকাল!
*

আমার অস্থির লাগছে। আমার ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে মজনুর চিন্তায়! না! আমি মজনুকে ভালোবাসিনি। সে-ও আমাকে প্রথমে ভালোবাসেনি। বিয়ে করেছিল প্রতিশোধ স্পৃহায়! কিন্তু এখন সে আমাকে ভালোবাসে! কী অবাক ব্যাপার! মজনু আমাকে ভালোবাসে! আর সে আমাকে এতটাই ভালোবাসে যে আমার জন্য সে নিজেকে বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে! আমার পরিবারের মানসম্মান বাঁচাতে সে প্লাবনের সাথে যুদ্ধ করেছে! আমি জানি না মজনু কোথায় আছে বা কেমন আছে! সে আদৌ বেঁচে আছে কি না! নাকী প্লাবন আর রাহাত তাকে মেরে ফেলেছে! এই কথাটা মনে হতেই আমার বুকের ভেতরটা কামড়ে ওঠে! আমি কি তবে মজনুর মায়ায় আটকে গেছি! তার ভালোমানুষি কি আমাকে আকৃষ্ট করছে!
বাসায় আসার কিছুক্ষণ পরেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি মজনুর বাসায় যাব। সে যদি ওখানে গিয়ে বসে থাকে? আমাকে যদি না জানায়? সে তো আমাকে একতরফা ভালোবেসে গেছে। সে এখন তার জীবন থেকে আমাকে মুক্তি দিতে চায়। তাও সেটা আমি চেয়েছি বলেই!
আমি ব্যাগ গোছালাম।

বের হওয়ার সময় দেখি সবাই চুপচাপ বসে আছে।

আমাকে সবার আগে ফুপু জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছিস মা?
আমি সংক্ষেপে উত্তর দিলাম, মজনুর বাসায়!

সবাই অবাক হল!

মা শান্ত গলায় প্রশ্ন করলেন, ওখানে কী দরকার?
– কোন দরকার নেই। ও যদি ওখানে আসে?
– আসলে কি আমরা জানব না?
– ও যদি আমাকে না জানায়?
বাবা চাপা গলায় বললেন, আমার বড় মেয়ে পাগল হয়ে গেছে! আরে মা রে! মজনুর কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া গেলে আমরা জানব।
– সেটা পরে দেখা যাবে। আমি যাব-ই।
মা বললেন, দাঁড়া মৌ! ওখানে একা একা তুই কী করবি? আর তুই তো এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি চেয়েছিলি। তুই তো চাপে পড়ে বিয়েটা করেছিলি। তবে এখন…
– সময় অনেক কিছুই পাল্টে দেয় মা।
বাবা বললেন, তার মানে ওকে পাওয়া গেলে তুই ওর সঙ্গেই থাকবি?
মা বললেন, তুই যদি ওকে ভালো না-ই বাসিস, তবে বাকী জীবন এভাবে ভালোবাসা ছাড়া পাড় করা যাবে?

আমার মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠলো!

আমি তীব্র গলায় বললাম, আর তুমি যে গোটা জীবন মনের মধ্যে রাগ আর ঘৃণা পুষে পাড় করে দিয়েছ? সেটা কিছু নয় মা? তুমি সেটা কীভাবে পারলে?

মা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন!

এবার আমি বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, আর আমি পাগল হয়ে গেলেও, তোমার মতো কারো জীবন নিয়ে খেলছি না! মজনু যেরকম-ই হোক, সে তোমার মত নয়। তোমাদের কারো মধ্যে কি কোন কৃতজ্ঞতাবোধ নেই? একটা মানুষ আমাদের ফ্যামিলির জন্য বিপদে পড়েছে, তার কী হয়েছে, সে কোন অবস্থায় আছে, সে বেঁচে আছে না মরে গেছে কিছুই আমরা জানি না! এই অবস্থায় তোমরা এসব আলোচনা কী করে করতে পারছ? বাবা তোমার মাঝে কি লজ্জা বা অনুশোচনার ছিটেফোঁটাও নেই?

বাবা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে ফেললেন।

সমুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, মৌ, আমি কোন এক্সপ্ল্যানেইশন চাচ্ছি না। তুমি মজনুকে ভালোবাসো আর না-ই বাসো, সেটা তোমাদের ব্যাপার। কিন্তু ওই বাসায় গিয়ে কোন লাভ হবে না। আমরা থানায় কথা বলে এসেছি। মজনুর খবর পাওয়া গেলে আমরাই আগে জানব।
মা এবারে তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করলেন, মৌসুমী তুই কি মজনুকে ভালোবেসে ফেলেছিস?

আমি চমকে উঠলাম!

এরপর কাঁপা গলায় বললাম, না!
মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তোর ‘না’-তে আমি কোন জোর পাচ্ছি না!
হঠাৎই ভেতর থেকে চাচীর চিৎকার ভেসে এলো। আমরা তড়িঘড়ি করে ছুটলাম। চাচী দাদীর ঘরে একপাশে দাঁড়িয়ে কাঁপছেন! আমাদের দেখে কোনভাবে ইশারা করলেন দাদীর দিকে।
দাদী নিথর হয়ে পড়ে আছেন। তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে গেছে। চাচী দাদীর খাবার দিতে এসে দেখেন এই অবস্থা!

সমুদ্র পালস চেক করে কাঁপা কণ্ঠে বলল, নানী আর নেই!

একটার পর একটা শোক আসছেই আমাদের এই ‘হক নিবাস’-এ। কার যেন নজর লেগেছে এই বাসায়! আসলে নজর নয়, অভিশাপ! কথায় আছে না ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না।’

দাদী মারা যাওয়ার পর আজ তিনদিন পাড় হয়েছে। বাবা এক কোণায় বসে কাঁদছে।

আমি বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

হঠাৎই বললাম, খুব কষ্ট লাগছে, তাই না বাবা?

বাবা মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন।

– একবার ভেবে দেখো তো বাবা মানিকের কেমন লেগেছিল? যখন ও জানতে পেরেছে তুমি-ই ওর মাকে মানসিক নিপীড়ন করে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছিলে?

মধু পাশ দিয়ে যাচ্ছিল।

সে আমার হাত টান দিয়ে বলে, চলে এসো আপু। উনার এসবে কিছু যায় আসে না!

চলে আসার সময় দেখলাম, বাবা ফ্যালফ্যাল করে আমাদের দুই বোনের দিকে তাকিয়ে আছেন!
*

চুপ করে বসে ছিলাম। হঠাৎই সমুদ্র ভাইয়ার ফোন পেলাম।

ধরার সাথে সাথেই ভাইয়া বলে, মধু! একটা ঠিকানা টেক্সট করছি। মৌ-কে নিয়ে তাড়াতাড়ি এখানে এসো। এক্ষুনি রওনা দেও।
আমি উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করলাম, কী হয়েছে ভাইয়া?
ভাইয়া বলে, মজনুর খোঁজ পাওয়া গেছে। রাহাতকেও ধরা হয়েছে। পুলিশের প্রশ্নের মুখে সে সব স্বীকার করেছে। সব খুলে বলেছে।

ফোনটা রেখে, ঠিকানাটা নিয়ে আপুর কাছে গেলাম। আপু ঘুমিয়ে ছিল। আপু এই ক’দিনে নিজের বেহাল দশা করেছে। তার চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে! তার চুল উষ্কখুষ্ক! আমার সুন্দরী আপুর চেহারা একেবারেই ভেঙে গেছে! আপুকে ডেকে তুলে সব খুলে বললাম।

আপু তড়িৎ গতিতে স্যান্ডেল পড়লো। আমার হাত ধরে বের হওয়ার আগে হঠাৎ আপু থমকে দাঁড়ালো।

আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে আবার আমার হাতে দিয়ে বলল, খোল এটা!
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? কী করবে?
আপু অসহিষ্ণু, উত্তপ্ত গলায় বলে, তাড়াতাড়ি মধু।

ফোন খুলে আপুর হাতে দিলাম।
আপু সমুদ্র ভাইয়াকে ফোন করল দেখলাম।

ফোন রিসিভ হওয়া মাত্র আপু হড়বড় করে জিজ্ঞেস করে, সমুদ্র! মজনু কি বেঁচে আছে? ও কি ভালো আছে?
আপু হঠাৎই হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, যে মানুষটা আমাদের পুরো পরিবারের জন্য সাফার করেছে, সে কি ভালো আছে?

[চলবে]