হক নিবাস পর্ব-১২

0
220

#গল্প
#হক_নিবাস
#পর্ব_১২
– শাতিল রাফিয়া

মানিক আপুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, তুমি আগে বল। মজনু ভাই তোমাকে কী এমন বলেছিল যে তুমি তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলে?

আপু কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ ছলছল করতে থাকে!

সমুদ্র ভাইয়া তার কাঁধে হাত রেখে ডাকল, মৌসুমী!

আপু চোখ মুছে বলল, মাধুরী আর রাহাতের ছবিগুলো দেখিয়েছিল। মাধুরী আর সমুদ্র যেই ডায়েরির পাতার কথা বলল, সেগুলোর ছবি পাঠিয়েছিল। ওইগুলো দেখেই আমি বুঝেছিলাম, মানিক মায়ের সন্তান নয়। দাদীকে কথাগুলো বলে চাপ দিতেই দাদীও স্বীকার করেছিলেন সব সত্যি।
সমুদ্র ভাইয়া প্রশ্ন করে, মজনু সেসব দেখিয়ে তোমায় ব্ল্যাকমেইল করেছিল মৌ?
আপু মাথা নেড়ে বলল, বলেছিল, ছবিগুলো নেটে ছেড়ে দিবে। আমাদের পরিবারের সব ইতিহাস এক্সপোজ করে দিবে।
আমি ঝাঁঝিয়ে উঠে বললাম, আর তাই পরিবারের মানসম্মান বাঁচাতে তুমি ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে বিয়ে করলে ওই ফালতুটাকে! একবার বলতে পারলে না আমাদের?
ম্লান হেসে আপু জবাব দেয়, তোর সম্মান যে জড়িয়ে ছিল মধু!
আমি মুখ বিকৃত করে জিজ্ঞেস করলাম, আর সে এইসব তথ্য কোথায় পেয়েছে?
– সেটা বলেনি। তবে আমি একজনকে সন্দেহ করেছি।
সমুদ্র ভাইয়া প্রশ্ন করে, আচ্ছা তোমাদের পরিবারের মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে তার কী লাভ?
– ও আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। আমাকে বিরক্ত করতো বলে একদিন রাস্তায় সবার সামনে চড় মেরেছিলাম!
মানিক এসব কথার পাত্তা না দিয়ে হুট করে জিজ্ঞেস করে, আর তুমি সন্দেহ কাকে করেছিলে?
– কী বলছিস?
– বললে না যে মজনুকে কে এসব জানিয়েছে, তুমি একজনকে সন্দেহ করেছ?
– হুমম… আ…
আপু কথা শেষ করার আগেই মানিক বলল, প্লাবন? সে কি প্লাবন?

আপু খুব ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল!

আমরা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম! তখন থেকে মানিক প্লাবনের দোষ দিয়ে যাচ্ছে। কেন এই সমস্ত কাজ প্লাবন করতে যাবে? সে তো জানেই না কিছু! আমরাই তো আজ জানলাম! আর সে তো আমাদের পরিবারেরই একজন!

আমি হড়বড় করে বলি, কী বলছিস আপু এসব? প্লা…
কঠিন কণ্ঠে জোর দিয়ে মানিক বলল, সন্দেহ ঠিক আছে। এই সবকিছুর পেছনে প্লাবন আছে!
আমি ধমকে উঠে বললাম, তুই তখন থেকে বলে যাচ্ছিস তুই কী সব শুনে এসেছিস! তখন থেকে প্লাবনকে দোষী বানিয়ে যাচ্ছিস! এমনকি ওকে মেরেও বসলি! ও কিছু জানে যে এইসব করবে? ও আমাদের কত আপন…
– কত আপন আপু? তার খালাকে কষ্ট দিয়ে তিলে তিলে মেরেছে যে পরিবার সেই পরিবার তার কতটা আপন হতে পারে বলে তুমি মনে কর?

আমি বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে রইলাম!

এরপর বললাম, তুই যে কারণগুলো বলছিস, ও তোকে বেশি আদর করে, তোর মন ভালো করে দেয়… এসব সে তোকে ভালোবাসে বলে করে। ছোট থেকে তোকে চোখের সামনে বড় হতে দেখেছে। বেচারা ইদানিং একা একা থাকে। তার কোন ছোটভাই নেই…
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমাকে বাঁধা দিয়ে মানিক বলল, বলেছিলাম না আমি লুকিয়ে তাদের কথা শুনেছি?
সমুদ্র ভাইয়া বলে, মানে প্লাবন সত্যিটা জানতো?
মানিক মাথা নেড়ে বলল, জানতো। অনেক আগে থেকেই জানতো! আর তাই সে আমাকে আগলে রাখতো! আর সে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল।
ফুপু বললেন, নাহ বাবা! কিছুই বুঝতে পারছি না।
মানিক বলে, প্লাবনদের বাসায় আমার মায়ের ডায়েরিটা ছিল। কয়েক বছর আগে সে আলমারির কোন একটা ড্রয়ারে এই ডায়েরি আবিষ্কার করে। ডায়েরিতে তোমরা যা যা পড়েছ তার সবকিছুই লেখা ছিল। শেষে আরেকটা পেইজ ছিল। সেই পেইজের লেখাটা প্লাবন পাঠায়নি।
আমি কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কী লেখা ছিল?
– লেখা ছিল, আমি তো পারলাম না। তবে আমি এই মানুষগুলোকে অভিশাপ দিয়ে গেলাম। এরা শাস্তি পাবেই। অন্য কেউ শাস্তি না দিলেও সৃষ্টিকর্তা এদের শাস্তি দিবেন-ই। এদের পাপের ফল, এদের কর্মের ফল এরা পাবেই।
– তাহলে রাহাত আর মজনুভাই এখানে জড়িত কেন?
– টাকার জন্য। রাহাত তোমাকে আসলে ভালোবাসেই না! ভালোবাসলে ক’টা টাকার লোভে কেউ এরকম করে? এনাম চাচা কয়েকদিন আগে প্লাবন ভাইয়ের সঙ্গে যৌথ একাউন্ট খুলেছেন। প্লাবন চাইলেই সেখান থেকে টাকা তুলতে পারে। চাকরির জন্য প্রতীক ভাইয়া আর চাচা দুইজনেই অন্য জায়গায় থাকে। প্রতীক ভাইয়া প্রতি বৃহস্পতিবার এসে শনিবারে চলে যায়। যে কোন প্রয়োজনে প্লাবন যেন টাকা তুলতে পারে, তাই এই ব্যবস্থা করেছিলেন চাচা। কিন্তু প্লাবন ভাইয়া এই সুবিধার অপব্যবহার করেছে। সে কয়েক বছর আগে থেকেই সত্যিটা জানে। এরপর সে প্ল্যান করেছে। সে গতরাতে বলেছিল, “সবটা জেনে আমি রাগে ফুঁসেছি! ইচ্ছে করছিল যেয়ে খুন করে আসি আহসান শফিক হককে! কিন্তু আমি করিনি। আমি প্ল্যান করেছি। আমি সময় নিয়েছি। সুযোগ খুঁজেছি আর সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছি। আহসান শফিক হকের কলিজার টুকরো তার দুই মেয়ে। তার দুই মেয়ের জীবন আমি বিষাক্ত করে দিতে চেয়েছি!”
মানিক বলে, তার হঠাৎই সুবর্ণ সুযোগ আসে। মজনু ভাইকে আপু থাপ্পড় মেরেছিল এটা সে জানতো। মজনুভাই এমনিতেই অপমানে জ্বলছিল। সে সেই আগুনে ঘি ঢেলেছে। সে মজনু ভাইকে আরও উস্কে দিয়েছে। বলেছে তার কথামতো কাজ করলে সে মজনু ভাইয়ের কবিতার বই ছাপিয়ে দেবে।
আপু মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, সেজন্যই মজনু প্রায়ই কবিতার বইয়ের কথা বলতো!
মানিক সম্মতি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, আর ওই রাহাত একটা থার্ড ক্লাস ছেলে। টাকার লোভে রাজি হয়েছে!
আমি জিজ্ঞেস করলাম, রাহাতের কথা ও কী করে জানলো? আমি তো আপুকেও বলিনি।
মাথা নেড়ে মানিক উত্তর দিল, সেটা আমি জানি না।
সমুদ্র ভাইয়া বলল, হ্যাঁ তারপর?
– তারপর আর কী? ও চেয়েছিল আমার মায়ের আত্মহত্যার প্রতিশোধ নিতে। সব সত্যিটা সবার সামনে তুলে ধরতে।
মা বললেন, ওহ! আমার মৌসুমীর জীবন তো ধ্বংস হয়েই গেছে! আর আরেকটু হলে মাধুরীর জীবনটাও যাচ্ছিল।
মানিক প্রতিত্তোরে বলে, তবে মজনু ভাই তার বাবা-মাকে হারিয়ে জীবনে অনেক বড় একটা ধাক্কা খেয়েছে।
আপু বলল, হ্যাঁ। আগের ছেলেমানুষি আর নেই! সে যেন আকাশ থেকে মাটিতে এসে পড়েছে!
– আর সেই ধাক্কাটাই তাকে বদলে দিয়েছে।
আপু বিড়বিড় করে যেন নিজেকেই বলল, আসলেই সে পাল্টে গেছে!
মানিক বলে, আপু মজনু ভাই তোমাকে ভালোবাসে।

আপু চোখ তুলে একবার মানিকের দিকে তাকাল। কিন্তু কোন উত্তর দিল না।

আমি ছ্যাঁৎ করে উঠলাম!
– ভালোবাসা না ছাই! কত দেখলাম এসব রঙ্গ!
শান্ত গলায় মানিক বলে, না আপু। মজনু ভাই মৌ আপুকে আসলেই ভালোবাসে। সে স্বীকার করেছে প্লাবনের কাছে। আর সে বলেছে সে গোপনেই আপুকে ভালোবেসে যাবে। কাউকে বলবে না। আপুকেও বলবে না। আর মজনু ভাই তোমার ছবিগুলো ভাইরাল করতে রাজি হয়নি বলে তার সাথে প্লাবনের গত রাতে প্রচন্ড কথা কাটাকাটি হয়েছে।

আমি আবার অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম!

আবার মাথা নেড়ে মানিক বলে, অথচ তোমার রাহাত কিন্তু ছবিগুলো ভাইরাল করতে চেয়েছিল। বলেছিল মজনু ভাইয়ের পরিবর্তে সে করে দেবে পেমেন্ট পেলে!

রাহাতের প্রতি ঘৃণায় আমি মুখ কুঁচকে ফেললাম।

– তারা আরো আগেই এসব করতো। কিন্তু মজনু ভাইয়ের বাবা-মা মারা যাওয়ায় মাঝখানে তারা কিছুদিন চুপ ছিল। এই আলোচনা করতেই মজনু আর রাহাতকে ডেকেছিল প্লাবন গতকাল। তার পরবর্তী প্ল্যান ছিল মধু আপুর ছবি ভাইরাল করা, আর সেটাও আবার মজনু ভাইকে দিয়ে। যাতে মৌ আপু আরো বেশি কষ্ট পায়! কিন্তু মজনু ভাই এসব করতে অসম্মতি জানিয়েছে। সে বলেছে সে আপুকে ভালোবেসে ফেলেছে। আর তার মা-বাবা চলে যাওয়ার পর সে উপলব্ধি করতে পেরেছে এসব ঠকবাজি করে বাঁচা যায় না! অনেক কথা কাটাকাটি হয়েছে। আমি সব শুনছিলাম। কিন্তু হঠাৎই পায়ের কাছ দিয়ে একটা বিড়াল যেতেই আমি চমকে উঠেছিলাম! নড়ে ওঠায় জানালাতে শব্দ হল। ওরা আসছে দেখেই আমি দৌড়ে পাশের ঝোপে লুকিয়ে পড়লাম। এরপর ওরা আবার ভেতরে যাওয়ার পর আমি বাসায় ফিরে এসেছি। এরপরে কী হয়েছে আমি জানি না!
মা বললেন, নিজের খালার জন্য মানুষ এতকিছু করে…
মানিক তীব্র গলায় বলে, যার সম্পর্কে বলছো উনি আমার মা হন!

মা আর কিছু বললেন না, চুপ করে গেলেন।

আপু হঠাৎই মানিককে প্রশ্ন করে, কাল তুই যতক্ষণ ছিলি মজনু কী ওদের সঙ্গেই ছিল?
– হ্যাঁ। কেন?
আপু উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে, মজনু গতকাল রাতে আমাকে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে সেই যে ফোন বন্ধ করেছে, ওকে আর ফোনে পাচ্ছি না! কিন্তু এটা কখনো হয় না! আমার সাথে কথা বলার জন্য সে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা কর! আবার তুই বলছিস ওদের ঝগড়া লেগেছিল!
– হ্যাঁ, অনেক কথা কাটাকাটি হয়েছে!
আপু বলল, আমার তো ভয় লাগছে! ওরা আবার মজনুকে কিছু করে দিল না তো?
সমুদ্র ভাইয়া বলে, মানিক, চলো আমরা প্লাবনের বাসায় গিয়ে মজনুর খোঁজ করি। কুইক! আর মধু তুমি রাহাতকে ফোন করো। কিচ্ছু বলবে না এসব। শুধু জানতে চেষ্টা করো সে কোথায় আছে।

এসময় বাবার ফোনটা হঠাৎ বেজে ওঠে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে চাচা জানালেন, প্লাবনের জ্ঞান ফিরেছে।

[চলবে]