হঠাৎ তুমি এলে পর্ব-০৩

0
612

#হঠাৎ_তুমি_এলে
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৩

কাছে যেতেই নিলয় ঘরের দরজাটা লাগিয়ে আমাকে চেপে ধরে বলল-

– ঐ ছেলের সাথে এত ঢলাঢলির কী আছে।ওর সাথে তোর কী শুনি?

নিলয়ের এরকম অস্বাভাবিক আচরণের কারণ গুলো আমার অজানা ছিল। আমি নিলয়কে বললাম-

– ও আমার চাচাত ভাই হয়। আমি নিজের ভাইয়ের মতো মনে করি। আর তুমি কী না তাকে নিয়ে আমাকে আজেবাজে কথা বলছো। কেন এমন করো তুমি? আমার সাথে এরকম করে কি আনন্দ পাচ্ছ?

আমার কথাগুলো শুনে নিলয়ের রাগটা আরও বেড়ে গেল আমাকে চেপে ধরে বলল-

– আমার কথা মতো থাকলে তোকে মাথায় করে রাখব। কিন্তু আমার অপছন্দের কাজ করলে একদম ভালো হবে না।

আমি এর জবাব কী দিব বুঝতে পারছিলাম না। শুধু মাথা নেড়ে গেলাম। বাবা মাকেও বিচার দিতে পারব না। কারণ সে মুখ তো আমার নাই। সবকিছু আমি নিজেই নষ্ট করে দিছি। কোনরকমে সারাটাদিন পরশের থেকে দূরে দূরে থেকে সবাইকে বিদায় দিলাম। বেশ অশান্তি হচ্ছিল ভিতরে। সেদিন রাতে চুপ হয়ে বিছানার এক কোণায় বসে রইলাম।শুধু একটা ভাবনায় ডুবে রইলাম। কী হবে আমার জীবনে? কী হতে চলেছে? হঠাৎ করে নিলয় রুমে ঢুকল। হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে। খাবারের প্লেট টা নিয়ে আমার কাছে এসে বলল-

– সারাদিন খেয়াল করলাম তেমন কিছু খাও নি।দুপুরেও অল্প ভাত নিয়ে এঁটো করে রেখেছ। এখন এগুলা সব শেষ করতে হবে।

“মেয়ে মানুষ হচ্ছে আবেগের মোম। সামান্য ভালোবাসায় গলে যায়।”

তেমনি নিলয়ের কথা শুনে আমি একদম গলে গেলাম। নিমিষেই আমার অভিমানটা বেড়ে গেল।আর বললাম-

– আমি খাব না। তুমি খেয়ে নাও।

নিলয় আমার কাছে এসে বলল-

– এত রাগ করতে হবে না। আমি কী ইচ্ছা করে তোমার সাথে এমন করি। তুলি আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমি তোমাকে হারাতে চাই না।তুমি কেন এটা বুঝতে চাও না বলো। তুমি মাঝে মাঝে আমার অপছন্দের কাজ গুলো করো তাই আমার রাগ বেড়ে যায়। আমাকে ক্ষমা করে দাও।

সেদিন নিলয়ের কথা শুনে মুহুর্তের মধ্যেই আবেগী হয়ে গেলাম।

“মেয়েরা খুব আবেগপ্রবণ। মেয়েদের আবেগের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে মায়া। এ মায়ার কারণে মেয়েরা আবেগের অতল তলে নিমজ্জিত হয়ে যায় আর বারবার নিজের মধ্যে থাকা অস্তিত্বকে বিলীন করে দেয়।”

আমিও নিজের স্বামীর এমন কথায় নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। নিলয়ের হাত দুটো ধরে বললাম-

– আমার শুধু একটাই অনুগ্রহ তুমি আমার সাথে হুট করে এমন ব্যবহার করো না যাতে আমার কষ্ট হয়।আমি এখন তোমার স্ত্রী হই চাইলেও অন্য কারও হওয়া সম্ভব না। বিয়েটা তো ছেলে খেলা না, করলাম আবার ছেড়ে দিলাম।

নিলয় আমার কথা শুনে তার কান ধরে বলল-

– আমার আর কখনও এমন হবে না। দেখে নিও।
কিন্তু কথায় আছে

“মানুষ অভ্যাসের দাস।অভ্যাস মানুষকে নীচে নামাতেও দ্বিধা করে না”

ঠিক তেমনি নিলয়ের মধ্যে একটা অভ্যাস ছিল আমাকে কারণে অকারণে সন্দেহ করা। কোন ঝামেলা হলেই প্রশ্নের তীর আমার দিকে ছুরে দেয়া।
সেদিন ডিশ লাইন ঠিক করতে লোক এসেছিল। সে সময় নিলয় বাথরূমে ছিল। যার দরুণ আমি দরজা খুলে দিয়েছিলাম। লোকটা এসে লাইন ঠিক করতে লাগল। নিলয় বাথরুম থেকে এসে লোকটাকে দেখে ক্ষেপে গেল। লোকটার সামনেই আমাকে দু এক ঘা প্রহার করল। লজ্জায় আমার এমন অবস্থা হয়েছিল যে তখন যদি মাটিটা ভাগ হত আর আমি ঢুকে যেতে পারতাম তাহলে হয়ত সবচেয়ে ভালো হত।
প্রহার করা আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং ডিশ লাইনের লোকটাকেও দুই এক ঘা বসিয়ে দিল।লোকটা তো পেটের দায়ে এসেছিল। কে জানত তার কাপলে এরকম অপবাদ জুটবে। এরপর থেকে বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে লাগল। আমার পরিবার যেন বাসায় আসতে না পারে সেজন্য বাসা বদল করে ফেলেছিল। আমার হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়েছিল। আমি তো এ ব্যাথা কাউকে বলে বুঝাতে পারছিলাম না। শারীরিক মানসিক দুইভাবেই নির্যাতিত হয়েছি। কি নির্মম ভাবে আঘাত করা হয়েছে আমাকে সেটা শুধু আমি জানি।

এভাবেই কেটে গেল পাঁচ মাস। একদিন মায়ের জন্য অনেক খারাপ লাগছিল। প্রতি মুহুর্তে মাকে মিস করতেছিলাম। মাকে কল দেওয়ার ও কোন উপায় পাচ্ছিলাম না। সারাদিন বাসার মধ্যে বন্দি করে কোথায় যে যেত উনি জানতাম না। আমি একা বন্দী পাখির মত ছটফট করতে থাকতাম। আমার যে অস্তিত্ব আছে আমি সেটাই ভুলে গিয়েছিলাম।
মায়ের কথা মনে হয়ে একটু কাঁদলেও আমার স্বমী মাঝ রাতে উঠে আমাকে পিটাত। ভাবত আমি কোনো প্রাক্তনের জন্য কাঁদছি। বুঝতেই পেরেছিলাম সে এক মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত । কিন্তু সেদিন রাতে একটু সাহস করে চুপি চুপি তার ফোনটা চুরি করে হাতে নিলাম। আস্তে করে বারান্দায় গেলাম। মাকে ফোন করার জন্য অর্ধেক নম্বর সবে মাত্র টাইপ করেছি ঠিক এ মুহুর্তে পিঠে এক অদ্ভূত জ্বলা অনুভব করলাম। নিমিষেই চেঁচিয়ে উঠে খেয়াল করলাম নিলয় আমার পিঠে জ্বলন্ত সিগারেটটা চেপে ধরে রেখেছে। আমি যন্ত্রণার চুটে ব্যাথায় কাঁতরাতে কাঁতরাতে বললাম-

– কী হয়েছে তুমি এভাবে আমার গায়ে সিগারেট ধরে রেখেছ কেন?

আমার কথা শুনে নিলয় তার চোখ রক্ত বর্ণ করে আমার চুলের মুঠিটা ধরে বলল-

– এত রাতে কোন ছেলেকে ফোন দিতেছিলি বল?
আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। এতটা হিংস্র হয়ে গিয়েছিল যে আমি ভয়ে মোচড়ে গেলাম।একদম চুপ হয়ে রইলাম। আমার নীরবতা দেখে নিলয় আরও ক্ষেপে গেল। ক্ষেপে গিয়ে চুলের মুঠিটা আরও জোরে শক্ত করে ধরে মেঝেতে আঁচড়ে ফেলল। তারপর একের পর এক কিল, ঘুষি, লাথি মারতে লাগল।
মারতে মারতে নিলয় হয়তো এক পর্যায়ে বেশ ক্লান্ত হয়ে গেল তাই আমার গায়ে হাত, পা তোলা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
সেদিন আমার সারা শরীর ব্যথায় টনটন করতে লাগল। মাথাটা মনে হচ্ছিল ব্যথার চুটে ভেঙ্গে ফেলি।সারাটা রাত ব্যথায় মোচড়াতে মোচড়াতে পার করলাম।
এভাবেই দিন মাস যেতে লাগল। বিয়ের পাঁচ মাস পর্যন্ত আমি শুধু জানতাম নিলয় আমাকে অতিরিক্ত ভালোবাসে এজন্য হয়তো সন্দেহ করে এমন করতেছে। কিন্তু সেদিন নিলয়ের দ্বিতীয় মুখোশটা আমার সামনে উন্মোচিত হয়ে যায়। আর ভাবলাম আমি এত বোকা কেন?
বরাবরের মত ঐ বাসায় আমার কোন স্বাধীনতা ছিল না। সারাদিন পরগাছার মত পড়ে থাকতাম।নিলয়ের কথার বাইরে গেলেই মাইর খেতাম।
পারছিলাম না কোনভাবে এ জীবন থেকে বের হতে আবার পারছিলাম না সহ্য করতে। স্বাধীনতা না থাকার দরুণ নিলয় ঠিক কি চাকুরি করে বিষয়টা সঠিকভাবে জানতাম না। সত্যি বলতে জানার কোন উপায় ছিল না। ফেসবুকে কথা বলার সময় বলেছিল একটা সরকারি চাকুরি করে। তবে বিয়ের পাঁচ মাস পর জানতে পারলাম নিলয় কোন চাকুরি করে না। সে ড্রাগসের ব্যবস্যা করে। আর এ কথাটা জানতে পারি নিলয়ের ড্রয়ারে ড্রাগসের প্যাকেট আর কোথায় কোথায় পাঠাতে হবে সেটার একটা তালিকা দেখে।
এ কথাটা জানার পর কেন জানি না আমি রাগটা ধরে রাখতে পারলাম না। ঐদিন নিলয় বাসায় আসার সাথে সাথে নিলয়কে বললাম-

– কী করে পারলে এত বড় মিথ্যা ধোঁকা দিতে? কী ক্ষতি করেছিলাম তোমার?

নিলয় চোখগুলো রক্তবর্ণ করে বলল-

– কী করেছি আমি? এভাবে চিল্লাচ্ছিস কেন?

আমি চেঁচাতে চেঁচাতে বললাম-

– চিল্লাব না তো আনন্দে নাচব। তুমি না সরকারি চাকুরি করো তাহলে এসব কী?

আমি ড্রাগসের প্যাকেট গুলো নিলয়ের দিকে ছুরে মারলাম। নিলয় তখন ড্রাগসের প্যাকেট গুলো দেখে আমার দিকে তেড়ে এসে আমার চুলগুলো ধরে বলল-

– তুই আমার অনুমতি ছাড়া আমার ড্রয়ারে ধরেছিস কেন? এত বড় সাহস তোকে কে দিয়েছে?

আমি চেঁচিয়ে বললাল-

– আমি তোমার স্ত্রী হই। তোমার ড্রয়ার ধরার জন্য আমাকে অনুমতি নিতে হবে কেন? আর আমাকে এভাবে বন্দি করে রেখেছ কেন? আমাকে আমার পরিবারের সাথে কথা বলতে দিচ্ছ না কেন? আমার মায়ের সাথে কথা বলতে চাই। আমি তো মানুষ। কতদিন এভাবে একা বন্দি পাখির মত থাকব বলো?

নিলয় আমার চুলগুলো আরও শক্ত করে ধরে বলল-

– তোকে এভাবেই পচিয়ে মারব।ফের যদি অনুমতি ছাড়া কিছু ধরেছিস খবর আছে তোর।

এ বলে রান্না ঘর থেকে খুন্তি গরম করে এনে আমার পিঠে লাগিয়ে দিল। আমি ওমাগো বলে চিল্লানি দিয়ে তখন বলেছিলাম-

– আমাকে ছেড়ে দাও। আমাকে এত কষ্ট কেন দিচ্ছ। এগুলা আমি সহ্য করতে পারছি না।

নিলয় খুন্তিটা আরও চেপে ধরে বলল-

– যদি আমার অনুমতি ছাড়া আমার ব্যপারে কিছু করতে চাস তাহলে তোকে এভাবেই শাস্তি দিব মনে রাখিস।

তারপর সে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। সেদিনের কথা মনে হলে এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। পিঠে হাত দিতে পারছিলাম না ব্যথায়। যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলাম। শুতেও পারছিলাম না ব্যাথায়।কি যে সময় পার করেছিলাম সেটা মনে হলে বুকের ভিতরটা এখনো কেঁপে উঠে।
এমন করে জীবনটা শেষ হয়ে যাবে বুঝতে পারি নি।এ জীবন থেকে বেরিয়ে আসতেও পারছিলাম না।কারণ আমার করার মতো কিছু ছিল না। হাত পা বাঁধা ছিল। আমার বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেলেও কিছুই বলতে পারতাম না। কারণ সেদিন আমার বলার মতো কোন বাকস্বাধীনতা ছিল না।
সেদিন নিলয় রাতে আবার বাসায় ফিরে। যতই হোক স্বামী তো এতকিছুর পরেও কেন জানি না তার প্রতি মায়া জন্মে গিয়েছিল। মেয়েরা তো মায়ের জাত তাই হয়ত মায়াটা বেশি কাজ করত। এত মায়া কাজ করাও যে জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ তা তখন টের পাই নি। নিলয় আসার সাথে সাথে আমি একদম স্বাভাবিকভাবে বসেছিলাম। খেয়াল করলাম নিলয় আমার রুমে না এসে পাশের রুমে চলে গেল। আমি পাশের রুমের দরজার কাছে গিয়ে দেখলাম দরজা লাগানো। দরজার এপাশ থেকে বুঝতে পারলাম কারও সাথে কথা বলছে সে।
দরজা নক করার সাহস ও হলো না। কারণ আমি জানতাম আমি দরজা নক করলেই আমাকে এসে পিটাবে। শরীরের ও একটা সহ্য ক্ষমতা থাকে যেটা আমি হারিয়ে ফেলতেছিলাম দিন দিন।
তাই ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। চোখটা যখন ঘুমে আচ্ছন্ন হল হালকা, তখন মনে হল কেউ একজন আমার হাতটা ধরে কিছু করছে। কিন্তু শরীরে শক্তি ছিল না আর পিঠের ব্যথায় এপাশ হতে পারছিলাম না তাই উঠতেও পারছিলাম না। কেন জানি না সে রাতে কড়া ঘুম হল । এত ভালো ঘুম কখনও হয় নি।তবে উঠার পর থেকে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কামড়ের দাগ পেলাম। শরীরে কামড়ের দাগগুলো দেখে বেশ ভয় পেতে লাগলাম। কীভাবে এগুলো হল ভাবতে লাগলাম। ভাবনার কোন কূল কিনারা পাচ্ছিলাম না। অপরদিকে পিঠের ব্যথা তো আছেই।
কাপড় চোপড় ও আমার এলোমেলো হয়ে আছে বিছানাও এলোমেলো হয়ে আছে। আমি এটা নিশ্চিত ছিলাম যে কেউ আমার সাথে নোংরা কাজ করেছে। আশে পাশে চোখ বুলাতে লাগলাম। হুট করে খেয়াল করলাম একটা সিরন্জ পড়ে আছে। আমি সিরিন্জটা হাতে নিয়ে বুঝতে পারলাম আমার সাথে কী হয়েছে আর কে করেছে। আর কেন আমার এত কড়া ঘুম হল।
কারণ সিরিন্জটা ছিল ঘুমের ঔষধের। আমি হালকা ঘুমের পর আমাকে এটা দেওয়া হয়েছিল। ঐ যে আমার মনে হয়েছিল কেউ একজন আমার হাত ধরে কিছু করছে তখন নিলয়েই ছিল সেটা আর আমাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছিল। এরপর আমার সাথে কুকর্ম করেছিল। এমনিতে তো আমাকে কাছে পেতে চাইলে চিল্লায়তাম। হয়তো তার আমার আর্তনাদ ভালো লাগত না। তাই নিজের জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য এমন করেছিল। তার উপর সেদিন আমার পিঠে ব্যথা ছিল। কতটা বিকৃত মস্তিষ্কের সে, আমি আরও ভালো করে বুঝে গেয়ছিলাম।
ঘঁড়ির কাটায় খেয়াল করে দেখলাম নয় টা বাজে। আর নিলয় বাথরুমে গোসল করছে। লক্ষ্য করে দেখলাম নিলয়ের ফোনটা বিছানায় রেখে গেছে। ফোনটা হাতে নিতে বেশ ভয় লাগছিল। বুকের ভিতরটা ধুক ধুক করছিল। হার্টবিটটাও যেন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি জোরে স্পন্দিত হচ্ছিল ভয়ে। এত জোরেই স্পন্দিত হচ্ছিল যে আমি নিজের হার্টবিটের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। তবুও আমি সাহস করে কাঁপা কাঁপা হাতে নিলয়ের ফোনটা হাতে নিলাম।

চলবে?