হঠাৎ তুমি এলে পর্ব-০৪

0
608

#হঠাৎ_তুমি_এলে
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৪

নিলয়ের ফোনটা হাতে নিয়ে প্রথমেই খেয়াল করলাম ফোনে কোন লক দেওয়া নেই। এর আগে মায়ের কাছে যেদিন ফোন দিয়েছিলাম এরপর থেকে ফোন লক করে রাখত। চাইলেও কাউকে কল দিতে পারতাম না। ভাবলাম মাকে কল দেই। যখন কল দিতে যাব ঠিক এ মুহুর্তে প্রাপ্তি নামের একটা মেয়ের মেসেজ মেসেন্জারে আসলো।আমি মেসেজটা ওপেন করে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আর যাইহোক এটা ভেবেছিলাম যে নিলয় আমাকে ছাড়া আর কোন মেয়ের সাথে কিছু করবে না।তবে সে বিশ্বাসটাও সেদিন উঠে গেল। প্রাপ্তি নামের মেয়েটা মেসেজ দিল-

– কী গো বাবুই তুমি কোথায় তোমাকে খুব মিস করছি। সেদিনের আদর এখনও ভুলতে পারছি না।

মেসেজটা দেখে মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল। আমি নিলয়কে এভাবে আবিষ্কার করব কখনও চিন্তা করে নি। মেসেন্জারটা চেক করতে থাকলাম। চেক করতে করতে দেখলাম মেসেন্জারে এরকম আট থেকে দশটা মেয়ে ছিল যাদের সাথে নিলয়ের প্রেম চলতেছে। হায়রে আমি কতটা বোকার রাজ্যে ছিলাম এখনো ভাবলে হাসি পাই। একের পর এক মেসেজ দেখতে লাগলাম আর বিস্মিত হতে লাগলাম। খেয়াল করলাম সবার সাথে একইরকম কথা একই রকম মেসেজ। সব মেয়েকে একইভাবে ফাঁদে ফেলতেছে। কারও কারও সাথে বন্ধুত্ব রেখেছে। কারও কারও সাথে দেখা করার তারিখ বরাদ্ধ করেছে। সেদিনের পর থেকে নিলয়ের প্রতি যে মায়াটা অবশিষ্ট ছিল সে মায়াটা চলে গিয়েছিল।নিলয়ের এমন প্রতরণা মেনে নিতে পারছিলাম না।
রাগে শরীরটা গিজ গিজ করতে লাগল। এতটা রাগ কখনো উঠেছে কি না মনে নেই।তবে সেদিনের সে রাগটা আমাকে আরও বেশি ধ্বংসের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। আমি সেই সময়টাই মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে নি।
নিলয় বাথরুম থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে আমি নিলয়ের দিকে তেড়ে গেলাম। নিলয় ও একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল আমার এরকম তেড়ে আসাতে। নিলয় কিছু বুঝে উঠার আগেই নিলয়ের দিকে তেড়ে গিয়ে মোবাইলটা আছার মেরে বললাম-

– এসব কী নিলয়? আমাকে তুমি এত কষ্ট দিয়েছ আমি কখনো তোমাকে কিছু বলে নি। মুখ বুজে সব সহ্য করেছি। বন্দি পাখির মত আটকে রেখেছ কিছু বলার সুযোগ দাও নি। তোমাকে কখনো আমি কিছু বলতে গেলেই ইচ্ছামত শারিরীক নির্যাতন করেছ।আমার সারা শরীরে তোমার আঘাতের চিন্হ ছাড়া কিছু নেই। বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে দাও না।বাবা, মা যেন আসতে না পারে তাই বাসা বদলে ফেলেছ। তাও আমি মেনে নিয়েছি। যেদিন জানতে পারি তোমার ড্রাগসের ব্যবস্যা আছে সেদিনও তোমাকে মেনে নিয়েছি। শত কষ্ট হলে ও আমি চুপ করে সব সহ্য করেছি। তবে এটুকু বিশ্বাস করেছিলাম যে তুমি আমাকে ছাড়া অন্য কোন মেয়ের সাথে কিছু করতে পারবে না। কিন্তু আজকে সে বিশ্বাসটাও ভেঙ্গে দিলে। একটা না, দুইটা না,দশ থেকে বারোটা মেয়ের সাথে তোমার চক্কর চলতেছে। কোনো স্ত্রী এসব মানবে বলো?
আমাকে রেহাই দাও নিলয়। আমাকে তুমি ডিভোর্স দিয়ে দাও। আমি বাবা, মায়ের কাছে চলে যাব।আমার পক্ষে এসব মানা সম্ভব না। জীবনে কী পাপ করেছিলাম আর তোমার মত মানুষের সাথে আমার পরিচয় হলো। ছয়টা মাসে আমি একটা মানসিক রোগী হয়ে গিয়েছি। শারিরীক মানসিক সবভাবে নির্যাতিত হচ্ছি। আর সহ্য করতে পারব না।

আরও কিছু বলতে নিব ঠিক এমন সময় আচমকা একটা লাথি আমার পেটের উপর পড়ল। আমি ছিটকে মাটিতে পড়ে গেলাম।এত জোরে লেগেছিল যে আমি ব্যাথায় বলে উঠলাম –

“আল্লাহ্ গো আমায় বাঁচাও। মা গো সহ্য করতে পারছি না।”

তখন নিলয় আমার কাছে এসে আমার মুখটা চেপে ধরে বলল-

– একদম চিল্লাবি না।চিল্লালে মুখটা ভেঙ্গে দিব।
সাহস কী করে হয় আমার ফোন ধরার। তোকে হাজার বার নিষেধ করেছি যে ফোন ধরবি না।তাহলে ফোন ধরলি কেন? আর তুই কি ভেবেছিস এসব বললে আমি তোকে ছেড়ে দেব? আর তোকে ছেড়ে দিলে তুই আমার নামে মামলা করবি তাই না? আমার ড্রাগসের ব্যবস্যার কথা ফাঁস করে দিবি।আমি কি তোর নাটক বুঝি না। আর আমার ফোন দিয়ে আমি যার সাথে ইচ্ছা কথা বলব তাতে তোর কি আসে যায়।

আমি ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে বললাম-

– আমি কিছুই করব না। কোন মামলা করব না।একদম মায়ের কাছে গিয়ে থাকব। তোমার এসব কথা কাউকে বলব না। আমাকে শুধু যেতে দাও। না যেতে দিলে মায়ের সাথে একটু কথা বলতে দাও। কতদিন যাবৎ মায়ের সাথে কথা বলি না। মাকে খুব মনে পড়ে।

এটা বলার পর নিলয় আমাকে আরও দুইটা লাথি দিয়ে বলল-

– তুই কী আমাকে বোকা পেয়েছিস? তোর মাকে আমি কল দেই আর তোর মা আমার নামে মামলা করুক তারপর পুলিশ আমার নম্বর ট্র্যাক করে আমার ঠিকানা জেনে যাক তাই না? আর তখন আমার সব কুকর্ম ফাঁস করে দিবি তাই তো?

কথায় আছে চোরের মন পুলিশ পুলিশ। আমি এরকম কিছুই ভাবি নি। আর নিলয় কত কিছু ভেবে বলে ফেলল। একে আর কি বলব আমি। পেটের ব্যাথায় তখন মোচড়ে যেতে লাগলাম। মাথাটা বেশ ঘুরতে লাগল। মনে হল ঘরটা উল্টে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ এর মধ্যেই আমি জ্ঞান হারালাম।
জ্ঞান ফিরার পর নিজেকে আবিষ্কার করলাম নতুন একটা রুমে। আমি বেশ অবাক হলাম এটা ভেবে যে একটা নতুন রুমের নতুন বিছানার উপর আমি শুয়ে আছি কীভাবে? চারপাশ তাকিয়ে দেখলাম, আর বুঝতে পারলাম সত্যিই রুমটা নতুন। কিন্তু আমি এ রুমে কিভাবে আসলাম ভেবে পাচ্ছিলাম না।
বিছানা থেকে নামতে নিলাম পেটে বেশ ব্যথা অণুভব করলাম পিঠেও অনেক ব্যাথা পেলাম।পিঠের ফুসকাটা গলে পানি পড়ছে। আর এজন্যই এত জ্বলছে । মাথায়ও অনেক ব্যথা হতে লাগল।
এর মধ্যে পেটের ব্যথাটাও প্রবল হতে লাগল। এ ব্যথা নিয়ে কোনরকমে উঠলাম।কিন্তু ভেবে পাচ্ছি না এ নতুন বাসায় আমি কি করে আসলাম । আর নিলয়েই বা কোথায় গেল সেটাও মাথায় আসছে না। এদিকে ক্ষুধায় আমার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছে।পেট ব্যথা নিয়ে পা হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে রন্না ঘরে গেলাম। কিছু ফল পেলাম। তা নিয়ে খেয়ে ফেললাম। কারণ এত ক্ষুধা লেগেছিল কী বলব।তারপর কাতরাতে কাতরাতে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম।
কয়টা বাজে তাও জানি না। খেয়াল করলাম এ রুমের সাথে বারান্দা আছে। বারান্দা দিয়ে হালকা আলো ঘরে পড়েছে। কোন রকমে বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় গেলাম একটু। আজকে অনেকদিন পর আকাশ দেখছি। আগের বাসায় থাকতে বারান্দায় যাওয়ার কোন ব্যবস্থা ছিল না। যে রুমের সাথে বারান্দা ছিল সে রুমটা সবসময় নিলয় তালা দিয়ে রাখত। আর আমার রুমের চারপাশে বিশাল বিশাল অট্টালিকা ছিল যার জন্য বাইরের কোন আলো প্রবেশ করত না। ছয় মাসে আকাশ দেখতে কেমন হয় ভুলে গিয়েছিলাম। আজকে আকাশটা দেখে মনটা বেশ শান্ত লাগছে। কতদিন এ আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদ, সূর্য দেখি নি। এ বন্দি জীবন থেকে কবে যে মুক্তি পাব জানি না।
ঠিক সে মুহুর্তে খেয়াল করলাম কিছু পাখি কিচিরমিচি করে উড়ে যাচ্ছে। আহ! কি শান্তিতে স্বাধীন ভাবে উড়ছে। আমি যদি একটু উড়তে পারতাম কত ভালোই না হত।কিন্তু আমার উড়ার ডানা দুটো যে আজকে ভেঙ্গে থুবরে পড়েছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নামল।বারান্দা থেকে যেতে ইচ্ছা করছে না তবে মাথাটা অনেক ঘুরাচ্ছে। তাই বেশিক্ষণ বারান্দায় থাকার ধৈর্য ছিল না।
যার দরুণ ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম নিলয় এসেছে।

চলবে