হঠাৎ তুমি এলে পর্ব-০৭

0
558

#হঠাৎ_তুমি_এলে
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৭

স্পর্শটা পেয়ে আমি খপ করে ঘুম থেকে উঠে বসে পড়লাম। খেয়াল করলাম নিলয় পাশে বসে আছে ।অহ! তার মানে নিলয় ছিল। নিলয় আমাকে এভাবে চমকে উঠতে দেখে বলল-

– কি ব্যাপার ভয় পেয়ে গেলে নাকি?

– হঠাৎ করে এভাবে স্পর্শ করেছ ভাবলাম কে না কে?

নিলয় অট্টহাসি দিয়ে বলল-

– বোকা মেয়ে এ বসায় আর কে আসবে?আমি, তুমি খালা ছাড়া এ বাসায় কেউ নেই। যাইহোক ঘুম কেমন হলো বলো।

আমি মুখে হাই তুলতে তুলতে বললাম-

– আজকে ঘুম অনেক ভালো হয়েছে।

– আর পিঠের ব্যাথাটা কমেছে তো।

আমি নিলয়ের দিকে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। এ নিলয় কী সে নিলয় যে নিলয় আমাকে দীর্ঘ ছয় মাস ধরে অত্যাচার করেছে নাকি এটা অন্য কোন নিলয়। আমার অপলক চাহুনি দেখে নিলয় একটা অপ্রস্তত কাশি দিয়ে বলল-

– কি ব্যপার এভাবে চেয়ে আছ যে, ব্যথাটা কমেছে কিনা জিজ্ঞেস করতেছিলাম।

-হ্যাঁ ব্যথাটা কমেছে।

নিলয় আমার পিঠের কাপড় টা আবার তুলে পুনরায় মলম লাগিয়ে দিল। এখন মলম লাগানোর সময়েও এত ব্যথা হলো না। ঔষধ টা খাওয়ার পর ব্যথাটা অনেক কমে গিয়েছিল।মলম লাগানোর শেষে নিলয় বলল-

– আজকে অনেক ঘুমিয়েছ। এবার উঠে একটু হাঁটাহাঁটি করো। না হয় শরীর বেশি দুর্বল লাগবে।

নিলয় যতবারই ভালোভাবে কথা বলছিল ততবারই নিলয়কে আমার বেশ অপরিচিত লাগছিল। তার উপর বাসা পরিবর্তন এর বিষয়টাও বেশ গোলমেলে লাগছিল। তবুও কিছু করার ছিল না কারণ যা হচ্ছিল তা জানার কোন উপায় ছিল না।নিলয়ের কথায় হালকা হাঁটাহাঁটি করে ড্রইং রুমে বসলাম।খালা আমার পাশে বসে বলল-

– কী গো মা এখন কেমন লাগছে?

– এখন অনেক ভালো লাগছে।

খালা হাসতে হাসতে বলল-

– শরীর ভালো হলে কিন্তু আমাকে সব কাজে সাহায্য করবে। আর নিলয় ও কিছুদিনের জন্য বাইরে থাকবে।বসায় শুধু তুমি আর আমি।

নিলয় বাইরে যাবে শুনেই একটা অজানা ভয় বুকে চিলিক দিয়ে উঠল। আমি নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম-

– তুমি কোথায় যাবে?

নিলয় আমার দিকে তাকিয়ে যখনই বলতে নিল আমি… ঠিক তখনই খালা নিলয়ের কথাটা কেড়ে নিয়ে বলল-

– নিলয় রিহ্যাবে যাবে। রিহ্যাবে গেলে নিলয় নেশাটা ছাড়তে পারবে। তাই নিলয় তিনমাসের জন্য রিহ্যাবে যাবে।

খালার মুখে এমন কথা শুনে সেদিন আমি কতটা খুশি হয়েছিলাম বুঝানোর ভাষা আমার নেই। কারণ আমার কাছে সবসময় মনে হত নিলয় নেশা করে বলেই নিলয়ের হিতাহিত জ্ঞান কাজে করে না। আর সেজন্য নিলয় আমার সাথে এমন করে। আর এখন নিলয় রিহ্যাবে গিয়ে কোনোরকমে নেশা ছাড়তে পারলে আমার সকল সমস্যা দূর হয়ে যাবে। বিয়েটা যে করেই হোক না কেন মেনে নিয়েছিলাম। এত কষ্ট দেওয়ার পরও আমি কেমন করে যেন নিলয়ের প্রতি দুর্বল হয়ে গিয়েছিলাম। সত্যি বলতে মেয়েরা কারও কাছে হাজার বার আঘাত পেলেও সামান্য ভালোবাসায় গলে যায়।

“মেয়েরা খুব মায়াবী হয়। তাদের ভালোবাসা জড়ানো মন বাচ্চাদের মত মায়া মাখা।তারা একটু ভালেবাসায় গলে টইটুম্বুর হয়ে যায়”

আবেগ জড়িত কন্ঠে নিলয়কে জাবাব দিলাম-

– এটা তো উত্তম সিদ্ধান্ত। তোমার যতদিন লাগে তুমি থেকে আসো। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।

নিলয় ভরসা দিয়ে বলল-

– সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি শুধু এ বাসায় খাবে ঘুমাবে আর খালার সাথে গল্প করবে। তিন মাস পরে আমরা নতুন ভাবে সংসার শুরু করব।

ঐদিন নিলয়ের এরকম কথা শুনে অনেক শান্তি লেগেছিল। আমি একটা পরম শান্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এমতাবস্থায় খালা বলল-

– আমি খাবার নিয়ে আসছি। সবাই একসাথে খাব।

এ বলে খালা রান্না ঘরের দিকে রওনা দিল। খানিক্ষণ পর খালা দুই হাতে দুইটা প্লেট নিয়ে আসলো। আমি খালার হাত থেকে দুইটা প্লেট নিয়ে টি টেবিলে রেখে জিজ্ঞেস করলাম-

– খালা এখানে নিয়ে আসলেন যে খাবার।

– ভাবলাম টেবিলে না বসে এখানে সবাই টেলিভিশন দেখতে দেখতে খাই। আচ্ছা দাঁড়াও আমি বাকি জিনিসপত্র গুলো নিয়ে আসি।

খালাকে আটকে দিয়ে বললাম-

– খালা আমি নিয়ে আসি আপনি বসেন।

খালা রাগ রাগ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল-

– তোমার শরীর ভালো না আর তুমি কাজ করবে?চুপ করে এখানে বসো। কাজ করার সময় তো চলে যায় নি।সামনে অনেক সময় আছে তখন কাজ করো। এখন নিজেকে একটু সময় দাও বিশ্রাম করো।

খালা এমন ভাবে বলল আমি একদম বাধ্য মেয়ের মতো বসে পড়লাম। তারপর খালা পুনরায় খাবার আনতে গেল। অতঃপর সব আনা শেষ হলে আমরা সবাই একসাথে খেতে বসি। সেদিন ছিল আমার বিয়ের পর কাটানো সবচেয়ে ভালো দিন। সেদিন খুব গল্প করে খাওয়া পর্ব শেষ করে যে যার রুমে গেলাম।
কিন্তু আমি রুমে যেতেই মাথাটা একটু ঘুরাতে লাগল।নিলয় আমাকে ধরে খাটে বসাল। তারপর হাতে এক গ্লাস দুধ ধরিয়ে দিয়ে বলল-

– এটা খেয়ে শেষ করো।

আমার তখন দুধ খেতে একদম ইচ্ছা করছিল না।অনেক গা গুলাচ্ছিল। আমি নিলয়কে নাক ছিটকাতে ছিটকাতে বললাম-

– আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।

নিলয় আমার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল-

– কালকে তো রিহ্যাব এ চলে যাব। তিনমাস আর কথা হবে না। দেখা হবে না। আজকে না হয় আমার হাতে দুধটা জোর করে খেলে। না হয় মন খারাপ লাগবে আমার।

নিলয়ের এহেম কথায় আমি পুনরায় গলে গেলাম। হাত থেকে দুধের গ্লাসটা নিয়ে চট করে খেয়ে ফেললাম।দুধটা খেয়ে নিলয়কে বললাম-

– আচ্ছা কথাও কি হবে না?

নিলয় মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল-

– কথা হবে। তবে খালার ফোনে কল দিব।তোমাকে আলাদা ফোন দিয়ে গেলে তুমি আবার তোমার মা,বাবাকে কল দিবে। এত অনিশ্চয়তার মধ্যে তোমাকে রেখে যেতে পারব না। খালার ফোনে কল দিলেই তোমার সাথে কথা হবে।

নিলয়ের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না তাই শান্তভাবে মেনে নিলাম। এদিকে আর কথা বলার কোনো শক্তি পাচ্ছিলাম না। ঘুমে চোখটা একদম বুজে যাচ্ছিল। ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে কথা বলতে বলতে ঘুমের রাজ্যে কখন যে পদার্পণ করেছি টের পাই নি।সকালে হালকা হালকা ঘুম নিয়ে চোখ মেলে দেখলাম বারান্দা দিয়ে আসা কড়া রোদ আমার মুখে পড়ছে। পাশে তাকালাম খেয়াল করলাম নিলয় পাশে নেই। ঘঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম এগারোটা বাজে।এগারোটা বাজতে দেখেই আমি খপ করে উঠে পড়লাম। এর মধ্যেই খালা রুমে এসে বলল-

– সেই কখন থেকে ডাকতেছি তুমি এত ঘুমিয়েছ যে টেরেই পাও নি। তোমাকে ঘুমাতে দেখে নিলয় তোমাকে না বলেই চলে গিয়েছে।

খালার কথা শুনে মনটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল।কারণ নিলয়কে শেষবার দেখতে পারলাম না।

আমি চুপ করে দম ধরে কিছুক্ষণ বসে থেকে খালাকে বললাম-

– কেন জানি এত ঘুম হলো বুঝতে পারছি না। আমার ইদানিং খুব ঘুম পায়।কি যে হলো আমার। নিলয়কেও এ ঘুমের জন্য শেষবার দেখতে পারলাম না।

– আরে কিচ্ছু হয় নি তোমার। নিলয় সুস্থ হয়ে তো ফিরে আসবেই, এরমধ্যে একটু ভালমন্দ খেয়ে শরীর স্বাস্থ্য ভালো করতে হবে। শরীর দুর্বল তাই এত ঘুম পাচ্ছে তোমার।

আমিও খালার কথায় বেশ ভরসা পেলাম।সেদিনের পর থেকে আমার জীবনটায় অন্য একটা মোড় নিল। খালার কাছে সব আদর পেয়েছিলাম। বিয়ের পর ঐ সময়টা ছিল আমার কাটানো সবচেয়ে ভালো সময়।
খালা আমাকে কোন কাজেই করতে দিত না। এক মাসে আমি বেশ বদলে গিয়েছিলাম। আমার শরীরের ওজন বাড়ল। আমার চেহারার রুপ খুলতে লাগল। শরীরে আগের থেকে বেশি শক্তিও পাচ্ছিলাম। তবে একটাই সমস্যা হত আমার রাতে কড়া ঘুম হত।খালার প্রতিদিন কাজেই ছিল আমার যত্ন নেওয়া।সারাদিন আমাকে এটা ওটা খেতে দিত। আর রাতে এক গ্লাস দুধ দিয়ে যেত। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও আমার খেতে হত। কারণ খালাকে নাকি নিলয় কড়া করে বলে গিয়েছে প্রতিরাতে যেন আমাকে দুধ দেয় খাওয়ার জন্য। তাই খালা নিলয়ের কথা রাখতে আমাকে রাতে এক গ্লাস দুধ দিতে ভুলত না। নিলয়ের সাথে মাঝে মাঝে খালার ফোন দিয়ে কথা হত।দেখতে দেখতে দুইটা মাস সুখেই কেটেছিল।কিন্তু হঠাৎ একদিন একটা ঘটনা আমার সামনে স্পষ্ট হয়। প্রতি রাতেই দুধ খেলেও সেদিন খালা দুধ দিয়ে যাওয়ার পর তেমন খেতে ইচ্ছা করল না। আমি দুধটা পাশে রেখে খালাকে বললাম-

– আমি খেয়ে নিব আপনি গিয়ে ঘুমিয়ে যান।

খালা তার রুমে যেতে যেতে বলল-

– মনে করে খেয়ে নিও। আমি এসে দেখে যাব কিন্তু।

এ বলে খালা পাশের রুমে চলে গেল। আমি দুধটা পাশে রেখে দরজাটা হালকা চাপিয়ে দুধটা বাথরুমে ফেলে দিলাম। কারণ খালা দুধের গ্লাস খালি না দেখলে জোর করে খাওয়াবে। আর এখন আমার মোটেও দুধ খেতে ইচ্ছে করছে না। তাই এ কাজ করতে বাধ্য হলাম।দুধের গ্লাসটা খালি করে বিছানার পাশেই রেখে দিলাম। আর আমি শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর খালা এসে বলল-

-কি গো বউমা দুধটা খেয়েছ।

আমি খালি গ্লাসটা খালাকে দিয়ে বললাম-

– এই যে খালা খেয়ে নিয়েছি। এখন ঘুম পাচ্ছে ঘুমাব।

-আচ্ছা ঘুমাও।

এ বলে খালা চলে গেল। আমি কিছুক্ষণ চোখ বুজে হালকা ঘুমিয়ে গেলাম। হঠাৎ বিড়বিড় আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙল। অন্ধকারে আওয়াজ টা কোথায় থেকে আসছে বুঝতে পারছিলাম না।তবে চুপটি মেরে আওয়াজটা শুনার চেষ্টা করছিলাম।খালা কাকে যেন বলছিল-

– তুই ঐখানে দাঁড়া আমি দেখে আসি মেয়েটা ঘুমিয়েছে কিনা।

এ বলে খালা আমার রুমে আসল।

চলবে।