হতে পারি বৃষ্টি পর্ব-২৮+২৯

0
659

#হতে_পারি_বৃষ্টি
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৮

মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। সূর্যটা মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। রিহার কলেজ মাত্রই ছুটি হলো। সে রাস্তার এক পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আশে পাশের কোনো দিকে খেয়াল নেই তার যেন কোনো গভীর চিন্তায় মগ্ন। হঠাৎ হাতে কারো ছোঁয়া পেয়ে থেমে গেল সে। পিছু ফিরে সে পরিপাটি সিফাতকে আবিষ্কার করল। মুখে তার হাসির রেখা। সে নিজের চোখ থেকে সানগ্লাস টা খুলে বলল —

— কোন ভাবনায় মগ্ন ছিলে পিচ্চি? কখন থেকে ডাকছি শুনতেই পাচ্ছ না।

রিহার হাত এখনও তার হাতের মুঠোয়। রিহা নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। কোনো কথা বলল না। পিচ্চি বলার পরও রিহার মৌনতা দেখে সিফাত অবাক হলো। ভ্রু কুঁচকে বলল–

— তোমার কি মন খারাপ? কি হয়েছে?

রিহা মুখ ঘুরিয়ে বলল–

— কিছু না।

বলে সে হাঁটা ধরল। সিফাত এগিয়ে গিয়ে পুনরায় তার হাত চেপে ধরল। কিঞ্চিত রাগ দেখিয়ে বলল–

— আশ্চর্য! এমন করছ কেন? আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি তো, এভাবে চলে যাচ্ছ কেন?

কয়দিন ধরে রিহার মেজাজ একদমই ভালো নেই। আর আপুর হঠাৎ বিয়ে হয়ে যাওয়া, কত ঝামেলা! তার ওপর আজ নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া করেছে। তাও আবার সিফাতকে নিয়ে। কলেজ যাবার সময় তারা সিফাতকে দেখেছিল। সে বাইকে করে কোথাও যাচ্ছিল। সিফাত অবশ্য রিহাকে দেখেনি। কলেজে গিয়ে তার বেস্ট ফ্রেন্ড বলেছে সিফাত নাকি খুব সুন্দর আর হ্যান্ডসাম। তাকে লাইন মারারও পরিকল্পনা করছিল। এই শুনে হুট করেই রিহার মাথা গরম হয়ে গেল। সিফাতের নামে এসব শুনে সে কেন রেগে গেল তা সে জানে না। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করেছে সে। কেন সিফাতের নামে ওসব বলল? যখন তার বেস্ট ফ্রেন্ড জিজ্ঞেস করেছিল যে সিফাতকে নিয়ে কথা বললে তার কি যায় আসে? রিহা তখন কিছু বলতে পারেনি। সে চুপ করে ছিল। কি বলত সে? সিফাত তার কে? কেউ না। তাহলে সে রেগে গেল কেন?

এই সব ঘটনা নিয়ে রিহার মন মেজাজ প্রচুর খারাপ। সিফাতকে এই মুহূর্তে তার সহ্য হচ্ছে না। অজানা এক অনুভূতিতে সে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। সে বুঝতে পারে না সিফাত আশে পাশে থাকলেই কেন তার হার্টবিট বেড়ে যায়? কেমন যেন অস্বস্তি হয়, সিফাতের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। এমনটা সেই বাচ্চাটার এক্সিডেন্টের পর থেকেই শুরু হয়েছে। সেই এক্সিডেন্টের পর সিফাতের সাথে তার অনেক বার দেখা হয়েছে। যতবার দেখা হয়েছে ততবার এমন অদ্ভুত অনুভূতির শিকার হয়েছে সে।
সিফাত পুনরায় বলল–

— কি হলো? কথা বলছ না কেন?

রিহা তার হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিল। সিফাত দিগুন অবাক হয়ে গেল। রিহা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল–

— এভাবে রাস্তা ঘাটে একটা মেয়ের হাত ধরতে লজ্জা করে না? কিছু বলি না বলে যা খুশি তাই করবেন? নিজের সীমানায় থাকুন। আর এভাবে আমার পেছনে পড়ে আছেন কেন? কি উদ্দেশ্য আপনার? কখনও যেন আমার পিছু আসবেন না। যদি আসেন তো আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।

সিফাতের যেন আজ অবাক হওয়ার দিন। রিহা তার সাথে এভাবে কেন কথা বলছে? সে কন্ঠস্বর নরম করে বলল–

— কি হয়েছে আমাকে বলো? তুমি এভাবে কথা বলছ কেন? রেগে আছো আমার ওপর? বলো কি করেছি আমি?

রিহা মুখ ঘুরিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল–

— আমি আপনাকে সহ্য করতে পারছি না। চলে যান আপনি। আর কখনও আমাকে আপনার মুখ দেখাবেন না।

বলে সে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল। আজ রিহা যদি শান্ত মস্তিষ্কে থাকত তাহলে হয়ত বুঝতে পারত কি ভুলটাই না সে করেছে!

সিফাত রিহার এমন আচরণে খুব কষ্ট পেল। সে ভেবেছিল আজ রিহাকে সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে যাবে এবং তাকে নিজের মনের কথা বলবে। বলবে যে সে একটা পিচ্চি কে ভালোবেসে ফেলেছে। কীভাবে সে জানে না। কিন্তু সে ভালোবাসে খুব ভালোবাসে। তা আর বলা হলো না, তার আগেই রিহা কথার বানে তাকে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়ে চলে গেল। সিফাতের বুক ভারি হয়ে এলো, চোখ প্রচন্ড জ্বলতে শুরু করল। সে তৎক্ষণাৎ গাড়ি নিয়ে অজানা গন্তব্যে ছুটে গেল।
——–

আজ মিমি নিশানকে পড়াতে এসেছে। কাইফ ও এসেছে। তবে বরাবরের মতই আলাদা। তাদের গন্তব্য এক হলেও তারা একসাথে যাতায়াত করে না, কাইফ নিজের মতো গাড়ি নিয়ে যায় আর মিমি যায় রিকশায়। ঈশানি কাইফের সামনের সোফায় বসে কাইফকে পর্যবেক্ষণ করছে। কাইফ মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করে যাচ্ছে। সে ঈশানির দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল–

— কি হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? কিছু বলার থাকলে বলে ফেল।

ঈশানি নড়েচড়ে বসে বলল–

— মিমি আর তোমার মধ্যে কি সব ঠিক আছে ভাইয়া?

কাইফ ভ্রু কুঁচকে বলল–

— আর তোর এমন প্রশ্নের কারন কি?

— আহা! বলো না ভাইয়া?

— হ্যাঁ সব ঠিক আছে।

— কেমন ঠিক তা তো দেখতেই পাচ্ছি। তুমিও তো এখানে এলে তাহলে মিমিকে তোমার সাথে করে আনলে না কেন? মিমি আলাদা রিকশায় করে এলো কেন?

কাইফ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। অতঃপর বলল–

— আমার কাজ ছিল। তাই আমি ওকে নিয়ে আসতে পারিনি। আর তুই এতো কথা না বলে যা আমার জন্য কফি নিয়ে আয়।

বলা বাহুল্য বিয়ের পর থেকেই অদ্ভুত ভাবে কাইফ মিমিকে আর আপনি করে বলতে পারে না। তার মুখ থেকে আপনাআপনি তুমি বের হয়। সে যখন প্রথম তুমি করে বলেছিল তখন মিমি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল। তা দেখে কাইফের খুব হাসি আসছিল। কিন্তু কাইফ হাসেনি। ঈশানি কিছু না বলে উঠে গেল। তার ভাই না বললেও সে বুঝতে পারে যে তাদের মধ্যে কিছুই ঠিক নেই। তারা নামে স্বামী স্ত্রী হলেও তাদের মধ্যে কোনো স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক নেই। একদিন না একদিন তো সব ঠিক হবে, ভেবেই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

মিমি গালে হাত দিয়ে বসে আছে। তার সামনে বসে নিশান অ আ লিখছে। নিশান অনেক কিছুই শিখেছে। আর তা শেখাতে যেয়ে মিমির বেগ পোহাতে হয়েছে। মিমি বসে বসে চিন্তা করছে, সে রোজ সোফাতে ঘুমায়। কিন্তু ঘুম থেকে যখন ওঠে তখন সে বিছানায় থাকে। বিছানায় থাকলেও নাহয় মানা যায়। তবে একেবারে কাইফের বুকের ওপর থাকলে সেটা কীভাবে মানা সম্ভব? ভাগ্যিস তার ঘুম কাইফের আগে ভাঙে। নাহলে সে কি লজ্জায় না পড়ত। কাইফের বাড়িতে আসার পর থেকেই তার ঘুমের মধ্যে হাঁটার অভ্যাস হয়েছে। ঘুমের মধ্যে কখন যে কাইফের বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে তা সে নিজেই জানে না। মিমি পারে না কেঁদে গড়াগড়ি দিতে। কাইফ যদি কোনো দিন দেখে ফেলে তাহলে কি ভাববে? তাকে তো ছেচড়া ভাববে। তার ভাবনার মাঝেই নিশান বলে উঠল–

— রসমালাই! এই দেখো আমার লেখা শেষ।

মিমি নিশানের খাতাটা হাতে নিল। দেখল নিশান বেশ ভালো লিখেছে। তবে অ এর জায়গায় ত আর আ এর জায়গায় অ লিখেছে ‌। মিমি তাকে ভালো করে দেখিয়ে দিল। অতঃপর মনের দুঃখে বলে উঠল–

— জানো নিশান? তোমার বড় মামা টা এক নম্বরের নির্দয় লোক। খুব পঁচা লোক একটা।

নিশান বরাবরের মতই কিছু বুঝল না। মিমি নিজের মতো বলতেই থাকল–

— আরে বাবা! একই বাড়িতে তো থাকি, একই অফিসে যাই। তাহলে আমাকে তার সাথে করে একটু নিয়ে যেতে কি হয়? আমাকে একটু ড্রপ করে দিলে তার কি মান ইজ্জত সব চলে যাবে? নাকি তার গাড়িতে বেশি প্রেট্রোল লাগবে? নিজে তো আরাম করে নিজের মতো চলে যাবে। রিকশা করে যেতে যেতে আমার দেরি হয়ে যাবে আর সে আনন্দের সাথে আমাকে ঝাড়ি দেবে। আমাকে ঝাড়ি দিতে তার এতো ভালো কেন লাগে? আমি বুঝি না। আদিল স্যারের সাথে কথা বললেও ঝাড়ি দেবে। মানে আমাকে সে পেয়েছে টা কি?

নিশান সব কিছু শুধু গিলল। মিমি আবারও বলল —

— বুঝলে নিশান? তোমার বড় মামা আস্ত একটা বাজে অসভ্য লোক।

নিজের মনের মধ্যে চেপে রাখা কথাগুলো সব বলে মিমির নিজেকে হালকা লাগল। সে এতো কথা নিজের মধ্যে চেপে রেখেছিল। কাকেই বা বলত? তানিয়াকে বললে সে ছোট মাকে জানিয়ে দিত আর সবাই জেনে যেত যে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। তাই সে এসব কথা কাউকে বলতে পারেনি, এমনকি নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড তানিয়াকেও না। হুট করে মিমি নিজের জ্ঞানে ফিরল। সে চোখ বড় বড় করে নিজের মুখ দুহাতে চেপে ধরল। সে কার সামনে কি বলে ফেলেছে? নিশান তো পেটের মধ্যে কিচ্ছু রাখবে না। এখন কি হবে? সে নিশান কে আটকাতে যেয়ে দেখে নিশান রুমে নেই। সে হাওয়া! মিমি ছুটে বাইরে গেল। যেয়ে দেখল সে বড্ড দেরি করে ফেলেছে। ইতোমধ্যে নিশান কাইফের কোলে বসে সুন্দর করে সব কথা বলে ফেলেছে। তাও আবার হুবহু, কোনো দাড়ি কমার ভুল হবে না। শেষে মিমি শুনতে পেল নিশান বলছে–

— তারপর রসমালাই কি বলেছে জানো? বলেছে নিশান! তোমার মামা আস্ত একটা বাজে অসভ্য লোক।

ব্যস কাইফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলল এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা মিমির ওপর। মিমি ভয়ে কাচুমাচু হয়ে নিশানের দিকে ছলছল নয়নে হাসি মাখা বদনে তাকাল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল ‘মনে কথা চেপে রেখে পটল তুললেও, তোর সামনে আর কিছু বলব না বাপ! তুই আমারে কদিনে যে বাঁশ গুলো দিলি এমন বাঁশ আমি আমার সারা জীবনে খাইনি।’

চলবে?

#হতে_পারি_বৃষ্টি
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৯

পিনপতন নীরবতা। শুধুমাত্র নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কাইফ গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে আছে মিমির দিকে। আর মিমি এক পাশে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নিচু তার, কাইফের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলাবার ক্ষমতা তার নেই। তারা বর্তমানে তাদের রুম অর্থাৎ কাইফের রুমে অবস্থান করছে। বাইরে থেকে এখনও ফ্রেশ হওয়াও হয়নি। ঈশানির ফ্লাট থেকে আসতে রাত হয়ে গিয়েছিল। মিমি ভেবেছিল একাই চলে আসবে কিন্তু কাইফ বিনা বাক্যে মিমির সামনে গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিল। যার অর্থ আজ মিমিকে কাইফের সাথেই ফিরত হবে। অগত্যা তারা এক সাথেই ফিরেছে। বাড়িতে ফেরার পর মিমি চুপচাপ তানিয়ার কাছে কেটে পড়তে চেয়েছিল। তবে এর মাঝে বড় একটা কিন্তু আছে! কিন্তু কাইফ তার পালানোর আগেই তার হাত খপ করে ধরে সোজা রুমে এনে ছেড়েছে। নিশানের বোমা ফাটানোর পর থেকে কাইফ গম্ভীর হয়ে আছে। ভয়ে মিমির বুক কাঁপছে, মনে হচ্ছে এই বুঝি কাইফ রেগে তাকে দু ঘা বসিয়ে দেবে। কাইফ তখন থেকে সোফায় বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে তো আছেই, কিছু বলছেও না কিছু করছেও না। মিমি মনে হলো এভাবে এক নাগাড়ে তাকিয়ে থাকার চেয়ে কাইফ তাকে কয়েক ঝাড়ি দিক। তবুও এমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে না থাকুক। এতক্ষণে কাইফ নিজের মুখ খুলে গম্ভীর কণ্ঠে বলল–

— আমি যেন কি? কেমন লোক?

কাইফের কন্ঠে মিমি ঈষৎ কেঁপে উঠল। বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল–

— ম মিস্টার খান! আ আমি ক কিছু বলিনি। ন নিশান ছোট ম মানুষ কি থেকে ক কি বলেছে।

মিমি কাইফকে মিস্টার খান বলে ডাকে। অফিসেও মাঝে মধ্যে স্যার বলতে গিয়ে মিস্টার খান বলে ফেলে, আবার পরবর্তীতে শুধরে নেয়। আসলে সে কাইফকে মিস্টার খান বলতে বেশি পছন্দ করে। কেন সে জানে না, কিন্তু পছন্দ করে। কাইফ পুনরায় গম্ভীর কণ্ঠে বলল–

— নিশান কখনও মিথ্যা বলে না। তুমি দেখছি নিজেকে বাঁচাতে যেয়ে নিশানকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছ। তুমি কি নিশানের মতো বাচ্চা?

বেচারা মিমি! কি করবে সে? এখন হাজার বলেও কাইফের থেকে সে বাঁচতে পারবে না। নিশানের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েও লাভ নেই। কিন্তু এখানে নিশানেরও দোষ আছে সে কেন কাইফকে সব বলে দিল? মিমি তো আবেগের বসে নিশানের সামনে কথা গুলো বলে ফেলেছিল। মিমি বলার কিছু খুঁজে পায় না। কাইফ ধমকে ওঠে–

— মিমি! কিছু বলছি আমি। তুমি কথা বলছ না কেন? আমি অসভ্য লোক? আর কি কি?

মিমি পারে না কেঁদে দিতে। সে নিজের পক্ষে কিছু বলবে তার আগেই নিচ থেকে মেঘের গলার আওয়াজ ভেসে আসে। সে চিৎকার করে সকলকে ডাকছে। কাইফ, মিমি ভাবল কারো বিপদ হয়েছে বোধহয়। কাইফ দৌড়ে নিচে নেমে গেল। তার পিছু পিছু মিমি গেল। মেঘ কাইফকে দেখে তাকে ঝাপটে ধরল। কাইফ চিন্তিত কন্ঠে বলল–

— কি হয়েছে মেঘ? এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন?

মিমি তানিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সে তানিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখল সে কেমন যেন চুপসে আছে। মাথা নিচু করে লাজুক হাসছে। মিমি তানিয়ার কানে ফিসফিস করে বলল–

— এই তানি! কি হয়েছে রে?

তানিয়া কিছু বলল না। সে পূর্বের ন্যায় মাথা নিচু করে আছে। মিসেস রিতা বললেন–

— মেঘ! এভাবে সবাইকে ডেকে এখন চুপ করে আছিস কেন? আমি ভাবলাম বাড়িতে ডাকাত পড়েছে।

মেঘ কাইফকে ছেড়ে দিয়ে মিসেস রিতার দিকে তাকিয়ে বলল–

— আমি বাবা হতে চলেছি ছোট মা! আমার তানিয়া মা হতে চেলেছে।

ছোট খাটো একটা বোমা ফাটলো বোধহয়। সকলে স্তব্ধ! মিমি ঘোর থেকে বের হয়ে তানিয়াকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। বলল–

— সত্যি তানি? আমি খালামনি হবো? আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে।

অতঃপর তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল–

— আমি এক্ষুনি মিষ্টি নিয়ে আসছি।

মিমি দৌড়ে চলে গেল। মিসেস রিতা তানিয়াকে আলিঙ্গন করে দোয়া করলেন। বললেন–

— সুখী হও মা। একটা ফুটফুটে সুস্থ সন্তানের জন্ম দাও। দোয়া করি।

আফজাল খান এবং আজমল খান তানিয়ার মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন। মিমি মিষ্টি নিয়ে এসে সকলকে দিল। নিজের হাতে তানিয়াকে খাইয়ে দিল, তানিয়াও দিল। মেঘ মিষ্টি নিয়ে কাইফের মুখের সামনে ধরে বলল–

— আজ অন্তত একটা মিষ্টি খাও ভাইয়া?

মিমি মুখ ভেংচি কেটে বিড়বিড় করে বলল–

— মিষ্টি খাবেন কেন? মিষ্টি খান না বলেই মুখ দিয়ে শুধু তেতো কথা বের হয়।

কাইফ খাবে না করেও মেঘের মন রাখতে খেয়ে নিল। সকলে নিজের রুমে চলে গেলেন। রয়ে গেল তানিয়া, মিমি, মেঘ এবং কাইফ। মেঘ কাইফের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল–

— তুমি চাচ্চু হতে যাচ্ছ ভাইয়া! আমি একদিক থেকে খুবই দুঃখ পাচ্ছি। আমি তোমার ছোট অথচ আমি তোমাকে আগে চাচ্চু ডাক শোনাতে চলেছি। এখন তোমার দায়িত্ব খুব শীঘ্রই আমাকে চাচ্চু ডাক শোনানো। কি ভাইয়া? সু সংবাদ কবে পাচ্ছি?

মেঘের কথায় কাইফ বড়সড় আকারের বিষম খেল। মিমি টেবিল থেকে গ্লাসে পানি নিয়ে কাইফকে দিল। পুনরায় বিড়বিড় করে বলল–

— একটু খানি মিষ্টি খেয়েছে কি খায়নি অমনি বিষম খেল। আসলে ভালো জিনিস কারোর সহ্য হয় না।

কাইফ তা শুনতে পেল। সে পানি পান করে চোখ রাঙিয়ে মিমির দিকে তাকাল। মিমি শুকনো ঢোক গিলে জোর পূর্বক হেসে গ্লাস নিয়ে সরে আসলো। মেঘ বলল–

— বিষম খেলে তো শুনছি না ভাইয়া। সু খবর খুব তাড়াতাড়িই চাই। তানিয়া চলো রুমে চলো। তোমার এখন অনেক রেস্ট করতে হবে।

বলেই সে তানিয়ার হাত ধরে তাকে রুমে নিয়ে গেল। এমন ভাবে নিয়ে গেল যেন তানিয়া সদ্য হাঁটতে শিখেছে। মিমির তানিয়ার প্রতি মেঘের এমন কেয়ার দেখে খুবই ভালো লাগে। তারা চলে গেলে মিমি কাইফকে জিজ্ঞেস করল–

— জিজু কিসের সু খবরের কথা বলছিলেন মিস্টার খান?

কাইফ হুট করেই যেন অস্বস্তিতে পড়ে গেল। সে গলা ঝেড়ে বলল–

— কিছু না। তুমি বুঝবে না।

সে লম্বা লম্বা পা ফেলে রুমে চলে গেল। মিমি কিছুক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল। কি এমন কথা যে সে তা বুঝতে পারবে না? ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে সেও রুমের দিকে পা বাড়ায়। আপাতত কাইফ সেই বিষয়টা ভুলে গিয়েছে মনে হয়, ভুলে গেলেই সে বেঁচে যায়।
——–

— এসব কি মিমি?

মিমি কাঁচুমাচু হয়ে বলল–

— কি মিস্টার খান না মানে স্যার?

— তোমাকে একটা ছোট্ট ফাইলের কাজ করতে দিয়েছিলাম। তুমি তার মধ্যে এতো ভুল করেছ! মন টা কোথায় থাকে তোমার? কাজ টাজ কিছু হয়? নাকি মিস্টার আদিলের সাথে শুধু গল্প করাই হয়?

অপমানে মিমির মুখ থমথমে হলো। সে নিচু কন্ঠে বলল–

— আমি কথা বলি না স্যার। তিনিই এসে আমার সাথে কথা বলেন। এখানে আমার দোষ কোথায়?

কাইফ আরো কিছু বলতে নেবে তার আগেই বলা নেই কওয়া নেই হুট করে একটা মেয়ে কেবিনে ঢুকে পড়ল। সেটা বড় কথা নয়। সবথেকে বড় কথা হলো সে হুট করে কাইফকে জড়িয়েও ধরল। মিমি বিস্ফোরিত চোখে তাকাল। কে এই মেয়ে? হুট করে কাইফের ওপর চড়ে বসল কেন? জামা কাপড়ের হাল দেখ! ছিঃ মিমির নিজেরই লজ্জা লাগছে। তার মনে হলো বাচ্চারা যেমন ফ্রক পরে তেমনটা পরেছে তবে তাকে দেখতে একদমই অশ্লীল লাগছে। মিমির রাগ হচ্ছে, প্রচুর রাগ হচ্ছে। সে তার হাতে থাকা কাগজ দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিচ্ছে। যেন সে তার সামনে থাকা এই অভদ্র মেয়েটাকে মোচড়াচ্ছে। মেয়েটা কাইফকে ছেড়ে দিয়ে বলল–

— হেই কাইফ! হাউ আর ইউ? আই মিসড ইউ সো মাচ!

কাইফ মেয়েটাকে দেখে বলল–

— ওহ! জেসি। এটা আমার অফিস। এভাবে কেউ জড়িয়ে ধরে?

— আরে ছাড়ো তো কাইফ। কে আছে এখানে? জড়িয়ে ধরেছি তো কি হয়েছে?

কাইফ আড় চোখে মিমির দিকে তাকাল। মিমি রাগে ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। সে জলজ্যান্ত একটা মানুষ এখানে দাঁড়িয়ে আছে আর এই মেয়ে বলে কিনা এখানে কে আছে? কাইফের তাকানো দেখে জেসি মিমির দিকে তাকাল। কেমন যেন মুখ কুচকাল। বলল–

— ওহ! তুমি আছ? স্যরি আমি খেয়াল করিনি। আসলে কাইফ সামনে থাকলে আমার আশে পাশে কারোর দিকে খেয়াল থাকে না। কাইফ কে এ?

— আমার পিএ মিমি।

— পিএ! ইশ্ কেমন খ্যাত মার্কা। তুমি এমন পিএ রেখেছ কেন?

কাইফ কিছু বলল না দেখে মিমির রাগ তরতর করে বাড়তে লাগল। কাইফ তাকে পিএ বলে পরিচয় দিল? মিমি তার আর কিছু হয় না? জেসি আবারও বলল–

— এই পিএ! যাও তো আমার জন্য কফি করে নিয়ে এসো। সুগার দেবে না। ওকে? নাও গো এ্যান্ড লিভ আস এ্যালোন।

মিমি কাইফের দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেল। যাবার সময় দরজাটা শব্দ করে লাগিয়ে দিল। কাইফ বুঝল তার রাগের পরিমাণ। বুঝেও সে চুপ রইল। জেসি মুখ কুঁচকে বলল–

— দেখেছ কেমন ম্যানার্সলেস গার্ল? এভাবে কেউ দরজা আটকায়? তুমি চুপ আছ কীভাবে? আমি হলে ঘাড় ধরে বের করে দিতাম।

কাইফ জেসির কথা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যাচ্ছে। সে বলল–

— ওসব কথা বাদ দাও জেসি। বলো তুমি কবে দেশে এসেছ?

— আমি গতকাল এসেছি আর আজ তোমার সাথে দেখা করতে চলে এসেছি।

তারা আরও টুকি টাকি কিছু কথা বলল। জেসি কাইফের এক প্রকার ফ্রেন্ডই বলা চলে। সে আমেরিকায় পড়াকালীন আলাপ হয়েছিল। জেসি জন্মস্থান বাংলাদেশ হলেও তারা সেখানে সেটেল। জেসি মাঝে মধ্যে বাংলাদেশে আসে। এখানে তার পৈতৃক বাড়ি আছে। জেসির গায়ে পড়া স্বভাবটা খুবই অসহ্যকর লাগে কাইফের। তবুও বন্ধু বলে কাইফ তাকে সহ্য করে।‌‌ কাইফে বারন করা সত্ত্বেও জেসি তার গায়ে পড়া স্বভাবের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আনেনি। আসলে আমেরিকান কালচারে মানুষ হয়েছে। এমন স্বভাব থাকা স্বাভাবিক। তবে কোন দিন যে সহ্যের বাঁধ ভেঙে যাবে সেদিন জেসি খুবই পস্তাবে।

চলবে?
{ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন, ধন্যবাদ}