হতে পারি বৃষ্টি পর্ব-২৬+২৭

0
489

#হতে_পারি_বৃষ্টি
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৬

পাশাপাশি বসে আছে মিমি ও হাসেম আলী। তাদের সামনে বয়স্ক কাজী। তাদের ঘিরে আছে পাড়ার লোকেরা। মিমি যে অবস্থায় ছিল তেমনই আছে। শুধু মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা দেওয়া। হাসেম আলীর কথা হলো সে দেরি করতে চায় না, সাজানো গোছানো দরকার নেই। সে বউ ঘরে তুলে নিজের মন মতো সাজাবে। মিমির পূর্বের ন্যায় অনূভুতি হীন ভাবে বসে আছে। তার চোখের পলক পর্যন্ত নড়ছে না। মিসেস মুক্তার নিজেকে খুবই অসহায় লাগছে। নিজের সামনে নিজের মেয়ের সর্বনাশ হতে দেখছেন তিনি। অথচ তার করার কিছুই নেই। রিহা বিয়ে আটকানোর জন্য চেঁচামেচি শুরু করেছিল। কিছু মহিলা মিলে তাকে রুমে বন্ধ করে রেখেছে। এক নাগাড়ে সে দরজা ধাক্কিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কেউ কর্ণপাত করছে না। ইতোমধ্যে কাজী বিয়ের কাজ শুরু করল। হাসেম আলীকে কবুল বলতে বললে সে কবুল বলে দিল। সে তো এই দিনটারই অপেক্ষায় ছিল। দেরি করার কোনো মানেই হয় না। কাজী এবার মিমিকে কবুল বলতে বলল। মিমি চুপ করে থাকে। হাসেম আলী তার কানে কানে বলল–

— কি গো! কবুল কও না ক্যা? তাড়াতাড়ি কবুল কইয়া দাও। তাড়াতাড়ি তোমারে মোর ঘরে লইয়া যামু।

হাসেম আলীর কথা শুনে মিমি গা গুলিয়ে ওঠে। সে মুখ খোলার আগেই বিকট শব্দ হলো। সকলে হতবাক হয়ে তাকাল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে কাইফ, তার পায়ের কাছে পড়ে আছে ভাঙা ফুলদানি। অসম্ভব লাল তার মুখমন্ডল, শক্ত চোয়াল। সে চেঁচিয়ে উঠল–

— বন্ধ করুন এই বিয়ে!

পাড়া প্রতিবেশীরা কানাকানি শুরু করল। হাসেম আলী দাঁড়িয়ে বলল–

— আপনে কেডা? বিয়া বন্ধ করমু ক্যান?

প্রতিবেশীর এক মহিলা বলল–

— এ নিশ্চয় এই মেয়ের কোনো না/গ/র হবে। এর সাথেই কি রাত কাটিয়ে ছিল সেদিন?

কাইফ ভয়ংকর রেগে গেল। তানিয়া মেঘ তার পিছু পিছু আসছিল। তানিয়া মিমির পাশে যেয়ে বসল। হাসেম আলী বিশ্রী ভাবে বলল–

— ক্যান রে? এক রাত মস্তি করেও তোর স্বাদ মেটে নাই? এখন বিয়া আটকাইতে চাস? মনে ধরছে নাকি খুব?

কাইফ তার কলার চেপে ধরে লাগাতার দু ঘা বসাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল–

— লজ্জা করে না মেয়ের বয়সী একটা মেয়েকে নিয়ে এমন বাজে মন্তব্য করতে? আর আপনারা! আপনাদের ও লজ্জা হওয়া উচিত ছিঃ।

হাসেম আলী খ্যাক করে উঠে বলল–

— আমার গায়ে হাত তুলিস? শা/লা তোর এত সাহস!

এক মহিলা বলল–

— বাবাহ! এই ন/ষ্টা মেয়ের জন্য এত দরদ? কে তুমি? হাসেম আলী বিয়ে করবে না তো এই মেয়েকে কে বিয়ে করবে? তুমি?

কাইফ চেঁচিয়ে ওঠে–

— হ্যাঁ আমি! আমি বিয়ে করব।

বলে সে মিমির পাশে যেয়ে বসে। হাসেম আলী তেড়ে এসে বলল–

— না! আমি বিয়া করমু ওরে। তোরে তো আজ মাইরাই ফালাইমু।

কাইফ মেঘকে উদ্দেশ্য করে বলল–

— মেঘ! পুলিশকে কল দে। দেখি আজ আমাকে কে আটকায়। সব কটাকে জেলের ঘানি টানিয়ে ছাড়ব।

কাইফের কথায় সকলে ভেজা বিড়ালের ন্যায় চুপসে গেল। হাসেম আলী ও পিছু হটে গেল। কাইফ বলল–

— বিয়ে পড়ানো শুরু করুন কাজী সাহেব।

কাজী অগত্যা পুনরায় বিয়ে পড়ানো আরম্ভ করল। মিমি এতোক্ষণ নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল। সব কিছু তার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। সে যেন এক ঘোরের মধ্যে আছে। ঘোরের মধ্যে থেকেই তার সাথে কাইফের বিয়ে হয়ে গেল। সেটা আইনগতভাবে ও হলো আবার ধর্মীয়ভাবে ও। বিয়ে শেষে কাইফ উঠে দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বলল–

— প্রতিবেশী দের উচিত বিপদে একে অপরের পাশে থাকা। তাদের সাহায্য করা, সাহস দেওয়া। কিন্তু আপনারা কি করলেন? এতো বড় একটা অপবাদ একজন মেয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন? আজ যদি এই জায়গায় আপনাদের কারোর মেয়ে থাকত? তাহলে কি করতেন? নিশ্চয়ই এই ঘৃণিত কাজটা করতেন না। মিমির এই এলাকায় থাকা নিয়ে আপনাদের সমস্যা তাই তো? ওকে! আজ থেকে মিমি এই এলাকায় তো দূরে থাক এর আশে পাশেও আসবে না। এবার খুশি তো আপনারা? ছিঃ!

কারোর মুখে কোনো কথা নেই। সকলে এক এক করে মিমিদের বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। হাসেম আলী এতো শখ করে বিয়ে করতে এসেছিল সে খালি হাতেই ফিরে গেল। মিমিকে তার তৃতীয় বউ বানানো হলো না। মিসেস মুক্তা চোখে জল নিয়ে কাইফের হাত মুঠোয় নিয়ে বললেন–

— আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট হওয়া থেকে তুমি বাঁচিয়ে দিলে বাবা। তুমি আরও একবার ওকে বাঁচালে। তোমাকে ধন্যবাদ জানানোর কোনো ভাষা-ই আমার নেই।

কাইফ তার হাতের ওপর হাত রেখে বলল–

— এভাবে বলবেন না।

— তুমি আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো বাবা। আমার মেয়েটা বড্ড ভালো জানো তো। ওর বাবা ওকে খুব ভালোবাসতেন। তুমি ওর খেয়াল রেখো।

— আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি। ওনার কোনো অযত্ন হবে না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।

দরজা ধাক্কানোর শব্দে তানিয়া দরজা খুলে দিল। রিহা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল–

— কোথায় হাসেমের বা/চ্চা? ওকে তো আজ মেরেই ফেলব। আমার আপুকে বিয়ে করবে? ওর সব শখ আমি ছুটিয়ে ছাড়ব। ওই, ওই বুড়ো কি আপুকে বিয়ে করে ফেলেছে?

তানিয়া তাকে ধরে বলল–

— রিহা শান্ত হও। তোমার আপুর ওই হাসেম আলীর সাথে বিয়ে হয়নি।

— তাহলে?

— বিয়ে হয়েছে ওই যে ওনার সাথে। মেঘের বড় ভাই।

বলে সে কাইফকে দেখিয়ে দিল। রিহা শান্ত হলো। এই যাত্রায় তার আপুর জীবনটা রক্ষা পেল। সেও কাইফের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। কাইফ মেঘকে তাড়া দিয়ে বলল–

— আমাদের এখন যেতে হবে মেঘ। আমরা তাহলে আসি আন্টি?

মিসেস মুক্তা মেয়েকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলেন। মিমি এতক্ষণ বাদে নিরবে কেঁদে উঠল। মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মিসেস মুক্তার ও চোখ ভিজে ওঠে। তিনি বললেন–

— ভালো হয়ে থাকবি মা। আজ থেকে ওরাই তোর সব। মনে রাখিস কাইফ তোর স্বামী, সব সময় তার কথা শুনে চলবি।

তিনি ও রিহা মিলে মিমিকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেন। রিহা কাঁদলেও সে তার বোনের জন্য খুব খুশি। মেঘ, কাইফ সামনে বসল এবং তানিয়া ও মিমি পেছনে। তারা বিদায় নিয়ে রওনা দিল নিজেদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। পুরো রাস্তা তাদের কথা হলো না। তানিয়া মিমিকে আগলে নিয়ে বসে রইল।
——–

বাড়িতে এসে মেঘ মিসেস রিতাসহ সকলকে সবটা বুঝিয়ে বলল। তারা মোটেও অখুশি হলেন না। আফজাল খান মিমির মাথায় স্বস্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন–

— আজ থেকে এটা তোমারও বাড়ি। আমার ছেলের বউ নয় তুমি আমার মেয়ে হয়ে থাকবে।

তিনি মন থেকে দোয়া করলেন। খুব খুশি হয়েছেন তিনি। যে ছেলে বিয়ের কথা শুনলে পালায় পালায় করত, আজ সে নিজে থেকে বিয়ে করে এনেছে। এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে? তাছাড়া তিনি মিমিকে দেখেই বুঝেছেন সেই পারবে তার রাগ চটা ছেলেকে সারা জীবনের জন্য সামলাতে। আজমল খানও মিমির সাথে কথা বলে দোয়া করলেন। অতঃপর তারা নিজেদের কক্ষে চলে গেলেন। মিসেস রিতা তানিয়াকে বললেন–

— তানিয়া যাও মিষ্টি নিয়ে এসো। আমার ঘরে নতুন বউ এসেছে মিষ্টি মুখ না করলে হবে? যাও নিয়ে এসো।

তানিয়া ছুটে চলে গেল মিষ্টি আনতে। তিনি মিমিকে সোফায় বসিয়ে নিজে তার পাশে বসলেন। বললেন–

— তুমি ঈশানি আর তানিয়ার মতোই আমার আর এক মেয়ে। আমার কাইফটা একটু রাগী। তুমি সামলাতে পারবে না তাকে? বলো?

মিমি কোনো রকম মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল যে সে পারবে। মনে তার বিষন্নতা ছেয়ে আছে। কাইফ তাদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছে। তার নাকি অফিসে কাজ আছে। মিমির ধারণা কাইফ কাজের বাহানা দিয়ে চলে গিয়েছে। তবে কি কাইফ মন থেকে বিয়েটা করেনি? তার ভাবনার মাঝেই তানিয়া মিষ্টি নিয়ে হাজির। মিসেস রিতা মিমিকে মিষ্টি খাইয়ে দিয়ে বললেন–

— সুখী হও। আজ থেকে এই বাড়ির বড় বউ তুমি। ধীরে ধীরে সকল দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেবে। তানিয়া আর তুমি মিলে আমার সংসার সামলাবে। তানিয়া মিমিকে কাইফের রুমে নিয়ে যাও। ওর একটু বিশ্রামের প্রয়োজন।

তানিয়া সম্মতি দিয়ে মিমিকে নিয়ে ওপরে চলে গেল। মিসেস রিতা স্বস্তি পেলেন। কাইফকে নিয়ে তার বড় চিন্তা ছিল। এখন থেকে তিনি চিন্তা মুক্ত থাকতে পারবেন। এখন মিমি কাইফের বউ হয়ে এসেছে, সে নিঃসন্দেহে কাইফের জন্য যোগ্য জীবনসঙ্গী। শুধু কাইফের রাগ সহ্য করতে পারলেই হয়। তিনি মনে মনে তাদের সুখী জীবনের জন্য দোয়া করলেন।

চলবে?

#হতে_পারি_বৃষ্টি
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৭

তানিয়া মিমিকে নিয়ে কাইফের রুমে গেল। মিমি এই প্রথম কাইফের রুমে এসেছে। সে চারপাশে তাকিয়ে দেখে। কাইফের রুমটা সাদা রঙের, বিশাল রুম দামি আসবাব পত্রে সজ্জিত। রুমের রয়েছে বিশাল এক বিছানা, বিছানার অপর পাশে দেওয়াল ঘেঁষে রেয়েছে তিন সিটের সোফা, তার সামনে আছে টি টেবিল, সোফার পেছনে রয়েছে কাইফের গম্ভীর মুখের বড় একটা ছবি। এক পাশে কাপড় রাখার বিশাল ওয়ারড্রব, এটাচ ওয়াশ রুম এবং তার পাশেই বড় আয়না। রুমের সাথে বেলকনিও আছে। তানিয়া মিমিকে নিয়ে সোফাতে বসে। তানিয়া এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এখন সে উল্লাসে ফেটে পড়ল। মিমিকে ঝাপটে ধরে বলল–

— মিমু মিমু মিমু! আমি যে কি খুশি হয়েছি তোকে আর কি বলব? তোকে বলে বোঝাতে পারব না ইয়ার। তুই আমার জা হয়ে এ বাড়িতে আসবি তা আমি কখনও ভাবতেই পারিনি। ইশ্! আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে! এবার থেকে আমরা একসাথে থাকব। কিন্তু তুই আমার থেকে সম্পর্কের দিক বড় হয়ে গেলি, তাই কি সমস্যা নেই। আমরা তো জিগরি দোস্ত।

মিমি কিছু বলে না। চুপচাপ তানিয়ার কথা শোনে। তার মাথায় এখনও কাইফের কথা ঘুরছে। তার মনে হচ্ছে কাইফ এই বিয়েতে খুশি নয়, সে শুধুমাত্র মিমির জীবন বাঁচানোর জন্য তাকে বিয়েটা করেছে। তানিয়া আবারও বলল–

— জানিস মিমু? যখন আমি তোর বিয়ের কথা শুনলাম না ওই বুড়োর সাথে? সাথে সাথে মেঘকে জানালাম ‌‌আর আমরা বের হচ্ছিলাম। ভাইয়া ভাগ্যক্রমে বাড়িতেই ছিলেন। আমরা কোথায় যাচ্ছি শুনলে আমরা সবটা বললাম, তিনি দু মিনিটে রেডি হয়ে আমাদের সাথে বেরিয়ে পড়লেন। তারপর থেকে তুই সব জানিস।

মিমি শুনলো। তানিয়া আরও অনেকক্ষণ নিজের মতো কথা বলে গেল। মিমি শুনে গেল টু শব্দ করল না। তার ক্লান্ত লাগছে, খুবই ক্লান্ত।

রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে রুমে এসেছে মিমি । দুপুরে খাওয়ার পর সে অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে। এখন আর ঘুম আসছে না। কাইফ সেই যে গিয়েছে এখনও বাড়িতে আসেনি। মিমি বেলকনির দিকে এগিয়ে গেল। বেলকনিটা যথেষ্ট বড়। এখানে দুইটা এক ছিটের সোফা ও টি টেবিল রাখা। মিমি রেলিং ধরে আকাশের দিকে তাকায়। মিটিমিটি তারা জ্বল জ্বল করছে আকাশে। মিমি উদাস মনে সেদিকে চেয়ে রইল।

রাত এগারোটার সময় বাড়িতে ফিরল কাইফ। সারাদিন সে খুবই ব্যস্ত ছিল। সে নিজের মতোই সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে গেল। সেখানে গিয়ে লম্বা একটা শাওয়ার নিল।অতঃপর ড্রেস চেঞ্জ করে একটা টিশার্ট ও ট্রাউজার পরে বেলকনিতে গেল। বেলকনিতে পা রাখতেই কাইফ হকচকিয়ে গেল। সে মিমির কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল, ভুলেই গিয়েছিল যে এখন তার বউ আছে। বিষয়টা বড়ই অদ্ভুত। মিমি রেলিং ঘেঁষে কাইফের দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে আছে। কাইফ একটু এগিয়ে গিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল। এতে সে সফলও হলো। মিমি তার দিকে ঘুরে তাকিয়েছে, নিষ্প্রাণ তার দৃষ্টি। কাইফ কি বলবে খুঁজে না পেয়ে জিজ্ঞেস করল–

— কি করছেন এখানে? খেয়েছেন রাতে?

মিমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জবাব দিল–

— হ্যাঁ। আপনি খেয়েছেন?

— হুম আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি। আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।

— আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন কেন মিস্টার খান?

কাইফের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়। সে এখন এসব বিষয়ে একদমই কথা বলতে চাচ্ছে না। সে মিমির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল–

— এখন এসব কথা থাক। আপনাকে আমি ঘুমাতে যেতে বলেছি।

— আমি জানি আপনি বাধ্য হয়ে আমাকে বিয়ে করেছেন। তার জন্য আমি আপনার কাছে চির কৃতজ্ঞ। তবে আমি চাকরিটা করে যেতে চাই। যাতে মা আর বোনকে সাহায্য করতে পারি।

— অবশ্যই করবেন। আমার কোনো আপত্তি নেই।

মিমি আর কিছু বলে না। সে নিঃশব্দে রুমে যায়। মনে মনে ভাবে কাইফ তো বাধ্য হয়ে তাকে বিয়ে করেছে। তাহলে কাইফের কোনো জিনিসের প্রতি তার অধিকার নেই। সুতরাং বিছানাতে ঘুমানো উচিত হবে না। সে সোফায় গিয়ে গুটি শুটি মেরে শুয়ে পড়ে। হুট করেই তার খুব কান্না পায়। কেন তার সাথে এমনটা হলো? একটা বুড়ো লোক তাকে বিয়ে করে নিয়ে যাচ্ছিল আর এখন এমন এক লোকের সাথে বিয়ে হয়েছে যে তাকে চায়-ই না। মিমির মনে হচ্ছে হাসেম আলীর সাথে বিয়ে হওয়াটাই ভালো ছিল, অন্তত সে তাকে চায়ত। মিমি কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।

প্রায় অনেকক্ষণ পর কাইফ রুমে আসে এবং সোফাতে ঘুমন্ত মিমিকে আবিষ্কার করে। কাইফ বুঝল না এতো বড় একটা বিছানা থাকতে মিমি সোফাতে ঘুমিয়েছে কেন? সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অতঃপর মিমিকে পাঁজাকোলা করে বিছানায় শুইয়ে দেয়। নিজেও তার থেকে দূরত্ব নিয়ে শুয়ে পড়ে। ক্লান্ত সে, এখন তার একটা শান্তিপূর্ণ ঘুমের দরকার। সে ঘুমানোর উদ্দেশ্যে নিজের চোখ বন্ধ করে নেয়।
——-

সকালের মিষ্টি রোদ চোখে পড়ায় ঘুম ভেঙে গেল কাইফের। সে নিজের বুকের ওপর ভারী অনুভব করে। তাকিয়ে দেখে মিমি তার বুকের ওপর ছোট্ট বিড়াল ছানার ন্যায় ঘুমিয়ে আছে। কাইফ নিজের অজান্তেই ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। মিমির মুখের ওপর থেকে এক গোছা চুল সরিয়ে দেয়। মিমির চোখেও আলো পড়ার সে নড়ে চড়ে ওঠে। কাইফ ভড়কে গিয়ে পুনরায় চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ভান ধরে শুয়ে থাকে। মিমি পিটপিট করে চোখ মেলে নিজেকে কাইফের বুকের ওপর আবিষ্কার করে। মস্তিষ্কে ব্যাপারটা খেলতেই, তার ঘুম পুরোপুরি উড়ে গেল। মিমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তৎক্ষণাৎ সরে গেল। সে কীভাবে বিছানায় আসলো? সে তো সোফায় ঘুমিয়ে ছিল। মিমি কাইফকে ডাকল–

— মিস্টার খান!

কাইফের হেলদোল নেই। সে চোখ শক্ত করে বন্ধ করে আছে। মিমি নিজের মতো বকবক করে–

— আমি বিছানায় কীভাবে আসলাম? আমি তো সোফাতে ছিলাম। হায় আল্লাহ! উনি যদি আমাকে ওনার বিছানায় দেখেন না জানি কি করবেন? আমার তো ঘুমের মধ্যে হাঁটার রোগ নেই। তাহলে আমি কীভাবে এখানে আসলাম? বিছানায় এসেছি ভালো কথা কিন্তু একেবারে ওনার বুকের ওপর! ছিঃ!

মিমি খুবই লজ্জা পায়। সে তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশ রুমে প্রবেশ করে। মিমি ওয়াশ রুমে ঢোকার পর কাইফ চোখ মেলে তাকায়। মিমির বোকা বোকা কথা গুলো তার কানে এসেছে, সে ঠোঁট কামড়ে হাসে।

সকলে টেবিলে ব্রেকফাস্ট করার উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়েছে। মিসেস রিতা সকলকে সার্ভ করে দিচ্ছেন। তাকে সাহায্য করছে তানিয়া এবং মিমি। তিনি মানা করলেও তারা শোনেনি। সার্ভ করা শেষে তার নিজেও বসে পড়ল যার যার স্বামীর পাশে। খেতে আফজাল খান কাইফকে উদ্দেশ্য করে বললেন–

— তোমাদের বিয়ে কেমন পরিস্থিতিতে হয়েছে আমরা জানি। কিন্তু বিয়ে মানে বিয়ে-ই। আমরা কেউ এই পবিত্র সম্পর্ককে অস্বীকার করতে পারি না। আমি চাচ্ছিলাম তোমাদের বৌভাতের অনুষ্ঠানটা বড় করে করতে। তাতে সবাই তোমাদের বিয়ের বিষয়টা জেনেও যাবে। তো তোমার কি মতামত?

কাইফ চোখ তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল–

— আমি এখন এসব কিছুই করতে চাচ্ছি না বাবা আর না কাউকে বিয়ের ব্যাপারটা জানাতে চাই।

সকলে অবাক হলো। মিমি মনে মনে শিওর হলো যে কাইফ মন থেকে তাকে গ্রহণ করেনি। আফজাল খান বললেন–

— কিন্তু কেন? আজ নাহয় কাল সকলে তো বিয়ের ব্যাপারটা জেনেই যাবে তাই না?

— হ্যাঁ। কিন্তু আমি এই মুহূর্তে কোনো অনুষ্ঠান করতে চাচ্ছি না। আমি খুবই ব্যস্ত আছি একটা প্রোজেক্ট নিয়ে। প্রোজেক্টের কাজ শেষ হলে তারপর অনুষ্ঠানের কথা ভেবে দেখব।

আফজাল খান কাইফের সমস্যার দিক বিবেচনা করে বললেন–

— আচ্ছা বেশ! তুমি যেমনটা চাও তেমনই হবে।

কেউ আর টু শব্দটি করল না। মিমি নিজের মন মতো ভেবে চলেছে।‌‌ তার মতে সব কিছু শুধুমাত্র কাইফের বাহানা। কাইফ খাওয়া শেষে বলল–

— ছোট মা! মিমি আগের মতোই অফিস কনটিনিউ করতে চান। তো উনি আজ থেকেই অফিস জয়েন করবেন।

মিসেস রিতা সম্মতি দিয়ে বললেন–

— হ্যাঁ, কিন্তু গতকালই বিয়ে হলো আর আজই অফিস!

— হ্যাঁ আজ থেকেই অফিস যেতে হবে। কাজের ক্ষেত্রে আমি কোনো হেলা ফেলা পছন্দ করব না।

বলেই সে গটগটিয়ে হেঁটে প্রস্থান করল। উপস্থিত সকলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মিমি তাদের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বেরিয়ে গেল। সে বাইরে গিয়ে দেখে কাইফ সহ তার গাড়ি হাওয়া, টিকি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। মিমি ভেবেছিল কাইফ তাকে হয়তো তার সাথে নিয়ে যাবে। হয়তো একটু লিফট দেবে। কিন্তু কাইফ তার ভাবনার মুখে কালি লাগিয়ে চলে গেল। মিমি লম্বা শ্বাস টেনে রিকশা নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

চলবে?