হতে পারি বৃষ্টি পর্ব-৩৮+৩৯

0
481

#হতে_পারি_বৃষ্টি
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩৮

সকালে ঘুম থেকে উঠে শাওয়ার নিয়ে তানিয়ার রুমের দিকে অগ্রসর হলো মিমি। সেখানে গিয়ে দেখল ঈশানি ও তানিয়া বসে গল্প করছে। মিমির মনে হলো এখন তাদের সাথে একটু গল্প করলে মন্দ হয় না। মিমি হাসি মুখে বলল–

— আসবো তানি?

তানিয়া তার দিকে তাকিয়ে বলল–

— আরে মিমু! আমার রুমে আসার জন্য কি তোর পারমিশন লাগবে নাকি? চলে আয়।

মিমি এগিয়ে গিয়ে তানিয়ার পাশে বসলো। পাঁচ মাসে পড়েছে তানিয়া। তার পেট উঁচু হয়েছে। একটু গোলগাল ও লাগছে তাকে। তবে তাকে কিউট লাগছে। তারা টুক টাক গল্পে মেতে উঠল। তাদের গল্পের মাঝেই নিশান এসে ঈশানির কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মিমি তাকে দেখে হেসে বলল–

— কি খবর নিশান? এতোক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি?

নিশান মিমির দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবল। তারপর বলল–

— আমি নানুর সাথে ছিলাম। নানু ব্রেকফাস্ট তৈরি করছিল তাই দেখছিলাম।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বলল–

— তুমি এতো সকালে শাওয়ার নিয়েছ রসমালাই? তোমার শীত লাগেনি? আমি তো শীতকালে শাওয়ার নিতেই চাই না, মাম্মা আমাকে জোর করে শুধু।

মিমি লজ্জায় পড়ে গেল। তার গাল লালচে আবরণ ধারন করল। নিশান তাকে আরও লজ্জায় ফেলতে বলে উঠল–

— আর তোমার ঠোঁটে কি হয়েছে রসমালাই? কেউ কি তোমাকে কামড়ে দিয়েছে?

মিমি শুকনো কেশে উঠল। চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। তানিয়া ও ঈশানি মিটিমিটি হাসতে লাগল। ঈশানি নিশানকে বলল–

— তোমার রসমালাই কে ইঁদুরে কামড়ে দিয়েছে নিশান।

নিশান চোখ গোল গোল করে তাকাল। সে কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলেই ঈশানি আবারও বলল–

— তুমি এখন তোমার পাপার কাছে যাও। কি করছে সে দেখে আসো তো?

নিশান বাধ্য ছেলের মতো চলে গেল। নিশান চলে যেতেই তানিয়া শব্দ করে হেসে বলল–

— কি রে মিমু? আজ কাল তোর রুমে ইঁদুর একটু বেশিই ঘোরাঘুরি করে মনে হচ্ছে।

মিমি চোখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে। ঈশানি তাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল–

— কি ব্যাপার মিমি? আজকাল ভাইয়া তোমাকে চোখে হারাচ্ছে। কি জাদু করেছ আমার ভাইয়ার ওপর? হুম?

মিমি অস্বস্তিতে জড়সড় হয়ে বলল–

— কি যে বলেন না আপু!

— আমি তো ঠিকই বলছি। আমার গম্ভীর ভাইকে তুমি বশ করে ফেললে গো মিমি।

তানিয়া ও ঈশানি মিমিকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অনেক লজ্জা জনক কথা বলতে লাগল। অবশেষে মিমি আর সহ্য করতে না পেরে দৌড়ে বের হয়ে গেল।
——-

সকলে মিলে একসাথে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছে। তানিয়াকে কোনো কাজ করতে দেওয়া হয় না এবং হচ্ছে ও না। মেঘ তাকে নিজের পাশে বসিয়ে জোর করে খাওয়াচ্ছে। খেতে না চাওয়াতে অল্প স্বল্প ধমকা ধমকি ও করছে। সকলে তাদের কান্ড দেখে ঠোঁট চেপে হাসলেও মিসেস ঝর্না মুখ বাঁকিয়ে রেখেছেন। তিনি খুবই বিরক্ত। ঈশানি, মিমি এবং মিসেস রিতা সকলকে পরিবেশন করে দিচ্ছেন। মিমির শরীর টা ভালো লাগছে না। ক্লান্ত লাগছে খুব। আজ অফিসে যেতে একদমই ইচ্ছে করছে না। সে কাইফকে ব্যাপারটা জানানোর উদ্দেশ্যে ডাকল–

— মিস্টার খান!

শুধু একজন নয় চার চারজন মিস্টার খান তার দিকে তাকাল। মিমি ভড়কে গেল। তার এক ডাকে আফজাল খান, আজমল খান, মেঘরাজ খান এবং কাইফ খান একসাথে তাকিয়েছে। এনারা সবাই-ই মিস্টার খান! মেঘ বলে উঠল–

— তুমি কাকে ডাকলে মিমি? না মানে এখানে তো আমরা চারজন মিস্টার খান আছি। তোমার কাকে চায়?

লজ্জায় মিমি পারে না মাটির নিচে ঢুকে যেতে। ঈশানি তার বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বলল–

— কি গো মিমি? তোমার কোন মিস্টার খানকে চায়?

মিমি চোখ বন্ধ করে হড়বড়িয়ে বলল–

— মিস্টার খান! আমি আজ অফিসে যাব না। আমার শরীর ভালো লাগছে না। কোন মিস্টার খানকে বলেছি সে বুঝে নিন।

বলে সে দ্রুত সিড়ি বেয়ে রুমে চলে গেল। উপস্থিত সকলে হেসে উঠল শুধুমাত্র মিসেস ঝর্না ছাড়া। তার কাছে এসব কিছু অসহ্য লাগছে। আজ রাতের ফ্লাইটে তারা চলে যাবেন। এখানে থাকতে তার আর ভালো লাগছে না। যদি দুই বউ এর মধ্যে কাউকে কটু কথা শোনাতে পারতেন তাহলে হয়তো ভালো লাগত।

ব্রেকফাস্ট শেষে মিমির জন্য খাবার নিয়ে ওপরে গেল কাইফ। যেয়ে দেখল মিমি কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। কাইফ ভ্রু কুঁচকে ফেলল। টেবিলের ওপর ট্রে রেখে এগিয়ে গেল। মিমির মাথার কাছে যেয়ে বসে বলল–

— এই সময়ে শুয়ে আছ কেন? খুব খারাপ লাগছে?

মিমি কাইফের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল–

— তেমন কিছু না। শরীর টা কেমন ম্যাজ ম্যাজ করছে।

কাইফ তার কপালে, গালে, গলায় হাত দিয়ে দেখে। শরীর গরম। সে চিন্তিত কন্ঠে বলল–

— তোমার তো জ্বর এসেছে। আমাকে কিছু বলো নি কেন?

— এ কোনো বড় ব্যাপার নয় যে আপনাকে বলতে হবে। আপনি রেডি হয়ে অফিসে যান।

— যাব। তার আগে তুমি খেয়ে নাও। তারপর ওষুধ খেতে হবে।

কাইফ তাকে ধরে উঠিয়ে বসায়। খাবার তার মুখের সামনে ধরে। মিমি বলল–

— আপনার দেরি হয়ে যাবে তো মিস্টার খান!

— দেরি হলে হোক। তুমি খাও।

মিমি খেয়ে নেয়। কাইফ তাকে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে বলল–

— চুপ চাপ শুয়ে থাকবে। খবরদার রুম থেকে বের হয়েছ তো! আমি এসে যেন তোমাকে এভাবেই থাকতে দেখি। আর হ্যাঁ! তাড়াতাড়ি চলে আসব।

কাইফ বসা থেকে উঠে অফিসের জন্য রেডি হতে থাকে। মিমি কম্বলের নিচ দিয়ে উঁকি দিয়ে তাকে দেখে। সে বুঝতে পারে না লোকটা দিন দিন এতো সুন্দর কীভাবে হচ্ছে? মিমি ইচ্ছে হয় সারাদিন রাত তাকে চোখ ভরে দেখতে। তবুও যেন তার তৃষ্ণা মেটে না। কাইফ তার দিকে তাকাতেই সে কম্বলের নিচে মুখ লুকিয়ে ফেলে। কাইফ মুচকি হেসে এগিয়ে আসে। তার মুখের ওপর থেকে কম্বল সরিয়ে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। মিমি চোখ বন্ধ রেখেই হাসে। কাইফ চলে গেল। মিমি তার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল।
——

দেখতে দেখতে কেটে গেল চারটা মাস। সবার জীবন ভালো ভাবেই চলছে। তানিয়া ন মাসে পড়েছে। পেট অনেক উঁচু হয়েছে তার। হাঁটা চলা করতে কষ্ট হয়। মেঘ সব সময় তার আশে পাশেই থাকে। তার চিন্তার শেষ নেই। কখন কি হয়! তানিয়া খুবই জেদি হয়ে উঠেছে। সে একবার যা চায়বে তাকে তা দেওয়ায় লাগবে। এখন যেমন তানিয়া মুখ লটকে বসে আছে। আর মেঘ অসহায় মুখ করে বসে আছে। তানিয়া মেঘের হাত ঝাঁকিয়ে বলল–

— তুমি কি আমার জন্য আইসক্রিম এনে দেবে নাকি দেবে না মেঘ?

মেঘ তানিয়াকে বোঝানোর স্বরে বলল–

— তানিয়া! আমার সোনা মোনা। এই সময়ে আইসক্রিম খাওয়া একদমই ঠিক নয়। তোমার যদি ঠান্ডা লাগে তাহলে বেবির তো কষ্ট হবে বলো? বোঝার চেষ্টা করো একটু?

তানিয়া তবুও মানতে চায় না। সে আইসক্রিম খাবে তো খাবেই। তানিয়া রেগে বলল–

— একটা আইসক্রিম খেলে কিছুই হবে না। তুমি আমাকে এনে দেবে নাকি আমি চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলব?

এখন রাত বারোটা বাজে। সবাই নিশ্চয়ই গভীর ঘুমিয়ে আছে? এখন তানিয়া যদি চেঁচায় তাহলে সবার সমস্যা হবে। মেঘ হার মেনে নিল। বলল–

— আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু ছোট্ট একটা এনে দেব। তাই খাবে। ঠিক আছে?

তানিয়া হেসে মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। মেঘ চলে যায়। ফ্রিজেই আইসক্রিম রাখা আছে। মেঘ সেখান থেকে তানিয়াকে একটা এনে দিল। তানিয়া খুশি হয়ে তৎক্ষণাৎ তা খাওয়া শুরু করল। মেঘ চোখ ভরে দেখে। কদিন পর যার কোলে বাচ্চা আসবে, সে দেখো কেমন বাচ্চাদের মতো করে খাচ্ছে। মেঘ হাসে। হুট করেই তানিয়া ব্যথাতুর আওয়াজে চেঁচিয়ে উঠল। মেঘ হকচকিয়ে গিয়ে বলল–

— কি হয়েছে তানিয়া? কোথায় কষ্ট হচ্ছে?

তানিয়া জড়ানো গলায় বলল–

— আ আমার পেটে খুব ব্যথা করছে মেঘ। খুব ব্যথা করছে।

মেঘ কি করবে ভেবে পেল না। সে দৌড়ে কাইফের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে ধাক্কাতে লাগল। কিছুক্ষণ পর কাইফ দরজা খুলে বের হয়ে এলো। সবে মাত্র ঘুম এসেছিল তার। ভাইকে উদ্ভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল–

— কি হয়েছে মেঘ? তোকে এমন লাগছে কেন?

মেঘ ঢোক গিলে বলল–

— তানিয়া! তানিয়ার পেটে ব্যথা হচ্ছে ভাইয়া।

তানিয়ার কথা শুনে ধড়ফড়িয়ে এগিয়ে আসে মিমি। কাইফ গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে বলল–

— তুই তানিয়াকে নিয়ে আয়। আমি গাড়ি বের করছি।

মেঘ কাইফ তৎক্ষণাৎ চলে গেল। মিমি গিয়ে সবাইকে জানাল। সকলে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। মেঘ তানিয়াকে কোলে করে নামিয়ে গাড়িতে শুইয়ে দিল। তার মাথা নিজের কোলে নিয়ে বসল মিমি। মেঘ কাইফের পাশে বসা মাত্রই সে গাড়ি ছোটালো। ব্যথায় তানিয়ার মুখ নীল বর্ণ ধারণ করছে। মিমি তাকে শান্তনা দিয়ে বলল–

— চিন্তা করিস না তানি। একটু সহ্য কর। আমরা এক্ষুনি হাসপাতালে পৌঁছে যাব।

অতঃপর কাইফের উদ্দেশ্যে বলল–

— একটু তাড়াতাড়ি চালান না মিস্টার খান?

কাইফ গতি বাড়ায়। তারা হাসপাতালে পৌঁছালে মেঘ তানিয়াকে কোলে করে ভেতরে নিয়ে যায়। কাইফ আর মিমিও ছোটে তাদের পিছু। তানিয়ার অবস্থা দেখে ডাক্তার তাকে ইমার্জেন্সিতে নিতে বলে। মেঘ স্ট্রেচারে তানিয়াকে শুইয়ে দিয়ে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল–

— একদম ভয় পাবে না। তোমার কিচ্ছু হবে না।

তানিয়াকে নিয়ে যাওয়া হলো। আফজাল খান, আজমল খান এবং মিসেস রিতা ও চলে এসেছেন। তারা বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। মেঘ তানিয়ার বাড়িতে খবর দিল। তারা তৎক্ষণাৎ রওনা দিলেন। সবাই যখন চিন্তিত এই সুযোগে তাদের বিপদ প্রবেশ করল হাসপাতালে। ছদ্দবেশে অপেক্ষা করতে লাগল।

মিমি এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ করেই তার মাথা টা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল। পরক্ষনেই সে নিজেকে সামলে নিল। ভাবল কাইফকে বলবে যে কদিন ধরে তার শরীরটা একদমই ভালো যাচ্ছে না। কিন্তু পরে ভাবল কাইফ এখন চিন্তায় আছে, তার চিন্তা বাড়ানোর কোনো মানেই হয় না। মিমি চোখে মুখে পানি দেওয়ার উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেল। সকলে তানিয়াকে নিয়ে চিন্তিত থাকার ফলে মিমির দিকে কারোরই খেয়াল নেই। মিমি এক নার্সের কাছ থেকে শুনে ওয়াশ রুমে চলে গেল। ওখানে যেয়ে আবার গা গুলিয়ে উঠল। গড়গড় করে বমি করে ফেলল। পেটে যা ছিল সব উঠে গেল। মিমি মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছল। পেছন ফিরে তাকাতেই তার মুখের ওপর স্প্রে করে দিল কেউ। স্প্রের এতোটা তেজ ছিল যে মিমি কোনো সুযোগ পেল না কাউকে দেখার, কাউকে ডাকার। মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।

চলবে?

#হতে_পারি_বৃষ্টি
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩৯

মাঝ রাতে হাসপাতাল নিরব। সকল রোগী ঘুমিয়ে আছে, সাথে তাদের তাত্মীয় স্বজনও। করিডোর দিয়ে চঞ্চল পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে কয়েকজন নার্স এবং ওয়ার্ড বয়। তানিয়ার বাবা মা ইতোমধ্যে হাসপাতালে পৌঁছেছেন। তারা মনে মনে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছেন। কাইফ বহু কষ্টে মেঘকে নিজের পাশে বসিয়ে রেখেছে। মেঘের দৃষ্টি কেবল ওটির দিকে। তার হৃদপিণ্ড ধপ ধপ করে লাফাচ্ছে। মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে ‘আমার তানিয়ার কিছু হবে না তো? আমার বাচ্চাটার কিছু হবে না তো?’ কাইফ তাকে শান্তনা দেওয়া চেষ্টা করেছে। তবুও মেঘ তাদের সুস্থ অবস্থায় নিজ চোখে না দেখা পর্যন্ত শান্ত হতে পারবে না। প্রায় দু ঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে। আকস্মিক বাচ্চার কান্নাতে মুখোরিত হলো করিডোর। মেঘ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ওটির দরজা খুলে বের হয়ে এলেন একজন নার্স মুখে তার হাসি। কোলে শুভ্র তোয়ালে মুড়িয়ে রাখা ছোট্ট একটা শিশু। সকলে দাঁড়িয়ে পড়লেন। নার্স হাসি মুখে বললেন–

— অভিনন্দন! ছেলে হয়েছে। ছেলের বাবা কে?

মেঘ গলা কাঁপছে। তার ছেলে হয়েছে! এ কেমন সুখানুভূতি? বাবা হওয়ার সুখ বুঝি এমনই হয়? মেঘ এগিয়ে গিয়ে বলল–

— আ আমি।

— বকশিস না দিলে ছেলের মুখ দেখতে দেব না। আমাদের বকশিস চাই।

মেঘ পকেট হাতড়ে নার্সের হাতে তার মানিব্যাগ টায় তুলে দিল। ভাগ্যিস মানি ব্যাগ টা সাথে করে এনেছিল। মেঘ প্রফুল্ল কন্ঠে বলল–

— এতে যা আছে সব রেখে দিন। আমার ছেলেকে আমার কোলে দিন।

এতো বকশিস পেয়ে নার্স খুশিতে গদগদ হয়ে উঠল। নার্স খুব সাবধানের সাথে বাচ্চাটাকে মেঘের কোলে তুলে দিল। মেঘ তাকে আলতো ভাবে কোলে নিয়ে বসে পড়ল। ভয় হচ্ছে তার, ছোট্ট বাচ্চা আগে কখনও কোলে নেওয়া হয়নি। যদি পড়ে যায়? ছেলের মুখ দেখে মেঘের মুখ চকচক করে ওঠে। আলতো করে ছুঁয়ে দেয় ছেলের আঙুল। মেঘ নার্সকে বলল–

— আমার ওয়াইফ কেমন আছে?

— আপনার স্ত্রী একদম ভালো আছেন। একটু পর তাকে কেবিনে দেওয়া হবে।

নার্স চলে গেল। মেঘ ছেলের দিকে তাকায়, ছোট্ট শিশু নিভু নিভু চোখে তাকে দেখছে। মেঘ হাসে। সে হয়তো ভাবছে এ কোথায় আসলাম আমি? কাইফ শুধু ভাইকে দেখে। এক সময় যে ছোট্ট ভাইকে কোলে নেওয়ার চেষ্টা করত। এখন সে ভাই-ই নিজের ছেলে কোলে নিয়ে বসে আছে। কাইফ চোখ ভরে ভাইয়ের মুখের ঔজ্জ্বলতা দেখে। মিসেস রিতা এগিয়ে এসে বললেন–

— এই মেঘ! এবার আমাদের কোলেও একটু দে। দাদুভাই কে কোলে নেওয়ার জন্য তর সইছে না।

মেঘ এক গাল হেসে তার কোলে দিয়ে দেয়। এভাবেই ছোট্ট ছেলে সবার কোলে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। তানিয়াকে কেবিনে দেওয়া হয়। সকলে এক এক করে তার সাথে দেখা করতে যায়। হঠাৎ কাইফের কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এতক্ষণে হুঁশ ফিরল তার। সবাই তো ছিল, কিন্তু মিমি কোথায়? নাহ মিমি নেই। কাইফ খেয়াল করেনি যে মিমি তার আশে পাশে নেই। তাহলে কি ওয়াশ রুমে গিয়েছে? কাইফ তাকে খুঁজতে চলে গেল।

তানিয়া শুয়ে আছে। ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। মেঘ ঘুমন্ত ছেলেকে তানিয়ার পাশে শুইয়ে দিল। তানিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল–

— কেমন লাগছে এখন?

— ভালো। ছেলেকে দেখেছ?

— হ্যাঁ। একদম তোমার মতো হয়েছে।

তানিয়া ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল–

— মোটেও না। তোমার মতোও হয়েছে।

মেঘ তর্ক বাড়াল না। সকলে তানিয়ার সাথে টুক টাক কথা বলে বাইরে চলে গেলেন। তারা কিছুক্ষণ একা থাক। তানিয়া বলল–

— ছেলের জন্য নাম ঠিক করেছ?

মেঘ একটা টুল টেনে তানিয়ার পাশে বসে বলল–

— হ্যাঁ করেছি তো।

— কি নাম?

— মেঘরাজ খানের ছেলে তাহির খান। কেমন?

— খুব সুন্দর।

— এখন রেস্ট করো। চুপ করে ঘুমাও।

তানিয়া হেসে চোখ বন্ধ করে নিল। মেঘ তার পাশে বসেই একবার ছেলেকে আর একবার বউকে দেখতে লাগল।
—–

ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরছে মিমির। মাথাটা ঝিম মেরে আছে। ব্যথা করছে খুব। শরীরটাও দূর্বল লাগছে। মিমি নিভু নিভু চোখে তাকায়। অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পায় না। হাত নাড়াতে যেয়ে বুঝলো হাত বাঁধা আছে শক্ত করে। অনুভব করে চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে তাকে। মিমি মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করল। তার মনে পড়ে গেল ওয়াশ রুমের কথা। সেখানে কেউ তার মুখে স্প্রে করে দিয়েছিল। কিন্তু মিমি তার মুখ দেখতে পায়নি। মিমির বড্ড খারাপ লাগছে। কোথায় আছে সে? কেন তাকে ধরে আনা হয়েছে? তানিয়া এখন কেমন আছে? আর বাচ্চাটা সুস্থ আছে তো? শত শত প্রশ্ন কিলবিল করছে তার মাথায়। হঠাৎ মিমি খেয়াল করল তার মুখ বাঁধা নেই। মিমি চেঁচিয়ে উঠল। তবে দূর্বল থাকায় সে আওয়াজ বেশি দূর গড়ালো না।

— কেউ আছেন? হেল্প! আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন? আছেন কেউ?

মিমির গলা শুকিয়ে আসে। হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠে। আলোর তীব্রতায় মিমির চোখ বন্ধ হয়ে আসে। ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকায় সে। সামনে কাউকে বসে থাকতে দেখতে পেল। ভয়ে বুক ধক করে উঠল তার। থরথর করে কেঁপে উঠল। এ যে রায়হান তালুকদার! তাকে কি আবারও পাচার করে দেওয়ার জন্য ধরে এনেছে? রায়হানের পাশে দাঁড়ানো একজন মডার্ন মেয়ে। মিমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে গেল। জেসি! তাদের উভয়ের মুখে কুটিল হাসি। জেসি হেসে বলল–

— কি খবর মিসেস মিমি?

মিমি কথা বলে না। অবাকতা ঘিরে রেখেছে তাকে। মিমি ঢোক গিলে বলল–

— আমাকে এখানে এনেছেন কেন? কি চায় আপনাদের?

শব্দ করে ভয়ংকর ভাবে হেসে ওঠে দু’জনে। যেন মিমি খুব মজার কথা বলেছে। রায়হান বলল–

— তোমার সাথে আমার কোনো লেন দেন নেই।

— তাহলে? আমাকে বেঁধে রেখেছেন কেন?

— আমার দরকার কার সাথে জানো? কিং! আমার তো কিং কে চাই।

পাশ থেকে জেসি বলে উঠল–

— রায়হানের চায় কিং কে। আর আমার চাই কাইফকে। তোমাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে পারলেই কাইফ আমার।

মিমি বিস্ময়ে হতবাক। জেসির বিষয়টা সে বুঝেছে কিন্তু কিং এর জন্য তাকে কেন কিডন্যাপ করা হয়েছে? সে বলল–

— কিং এর জন্য আমাকে কেন কিডন্যাপ করেছেন? কিং এর সাথে আমার কি সম্পর্ক?

— আছে আছে। কিং এর সাথে তোমার গভীর সম্পর্ক আছে। কিং সেখানেই আবির্ভূত হয়েছে যেখানে তুমি ছিলে। তোমার সাথে সম্পর্কিত সব ঘটনায় কিং এর হস্তক্ষেপ আছে। এ্যান্ড আ’ম ড্যাম শিওর যে কিং এখানে আসবে এবং আসবেই। আর কিং কে শেষ করায় আমার একমাত্র উদ্দেশ্য।

মিমি রায়হানের কথা কিছুই বোঝে না। কিং তাকে বাঁচানোর জন্য কেন আসবে? সে তো কিং এর কেউ নয়। এর মধ্যেই জেসি বলল–

— রায়হান লেট মি ডু সামথিং।

সে মিমিকে চড় মেরে বসল। চড়ের তীব্রতায় মিমির মাথা ঘুরে উঠল। জেসি তার মুখ চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল–

— তোমার জন্য কাইফ আমাকে মেরেছিল। এটা তার শোধ নিলাম। এবার শুধু কিং কে আসতে দাও। তারপর তোমাকে চিরতরের জন্য ওপরে পাঠিয়ে দেব।

ভয়ংকর ভাবে হেসে উঠল দু’জনে। মিমির নিভু নিভু চোখে দেখল তাদের। মনে মনে শুধু একটায় কথা ঘুরছে মিস্টার খানের সাথে কি তার আর দেখা হবে না?

পুরো হাসপাতাল তন্ন তন্ন করে খুঁজেও মিমিকে পেল না কাইফ। দুশ্চিন্তায় তার প্রাণ ওষ্ঠাগত। তানিয়ার কেবিনের বাইরে ছিল সবাই। কাইফ সেখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করল–

— ছোট মা? মিমিকে দেখেছ? ও কি কোথাও গিয়েছে? তোমাকে বলেছে কিছু?

সকলের খেয়াল হলো মিমি এতক্ষণ তাদের সাথে ছিল না। মিসেস রিতা বললেন–

— না তো। মিমির সাথে আমার কোনো কথা হয়নি। কোথায় গেল মেয়েটা?

কাইফ তাদের নিশ্চিন্তে থাকতে বলে বলল–

— চিন্তা কোরো না। আমি দেখছি। আর তোমরা বাড়িতে চলে যাও। সকলের অনেক ধকল গিয়েছে। বাড়িতে গিয়ে রেস্ট নাও।

কাইফ দ্রুত পায়ে চলে গেল। তবে সকলে চিন্তিত রয়ে গেলেন। কোথায় গেল মিমি? কোনো বিপদ হলো না তো?

——
মিমি এখন যে রুমে বসে আছে সেখানে অনেক লোক আছে। অনেক লোক বলতে বন্দুক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গার্ড। জেসি ও রায়হান পাশাপাশি আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছে। অপেক্ষা শুধু কিং আসার। মিমির হাত এতো শক্ত করে বেঁধে রেখেছে যে তার হাতে দড়ির ছাপ বসে গিয়েছে। মিমি নিরব বসে আছে। সে জানে এখন এদের হাজার বললেও এরা কিছুই করবে না। কিছুক্ষণ আগে মিমি ভাবছিল কিং যে ভয়ংকর মানুষ! তার হাত থেকে রায়হান ছাড়া পেল কি করে? তার কৌতুহল বুঝতে পেরে রায়হান বলেছিল–

— তুমি ঠিকই ভাবছ। কিং এর হাত থেকে বাঁচা সহজ নয়। এক কথায় বলতে গেলে সম্ভবই নয়। কিন্তু আমি বেঁচে গিয়েছি। কীভাবে জানো? কিং এর লোকেরা যখন আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন আমার বিশ্বস্ত কয়েকজন কর্মচারী আড়ালে লুকিয়ে ছিল। সুযোগ বুঝে তারা কিং এর লোকদের মুখে ধুলো ছুড়ে মারে। ফলে তারা কিছুই দেখতে পায় না এবং আমার লোকজন আমাকে নিয়ে পালায়। কিং আমাকে আর ধরতে পারল না কারণ সে তোমাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তবে আজ পুরো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। কিং কে আজ দেখিয়ে দেব রায়হান কি জিনিস।

মিমি শুধু শুনে যায়। তার করার কিছুই নেই। কিং তার কাছে একটা রহস্য। সেটা কি আজ সমাধান হবে? তার খুব কান্না আসছে। ধীরে ধীরে শরীর নেতিয়ে যাচ্ছে। সেই যে রাতে তাকে এখানে আনা হয়েছে। তারপর একটা দিন পেরিয়ে আবার রাত নেমেছে। একটু পানি ব্যতীত তার পেটে কিছুই পড়েনি। এতো ধকল তার পক্ষে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। হঠাৎ বিকট আওয়াজ হলো। সকলে বন্দুক নিয়ে সতর্ক হয়ে গেল। রায়হান মুখ ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাল। আঁধারে একটি অবয়ব দেখা যাচ্ছে। অবয়ব টি ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। তার দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে মিমি অস্ফুট স্বরে আওড়াল–

— কিং!

চলবে?
{ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। }