হলদে প্রজাপতি পর্ব-১৬+১৭

0
171

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

ষোল

তারপর থেকে কতবার যে সেই দৃশ্য আমার মনের উঠোনে পুনরাবৃত্তি হয়ে চলল তার ইয়ত্তা নেই । চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই ওর আঙুলগুলো আমার আঙ্গুল ছুঁয়ে যাচ্ছে । চোখ খুললে দেখতে পাই, কার্নিশের গায় অসহায় ভাবে পড়ে রয়েছে আমার হাত দুটো, সোনুদার স্পর্শের অপেক্ষায় । ওর হাত দুটো নেমে এলো আমার হাতের ওপরে। ছুঁয়ে দিল । জাগিয়ে দিল আমার ঘুমন্ত হাত দুটোকে, আমার মন , আমার শরীর, আমার সত্তাকে । আমি চঞ্চল হয়ে উঠলাম । চঞ্চল ঝর্ণার মত অস্থির নৃত্যের তালে তালে কোন পাকদন্ডী বেয়ে অজানা কোনো একঢাল সহস্র-রঙা ফুলের ওপর দিয়ে নাচতে নাচতে নেমে চললাম পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ।
এমন করে ও ছুঁয়ে দিল আমায় ?
এমন করে ছোঁয়া যায়?
মা যে তবে বলে অনাত্মীয় কোন পুরুষ বিয়ের আগে ছুঁয়ে দিলে শরীরে পাপ ঢোকে? কোথায় সেই পাপ ? আমার মন তো পাখনা মেলেছে। প্রজাপতির মতো রঙিন পাখা মেলেছে। পাখির মত মেঘের মধ্যে দিয়ে উড়ে চলেছে । ঝর্নার মত পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বয়ে চলেছে । কোথায় পাপ? এ যে শুদ্ধ, পবিত্র , নির্মল । প্রকৃতির মতো অপাপবিদ্ধ। আমার মনের মধ্যে একেবারে নতুন সৃষ্টি হওয়া এই চঞ্চল ঝর্নার মতো আবেগকে আমি একা সামলে উঠতে পারলাম না । কাউকে বলতে না পারলে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা । একি সত্যি, না স্বপ্ন ? নাকি, কি ?
কিন্তু, সেদিনের পর থেকে একটা ব্যাপার ঘটল। আগে আমি সবসময় সিঁটিয়ে থাকতাম, পাছে সোনুদার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। কিন্তু সেদিনের পর থেকে আমি সব সময় উন্মুখ হয়ে থাকতাম একটিবার তার দর্শন পাবার আশায়। কিন্তু সোনুদা বিকেলে বেরোনো বন্ধ করে দিল। আমার সঙ্গে দেখা হওয়াও বন্ধ। কারণ বুঝতে পারতাম না । আবার স্বাভাবিক ভাবে একবার ওর বাংলোয় গিয়ে ওর সাথে দেখা করে জিজ্ঞাসা করে আসতেও পারতাম না । কেন আসছে না ও , কি বৃত্তান্ত । তবে মনের মধ্যে সবসময় সূচের মতো বিঁধে থাকতো সেকথা। সেদিনের পর থেকে সে শুধুমাত্র আমার কল্পনায় ধরা দিয়েছে। বাস্তবে একবারও না । আগে আমার সাথে দেখা না হলেও বান্টির কাছ থেকে ওর খবর পেতাম । এখন সে পথও বন্ধ । ছটফট করে বেড়াতে লাগলাম ভেতরে ভেতরে , একটি বার তার দেখা পাওয়ার জন্য। কিন্তু ও একবারও দেখা করলো না। আমিও ওর সাথে দেখা করার সাহস জোগাড় করে উঠতে পারলাম না । কি করি! এদিকে মনের ভেতর জোয়ারে ভাসা সমুদ্রের আবেগ । এই বড় বড় ঢেউ তৈরি হচ্ছে, আছড়ে পড়ছে । আর ওদিকে ও সম্পূর্ণ গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে । হঠাৎ করে একদিন এমনভাবে ছুঁয়ে দিয়ে কেউ এভাবে চোখের সামনে থেকে সরে যায় কি করে ? কি করব বুঝে উঠতে পারলাম না । কিন্তু, কিছু যে একটা করতে হবে, সেটা বুঝতে পারলাম । কি করি, কি করি ? হ্যাঁ, একজন আমায় এই ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে । অরুনিমা । অরুনিমাকে নিজের মনের সমস্ত আবেগ উজাড় করে বললাম সবটা। ও সম্পূর্ণটা মনোযোগ দিয়ে শুনে বিজ্ঞের মত মতামত দিল , আমি নাকি সোনুদাকে ভালবেসে ফেলেছি , আর সোনুদাও আমাকে । আর এমনটা যখন হয় , যখন দুটি ছেলে-মেয়ে পরস্পর পরস্পরকে ভালোবেসে ফেলে, তখন ছেলেটি যে মেয়েটির শারীরিক সান্নিধ্য চাইবে, তাকে ছুঁতে চাইবে, এটা খুবই স্বাভাবিক । সেক্ষেত্রে যদি সে বাধা পায়, তাহলে রাগ-অভিমান হওয়াটাও নাকি স্বাভাবিক। আমার নাকি সেদিন ওভাবে ছাদ থেকে ছুটে চলে আসাটা ভীষণ রকম অনুচিত কাজ হয়েছে। আমার সেজন্য সোনুদার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত । ক্ষমা চাইতে পারলেই ব্যাপারটা চুকে যাবে । ও আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরবে । আমার সঙ্গে আবার প্রতিদিন বিকেলে দেখা করবে, যেমনটা করতো ।

ব্যাপারটা খুবই গোলমেলে লাগলো । এই ক্ষমা চাওয়া ব্যাপারটা । কেন ক্ষমা , কিসের ক্ষমা ! আমি কেন ক্ষমা চাইবো, কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না । তবে অরুনিমার কথাগুলো শুনে একটা গ্লানিবোধ জমা হলো মনের মধ্যে । সত্যিই কী তবে আমি ওভাবে সেদিন ছুটে চলে আসার জন্যই ও রাগ করে আর আসে না? ক্ষমা চাওয়াটা প্রয়োজন । কিন্তু, ক্ষমা চাইবো কিভাবে? কি বলেই বা ক্ষমা চাইবো ? আমি তো সত্যিই কোন দোষ করিনি । একটা একটা করে দিন কাটতে লাগল । সেদিন সন্ধ্যাবেলার পর থেকে সাত দিন কেটে গেছে ,একবারও ও আমার সঙ্গে দেখা করেনি। ক্ষমা চাওয়ার ব্যপারটা মাথার মধ্যে বেশ জাঁকিয়ে বসলো । বুঝলাম ক্ষমা চাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু, কিভাবে? প্রতিদিনই ভাবতে লাগলাম , সেদিন কলেজ থেকে ফিরে বিকেলবেলা ওর বাংলোর দিকে যাব । ওকে জিজ্ঞাসা করব, আর ও বিকেলে বেরোয় না কেন ? কিন্তু সেই দৃশ্য কল্পনা মাত্রই আমার বুকের ভেতর অসম্ভব রকমের ঝড় তৈরি হতো । তারপরে ঠিক ন’দিনের মাথায় ভীষণ রকম অস্থিরতা পেয়ে বসল আমায়। বুঝতে পারলাম আর না গেলেই নয় ।

সেদিন কলেজ থেকে ফিরে অনেকটা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে বিকেলবেলা বেরোলাম। এক’ পা এক’ পা করে এগিয়ে চললাম ম্যানেজারের বাংলোর দিকে। যতই এগোই ততই মনের ভেতর অশান্ত ঝড় বয়ে চলে । যখন গেটটা খুলে এসে দাঁড়ালাম, তখন সেই ঝড়, ঘূর্ণিঝড়ের আকার ধারণ করে যেন আমার মনের ভেতরটাকে তছনছ করে দিচ্ছে । একবার ভাবলাম এমন ভাবে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর চেয়ে বরং অনন্তকাল তার সাথে দেখা না হওয়া মঞ্জুর । কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে । আঙ্গুলের ডগাগুলো হিমশীতল । না পারবো না আমি। কিছুতেই সোনুদার সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়াতে পারবো না। যদি বা যাই, গিয়ে বলব কি? আমার ফিরে যাওয়াই ভালো। মনে হতেই নিমেষের মধ্যে খোলা গেটের ওপারে গিয়ে গেটের মাথার দিকে যে বাঁকা লোহার ছিটকিনিটা ওপাশ থেকে এপাশে এনে ফেলতে হয়, সেটা ফেলে দিলাম । অস্থিরতার কারণেই হবে হয়তো , ঠং করে একটা ধাতব শব্দ হলো । আর তাতেই বাংলোর ভেতর থেকে একটা স্বর ভেসে এল,
— কে?
বুকের মধ্যে তখন আমার সুনামির ঢেউ আছড়ে পড়ছে । গলা শুনে বুঝতে পারলাম , আমার সোনুদার গলা নয় । ম্যানেজারের গলা হবে। কিন্তু তবুও যেন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়ার মতো, অপরাধে মাথা নিচু করে সেখানেই কাঠের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। পরক্ষণেই ম্যানেজার কাকু দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। এই মানুষটার দেখা খুব একটা বেশি পাওয়া যায় না। নিতান্ত ভদ্রলোক গোছের ধোপদুরস্ত একটা ব্যাপার রয়েছে । কথাবার্তা অত্যন্ত পরিশীলিত । প্রয়োজনের বেশি একটা কথাও বলেন না। নিজের কাজ নিয়ে মশগুল হয়ে থাকেন।
গেটের কাছে আমাকে দেখে বললেন, কিরে, তরুশী যে! কিছু বলবি ?
আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না । সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম ।
উনি বললেন , গেটের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে আয়!
যন্ত্রচালিতের মত গেটটা আবার খুললাম । ভেতরে পা রাখলাম । এক’পা এক’পা করে বাংলোর দিকে এগিয়ে চললাম । একেবারে সদর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম ।
উনি বললেন, ভেতরে আয় । ঘরে এসে বসবি?
— না , মানে-
উনি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন আমার দিকে । আমি কিছু বলছিনা, এদিকে ওনার এই দিকে কেন এসেছি বোধহয় বোঝার চেষ্টা করছিলেন।
তারপর একটু হেসে বললেন, তোর বিকেলবেলাটা সময় কাটছে না বল একদম ? বান্টির শরীর খারাপ হওয়ার পর থেকে? তাই এ দিকে । শৌণকটা কি করছে কে জানে ? ও বিকেল বেলাটায় একটু বেরোলেও ওর সাথে গল্প করতে পারিস, দুজনে মিলে। আজকে বেরোয়নি। দাঁড়া দেখি আমি ।
উনি ভেতরে চলে গেলেন । আর আমি কালবৈশাখী, সাইক্লোন, টর্নেডো, সুনামি, সমস্ত কিছু একটা ছোট্টো বুকের মধ্যে ধারণ করে দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে । সম্পূর্ণ এক মিনিটও পূর্ণ হওয়ার আগে সোনুদা এসে আমার সামনে দাঁড়ালো ।
আমাকে দেখে গম্ভীর মুখে বলল , কি ব্যাপার? এখানে?
গলার আওয়াজ শুনে আমার কান্না পেল । ভয় লাগলো । এমনধারা গম্ভীর গলার স্বর আমি সোনুদার কখনো আগে শুনিনি।
শুকনো গলায় ঢোঁক গিলে বললাম , না এমনি –
আমার অবস্থা তখন যাঁতাকলে পড়ে ইঁদুরের মতো । সেখান থেকে এক ছুটে পালিয়ে যেতে চাইছি , কিন্তু পারছিনা।
ম্যানেজার কাকু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, শৌণক, তরুশী মনে হচ্ছে তোমাকেই ডাকতে এসেছে । একা একা আর কি ঘুরবে? দুজনে মিলে যাও বরঞ্চ, কাছাকাছি ঘুরে এসো । ভালো লাগবে । এত সুন্দর জায়গা। বিকেলবেলা ঘরের মধ্যে বসে থাকতে ভালো লাগে ?
সোনুদা ম্যানেজার কাকুর কথা শুনে আরো গম্ভীর হয়ে বলল, আমাকে একটা প্রজেক্ট রিপোর্ট রেডি করতে হচ্ছে ।
বলে আমার দিকে তাকিয়ে সরাসরি বলল, তুমি চলো আমার স্টাডিতে, কিছুক্ষণ ওয়েট করবে । একটা প্যারা চলছে । সেটা কমপ্লিট হয়ে গেলে আমি বেরোতে পারি তোমার সঙ্গে।
ব্যাপারটার যে এত সহজ নিষ্পত্তি হয়ে যাবে, আমি ভাবতেও পারিনি ।
বললাম, ঠিক আছে । চলুন । আমি ওয়েট করছি ।

ওর পিছন পিছন ওর স্টাডিতে এসে উপস্থিত হলাম । সেদিন প্রথম আমি ওর কোনো একটা ঘরে এলাম। সম্পূর্ণ বাংলোটা পার্টিশন দিয়ে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়েছে । ডান পাশটা ম্যানেজার কাকুর। বাম পাশটায় সোনুদা থাকে। সোনুদার অংশ বলতে এখানে শুধুমাত্র একটা বেডরুম, একটা স্টাডি রুম, টয়লেট আর একটা ছোট্ট কিচেন। অবশ্য সেদিন শুধুমাত্র ওর স্টাডি রুমটাই আমি দেখেছিলাম । ঘরভর্তি বিভিন্ন সাবজেক্টের বইপত্র, জার্নাল। বুঝলাম ও ওর রিসার্চের জন্য ওইসব বইপত্র নিয়ে এসেছে । ঘরের বাঁদিকের কোণে একটা ডেস্কের ওপরে একটা কম্পিউটার বসানো । এই যন্ত্রটার সঙ্গে আমার তখনও পর্যন্ত একেবারেই কোন পরিচয় ছিল না। কয়েক’টা জায়গায় দেখেছি , এই পর্যন্ত । অজিত কাকুর বাংলোর লাইব্রেরীতে একটা আছে । অজিত কাকু মাঝে-মধ্যে বসে কি সব কাজ করেন । বান্টিও কম্পিউটার জানে । তবে আমি এই যন্ত্রটার ব্যাপারে তখনও পর্যন্ত কিছুই জানতাম না । অজানা যে কোন বস্তু ঘিরেই একটু ভয় থাকে । এমনিতেই সোনুদাকে আমি মনে মনে ভয় করি । তার ওপরে ওর স্টাডি রুম জুড়ে বিভিন্ন ধরনের বইপত্র, জার্নাল । তার সাথে একটা কম্পিউটার । সমস্ত কিছু দেখে আমি রীতিমত ঘাবড়ে গেলাম ।
ঘরে ঢুকে সোনুদা আমাকে সেরকম গম্ভীর গলাতেই একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল, বস !
আমি জড়োসড়ো হয়ে বসলাম। কম্পিউটারের সামনে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে কীপ্যাডে টকটক্ টকাটক্ টাইপ করতে লাগল ও। আমি পাশ থেকে দেখতে পাচ্ছি কম্পিউটার স্ক্রিনের উপর লেখাগুলো ফুটছে । ইংলিশে কী স্পিডে টাইপ করে যাচ্ছে সোনুদা ! ঘরের মধ্যে যে কটা বইপত্র বা জার্নাল আমি দেখেছি, প্রত্যেকটাই ইংরেজিতে। একটাও বাংলা বই নেই। কম্পিউটার যন্ত্রটা তখন আমার কাছে কিছুটা টিভির মতো । ভাবতাম বুঝি মনিটরটাই সব । তাছাড়া আর কোন পার্টস সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না । সোনুদা আমার সাথে একটাও কথা না বলে মনোযোগ দিয়ে টাইপ করতে লাগলো। আমিও বসে বসে কিছুটা তন্ময় হয়ে সোনুদার টাইপ করা দেখছিলাম।
কিছুক্ষন পর সে ঘাড়টা অল্প ডান পাশে ঘুরিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি কম্পিউটার জানো?
ওর আঙুলগুলো কিন্তু টাইপ করেই চলেছে। আমি একটা ঢোঁক গিলে বললাম , না !
— সেকি ! এত বড় হয়ে গেছো, এখনো কম্পিউটার জানো না?
লজ্জিত মুখ নামিয়ে নিয়ে বুকের সঙ্গে প্রায় সেঁটে ফেলে বললাম, না-
ও আর কিছু বলল না। স্পিডে কিছুক্ষণ টাইপ করে নিয়ে তারপর কম্পিউটারটা অফ করে দিয়ে আমার দিকে ঘুরে বসলো ।
বলল, তুমি আমার সাথে দেখা করতেই এসেছ নিশ্চয়ই এখানে ?
আমি হ্যাঁ না কিছু বললাম না ।
ও বলল, কি বলবে বলো ।
আমি অবুঝ চোখে তাকালাম ।
অল্পক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল , কি হল, বল কি বলবে ? কিছুতো একটা বলবে বলে এসেছ আমার সঙ্গে দেখা করতে?
আমি বললাম , না ,এমনি ভাবলাম আপনি আর বেরোচ্ছেন না বিকেলবেলায়-
ও বলল , কাজ করছি দেখতেই তো পাচ্ছো ।
গলার মধ্যে কেমন যেন একটা উদাসীন কাঠিন্য ।
আমি আমতা আমতা করে বললাম, হ্যাঁ তা –
ও বলল, তাছাড়া তুমি তো আগেই আসতে পারতে। এতদিন তো কই আসোনি ?

এটাকেই কি অভিমান বলে?
ও কি আমার ওপর অভিমান করে বেরোয়নি?
অভিমান , যতদিন গেছে, বেড়েছে?
আমি বললাম, আজকে তো কাজ শেষ হয়েছে এখনকার মতো। এখন বেরোবেন না ?
ও কিছুক্ষণ মুখ নিচু করে মাথার মধ্যে পাঁচটা আঙ্গুল চালিয়ে নিয়ে মুখ তুললো। যখন মুখ তুললো , তখন দেখলাম ওর মুখে ফিরে এসেছে সেই দুষ্টুমি মাথা হাসিটা ।
আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বেরোতে পারি। একটা কথা বলো তো। তুমি হঠাৎ করে আমাকে ডাকতে চলে এলে যে?
এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই আমার কাছে ।
নেই , নেই ।
আমি মাথা নীচু করে বসে রইলাম । ও আমার লজ্জার ভারে নত মুখটার দিকে তাকিয়ে একটা নির্দয় প্রশ্ন করে বসলো।
বলল , সেদিন ছাদের মধ্যে এভাবে ছুটে পালিয়েছিলে কেন? আমি রয়েছি সেখানে। একবারও আমাকে না ইনফর্ম করে, আমার পারমিশন না নিয়ে, তুমি আচমকা ছুটে চলে গেলে যে ?
প্রশ্ন শুনে আমার কেমন গা-গোলাতে লাগলো।
ও বলল, যাকগে, যা করেছ, করেছ । আমি তোমার সঙ্গে আজকে বেরোতে পারি। বাট আই হ্যাভ টু কন্ডিশনস।

কন্ডিশন? আবার শর্ত দেওয়া হবে ? কি শর্ত কে জানে !
আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম ।
ও বলল, কি শর্ত মানতে পারবে তো নাকি ?
আস্তে আস্তে বললাম, সেটা , শর্ত কি, না শুনে বলব কি করে?
ও বললো, টু কন্ডিশনস, নাম্বার ওয়ান, আমি থাকলে ওভাবে কখনো আমার কাছে পারমিশন না নিয়ে হুট করে চলে যাওয়া যাবেনা । আর নাম্বার টু, আমাকে ‘আপনি’ বলা চলবে না, ‘তুমি’ করে কথা বলতে হবে।

এ আবার কি শর্ত রে বাবা ! শুনে হাত-পা ভেতরে সেঁধিয়ে এলো । প্রথমটা যদি বা চেষ্টা করতে পারি , দ্বিতীয়টা ভাবতেই আমার গলা শুকিয়ে কাঠ! সোনুদাকে ‘তুমি’ করে বলবো আমি ! সেটা কিভাবে সম্ভব ?
কোন উত্তর দিলাম না । চুপ করে মাথা নামিয়ে বসে রইলাম ।
ও বলল , কী , শর্তে রাজি?
আমি তবুও চুপ। ও কিছুক্ষণ ভাবার সময় দিলো আমায় ।
তারপর বলল, চটপট বল । রাজি হলে যাব । নয়তো এখন তুমি এসো ।
মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল । ও কি অবলীলায় বলে দিলো, আমি শর্তে রাজি না হলে আমি যেন এখন এখান থেকে উঠে যাই। কি করি? কি করি?
মাথা নিচু করে প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বললাম , চেষ্টা করব।
বলল , কি ? শুনতে পেলাম না । ভালো করে বল।
গলাটা ঝেড়ে নিয়ে অতি কষ্টে একটু জোরে বললাম, চেষ্টা করে দেখব ।
ওর দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম, ও সেই আগের মতো করে মিটিমিটি হাসছে ।
বলল, ঠিক আছে । চলো একটু ঘুরে আসি তোমার সাথে ।
আমি সর্বাঙ্গে লজ্জা মেখে উঠে দাঁড়ালাম । ছি ছি ছি, কী লজ্জার কথা ! সোনুদাকে ডাকতে এলাম। তাতেও হলো না । ওর অনৈতিক শর্তে রাজি হয়ে গেলাম ।
শর্তটা কি সত্যিই অনৈতিক?
কি জানি!
সে ঘর থেকে বের হতে যাচ্ছি, ও বলল, এখানে মাঝেমাঝে আসবে, আমার স্টাডি রুমে। এত বড় মেয়ে, এখনো কম্পিউটার জানো না ? লজ্জা করে না তোমার ? কম্পিউটার শিখে নেবে আমার কাছে ।
লজ্জায় মরে গেলাম । সময়-সুযোগ পেলেই আমাকে ও লজ্জা দিতে ছাড়েনা । এমনও তো বলতে পারতো – ‘কম্পিউটারটা শিখে নেওয়া ভালো , মাঝে মাঝে এসো আমার কাছে । আমি শিখিয়ে দেবো । ‘
তা নয়, ‘এত বড় মেয়ে, এখনো কম্পিউটার জানো না’
আমার বেশ কিছু বান্ধবী আছে, যারা জানেনা । একেবারে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে নাকি কম্পিউটার না জানলে?
কিছু বললাম না। একদিকে ঘাড় কাত করে অস্ফুটে জানালাম, আসবো ।
সেদিন ও বেশ কিছুক্ষণ ঘুরেছিল আমার সঙ্গে।

আমি সেদিনের সমস্ত কথা পরের দিনই অরুণিমাকে বলেছিলাম ।
অরুনিমা শুনে চোখ দুটো বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, কোনো ভুল নেই রে ! কোনো ভুল নেই। আমি ঠিকই বুঝেছি । হুঁ হুঁ বাবা! আজকে তিন বছর হয়ে গেল প্রেম করছি রে । এসব ব্যাপার বুঝতে আমার কোন ভুল হয় না । ও তোকে খুবই ভালবাসে । তাই জন্যেই তুই এভাবে ছুটে চলে যাওয়ায় ওর খুব অভিমান হয়েছিল ।
অরুনিমার কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার শরীর, মনের ভেতর কেমন যেন একটা অস্থির অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছিল। গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল।
ভালোবাসে ?
সোনু দা আমাকে ভালোবাসে ?
ঈশ্বর ! আমার কপালে এত সুখও ছিল ! মনে মনে বলেছিলাম , কি আছে তরু তোর ? এইরকম একটা সাদামাটা মেয়ে হয়ে সোনুদার মতো একজনের মন জয় করতে পেরেছিস ? ব্রাভো! তরু ব্রাভো !
ভেবেছিলাম সেই মানুষটা বিশেষ বলেই সে সাধারণের মধ্যেও বিশেষ কিছু খুঁজে নেয় । আমার মত সাধারন একটা মেয়ের মধ্যেও সে নিশ্চয়ই তবে বিশেষ কিছু খুঁজে পেয়েছে ।
তারপরে কয়েকদিন আবার আগের মতোই আমরা দুজনে বিকেলবেলায় কিছুক্ষণ করে বেড়াতে বেরোতাম ।

তারপরে একদিন হঠাৎ এল সেই দিন ! সেই বিশেষ দিন! অবশ্য ওর সাথে দেখা হওয়া প্রতিটা দিনই আমার কাছে বিশেষ । তবু বিশেষ এর মধ্যেও বিশেষ কিছু থাকে । এই সেই দিন , যেদিন কলেজ শেষ হওয়ার পর যথারীতি প্রতিদিনের মতো যেখানে আমার জন্য গাড়িটা ওয়েট করে থাকে, সেদিকে চলেছিলাম আমি । আমার সঙ্গে অরুনিমাও থাকতো। আমি গাড়িতে উঠে পড়তাম। ওর বাড়ি কাছেই, শিলিগুড়িতেই । ও সাইকেল নিয়ে কলেজে আসত। সাইকেলটা নিয়ে আমার পাশে পাশে হাঁটতো । আমি গাড়িতে উঠে পড়লে ও সাইকেল চালিয়ে বাড়ি চলে যেত। সেদিন গাড়ির দরজা খুলে বসতে যাব, হঠাৎ করে চোখ আটকে গেল ড্রাইভারের সীটে। আমি কি ভুল দেখছি! নাকি কোনো স্বপ্ন দেখছি ? ড্রাইভারের সীটে বসে রয়েছে সোনু দা ! আমি দরজা খুলে বসতে গিয়েও যেনো স্ট্যাচুর মত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম ওকে দেখে ।
ও মাথাটা বাঁ পাশে ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কি হল? উঠে বস ।
অরুনিমা তখনও সাইকেল নিয়ে আমার পাশেই দাঁড়িয়ে । ও জিজ্ঞাসু চোখে একবার তাকালো আমার দিকে । প্রতিদিন ও আমার ড্রাইভারকে দেখে । সেদিন অপরিচিত একজনকে দেখে , আর সে যে কোন মতেই কোন অ্যাঙ্গেল থেকে ঠিক ড্রাইভার নয়, সেটা বুঝেই আমার দিকে ওভাবে তাকিয়েছিল। আমি ওকে কি উত্তর দেবো ? তখন যে আমার মনের ভেতরে কি চলছে, তা স্বয়ং ঈশ্বরও জানেন না । আর, আমিও জানতাম না , সেই দিনটা আমার কাছে ঠিক কতখানি বিশেষ দিন , সমস্ত দিক থেকে । বিশ্বের সব আনন্দ, দুঃখ, উত্তেজনা, সমস্ত অনুভূতি মিলেমিশে গিয়ে সেই দিনটা আজও আমার কাছে ঠিক ততোখানিই বিশেষ।

ক্রমশ..

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

সতেরো

অরুনিমার কৌতুহলী চোখে ভুরু নাচিয়ে করা প্রশ্নের আমতা-আমতা জবাব দিলাম, ইয়ে –
গলা ঝেড়ে বললাম , শৌণক দা! উনি রিসার্চ করছেন।
অরুনিমা ছোট্ট একটা ‘ও’ বলে মুখ নিচু করে হাসতে লাগলো ।
সোনু দা গলাটা একটু বাড়িয়ে আমার পিছন থেকে ওকে দেখে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল , বান্ধবী নাকি ? ইউর বেস্ট ফ্রেন্ড ?
— হ্যাঁ , ও অরুনিমা ।
ও বললো , ওকে অরুনিমা! আর একদিন না হয় তোমার সাথে ভালো করে পরিচয় করা যাবে । আজকে একটু তাড়া আছে । চললাম, বাই ।
বলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, উঠে এসো গাড়িতে ।
আমি ড্রাইভার কাকুর পাশের সিটে বসেই বাড়িতে ফিরতাম প্রতিদিন । বান্টি তো এখন আর আমার সাথে থাকে না । তাই পেছনের সিটে আমি বসি না । ড্রাইভার এর পাশের সিটে বসে অনেক ভাল দৃশ্য দেখা যায়। কিন্তু , সোনুদাকে ড্রাইভারের সিটে দেখার পর থেকেই আমার মাথা গুলিয়ে গেছিল । এমন অপ্রত্যাশিত কিছু আমি আমার কল্পনাতেও কোনোদিন ভাবি নি ।
সোনু দা আমার ড্রাইভার !
আমি ঘাড় হেঁট করে পিছনের দরজাটা খুলে বসতে যাচ্ছিলাম ।
সোনুদা ঘাড়টা বাঁ পাশে ঘুরিয়ে আমাকে একটা ছোট ধমক দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল , ওখানে কোথায় বসছ ? সামনে এসে বসো !
আমি বাধ্য মেয়ের মত ড্রাইভারের পাশের সিটে গিয়ে বসলাম , কোলের ওপর ব্যাগটা নিয়ে জড়োসড়ো ভঙ্গিতে । ও একবার আড়চোখে আমাকে জরিপ করে নিয়ে আমার কোলের উপর থেকে ব্যাগটা বাঁ হাতে তুলে নিয়ে সেটাকে পেছনের সিটে ছুঁড়ে দিল। মুখে কিছু বলল না । শুধু ঠোঁটটা বেঁকিয়ে একটা শব্দ করলো, হুঁহ্।
বলে, গাড়ি স্টার্ট দিল ও ।
আমি ঘাড়টাকে আরষ্ঠ করে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলেও, আড়চোখে মাঝে মাঝেই ওর গাড়ি চালানোর ভঙ্গিমাটি দেখে নিচ্ছিলাম। একজন মানুষকে ভালবাসলে, তাকে নতুন নতুন ভঙ্গিমায় এবং কাজের মধ্যে দেখতে যে কোনো মেয়ের খুব ভালোলাগে । আমারও একটা অদ্ভুত গা’ শিরশিরে অনুভূতিতে সমস্ত শরীরটা ভরে উঠছিল । তার সাথে মনে হচ্ছিল- ইস্! বড্ড সাদামাটাভাবে আজকে কলেজে চলে এসেছি । ও আসবে জানলে, হয়তো কলেজ থেকে বেরোনোর আগে মুখটা একবার ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতাম । ব্যাগের মধ্যে একটা চিরুনি থাকে, চুলটা একটু পরিপাটি করে আঁচড়ে নিতাম। একটা ছোট্ট টিপের পাতা নিয়ে আসতাম, একটা টিপ পরে নিতাম কপালে । একটা কাজল পেন্সিল নিয়ে আসতাম, একটু কাজলের ছোঁয়া লাগাতাম চোখে। কীভাবে না জানি চলে এসেছি ! সারাদিনের ক্লাস, ধকল , ভূতের মত লাগছে না তো আমায়?

শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা চলে আসার পর যখন দুদিকে শুধুই চা বাগানের স্নিগ্ধতা, তখন সেই সমস্ত দৃশ্যপট আমার মনের ভেতর অদ্ভুত মুগ্ধতা সৃষ্টি করলো। শুধুমাত্র প্রকৃতির সৌন্দর্য একভাবে মুগ্ধ করে, আর প্রকৃতির সঙ্গে প্রেম , দু’য়ে মিলে সম্মিলিত যে মুগ্ধতা সৃষ্টি করে, তা একেবারে অনবদ্য । প্রতিদিনের যাওয়া-আসার চেনা পথ আমার কাছে এক নতুন রূপে ধরা দিলো । বেশ কিছুটা চা বাগানের পথ চিরে গাড়ি চালানোর পর, ও মেইন রোড থেকে সাইডের একটা রাস্তা ধরল।
জিজ্ঞাসা করবো , কি করবো না , এরকম একটা দ্বন্দ্ব মনের মধ্যে রেখেই একসময় জিজ্ঞাসা করে ফেললাম,
— আমরা কোথায় যাচ্ছি?
উত্তরে ওর মুখে শুধুমাত্র একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠল । সেই প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে ও আমায় বলল,
— তোমার বান্ধবী মনে হয় আমার তোমাকে কলেজ থেকে নিতে আসা দেখে বেশ মজা পেয়েছে ।
আমি মুখ নিচু করে নখ খুঁটতে খুঁটতে বললাম, না মানে .. প্রতিদিন ওই ড্রাইভার কাকুকে দেখে তো । তাই-
ও বলল, তুমি একবারও জানতে চাইলে না তো, আজকে আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি কেন।
আমি বললাম, ড্রাইভার কাকু কি কোন কারনে আসতে পারলেন না ?
ও এবারেও সেই অন্য প্রসঙ্গে কথা বললো, দেখো আবার ! আমি এসেছি, তোমাকে হয়তো এমন জায়গায় নিয়ে চলে গেলাম, তুমি হারিয়ে গেলে !
বলে ওর স্বভাবসিদ্ধ হাসিটা হাসলো ।
আমি আর কিছু বললাম না । কিছুটা ভেতরে ঢোকার পর মেঠো রাস্তার ওপরে ও গাড়িটা ব্রেক কষে দাঁড় করিয়ে দিল। নিজে ড্রাইভারের সিট থেকে নেমে পড়ল ।
আমার দিকে তাকিয়ে বলল, নেমে এসো আমি গাড়ি থেকে-
নেমে পায়ে পায়ে এগিয়ে ওর পাশে এসে দাঁড়ালাম । যদিও মনে তখন পুলকের জোয়ার লেগেছে , তবুও জিজ্ঞাসা করলাম , এখানে .. না.. মানে , এখানে কেন –
ও বলল, সব সময় কি বাড়ির চারপাশের চা বাগানগুলো দেখতেই ভালো লাগে ? এখানটা কি সুন্দর অন্যরকম । তাই না ?
আমি যেন ওর কথায় আবিষ্ট হয়ে চারিদিকে নতুন করে চোখ বুলোলাম। এই সমস্ত চাবাগান, আশেপাশের প্রকৃতি, সবকিছুর রূপ-রস-গন্ধ তখন পরিবর্তন হয়ে গেছে আমার কাছে । সমস্ত কিছুর নতুন অর্থ আমি দেখতে পেলাম । চা গাছের পাতার যে শ্যামলিমা , তা স্বর্গীয় । আমি দেখতে পেলাম , যে সমস্ত পাখিগুলো কিচিরমিচির করছে আশেপাশে, তাদের গলার স্বর যেন স্বর্গের বীণা। আমি দেখতে পেলাম , চা বাগানের ফাঁকে ফাঁকে হলুদ রঙের ছোট ছোট যে প্রজাপতিগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে, সেগুলো যেনো হলুদের কোন অপার্থিব প্রকাশ। এত প্রজাপতি ওড়ে চা বাগানে, কই আগে তো চোখে পড়েনি ? সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে হলুদ প্রজাপতিগুলো যেনো কোন অদৃশ্য রংয়ের জাল বুনে চলেছে। অনন্ত তার বিস্তৃতি ।
ও বলল , হঠাৎই বলে উঠল , আবার যথারীতি এক বিটকেল প্রশ্ন,
— তুমি কি চা খাও ?
— কি চা ?
ওর করা প্রশ্নটাই আবার স্খলিত গলায় করে ফেললাম আমি ।
ও বললো , হ্যাঁ, কি চা খাও ?
— এমনি দুধ চা।
বেশ গলা ছেড়ে হেসে উঠল ও। হাসিতে উপহাসের সুস্পষ্ট ছাপ।
বলল , তুমি দুধ চা খাও ! ও মাই গড !
আমার অল্প রাগ হলো । এই এত সুন্দর পরিবেশের মধ্যে গাড়ি এনে থামিয়েছে , কোথায় ভেবেছিলাম , দু একটা ভাল ভাল কথা অন্তত বলবে। তা নয় , সেই আবার যদি ঠুকেই কথা বলতে হয় , তাহলে এখানে নিয়ে এসেছে কেন আমায় ?
বললাম, হ্যাঁ দুধ চা’ই খাই । তাতে হাসার কি হয়েছে ? সবাই তো তাই খায়।
— তুমি এই নর্থ বেঙ্গলের চা বাগানের মধ্যে বসে দুধ চা খাও? দুধ চা’য় তো চায়ের ফ্লেভারটাই পাওয়া যায় না ।
ব্যাজার মুখে বললাম, তাহলে কি চা খাব ?
— র’চা খাবে । ব্ল্যাক টি । আ্যটলিস্ট চা পাতার ফ্লেভারটা তো পাবে ।
— ছি ! আমার ওই তেঁতো মার্কা কষাটে র’চা একদম ভালো লাগে না খেতে ।
ও বলল , সেই জন্যই তুমি এরকম ।
নিজে থেকেই ভুরুটা অল্প কুঁচকে গেল আমার । ওর দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বললাম, এরকম বলতে ?
বলল , তোমার বডিতে ফ্যাট জমার টেন্ডেন্সি রয়েছে। তুমি বুঝতে পারো না ?
লজ্জায় বিরক্তিতে আমার কানের লতিগুলো লাল হয়ে উঠল । একদম ভালো লাগলো না কথাটা ।
আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললাম , তার সঙ্গে চা খাওয়ার সম্পর্ক কি ?
— অবশ্যই চা খাওয়ার সঙ্গে যোগাযোগ আছে । গ্রিন টি খাবে সকাল-বিকেল । অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট । যোগা করবে । দেখবে , শরীরে ফ্যাট জমতে পাবে না ।
আমি কিছু বললাম না । একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম । ও-ও চুপ করে রইলো । ঠোঁটের ডগায় চলে এসেছিল একটা কথা – ‘আমি একদম ভালো নই, না ? দেখতে ?’ কিন্তু সেটা আর বলে উঠতে পারলাম না । কারণ সেটা বলে ফেললেই অভিমানের অবরুদ্ধ বাষ্পচাপ ঠেলে ভেতর থেকে কথাটা বেরিয়ে আসবে । যেটা বাঞ্ছিত নয় ।
ও আবার ঝট্ করে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে ফেললো । বললো , নট অনলি গ্রিন টি । কত টাইপের চা-পাতার প্রসেসিং হয় জানো তুমি? ডু ইউ নো অ্যাবাউট হোয়াইট টি ?
কোন কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না।
তেঁতো মুখে জবাব দিলাম, না ।
— এগুলো জানতে হবে তো । তুমি চা বাগানের মধ্যে থাকো । বাট ইউ আর লিস্ট ইন্টারেস্টেড আ্যবাউট দা প্রসেসিং অফ টী লীভস্। র’চা বা দুধ’চা করার জন্য আমরা নরমালি যে ধরনের চাপাতা ইউজ করে থাকি, তার থেকে অনেক মিনিমাম প্রসেসিং করা হয় গ্রীণ টি’ বানানোর জন্য। আর হোয়াইট টি বানানোর জন্য, প্রায় কোন প্রসেসিং করাই হয় না । অনলি ড্রায়েড লীভস্।

আমি দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বললাম , আমার প্রয়োজন নেই ওসব জানার । আপনি নিজের নলেজ নিজের কাছে রাখুন।
ও হেসে বলল, ওকে লিভ দেন । আই থিঙ্ক ইউ আর গেটিং এম্বারাসড ।
আমি পায়ে পায়ে চা বাগানে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে ওর থেকে কিছুটা দূরে চলে এসেছিলাম । অভিমান জমা হয়েছিল প্রচুর । জমা হওয়াই স্বাভাবিক । আমি তখন অষ্টাদশী তরুণী । শরীর জুড়ে মেদের আধিক্য না থাকলেও , আমাকে কোন কালেই স্লিম বলা চলে না । বুকদুটো বয়ঃসন্ধির পর থেকেই একটু বেশি ভারী । তবে তখন ততটা ছিল না । কোমরের খাঁজে কোন চর্বি ছিল না তখন। হাত-পা সুডোল, নিটোল । কন্ঠার হাড় বেরোনো না হলেও , ঘাড়ে-গর্দানে মোটেই ছিল না। বা ভবিষ্যতে এমনটা হতে পারে , সেরকম কোন ইন্ডিকেশন-ও ছিল না । কাজেই ওর চেহারা নিয়ে বলা কথাগুলো বড় কষ্ট দিয়েছিল আমায় । ও কি তবে আমার চেহারাটা পছন্দ করে না ? কোন কিছু অপছন্দ হলেও কি ভালোবাসা যায় ? পছন্দ, ভাললাগা , এগুলো কি ? আর ভালোবাসা কি ? ভালোলাগা থেকেই কি ভালোবাসা জন্ম নেয়? এই রকম নানাবিধ প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে লাগলো । আমি আনমনে কিছুটা এগিয়ে গেলাম ওর থেকে। ইচ্ছে করেই ওর থেকে একটু দূরে সরে যেতে চাইলাম । ও সেদিন নিজে ড্রাইভ করে আমায় কলেজ থেকে আনতে গিয়েছিল । কারণ আমার জানা নেই , তবে মনের মধ্যে পুলকের কোন অন্ত ছিল না । ও আমাকে ড্রাইভ করে কিছুটা অন্য রাস্তায় নিয়ে এসে একটা চা বাগানের মধ্যে ফেলেছে। হারিয়ে যেতে চেয়েছিলাম আমি ওর সঙ্গে । দুচোখ বাষ্পাকুল হয়ে উঠল । জল জমা হলো না ঠিকই , তবে সংশয়ের বাষ্প জমা হলো । মিনিট দশ-পনেরো হবে , আমি চুপচাপ কোন কথা না বলে নিজের মনের জগতে ডুব দিয়ে ওর থেকে কিছুটা দূরে চলে এসেছি ।
হঠাৎ করে পেছন থেকে ওর গলা পেলাম, কি সত্যি করেই হারিয়ে যাবে নাকি ? এরপর তো আমি আর তোমায় খুঁজে পাবো না ।
আমি ওর প্রশ্নের কোন উত্তর দিলাম না বটে , তবে দাঁড়িয়ে পড়লাম । ও কিছু একটা বললে, সরাসরি সেটা অমান্য করার ক্ষমতা আমার ছিল না। পাশেই একটা শেড ট্রি ছিল । সেটার গায়ে হেলান দিয়ে ওড়নার খুঁটটা টেনে নিয়ে ডান হাতে করে বাঁ হাতের তর্জনীতে পেঁচাচ্ছিলাম মুখ নিচু করে । ও এগিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়ালো ।
আমার নত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ওহো, ম্যাডাম মনে হচ্ছে এম্বারাসড্ নয় , রাগ করেছে ।
আমি চকিতে একবার চোখ তুলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে নিলাম । ওর মুখে লেগে রয়েছে সেই রহস্যময় হাসিটা ।
আমি চোখ নামিয়ে নেওয়ার পরক্ষণেই ও বললো , কই দেখি তাকাও আমার দিকে । কতটা রাগ হয়েছে তাহলে বুঝতে পারবো।
কিন্তু আমি ওর দিকে তাকাবো না এখন ।
কিছুতেই তাকাবো না ।
তাকাবো না, তাকাবো না !
ও বলল , বাব্বাহ্, অনেকটাই রাগ হয়েছে মনে হচ্ছে । তা , রাগের কারণটা শুনি।
আমি এবার কথা বললাম । মুখ নিচু করেই বললাম , যদিও আসল কারণটা বললাম না ।
বললাম , আচ্ছা আপনি কি ভাবেন বলুন তো ? আপনার রিসার্চ এরিয়াটাই কি সব ? তার বাইরে আর পড়াশোনা করেন না আপনি ? লিটারেচার পড়েন না ?
ও ঠোঁট টিপে হাসলো । বলল , বা রে ! পড়বো না কেন? শুনবে তুমি ?
আমি জিজ্ঞাসু চোখে ওর দিকে তাকালাম । ও যে ঠিক কি শোনাতে চাইছে বুঝতে পারলাম না ।
ও আমার চোখের দিকে চোখ রেখে কেটে কেটে আবৃত্তি করার ভঙ্গিতে বলল , পাবলো নেরুদা কি বলেছেন জানো? –
‘ You start dying slowly
If you avoid to feel passion
And their turbulent emotions;
Those which make your eyes glisten
And your heart beat fast.’
তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করল , ক্যান ইউ ফিল ?
আমার অসহায় লাগছে । ভীষণ অসহায় লাগছে । ওকে লিটারেচারের কথা বলতে হঠাৎ করে যে ইংরেজি কবিতা আওড়াতে আরম্ভ করে দেবে ভাবতে পারিনি ।
আমি ঢোঁক গিলে বললাম, কি ?
ও বলল, ইমোশন অফ দোজ লাইনস্?
আমি কোন উত্তর দিলাম না । বুঝতে পারলাম আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে । কবিতার লাইনগুলো আমার খুবই ভালো লেগেছে। তবে ও যে ঠিক কোন অ্যাঙ্গেল থেকে কি কি প্রশ্ন করতে আরম্ভ করবে সেটাই ভাবার চেষ্টা করছিলাম ।
ও বলল , কি , পড়ি তো নাকি লিটারেচার ?
কি যে মনের মধ্যে হচ্ছে ঠিক বোঝাতে পারবো না। কিরকম যেন একটা তীক্ষ্ণ রোমান্টিসিজম্ মিশে রয়েছে ওর গলায় । তা যেন আমার রক্তের প্রতিটি বিন্দুতে রোমান্টিসিজম্ ছড়িয়ে দিতে লাগল।
অস্ফুট গলায় বললাম, হ্যাঁ ।
ও বলল , কি বুঝলে বলো ?
ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। এবারে এই লাইন কটাকে নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন আরম্ভ করে দেবে । যদিও লাইনগুলোর অর্থ বুঝতে পেরেছিলাম এবং তার বাংলা একটা তর্জমা করতেও পারতাম । তবুও , ওই যে ! ও জিজ্ঞাসা করেছে । হয়ে গেছে আমার ! ওখানেই সব জারিজুরি শেষ।
মুখ নিচু করে ওড়নাটাকে আঙ্গুলের ওপরে আরও একটা লেয়ারে পেঁচাতে লাগলাম।
ও বলল, কি হল ? বল কি বুঝলে ?
আমি মুখ নিচু করে প্রায় অস্ফূট গলায় বললাম , আপনি বলুন –
— বলতে পারি । তবে , ওই আপনি’টা বাদ দিতে হবে। অন্যভাবে বলতে বলো । আমি বলব ।
সেদিনের সেই দুটো শর্ত মনে রেখে আমি ওকে বার কয়েক অতি কষ্টে ‘তুমি’ বলার চেষ্টা করেছি । কিন্তু কাজটা যে কি কঠিন ! কিছুতেই পারি না ।
ও হঠাৎ করে বাঁহাতটা বাড়িয়ে আমার মাথার ওপর দিকে গাছের গুঁড়ির ওপর রেখে, ডান হাতে আমার চিবুকে আঙ্গুল দিয়ে আমার মুখটাকে তুলে ধরে বলল , কি হলো ? আপনি’টা বাদ দিয়ে ‘তুমি’ করে বলো । বুঝতে পারলে কি বলছি আমি ?
ওর এই আবদারে, চিবুকে ওর ছোঁয়ায় , তখন আমি তিরতির করে কাঁপছি । কিছু বলবো কি ! আমি তখন আর আমাতে নেই ।
ও বলল , এই লাইন কটার মানে আমি এক্ষুনি তোমায় বুঝিয়ে দিতে পারি । দেব ?
আমি শুকনো গলায় বললাম , হ্যাঁ ।
ও আবারও সেই দিনের সন্ধ্যাবেলার মতো বাঁ হাতের তর্জনী আর মধ্যমা দিয়ে ছুঁয়ে দিল আমার দুটো চোখের পাতা । সেই দুটো সঙ্গে সঙ্গে টুপ্ করে বন্ধ হয়ে পড়ে যেন কোন স্বপ্নের জগতে ডুব দিল ।
আর তখনই..
ঠিক তখনই..!
তখনই কি যে ঘটে গেল আমার জীবনে ! কেমন যে সে অনুভূতি , কিভাবে যে তা প্রকাশ করা যায়, আমি জানি না । বুকের মধ্যে যেন সমস্ত রক্ত দেহের সমস্ত অনুভূতি নিয়ে চলকে উঠলো ।
আমি বুঝলাম , আমার ভয়ে আড়ষ্ট ভিজে ভিজে দু’টো ঠোঁটের ওপর নেমে এসেছে ওর আঙুলের স্পর্শ। তারপরে , আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুঝলাম, এবারে আর আঙ্গুল নয় , ওর উষ্ণ দু’টো ঠোঁটের ছোঁয়া লেগে রয়েছে আমার ঠোঁটে।
চুম্বন !
প্রথম চুম্বন !
আমার ঠোঁটের ওপর ওর ঠোঁটের স্পর্শ ! অনির্বচনীয় সে স্বাদ ! আজও চোখ বন্ধ করলে যেন অনুভব করতে পারি ।
একটা .. দুটো.. তিনটে ..
কেটে চলেছে মুহূর্ত! সমগ্র পৃথিবী থমকে গেছে । পাখিরা উড়ছে না । প্রজাপতিরা ডানা মেলছে না। চা গাছের পাতার ওপর দিয়ে বাতাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে । সমগ্র পৃথিবী একটা মুহূর্তের মধ্যে যেন লীন হয়ে গেছে । সমস্ত রকম চলাচল বন্ধ ।
তারপরেই, সেই স্পর্শ , সেই প্রথম চুম্বন স্পর্শ, আমার বুকের খাঁচা ছেড়ে উঠে এলো মাথায়। মাথা বুঝলো – একটা নির্জন চা-বাগানে সোনু দা আর আমি , আমি আর সোনু দা! আমার বয়স আঠারো, ওর বয়স আঠাশ। দুজনেই যুবক-যুবতী। অবিবাহিত । বাড়ি থেকে দূরে এভাবে দুজনে একটা নির্জন চা-বাগানে ও আমার ঠোঁটে ডুবিয়েছে নিজের ঠোঁট ।
আমি আবার..! আবারও সেই একই ভুল করলাম। শর্ত ভুলে গেলাম । ও যে আমার ওপর অভিমান করেছিল, আমাকে সে অভিমান ভাঙাতে হয়েছিল- সব ভুলে গেলাম । হঠাৎ করে স্বপ্নের জগৎ থেকে উঠে এসে বুঝতে পারলাম , আমি ছুটছি। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছি গাড়ি লক্ষ্য করে । যেন বাতাসের আগে ছুটে চলেছি। হাপরের মতো বুক উঠছে, নামছে। আমি এক ছুটে গিয়ে গাড়ির পিছনের দরজাটা খুলে , সীটে বসে পড়ে , দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে দিয়ে , কোলের ওপর তুলে নিয়েছি নিজের কলেজের ব্যাগটা । দু’ হাতে ব্যাগটা চেপে ধরেছি বুকের ওপরে।
হাঁপাচ্ছি ।
হাঁপাচ্ছি।
কিছুক্ষণ পরে ও ফিরে এল গম্ভীরমুখে । ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো । গাড়ি স্টার্ট দিল । আমি চোখ বন্ধ করে আছি । সর্বশক্তি দিয়ে বুজে রয়েছি দু’চোখের পাতা ।
খুলবো না ।
আমি কিছুতেই চোখ খুলবো না ।
কি যে হচ্ছে আমার মনের মধ্যে! কত যে অশান্ত ঝড় বয়ে চলেছে! চোখ খুলে ফেললেই যেন সমস্ত পৃথিবী তা জেনে যাবে । তাই আমি চোখ বন্ধ করে থাকবো । কিছুতেই খুলবো না –

ক্রমশ..