হলদে প্রজাপতি পর্ব-১৮+১৯

0
183

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

আঠারো

আজকে প্রায় চার মাস হতে চলল আমি এই টী এস্টেটের ম্যানেজার হিসেবে জয়েন করেছি । এখন ভরা শ্রাবণ । চতুর্দিকে চা বাগানগুলো শ্রাবণের ধারাপাতে যেন সবুজে সবুজ হয়ে উঠেছে । এমনিতেই সবুজ । সারাবছরই সবুজ । কিন্তু বৃষ্টিস্নাত শ্যামলিমা একটা অন্য ব্যাপার । যে কোন গাছের দিকে তাকালেই যেন মনে হয় , এই সবেমাত্র গাছটা স্নান করে উঠলো । জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন লতাপাতা । তাতে ছোট ছোট অজানা ফুল গজিয়েছে। আমার লনের বাগানে হারানদা প্রচুর গোলাপি রঙের রেন লিলি লাগিয়েছে । কিছুটা দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন গোলাপি চাদরে কিছুটা জায়গা মোড়া। মাঝের এই তিনটে মাসে আমার জীবনধারাটা মোটামুটি একই রকম থাকলেও , কিছু কিছু জায়গায় ছোট ছোট পরিবর্তন হয়েছে। যেমন , প্রথম মাসের প্রজেক্ট রিপোর্ট পাঠানোর পরে মালিকপক্ষ আমাকে যে ধরনের রিপ্লাই পাঠিয়েছিল ইমেইলে , তাতে করে আমি যথেষ্ট হতাশ হয়েছিলাম এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে বাধ্য হয়ে আমাকে কিছু স্টেপ নিতে হয়েছে । যেমন চা বাগানের শ্রমিকদের সঙ্গে অনেক স্ট্রিক্ট বিহেভ করতে হয় আমায় আজকাল বাধ্য হয়েই । ওরা আমার সাথে সবে একটু সহজ হতে আরম্ভ করেছিল আর তখনই এটা আমাকে করতে হচ্ছে। আমার নিজের ঘোরতর অপছন্দের কাজটা করতে হচ্ছে, ওরা যাতে ওদের সর্বোচ্চ এফিশিয়েন্সি কাজে লাগিয়ে প্রোডাকশন বাড়াতে সাহায্য করে । সেইজন্য ওদের কাজের সিডিউলটা অনেক বেশি টাইট আর কম্প্যাক্ট করতে হয়েছে । ওরা আজকাল আমাকে আর পছন্দ করে না । একেবারেই করে না। আমি জয়েন করার পরেও করত না । মাঝখানে ওদের মনোভাবের একটু পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়া মাত্রই আবার আমার ব্যবহারের জন্যই এখন আর পছন্দ করে না । ম্যানেজার-লেবার সম্পর্ক ছাড়া এখন আর আমি ওদের সাথে মেলামেশা করার কোন চেষ্টাই করি না ।

তাতে করে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট শিশির খুব খুশি হয়ে বলেছে, ম্যাডাম আপনাকে তো আগেই বলেছিলাম এই সমস্ত ছোটলোক লেবারের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে আপনাকে চলতেই হবে । ক’ পয়সা মাইনে পায় ওরা ? ক’ টাকায় সংসার টানে বলুনতো? আপনি যত ওদের সঙ্গে মেলামেশা করবেন, ততই আপনাকে অভাব-অভিযোগের কথা শুনতে হবে । তাতে আপনার কোন লাভ নেই বরং ক্ষতি ।
আমার কথাগুলো শুনতে মোটেও ভাল না লাগলেও শ্রমিকদের সঙ্গে শুধুমাত্র একটা মেকানিক্যাল সম্পর্ক রাখা ছাড়া এই মুহূর্তে আমার আর কিছু করার ছিল না । চাকরির দায় বড় দায় । প্রোডাকশন আমায় বাড়াতেই হবে । আরো কতগুলো স্ট্রীক্ট নিয়মকানুন বহাল করতে হয়েছে আমায় । লেবাররা সঠিক সিডিউল মেনে কাজকর্ম করছে কিনা সেটা দেখার জন্য আমি নিজেও দিনের বেশ কিছুটা সময় ওদের সুপারভাইজ করি । শিশিরকেও অনেকটা সময় ধরে ওদের সুপারভাইজ করার কাজ দিয়েছি । তাছাড়া আমাদের চা পাতার প্রসেসিং যেখানে হয়, সেই টি ফার্মে সমস্ত সময় ধরে তদারকি করার জন্য হয় আমি থাকি, না হলে শিশিরকে পাঠাই ।
তাছাড়া বিভিন্ন ভ্যারাইটির চা গাছের ওপরে একটা ছোট নার্সারি মত করেছি। আমার বাংলোর পিছন দিকের কিছুটা জায়গা জুড়ে । সেটার দেখাশুনো অবশ্য হারানদা’ই করে । সেখানে বিভিন্ন ভ্যারাইটির ছোট চারাগাছ, তার সাথে চা গাছের বীজ সংরক্ষণের জন্য বড় বেশ কিছু চা’গাছ করব ঠিক করেছি । প্রজেক্টটা সবে শুরু করেছি । বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে আমার । এই প্রজেক্টর ব্যাপারে মালিকপক্ষ যথেষ্ট ইন্টারেস্ট দেখিয়েছে ।
কর্মক্ষেত্রে এই সমস্ত কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা ছাড়া, আমার দৈনন্দিন জীবনেও ছোট একটা পরিবর্তন এসেছে। আজকাল মাঝেমাঝেই উপমা চলে আসে আমার বাংলোয়। কখনো কখনো জগন্নাথকে পাঠিয়ে দিই ওকে আনার জন্য । কখনো আবার আমি নিজেও যাই। সপ্তাহে দু-তিন দিন তো হবেই । দুপুরের দিকে চলে আসে ও আমার বাংলোয়। বিকেলবেলাটা থাকে। সন্ধ্যাবেলা আবার ওকে পৌঁছ দেওয়ার ব্যবস্থা করি । ও যে আমাকে পছন্দ করে, আমার কাছে থাকতে চায়, সেটা বুঝতে পারি । আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত টগর ওকে দেখে রাখে। টগর যথেষ্ট দায়িত্বশীল, চিন্তা করার কোনো কারণ নেই । তবে আমি ফিরে এলে উপমা একগাল হাসে। কখনো আমায় জড়িয়ে ধরে । আজকাল আবার দু-একটা বইপত্র নিয়ে আসে । ওর ঠাকুমা ব্যাগে ভরে পাঠিয়ে দেয় ।
ইন্দ্রাশিষ বাবুর সঙ্গে মাঝে বারকয়েক দেখা হয়েছে । উনি এসেছেন আমার বাংলোয় । আমিও বার দুয়েক ওনাদের বাড়িতে গেছি । ওনার বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে । বাতের ব্যথায় তিনি প্রায় পঙ্গু । হাঁটাচলা করতে ভীষণ অসুবিধা । উপমার আমার কাছে পড়াশুনা করার ব্যাপারে অবশ্য ইন্দ্রাশিষ বাবু সরাসরি আমাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, প্রপার একটা রেমুনেরেশন নিয়েই ওকে পড়াতে । বলাই বাহুল্য, এই ধরনের প্রস্তাবে রাজি হওয়া যায়না । উপমা আমাকে ভালোবাসে । ও আমার কাছে থাকতে চায়। ওর ঠাকুমা ওকে নতুন ক্লাসে ওঠার পর পড়াশোনার ব্যাপারে আর খুব একটা সাহায্য করতে পারেন না । আমি দেখিয়ে দিই। যতটুকু সময় আমার কাছে থাকে তার মধ্যে যতটা সম্ভব । এই সমস্ত ভালোবাসাবাসির সম্পর্কে টাকা পয়সা এনে ফেললে সম্পর্কটাই মাটি ।
ওকে অবশ্য আমি আজকাল ‘পাতা’ বলেই ডাকি । এই নামটা আমার ভারী পছন্দ হয়েছে । ও আমাকে মাসীমণি বলছিল । আমি ওকে বলে ওটা কেটেছেঁটে শুধু ‘মনি’ করে নিয়েছি । আমাকে ও ‘মনি’ বলেই ডাকে ।

এখন ভরা শ্রাবণ মাস । মাঝে মাঝে এক-আধটা দিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার থাকে । অঝোর ধারায় বর্ষণ হয় । সেই দিনগুলোতে কাজকর্ম মোটামুটি সব বন্ধ থাকে । বিশেষত ফিল্ড ওয়ার্ক । টি ফার্মে যাই । শিশিরকেও পাঠাই। সেখানে যেটুকু যা তদারকির কাজকর্ম থাকে । বাদবাকি অফিশিয়াল কাজকর্ম বাড়িতেই ল্যাপটপে করে নিই। ফাইলপত্রগুলো অফিস থেকে বেশিরভাগ নিয়ে এসে এখন বাড়িতেই রেখেছি ।

গতকাল থেকে নিম্নচাপ প্লাস মৌসুমী বায়ু দু’য়ের প্রভাবে অঝোর বর্ষণ আরম্ভ হয়েছে । চারিদিক ধোঁয়াটে, জলের ঝাপটায় । কিছু দেখা যায় না । দরজা-জানলা প্রায় সব বন্ধ করে রেখে দিতে হচ্ছে । বৃষ্টির ঝাপটা খুব । বারান্দা আর সামনের লন তো জলে থৈথৈ করছে ।
অফিসে যাইনি আজ। ঘরে বসে বসে কাগজে কলমে কাজগুলো সব সকাল-সকাল সেরে নিয়েছি আমি । তারপরে একবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পাতাকে নিয়ে এসেছি । পাতা দুদিন ধরে স্কুলে যাচ্ছে না । এই বৃষ্টির মধ্যে যাওয়া সম্ভব নয় । ও আমার বাড়িতে স্নান খাওয়া দাওয়া করেছে আজকে । এই বাদলা দিনে গরম গরম খিচুড়ি, আলু ভাজা, ডিম ভাজা, পোস্তর বড়া । আহা ! যেন অমৃত ।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সারা হতে আমি আর পাতা দুজনে গা ঘেঁষে বসে টগরের কাছে গল্প শুনছিলাম । ওর গ্রামের গল্প , বাড়ির গল্প, মানুষজন, পূজা-পার্বণের গল্প। নানা রকম গল্প। সময়-সুযোগ পেলেই ও গল্প শোনায় আমদের। টগরের গল্প বলার ভঙ্গীটি ভারী সুন্দর । একবার গল্প বলতে আরম্ভ করলে হাঁ করে শুনতে হয়। সুর চড়িয়ে নামিয়ে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে এমন করে বলবে, মনে হয় যেন সত্যি করেই সে সমস্ত ঘটনা ঘটে চলেছে চোখের সামনে। নানারকম গল্প করতে করতে শেষমেষ এসে ঠেকেছে ভুতের গল্পে। ওর মত ভাষা প্রয়োগ, সুর ওঠানামা তো আমার পক্ষে সঠিক ব্যাখ্যা করা অসম্ভব । তবে ওর বাচনভঙ্গিমা , অঙ্গভঙ্গি, বাইরের অন্ধকার বাদল, সাথে মেঘ গুরুগুরু, সব মিলিয়ে পাতা দুচোখ বিস্ফারিত করে হাঁ করে ওর গল্প গিলছিল প্রায় । কিছুক্ষণ পরপর আমার কোলের কাছে ঘেঁষে আসতে আসতে এখন মোটামুটি আমার কোলের ওপর উঠে পড়েছে ।
টগর আমাদের যে গল্প শোনাচ্ছে তা মোটামুটি এইরকম –
ওদের গ্রামে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন ভূত-প্রেত-পিশাচ বা অপদেবতাদের দর্শন মেলে । ওদের গ্রামে মাশান ঠাকুরের থান আছে । মাশান ঠাকুর নাকি বিভিন্ন রূপে বিরাজ করতে পারেন। তিনি শ্মশানে থাকেন বটে, তবে বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন জায়গায় বিরাজ করতে পারেন। বিভিন্ন রূপে স্বপ্নে মানুষকে পথভ্রষ্ট করে নানা জায়গায় নিয়ে গিয়ে তাদের উপর ভর করতে পারেন মাশান ঠাকুর । থানে নিয়ে গিয়ে পুজো দিলে অনেক সময় নাকি সুফল পাওয়া যায় । তাঁর মূর্তিটিও বড় বিকট। দশাসই পেশীবহুল চেহারা । অনেক সময় আবার মূর্তিতে কোন মাথা থাকে না । চোখ মুখ সমস্ত কিছু বুকের উপরে থাকে। গলার কাছে গিয়ে মূর্তির কাঠামো শেষ হয়ে যায়। পায়ের নিচে বাহন থাকে এই আ্যত্তো বড় একখানা শোলমাছ । এই রকমই এক মাশান ঠাকুরের থান রয়েছে টগরের গ্রামে । কোনো মানুষের মধ্যে বেচাল কিছু দেখলেই যখন বোঝা যায় তার শরীরে অপদেবতা ভর করেছেন, তখন তাকে মাশান ঠাকুরের থানে নিয়ে যাওয়া হয় । মাশান ঠাকুর ভর করলে বোঝা যায় দেখে। ঠিক করে পুজো দিতে পারলে নাকি সব ঠিক হয়ে যায়।

এই সময়টায়, এই আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে তাদের গ্রামের খাল-বিল সব জলে টইটুম্বুর থাকে। আশেপাশের পুকুর, নদী, জলে ভরে গিয়ে জল উপচে পড়ে। অনেক ধরনের মাছ তখন চাষের ক্ষেতে এসে পড়ে। ক্ষেতের অনেক ফসল নষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকলেও মাছ ধরার হিড়িক পড়ে যায়। আকাশ কালো করে বৃষ্টি , তার মাঝে গ্রামবাসীরা বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরার ফাঁদ তৈরি করে মাছ ধরতে নেমে পড়ে । আকাশে কালো মেঘ, ঝড়-বৃষ্টি , চারিদিক জলে থইথই । তার মধ্যে চাষের ক্ষেতে বা নিচু জায়গায় জমে থাকা জল থেকে মাছ ধরার আনন্দ নাকি আলাদা! ছেলে বুড়ো সবাই গামছা বেঁধে নেমে পড়ে ।

এ হল দু’ বছর আগের ঘটনা। সেবছর এরকম সময়ে ঠিক একইভাবে মাঠ-ঘাট জল থইথই হয়ে গেছিল । বিভিন্ন মাছ চলে এসেছিল আশেপাশের পুকুর উপচে। টগরদের বাড়ির ঠিক দুটো বাড়ি পর বিনোদ বাউরীর বাড়ি । বিনোদ বাউরী নামটা উচ্চারণ করার সময় টগর একবার কপালে হাত ঠেকাল। তারপর বলল, তার বয়স নাকি পঞ্চাশের কোঠায়। তিন ছেলেমেয়ে, বউ , মা-বাবা দুজনেই জীবিত , ভরা সংসার। শ্রাবণের একুশ তারিখ ছিল সেটা। ঠিক তার দুদিন আগে থেকে নিম্নচাপের বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে । চারিদিকে, যেদিকে চোখ যায় শুধুই জল থৈ থৈ ! সেকি কাণ্ড ! বৃষ্টি আর কিছুতেই থামতে চায় না । তিনদিন পরেও বৃষ্টির বেগ যেন বেড়েই চলেছে । কমার নাম নেই । বাড়ি থেকে বেরোতে গেলে রাস্তায় জল । একটু নিচু জমি হলে তো কথাই নেই । প্রায় কোমর পর্যন্ত জল। অনেকের বাড়িতে জল ঢুকে গেছে । ছেলেপুলেরা সব সারাদিনে যখন-তখন সেই জলের মধ্যে নাইতে ছোটে । সেদিন সারাদিন বৃষ্টি হওয়ার পরেও সন্ধ্যেবেলা থেকে বৃষ্টির বেগ বাড়লো বই কমলো না। ইলেকট্রিসিটি তাদের গ্রামে আছে বটে , তবে অবস্থা খুব বেহাল । একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই টানা একআধ দিন কারেন্ট থাকে না। সেদিনও সেই বিকেল থেকে কারেন্ট গেছে , আর আসার নাম নেই । হ্যারিকেনের আলোয় বাড়িগুলোর মধ্যে ওই একটা ঘরের কিছুটা অংশ আলোকিত হওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু আর হয় না। চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার । তার সাথে জলে ভর্তি।

রাত্রিবেলা তখন কটা হবে ? রাত প্রায় দশটা । ওই অত বৃষ্টি, অন্ধকারের মধ্যে রাত দশটা মানে তখন নিশুতি রাত । গ্রামের সকলেই মোটামুটি ঘুমিয়ে পড়েছে । অনেকের কাঁচা বাড়িতে জল ঢুকেছে । যদিও ততখানি নয় যে , বাড়ি ধসে পড়বে । তক্তার উপরে তক্তা বসিয়ে কোনরকমে খাটিয়ার ব্যবস্থা করে সকলেই প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। এমন সময় হঠাৎ করে বিনোদ বাউরী বিছানার উপর উঠে বসে বলে, সে মাছ ধরতে যাবে ! সে’ও ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘন্টাখানেক ঘুম দেওয়ার পর হঠাৎ করে ঘুম থেকে উঠে সে ঘরের কোণ থেকে মশারি বাঁধা ছোট জালটা তুলে নিয়ে কাঁধে ফেলে সটান বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়ল । তার কান্ড দেখে তার বউ আর তার জোয়ান দুই ছেলে আছাড়ি-পিছাড়ি করে তার পিছু পিছু ছুটল । তাকে ধরে ঘরে ফিরিয়ে আনার জন্য অনেক সাধ্যসাধনা করল । কিন্তু তার শরীরে তখন দশজন মানুষের বল ! তিনজনে মিলে তার সঙ্গে পারবে কেন ? সে এক হুংকার দিয়ে তিনজনকে এক ঝটকায় ফেলে দিয়ে জমির ওপর দিয়ে এক হাঁটু জলে ছপাৎ ছপাৎ শব্দ তুলে এগিয়ে চলল । তার বউ ব্যাপার বুঝে মরা কান্না জুড়ে বসল । রাতবিরেতে তার স্বামীর ঘাড়ে অপদেবতা ভর করেছেন। তার চিৎকার , কান্নাকাটি শুনে আশেপাশের আরো পাঁচটা বাড়ির লোকজন দুয়ার খুলে বাইরে বেরিয়ে এল ; ছাতা, হ্যারিকেন, যার যা ছিল তাই নিয়ে । কয়েকজন সঙ্গে লাঠিসোঁটাও নিল । সবাই মিলে ধরেবেঁধে তাকে ঘরে ফেরানোর অনেক চেষ্টা করল । কিন্তু বিনোদ বাউরীর তখন শরীরে যত ক্ষমতা, গলার স্বর তত চড়েছে ! বুক কাঁপানো চিৎকার করছে সে । কেউ তার আশেপাশে যেতেই ভয় পাচ্ছে।

যাইহোক, কোনরকমে তাকে সেই অবস্থার মধ্যেই জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হল গ্রামের সীমানার বাইরে বটগাছের তলায়, যেখানে মাশান ঠাকুরের থান রয়েছে । অতখানি রাস্তা সেই অন্ধকারের মধ্যে জল ডিঙিয়ে যাওয়া নেহাত চাট্টিখানি কথা ছিল না । কিন্তু সেখানে নিয়ে যাওয়ার পরেও শেষ রক্ষা হল না । সেখানে ঢোকার মুখেই একটু আলগা পেল কি, সে একেবারে সমস্ত শক্তিতে ছুটে এক নিমেষে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল । শুধু মাঠের মধ্যে তার দ্রুতপায়ে জল ঠ্যাঙ্গানোর ঝপাৎ ঝপাৎ ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দ ! যেদিকে সে ছুটে যাচ্ছে, সেই দিকে তাকে ধরতে যাওয়ার কথা কেউ ভাবতেও পারে না । গ্রামের লোকেরা তো কোন দূর , তার বউ, দুই ছেলেরও সেদিকে যাওয়ার সাধ্য ছিল না। কেউ আর এগোনোর বিশেষ ভরসা পেল না। যেদিকে বিনোদ বাউরী গেছে, সেদিকে যে কাটরা-পুকুর ! ওই ভয়ানক পুকুরের দিকে দিনে-দুপুরেই কেউ যাওয়ার ভরসা পায় না, তা এই নিশুতি রাতে, চারিদিক জল থৈ থৈ করছে, তার মাঝে ওইদিকে ওই কাটরা-পুকুরে কে যাবে ? সকলে শুধু ঢিপঢিপ বুকে সেই চাপ চাপ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল । বিনোদ বাউরীর পদশব্দ ক্রমশ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে – ছপ্ ছপ্ ছপ্ ছপ্ শব্দ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে বটে , তবে যেদিকে সে শব্দ যাচ্ছে , সেসম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে প্রত্যেকেরই বুক ভয়ে কেঁপে উঠলো । ওই পুকুর যে সর্বনাশা ! ও যে যকের পুকুর । কি ভয়ানক ! একখানা পাথরের মূর্তি পাওয়া গেছিল সেই পুকুরের ডানপাশের নরম মাটি থেকে । পাথরে খোদাই করা মূর্তি । এই ভাঁটার মতো দুটো চোখ, কষের কাছে লম্বা দাঁত । এই পুকুর একেবারে সাক্ষাৎ যকের পুকুর । সেই মূর্তি পাওয়ার আগে বা পরে সেই পুকুরে কত ছেলেপিলে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি । গ্রামের সকলেই জানে ওই পুকুরে ‘পানভূত’ থাকেন । অপদেবতা । ভয়ঙ্কর অপদেবতা । এই বৃষ্টি বাদলের মাঝে তার শক্তি হাজার গুণ বেড়ে যায় । তখন বিভিন্ন রূপে ভর করে মানুষকে ছলচাতুরি সেই পুকুরের দিকে টেনে নিয়ে যায় । সেই মানুষের আর কোন ক্ষমতাই থাকে না । বোধ বুদ্ধি সব হারিয়ে যায় । নিশি পাওয়ার মতো সে ছুটে চলে । ঠিক যেমনটা বিনোদ বাউরীর সঙ্গে হলো ।

সব আশা ছেড়ে দিয়ে, সকলে মিলে তাও প্রায় জনা বারো-পনেরো তো হবেই , রামনাম জপ করতে করতে লন্ঠন ধরে কোনরকমে জল ঠেলে যে যার বাড়িতে ফিরে এসে দরজায় আগল তুলে দিল । সেই রাতে আর কেউ ঘুমোতে পারল না । কখন কি হয়ে যায়, কার বাড়িতে কোন অপদেবতা ভর করে বলা যায় কি? ঘুমের ঘোরে তাদের আরও সুবিধা কিনা ! বলা যায়না । সকলে সারারাত জেগে থেকে রামনাম করেই কাটিয়ে দিল । পরের দিন সকালে বৃষ্টির তেজও অনেকটা কমলো । দিনের আলোয় গ্রামবাসীর বেশ বড়সড় একটা দল, বুকে কোনমতে সাহস জোগাড় করে সকলে গেল সেই কাটরা-পুকুরে । তবে বিশেষ কিছু খোঁজাখুঁজি করতে হলো না । পুকুরের জল বেড়ে চারিদিক জলে থৈথৈ হয়ে রয়েছে । সেখানে কোনখান থেকে যে পুকুরের খাদ নামছে ঠিকঠাক ঠাহর করা খুবই মুস্কিল । তবে একখানা পাকুড় গাছের পশ্চিম দিকে গুনে গুনে দশ’পা গেলে পুকুরের একখানা ঘাট পড়ে । আর সেই পাকুড় গাছের গোড়াতেই দেখা গেল বীভৎস দৃশ্য ! বিনোদ বাউরীর দেহটা পাওয়া গেল বটে, তবে সে একেবারে ভয়ানক অবস্থা । তার চোখ নেই, একটা কান নেই , জায়গায় জায়গায় মাংস খোবলানো। নেহাত সৎকার করতেই হবে, তাই সকলে মিলে কোনরকমে হরিনাম জপ করতে করতে বিনোদ বাউরী দেহটা নিয়ে এসে তার বাড়ির আঙিনায় ফেলল ।

এই গেল বিনোদ বাউরী আর পানভুতের গল্প । টগর তার গল্প শেষ করতে দেখলাম পাতা একেবারে আমার বুকের মধ্যে তার মুখখানাকে গুঁজে দিয়েছে প্রায় । শৈশবে এইসব ভূতের গল্পগাছা সবাই বিশ্বাস করে , ভয় পায় । সেটা তো স্বাভাবিক , যে পাতা ভয় পাবে । পাতার মণিই ভয় পাচ্ছে ! সত্যি কথা বলতে কি, কলকাতার লম্বা-চওড়া ফ্ল্যাটের মধ্যে আর ট্রাফিক জ্যামে, গাড়ির হর্ন, বিবিধ শব্দ, কোলাহলের মাঝে যে সমস্ত চিন্তা মনে দানা বাঁধতে পায় না, আজকে এই চারিদিক ধূধূ করা চা বাগানের মধ্যে যখন প্রবল বৃষ্টিতে কোথাও আর কিছু দেখা যাচ্ছে না, আশেপাশে কোন বসতবাটি নেই , ঘরের মধ্যে প্রাণী বলতে আমরা তিনজন , যদু এই বৃষ্টির মধ্যে খাটিয়া পেতে শিশিরের ঘরেই শোয়, তবে বৃষ্টির মধ্যে এখন আমরা চাইলেও শিশিরের ঘরে যে ছুটে যাব তাও বোধহয় ক্ষমতায় কুলোবে না, এইরকম গা ছমছমে নিঝুম পরিবেশে সত্যি যেন কোথাও আমিও বিশ্বাস করলাম- বিনোদ বাউরীকে অপদেবতা ভর করে তার অদৃষ্টের দিকে টেনে নিয়ে গেছিল । সে ওই নিশুতি রাতে নিশির ডাকের মতো ছুটে গেছিল সেই ভয়ানক কাটরা পুকুরে । তারপর, অদৃষ্টের টানে তার সেই ভয়ানক পরিসমাপ্তি ।

টগরের গ্রাম , গ্রামের মানুষজন , বর্ষাকালে জল থইথই করা চারিদিক , গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের সেই জলের মধ্যে খেলা করে বেড়ানো, সন্ধ্যে হতেই চারিদিক অন্ধকারে ডুবে যাওয়া, বাড়ির মধ্যে হ্যারিকেনের বা ল্যাম্পের মিটমিটে আলো- সবকিছুই যেন আমি আমার মানস চক্ষুতে দেখতে পেলাম । কলকাতায় বা ব্যস্ত শহরে বা শহরতলীতে যা অসম্ভব , তা যেন টগরদের সেই গ্রামে এই ভরা বাদলায় খুবই সম্ভব । কোন কিছুই অসম্ভব নয় । অপদেবতার ভর করা, যকের পুকুর , সেখানে আস্ত জ্যান্ত মানুষকে নিশির ডাকের মতো টেনে নিয়ে যাওয়া , পরদিন সকালে ওইভাবে সেখান থেকে তার মৃতদেহ আবিষ্কার- ঘটনা যে সম্পূর্ণ অন্যরকম কিছু, গ্রামের মানুষদের মুখে ঘুরে ঘুরে আসল ঘটনা এই হয়ে দাঁড়িয়েছে, সবই বুঝি। তবু সেই গা ছমছমে ভূতের গল্পটাই আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করলো । পাতার মতই । ঠিক করলাম মানস চোখে নয় , চর্মচক্ষুতে একবার তাদের গ্রামে গিয়ে দেখে আসতে হবে । টগর, তার বাড়ি, তার গ্রামের গল্প শোনায়, আর বলে তাদের গ্রামে যেতে । আজকে ঠিক করলাম, বৃষ্টি-বাদলা থামলে ছুটির একটা দিন দেখে আমরা সবাই তার গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে আসবো।

ক্রমশ..

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

উনিশ

এখন সেপ্টেম্বর মাস । ভাদ্র মাস শেষ হয়ে এই সবে আশ্বিন পড়ল। কাজকর্ম বেশ কিছুটা গুছিয়ে নিয়েছি । সামনের মাসের প্রথমের দিকে ছুটির জন্য অ্যাপ্লিকেশনও করে রেখেছি। পুজোর চারদিন তো বটেই, তার আগু পিছু মিলিয়ে প্রায় দিন আষ্টেকের ছুটি নিয়ে পুজোর সময় বাড়ি যাবো। পাঁচ মাস হয়ে গেল এখানে কাজ করা । তবে ছুটি আমি শুধুমাত্র দুটো সিএল ছাড়া আর কিছুই নিই নি। মাঝে দুবার শুধু বাড়ি গেছিলাম । তাও একটা দিনের জন্য । যেদিন পৌঁছেছি তারপরের দিনটা থেকে, তারপরের দিন ব্যাক করেছি। এবারে টানা ছুটিতে বাবা-মায়ের কাছে থাকবো। বাবার শরীরটা ক’দিন ধরে আবার একটু বেগড়বাই করছে। যদিও বাড়াবাড়ি কিছু নয়। তবুও এত দূরে থাকি তো, ইচ্ছা হলেই সঙ্গে সঙ্গে যাওয়া যায় না । মন খারাপ করে ।

বৃষ্টি বাদলের মাসগুলো শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম । এখন তো আকাশে আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘের সমাগম । যদিও আমার চারপাশে শুধুই চা বাগান । সেখানে কাশফুল দেখার বিশেষ সুবিধা হয় না । তবে মনটা মাঝে মাঝেই উড়ে যায় নদীর ধারে, রাস্তার দু’পাশে, যেখানে এখন ভর্তি হয়ে ফুটে রয়েছে কাশফুল , আনন্দে মাথা দোলাচ্ছে । খুব ভোরে উঠলে মাঝে মাঝে দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসে শিউলি ফুলের গন্ধ। কোথাও গাছ রয়েছে । তবে আশেপাশে নয়। তাহলে নিশ্চয়ই মাঝে মাঝে ভোরবেলা গিয়ে আঁজলা ভর্তি করে টুপটুপ করে খসে পড়া শিউলি ফুলগুলো তুলে আনতাম। মনটা খুব পালাই পালাই করে দূরে কোথাও । এমনিতে সারা বছর এই সবুজ চা বাগানে চোখ রেখেও কোন ক্লান্তি আসে না । তবে , এই প্রথম আশ্বিনের শারদপ্রাতে মনে হয় যেন এই চা বাগান পেরিয়ে, কাশফুলের রাজ্যে, শিউলি ফুলের রাজ্যে , হারিয়ে গেলে বেশ হয় । টগরের গ্রামটা এখান থেকে প্রায় ঘন্টা খানেক কি ঘন্টা দেড়েকের রাস্তা । তার কাছে অনেক গল্প শুনেছিও বটে । ও অনেক বার যেতেও বলেছে । ওর দাদা মাঝখানে একবার ওর সাথে দেখা করতে এসেছিল , আমাকে অনেকবার ওদের বাড়িতে যেতে বলে গেছে । একেবারে যাকে বলে নিখাদ গ্রাম্য এসেন্স পাওয়া যাবে ওদের গ্রামে গেলে । সেটা আমি টগরের মুখে গল্প শুনে বুঝতেই পারি। তাই জন্য একটা ছুটির দিনে ওদের গ্রামে যাওয়ার প্রোগ্রাম ঠিক করেই ফেললাম । আমরা থ্রি মাস্কেটিয়ার্স তো আছিই- পাতা, পাতার মনি, আর টগর । আর তার সাথে থাকবে জগন্নাথ দা। ও’ই আমাদের ড্রাইভ করে নিয়ে যাবে । প্রোগ্রামটা করতে চাইছিলাম বেশ কিছুদিন ধরেই। কিন্তু বৃষ্টি, তার সাথে ভাদ্র মাসের গুমোট ব্যাপারটা কাটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম । যদিও দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় এখানে ভাদ্রমাসের গুমোট গরম কিছুই নয়। গায়ে লাগেনা । তবে আশ্বিন মাসের ওয়েদার একেবারেই আলাদা। আশ্বিন মাস তো আসেই পুজোর গন্ধ গায়ে মেখে। তার সাথে থাকে শিশিরের গন্ধ , হিমেল হাওয়ার গন্ধ, আসন্ন শীতের উত্তুরে হাওয়ার গন্ধ । তাই আশ্বিনের জন্যই অপেক্ষা করে বসেছিলাম ।

সেদিন সকালে , একেবারে সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়লাম । আজকে আমি একটু হলেও সেজেছি । শাড়ি পরেছি একটা, কচি কলাপাতা রঙের তাঁতের শাড়ি । কপালে শাড়ির রঙের সঙ্গে ম্যাচ করে একটা ছোট টিপ। চোখে কাজল দিয়েছি । ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। শাড়ির কালার এর সাথে কনট্রাস্ট ম্যাচিং মাটির তৈরি নেকপিস আর ইয়ার রিং। গায়ে হালকা সুগন্ধি দিয়েছি। বেড়াতে যাচ্ছি বলে কথা , এটুকু সাজবো না বুঝি?

যাওয়ার পথে পাতাকে তুলে নিলাম তার বাড়ি থেকে।
ইন্দ্রাশিষ বাবু তাকে গাড়িতে তুলে দেওয়ার সময় দেখলাম তিনি আমার এই সাজপোশাকের পরিবর্তনটুকু লক্ষ্য করেছেন । ভালো লাগলো বেশ । কোথাও যেন সাজার পর পুরুষ চোখের অ্যাপ্রিশিয়েসনটা বেশ ভালো লাগে।
তিনি বললেন , দেখবেন আবার , মেয়ে যে বিশেষ সুবিধের নয়, সে তো নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন এই কটা মাসে। এখানে আপনার বাড়িতেই থাকে সেটা অন্য রকম , এখন আবার একটা অন্য জায়গায় যাচ্ছে তো –

আমি মুখ বাড়িয়ে বললাম, আপনি একেবারেই চিন্তা করবেন না । আমি যদি তাও দুটো মিনিটের জন্য ওর খেয়াল রাখতে ভুলে যাই, টগর কখনোই ভুলবে না । সে সম্পর্কে নিশ্চিত থাকতে পারেন ।
উনি হেসে বললেন , সে আর বলতে? আমার মেয়ে একচুয়ালি আপনাদের কাছেই সবচেয়ে ভালো থাকে। আমার বাবা হয়ে এসব কথা বলার আর মুখ কোথায় ? আমি ওকে আর সারাদিনে কতক্ষণ সময় দিই , বলুন ?
হাত নেড়ে বললাম, আজ চললাম । তবে , নেক্সট টাইম আপনাকে একদিন হাইজ্যাক করে নিয়ে যাব বেড়াতে । সেদিন যেতে হবে কিন্তু-
উনিও হাসিমুখে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ । আজকেই যেতে ইচ্ছে করছিল বটে , তবে লোভ সামলে নিলুম । নেক্সট টাইম আর সামলাতে পারবো না-
— আচ্ছা !
হাসি মুখে হাত নাড়লাম। জগন্নাথদা গাড়ি চালিয়ে দিলো ।
সবুজের বুক চিরে এগিয়ে চলল গাড়ি । পাতা সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছে । অনর্গল বকে চলেছে জগন্নাথদার সঙ্গে । ওর উত্তেজনা চোখে পড়ার মতো । আধঘন্টা মত মেঠো রাস্তার ওপর দিয়ে গাড়ি চলার পর পিচের রাস্তায় এসে পড়ল । তারপর উত্তর মুখে চলল গাড়ি। মোট ঘণ্টা দেড়েকর কিছু বেশি সময় লাগল টগরদের গ্রামে পৌঁছতে ।

গ্রামটি বড় সুন্দর । একেবারে ছবির মতই । খুব বেশি হলে পঞ্চাশ ঘর মানুষের বাস হবে । প্রতিটা ঘর মাটির সুন্দর করে নিকানো , চকচকে তকতকে । প্রতিটা বাড়ির মধ্যে বেশ কিছুটা দূরত্ব রয়েছে এবং প্রতিটা বাড়িতেই প্রয়োজনীয় ফল, সবজি , কিছু ফুল গাছ রয়েছে। টগরদের বাড়িটা টালির ছাউনি দেওয়া সুন্দর করে নেকানো, একটা এল প্যাটার্ন এর মাটির বাড়ি। মাঝখানটা মাটির উঠোন । তার তিন ভাই তার মধ্যে একজন তার থেকে বড়, দাদা । আরো দুজন টগর এর চেয়ে বয়সে ছোট, তার ভাই। প্রত্যেকেই বিয়ে থা’ করে সংসারী মানুষ । তার বড় ভাইয়ের যে ছেলের কথা সে বলেছিল, তার কথা অনুসারে ইন্দ্রাশিষ বাবুর কাছে চিকিৎসা করিয়ে যে সুস্থ হয়, সে এখন রীতিমত জোয়ান । তিন ভাইয়ের মোট আট ছেলেমেয়ে । বড় দাদার দুই মেয়ে, তাদের বিয়ে হয়ে গেছে । এখন মোট ছ’টি ছেলেমেয়ে সেই বাড়িতেই থাকে। অর্থাৎ তাদের বাড়ির এখন মোট সদস্য সংখ্যা টগরের তিন ভাই, তিন ভাইয়ের বউ , ছয় ছেলেমেয়ে – এক ডজন সদস্য । তারা ভেতর ঘরগুলো সব নিজেদের মতো ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিয়েছে। এখানকার বাড়িঘর প্রায় সবই বাস্তুশাস্ত্র মেনে তৈরি করা । বেশিরভাগ বাড়িতেই পশ্চিমদিকে কিছু সুপারি গাছ এবং সুপারি গাছ লতিয়ে ওঠা কিছু পান গাছ রয়েছে । পান-সুপারি এদের জন্য শুভ ।

আমরা পৌঁছলাম যখন, তখন প্রায় নটা বাজে। বাড়ির প্রত্যেকের সাথে আলাপ হল প্রথমে, উঠোনে জলচৌকিতে বসে । একটা বেশ বড়সড় রসগোল্লার হাঁড়ি নিয়ে এসেছিলাম , সেটা টগরের বড়বৌদির হাতে দিলাম । ছোট ছোট ছেলেমেয়ে গুলো বেশ লাজুক । তারা দালানের খুঁটি ধরে দূর থেকে জুলজুল করে তাকিয়ে দেখছে, কিন্তু সামনে এসে আলাপ করার বিশেষ ভরসা পাচ্ছে না । আমি বুঝতে পারছিলাম টগরের বৌদিরা আমাকে বেশ কৌতুহলী ভঙ্গিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। আমার মত বয়সের একজন অবিবাহিতা, কর্মরতা মহিলা – সেই বস্তুটা যে ঠিক কি হতে পারে, সেই সম্পর্কে একটু ধ্যান-ধারণা করার চেষ্টা করছিলো মনে হয়। যাইহোক, প্রাথমিক আলাপ শেষে তারা যে যার কাজে চলে গেল । বড় বৌদিটি মনে হয় হেঁশেলের দায়িত্বে রয়েছে । বাকিরা কেউ গৃহস্থালির কাজে, গোয়ালের কাজে ,এসব নানাবিধ কাজে চলে গেল ।
মোটামুটি আধঘণ্টার মধ্যেই আমাদের জন্য জলখাবার এলো। জলখাবারের মধ্যে যেটা সবচেয়ে আকর্ষণীয় সেটা হল, ঝকঝকে কাঁসার বাটি আর থালা । দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায় । আজকালকার দিনে আর দেখা যায় কোথায় ? কাঁসার থালাতে করে এলো ঘরে ভাজা মুড়ি, তার সাথে ক্ষেতের বেগুনের ফুলকো বেগুনি । বাটিতে এল আলুর তরকারি , ক্ষেতের আলু নিশ্চয়ই। তার সাথে গুড়ের নারকেল নাড়ু ।
এই অঞ্চলের গ্রামগুলোর পরিবেশ বেশ অন্যরকম । গ্রামের মধ্যে এবং তার আশেপাশের কিছুটা অঞ্চল জুড়ে ক্ষেতে বিভিন্ন শাক সবজি চাষ হলেও, কিছুটা দূর থেকেই শুরু হয়ে যায় দিগন্তবিস্তৃত সেই চা বাগান । আমরা আসছি শুনে সেদিন টগরের তিন ভাই সকাল থেকে বেরোয়নি । তাদের সাথে গল্প করতে করতে খাওয়া-দাওয়া চলল। খাওয়া-দাওয়া সারা হতে আমি আর পাতা বেরোলাম । টগর অনেকদিন বাড়ির লোকজনের সাথে গল্পগাছা করতে পারেনি। সে বৌদিদের সঙ্গে হেঁসেলে ঢুকে গল্প জুড়ে বসল । আমাদের সঙ্গে তার দুই ভাইপো ভাইঝি হারু আর লক্ষ্মীকে পাঠালো । লক্ষী তার ছোট ভাইয়ের মেয়ে । সে প্রায় পাতার সমবয়সি । হারু তার থেকে কিছুটা বড়। পাতা আর লক্ষীর ইতিমধ্যে বেশ ভাব হয়ে গেছে । পাতা এখানে এসে পড়ে খুবই আপ্লুত । সে খোলামেলা পরিবেশ পায়, খেলার অনন্ত জায়গা পায় , তবে তার খেলার সাথীর বড় অভাব । এখানে এসে তার সমবয়সী প্রায় দু-তিনজন সাথী পেয়ে সে রীতিমত উত্তেজিত । আমরা গ্রামের মধ্য দিয়ে ক্ষেতের দিকে চললাম । এখানে গ্রামের রাস্তা ধরে হাঁটলে মনে হয় যেন সেটা বাড়ির উঠোন । বাচ্চা ছেলেরা খেলছে । ইতস্তত ফুল গাছ লাগানো । মেয়েরা কাজ করছে । মুরগি চরছে । প্রাত্যহিক কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে প্রতিটা মহিলা-পুরুষ-শিশু আমাদের দিকে দেখে নিচ্ছিল। প্রতিটা বাড়ি থেকে গ্রাম্য ভাষায় কথাবার্তার শব্দ, গোয়াল ঘরে গরুর ‘হাম্বা’ ডাক , কোথাও কোথাও আবার দুধ দোয়ানোর চ্যাঁচোঁ শব্দ , সাথে বালতির টুং টাং , কোথাও আবার মাটির উনুনে আঁচ দেওয়া হচ্ছে, তার ধোঁয়া । এখনো এখানে বেশিরভাগ বাড়িতেই মাটির উনুনে রান্না হয়।

আমরা কাছাকাছি কয়েকটা বাড়ি পেরিয়ে একটা ক্ষেতে এসে পড়লাম ।
হারু হাত তুলে দেখিয়ে বলল, হুই যে , হোইই যে আমাদের ক্ষেতি , বুঝলা ?
এগিয়ে গিয়ে দেখলাম সেখানে বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষ হয়েছে । কিছুটা কিছুটা অংশ এক একটা সবজির জন্য বরাদ্দ । যেমন আলু , বেগুন, উচ্ছে , কলাই , এইরকম বিভিন্ন । আবার মাচা বানিয়ে কিছু লতানে গাছ লাগানো হয়েছে- লাউ, কুমড়ো, মাচার নিচের দিকে ঝুলছে কয়েকটা । পাতা পরম মমতায় সবজিগুলোর গায়ে হাত বোলাতে লাগলো চোখ বড় বড় করে ।
মাঝে মাঝে পাতাকে ফিসফিস করে বলা লক্ষ্মীর দু-একটা কথা আমি শুনতে পাচ্ছিলাম — হুই যে লাউটা, ওইটা মা কাল রান্ধবে, বুঝলা ? … আমি একন একেন থিকে শাক তুলব , বড়মা চেয়েচে যে..
সে উবু হয়ে বসে লালশাক তুলতে লাগলো ।
আমি হারুর দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমাদের বাড়ি থেকে যে এতটা দূরে এসে সমস্ত চাষ হয় , পাখি হনুমান এসব খেয়ে যায় না?
— বা রে ! হুই হুইটা আচে কিনা-
হাত তুলে সে একটা কোন বস্তুর দিকে নির্দেশ করল । তবে সেরকম কিছু দেখতে পেলাম না সেখানে। নিমেষের মধ্যে সে ছুটে গিয়ে ক্ষেতের ওপর কাৎ হয়ে পড়া একটা বাঁশের লাঠি ধরে একটা কিছুকে তুলে দাঁড় করালো । দেখলাম সেটা একটা কাকতাড়ুয়া । হয়তো সেটা হাওয়ায় কাত হয়ে পড়ে গেছিল।
সেটাকে তুলে নিয়ে হারু মাটির মধ্যে গেঁথে বসাতে বসাতে বলল,
-জাগি জাগি জাগি
যে কামের কাম
সেই কামেতে নাগিস-
এই একই ছড়া সে মন্ত্র আওড়ানোর মতো বারবার আওড়াতে লাগলো।
আমি হেসে বললাম, ও কি বলছো হারু?
সে কাকতাড়ুয়াটা জমির মাটিতে বসানোর কাজ শেষ করে ছুটে এসে বলল, এইটে কইতে হয় যে ! নাইলে কাক পক্ষীতে সব খেয়ে নিবে !
লক্ষীর কোঁচর ভরে শাক তোলা হতে সে তার ফ্রকের কোঁচোর উঁচু করে তুলে ধরে শাকগুলোকে নিয়ে ছুট দিল বাড়ির দিকে । মিনিট খানেকের মধ্যেই অবশ্য ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হলো । আমরা চারপাশের আরো কয়েকটা চাষের ক্ষেত ঘুরে দেখলাম । সেগুলো অবশ্য টগরের দাদাদের নয় । অন্যান্য বাড়ির । তাদের মধ্যে কিছু কিছু পুরুষ মহিলা তখন গাছগাছালি তদারকি করতে সে অঞ্চলে এসেছিল। তারা হাঁ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল । বোধহয় আমার আসার খবর গোটা গ্রামটায় চাউর হতে সময় লাগে নি । ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরি করে ফিরে গেলাম টগরদের বাড়িতে । ফিরে যাওয়ার আগে হারু আর লক্ষ্মী অবশ্য আমাদের সেই মাশান ঠাকুরের থান দেখিয়ে আনলো। প্রকাণ্ড একটা বটগাছের নিচে ছোট মত একটা মন্দির । বটের ঝুরিগুলো মাটিতে নেমেছে । গ্রামের একেবারে প্রান্তে সে জায়গা । দু’তিনটে গরুর খুঁটি বাধা রয়েছে । তাছাড়া সেখানটা জনমানব শূন্য । আমি অবশ্য কাটরা-পুকুরটাও দেখতে চেয়েছিলাম । শুনে হারু আর লক্ষ্মী দুজনেই দু’ ইঞ্চি করে জিভ বার করে, দু’কানের মধ্যে আঙ্গুল গুঁজে দিল। আর বিশেষ ভরসা পেলাম না।

বাড়িতে ফিরে এসে কিছুক্ষণ গল্পগাছা করলাম টগরের বৌদিদের সাথে । তারা ততক্ষণে গৃহস্থালির কাজকর্ম মোটামুটি সেরে ফেলেছে। দাওয়ায় বসে কথাবার্তা হচ্ছিল। গ্রামের কথা, পাড়া-প্রতিবেশীর কথা, তাদের সন্তানদের কথা, সব রকম কথা ।
উঠোনের কোণের দিকে একটা বাঁশের লাঠির মত কি একটা রয়েছে । তার গায়ে চৌকোনা জালের মত একটা গঠন ।
জিজ্ঞাসা করলাম, ওইটা কি ?
টগরের মেজবৌদি উত্তর দিল, ওইটে যে টঙ্গী জাল । ভরা বাদলে এইসব নিয়ে বেরিয়ে ছেলেপুলেরা সব মাছ ধরে আনতো।
মনে পরল টগরের সেই মাছ ধরার গল্প ।
টগরের বড়বৌদি বেশ উত্তেজিত গলায় আমাকে বলল , আপনে আইজ রেতে থাইবেন নে ?
হেসে বললাম, না, রাতে তো থাকা হবে না।
সে গালে হাত দিয়ে ভীষণ অবাক হয়ে বলল, ওমা ! তাইলে কি করে হবে ? আইজ যে বৈকাল থিকে পালাগান আচে। পালটিয়া গান হয় যে ভাদর শেষে আশিন মাসে। আইজ মোদের বাড়ির দুয়ারে বইবে কিনা –
— তাই নাকি ? সেটা কিরকম?
— আপনে তো রেতে থাইবেন নেকো । তাইলে আর কিভাবে দেখবা ?
তার ছোট যা বলল, অবশ্যি বৈকাল থিকে শুরুটা হই যাবা । রেতে যদি কিছুতেই না থাকা হয় কিনা, শুরুর খানটা দেখতে পাবা-
টগর কোথা থেকে ঘুরে এসে আলোচনা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল , দিদি তোমাকে তো কতবার বললাম কিনা, এই একটা রেতে থেকে যাও । তা, তুমি তো শুনবা না কতা।
মাঝের এই কটা মাসে ওর আমাকে ‘মেম’ বলা আর ‘আপনি আজ্ঞে’ করাটা ছাড়িয়েছি। প্রথম প্রথম দিদিমণি বলছিল । এখন অবশ্য শুধু ‘দিদি’ বলে ।
আমি বললাম, না গো টগর । তুমি তো জানোই । আজকে ছুটির দিন ছিল বলে আসতে পারলাম । কালকে সাত সকালে উঠে বাড়িতে ফিরে গিয়ে আবার সেই সারাদিন দৌড়ঝাঁপ আর পারি না গো । রাত্রেবেলাটা একটু রেস্ট নিলে সকাল থেকে ফ্রেশ লাগবে ।
আরো কিছুক্ষণ গল্পগাছা চললো ।
তারপর টগর বললো, আমাদের পাতা তো খুব জোর করছিল পুকুর ঘাটে নাইতে যাবে বলে ।
শুনে আমার চোখ কপালে উঠলো , বললাম , সেকি ! ও তো তোমার সাথেই ছিল-
অল্প হেসে সে বলল , আরে চিন্তা করেন না দিদি । ওকে আমি ওমনি ঝোঁক করলেই কি পুকুরে নাইতে পাঠিয়ে দেবো নাকি? জোর করে চানঘরে নাইতে পাঠিয়েচি। এমনি হয়তো এতক্ষণে তার নাওয়া হলো । তুমি নেয়ে নাও যাও-

স্নান সেরে দুপুরে খেতে বসলাম । ভাতের পাতে ছিল- অল্প মোটা চালের ভাত , তার সাথে জমির লালশাক ভাজা, লক্ষ্মী যেগুলো কোঁচর ভর্তি করে তুলে এনেছিল ; উচ্ছে ভাজা , ডাল , লাউ ঘন্ট, ডালের বড়া দিয়ে মোচার তরকারি, দেশী মাগুরের ঝোল , সরপুঁটি দিয়ে তেঁতুলের টক, তার সাথে দই , মিষ্টি । প্রতিটাই কাঁসার পাত্রে , একেবারে যেন সোনার মতো ঝকঝক করছে । একটা রেকাবিতে আবার সাজা পান কয়েকটা । এটা নাকি তাদের শুভ । অতিথি আপ্যায়নের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । অনেক কিছু আয়োজন করেছে তারা । মোটামুটি সবই খেলাম । তবে মিষ্টিটা আর খেতে পারিনি ।
খেয়েদেয়ে উঠে মাটির ঠাণ্ডা ঘরে একটু গড়াতে ইচ্ছে করলো । পাতা তো মোটেই শোবে না । সে তার নতুন পাওয়া সঙ্গীদের সাথে খেলায় মত্ত । টগরকে বলে দিলাম পাতাকে চোখে চোখে রাখতে । অবশ্য তাকে এসব ব্যাপারে কিছু বলতে হয় না । সে আমাকে তাদের বাড়ির মধ্যে যেটা সবচেয়ে বড় শোবার ঘর , দক্ষিণ খোলা , সেই ঘরটাতে মেঝের ওপরে একটা চাটাই বিছিয়ে দিল । শুয়ে পড়লাম সটান । মাটির ঠান্ডা ঘরে , মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে যেভাবে ঘুমটা হবে , সেটা একেবারে স্বর্গীয় । কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়েও পড়লাম ।
ঘুম ভাঙলো যখন, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল । বাড়ির উঠোনের দিকে সম্মিলিত কিছু মহিলা মহলের গলার আওয়াজ পেলাম । ঘরের দরজা খুলে তাকিয়ে দেখলাম বেশ কিছু প্রতিবেশী মহিলার সমাগম হয়েছে বটে । বাইরের দালানে বেরিয়ে এলাম গুটি গুটি পায় । হ্যাঁ , বেশ কিছু জনের জমায়েত হয়েছে । দু একজন অচেনা পুরুষও রয়েছে সেখানে । তারপরেই মনে পড়ে গেল, ওহো ! একটা পালাগান না কি যেন হওয়ার কথা বলছিল টগরের বৌদিরা । ধীরে ধীরে কিছুক্ষণের মধ্যে উঠোনটা বেশ ভরে উঠলো । মহিলার সংখ্যাই বেশি, তবে পুরুষও রয়েছে। টগর পাতাকে নিয়ে এসে আমাদের দুজনের হাত ধরে একেবারে সামনের সারিতে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হলো পালটিয়া গান পাবন । উর্বর ফসলের কামনায় আশ্বিন মাসে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে এই পালাগান হয় । ভাওয়াইয়া গান আর ছড়ার তালে তালে পৌরাণিক কোন উপকথার সূত্র ধরে নাচ । বিভিন্ন পালাগান, এই ধরনের আসর, এখনো উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে দেখা যায় । ভাওয়াইয়া কথাটা হয়ত ‘ভাব’ থেকে এসেছে । পালাগান , সাথে সাথে আবার কিছু গ্রামবাসী বিভিন্ন প্রাণীর আদলে গড়া মুখোশ পরে তালে তালে ঘুরে ঘুরে নেচে থাকে। এই মুখোশের চল ভুটান সান্নিধ্য থেকে এ অঞ্চলে এসে থাকতে পারে, কিংবা পুরুলিয়া মেদিনীপুর থেকে চা বাগানের ব্যবসার একেবারে আরম্ভের দিকে বেশ কিছু শ্রমিক এনে উত্তরবঙ্গে কাজ করানো হতো, তাদের থেকেও পুরুলিয়ার ছৌ নাচের আদলে এখানে প্রচলিত হয়ে থাকতে পারে । পৌরাণিক বিভিন্ন চরিত্র, হিন্দু ঠাকুর দেবতা , শিব পার্বতী, রাধা কৃষ্ণ , এই সব গানের অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে। ভাওয়াইয়া আর চটকা গান এই দুই লোকগীতি মূলত উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে এই সমস্ত পালাগানে গাওয়া হয়ে থাকে। যে সমস্ত স্ত্রী-পুরুষরা গান গাইবে , তারা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরে মাথায় ফুল গুঁজে সেজেগুজে এসেছে, আবার পুরুষরা পরেছে কোঁচা মেরে ধুতি পাঞ্জাবি । দোতারা রেখেছে সঙ্গে ।

আমি বেশিক্ষণ সেসব শুনতে পারলাম না। সময় নেই যে । তবে তার মধ্যে একটা গান বেশ কানে বাজতে লাগল। গানের কথাগুলো এইরকম, কিছুটা বৈষ্ণব পদাবলীর ছোঁয়া-
“কিসের মোর রাঁধন , কিসের মোর বাড়ন
কিসের মোর হলুদী বাঁটা
মোর প্রাণনাথ অন্যের বাড়ি যায়
মোর আঙিনা দিয়া ঘাটা -”
কল্পনায় দেখতে পেলাম একটি বিরহী মেয়েকে ছেড়ে তার প্রেমাস্পদ চলে যাচ্ছে । তার হৃদয়ের সবটুকু উথাল পাথাল করে দিয়ে। ঠিক যেমন রাধাকে ছেড়ে কানাই চলে গেছিল । সেই মেয়েটির কাছে সংসারের সমস্ত কাজ অর্থহীন লাগছে তাই । উদাস হয়ে গেল মনটা।

হঠাৎ করে আমার হাতের ওপর কারো আঙ্গুলের স্পর্শ পেলাম । কেউ যেন আমায় ডাকছে । মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম একটি গ্রাম্য বধূ , সে একটু দূর থেকে হাত বাড়িয়ে আমার হাতের ওপর চাপ দিয়ে আমাকে ডাকছে ,
— অ দিদিমুণি –
আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম তার দিকে , আমাকে কিছু বলছো?
ওপর নীচে ঘাড় নাড়লো সে ।
বললাম, কি বলছ?
সে বলল, আপনে মানিজার দিদিমুণি কিনা ?
— হ্যাঁ বল-
খুব উত্তেজিত হয়ে সে বলল, মোর ভাইটু আচে না ? আপনের ওকেনে কাম করে যে । গোপাল, গোপালকে চিনেন কিনা ?
অল্প হাসলাম । কত লেবার, তার মধ্যে কে গোপাল, কেইবা সুবল। চেনা সম্ভব নয় ।
মুখে বললাম, আমার চা বাগানে ? তুমি বুঝি তোমার ভাইয়ের মুখে আমার কথা শুনেছ ?
— হিঁ গা । সে তো খুউব কয় আপনের কতা। এই পেত্তম তুমি মে’ছেলে হই কিনা মানিজার হই এলা! বাপ্পাহ্!

গালে হাত দিয়ে প্রায় চোখ কপালে তুলে সে বললো,
— আমি কই কিনা, মোর কত্তারে সব্যক্ষণ কই । মোদের দিয়া তো সারাটা জেবন রান্ধাবাড়া , উঠোন নিকেন বই আর কিচ্চুটি করতে দিলা না । মোদেরও বুজি নেকাপড়া করাইলে মোরা ওরম চারটে নিকে-যুকে কাম-কাজ কত্তে পাইতাম নেকো? যকনই ভাই ফোন করে কিনা, আমি আপনের কতা শুদাই । আপনের কথা শুনতে কি ভালোই যে নাগে –

কী ভাল যে লাগলো তার কথাগুলো শুনে ! এই প্রথম আজ এক অজ পাড়াগাঁয় এসে পালাগান শুনতে শুনতে একটি গ্রাম্য বধূ আমাকে মন খুলে বলল , তার আমাকে খুব ভালোলাগে । আমার গল্প শুনে নাকি আমাকে তার ভারী পছন্দ । আমি চা বাগানের ম্যানেজার হয়েছি, পড়াশোনা করে চাকরি করছি, এটি তার ভারী পছন্দের । তারও জীবনে সাধ ছিল, সেও লেখাপড়া করে চাকরি করে। চা বাগানে মহিলা হয়ে ম্যানেজার পোস্টে জয়েন করার পর থেকে এটি আমার প্রথম অ্যাপ্রিসিয়েশন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে।

সন্ধ্যার মুখে মুখে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম । বেরোনোর আগে টগরের সবকটা ভাইপো ভাইঝিকে দুশো’টা করে টাকা দিয়ে এলাম । সামনে পুজো । তারা তাদের মনের মতো করে খরচ করবে । ওরা খুব খুশি হলো। গাড়িতে উঠে বসলাম । টগরের বাড়ির প্রত্যেকে তো বটেই , অন্যান্য বাড়ির অনেকেও আমাদের গাড়ির সামনে এসে আমাদেরকে বিদায় জানালো । বারবার করে আবার আসতে বলল ।
জগন্নাথ দা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিল । এগিয়ে চলল গাড়ি । তখনো পর্যন্ত জানতাম না , সেদিন কি সাংঘাতিক এক ঘটনা ঘটতে চলেছে-

ক্রমশ..