হলদে প্রজাপতি পর্ব-২৬+২৭+২৮

0
229

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

ছাব্বিশ

পুজো আসছে । মায়ের মুখ, নতুন শাড়ির গন্ধ, বাবা-মা, পাড়ার প্যান্ডেলে ঢাকের বাদ্যি, অষ্টমীতে মায়ের হাতের ফুলকো লুচি- সবকিছু আমার মনকে প্রবলবেগে কলকাতার দিকে টানতে লাগলো । খুবই স্বাভাবিক । আজ পর্যন্ত তো কোন পুজোয় বাবা-মায়ের থেকে দূরে কাটাইনি। মালিকপক্ষ মাত্র পুজোর চারটে দিনের জন্য ছুটি দিতে চাইছে। আমি আরো এক্সট্রা কয়েকটা দিনের জন্য আ্যপ্লাই করলাম । একবারে ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যার ট্রেনে চেপে বসবো। সপ্তমী থেকে লক্ষ্মীপুজো বাবা-মা’য়ের কাছে । অন্য কোন প্রশ্নই ওঠে না । বাবার কাছে কত দিন বসে শান্ত মনে কথা বলা হয়নি। পুজো এমন একটা আবেগ, যখন বাবা-মা’য়ের কথা তো ছেড়েই দিলাম, এমনকি পাড়ার বিমালা কাকিমাকে পর্যন্ত মিস করতে থাকি। বিমালা কাকিমার পাড়ার প্যান্ডেলে এসে মায়ের পাশের চেয়ারটাতে বসে পাড়ার যত রাজ্যের পরনিন্দা পরচর্চা – এও যেন মনে হয় বড় একটা উপভোগের ব্যাপার । সবকিছু মিলিয়ে পুজোর সঙ্গে জড়িত যেকোনো কিছুই প্রতিটা বাঙালি নিজের বাড়ি থেকে দূরে থাকলে মিস করতে থাকে ।

দেখতে দেখতে ষষ্ঠী চলে এলো । টগর আবার বায়না ধরেছে আমার সাথে ও এবার কলকাতায় পূজো দেখতে যাবে । তা আমার প্রস্তাবটা বেশ ভালোই লেগেছে। ও ঘুরলো, পুজো দেখল, খানিকটা আনন্দ পেল । আবার , পুজোর দিনে বিশেষ রান্নাবান্না প্রতিদিনই দু-একটা পদ কম করে হয়ই, তারপর সাধারন রান্নাবান্না তো আছেই। সব মিলিয়ে রান্নার একটা ধুম পড়ে যায় প্রতিটা বাড়িতে । মা’কে সে ব্যাপারে ও হেল্প করে দিতে পারবে । রান্নাবান্না সম্পূর্ণ করেও দিতে পারে । রান্নার হাতটা খুব ভালো তো। কাজেরও মেয়ে । কাজেই সব মিলিয়ে আমার ভারি মনঃপূত হয়েছে ব্যাপারটা ।

ঠিক সপ্তমীর দিন সকালে পৌঁছলাম বাড়িতে । চারিদিকে পুরোদমে পুজোর মরসুম চলছে । ঢাকের বাদ্যি , পুজোর গান.. ভরা মন নিয়ে ফ্ল্যাটে পৌঁছলাম। পুজোর সময় নিজের বাড়িতে ফেরা যেকোনো বাঙালির কাছে ঠিক যেন শুধু বাড়িতে ফেরা নয় , শেকড়ের টানে মাটিতে এসে পৌঁছোনো । যেমন বাড়িই হোক , পছন্দের অপছন্দের যাই বা হোক, তখন তা স্বর্গ বলে মনে হয় । আর বাবার ওই সাদা পাঞ্জাবি পরা চেহারা, হাসিতে উজ্জ্বল মুখটা দেখলে বুক জুড়িয়ে যায় , প্রাণ ভরে ওঠে । বাবার সাথে প্রাণভরে গল্প করে , মায়ের হাতের রান্না পেট ভরে খেয়ে আর টগরের সঙ্গে আরো একজন-দুজন বান্ধবী জুটিয়ে নিয়ে প্যান্ডেল হপিং করে জব্বর পুজো কাটলো। পুজোর ছুটির মধ্যে আরও একটা বড় পাওনা হল- লক্ষ্মী পুজো উপলক্ষে পুরুলিয়ায় আমাদের দেশের বাড়িতে গেলাম । সেই রাঙ্গামাটির রাস্তা, দূরে দূরে ছবির মত টিলা পাহাড় – টগর তো ভীষণ খুশি ! সে বেচারি বেড়াতে কোথাও যেতেই পায়না । একসঙ্গে কলকাতা, পুরুলিয়া দুটো জায়গায় ঘুরতে পেয়ে খুশিতে একদম ডগমগ করছে।

সবই তো হলো । কিন্তু ছুটি তো আর অনন্ত নয় । ভাগ্যে লক্ষ্মী পূজার পরের দিনটা রবিবার পড়েছিল । সেদিনই রাতে ট্রেনে উঠলাম। পরের দিন সকালে আবার জগন্নাথের সঙ্গে গাড়িতে করে আমার সেই টি এস্টেট ! সত্যি কথা বলতে কি, কিছুক্ষণের জন্য মনে নিম্নচাপ তৈরি হয় বৈকি । সেই ট্রেনের বেগে কাশের বনে ঢেউ তুলে দুর্গাপুজোর ভরা আনন্দ বুকে নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়া । তারপর আবার ফিরে আসা নিজস্ব এই কর্মক্ষেত্রে। কিছুক্ষণের জন্য কিছুই ভালো লাগেনা । পুজো শেষ- এই অনুভূতিটাই বাঙালির মনে নিম্নচাপ ঘনিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট । তবে আমার এই দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ কর্মক্ষেত্রের মধ্যে এমন একটা সজীবতার ছোঁয়া রয়েছে যে, সেই নিম্নচাপ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সুযোগ পায় না। আবার মেতে উঠলাম প্রতিদিনের রুটিনে । আমার চা’ গাছগুলোর সঙ্গে কথা বলা , তাদের যারা দেখাশোনা করে, তাদের সঙ্গে কথা বলা – সবই চলতে লাগলো ।

সাত মাস কেটে গেছে আমি জয়েন করেছি । এখন নভেম্বর মাস । প্রাথমিক বড়োসড়ো বেশকিছু বাধা কাটিয়ে উঠে এখন আমার সঙ্গে চা বাগানের শ্রমিকদের সম্পর্ক অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। অবশ্য এর জন্য বড় একটা কৃতিত্ব ইন্দ্রাশিষ বাবুকে দিতেই হয় । বিশাল বড় যে ধাক্কাটা এসেছিল, সেটা তিনি সামলে না দিলে আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না । ইন্দ্রাশিষ বাবুদের বাড়ির সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা আরো কিছুটা বেড়েছে । পাতার সাথে বন্ধুত্বও। পাতা এখন পারলে সারাদিনই আমার কাছে থাকতে চায়। নিজের বাড়িতে যেতেই চায়না একবার এলে । এক-আধদিন বাদে মোটামুটি প্রতিদিনই চলে আসে। দিনের ম্যাক্সিমাম টাইমটাই এখন আমার বাংলোয় কাটিয়ে যায়। ইন্দ্রাশিষ বাবু অবশ্য এর জন্য অনুতপ্ত । ওনার ধারনা, উনি ওনার মেয়েকে সময় দিতে পারেন না বলেই পাতা আমার কাছে থাকতে এত ভালবাসে। কিন্তু আমি জানি , উনি ওনার মেয়েকে সময় দিলেও পাতা আমার কাছে থাকতেই বেশী ভালোবাসতো । মেয়েরা একটা নির্দিষ্ট বয়স পার হয়ে আসার পর বয়সন্ধি আসার আগে থেকে মায়ের সাথেই স্বচ্ছন্দ থাকে বেশি । বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে । তার কারণ আর কিছুই নয় , নিজেদের অজান্তেই তারা যেকোনো স্ত্রীলোকের কাছে বেশি সেফ আ্যন্ড সিকিওর ফিল করে । সেটা হয়তো না জেনেই , সেক্সুয়ালিটি , লিঙ্গভেদ এগুলো সম্পর্কে ধারণা গড়ে ওঠার আগেই তারা মানসিকভাবে পুরুষদের থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে । আবার যৌবন এলে তখন সমবয়সী বা নিজেদের থেকে কিছুটা বয়সে বড় যুবকদের প্রতি একটা আকর্ষণ অনুভব করে। এগুলো সমস্তই প্রকৃতিগত ব্যাপার । কিছু বলে দিতে হয় না। কিছু শিখিয়েও দিতে হয় না । সমস্তই নিজে থেকে ঘটে চলে । হয়তো সেরকম কোনো কারণেই পাতা যত দিন যাচ্ছিল, আমার ন্যাওটা হয়ে পড়ছিল ।

তখন নভেম্বরের শেষের দিক । শীতের সূচনাপর্ব ডুয়ার্সের কোল ঘেঁষা এই সমস্ত চা-বাগানে, উত্তরবঙ্গে, আগে থেকেই শুরু হয়ে যায়। দক্ষিণবঙ্গে তো নিদেনপক্ষে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি না হলে শীতের আমেজ বোঝাই যায়না। কিন্তু উত্তরবঙ্গের এই সমস্ত জায়গায় নভেম্বর থেকেই শীত তার আমেজ বুঝিয়ে দিতে শুরু করে । আর শীতের আমেজ শুরু হয়ে যাওয়া মানেই, মনটা করে পালাই পালাই । বেড়ানো, পিকনিক, পাহাড় , জঙ্গলের কোণে কোণে ঘুরে বেড়ায় । তখন আর বাড়িতে মোটেই মন টেকে না। মনের মধ্যে নানা রকম মানস ভ্রমণের আলপনা বুনে চলেছি , কিন্তু তখনও পর্যন্ত বেড়াতে যাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট প্রোগ্রাম ঠিক করে উঠতে পারিনি ।

একটা ছুটির দুপুরে ইন্দ্রাশিষ বাবুর মায়ের কাছ থেকে লাঞ্চের আমন্ত্রণ পাওয়া গেল । আলাপ পরিচয় থাকলেও সে ভাবে আলাপ জমানোর সুযোগ হয়ে ওঠেনি ভদ্রমহিলার সাথে । বয়স প্রায় সত্তর ছুঁইছুঁই হলেও তিনি যথেষ্ট কর্মঠ । যদিও বাতের ব্যথার কারণে বাড়ি থেকে বেরিয়ে খুব একটা হাঁটাচলা ঘোরাফেরা করার ক্ষমতা নেই। তবে বাড়ির মধ্যে সমস্ত কাজ আর দেখতে হবে না , একা হাতেই সমস্তটা সামলে নেন । আমরা, আমি আর টগর , গিয়ে পৌঁছলাম প্রায় বেলা বারোটা নাগাদ । একটু তাড়াতাড়িই গেছিলাম । দুপুরের খাওয়া দাওয়ার জন্য সময়টা তাড়াতাড়িই বটে । হাতে সময় নিয়ে যাওয়ার কারণ হলো, টগর কিছুটা সাহায্য করে দিতে পারবে। কিন্তু, গিয়ে দেখি , ওমা , কোথায় কি! ওনার সমস্ত কাজই তখন অলরেডি সারা হয়ে গেছে । ইন্দ্রাশিষ বাবুর মা ছোটখাটো চেহারার একজন বৃদ্ধা । বাত জনিত কারণে বয়সের চেয়ে একটু বেশিই বয়স্ক লাগে। মাথার প্রায় আশি শতাংশ চুলই পেকে সাদা হয়ে গেছে । তবে এখনো চুলের গোছ আছে । যে খোঁপাটা করে রাখেন , সেটার আকার আমার পক্ষে বেশ লোভনীয় । চোখ দুটোর মধ্যে একটা সদাসতর্ক, এদিকে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি । যেন বুঝে উঠতে পারছেন না কোথায় কি করা উচিত। তবে যেটুকু উনি করেন সেটুকু যে যথেষ্ট গুছিয়ে করেন, তা ঘরদোর দেখেই বোঝা যায় । গলার স্বরে অবশ্য বয়সের ছাপ তেমন পড়েনি । বড়জোর বছর পঁয়ত্রিশ চল্লিশের মহিলার গলা মনে হবে কথা শুনে। ইন্দ্রাশিষ বাবুর ফিরে এসে আমাদের সঙ্গেই লাঞ্চ করার কথা সেদিন । তবে ফিরতে দুটো আড়াইটে তো হবেই । অগত্যা ওনার মায়ের সঙ্গেই জমিয়ে গল্প করতে লাগলাম । এদিকে সেদিন পাতার একজন বান্ধবী এসেছে- টুসি । সে এক চা শ্রমিকের মেয়ে । মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে চা বাগানে চলে আসে, টুকটাক কাজ করে দেয় মায়ের হাতে হাতে । সেই থেকেই পাতার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব । পাতা তার সমবয়সী বন্ধুকে পেয়ে আমার কাছে আজকে কম ভিড়ছে ।
টুসি পাতার থেকে মাথায় অল্প একটু লম্বা, রোগা ডিগডিগে।
সে ছুটতে ছুটতে এসে একবার আমাকে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত জরিপ করে নিল । তারপর বলল, তোমার মাথায় সিঁদুর কই ?
আমি প্রথমটায় বেশ ঘাবড়ে গেলাম প্রশ্ন শুনে ।
তারপরে হেসে বললাম, সব মেয়ের মাথায় বুঝি সিঁদুর থাকে ?
— মেয়েদের কেনো থাকবে গো ? বউদের তবে থাকে –
হেসে ফেললাম ।
বললাম , আমি বউ নই ।
শুনে গালে হাত দিয়ে চোখ দুটোকে ছানাবড়া করে বলল, সেকি! তুমি বিয়ে করনি বুঝি ? তোমার বর নেই ?
— না নেই ।
— ওমা! তা আবার হয় নাকি ?
— কেন হয় না ? সকলের কি বর থাকে?
— সক্কলের বর থাকে । আমার মেজদির বর আছে, সেজদির বর আছে ..
আরো দু-চারটে লম্বা লিস্ট দিয়ে সে বলল, সবাই মাথায় আ্যই মোট্টা করে সিঁদুর পরে।
— খুব ভালো কথা । আজকে আমাকে দেখলে তো ? আমার বর নেই , কেমন ? সকলের বর থাকে না । যাও তুমি এখন। পাতার সঙ্গে খেলা করবে যাও।
সে আরো কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে চলে গেল । যেন আমার মত কিম্ভূত কিমাকার জীব জগতে সে আর দুটো দেখেনি ।

সে চলে যেতে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ইন্দ্রাশিষ বাবুর মা আমাকে একই প্রশ্ন করে বসলেন , তুমি বিয়ে করনি কেন এখনো?
ওনার প্রশ্নের ধরন শুনে বুঝলাম, উনি এই প্রশ্নটা অনেকক্ষণ ধরেই আমাকে হয়তো করতে চাইছিলেন , সুবিধা করে উঠতে পারছিলেন না । টুসি সেই সুবিধাটা করে দিয়ে গেল ।
আমি বললাম , করিনি কেন ? ওরকম ভাবে কোনো কারণ ঠিক নেই। করা হয়নি , এই আর কি-
শুনে বললেন , আশ্চর্যের বটে ! এত ভালো চাকরি করো, দেখতে-শুনতেও ভালো, অথচ বিয়ে করোনি ?
এই এক অস্বস্তিকর প্রশ্ন । অজানা , অচেনা, স্বল্প-পরিচিত সমস্ত মানুষ দুমদাম করে এই প্রশ্ন আমাকে করে বসেন । যেন বিয়ে করাটা জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ । ওটা না করে আমি একটা বিশাল বড় অপরাধ করে বসে আছি ।
দুজনেই কিছুক্ষন চুপ করে রইলাম ।
এরপর হঠাৎ করেই বৃদ্ধা একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আর ভালোই করেছো। বিয়ে করেই বা কি ? আমার ছেলেটার তো এত কান্ড করে বিয়ে দিলাম। কি যে হলো বিয়ে করে ?
আমি কিছু বললাম না । চুপ করে রইলাম ।
উনিও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে এরপর সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে আমাকে একটা প্রশ্ন করে বসলেন ।
বললেন , তোমার পদবী কি মা ?
প্রশ্ন শুনে কয়েক সেকেন্ড আমি ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলাম ।
তারপর হাসি মুখে বললাম , ঘোষ , আমার সারনেম ঘোষ ।
— ঘোষ!..
একবার বলে আমার দিকে তাকালেন তিনি। ওনার তাকানোর ভাষা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
তারপর বললেন , তোমরা কি কাস্ট?
এইরে ! আমার কাস্ট নিয়ে আবার ওনার কী প্রয়োজন পড়ল ? সঠিক কারণ অনুমান করতে না পারলেও ভেতরটা অল্প একটু উত্তেজনায় দুলে উঠলো।
অল্প হেসে বললাম, কায়স্থ , আমরা কায়স্থ ।
শুনে তিনি চুপ করে গেলেন । বেশ কিছুক্ষণ মুখ নিচু করে চুপ করে রইলেন । আমার বেশ অস্বস্তি হতে লাগলো । কিছুক্ষণ পর ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ তুললেন । তারপর কয়েকটা কথা বললেন । মনে হল যেন নিজের ভাবনার জগতের অতীতের মাটি খুঁড়ে তিনি কথাগুলো তুলে এনেছেন ।
ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবে কিছুটা স্বগতোক্তির মতো বললেন , কায়স্থ ! যখন আমার ইন্দ্র তখন কলেজে পড়ে । কলেজের শেষের দিকে আমাকে সে বলেছিল , ওর নাকি একটা মেয়েকে ভাললাগে । ওর সঙ্গেই কলেজে পড়ে সে। মেয়েটার নাম কি বলেছিল ভুলে গেছি। তবে পদবী ছিল দাস । কায়েতের মেয়ে । আমি পরিষ্কার কয়ে দিয়েছিলাম , এইসব কাস্টের মেয়ে জুটিয়ে ঘরে তুললে, হয় সেই মেয়ে থাকবে, নয় আমি থাকবো । বামুন ছাড়া অন্য কোন ঘরের মেয়েকে বউ করে ঘরে আনা যাবেনা।
অল্পক্ষণ চুপ করে কিছুটা বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সেই একবারই কয়েছিল। আর না। তারপরে অনেকগুলো বছর বিয়ের কথা তুললেই এড়িয়ে যায়, এড়িয়ে যায় .. এরকম করে কাটলো । শেষে বত্রিশে গিয়ে ছেলের বিয়ে দিলাম । নিজে দেখে শুনে দিলাম । একেবারে খাঁটি বামুনের মেয়ে – মুখুজ্জে । দেখ না, তারপর কি হলো ! ছেলের আমার সংসার করাই হলো না। মনে হয় যেন নিজে হাতে সব ভাসিয়ে দিয়েছি। তারপরেও সমস্ত বাবা চুকেবুকে যাওয়ার পর , কাগজপত্রের সব সইসাবুদ হয়ে গেল, মিটে গেল, তারপর কতবার কয়েছি , আর একটা বিয়ে কর্। সে যেন আমার কোন কথা কানেই তোলে না।
এইরকম অস্বস্তিকর একটা প্রসঙ্গ যে উত্থাপন হতে পারে আদৌ, ভাবতে পারিনি । চুপ করে বসে রইলাম । উনিও চুপ করে বসে রইলেন ।
কিছুক্ষণ পর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বললেন, দেখি একটু –
বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন । কী দেখবেন বলে যে গেলেন ঠিক বোঝা গেল না । উনি বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজা দিয়ে ঝড়ের বেগে ঢুকলো পাতা। ঢুকে আমি যে চেয়ারের ওপর বসে ছিলাম, সেখানে এক ছুটে এসে আমার কোলের কাছে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে উত্তেজিতভাবে বলতে লাগল, ও নাকি একটা অদ্ভুত সুন্দর রঙের ফড়িং দেখতে পেয়েছে । আমার হাত ধরে টানতে লাগলো। আমাকে তখনই উঠে সেটা দেখতে যেতে হবে ।
আমি বললাম, ফড়িং কি এক জায়গায় বসে থাকবে রে? সেটা কখন উড়ে পালিয়েছে ।
— তুমি দেখবে চলনা মণি?
হাত ধরে ঝাঁকাতে লাগলো । অগত্যা আর কি করা যায়? উঠতে হলো । উনি দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে রইলেন আমাদের দিকে । আমি ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা পেরিয়ে পাতার সঙ্গে যেতে যাচ্ছি , উনি পেছন থেকে বললেন,
— তুয়া তোমাকে বড্ড ভালোবাসে। সব সময় তোমার কথা বলে । তোমার সাথে থাকতে চায় ।
আমি পেছনে ঘুরে তাকালাম একবার ভদ্রমহিলার মুখের দিকে। উনি কি কিছু বলতে চাইলেন আমায় ? বেরিয়ে এলাম পাতার সঙ্গে ।

ঘন্টাখানেক পরে ইন্দ্রাশিষ বাবু ফিরলেন । জমিয়ে দুপুরের খাওয়া হল, সাথে আড্ডা। ইন্দ্রাশিষ বাবুর মায়ের রান্নার হাত ভালো । মুড়িঘন্ট আর খাসির মাংসের ঝোলটা তো জাস্ট অনবদ্য হয়েছিল । মুখে লেগে রইলো । খেতে খেতেই বসে ঠিক হলো আমরা খুব শীগ্রই একটা পিকনিক করবো । ডুয়ার্সের কোন একটা বাফার জোনে হবে বলে ঠিক হলো । জায়গা যদিও ঠিক হলো না , তবে টুরিস্ট রাশ কম থাকবে এরকম একটা নিরিবিলি জায়গা খুঁজে বার করা হবে বলে ঠিক হলো।

ক্রমশ..

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

সাতাশ

ডিসেম্বর মাস শুরু হয়েছে । এখানে ডিসেম্বর মাস মানে যথেষ্ট শীত। এর মধ্যে একদিন ছুটির দিন দেখে আমি আর টগর দুজনে মিলে শিলিগুড়ি গিয়ে কিছু শীতের পোশাক, ব্ল্যাঙ্কেট ইত্যাদি কিনে এনেছি । শীতকালটা চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য ভালো। তাদের অন্তত রোদে পুড়ে কাজ করতে হয় না। শীতের রোদ তো গায় ভালো লাগে। শীতের রোদ যেন একটু বেশিই সোনালী । চা পাতার ওপর দিগন্তবিস্তৃত সোনালী ফোঁটাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মন উড়ে যায় দূরে কোথাও । দূরের কোনো অদেখা পাহাড়, জঙ্গলে, মন ঘুরে বেড়াতে চায়। দূরের কোন দেশ, অজানা কোন রাজ্য। ঠিক যেন স্বপ্নের মত মনে হয় । তারপরেই মনে পড়ে যায়, আমার জন্মভূমি , আমার বঙ্গদেশ কৃপণ কোথায় ? সে তো উত্তরে পাহাড়, দক্ষিণে সমুদ্র, উত্তর-দক্ষিণ মিলিয়ে জঙ্গল, সবকিছুই দিয়েছে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে তো সবসময়ই কাঞ্চনজঙ্ঘার হাতছানি।

ছুটির দিনে স্নান করে উঠে চুল খুলে রোদের দিকে পিঠ করে লনে বসে থাকতে খুব ভালো লাগে । এখনো যদিও খুব বেশিক্ষণ বসা যায় না, আর কটা দিন পরে দুপুরবেলাটা লনে বসে গল্প করে কাটিয়ে দেবো ভাবছি। ছুটির দিনের সোনালী দুপুর। হারানদা আবার কয়েকটা শীতের মরসুমী ফুল লাগিয়েছে। লনের সামনের দিকটাতে দুপাশে সার দিয়ে বেশ কিছু ক্যালেন্ডুলা আর গাঁদা। এখনো পর্যন্ত যে খুব বেশি সংখ্যায় ফুল ফুটছে তা নয়, তবে যে কটা ফোটে আলো হয়ে থাকে। গেটের ছাউনির ওপর দিয়ে লতানে গার্লিক ভাইন তুলেছে একটা। সেটা এই সময়ে ফুলে ভর্তি হয়ে বেগুনি হয়ে থাকে। পাতা দেখাই যায় না ।

আজকাল আবার আমাদের আরেকজন সাথী জুটেছে- টগরের খুড়তুতো বোন কমলা। তার স্বামী গতবছর চা বাগানে কাজ করার সময় সাপের কামড়ে মারা যায় । মেয়েটা আমারই সমবয়সী। দুটো মেয়ে আছে । দুজনেই সাবালিকা । একজনের বয়স আঠারো, আরেকজনের কুড়ি। দু জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। একা একা দিনকাল ভালো কাটছিল না কমলার। শ্বশুর বাড়ির লোকজনও মানসিক, শারীরিক, অত্যাচার করছিল যাতে সে বাড়ি ছাড়া হয় । এসমস্ত শুনে টগরই আমার কাছে পারমিশন নিয়ে ওকে কয়েকটা মাসের জন্য এখানে এনে রাখতে চেয়েছিল । আমার আর কিসের অসুবিধা? টগরের হাতে হাতে একটু হেল্পও হবে, আবার একটা অসহায় মেয়ে দুবেলা-দুমুঠো খাবে বৈ তো নয়। সেটুকু দিতে তো আর আমার ভাঁড়ার শূন্য হয়ে যাবে না। কাজেই সে এসে আছে । মেয়েটা যখন এসেছিল বেশ মনমরা ছিল। এখন অবশ্য আমাদের সঙ্গে হাসি, গল্পে মেতে থাকে। কমলা কিছুটা ওর খুড়তুতো দিদি টগরের মতই দেখতে। হাবেভাবেও মিল আছে। শরীরের বাঁধুনি খুব । কালো চিকন ত্বক। দুটো চোখে ভাষা আছে। নাকটা চ্যপ্টা, চুলের গোছ ভালো। তবে টগরের থেকে কিছুটা লম্বা। স্বামী মারা যাওয়ার পর শ্বশুরবাড়িতে সে বাধ্য হয়ে নিরামিষ খেত। কিন্তু মেয়েটা মাছ-মাংস খেতে খুব ভালোবাসে। আমার কাছে এসে কটা দিন মনের মত করে খেতে পেয়ে ও খুব আনন্দে আছে। রসনা তৃপ্তি মনকে ভালো করার একটা অন্যতম উপায়।

ডিসেম্বরের প্রথম উইকেন্ডে আমরা একটা কাছাকাছি চড়ুইভাতি কাম ওয়ান নাইট স্টে ট্যুর প্ল্যান করে ফেললাম । চাপড়ামারি ফরেস্ট বাংলো বুক করা হলো। সাউথ বেঙ্গল থেকে এনজেপি হয়ে আসতে গেলে এটা বেশ অনেকটাই রাস্তা, দু আড়াই ঘন্টা লেগে যাবে । কিন্তু আমরা তো কাছাকাছিই রয়েছি । এখান থেকে যেতে মূল রাস্তায় অর্থাৎ এনএইচ সেভেন্টিনে উঠে পড়ার পর মোটামুটি ওই মিনিট চল্লিশেক লাগে।

ডিসেম্বরের প্রথম রবিবার। আজকের দিনটাই বুক করে রাখা রয়েছে । অবশ্য বুকিং রিলেটেড এভরিথিং বা ট্যুর প্ল্যানিং ইন্দ্রাশিষ বাবুই সবটা করেছেন। আমি তাঁকেই করতে বলেছিলাম। ডিসেম্বরের ফার্স্ট উইকেন্ডে ট্যুর প্ল্যান করার একটা কারণ হলো, এখনো নর্থ বেঙ্গলে টুরিস্ট এর ঢল নামার সময়টা আসেনি। ডিসেম্বরের কুড়ি বাইশ তারিখের পর থেকে মোটামুটি প্রকৃতি-পরিবেশ এবং প্রকৃতিকে সত্যি করে ভালোবেসে যে সমস্ত পর্যটকরা আসতে চান , দুই পক্ষেরই সমস্ত ধরনের শান্তিভঙ্গ । আর দ্বিতীয়তঃ, এই সময়টা পূর্ণিমার আগের দিন পড়ছে । ডুয়ার্সের জঙ্গল, চাঁদের রূপালী আলো, নির্মেঘ আকাশ থাকলে আর মনের দরজা জানলাগুলো সব খোলা রাখতে পারলে, মনে হবে স্বর্গের কাছাকাছি চলে এসেছি। সশরীরে স্বর্গে শুধু যুধিষ্ঠির যেতে পেরেছিলেন । আমার কাছে তো প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ মেখে হারিয়ে যাওয়াই সশরীরে স্বর্গে যাওয়া, আবার কি !

সকালবেলা উঠে প্রাত্যহিক কাজকর্ম সেরে চা খেয়ে রেডি হতে যেটুকু সময় লাগলো । আমরা মোটামুটি নটা নাগাদ তল্পিতল্পা গুটিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম । একটা স্করপিও বুক করা হয়েছে। জগন্নাথই গাড়ি চালাবে। ওই গাড়ির মালিকের সাথে যোগাযোগ করে গাড়ি ঠিক করেছে। সাথে অবশ্য একটা ছোট ম্যাটাডোর ভ্যান যাবে। তাতেই চড়ুইভাতির বাসন-কোসন আরও যা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব যাবে। আমরা প্রথমে মূর্তি নদীর ধারে একটা অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি জায়গা দেখে সেখানে চড়ুইভাতি করব। তারপর সেখান থেকে চলে যাব চাপড়ামারি ফরেস্ট বাংলো । আমার বাংলা থেকেই গাড়ি স্টার্ট দিলাম। সঙ্গে অবশ্য আমার সাঙ্গ-পাঙ্গরা সকলেই যাচ্ছে। সাঙ্গোপাঙ্গ বলতে, টগর, কমলা তো আছেই, তার সাথে যদু আর শিশির। হারানদাকেও যেতে বলেছিলাম । কিন্তু , হারাণদার বাড়িতে কিছু একটা বিশেষ কাজ পড়ে গেছে, আজকে যেতে পারবেনা । আমরা গাড়ি স্টার্ট করে প্রথমে গেলাম ইন্দ্রাশিষ বাবুর বাড়িতে । সেখান থেকে তাঁকে আর পাতাকে তুললাম । ওনার মা বাতের ব্যথার কারণে যেতে পারবেন না । আগেই জানতাম সেকথা। এরপর মেঠো পথ পেরিয়ে মেন রোডে ওঠা। সেখান থেকে দুপাশে চা বাগানকে রেখে হুহু করে এগিয়ে চলল গাড়ি । পথে ওদলাবাড়ি , ডামডিম , এরকম কত ছোট-বড় বিভিন্ন চা বাগান। মালবাজার, চালসা, হয়ে মূর্তি নদী ব্রিজ পড়ল । সেটা পেরিয়ে কিছুটা গিয়ে আমাদের গাড়ি ঢুকলো বাঁদিকে । আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের প্রথম গন্তব্যের দিকে। মূর্তি নদীর ধারে একটা নিরিবিলি জায়গা দেখে গাড়ি এসে থামল। সেখানে আমাদের সমস্ত সাজসরঞ্জামপাতি নামানো হলো ।

দশটা বেজে গেছে। সাড়ে দশটার দিকে গড়িয়েছে ঘড়ির কাঁটা । ছোট একটা গ্যাস সিলিন্ডার আর ওভেন আনা হয়েছে। তাতেই রান্না হবে। টগর বেগুন কেটে বেসন ফেটিয়ে নিয়ে, কড়াই এর মধ্যে আধ কড়াই তেল ঢালল । বেগুনি ছাঁকা হবে । আমি, কমলা আর ইন্দ্রাশিষ বাবু মিলে পেঁয়াজ কুচি , লঙ্কা কুচি , শসা কুচি সহযোগে ঝাল মুড়ি মেখে ফেললাম। জম্পেশ হয়েছে। ঝালমুড়ির সাথে যে য’টা পারবে গরম গরম ফুলকো বেগুনি । গোল করে সবাই মিলে ঝাল মুড়ির বাটি নিয়ে বসে গল্প করতে করতে চোখ রাখলাম প্রকৃতির দিকে । এখানটা নদীর চর । ছোট-বড় নুড়িতে ভর্তি । সামনে নদী। ওপাশে ঝোপঝাড়ের । জঙ্গল আমাদের পেছনদিকেও তাই । ঝিরঝির করে বয়ে চলেছে মূর্তি নদীর ধারা। নিস্তব্ধ জায়গায় নদীর এই ঝিরিঝিরি বয়ে চলার ছন্দ যে কি অপূর্ব বাদ্যযন্ত্রের মতো শুনতে লাগে, তা শুধুমাত্র তারাই উপলব্ধি করতে পারে যাদের মনের বীণার তারগুলো সেই ছন্দ ও লয়ের সাথে নিজেকে বেঁধে ফেলে । তার মাঝে উটকো খানিকগুলো মানুষের আগমনে বেসুরো কিছু গলা সঙ্গ দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতির ছন্দ তাতে করে ছন্দহীন হয়ে পড়ছে না । আমাদের মুড়ির বাটি যখন প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে, তখন বেচারা টগর আমাদের সঙ্গে এসে বসতে পেল । প্রত্যেকের জন্য বেগুনি ভাজা শেষ করে নিজে শেষে ভাজা দুটো বেগুনি আর মুড়ি নিয়ে এসে বসলো।

জলখাবারের পাঠ চুকতে আরম্ভ হল দুপুরের খাবারে তোড়জোড় । মেনু খুব সিম্পল । মুগের ডাল , দেরাদুন রাইস, ঝিরিঝিরি করে আলু ভাজা, বেগুন ভাজা, খাসির মাংসের ঝোল আর চাটনি – এই রান্না হবে। দই আর মিষ্টি সাথে এনেছি। চড়ুইভাতির মেনু সিম্পল হওয়াই ভাল । সবাই মিলে একসাথে জড়ো হয়ে আনন্দ করাটাই এখানে মুখ্য উদ্দেশ্য । খাওয়া-দাওয়াটা অবশ্যই একটা ব্যাপার, তবে গৌণ । ঝটপট করে আমরা আলু , বেগুন , পেঁয়াজ, রসুন, আদা , সব কাটাকাটি আরম্ভ করে দিলাম । হয়েও গেল তাড়াতাড়ি। পাতা কাছাকাছি ঘুরঘুর করছিল। নদীর ধারে যেখানে স্রোত হালকা সেখানে নীচু হয়ে ঝুঁকে কি সব দেখছিল। জলের পোকা, ছোটখাটো মাছ এসব নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছে । কিছুক্ষণ পরে এসে আমার হাত ধরে টানাটানি করতে আরম্ভ করলো। সমবয়সী কেউ আসেনি তো , একা একা ওর হয়তো একটু বোর লাগছে। কিছুক্ষণ পর উঠে গেলাম ওর সাথে। ও নদীর ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটু দূরে চলে যাচ্ছিল বলে আমরা বারবার বকা দিচ্ছিলাম । তাইতে আমি ওর সাথে থাকলে ওর সুবিধে হয়, কেউ আর দূরে যেতে বারণ করবে না, এই আর কি। পাতার সঙ্গে কিছুটা এগিয়ে গেলাম । বাকি সকলে চোখের আড়ালে, এখন আর কেউ নেই । বাসন-কোসনের ঠকাঠক , ঝনঝন নেই, কথার আওয়াজ নেই, হাসির শব্দ নেই, শুধু আমি , কিশোরী একটা ছটফটে মেয়ে আর বহমান নদীর কলকল। দুধারে মাথা দোলাতে থাকা ঘাস আর গাছের পাতা । পাতা কখনো নদীর জলের মধ্যে কিছুটা নেমে যাচ্ছে , তখন ওর কাছে গিয়ে খেয়াল রাখতে হচ্ছে যাতে বেশি গভীরে না যায় । আবার কখনো নদীতীরে ছুটতে ছুটতে ঘাসের ওপর বসা ফড়িংগুলোকে ধরার চেষ্টা করছে । একটা ধরেও ফেলল। ডানাদুটোকে পেছনের দিকে দুটো আঙ্গুলের ফাঁকে চেপে ধরে আমাকে দেখাতে নিয়ে এলো । ফড়িংটা খুবই সুন্দর দেখতে । উজ্জ্বল হলুদ আর কালোয় মেশানো। ফড়িংটা অসহায় ভাবে পাগুলো ছুঁড়ছে মুক্তি পাবার আশায় ।
আমি পাতাকে বললাম , পাতা ফড়িংটাকে ছেড়ে দাও ।
— ছেড়েই তো দেব মণি। ওদেরকে আমি ধরে রাখি নাকি ? আমিতো জানি , আমাদের মত সমস্ত আ্যনিমাল , গাছেদেরও কষ্ট হয় । বল মণি ?
আমি অল্প হেসে ওর গালে একটা আঙ্গুল বুলিয়ে দিয়ে বললাম , তবে যে তোমার গাছ-স্টুডেন্টদের মারতে লাঠি করে ?
— এখন আর মারিনা।
— তাই বুঝি ? কি করে বুঝলে তুমি ওদের কষ্ট হয় ?
— বা রে ! আমাদের স্কুলে ইভিএস ক্লাসে পড়ালো যে গাছেরও প্রাণ আছে আমাদের মত ?
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল , বাবা আমায় বারণ করেছে ।
— কি বারণ করেছে ?
— কোন আ্যনিমালকে মারতে নেই । তাদের কষ্ট হয়। বলেছে আমায় বাবা ।
— তাহলে তুমি যে এখনও ফড়িংটাকে ওভাবে ধরে রেখেছো ? আঙ্গুলে করে ওর দু’দিকের ডানা চেপে রেখেছো-, কত কষ্ট হচ্ছে। এরপর যখন ছেড়ে দেবে, তোমার আঙ্গুলের চাপে তো ওর ডানার কিছুটা অংশ ভেঙেও যেতে পারে পাতা -না
— আমি আস্তে করে ধরেছি মণি।
— তোমার এরকম মনে হচ্ছে পাতা । কিন্তু ওদের কাছে ওই ধরাটাই খুব জোরে। ওদের তাতেই ডানা ভেঙে যেতে পারে ।
পাতা সঙ্গে সঙ্গে আঙ্গুল দুটোকে আলগা করে ছেড়ে দিলো ফড়িংটাকে ।
কিছুক্ষণ পাতার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে আবার ফিরে এলাম আমাদের পিকনিক স্পটে । টগর আর কমলা দুজনে কোমরে আঁচল জড়িয়ে রান্না আরম্ভ করে দিয়েছে । যদু ওদের বাসন-কোসন ধুয়ে দেওয়া, এগিয়ে দেওয়া, জল বাড়িয়ে দেওয়া, এই সমস্ত কাজ করছে। শিশির আর ইন্দ্রাশিষ বাবু দুজনে বসে গল্প করছে । আমিও গিয়ে বসলাম।
— কি বুঝছেন? জন্তু-জানোয়ারের দর্শন মিলবে?
প্রশ্নটা করলাম ইন্দ্রাশিষ বাবুকে। যদু আর শিশিরের পিকনিক সেরে বাংলায় ফিরে যাওয়ার কথা । আমরা বাকিরা চাপড়ামারি বনবাংলোয় নাইট স্টে করব ।
তিনি বললেন, কোন কোন জন্তু দর্শনের ইচ্ছা আছে আগে শুনি-
— যেগুলো এখানে দেখা-টেখা যায় । ওই বাইসন , হরিণ, হাতি-
— এইটুকু মাত্র? দেখুন অরণ্য দেবী আপনার উপর প্রসন্ন হন কিনা। হয়তো দেখা মিলতে পারে । তবে এ জঙ্গলে চিতাও আছে জানেন তো ? আর নদী থেকে তো জলটল খেতে – , বুঝতেই পারছেন –
হেসে ফেললাম ।
বললাম, আপনি কি আমাকে ভয় দেখাতে চাইছেন , নাকি নিজে ভয় পেয়ে রয়েছেন ?
তিনি হেসে বললেন , এই আকাশ বাতাস প্রকৃতি সব সাক্ষ্য দিতে পারে, সেই আদিকাল থেকে বরাবরই পুরুষ জাতি নারীদের ভয় পেয়ে এসেছে । ভয় দেখানোর কথা তো দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি ।
হেসে ফেললাম ।
একজোড়া পাহাড়ি ময়না একটু দূরে নদীর চরে নুয়ে পড়া একটা অর্জুন গাছের ডালে বসে ডেকে উঠলো ।

টগর আর কমলা খুব হাত চালিয়ে রান্না করছে। মনে হচ্ছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা সবকিছু কমপ্লিট করে নামিয়ে ফেলবে। কিছুক্ষণ ওদের দিকে চোখ রেখে বসে রইলাম। দুই বোনের মধ্যে ভারী সদ্ভাব। কি সুন্দর মিলেমিশে রান্নাবাটি করছে। আমরা ছোটবেলায় বন্ধুরা মিলে একসাথে সবাই রান্নাবাটি খেলতাম । চড়ুইভাতি যেন বড়দের সেই রান্নাবাটি খেলাই।

একঝাঁক সাদা বক উড়ে এসে নদীর ওপারে বসলো । শিশির মোবাইলে কয়েকটা স্ন্যাপ তুলে নিল ।
আমি বললাম , ক্যামেরা নিয়ে আসোনি ? খুনিয়া, চাপড়ামারি এই অঞ্চলগুলোর জঙ্গলে বিভিন্ন ধরনের পাখি রয়েছে। আর পাখির ছবি তুলতে তো ক্যামেরা মাস্ট। বেস্ট অপশন অবশ্যই ডিএসএলআর উইথ প্রপার লেন্স।
— না ম্যাডাম , অত খরচা করে ক্যামেরার কেনা আর হয়ে ওঠেনি। এই মোবাইলেই যা পারি তুলে রাখি ।
— কই দেখি কেমন উঠলো ? বকগুলো তো বেশ দূরে রয়েছে ।
ও আমার দিকে মোবাইলটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল , ওই সাদা সাদা ফুটকির মতো উঠেছে আর কি ।
আমি অল্প হেসে ওর মোবাইল স্ক্রীনে চোখ রাখলাম।
ও বলল , দেখুন আরো রাইট সাইডে রোল করুন । ওই যা পেরেছি, দু’চারটে ছবি তুলেছি আরকি।
আমি আঙ্গুল বুলিয়ে বুলিয়ে ছবি চেঞ্জ করে দেখতে লাগলাম ।
ও মোবাইলের ওপর অল্প ঝুঁকে আমার কাছে একটু সরে এলো।
তারপর বেশ গলা নামিয়ে বলল, এই কমলা মেয়েটি কে ম্যাডাম ? ও বুঝি টগরের কেউ হয় ?
— হ্যাঁ বেশ কিছুদিন হয়ে গেল তো আমার কাছেই রয়েছে। টগরের বোন । ও বিশেষ বাইরে বেরোয় না , তাই বোধহয় দেখোনি-
— ও-
তারপর গলাটা আরেকটু নামিয়ে বলল, এসমস্ত মেয়েছেলেকে হুটহাট করে ঘরে না তোলাই ভাল, বুঝলেন কিনা ম্যাডাম ? কার মনে কি আছে । তারপর এদের সব চরিত্রের-
আমি তীক্ষ্ণ চোখে তাকালাম শিশিরের দিকে ।
মোবাইলটা ওর হাতে গুঁজে দিয়ে বললাম, এই ধরনের কথাবার্তা কি একটু এক্তিয়ারের বাইরে হয়ে যাচ্ছে না?
— না মানে আপনার ভালোর জন্যই ম্যাডাম-
এই লোকটার প্রথম থেকেই আমার ভালো চাওয়ার বহরটা খুব বেশি দেখছি । গায়ে পড়ে পড়ে খালি ‘ভালো চাওয়া’র কথা শোনাতে আসে। আমি আর কোন কথা বললাম না । ওই প্রসঙ্গটা আপাতত এখানেই ক্লোজ হোক । কারণ, এটা নিয়ে আমি যদি এখন কোন কথা বলে ফেলি, তাহলে ব্যাপারটা ভালো কিছুর দিকে গড়াবে না । খামোখাই একটা মুড অফ হয়ে যাওয়ার মতো কিছু ঘটে যেতে পারে । আর সেটা বাঞ্ছনীয় নয় ।

টগর হঠাৎ করে লম্বা খুন্তিটাকে ব্যাটের মত করে ধরে ডান্ডিটাকে কাঁধের ওপর রেখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বেশ জোরে বলল, ডাক্তারবাবু একখান গান করেন না । আমরা একেনে সক্কলে জানি আপনে ভারী সুন্দর গান করেন। হ্যাঁ কিনা?
প্রস্তাব শুনে ইন্দ্রাশিষ বাবু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন ।
আমি প্রায় চমকে উঠলাম । বললাম , একি ! আপনি এত বড় কথাটা আজকে চড়ুইভাতির দিনেও বেমালুম লুকিয়ে রেখেছেন? আমি জানিই না ? এত দিন হয়ে গেল আপনার সাথে পরিচয় !
— না না , আহ টগর ! কে বলছে এসব?
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি ওর কথা বাদ দিন !
— একদমই বাদ দেবো না । এক তো, আপনি একটা বিশাল বড় অপরাধ করে ফেলেছেন, এই কথাটা এতদিন লুকিয়ে রেখেছেন । আর এটা জানার পরেও আজকে যদি আপনার কাছে একটা গান না শুনে ছেড়ে দি, তাহলে সেটা আমার জন্যও একটা ক্রাইম হবে ।
— কিন্তু তেমনটা নয়-
— কেমনটা আমি সেটা শুনতে চাই!
— কি মুশকিলে আমায় ফেললে বলতো টগর এখন কি আমায় গান গাইতে হবে?
— গাইতেই হবে।
— এটা কি অর্ডার?
— ইয়েস, ইটস আ্যন্ অর্ডার !
— বুঝলাম ।
উনি কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে মাথার মধ্যে দিয়ে আঙ্গুল চালালেন । গান বাছলেন নিশ্চয়ই মনে মনে । তারপর একটা সময় গান ধরলেন-
‘ হৃদয় আমার প্রকাশ হল অনন্ত আকাশে-‘
গুরুগম্ভীর রাবীন্দ্রিক তালে মেতে উঠলো প্রকৃতি । গানটা ওনার গলায় কি অসম্ভব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে যেন রবিঠাকুর এই সময়ে ওনার গাওয়ার জন্যই গানটা লিখেছিলেন। ওনার গান গাওয়ার ক্ষেত্রে একটা ব্যাপার উপলব্ধি করতে পারলাম, সেটা হল, গানের সাথে উনি বড় একাত্ম হয়ে গাইছেন। শুধু ওনার গলায় নয়, মনের প্রতিটা বিন্দুতেও তাই সুরের , ভাষার, উপলব্ধির, অনুরণন । আত্মমগ্ন হয়ে ওনার গান শুনলাম । শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও আবেশ রয়ে গেল বেশ কিছুক্ষণ । কোন কথা বলতে পারলাম না । তবে গান শেষ হতে একবার ওনার দিকে তাকিয়েছিলাম । মুখে কিছু বলিনি । তবে হয়তো ওনার গান কেমন লেগেছে চোখের ভাষায় তা কিছুটা বলতে চেয়েছিলাম । কারণ, এইসব ভালোলাগা কেমন হয় , তা মুখে বলতে যাওয়ার মত মুর্খামি আর কিছুই হয় না । জানিনা উনি কতটা বুঝেছিলেন।

দুপুরের খাওয়া-দাওয়াটা সেদিন ভীষণ জমল । সাথে করে কলাপাতা নিয়ে আসা হয়েছিল । সেগুলো সাইজ করে কেটে সব মূর্তি নদীর জলে ধুয়ে আমরা সব কলাপাতা পেতে খেতে বসে পড়লাম। সাদা দেরাদুন রাইস, তার সাথে ভাজাভুজি যা ছিল, ছিল ; খাসির মাংসের ঝোলটা অসাধারণ হয়েছিল খেতে। তাছাড়া কলাপাতায় খেতে বসলে এমনিই খাবারের স্বাদ দ্বিগুণ হয়ে যায় । আমাদের খাওয়া-দাওয়া হতে টগর আর কমলা বসলো । ওদেরকে আমরা বেড়ে দিলাম। খাওয়া-দাওয়া মিটে যেতে সমস্ত বাসন-কোসন ধুয়ে ভ্যানে তোলা হলো । আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি আমাদের চাপড়ামারি বনবাংলোর কাছে নামিয়ে দিয়ে ফিরে যাবে আমার বাংলোয় । আমি, কমলা , টগর আর ওদিকে ইন্দ্রাশিষ বাবু আর পাতা – আমরা আজকের নিশিযাপন করব এই অরণ্য বাসে।

ক্রমশ..

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

আঠাশ

গাড়ি আমাদের নামিয়ে দিল চাপড়ামারি বনবাংলোর সামনে । শান্ত নিস্তব্ধ জঙ্গলে ঘেরা এক ফালি সবুজ জমি । বাংলোর সামনে বেশ কিছুটা দূরে একটা ছোট জলাশয় । আসার পথে জঙ্গলের মধ্যে দু’তিনটে ময়ূর দেখতে পেলাম । চকিত পা’য় তারা আমাদের গাড়ির শব্দ পেয়ে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে গেল । চাপড়ামারি জঙ্গল পাখিদের স্বর্গরাজ্য। আমরা যখন বনবাংলো পৌঁছলাম তখন বিকেল চারটে । শীতের বেলায় জঙ্গলে বিকেল চারটে মানে পুরোপুরি অন্ধকার হতে আর খুব একটা দেরি নেই । ঝুপ করে কখন অন্ধকার নেমে আসবে তার ঠিক নেই । তবে আমাদের থাকার জায়গাটা যেখানে, সেখানে সামনে কিছুটা ফাঁকা মাঠের মতো, তাই সেখানে তখনও চিকচিকে রোদ খেলছে । জলাশয়ের ওপর হালকা হাওয়ার দোলায় অজস্র সোনার কুঁচি তৈরি হচ্ছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে । জলাশয়ের ওপারে একটা হরিন সজাগ চোখের দৃষ্টি এদিকে মেলে দাঁড়িয়েছিল । আমরা যখন বাংলোয় ঢুকলাম, এই বিকেল সন্ধ্যের দিকটায় পাখিদের সক্রিয়তা কিছু বেশি লক্ষ্য করা যায় । ভোরের দিকে কাজে বেরোনোর পালা, সন্ধ্যের দিকে বাসায় ফেরার পালা । ডানার ঝটপটানি, কিচিরমিচির, কুহু কুহু ডাক, টুঁই টুঁই , পাতার খসখস্, বিভিন্ন শব্দ । যার বেশিরভাগই পাখিদের সক্রিয়তার কারণে । কিছু দেখা যায় , বাকি শোনা যায় ।

কিছু টুকটাক লাগেজ ছিল সাথে । সেগুলো রুমে রেখে দিয়ে আবার বেরিয়ে এলাম। আমাদের রুম বুক করা হয়েছে মোট তিনটে। একটাতে টগর আর কমলা থাকবে। একটায় আমি আর পাতা আর একটায় ইন্দ্রাশিষ বাবু । বাইরে বেরিয়ে এসে বুঝলাম হঠাৎ করে ঠাণ্ডা বেশ কিছুটা বেড়ে গেছে । নদীর ধারে পিকনিক যতক্ষণ করছিলাম রোদ ছিল। তার সাথে কাজকর্ম, খাওয়া-দাওয়া, সব মিলিয়ে ঠান্ডা বুঝিইনি একেবারে । গাড়িতে করে যখন আসছিলাম, তখন শিরশিরে অনুভূতি হলেও সেটা এভাবে পেয়ে বসেনি। এখন যেহেতু পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও একবার রিসোর্টের রুমের ভেতরে ঢুকেছিলাম, তাই বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে মালুম হলো বাইরে বেশ ঠাণ্ডা রয়েছে । একটা শাল জড়ানো ছিল গা’য় । হাতের যে অংশটা বেরিয়ে রয়েছে, বুঝলাম সেই অংশটুকুতে হঠাৎ করে যেন কাঁপুনি ধরে গেল । নিজের বুকের ওমের ভেতর হাত দুটোকে চাদরের নিচ দিয়ে চালান করে দিলাম । তাতেও যেন শিরশিরানি যেতে চায়না । মুখের সামনে হাতের তেলো দুটোকে খানিক ঘষে ভাপ দিলাম ।

পাতা এরইমধ্যে ওর ফিনফিনে দুটো পা মেলে যেন উড়ে চলে গেছে বেশ কিছুটা । দূরে জলাশয়ের ওপাশে দুটো চিতল হরিণ আর একটা বাইসনের দেখা পেলাম । পাতা এক ছুটে বেশ অনেকটা চলে গেছে। আমি ওকে ছুটতে বারণ করতে গেলাম, কিন্তু তার আগেই হরিণ দুটো ছুটে পাশের জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল । শেষবেলার গোলাপি আলো তাদের চিকন ত্বকে পিছলে বেরিয়ে গেল। বাইসনটা কান খাড়া করে সজাগ দৃষ্টিতে তাকাল এদিকে।
আমি গলা তুলে তাকে বললাম, ওভাবে ছুটতে নেই জঙ্গলে । এভাবে ছুটলে সব জন্তুরা পালাবে, পাতা-
পাতা থমকে দাঁড়ালো ।
— ইস্! মণি, দুটো হরিণ ছিল পালিয়ে গেল-
— জঙ্গলে কোন আওয়াজ করতে নেই । ছোটাছুটি, চিৎকার-চেঁচামেচি করলে ওরা ভয় পাবে না ? পালিয়ে যাবেই তো-
— কিন্তু ওরা তো অনেকটা দূরে ।
— ওদের কান আমাদের থেকে অনেক শার্প । অনেক সূক্ষ্ম শব্দও ওরা শুনতে পায় ।

— কি ? শীত করছে বুঝি খুব ?
পাশে তাকিয়ে দেখলাম কখন ইন্দ্রাশিষ বাবু নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছেন ।
— তা একটু করছে । হঠাৎ করে এখানে এসে পড়ে কিরকম যেন একটা গা শিরশির করে শীত করে উঠলো ।
— কোন জায়গা খুব ভালো লাগলেও শিরশিরে অনুভূতি হয় জানেন তো ? আপনার ঠিক শীতই করছে, নাকি খুব ভালো লাগছে জায়গাটা, কোনটা?
— দুটোই।
বলে পিছন ফিরে একবার আমাদের দোতলা বাংলোটার দিকে চোখ বুলোলাম । জঙ্গলের নিঝুম গণ্ডির মধ্যে একটা আস্তানা। কি ভীষণ মন কাড়া! নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
বললাম , সেইতো ! কেন যে আমরা ছুটে মরি ! এই নিঝুম জঙ্গলে একটা কুটীর থাকতো । কুটীরের চালে পাখিরা লাফালাফি করত ,ঝগড়া ঝাঁটি করত । হরিণগুলো আমাকে দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে যেত । আমাকে তাদের বন্ধু ভাবতো, ভয় পেত না মোটেও । গাছের ডালে লম্বা পেখম ঝুলিয়ে ময়ূর বসে থাকতো । আরো কত রকম কাণ্ডই যে ঘটতো । বাঁদরের হুপহাপ্ , বৃষ্টির ঝুপঝাপ । জীবনে কি পাবার আশায়, কোন সুখের লোভে, মানুষ যে কংক্রিটের জঙ্গল বানিয়েছে, প্রকৃতিকে শেষ করেছে, কে জানে !
— আপনি তো দেখছি মুখে মুখে ইনস্ট্যান্ট রূপকথার গল্প লিখে ফেলছেন । তবে স্বীকার করতেই হয়, আপনার রূপকথার রাজ্যটি ভীষণ লোভনীয় ।
পাতা গুটিগুটি পায়ে ফিরে এসেছে । আমাকে বলল, মণি, ওদিকে কি যাব না?
— তা বলিনি তো । ছোটাছুটি কোরো না , কোনো রকম শব্দ কোরো না। আর বেশি দূরে যেওনা, কাছাকাছি থাকো । কোন অসুবিধা নেই ।
পাতা গুটি গুটি পায় এগিয়ে গেল কিছুটা ।
— চলুন আমরা বরঞ্চ একটু এগোই ।
— চলুন ।
লঘু পা’য় প্রায় নিঃশব্দে এগোতে লাগলাম এক’পা এক’পা করে জলাশয়টার দিকে। দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে মাঝে মাঝে এক আধটা মাছরাঙ্গা হঠাৎ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে যেন জল থেকে ঠোঁটে করে একখন্ড সোনা তুলে নিয়ে উড়ে পালাচ্ছে। গোলাপি হতে হতে একটা সময় ক্রমশ মিলিয়ে গেল আলো। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এলো । পাখিদের কোলাহল যেন কিছুটা বেড়ে গেছে । অসম্ভব কিচিরমিচির শব্দে চারিদিক মুখরিত । এ তাদের বাসা, তাদের এলাকা, এখানে তাদের অধিকার । আমরা এখানে অবাঞ্ছিত । আমাদের তাই কথা বলা মানা । চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম জলাশয়ের ওপর চোখ রেখে । সেখানে ক্রমশ যেন দলা পাকানো অন্ধকার আর কুয়াশা মিলে মিশে যাচ্ছে।
স্বগতোক্তির মতো বলে ফেললাম, বড্ড তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে হয়ে গেল । আজকের দিনটা শেষ ।
পাশ থেকে ইন্দ্রাশিষ বাবু প্রায় ফিসফিসে গলায় বললেন , দিন শেষ তো কি হয়েছে? সন্ধ্যা, রাত, সবই তো এখনো বাকি । কালকে পূর্ণিমা । আজকেও প্রায় তাই ধরে নিতে পারেন । আকাশে মেঘ নেই। চাঁদকে পাকাপাকিভাবে তার সাম্রাজ্য দখল করতে দিন আগে, তারপর দেখবেন মজা!
কথাটা শুনে মনটা এক নিমেষে ভাল হয়ে গেল । সত্যিই তো, এখনও পূর্ণিমার রাত বাকি । দিনের আলো মিলিয়ে গেলেই কী সব আনন্দ মাটি হয়ে যায় নাকি ? কিছুক্ষণ পর ফিরে এলাম রিসোর্টে । রিসোর্টের আলো জ্বলে উঠেছে। বাইরে অন্ধকার । আকাশে নিশ্চয়ই চাঁদ উঠেছে, কিন্তু এখান থেকে তা দেখা যাচ্ছে না , চাঁদের আলো এখনো এসে পৌঁছায়নি। আমাদের ঘরগুলো সব ব্যালকনি বরাবর। সামনে বেশ চওড়া লম্বা ব্যালকনি, রেলিং দিয়ে ঘেরা। ধোঁয়া ওঠা চা আর স্ন্যাক্স নিয়ে বারান্দায় চেয়ারের ওপর বসলাম । ইন্দ্রাশিষ বাবুও ছিলেন । আমাদের পাতারানীও ছিল। টগর আর কমলাও ছিল । ওদের সারাদিন ভালই খাটাখাটনি গেছে। এখন দুজনে বসে মন খুলে গল্প করছিল । পাতাও ওদের তালে তাল মেলাচ্ছিল অল্পস্বল্প । আমি আর ইন্দ্রাশিষ বাবু চুপচাপ বসে চা, পকোড়া আর প্রকৃতির আমেজ নিচ্ছিলাম। আস্তে আস্তে চাঁদের আলোয় বনভূমি চোখের সামনে ভেসে উঠলো । বনভূমি এখন শান্ত । শুধু আমাদের কথাবার্তা ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই । এই রিসোর্টে আর কোনো ফ্যামিলি আসেনি, শুধু আমরাই ।

টগর নানা রকম গল্প করছে। একেবারে তার ছোটবেলা থেকে শুরু করেছে। সে নাকি ছোটবেলায়, তাদের গ্রামের পাশে একটা মাঝারি জঙ্গল মত ছিল, সেখানে হারিয়ে গেছিল । ওর বাড়ির লোকেরা কিভাবে ওকে গরু খোঁজা খুঁজেছিল, সেই গল্প। তারপর ও যখন ছোট , তখন নাকি ওর মা একবার ভূত দেখেছিল। পুকুরধারে বাসন মাজতে গিয়ে একটি অপরিচিত মেয়ে সাদা ঘোমটা টেনে ওর মায়ের পাশে বসে বাসন মাজছিল আর নানারকম গল্প করছিল । তারপরই হঠাৎ সন্ধের মধ্যে সে নাকি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এরকম কত রকম ভুতুড়ে, অদ্ভুতুড়ে সব গল্প ! সাধারণ ঘটনাও আছে , যেগুলো বিশ্বাসযোগ্য । পাতা তো গল্প পেলে আর কিছুই চায় না। হাঁ করে শুনছে। আমাদের এই রিসোর্টৈর নিজস্ব কৃত্রিম আলোটুকু বাদ দিলে বাইরে প্রকৃতির সেই মায়াবী আলো, তার সাথে টগরের গল্প- সময় কোথা দিয়ে কেটে যেতে লাগলো খেয়ালই রইলো না । এমনিভাবেই একটা সময় রাতে ডিনারের টাইমও হয়ে গেল।

রুটি , আলু ভাজা আর কষা কষা করে চিকেন কারি -এই ছিল ডিনার । ডিনার সারা হতে যে যার রুমে ঢুকে পড়লাম । পাতা ঘুমিয়ে পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যেই । আমার চোখের সামনে সারাদিনের সমস্ত বিক্ষিপ্ত ঘটনা আর দৃশ্যাবলী যেন খন্ড খন্ড আকারে ফিরে আসতে লাগলো । তারই সঙ্গে এই নিঝুম রাতের অরণ্য প্রবল আকর্ষণে টানতে লাগলো বাইরে। নাইট স্যুট এর ওপর চাদরটা খুব ভালো ভাবে জড়িয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে দরজা খুলে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম ।

প্রায় রাত বারোটা বাজে। মাঝরাতের কুহকিনী মায়াময় রুপোলী আভায় দেখা দিল উন্মুক্ত প্রান্তর , তারপরে অরণ্য .. । আমি ধীরে ধীরে নিজের অস্তিত্ব হারাতে লাগলাম । আমাদের এই রিসোর্টটা আর রইল না । আমি যেন অন্য মানুষ । জন্মের আদি লগ্ন থেকে আদিম অরণ্যে লালিত-পালিত । দূরের জলাশয়ের ওপর বাতাসের স্রোতে আঁকা রুপোলী আঁকাবাঁকা রেখা । একটা বাইসন জলাশয়ের একেবারে কাছেই রয়েছে । আলো-আঁধারিতে আকৃতি দেখে বোঝা যায় সেটা বাইসনই বটে । আর কিছু নেই । দু’চারটে হরিণ তো অন্তত থাকার কথা । খুঁজতে লাগলাম বিভোর হয়ে । সেদিকে কতক্ষণ তাকিয়ে রয়েছি খেয়াল নেই ।
হঠাৎ করে পেছন থেকে খুব চাপা গলার আওয়াজ পেলাম , কি ব্যাপার ! ওখানে যেতে মন চাইছে বুঝি ?
নিঝুম রাতে পরিচিত গলার স্বরেও চমকে উঠলাম । পাশে তাকিয়ে দেখি, ইন্দ্রাশিষ বাবু কখন উঠে এসেছেন।

অল্প হেসে বললাম, মন তো আমার সব সময় ওদের কাছেই যেতে চায় । তা আর হচ্ছে কই !
— পঞ্চ ইন্দ্রিয় , মন, সবকিছু দিয়ে ওদের জগৎটাকে ফিল করাও কিন্তু ওদের কাছে যাওয়াই।
— তা হয়তো কিছুটা ঠিক। কিন্তু তাই বা বারে বারে ঘটার সুযোগ কোথায়?
— নিশ্চয়ই ঘটবে । আপনি চাইলে কেন ঘটবে না ?
— এই আপনাদের এখানে আছি, হাত বাড়ালেই চাঁদ ছোঁয়ার মতো আমার স্বপ্নের জগৎটাকে ছুঁতে পারি । কিন্তু আবার কলকাতায় ফিরে গেলে তা সম্ভব হবে না ।
— সেরকম সম্ভাবনা রয়েছে বুঝি?
— না , ঠিক সে সম্ভাবনা এখনও তৈরি হয়নি। আমি এখানে বেশ আছি। সত্যি কথা বলতে কি , খুবই ভালো আছি । আমার ওই শহুরে কর্পোরেট কালচার একেবারেই ভাল লাগেনা, এইটুকুনি নিশ্চয়ই আপনি বুঝে গেছেন এতদিনে। তবে চিন্তা হয় বাবা-মাকে নিয়ে। বাবার শরীরটা খারাপ । এখানে নিয়ে এলে ট্রিটমেন্টের অসুবিধা হবে তো ।
— আপনি কিছুদিনের জন্য ওনাদের আনতেই পারেন । বরাবরের জন্য তো ভরসা দিতে পারি না । তবে ছোটখাটো কোন ট্রাবেল হলে আমি আছি, এটুকু বলতে পারি।
— সে আর আপনাকে বলতে হবে কেন ? আপনি যে আছেন , প্রতিটা অসুস্থ মানুষের জন্য সবসময় আছেন, সে তো এখানে ছেলে-বুড়ো সবাই জানে ।
তিনি অল্প একটু হেসে মুখটা নামিয়ে বললেন , তবে আপনাকে এখানে ধরে রাখার মত বড় আশ্বাস দিতে পারিনা । ডাক্তারি বিদ্যায় অতখানি দখল নেই ।
— সে আপনার কতখানি দখল আছে আপনি বুঝবেন , তবে আমি যে বাবা-মাকে নিয়ে আসব ভাবছি কিছুদিনের জন্য, আপনার ভরসাতেই যে নিয়ে আসবো, সে একেবারে নির্ভেজাল সত্যি ।
তিনি চুপ করে রইলেন , বললেন না কিছু ।
আমিও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কিছুটা অভিমানের সুরে বললাম , আপনি যে এত সুন্দর গান করেন, কই আগে বলেননি !
— তা তো জানিনা কেমন করি । তবে আপনার যে ভালো লেগেছে এবং সে কথা যে একেবারে খাঁটি তা আমি বুঝতে পেরেছি। আমার এতেই আনন্দ ।
এরপর দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে সামনের জোছনা ধোয়া মাঠের দিকে তাকিয়ে রইলাম ।

কিছুক্ষণ পর বললাম, একটাই বাইসন দেখতে পাচ্ছি তখন থেকে। আর কিছু তো নেই ।
— ভোরের দিকে উঠে দাঁড়িয়ে থাকবেন । আশা করা যায় বেশকিছু জন্তু-জানোয়ার দেখতে পেতে পারেন ।
— বাইসনটা ঘুরছেই যখন, একা-একা ঘুরছে কেনো? দু’চারটে সঙ্গী-সাথীকেও তো নিয়ে আসতে পারতো ।
— এভাবে দলছুট একা একা যে সমস্ত বাইসন ঘোরাঘুরি করে তাদেরকে কি বলে বলুনতো? মূলজারিয়া । এরা কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ করে খুব ফেরোশাস হয়ে ওঠে । ধরুন আপনি হঠাৎ করে সামনে পড়ে গেলেন , তখন এরা হঠাৎ ছুটে এসে আ্যটাক করতে পারে । একচুয়ালি ইনসিকিউরিটি থেকে হয় এটা। দলের সঙ্গে থাকলে এরা অনেক বেশি সিকিওরড ফিল করে।
আমি চুপ করে তাঁর কথা শুনছিলাম । বেশ লাগছিল।
তিনি বললেন, এই ধরনের পূর্ণিমার রাতে বা ভরা চাঁদের আলোয় বাইসন , হাতি এই ধরনের জানোয়াররা কোর্টশিপের জন্য খুব আগ্রহী থাকে জানেন তো ?
— তাই নাকি ? ওরাও তো তাহলে দেখছি আমাদের থেকে রোমান্টিক কম কিছু নয় ।
— অন্তত আপনার-আমার দুজনের থেকেই যে বেশি রোমান্টিক , এটা বলাই চলে ।
আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না , তবে তাঁর কথার ধরণে হেসে ফেললাম ।
উনিও আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সাততাড়াতাড়ি বলে উঠলেন , ওরা কিন্তু ওদের কোর্টশিপ টাইমে প্রাইভেসি চায় । আপনি-আমি তখন যদি কাছ থেকে ছবি তুলতে যাই বা সেরকম কিছু অ্যাক্টিভিটি দেখাই, ওরা হঠাৎ করে খুব ক্ষেপে গিয়ে তেড়ে আসতে পারে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, ওদের কথা তো অনেক হল। এবার কিছু নিজের কথা বলুন ।
— যেরকম ?
— যে রকম , এই ধরুন , শুনেছি আপনি আপনার কলেজ লাইফে একটি মেয়েকে ভালবাসতেন । তাকে বিয়ে করায় আপনার মায়ের অমত ছিল , তাই আর শেষমেশ আপনার তাকে বিয়ে করে ওঠা হয়নি ।

একটু থেমে বললাম , আপনার সম্পর্কে কোনো পার্সোনাল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে রাগ করবেন কি ?
— একেবারেই না । আমার মধ্যে দ্বিতীয় রিপু যে একেবারে আ্যবসেন্ট তা বলছি না, তবে প্রভাব বেশ কম । আপনি নির্ভয়ে বলতে পারেন । মানে , নিজের মনে যা প্রশ্ন আছে ঝেড়ে করে ফেলতে পারেন , নো প্রবলেম ।

একটু উদাস গলাতে প্রশ্নটা করেই ফেললাম।
বললাম, আপনার স্ত্রী যে আপনাকে ছেড়ে চলে গেছেন , সেটা কি আপনার কলেজ লাইফের প্রেমের জন্য ? মানে আমি বলতে চাইছি , আপনি কি আপনার কলেজ লাইফের রিলেশনশিপটা থেকে বেরিয়ে আপনার স্ত্রীকে যথেষ্ট ভালবাসতে পারেননি ?
— একেবারেই সেরকম কিছু নয় । আপনি হয়তো আমার মায়ের কাছে শুনেছেন। নিশ্চয়ই তাই হবে । মা আপনাকে ঠিক কি বলেছেন আমি জানিনা । তবে আমার কলেজ লাইফে ঠিক কোন প্রেম ছিল না । কিছুটা ইনফ্যাচুয়েশন বলতে পারেন। ভীষন ভালো লাগতো । প্রপোজ করেছিলাম । সে আ্যকসেপ্ট করেছিল । কিন্তু আমাদের ইন ডেপ্থ কোন রিলেশনশিপ তৈরিই হয়নি । দুজনেই দুজনের কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। সম্পর্ক বিল্ড আপ হয়নি বলতে পারেন । মায়ের কাছে বিয়ের কথাটা একবারই তুলেছিলাম। মা ভীষণ রকম আপত্তি জানিয়েছিলেন । ব্যাস । সেইদিনই , ইনফ্যাক্ট তারপর থেকেই ব্যাপারটা ইম্পসিবল বুঝে সম্পূর্ণটাই নিজেদের মধ্যে ডিসকাস করে আমরা আমাদের ইমোশন থেকে বেরিয়ে আসি । একটা ইমোশনাল অ্যাট্রাকশন আর সত্যিকারের গভীর সম্পর্কের মধ্যে অনেক পার্থক্য । বলতে পারেন দুটো সম্পূর্ণই আলাদা। তাই সেই ব্যাপারের রেশ থেকে আমার আনহ্যাপি ম্যারেড লাইফের কোন কারণই ছিল না । তবে আপনি যখন প্রশ্নটা করলেনই, তখন পরিষ্কার করেই বলি , আমি যে আমার স্ত্রীকে খুব ভালবাসতে পেরেছিলাম, তা নয়। যদিও সহজ স্বাভাবিক সম্পর্কই ছিল। অন্তত আমি তাই ভাবতাম । তার মনে যে অন্যকিছু ছিল, আমি অনেকদিনই বুঝিনি । তবে হ্যাঁ, একটা কথা – একটা মানুষকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়ে তার সঙ্গে ঘর-সংসার করা আর সেই মানুষটার নেচার’টাকে সত্যি করে পছন্দ করা, তার মধ্যে এমন কিছু কোয়ালিটি যা সত্যি করে আকর্ষণ করে, তা সে যাই হোক না কেন, সে রকম কিছু আমার পাতার মায়ের প্রতি ছিলনা । ওর সঙ্গে আমার নেচার সম্পূর্ণ আলাদা । আমার একটা প্রবলেম হচ্ছে, কখনো মানুষের বাইরের রূপ’টা আমাকে আকর্ষণ করতে পারেনা । যদি পারত , আমি অতখানি সুন্দরী স্ত্রী পেয়ে নিশ্চয়ই প্রাউড ফিল করতে পারতাম। কিন্তু সে সব কিছুই নয়। একচুয়ালী আপনাকে ঠিক আমি বোঝাতে পারবো না, আমি মন থেকে তাকে ঠিক সেভাবে পছন্দ কোনওদিনই করে উঠতে পারিনি । ভালোবাসার কথা যদি বলেন, যখন সংসার করছিলাম তার সঙ্গে, তখন ভাবতাম ভালো হয়তো বাসি । ছেড়ে চলে যাওয়ায় যে আমি কোন শক পাইনি , তাও ঠিক নয় । আবার খুব যে দুঃখ পেয়েছিলাম, তাও নয় । একটা সম্পর্ক ভাঙার দুঃখ ছিল বটে । তবে আমার অনেক কিছু হারিয়ে গেল, শূন্যতা তৈরি হয়ে গেল, এরকম কিছু মনে হয়নি । আমি কি বোঝাতে পারছি ?
— আমি কিছুটা কিছুটা বুঝতে পেরেছি । আপনি আপনার জীবনে দুজন নারীর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেই প্রেম-অপ্রেমের মাঝামাঝি পর্যায়ে ছিলেন ।
তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন , কি জানি ! কোনটা যে প্রেম, কোনটাই বা অ-প্রেম, এ জীবনে বোধহয় বোঝা হয়ে উঠলো না ।
আমি তির্যক চোখে একবার তাঁর দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললাম , জীবনের কি আপনার সবটুকু দেখা হয়ে গেছে ? দেখতে থাকুন জীবন আপনাকে আর কি কি দেখায় । ক্রমশ প্রকাশ্য ।
তিনি আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন , জীবনের যদি এই বিষয়ে আর সত্যিই কিছু দেখানোর থাকে , তবে প্রেম দেখাক। অ-প্রেম আর দেখতে চাই না ।

তাঁর কথা শুনে আপনা আপনি আমার চোখ দুটো নিচের দিকে নেমে পড়ল ।
তিনি আর কিছু বললেন না । আমিও তাঁর দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারলাম, তিনি আমার থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে দূরে জোছনার রাজ্যে চোখ মেলেছেন।

কিছুক্ষণ পর খুব আস্তে, প্রায় ফিসফিস করে আমায় বললেন, সামনে তাকিয়ে দেখুন ! আপনি তখন থেকে যে বাইসনটাকে দেখছেন , সে এখন আর একা নেই।
আমি সঙ্গে সঙ্গে উৎসুক চোখ তুললাম । দেখলাম , তাইতো , আর একটি সমগোত্রীয় ছায়া তার গা ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়েছে!

ক্রমশ..