হলদে প্রজাপতি পর্ব-২৪+২৫

0
186

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

চব্বিশ

— বাব্বাহ্! এতো একবারে জমিয়ে প্রেম করছিস রে। কী টপাটপ করে ফেললি সব!
— সব মানে ?
— সব মানে আবার কি? সব’ই বলবো। যেটুকু বাকি আছে সেটাও করে ফেলবি । দেখ বাপু, আমি কিন্তু অনেক দিন প্রেম করে তারপরে এইসব চুমু-টুমু খেয়েছি । তোরা তো একদম আরম্ভ হতে না হতেই জটাপটি আরম্ভ করে দিয়েছিস বাবা-
অরুনিমার কথাবার্তার মধ্যে আজকাল কেমন যেন একটা নিভৃত খোঁচা অনুভব করতে পারতাম । আগে, মানে সোনুদা আর আমি কাছাকাছি আসার আগে যখন আমি ওর দিক থেকে কোন ফিলিংস আছে কিনা বুঝতে পারতাম না, তখন অরুনিমা আমাকে যেভাবে বোঝানোর চেষ্টা করত যে ও-ও আমায় ভালবাসে, আমাদের মধ্যে একটা প্রেমের সম্পর্ক হবার সম্ভাবনা রয়েছে, যখন সেটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গেল, তারপর থেকেই আমি এই নিহিত খোঁচাটা ওর কথাবার্তার মধ্যে বুঝতে পারতাম।
ও বলতো, দেখিস! নিজেকে একটু সামলে সুমলে রাখিস। সব কিছু একবারে ওপেন করে দিস না আবার ।
এমন কথাও বলত, এই তরু! তোর সোনুদা কিন্তু হেবি হ্যান্ডসাম। ওই একদিনই তো এসেছিল রে বাবা কলেজে । সেদিন বলল, আমার সাথে পরিচয় করতে হবে ভালো করে। তা আমি তো সবেধন নীলমণি একটাই মাত্র শালী নাকি? আর একদিন কলেজে আসতে বল । ভালো করে পরিচয় টরিচয় করি। জামাইবাবু বলে কথা-
আমি বললাম, সেকি আমি সেদিন আসতে বলেছিলাম বলে এসেছিল নাকি? সে তো নিজের ইচ্ছায় এসেছিল । আবার যদি কখনো মনে হয় আসবে।
— আসল কথাটাই বল না । নিজের হ্যান্ডসাম বয়ফ্রেন্ডকে আমাদের থেকে লুকিয়ে রাখতে চাস। কি হিংসুটে মেয়ে বাবা তুই । আমাদের সাথে আলাপ পরিচয় করিয়ে দিলে আমরা বুঝি চুরি করে নেব অমনি তোর হ্যান্ডসাম বয়ফ্রেন্ডকে ?

সে কারণে আজকাল আর ওকে আমার মনের সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম অনুভুতির কথা বলে বিশেষ লাভ হচ্ছিল না। লাভ অর্থে আর কিছুই নয়, মেয়েরা কাউকে গভীরভাবে ভালোবাসলে মনের স্তরে স্তরে আবেগ জমা হয়। মেয়েরা সাধারণত প্রকৃতিগতভাবেই বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে । সে কারণে কোন মেয়ে তার প্রেমের সুখানুভুতিগুলো তার অন্তরঙ্গ বান্ধবীদের সাথে ভাগ করে নিতে খুব পছন্দ করে । আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আমিও ঠিক সোনুদা এই বলল, এই করল, এটা কেনো বললো, এটা করেছে তার মানে কি জানিস- এই সমস্ত ঘটনা পরম্পরা বিশদে বলে তার কার্যকারণ হৃদয়াঙ্গম করার চেষ্টা করতাম । আমার প্রিয় বান্ধবী বলতে অরুনিমাই ছিল। আর কারো সঙ্গে কলেজে সেরকম অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠেনি । তাই বলার প্রশ্নই ওঠে না । কিন্তু অরুনিমার মধ্যে এই রকম পরিবর্তন দেখার পরে আমার ওকে আর কিছু বলতে ইচ্ছে করতো না । কিন্তু, না বললেও নয় । এত যে আবেগ রয়েছে মনের ভেতরে সে সমস্তই শুধুমাত্র নিজের মধ্যে চেপে রেখে কত আর থাকা যায়? কোনো একজন কি নেই, যাকে আমি সব খুলে বলতে পারি? মাথায় ক্লিক করলো , হ্যাঁ আছে তো! বান্টি তো ক্লাস এইটে পড়ে । নাইনে উঠবে । টিনেজ বয়েস। নিশ্চয়ই খুব ভালো করে প্রেম-ভালোবাসা এই ব্যাপারগুলো জানতে বুঝতে শিখে গেছে । তাহলে বান্টিকে বললে কেমন হয় ?

একদিন বান্টির ঘরে সন্ধ্যের দিকে গেলাম । এটা ওটা চারটে অন্যান্য কথাবার্তা বলার পর আসল কথাটা পাড়লাম ।
বললাম , তোকে একটা কথা বলব বান্টি? খুব সিক্রেট কথা কিন্তু, তোকে আগে প্রমিস করতে হবে তুই এই কথাটা কিছুতেই কাউকে বলবি না । গোটা পৃথিবীতে কাউকে না ।
বান্টি খুব উৎসুক হয়ে উঠল । বলল , ঠিক আছে তরু দিদি, কাউকে বলবো না। কি কথা রে?
— উঁহু , ওই রকম করে বললে হবে না। তুই আমার গা ছুঁয়ে এই প্রমিস কর-
হাতটা মুঠো করে বাড়িয়ে দিলাম ওর দিকে ।
ও অল্প হেসে আমার হাতের ওপর হাত রেখে বলল , প্রমিস করছি তরু দিদি । কাউকে বলব না । বল্ তুই আমায় –
যখন নিজের সন্তুষ্টি হল , বুঝতে পারলাম ও বলবে না কাউকে, তখন কেমন যেন লজ্জা লজ্জা করতে লাগলো । ভয় ভয়ও লাগলো কেমন যেন। বান্টি আমার থেকে প্রায় পাঁচ ছ’ বছরের ছোট । ও যদি ভুল ভাবে আমায় ? আমাকে যদি বাজে মেয়ে ভাবে ? এই সমস্ত মনে হতে লাগলো । আমার ভেতরে তখন সোডা ওয়াটারের বোতলের মতো চেপে বন্ধ করা রয়েছে গুচ্ছ গুচ্ছ কথা আর আবেগ। তাই সেই সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলতে বেশি সময় লাগল না ।
বললাম , জানিস তো ! আমি একজনকে ভালোবেসে ফেলেছি।
শুনে বান্টি একটা ছোট মতো হাঁ করলো। চোখগুলো বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে খপ্ করে আমার হাত ধরে বলল, ওমা ! তাই নাকি তরু দিদি ! আমার শরীর খারাপ, আমাকে মা ঘরের মধ্যে সারাক্ষণ এই বিছানার ওপর বসে থাকা করায়, আমি বের হতেও পারি না, কিছুই হয়না, স্কুলেও যাই না, তা বলে তুই এরকম একটা কথা আমাকে বলিস নি ! এই বল্, বল্.. কে রে ? কাকে?
তারপরেই বলল, কলেজের তোর কোন বন্ধু ? সিনিয়ার দাদা? ইস্, কি মজা । বল্ বল্..
আমি রহস্য রেখে দিয়ে বললাম, না কলেজের নয় ।
— তাহলে ? তুই আজকাল প্রাইভেট টিউশন পড়তে যাস বল্ কলেজ থেকে ফিরতি পথে , উইকলি একদিন ? এই বল্ না , সেখানে রে ? তোর টিউশন ব্যাচে?
আমি ঘাড় নাড়লাম ।
— এমা ! সেখানেও নয় ? তাহলে কোথায় রে ? দেখছিস তুই আজকাল কোনো কিছুই আমাকে বলিস না তরু দিদি । যবে থেকে আমার শরীর খারাপ হয়েছে, আমার কাছে আসিস না , গল্প করিস না, কিচ্ছু না ।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বান্টির ডানহাতটা দুটো হাতের মধ্যে ধরে বললাম , খবরদার কাউকে বলবি না বল্? মরে গেলেও না?
— না রে বাবা। বলছি তো । বল্ না –
— তাকে তুই চিনিস ।
— ওমা তাই ? সেকি রে ? কে রে?
— বল্ তো কে ?
— আমি চিনি.. আমি চিনি..
বিড়বিড় করতে করতে ঠোঁটের উপর আঙ্গুল ঠুকে ঠুকে কিছুক্ষণ চিন্তা করল বান্টি ।
তারপর বলল, না , বুঝতে পারছি না তো রে। কে বলনা-
অর্থাৎ সোনু দা যে হতে পারে , সেটা ওর মাথাতেই এলোনা।
আমি ওকে বলেই ফেললাম নামটা।
শুনে ও চোখ দুটোকে বিস্ফারিত করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো বেশ কিছুক্ষণ । কথাটা যেন বিশ্বাস করতে পারলো না।
তারপর বলল, সোনু দা ! কি বলছিস রে ? অনেক বড় তোর থেকে । আমার দাদার থেকেও ও দু বছর না তিন বছরের সিনিয়র জানিস? আমার দাদার বয়স কত বলতো ? টোয়েন্টি সিক্স চলছে । তার মানে সোনুদার এজ টোয়েন্টি এইট-নাইন তো হবেই ।
বান্টি অনেকক্ষণ কথাটা বিশ্বাস করতেই পারল না । তারপর ওকে বিভিন্ন ছোটখাটো ঘটনা বলার পর ও একটু একটু করে বিশ্বাস করল। তবে নতুন পাওয়া খবরটার সঙ্গে ওর ধাতস্থ হতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে বুঝতে পারলাম ।

যাই হোক প্রাথমিকভাবে ওকে সেদিন জানানোর কাজটা করে ফেলে আমি খুব নিশ্চিন্ত হলাম। এরপর প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যে কি রাতের দিকে ওর ঘরে চুপি চুপি গিয়ে ওর সাথে বিভিন্ন ছোট ছোট ঘটনা, অনুভূতি , সমস্ত কিছু শেয়ার না করলে আমার পেট ফুলে যেত ।

মাস দুয়েক এভাবেই কাটলো । আমরা দুজনে আর বিশেষ কাছাকাছি আসিনি বটে , সেরকম সময় বা সুযোগ হয়ে ওঠেনি । তবে কলেজ থেকে ফিরে সন্ধ্যা হওয়ার আগে যে সময়টুকু পেতাম, সেটুকু আমি প্রায় প্রতিদিনই বেরোতাম। তারপর দুজনে কোন একটা জায়গায় মিট করে একটু দূরে কোথাও যেতাম । দূরে অর্থাৎ দূরে নয় । তবে বাংলো থেকে আমাদের যেন না দেখা যায় । দূরে অর্থে আড়ালে । এক আধদিন বান্টিও বেরোতো আমার সঙ্গে। তবে ওর হাঁটাহাঁটি করা বারণ ছিল । ও বেরোলে আমরা গাড়ী করে কাছাকাছির মধ্যে, বিশেষ করে লিস্ নদীর ধারে ঘুরতে যেতাম । বান্টি আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠছিল । তবে স্কুলে তখনও যেত না। হয়তো ভামিনী কাকিমার জায়গায় অন্য কেউ ওর মা হলে ওকে স্কুলে যাওয়ার ছাড়পত্র আগেই দিয়ে দিত । তবে ভামিনী কাকিমা তখনও দিয়ে উঠতে পারেননি । বান্টি যেহেতু আমার কাছে সমস্তটাই শুনেছিল, সেই কারণে ও আমার সঙ্গে বেরোলেও আমাকে একটু প্রাইভেসি দেওয়ার চেষ্টা করত।

প্রায় প্রতিদিনই আমাদের দেখা হলে টুকটাক চুমু বা হাত ধরা, কোমর ধরা, হালকা আলিঙ্গন – এর চেয়ে বেশি কিছু আর হয়ে ওঠেনি। যদিও টিনএজ বয়সের বা একেবারে প্রথম দিকের যৌবনের প্রেমের প্রকৃতি হচ্ছে সে ভীষণ শারীরিক সান্নিধ্য চায়। আমিও চাইতাম । সত্যি কথা বলতে কি ভীষণ, ভীষণভাবেই চাইতাম। প্রতিদিন সোনুদার সঙ্গে দেখা করে ফিরে এসে কতকিছু যে কল্পনা করতাম তার ঠিক নেই। যা কিছু বাকি রয়ে যেত, কল্পনায় প্রতিদিনই প্রায় তা সারা হত ।

এমনি ভাবে মাস দুয়েক কাটলো। তখন শীতকাল । বেলা ছোট । কলেজ থেকে ফিরে বিকেল বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকত না । আমাদের দেখা করার সময় খুবই সীমিত হয়ে এসেছিল। তা ছাড়া, ভামিনী কাকিমা ঠিক কিছু সন্দেহ করতেন কিনা জানিনা, তবে আমার যেন কিরকম একটা অস্বস্তি হতো । মনে হতো, প্রতিদিন বিকেলে আমাদের দুজনের ঘুরে বেড়ানো, গল্প করা , উনি খুব একটা সহজ স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন না । বিকেলবেলায় কিছুক্ষণের জন্য বেরোনো যেহেতু প্রথম থেকেই আমাদের ডেইলি সিডিউল এর মধ্যেই ছিল , সেজন্য সেটা সরাসরি বারণও করতেন না। তবে কি জানি, কেন এমনটা মনে হত আমার। তার মধ্যে বাস্তবতাও কিছু থেকে থাকতে পারে, আবার যেহেতু আমি এরকম একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলাম , সেহেতু আমার মনের দ্বিধা বা সংকোচ থেকেও ব্যাপারটা মনে হতে পারে আমার । সে কারণে আমাদের প্রতিদিন বিকেলে দেখা হওয়াটা বন্ধ হয়ে গিয়ে সপ্তাহে দিন দুয়েকে এসে ঠেকেছিল । এই সময় একটা সুবিধা হল । ভামিনী কাকিমার বাপের বাড়িতে একটা অনুষ্ঠানের দরুন তিনি বেশ কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়ি গেলেন । এমনিতে ওনার বাপের বাড়ি যাওয়াই হয় না । তাই যখন গেলেন, তখন ঠিক করলেন কিছুদিন সেখানে কাটিয়ে আসবেন । প্রায় দু সপ্তাহের ওপর তিনি ছিলেন না । ব্যাস্, আমার তো ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ! বান্টি সবটাই জানে। ওকে নিয়ে তো টেনশন এর কোনো ব্যাপারই নেই । আর অজিত কাকু নিজের কাজ , ফ্যাক্টরি , এই সমস্ত নিয়ে সারাদিন ধরে চরকি কেটে বেড়ান । যেটুকু সময় ফ্রি পান , সেটুকু সময়ও সেই নিজের এস্টেট, ফ্যাক্টরি, এই সমস্ত চিন্তাভাবনা । কে কার সাথে দেখা করলো, কতক্ষন ঘুরল, প্রেম করছে কিনা, এই সমস্ত দেখার তাঁর কোন ফুরসতই নেই । কাজেই সেই দুই সপ্তাহ, আমি সপ্তাহে দিন দুয়েকের বেশি কলেজই যেতাম না। সারাদুপুর বাড়িতেই থাকতাম।

শীতকাল । চা বাগানে শীতের দুপুর । উফ্, সে এক মারাত্মক রোমান্টিক ব্যাপার। একদিনের কথা খুব মনে পড়ে –
সেদিন দুপুরে আমরা দুজনে হাঁটতে হাঁটতে বাংলো থেকে বেশ অনেকটা দূরে চলে গেছিলাম । সেখানটা একেবারে জনমানবহীন । চারিদিকে শুধু চা গাছ । আর অন্য কিছু চোখের দৃষ্টির সীমানায় পড়ে না । প্রেমী যুগলের জন্য একেবারে আদর্শ জায়গা । ও আমাকে একেবারে জাপ্টে ধরে বসে ছিল। ঘাড়ে, গালে, ঠোঁটে, যখন তখন ওর ঠোঁট ছুঁয়ে যাচ্ছিল । ও সব সময় চাইত আরো একটু ঘনিষ্ঠ হতে । বিশেষ করে আমি বুঝতে পারতাম আমার বুক দুটো ওকে অদম্য আকর্ষণে টানছে। নারীর স্তন , সে তো সবসময়ই পুরুষের কামনার কেন্দ্রবিন্দু । কিন্তু সময় ও সুযোগের অভাবে সে ঘনিষ্ঠতা এখনো হয়ে ওঠেনি। কল্পনায় যে কতবার ও আমার স্তন স্পর্শ করেছে , গাল ঘষেছে বুকের মধ্যিখানে ঠিক স্তনসন্ধিতে , তার ঠিক নেই । তবে বাস্তবে তা তখনও একবারও হয়ে ওঠে নি। সেদিন ও আমার পোশাকের ভেতর দিয়ে ওর পুরুষালি হাতটা বাড়িয়ে দিতে চাইছিল। আমি সেটা বুঝতে পারছিলাম । আর কোনো এক অন্ধ সংস্কারের বশে ওকে বাধা দিচ্ছিলাম । চাইছিলাম ভীষণভাবে । অথচ বাধা দিচ্ছিলাম । কানে বাজছিল অরুনিমার বিদ্রুপাত্মক কথা — ‘দেখিস সাবধানে থাকিস। নিজেকে আবার অতটা সস্তা করে দিস না । ‘
আমি বুঝিনা, সব সময় সস্তা , বাজারি , বেশ্যা- এই সমস্ত সম্মানহানিমুলক কথাবার্তাগুলো সব সময় মেয়েদের ঘিরে থাকে কেন? যদি নারী পুরুষের সান্নিধ্য দোষের মধ্যেই পড়ে, তবে একই দোষে একজন নারী এবং পুরুষের মধ্যে শুধুমাত্র নারী কেন সস্তা হয়ে যায় ? যাইবা হোক, যে কারণেই বা হোক , আমি বাধা দিচ্ছিলাম । আমি আজকাল বাধা দিতে শিখে গেছি । কিভাবে নারীসুলভ আলতো প্রত্যাখ্যান করতে হয়, কোন অগ্রসর’কে কিভাবে একটা সীমানার মধ্যে বেঁধে রাখা যায় , এ সমস্ত অল্প অল্প শিখে গেছি । তাই অসুবিধা হতো না ।
তবে সেদিন অতখানি সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে ও আমাকে জিজ্ঞাসা করল , তোমার কিসের হেজিটেশন এত ? আমি বুঝতে পারি তুমি আমার কাছে আসতে চাও , বাট ইউ বিহেভ লাইক এ স্নেল । একটা কভারিং এর মধ্যে নিজেকে ঢুকিয়ে রেখেছ । হোয়াই সো? হোয়াই ডোন্ট ইউ ওপেন আপ ?
আমি কিন্তু কিন্তু করে সেই সংস্কারের কথাই বলেছিলাম ।
বললাম, এর বেশি বিয়ের আগে কি কিছু করা উচিত ?
শুনে ও হাসতে আরম্ভ করলো । বেশ কিছুক্ষণ ধরে হাসল । হাসি আর থামতেই চায় না। মনে মনে একটু রাগ হলো আমার । মুখ নিচু করে চা গাছের নিচে গজানো ঘাসগুলো ছিঁড়তে লাগলাম ।
একসময় হাসি থামিয়ে বললো , বিয়ে! ও মাই গড ! এ তো সেই কি যেন – গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল!
আমি বললাম , বা রে ! তা হবে কেন ? আমার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়ে যাক, তারপর আমি বাড়িতে জানাবো ।
ও আমার থেকে কিছুটা দূরে হাত দুটোকে পেছনে নিয়ে হাতের উপর হেলান দিয়ে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়েছিল । সেই ভাবেই থেকে আমার দিকে চোখ সরু করে তাকিয়ে বলল, তার মানে বিয়ের আগে তুমি ওপেন আপ করবে না? হাউ চাইল্ডিশ !
— চাইল্ডিশ হবে কেন ? মা যে বলে –
কিছু একটা বলতে গিয়েও আমি আর কথাটা শেষ করলাম না আমি, থেমে গেলাম ।
ও কৌতুহল নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল । বলল, কি বলে?
তারপর আবার জোরে হেসে উঠলো। বলল , তাহলে আমাদের রিলেশন এর মধ্যে তোমার মাও এক্সিস্ট করেন ?
আমি একটু অবাক চোখে তাকালাম ওর দিকে। আমাদের যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছে । এরপরে অবশ্যই আমার অন্তত গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়ে যাওয়ার পর বাড়িতে জানাতেই হবে । তবেই তো বিয়ে হতে পারে । আমি তো আর পালিয়ে বিয়ে করবো না । তাহলে আমার বাড়িতে বাবা-মা সবাই তো অটোমেটিক্যালি চলে আসছে ।
ও বলল, বিয়ে , তার মানে বিয়েটা তোমার কাছে সবচেয়ে ইম্পর্টেন্ট তাইতো?
আমি ভীষণ অবাক চোখে তাকিয়ে বললাম, হ্যাঁ ইম্পর্টেন্ট হবে না ? অবশ্যই ইম্পর্টেন্ট ।
— আর বিয়েটা যদি-
এই পর্যন্ত বলে ও এলিয়ে দেওয়া শরীরটাকে তুলে সোজা হয়ে বসলো । হাত দুটোকে সামনে এনে একবার ছেড়ে নিয়ে আমার গা ঘেঁষে সরে এলো । আমাকে কোমরের কাছ থেকে জড়িয়ে ধরে টেনে নিল ওর কাছে । কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, বিয়ে অনেক রকমের হয় জানো ?
আমি কিছু বললাম না। ওর সান্নিধ্যে তখন আমার গা শিরশির করছে ।
ও হঠাৎ করে পাশের চা গাছের পাতার উপর বসা একটা হলদে প্রজাপতি মুঠোর ভেতর ধরে ফেলল।
আমি করুণভাবে ওর মুঠোর দিকে তাকিয়ে বললাম, মরে যাবে যে !
ও বলল , আলগা করে ধরেছি। মরবে না।
আমি তবুও সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
ও এরপর আমাকে ছেড়ে বাঁ হাতটা ডান হাতের মুঠোর ওপর রেখে খুব আস্তে আস্তে সাবধানে মুঠোটা খুললো। কিভাবে যেন দুটো আঙুল দিয়ে ধরল প্রজাপতিটাকে। প্রজাপতিটা ডানার ঝাপটায় মুক্তি পেতে চাইছে। উড়ে পালাতে চাইছে ।
আমি বললাম, কি করছো ? ছেড়ে দাও-
ও বলল , ছেড়েই তো দেব । একটু চুপ করে বস-
বলে প্রজাপতিটাকে আমার বাঁ গালে বুলিয়ে দিল । একইভাবে ডান গালের ওপর বুলিয়ে দিল।
তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল , দেখো এবার । তোমার কেমন গায়ে হলুদ হয়েছে।
কিন্তু আমার চোখ তখন প্রজাপতিটার দিকে। নিজের মুখ এমনিতেও দেখতে পাওয়ার প্রশ্ন নেই। তবে আমার মনের চোখ যে তখন পড়ে আছে প্রজাপতিটার দিকে ।
ওকে বললাম, ছেড়ে দাও। প্রজাপতিটা মরে যাবে ।
— উফ্! ইউ আর সো মাচ আনরোমান্টিক। তখন থেকে খালি প্রজাপতি প্রজাপতি করে যাচ্ছে-
বলে ছেড়ে দিল সেটাকে। আমি দেখলাম প্রজাপতিটা আহত হয়ে ঘাসের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ল । কয়েকবার ডানা মেলে ওড়া ব্যর্থ চেষ্টা করলো । কিন্তু পারলো না । ভালো লাগেনি আমার । উঠে পড়েছিলাম সেখান থেকে।

বাড়ি ফিরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম প্রজাপতির ডানার হলদেটে রেনুগুলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে দুটো গালে লেগে রয়েছে । ঠিক যেন গায়ে হলুদ। কিন্তু সেই রং সেদিন আমার মনে রং লাগাতে পারে নি। সেদিন রাতে অনেকক্ষণ ঘুম আসেনি । কিন্তু অদ্ভুতের কান্ড, সেদিন কোন রোমান্টিক কল্পনা আমাকে পেয়ে বসেনি । বারবার মনে হচ্ছিল আমার মনের হদিশ কেন থাকে না ওর কাছে? আমি যে বারবার বললাম, প্রজাপতিটা মরে যাবে। তবুও ও শুনল না? হাত বাড়ালেই তো শরীরটাকে ছোঁয়া যায় । ঠিক শরীরের মতো করেই ভালোবেসে ও আমার মনটাকে কবে ছোঁবে ? আমিতো ওকে কবেই আমার মন দিয়েছি । কিন্তু ও ছোঁয় কি?

ক্রমশ..

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

পঁচিশ

সবকিছুই পবিত্র, বড় নির্মল। প্রেমে সমস্তকিছুই সমর্পণ করা যায় । আমি ওর । সম্পূর্ণভাবেই ওর । এই অনুভূতি এমনভাবে পেয়ে বসে যে, জগতের মাঝে নিজের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় আর একজনের অস্তিত্বের কাছে । আমি ওর কাছে হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজেকে। মৃত প্রজাপতির অনুভূতিটা দিন কয়েকের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছিল। কি এমন ঘটনা ? চাপ হয়তো বেশি পড়ে গেছিল, ও বুঝতে পারেনি । বেড়েই চলল আমার ওর প্রতি সমর্পণের আকুতি । আমি বুঝতে পারতাম ও যতটা না চাইত, তার চেয়েও বেশি সমর্পিত ছিলাম আমি ।

ওর কথায়, ওর কথা মতো নিজেকে সাজিয়ে তুলেছিলাম ।
ও একদিন আমার চুলের গোছাটা নিয়ে মন্তব্য করেছিল, তোমার যেরকম ফিগার আর গেটাপ, তোমাকে কিন্তু লম্বা চুল বেশি মানাবে ।
তাই হল। আমি ভামিনী কাকিমার অবাধ্য হলাম। চুল বড় করতে শুরু করলাম আবার।
ও বলেছিল , তোমার স্ট্রাকচারটা যদিও একদমই স্লিম মেয়েদের মত নয়, তবে চেষ্টা করলে কিছুটা ফ্যাট ঝরিয়ে কম্পারেটিভলি স্লিম হতে পারো। আই থিঙ্ক, ইউ উইল লুক বেটার ।
সকালবেলা নিজের ঘরে কিছুক্ষণ করে এক্সারসাইজ করতাম। খাওয়া দাওয়া কমিয়ে ফেললাম । মনে হত যেন একটু একটু করে স্লিম হচ্ছি। আমার মননে, চিন্তনে, নিঃশ্বাসে, কল্পনায়, বাস্তবে ,সর্বত্র শুধু সোনু দা । আমার সমস্ত ভবিষ্যৎ কল্পনা জুড়ে শুধুমাত্র একজন। আমার ক্ষমতা ছিল না , আজও সে ক্ষমতা আমি জোগাড় করে উঠতে পারিনি- সোনুদার জায়গায় অন্য কোন পুরুষকে কল্পনায় বা বাস্তবে বসানো । আমার খুব ইচ্ছা করত, এই যে সোনুদা এখানে একা একা থাকে, ওর জামাপ্যান্টগুলো সব নিজে হাতে কেচে দিতে । ওর বিছানার চাদরটা নিজে হাতে কেচে টানটান করে পেতে দিতে । ওর বালিশে ধবধবে ওয়ারটা নিজে হাতে করে পরিয়ে দিতে। অগোছালো বইগুলো সব গুছিয়ে দিতে । ওকে সব সময় ছুঁয়ে থাকতে পারিনা, কিন্তু সবটুকু সময় আমার স্পর্শ যেন ওর চারপাশ থেকে ঘিরে রাখে -আর এই ছিল আমার সর্বক্ষণের ভাবনা-চিন্তা । একটা ভবিষ্যৎ দেখতাম, যেখানে আমি আর সোনু দা । সেই আমি আর এই আমির মধ্যে পার্থক্য আছে । পার্থক্য হল – আমি আমার কপালে জ্বলজ্বলে একটা সিঁদুরের প্রলেপ এঁকেছি, দুটো ভ্রুর মাঝখানে সিঁদুরের একটা টিপ পরেছি । সমস্ত পৃথিবীর থেকে লুকিয়ে রেখে আমাদের আর প্রেম করতে হয় না । আমরা যে স্বামী-স্ত্রী ! আমার সম্পূর্ণ অধিকার ওর ওপর , ওর সম্পূর্ণ অধিকার আমার ওপর। পূর্ণ হয়ে উঠেছে আমার জীবন কানায় কানায়। ভীষণভাবে দেখতে পেতাম এই ছবিটা। আমি আমার সোনুদার দেওয়া সিঁদুর পরে, ওর হাত ধরে ওর ঘরে গেছি , লাল বেনারসি পরে । তারপর সারাটা জীবন, আমৃত্যু, শুধু দুজনে দুজনের হয়ে বেঁচে থাকা-! কত কিছু কল্পনা করেছি- একটা ছোট্ট ফুলের বাগান থাকবে, সেখান থেকে তাজা ফুল তুলে এনে ও আমার আলগা খোঁপায় গুঁজে দেবে । কিন্তু তারপর দুজনে শুধু দুজনার হয়েই কি জীবনটা কাটাবো ? না, তারপর আমাদের প্রতিনিধি হয়ে ছোট্ট একটা আলোর টুকরো আসবে আমাদের জীবনে ।

এইসব রঙিন কল্পনা করতে করতেই একদিন টুক করে এসে পড়ল রঙের দিন । ফাগুনের দিন । দোল পূর্ণিমা । মনের বসন্তের প্রথম রং খেলার দিন । মনে তখন পূর্ণিমার চাঁদ ঝলমল করছে। চাঁদের আলোয় উজ্জ্বল চারিদিক । বাসন্তী রঙের শাড়ি পরলাম সেদিন । মেরুন রংয়ের পাড়। মেরুন রংয়ের ব্লাউজ । কপালে একটা ছোট মেরুন টিপ । চুলটা অল্প লম্বা হয়েছিল, দু’পাক বিনুনি করা যেত তখন। চুলটা খুলে রেখেছিলাম । আমার চুলের সামনের দিকের আলগা ভাবটা ভারী সুন্দর ছিল তখন । খুলে রাখলে অল্প একটু ঢেউ খেলত । কপালটাও ছোট লাগতো । সব মিলিয়ে মুখের শ্রী বেড়ে যেতো । এখন তো চুল পাতলা হয়ে গিয়ে ওসব আর বোঝা যায় না । লাল, নীল , সবুজ, হলুদ , কমলা, গোলাপি, এলোমেলো সব রঙের আবির নিয়ে আমি আর বান্টি দুজনে বেরোলাম । ভাবটা এমন , দুজনে মিলে রং খেলবো । খেললামও কিছুটা । ও আমার গালে, মাথায়, কিছুটা আবির লাগিয়ে দিল। আমিও দিলাম । তারপর গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চললাম ম্যানেজারের বাংলোর দিকে। বান্টিকে বলে দিয়ে সুবিধা হয়েছিল। ও আমাদের কোনোভাবে ডিস্টার্ব তো করতই না , উল্টে সময় সুযোগ বুঝে ওকে পাহারায় রাখা যেত । একটু বেগতিক হলেই ও আমাকে কোন না কোনভাবে সাবধান করে দিত । কোন একটা শব্দ করতো বা সাংকেতিক কিছু । আমরা আলোচনা করে ঠিক করে রাখতাম, সেরকমই করত । ও বাংলোর গেট থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রইল । আমি একা ভেতরে গেলাম । বাংলোর গেটটা খুলে ভেতরে ঢুকতে হলে আমার বুকটা দুরু দুরু করে উঠতো। আমি জানি আজকে ম্যানেজার কাকু থাকবেন না। ও একা আছে বাংলোয়। ম্যানেজার কাকু দোলের ছুটিতে বাড়ি গেছেন । আমার এই বাংলোর গেটটা খুলে ভেতরে ঢোকার সময় অদ্ভুত একটা অনুভুতি হতো । মনে হতো কোনো নিষিদ্ধ আকর্ষণ যেন আমাকে নিশির ডাকের মতো সেখানে টেনে নিয়ে যাচ্ছে । অথচ আমি ভয়ও পাচ্ছি । পেটে খিদে , মুখে লাজ ।

আমি ঢুকলাম বাংলোর ভেতরে। দরজা ভেজানো ছিল , ভেতর থেকে বন্ধ ছিল না। নক করলাম দরজায়। তারপর নিজেই পাল্লা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম । সোনুদা ছিল ভেতরের ঘরে , ওর বেডরুমে । ও ওর বিছানায় আধশোয়া হয়ে কিছু করছিল । আমি ফাগের থালা নিয়ে হাজির হয়েছি দেখে আমার দিকে তাকিয়ে সেই মুচকি হাসিটা হাসল। তারপর হাতের ইশারায় ডাকলো আমায় । আমি এগিয়ে গিয়ে নিজের ভেতরের দুর্বলতাটুকু যথেষ্ট আগলে রেখে বাইরে স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করে হাসিমুখে ওর দু গালে গোলাপি আবির মাখিয়ে দিলাম । ও কিছুক্ষণ মিটিমিটি চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে । তারপরে এক ঝটকায় উঠে বসে আমার হাত থেকে আবিরের খেলাটা নিয়ে মাটির ওপর নামিয়ে রাখল। মুঠো ভরে তুলে নিল লাল আবির । তারপর আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার মাথার ঠিক সিঁথির কাছটা রেঙে উঠলো লাল আবিরে । সে ঘরের দেওয়ালে একটা আয়না ছিল । সেই আয়নাটার সামনে আমাকে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে আমার পেছনে ও দাঁড়ালো । আমার প্রতিবিম্ব পড়েছে আয়নার ওপর । ঠিক সিঁথির কাছটা টকটকে লাল! অদ্ভুত একটা গা শিউড়ানো ভালো লাগায় ভরে উঠল মনটা । সোনুদার হাতের আবিরে রেঙে উঠেছে আমার সিঁথি ! রূপকথার দৃশ্য ! সে এক রূপকথার অনুভূতি ! কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলাম নিজের পরিবর্তিত প্রতিচ্ছবির দিকে । সে এক অদ্ভুত ভালোলাগা, অদ্ভুত ভয় ! আমার কি তবে বিয়ে হয়ে গেল ?
আমার মনের প্রশ্নটাই কিভাবে যেন পৌঁছে গেল ওর গলায় ।
ও মুখটা নামিয়ে এনে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, কি, বিয়ে হয়ে গেল তো?
চমকে উঠলাম কথাটা ওর কাছে শুনে। বিয়ে হয়ে গেল ! আমার কি তবে সত্যিই বিয়ে হয়ে গেল ! মালাবদল করে, সাতপাক ঘুরে , সিঁদুর দান করে যে বিয়ে হয় – এটাও মানুষেরই বিশ্বাস । আমার মনে তখন আবেগের মাখামাখি। আমার কাছে বিশ্বাস , ও আমার সিঁথি রাঙিয়ে দিল মানেই আমার বিয়ে হয়ে গেল ।
ও আবার বলল, বলেছিলাম না, বিয়ে অনেক রকমের হয় ? দেখো তোমার আজ বিয়ে হয়ে গেল ।
আমি তখন বিভোর হয়ে ভাবছি, আমার সত্যিই বিয়ে হয়ে গেলো কিনা । হঠাৎ বুঝতে পারলাম ওর বাঁ হাতটা আমার নতুন শাড়ির গন্ধ মাখা নাভির কাছটা খামছে ধরেছে । আমি আবিষ্ট চোখে দেখতে পেলাম , আয়নায় যে সিঁথি রাঙ্গানো মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, তার চোখের পাতা দুটো বন্ধ হয়ে আসছে । তারপরে আর কিছু দেখতে পেলাম না । বুঝলাম, ওর হাতটা নাভিমূল ছেড়ে উঠে আসছে ওপরের দিকে । আমার মাথাটা এলিয়ে পড়ল ওর কাঁধের ওপরে। আমি বুঝতে পারছি ভাঁজে ভাঁজে পাট করা আঁচল শিথিল হয়ে আসছে ।
খসে পড়ছে।
পড়ছে ।
পড়ল !
আর তার সাথে সাথেই ওর হাতদুটো অধিকার করে নিল আমার শরীরের সবচেয়ে স্পর্শকাতর স্থান দুটো। এতদিন সযত্নে আড়াল করে রেখেছিলাম ওর স্পর্শ থেকে । দেহ-মন সর্বক্ষণই চাইতো। তবুও অন্ধ সংস্কারের বশে আড়ালে রেখে দিয়েছিলাম। আজ আর তা রইল না । বুঝলাম আমার পা দুটো শূন্যে উঠে যাচ্ছে । ও আমাকে কিছুটা পাঁজাকোলা করে তুলে নিল । তারপর বিছানার ওপরে বালিশগুলোর ওপর ভর দিয়ে ও যেমন আধশোয়া হয়ে বসেছিল, তেমনভাবে শুইয়ে দিল আমায় । আমি তখনও চোখ বুজে রয়েছি , খুব জোরে। কিছুক্ষণ পর ঠান্ডা আবিরের গন্ধ পেলাম মেরুন ব্লাউজের ওপর থেকে । সঙ্গে ঠান্ডা আবিরের পুরুষালি স্পর্শ । চোখ খুললাম। বুকের ওপর চোখ রাখলাম । সে দুখানা তখন ও দু’হাতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রয়েছে। তার সাথে কমলা রংয়ের মাখামাখি। ও কখন মুঠোয় করে থালা থেকে কিছুটা কমলা আবির তুলে নিয়েছিল । আমি জানি আজকে ও কোনো বাধা মানবে না । আমি এও জানি , আজকে আমি কোনো বাধা দেওয়ার চেষ্টাও করবো না ।

আমি দেখছি , চোখ মেলে দেখছি, কিভাবে ওর আঙ্গুলগুলো এক এক করে আমার ব্লাউজের হুকগুলো খুলে ফেলছে । একসময় সম্পূর্ণ খুলে ফেলল। আমি আমার অন্তর্বাস দেখতে পাচ্ছি । আর দেখতে পাচ্ছি সেটা কিভাবে তার নিজস্ব হালকা গোলাপি রঙের ওপর ওর হাত থেকে কমলা রং ধার নিয়ে রাঙিয়ে ফেলছে নিজেকে । কিছুক্ষণ প্রলুব্ধ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থেকে ও সেটাও খুলে ফেলল । আমি দেখছি , অবাক হয়ে দেখছি , কিভাবে আমার বাঁধন মুক্ত দুটো স্নেহ-পাত্র ওর হাতের নিচে গলে যাচ্ছে , জেগে উঠছে , পূর্ণতা পাচ্ছে । কমলা গুঁড়ো গুঁড়ো আবিরে অদ্ভুত সুন্দর এক রূপ ধারণ করেছে । যে রূপ পূর্ণতা পাচ্ছে ওর আঙুলগুলোর উপস্থিতিতে । ও কিছুক্ষণ খেলা করলো। মৃৎশিল্পী যেমন পরম যত্নে নিজের গড়া কাঠামোয় রঙ চড়ায়, সেভাবে ও আমার বুকদুটোয় ওর হাতে লেগে থাকা সমস্ত আবির মাখিয়ে দিল । তারপর রবি ঠাকুরের ভাষায় ঠিক যেখানটা ‘জীবনবৃন্তের মুকুল’ সেখানে ওর মুখটা নেমে এলো । উত্তেজনায় আমার চোখদুটো আবারো বন্ধ হয়ে গেল । কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই টের পেলাম আমার শরীরের সেই লালচে খয়েরি সেনসিটিভ অংশটুকুতে উষ্ণ স্পর্শ নেমে এসেছে । আমার স্তনবৃন্ত এখন ওর মুখের ভেতরে । ও ঠোঁট বুলোচ্ছে, কখনো আলতো দাঁতের চাপ দিচ্ছে , কখনো ওর মুখের ভেতরে শুষে নিচ্ছে –

একটা মেয়ের জন্য তার স্তনবৃন্তে তার প্রেমাস্পদর ছোঁয়া যে কি , কি অমূল্য অনুভূতি, কিভাবে তা সারাটা শরীরে-মনে একইসঙ্গে ঝড় তুলতে পারে, আবার অবশ করে ফেলতে পারে, সমস্ত অনুভূতি, শরীর-মন-আত্মা জুড়ে একটিমাত্র স্থানে একত্রিত হতে পারে , তা যতদিন না কোন একটি মেয়ে প্রথম স্পর্শ অনুভব করেছে, তার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় । সমস্ত শরীর আমার গলে যাচ্ছে, দ্রবীভুত হচ্ছে । কে যেন বীণার তারে হাত বুলিয়ে বাজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে । আবেগের ঢেউ । প্রতিটা ঢেউয়ের সাথে অমূল্য মণিমুক্তো উঠে আসতে লাগল । আমি চুপ করে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলাম । শুধু আমার হাতের আঙুলগুলো নিঃশব্দে কখন ওর মাথাটা পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে রইলো –

এরপর কখন ও আমাকে ছেড়ে দিয়েছে, কখন আমি অন্তর্বাসের হুক লাগিয়ে নিয়েছি, কিভাবে আবার ব্লাউজটা পরেছি , শাড়ির আঁচল বুনেছি, জানিনা । একটা সময় ফাগের থালা হাতে আবার বেরিয়ে এলাম বাংলো থেকে । নারী-শরীর যে কিভাবে পুরুষের স্পর্শে জেগে উঠতে পারে, তা যতদিন না তার স্তনবৃন্তে সে তার ভালোবাসার মানুষটির ছোঁয়া পাচ্ছে, ততদিন বোঝা যায় না । আমি সেদিন বুঝতে পারলাম, প্রথম বুঝতে পারলাম, শরীরের জাগরন কাকে বলে।

এরপর থেকে অবশ্য বেশ কয়েকবার ওভাবেই জেগে উঠেছে আমার শরীর । কখনো কখনো ও আবার পেনে করে কলকা একে দিতো আমার বুকের ওপর । নিজের ঘরে ফিরে এসে নির্নিমেষ চোখে কলকাগুলো দেখতাম । মনে হতো , ওগুলো আমার জন্ম-দাগ । গত জন্ম.. তারও আগের জন্ম.. বহু বহু জন্ম ধরে ওই দাগ বুকে নিয়েই আমি জন্মেছি .. আগামী অনন্ত জন্ম ধরে ওইভাবেই জন্মাবো। কখনো কখনো ও একটু জোরে কামড়ে দিত , দাঁতের দাগ ফুটে উঠতো, নখের দাগ ফুটে উঠতো , লাল হয়ে যেত চারপাশটা । সেই ফুটে ওঠা ‘লালে’র সঙ্গে তুলনায় আসতে পারে এমন কোন রং পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়নি । মনে হত যেন, সমুদ্রের আড়ালে মুখ লোকানোর আগে অস্তগামী সূর্য যে আভা ছড়িয়ে যায়, কিংবা প্রথম সূর্যোদয়ের যে লালচে আভা তিলকের মতো ফুটে ওঠে কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরে- সব রঙ’ই সেই রঙের কাছে ফিকে ।
আমি ভরে উঠতাম। প্রতিটা স্পর্শে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতাম।

ক্রমশ..