হলদে প্রজাপতি পর্ব-৪+৫

0
262

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

চার

আমার বাংলোটা ভারী পছন্দ হয়েছে। ছোটখাটো, ছিমছাম , সাজানো-গোছানো । প্রকৃতির কোলে । বাউন্ডারি ওয়াল বলে সেভাবে কিছু নেই । কিছুটা ফেন্সিং করা রয়েছে। তবে বাউন্ডারি ওয়াল নয়। একতলা বাংলো । লম্বাটে । ঢুকেই একটা লম্বা বারান্দা । বারান্দার ডান পাশে ডাইনিং রুম । তারপর দুটো বেডরুম । দুটো টয়লেট । ওপেন কিচেন ডাইনিং স্পেস এর মধ্যে। ভেতরটা যে খুব সাজানো , তেমন নয় । তবে ছিমছাম এবং মিনিমাম যা কিছু আসবাবপত্র লাগে সবই রয়েছে । চেয়ারগুলো সব বেতের । ডাইনিং টেবিলের সাথে চারটে চেয়ার । তাছাড়াও এক্সট্রা দুটো চেয়ার রয়েছে । দুটো আলমারি রয়েছে দুটো বেড রুমে , কাঠের । এছাড়া ওয়াল আলমারি রয়েছে একটা। এলইডি টিভি রয়েছে । কিন্তু দুঃখের কথা, সেটা আমার খুব একটা কাজে লাগে না । শুধুমাত্র সারাদিনের কাজ সেরে এসে টুকটাক নিউজ চ্যানেলগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখি এই আর কি। আমি সাথে করে বেশ কিছু গল্পের বই নিয়ে এসেছি । সেগুলোই পড়ে সময় কাটাবো বলে । তবে , এখনো পর্যন্ত সময় কাটানোর মত সময় পাইনি। এস্টেটের কাজকর্ম বুঝে নিতে বাংলোয় ফিরে এসো প্রতিদিন অফিসের ফাইল পত্র নিয়ে বসতে হয়েছে । তাছাড়া যেটুকু সময় ফ্রি থেকেছি, টগর উন্মুখ হয়ে বসে থেকেছে গল্প করার জন্য । ও খুব গল্প করতে ভালোবাসে । অথচ আমি সারাদিন বিজি থাকি ।ওর একটু অসুবিধা হচ্ছে বটে ।

দেখতে দেখতে সাতটা দিন এখানে কাটিয়েও ফেললাম । মোটামুটি প্রতিদিনের একই রুটিন। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে টয়লেটের কাজকর্ম সেরে কিছুক্ষণ সামনের লনে ঘুরে বেড়াই। ইচ্ছে হলে একটা চেয়ার নিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকি । তখন আবার মালি আসে বাগানের পরিচর্যা করতে । হারান দা খুব কম কথা বলেন। মন দিয়ে কাজ করেন । ঘন্টাখানেক ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটা গাছ দেখা , জল দেওয়া, আগাছা পরিষ্কার করা , গাছের গোড়া মাটি কুপিয়ে আলগা করা , যেখানে যতটুকু সার প্রয়োজন দেওয়া । তাছাড়া, সমস্ত বাগান পরিষ্কার করা তো আছেই । ওনার কাজ দেখলে বোঝা যায়, উনি শুধু কাজ হিসেবে সেগুলো করছেন না , গাছগুলোকে ভালোবেসে করছেন । বেঁটেখাটো , রোগাসোগা মানুষটি কিন্তু বড়ই হাসিখুশি । কম কথা বললেও , যেটুকু বলেন ভারি হাসিমুখে বলেন। সকাল-সকাল ওনার সাথে খানিক গল্প করে দিনের আরম্ভটা মন্দ হয় না । আমি জোর করেই ওনাকে এক কাপ করে চা খাওয়াই প্রতিদিন । আমার সঙ্গে বসে খান । অবশ্য এতে আমার স্বার্থ যথেষ্ট । ওনার সাথে গল্প করতে করতে আশেপাশের কিছু খবরা-খবর নেওয়াও হয় , আবার বিভিন্ন গাছের সম্পর্কে , পরিচর্যা করার পদ্ধতি সম্পর্কে জানাও হয় । আমার এই বাংলোর লনে রাস্তার দু’পাশে রয়েছে কিছু জারবেরা , জিনিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, কসমস। সবুজ ঘাসের লনে বেশ কিছু কিছু জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে নাইন ও ক্লক । আর লনের ওপাশে ঠিক ফেন্সিং এর কাছাকাছি জায়গাটায় সার দিয়ে বেশকিছু চন্দ্রমল্লিকা । ঠিক বাংলোয় ঢোকার রাস্তাটা যেখান থেকে শুরু হয়েছে, সেখানে রাস্তার দুপাশে দুটো কাঠচাঁপা গাছ । পশ্চিম দিকে অর্থাৎ যেটা আমার বাংলোর পিছনের দিক হচ্ছে ,সেখানে একটা জারুল গাছ । সেটার ডালপালার কিছুটা অংশ বাংলোর ছাদে গিয়ে পড়েছে । এছাড়াও পিছনের দিকে একটা আতা গাছ, একটা পেয়ারা গাছ, বেশকিছু বেলি ফুল আর নয়ন তারা ফুলের গাছ রয়েছে । একটা গন্ধরাজ ফুলের গাছও রয়েছে । অবশ্য সেটায় এখনো ফুল ফোটার সময় আসেনি । দেখা যাক সে ফুলের গন্ধ কেমন। এখন আবার অনেক ফুলেই ঠিক তেমন মনকেমন করা বন্ধ আর হচ্ছেনা। সর্বত্রই হাইব্রিড আর ভেজালের যুগ । ফুল ফল সবজিও তার থেকে রেহাই পায়নি ।

টগর ছাড়াও বাংলায় আর একজন এসেছে আজ দুদিন হল। শিশির , ছেলেটি আমার বয়সীই হবে । সে অবশ্য আমার বাংলায় থাকেনা। বাংলোর পিছন দিকে একটা ঘর রয়েছে । ছোট একটা ঘর, একটা টয়লেট, ব্যাস এইটুকু। সামনে শুধু একটা দুহাত ছোট বারান্দা । সেখানেই সে রান্না করে নেয় । সে হলো আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট । ম্যানেজারের বিভিন্ন রকম দায় দায়িত্ব থাকে । সবসময় আমি সব জায়গায় উপস্থিত হয়ে উঠতে না পারলেও যেন কোনো রকম ভাবেই কোনো কাজ থমকে না থাকে , সেই জন্য সে আমার বাংলোর চৌহদ্দির মধ্যেই থাকে। আমি যখন অফিসে যাই, আমার সঙ্গেই সেও যায় । অবশ্য অফিসে শুধু একটি বার করে হাজিরা দেওয়াই কাজ । তাছাড়া অফিসে তেমন কোনো কাজ থাকে না । অফিস থেকে কিছুটা দূরে স্টোর হাউসে চা পাতাগুলো প্যাক হয়ে ডেসপ্যাচ হওয়ার জন্য জমা থাকে । তাছাড়া শুকনো কিছু চা পাতাও গুদামে স্টোর করা থাকে । প্রসেসিং এর আগে । সেই স্টোরহাউসে গিয়ে কিছু দেখাশুনা করে রাখতে হয় । এছাড়া টি এস্টেটে ঘুরে ঘুরে কাজ । আর বাকি কাজ পাশের টি এস্টেট এর টি ফার্মে। সেখানে সমস্ত দেখেশুনে প্রসেসিং করিয়ে নিয়ে আসতে হয় । সুপারভাইজ না করলে কোত্থেকে কি হয়ে যাবে, হয়ত যত পরিমাণ চা পাতা পাঠানো হয়েছে, আনুপাতিক প্রসেসড টি তার হাফও পাবো না। মোটামুটি সারাদিন ঘুরে বেড়ানোটাই আসল কাজ । সারাদিনের এত ছোটাছুটির মধ্যেও একটাই শান্তি । বেশিরভাগ কাজই প্রকৃতির কোলে, সবুজ চা বাগানের মধ্যে। ইঁট , কাঠ , সিমেন্টের জঙ্গলে নয় । ক্লান্তি তো শারীরিকভাবে যা আসে, তার শতগুণ আসে মানসিকভাবে । এখানে মানসিক ক্লান্তি অনেক কম আসে। তবে একটা ব্যাপার আমি খুব ভাল করেই বুঝতে পারছি, চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে, তা সে পুরুষ হোক বা মহিলা, তাছাড়াও এস্টেট এর বিভিন্ন কর্মচারীদের মধ্যেও আমাকে নিয়ে একটা বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে । আমার যে এটা সৃষ্টির পেছনে বিন্দুমাত্র দায় রয়েছে তা কিন্তু নয় । আগে থেকেই হয়েছিল । যখন থেকেই ওরা শুনেছে একজন মহিলা আসছেন, ওদের ম্যানেজার হয়ে। ম্যানেজার মানেই তার কথা সব সময় শুনে চলতে হবে, তিনি নির্ধারণ করবেন সমস্ত কাজকর্ম, সেখান থেকে একজন পুরুষের অর্ডার পেতে এবং সেটা তালিম করতে ওরা যতটা স্বচ্ছন্দ, মোটেও একজন মহিলার ক্ষেত্রে ততটা নয় । পুরুষদের কথা ছেড়েই দিলাম । চা-বাগানে মহিলা শ্রমিকই বেশি । তাদের মধ্যেও সেই বিরূপ মনোভাবটা কিন্তু যথেষ্ট রয়েছে । এমনকি বেশি রয়েছে, তবু কম নয় । এটাই আশ্চর্যের । আমাদের সমাজে পুরুষতন্ত্রের শিকর এতটা গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত যে, নারীদের মানসিকতাও সেই পুরুষতন্ত্রের ছাঁচে ঢালা । অথচ পুরুষতন্ত্রের যাঁতাকলে থাকতে তাদের কিন্তু কোন অসুবিধা নেই । তবুও একটা আপাত সুবিধার আড়ালে থাকতে থাকতে তারা অভ্যস্ত । তাদের বোঝানো হয়েছে, পুরুষরা ভালো পারে যেকোনো ম্যানেজমেন্ট বা অফিশিয়াল কাজকর্ম । নারীদের যত ম্যানেজমেন্ট সমস্ত কিছু সেই হাতা-খুন্তি নাড়ানাড়ির মধ্যে । হাজার হাজার বছরের অচলায়তনের দ্বারা গড়ে ওঠা এই ঘুণ ধরা মানসিকতা এমনভাবে পেয়ে বসেছে যে, কি পুরুষ, কি নারি , প্রত্যেকেই তাতেই স্বচ্ছন্দ।

তাই আমি যখনই এস্টেটের বিভিন্ন জায়গায় কাজকর্ম দেখাশুনার জন্য ঘুরে বেড়াই, প্রত্যেকে সময় পেলেই সুযোগমতো আমার দিকে আড়চোখে কৌতুহলবশে তাকিয়ে নেয় । কৌতুহলের কিছুই নেই । তবুও এদের কৌতুহল। আমি যখনই যেখানে ভিজিট করি , দেখেছি এদের মধ্যে বেশ একটা গা’ছাড়া ভাব । সেটা আমি যখন একেবারে সামনে উপস্থিত থাকি তখনও কিন্তু থাকে । তরল একটা উপহাস মাখা চোখে। যেন ভাবটা এইরকম, মেয়েছেলে আবার ম্যানেজারির কি বোঝে? আমরা কাজ করি না করি, যেভাবে করি, সেভাবেই চলবে । আমি যখন আবার কিছুটা এগিয়ে যাই , তখন পিছন থেকে খুব হালকা একটা সম্মিলিত হাসির রেশ ভেসে আসে । চা বাগানের শ্রমিকদের যে সবসময় কলুর বলদের মত খাটতে হবে , এমন কোনো কথাই নেই । কিন্তু ম্যানেজার হিসেবে আমি যদি এদের ম্যানেজ না করতে পারি , সেটা কিন্তু আমার জন্য অসুবিধার হয়ে দাঁড়াবে। রাশ প্রথম থেকে ধরতে না পারলে একটা সময়ে গিয়ে একেবারেই হাতের বাইরে চলে যায় । এক সপ্তাহ হয়ে গেল অথচ এদের চোখে মুখে কোথাও আমাকে ঠিক ম্যানেজার হিসেবে অ্যাকসেপ্ট করে নেওয়ার মতো বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আমি দেখতে পাইনি।
আজকে ভাবলাম, এভাবে দূরে দূরে থেকে শুধু তদারকি না করে, ওদের সাথে একটু মিলেমিশে কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। যদি ওদের সাথে কথাবার্তা বলে বন্ধুর মতো মিশতে পারি, তাহলে হয়তো এই প্রবলেমটার একটা সলিউশন হতে পারে। গিয়েছিলাম এস্টেটের পূর্ব দিকের বাগানে । সেখানে তখন মোটামুটি জনা কুড়ি মহিলা আর ছ’ কি সাতজন পুরুষ কাজ করছিল। মহিলারা পিঠে সেই লম্বাটে ঝুড়িটা নিয়ে চা’পাতা তুলছিলো, আর পুরুষরা রাস্তার অন্য সাইডের গাছগুলোর প্রুনিং করছিল, ছাঁটাই । আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কাজ দেখলাম। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম তাদের দিকে । আমি যতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়েছিলাম , তারা হালকা মেজাজে কাজ করছিল। একবারও তাদের কাজের ধারা দেখে মনে হচ্ছিল না যে তাদের কাজ স্বয়ং চা বাগানের ম্যানেজার এসে পর্যবেক্ষণ করছে। কিন্তু যখন আমি ওদের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম, তখন ওদের মধ্যে একটা চাপা অস্বস্তি কাজ করতে আরম্ভ করলো যে সেটা বুঝতে পারলাম । একেবারে ওদের সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়ালাম । সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ওরা আর কোনরকম কৌতুহল বা কৌতুক মিশ্রিত দেহভঙ্গি এক্সপ্রেস করার সাহস পেল না । যতই হোক এই টি এস্টেট এর ম্যানেজার তো আমি । চোখ নামিয়ে যে যার মত কাজ করতে লাগল । আমি পুরুষদের দিকটাতে এসেছিলাম । ওরা লম্বাটে হালকা ধরনের একধরনের কাস্তে নিয়ে গাছগুলোর সার্ফেসের ওপর দিয়ে নিপুণ হাতে চালিয়ে ওপরের দিকের ইঞ্চিখানেক করে ছাঁটাই করে দিচ্ছে। টি প্লান্ট প্রুনিংয়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রুনার মেশিন পাওয়া যায় । কোনোটার সামনে চাকতির মত লাগানো, কোনোটা আবার লম্বাটে পাতের মত । কিন্তু আমাদের এস্টেটে এখনো ওসমস্ত কেনা হয়ে ওঠেনি । ওরা সেই কনভেনশনাল প্রসেসে কাস্তে দিয়েই কাজটা করছিল ।
আমি কিছুক্ষণ ওদের কাজ পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে একজনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম । বললাম , তোমার নাম কি ?
একবার আড়চোখে চকিতে আমার দিকে তাকিয়ে নিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলল সে । বলল, চন্দন ।
— কত দূরে বাড়ি তোমার?
— আইজ্ঞা, ইখান থিকা পাঁচ কি ছ’ মায়েল আউগুইয়া।
— কিসে করে আসো তুমি?
— সাইকেল, হুই , হুইখানে খাড়া করায় আছে ।
সে হাতে করে কিছুটা দূরে চা-বাগানের ফাঁকে একটা শেড-ট্রীর গায়ে হেলান দেওয়া তার জরাজীর্ণ রংচটা একখানা সাইকেল দেখালো।
সেটা দেখে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কত সময় লাগে তোমার আসতে?
— তা নাগে আধা ঘন্টা খানেকের , মেম। খুব জোরে চালায় কিনা।
— কতদিন কাজ করছো চা বাগানে?
— হামের আগিলা দুই পিড়ির ইটাই কাম কাজ ।
— তুমি এই চা বাগানে কতদিন কাজ করছো?
— বচ্ছর খান।
— হুঁ বুঝলাম।
তার পাশে একখানা তেলচিটে ছোপ লাগা কাপড়ে বাঁধা একটা পুঁটলি ছিল । ছাঁটাই করা চা’ গাছগুলোর ওপরে সে রেখেছে সেটা।
দেখিয়ে বললাম, এটা কি তোমার দুপুরের খাবার ?
— হিঁ।
— খাওয়া হয় নি এখনও?
— হাতের কাম কখান সারা হইলে খায় লিব ।
এরপর মুখটা তার কানের কিছুটা কাছে নিয়ে গিয়ে বেশ আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের আগের ম্যানেজার বাবু চলে গেছেন বলে তোমাদের কি ভালো লাগছেনা?
সে একখানা অদ্ভুত উত্তর দিল । কেমন ভাবে একটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল , আইজ্ঞা মেম , হামেরা গরীব মানষি, দিন লায় দিন খায়, কিনা? মালিক যেমন নোক মানিজার করি থুইবে তারোই চাখিরি করিব ।
আমার প্রশ্নের উত্তর হিসেবে চন্দন যা বলল, সেটা ঠিক সেই প্রশ্নের উত্তর না হলেও, তাতে প্রচ্ছন্ন একটা কথা প্রকাশ পাচ্ছিল। সেটা হল, মালিকপক্ষ যাকে আনবে তার আন্ডারে কাজ করতে আমরা বাধ্য । সেখানে আবার আমাদের পছন্দ-অপছন্দের কি? এরপর আমি চন্দনের সঙ্গে আর কথা বাড়ালাম না । সেখান থেকে চলে এলাম ।
বলে এলাম, আর বেশি দেরি করো না । তুমি বরঞ্চ খেয়ে নাও । তারপরে হাতের কাজ সেরো।
শুনে ‘হ্যাঁ’ ‘ না’ কিছু বলল না, কাস্তে তুলে নিল হাতে ।
এরপর একবার মেয়েদের দিকটায় গেলাম । আমি যতক্ষণ চন্দনের সঙ্গে কথা বলছিলাম , ততক্ষণ তারা উৎসুক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে দেখছিল যে , সেটা আমি তাদের দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছিলাম । সেখানে গিয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ তাদের আঙ্গুলের ভাঁজে ভাঁজে চা’ পাতা তুলে পিছনের ঝুড়িতে চালান করা দেখতে দেখতে একটি মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম । মেয়েটির নাম সীমা । তার সাথে পাঁচ-দশটা কথা বলে বুঝতে পারলাম, তারা আমাকে অ্যাভয়েড করতে চাইছে। আমার উপস্থিতিটা তাদের মোটেও পছন্দের নয়। তবুও আমি ইন্ডিভিজুয়ালি তাদের প্রত্যেকের সাথে কথা বললাম। নাম , ধাম জিজ্ঞাসা করলাম । যেচে পড়ে কথা বলাতেও তারা বিরক্ত । মনটা একটু ভারাক্রান্ত হল বৈকি । সমস্ত কিছুই চলছে । তবে তাতে প্রাণের স্পর্শ নেই । সেটা কি আগেও ছিল ? নাকি আমি আসার জন্য এমনটা হয়েছে? ঠিক বুঝতে পারলাম না। এদের সঙ্গে আরও একটু সময় আমায় দিতে হবে । এত তাড়াতাড়ি বোঝা সম্ভব নয় ।
সেদিন ছিল শনিবার । সেদিনকার মত আমার কাজ মোটামুটি শেষ হয়ে গেছিল । পরের দিন ছুটি । কাজে জয়েন করার পর থেকে একটানা কাজ করে চলেছি । মাঝে একটা দিনেরও ব্রেক পাইনি । এই প্রথম একটা দিন ছুটি পাব। নিজের অজান্তেই মনটাকে একটু ফ্রি করার ইচ্ছা হল । জগন্নাথ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল গাড়ি নিয়ে ।
ওর কাছে ফিরে গিয়ে বললাম , জগন্নাথ আজকে আমাকে নিয়ে লীস্ নদীর কাছ থেকে একবার ঘুরিয়ে আনবে ? আজকের মত কাজ কমপ্লিট । ঘন্টাখানেক ওখানে বসে থাকতে পারবো ।
— তা, চলুন দিদি। কিন্তু এখন নদীতে একদম জল নেই । শুকিয়ে কাঠ । আপনার ভালো লাগবে না ।
— জানি । তবুও চলো । ভালো লাগাতো মনের ব্যাপার । আমার ভালো লাগবে।
ও আর কিছু না বলে ড্রাইভারের সিটে গিয়ে বসলো । আমিও গাড়ির ভেতর ঢুকে বসলাম । চা বাগানের মধ্যে দিয়ে দুলতে দুলতে গাড়ি চলল। এখানে এসে থেকে চা বাগান প্রচুর দেখছি। অনবরত দেখছি। চোখের সামনে তো শুধুই সবুজের সমাহার। তবুও প্রকাশ্য দিবালোকে যখনই দেখেছি, তখনই আমি ভীষণ কাজের মধ্যে । সে কারণে, শুধু চোখই দেখছে, তা আর মাথা পর্যন্ত পৌঁছয়নি। কিংবা ঠিক মাথা নয় , হয়তো বা মন পর্যন্ত , কিংবা হৃদয়ে সে ছবির কোন প্রতিলিপি তৈরি হয় নি। তাই বলা যেতে পারে দেখেও দেখিনি । আজকে যখন আবার নিজের প্রথম যৌবনের স্মৃতিবিজড়িত নদীর ধারে চলেছি, তখন আচমকাই চারপাশের এই চা বাগানগুলো অন্য রূপে ধরা দিল আমার কাছে । আমি দেখতে পেলাম , দিগন্তবিস্তৃত চা বাগান জুড়ে বিভিন্ন ধরনের পাখি । তবে বী ঈটার বা বাঁশপাতি পাখি প্রচুর। ঠোঁট থেকে লেজ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ধরলে এক হাতের চেটোর পরিমাণ হবে কি হবে না। সবুজ রঙের চঞ্চল পাখিগুলো প্রচুর পরিমাণে শেড-ট্রীর ডালে ডালে বসে রয়েছে আর চঞ্চল ভাবে উড়ে গিয়ে পোকা ধরে খাচ্ছে বা খাওয়ার প্রয়াস করে চলেছে । অবিরত তাদের সেই ওড়াওড়ি, কিচিরমিচির । চা বাগান একটা বিশেষ ইকো সিস্টেম তৈরি করে । বিশাল অঞ্চল জুড়ে সেখানে বিভিন্ন ধরনের পোকা, মথ, প্রজাপতি থাকে। আর সে কারণেই বাঁশপাতি পাখি এত বেশি এখানে। চা বাগানের ওপর দৃষ্টি স্থির রেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে দেখা যায়, ছোট ছোট হলুদ প্রজাপতি প্রচুর । সেই প্রজাপতিগুলো .. সেই .. সেই রকমই.. ! যেন ‘গায়ে হলুদ’ হয়েছে ! আজও সব তেমনই আছে। তবু কিছুই তেমনটা নেই আর ।

প্রায় একঘন্টার কাছাকাছি সময় ধরে চা বাগানের বুক চিরে হেলতে-দুলতে উঁচু-নিচু রাস্তার ওপর দিয়ে চলার পর , গাড়ি পৌঁছলো লীস্ নদীর পাড়ে । বিস্তীর্ণ জায়গা । পাথুরে জমির মত ছোট-বড়-মাঝারি পাথরে ভর্তি হয়ে রয়েছে। বালির মাটি আর পাথর । বর্ষাকালে এই সমস্ত জায়গাই নদীর জলের তলায় চলে যায় । কিন্তু এখন শুকনো খটখট করছে । নদী প্রায় একটা নালার আকৃতি নিয়ে কুলকুল শব্দ করে একেবারে বাঁ পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে। বসন্তকাল। ওয়েদার ভালো। বিকেল হয়ে গেছে। পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যের আলো গায়ে লাগেনা । সবমিলিয়ে বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা রোমান্টিক পরিবেশ। উত্তরের দিকে তাকালে চোখে পড়ে ছোট ছোট পাহাড় চূড়ো । এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলটা পাহাড়ের সানুদেশ । সোজা উত্তরমুখো অনেকখানি চলে গেলে পড়বে মূর্তি। তারপর শুরু হয়ে যাবে ভুটানের পাহাড়ি অংশ । একটা বড় পাথরের ওপর বসে পড়লাম নদীর জলে পা ভিজিয়ে । ঐ পাশটা কিছুটা দূর থেকে নদীর পাড় শুরু হয়েছে, কিছুটা উঁচু। সেখানে ছোট বড় জঙ্গল । আমার ডান পাশে দূরে চোখ মেললে নীলচে পাহাড়ের ছবি ।

বসে আছি । আজ কত বছর পর আবার এখানে এই নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসে আছি ! সত্যি, ভাবতে অদ্ভুত লাগে। একা । আজকে দেড়’ যুগ বয়স বাড়িয়ে আমি আবার যখন এখানে ফিরে এসেছি, তখন আমি একা । সে আর আমার পাশে আজকে বসে নেই । ‘সে’ না থাকুক , আগে কখনো , ‘সে’ না থাকলেও একা আসিনি । আ্যটলিস্ট বিন্টি থাকতোই সঙ্গে । তিড়িংবিড়িং করে ছুটে বেড়াতো, খেলতো। নদীর জলে পাথর ছুঁড়তো। এভাবে একা বসে বসে নুড়িপাথর কখনো গুনি নি । আমার আজকে হঠাৎই আবার ভীষণ ভাবে অতীতের সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। বাস্তবে সম্ভব নয় তো কি হয়েছে? স্মৃতির অতলে তো সমস্তই রয়েছে । কি জানি কখন চুপচাপ সেখানে বসে সেই একটা অষ্টাদশী মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল । দুটো বিনুনি দুলতো তার বুকের ওপরে । ঘের ঘের চুরিদার পরতো মেয়েটা ,হাঁটুর নিচে ঝুল । ভীরু স্বভাবের । যতটা না স্বভাব জনিত ভীরুতা, তারচেয়ে অনেকগুণ ভীরু তাকে করে দিয়েছিল পরিবেশ-পরিস্থিতি । তন্বী দেহ না হলেও শরীরে মেদের আধিক্য নেই । মুখখানা সুশ্রী কি? তা হবে । সুশ্রী কি নয় , তার চেয়ে বড় কথা লাবণ্য যথেষ্ট । ওই বয়সের মেয়েরা তো লাবণ্যময়ীই হয় । তরুণী , কলেজে পড়া মেয়ে তখন আমি । মনের মধ্যে কত প্রজাপতি । লাল, নীল, হলুদ , সবুজ, রামধনু রং এর । একটা মেয়ে ছিল। রূপকথার রাজ্যে তার আনাগোনা। আজকে আবার বড় জমিয়ে, যুত করে, আমি সেই অতীতের স্মৃতি রোমন্থনে ফিরে গেলাম । এই আমি আর সেই আমি.. ? এখনকার নয়.. এ সেই .. সেই মেয়েটা.. !

যেন কোন তেপান্তরের মাঠ থেকে আওয়াজ ভেসে এলো,
— তরু মা ! শোন, দেখ কে এসেছেন তোর সঙ্গে দেখা করতে।
আমি তখন সবেমাত্র এইচএস দিয়েছি । লম্বা লম্বা দুটো বিনুনি দুলিয়ে ছুটতে ছুটতে বাবার বৈঠকখানা ঘরে গিয়ে হাজির হলাম। পুরুলিয়ায়। আমাদের সেই ছোট্ট বাড়িটায়।

ক্রমশ..

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

পাঁচ

সেই একেবারে প্রথম দিনের কথা মনে পড়ল। যেদিন অজিত কাকু এসেছিলেন সেই অদ্ভূত আর্জিটা নিয়ে আমাদের বাড়িতে । আমাদের পুরুলিয়ার বাড়িটা ছিল বাগমুন্ডি ব্লকে মুখোশ গ্রাম চড়িদার কাছাকাছি । আমাদের গ্রামেও মুখোশ বানানোর একটা চল আছে । গরিব মানুষজন , চাষাবাদ করে, মুখোশ বানায় । পাশের গ্রামে গিয়ে দোকান দেয়। পুরুলিয়ার মাটিতে যেমন রুক্ষতা আছে , তেমন আবার বসন্তের রাঙা মেঠো রাস্তায় দুধার রাঙানো পলাশ আছে। রুক্ষতার মধ্যেও প্রকৃতির আমেজ আছে । জঙ্গল আছে। শান্তি আছে । সবচেয়ে বড়ো কথা, সারা দিন-রাত ছুটে বেড়ানোর কোলাহল নেই । যারা প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠে , তাদের জীবন ধারার মধ্যে নিজস্ব কিছু জীবনমুখী শৈলীও গড়ে ওঠে । তারা আর ভবিষ্যতে ইঁট-কাঠ-পাথরের জঙ্গলে গিয়ে ভালো থাকতে পারে না, কখনোই না । আমাদের গ্রামের ছোট একটা প্রাইমারি স্কুলে আমি আমার শিক্ষাজীবন শুরু করি । তারপর জুনিয়র হাই স্কুলের পরে, ক্লাস নাইন থেকে এইচএস পর্যন্ত কাছাকাছি ছোট মফস্বল শহর বলরামপুরের স্কুলে পড়েছি । বাবা ছোট একটা প্রাইমারি স্কুলের টিচার ছিল । আমাদের গ্রামের বাড়ির কাছেই স্কুলটা । বাবা সামান্য একটা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষক হয়েও শিক্ষাদিক্ষা, জীবনের ছন্দ এবং তার বিভিন্ন দিকগুলো এত সুন্দর করে নিজের ভেতর পুষে রাখতে এবং তার প্রয়োগ করতে পেরেছিল, যা সত্যিই এক বিরল দৃষ্টান্ত। কথাবার্তা, আচার আচরন, জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, পোশাক-পরিচ্ছদ , সবই ছিল অদ্ভুত ধরনের শিষ্ট এবং শিক্ষনীয় । কিভাবে যে বাবা ছোটবেলা থেকে ঐরকম এক প্রত্যন্ত গ্রামে মানুষ হয়ে , মফস্বল থেকে পড়াশুনা করেও, এতখানি শিষ্ট এবং সৌম্য জীবন দর্শন গড়ে তুলতে পেরেছিল, তা যারা না বাবার সংস্পর্শে এসেছে তারা বিশ্বাস করতে পারবে না। অতি বড় শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও এত মার্জিত , শিক্ষিত কথাবার্তা এবং আচার-আচরণে তার প্রতিফলন পাওয়া যায় না। ফলে আমার মধ্যেও ছোটবেলা থেকে যে জীবনবোধ এবং শিক্ষা গড়ে উঠেছিল, তা বাবার কাছ থেকেই পাওয়া ।

গ্রামের দিকে তো বটেই, শহরের দিকেও আজও যে কোনো বাবা-মা সন্তান হওয়ার সময় পুত্রসন্তানই কামনা করেন । আমার জন্মের সাথে সাথে আমার এক যমজ দাদাও জন্মেছিল । কিন্তু গর্ভকালীন সময়ে মায়ের শরীরের কোনো এক বিশেষ সমস্যা জনিত কারণে একটি সন্তান বৃদ্ধির সময় কম পুস্টি পেয়েছিল। আমার সেখানে নরমাল গ্রোথ হয়েছিল। ফলে দু’জনের জন্ম প্রায় একই সময়ে, দাদার কিছুক্ষণ আগে এবং আমার কিছুক্ষণ পরে হলেও, জন্মের পরেই ডাক্তাররা জানিয়েছিল দাদার অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। হয়তো সে বেশিদিন নাও বাঁচতে পারে । ব্যাস্, আরম্ভ হলো বাড়ির প্রত্যেকের, আমার দাদু ঠাকুমা , মা-বাবা, প্রত্যেকের আমার দাদাকে নিয়ে লড়াই । বেশিরভাগ যত্নআত্তি সমস্তই দাদারই প্রাপ্য ছিল, স্বাভাবিক কারণেই। একে তো তার জীবনীশক্তি কম, তার ওপরে আবার পুত্রসন্তান। কিন্তু, এত যত্নআত্তি পরিচর্যাতেও দাদা এক বছরও বেঁচে থাকেনি। তার আগেই মারা যায়। সকলেই অসম্ভব দুঃখ পেয়েছিল । তবে , শুনেছি মা নাকি পুত্রসন্তান হারিয়ে প্রায় পাগলের মতো হয়ে গেছিল । ডাক্তার বলে দিয়েছিল , মায়ের রিপ্রোডাক্টিভ সিস্টেমে কিছু কম্প্লেক্সিটির কারণে আবারো সন্তান ধারণ সম্ভব নয় । মা এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে আমার দেখভাল প্রায় করতই না । সেই সময় থেকে আমাকে প্রায় কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে আমার বাবা । এত বছরের জীবনে তার ধ্যান জ্ঞান ছিল শুধু মেয়েকে মনের মতন করে মানুষ করা। পারেনি সে কথা আলাদা । আমি তো নিজের মনের মতন করেই মানুষ হতে পারিনি । তাহলে আর সন্তান হিসেবে বাবা-মায়ের মনের মতো কি করে হবো? তবে বাবার চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না । নিজের গ্রামের স্কুলের চাকরির জন্য অন্য কোথাও যেতে পারেনি। আমাকে ছোট বেলায় গ্রামের স্কুলেই পড়িয়েছে। তবে বাবার নিজস্ব যা শিক্ষা দীক্ষা সমস্ত আমাকে আপ্রাণ সারাটা জীবন ধরেই দেওয়ার চেষ্টা করেছে । তাই আমি যখন ক্লাস নাইনে বড়ো স্কুলে এসে ভর্তি হলাম, তখন বাবা, মাকে নিয়ে আমার স্কুলের কাছে একটা ছোট ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে আরম্ভ করেছিল । সেখান থেকে প্রতিদিন নিজে জার্নি করে যেত গ্রামের স্কুলে। আমি ছোট স্কুলে পড়তাম সে কথা ঠিক, তবে সেখানে প্রতিবছর ফার্স্ট হতাম। তারপরে এসে যখন বড় এইচএস স্কুলে ভর্তি হলাম, তখনও কিন্তু আমার পজিশনের কোন নড়চড় হলো না । সেখানেও আমি ফার্স্ট পজিশন ধরে রেখেছিলাম। ফলে, আমার এইচএস পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পরে বাবা দ্বিগুণ উৎসাহের সঙ্গে ভাবতে আরম্ভ করেছিল আমাকে ভালো কোনো কলেজে পড়িয়ে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করানোর কথা। কিন্তু আমি গ্রামের মেয়ে। আমার পক্ষে হঠাৎ করে পড়াশোনার জন্য শহরে বাড়ি ভাড়া করে একা থেকে পড়াশোনা করার ক্ষেত্রে রিস্ক ফ্যাক্টর প্রচুর ছিল। বিশেষ করে মা মেয়েকে একা রেখে কোথাও পড়াশোনা করানোর কথা ভাবতেই পারত না । যে কারণে বাবা আমার এইচএস রেজাল্ট বেরোনোর আগের সময়টাতে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল । সাইন্স নিয়ে পড়েছিলাম আমি এইচএস-এ । সাইন্স এর কোন একটা সাবজেক্টে অনার্স পড়ি , তারপর মাস্টার্স, এই ছিল বাবার ইচ্ছে । ইচ্ছে ছিল আমাকে কলকাতায় রেখে ভালো কোন কলেজ থেকে পড়ানোর । কিন্তু ছোট থেকে একেবারে গ্রামে বেড়ে ওঠা একটা মেয়ে কলকাতায় ওভাবে দুম করে বাড়ি ভাড়া করে থেকে সমস্ত কিছু আ্যডজাস্ট করে কলেজে পড়াশোনা করতে পারবে , এটা বাবাও বিশ্বাস করে উঠতে পারত না । ফলে খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিল ।

এমন সময়েই হঠাৎ করে ‘মেঘ না চাইতে জলে’র মত অজিত কাকুর সেই অদ্ভুত আর্জি নিয়ে আমাদের গ্রামের বাড়ীতে আগমন । বাবা আর অজিত কাকু দুজনে একেবারে ছেলেবেলার বন্ধু। হরিহর আত্মা । দুজনে একসাথে স্কুলে পড়াশোনা করেছে । অজিত কাকু’দের বাড়ির অবস্থা খুবই ভালো ছিল। বর্ধিষ্ণু পরিবার । সেকেন্ডারি লেভেল এর পড়াশোনা হয়ে যাওয়ার পরে অজিত কাকুকে তার বাড়ি থেকে কলকাতার স্কুলে ভর্তি করে। তারপর সেখান থেকেই কলেজ। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হতে অজিত কাকু ব্যবসা শুরু করেন । তাদের পরিবারের রক্তে ছিল ব্যবসা। কয়েক বছরের মধ্যেই ব্যবসায় কাকু বেশ উন্নতি করেন এবং লভ্যাংশ প্রচুর হয়। তা থেকেই অজিত কাকু ছোট একটা টি এস্টেট এর প্রপার্টি কিনে নেয় । নর্থ বেঙ্গলে। সেই প্রপার্টি তখন দশগুণ হয়েছে । বিশাল এরিয়া জুড়ে টী এস্টেট এর মালিক তখন অজিত কাকু। যদিও ম্যানেজার আছে, তবুও অজিত কাকু শুধু ম্যানেজারের ওপর ভরসা করে অত বড় ব্যবসা ফেলে রাখতেন না । কলকাতার সল্টলেকে বড় বাড়ি, তাছাড়াও ভবানীপুরের বিশাল বড় একটা অ্যাপার্টমেন্ট। সমস্ত কিছু থাকতেও অজিত কাকু তার ফ্যামিলি নিয়ে ওই চা বাগানের বাংলোতে থাকতেন । একটি ছেলে , একটি মেয়ে, আর স্ত্রী , এই নিয়ে ছোট সুখের সংসার । তবে ছেলেমেয়ের পড়াশোনার ক্ষেত্রে তিনি কোনো রকম আপোষ করেননি। নিজেও পড়াশুনা ভালোবাসতেন এবং কখনই চাইতেন না নিজে ব্যবসায় এসেছেন বলে ছেলে বা মেয়ে ব্যবসা করুক। তিনি সব সময় চাইতেন ছেলে মেয়ে দুজনেই যেন মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে এবং যত দূর যেতে পারে তারা যেন যায়। আমি যখন এইচএস দিয়েছি, তখন ওনার মেয়ে পড়ে ক্লাস এইটে। টিনেজ বয়েস, বছর চোদ্দো হবে । ছেলে বড়। ছেলের সঙ্গে মেয়ের বয়সের ডিফারেন্স অনেকটা, প্রায় বারো বছরের এজ ডিফারেন্স । ছেলে তাদের কাছে থাকেনা । পড়াশোনা করছে। রিসার্চ করছে সে তখন । ব্যাঙ্গালোরে থাকে । মেয়ে বান্টি, ভালো নাম শ্রীপর্ণা । সে বাবা-মায়ের সাথেই থাকে । নর্থ বেঙ্গলে তাদের যে বাংলোটা আছে সেখানে । সেখানে ভালো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশুনো করে । স্কুলটা শিলিগুড়িতে । তাদের নিজস্ব গাড়ি আছে। তাতেই প্রতিদিন যাতায়াত করে । শিলিগুড়ি সেখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে হলেও গাড়িতে ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় লাগে না।

সবেমাত্র এইচএস পরীক্ষা শেষ হয়েছে আমার। দিন পনেরো কুড়ি কবে । তখনও রেজাল্ট বের হতে দেরী আছে । অজিত কাকু একদিন সকালে আমাদের গ্রামের বাড়িতে এসে হাজির হন । কিছুক্ষণ পরে পাশের ঘর থেকে আমার ডাক পড়ল ।
— তরু মা ! একবার আসবি এখানে ? তোর অজিত কাকু তোকে ডাকছেন।
বাবার ঘরে গেলাম । সেটাই ছিল বাবার স্টাডি রুম , বৈঠকখানা । আবার গ্রামের কিছু ছাত্রছাত্রীকে বাবা বরাবর বিনা পারিশ্রমিকে পড়িয়ে এসেছে , যতদিন সেই গ্রামের বাড়িতে থাকত, তাদের পড়ার ঘরও সেটাই ছিল । বইতে পুরো ঘর ভর্তি। পুরোনো ঘর, চুনকাম ওঠা দেওয়াল। কিন্তু ঘরের ডেকোরেশন জুড়ে ছিল বিভিন্ন ধরনের বই । ঘরে ঢুকে দেখলাম, অজিত কাকুকে লাস্ট যবে দেখেছি তার থেকে আরো অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে চেহারায়। বিশেষ করে গেটআপে আদ্যোপান্ত সাহেবি ব্যাপার-স্যাপার । যেন কস্মিনকালেও কোনদিন ভেতো বাঙালি ঘরাণার সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিল না । অথচ বাবার কাছে এই অজিত কাকুর কত গল্পই শুনেছি । বন্ধুত্বের গল্প । এই সমস্ত জঙ্গলের মধ্যে খেলাধুলোর গল্প । গ্রামের বিভিন্ন ছোট বড় ঘটনা। বাবার কাছে সে সমস্ত গল্প শুনতে শুনতে আমার মনে হয় যেন সেই গল্পগুলোর অজিত কাকুই আসল , এখন যাকে দেখি সেটা মিথ্যা । লাস্ট দেখেছিলাম তারও চার পাঁচ বছর আগে । কাকু গ্রামে নিজের দেশের বাড়িতে প্রায় আসেনই না । শেষ দেখেছিলাম যবে , তার থেকেও অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেছেন। আমি গিয়ে কাকু, বাবা দুজনকেই প্রণাম করলাম ।

কাকু মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে আমার দিকে তাকিয়েই বাবার উদ্দেশ্যে বললেন , কিরে ভবো? তোর মেয়ে তো একেবারে বড় হয়ে গেল। চড়চড় করে বেড়ে গেছে তো ।
বাবা গর্বিত গলায় বলল , তা হবে না? কলেজে পড়বে এবার ।
— মেয়ে তো তোর পড়াশোনায় খুব ভালো। শুনেছি আমি।
বলে আমাকে বললেন, বোস মা এখানে । চেয়ারে বোস্ । তোর সঙ্গে কথা আছে দুটো ।
আমি পাশে রাখা একটা চেয়ারে বসে পড়লাম।
অজিত কাকু বাবাকে বললেন, হ্যাঁ আমি তো শুনেছি তোর মেয়ে খুব ভালো পড়াশোনা করছে । ওকে দেখে বোঝা যাচ্ছে । চোখ মুখ ব্রাইট । যা বলছি শোন, এখানে এইভাবে মফস্বলের কোনো জায়গায় শহরে নিয়ে গিয়ে ছোট কোনো কলেজে ভর্তি করিসনা । আর কলকাতায় ওভাবে ও একা একা থেকে পড়াশোনা করতে পারবে না । তোর চাকরি আছে । তুই বৌদির সঙ্গে গিয়ে থাকতেও পারবিনা । তোর মেয়ে কি আমার মেয়ে নয় ? তোর কি মনে হয় , ও আমাদের সঙ্গে আমাদের বাড়িতে গিয়ে কোনরকম অযত্নে থাকবে বা ওকে নিয়ে টেনশন করার মত তোর কিছু থাকবে? যা বলছি শোন, ওর দায়িত্ব আমার । আমি ওকে নিয়ে গিয়ে ওখানে শিলিগুড়ির সবচেয়ে ভালো কলেজে এডমিশন করিয়ে দেবো। আমার মেয়ের স্কুলও শিলিগুড়িতে। ও প্রতিদিন বাড়ির গাড়িতে যায় । তরুও আমার মেয়ের সঙ্গে একসঙ্গে থাকবে। গাড়িতে যাতায়াত করে কলেজ করবে। কোন অসুবিধা হবে না। তুই একদম চিন্তা করিসনা । নিশ্চিন্ত হয়ে ওকে তুই আমার দায়িত্বে ছেড়ে দে । আমার মেয়ে আমার কাছে যেমন, ও-ও ঠিক তেমনটা হয়ে থাকবে । ও যাতে হায়ার এডুকেশন ভালো রকম ভাবে পায় , সমস্তটা আমি দেখব ।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কি রে মা? তোর কোনো আপত্তি নেই তো ? আমার বাড়িতে গিয়ে থাকতে ?

সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব শুনে আমার বুকের মধ্যে উথাল পাথাল আরম্ভ হলো । আমি জন্ম থেকে কখনো বাবা-মাকে ছেড়ে থাকি নি। মাকে ছেড়ে থাকার কথা যদি বা ভাবতে পারি , বাবাকে ছাড়া আমার একটা দিনও চলে না । সেখানে সম্পূর্ণ বাবা-মায়ের চোখের আড়ালে কত দূরে, সেই নর্থ বেঙ্গলে গিয়ে থাকব? প্রায় অপরিচিত কিছু মানুষ জনের সঙ্গে ? অজিত কাকুকে সারাজীবনে বারকয়েক দেখেছি । তাছাড়া ওদের আর কাউকেই আমি চিনিনা । এদিকে সত্যিই ভালো কলেজ থেকে পড়াশোনা করার ইচ্ছেটাও প্রবল। সেটাও একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। আমি ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কিছুই বললাম না । বাবার মুখের দিকে তাকালাম । বাবার ভীষণ আত্মসম্মানবোধ । নিজের শিরদাঁড়ার ওপর জোর রেখে যতটুকু পারে, সেইটুকুই করে । কারোর কোনরকম সাহায্য নিয়ে তার মেয়ে পড়াশোনা করবে, এটা বাবার জন্য বড় লজ্জার । সেদিন সেই প্রস্তাবের কোন পজিটিভ উত্তর অজিত কাকু পেলেন না । না পেয়ে নিজের গ্রামের বাড়িতে সেদিনকার মতো ফিরে গেলেন । তবে সেবার কাকু নিজের কিছু প্রয়োজনে সম্পত্তি ঘটিত কোন ফয়সালার জন্য জ্ঞাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলার কারণে এসেছিলেন। তাই কিছুদিন সেখানে থাকার ব্যাপার ছিল । যে কদিন থাকলেন, প্রতিদিনই বাবার সাথে গল্প করতে আসতেন এবং ওই একই প্রস্তাব ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে উত্থাপন করতেন । এখানে কাকুর নিজস্ব একটা স্বার্থ ছিল । স্বার্থটা যদিও সংকীর্ণ কোন স্বার্থ নয় । ঠিক কি কারণে তিনি আমাকে ভীষণভাবে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন সেটা আমি পরে বুঝতে পেরেছিলাম । তবে একই কথা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে প্রতিদিন উত্থাপন করে করে অজিত কাকু বাবাকে এর পজিটিভ দিকগুলো খুব ভালো ভাবে বোঝাতে পেরেছিলেন । বাবা শেষমেষ রাজি হয়েছিল । কিন্তু সেই সঙ্গে আমার সেখানে থাকা, পড়াশোনা বাবদ যা কিছু খরচ হবে, সমস্তটাই বাবা দিতে চেয়েছিল। তাতে করে অজিত কাকু এতটাই অভিমান করেছিলেন যে , এত বছরের দুজনের বন্ধুত্ব প্রায় শেষ হতে বসেছিল । অগত্যা বাবাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে আমাকে নিজের মেয়ের মতো করে নিজের কাছে রেখে কলেজের পড়ানো ব্যাপারে বাবা-মা দুজনের কাছেই অনুমতি আদায় করে নিয়েছিলেন অজিত কাকু ।

আমার রেজাল্ট বেরোলো কিছুদিন পর । আমি স্টার না পেলেও, ভালোভাবে ফার্স্ট ডিভিসনএ এইচএস পাস করলাম । অজিত কাকু নিজে এসে আমাকে নিয়ে গেলেন। শিলিগুড়ির ভালো কলেজে ভর্তি করে দিলেন। বোটানি অনার্স নিলাম।

তারপর সে এক অদ্ভুত ধরনের অন্যরকম জীবন যাত্রা শুরু হলো আমার । অজিত কাকুর স্ত্রী ভামিনী কাকিমা ভীষণ স্ট্রিক্ট একজন মহিলা। তাঁর সংসারে সমস্ত কিছু মেপে মেপে চলে। কোন একটা জিনিসে হাত দিলে সেটা সেই জায়গাতেই আবার রাখতে হয় ।এক ইঞ্চি সরিয়ে রাখলেও বিপদ। সকাল সাতটায় ব্রেকফাস্ট। সাড়ে নটায় লাঞ্চ । ঠিক দশটা বাজতে দশে আমি আর বান্টি দুজনে গাড়িতে চেপে বসি, কলেজ আর স্কুলে যাওয়ার জন্য। সন্ধে ছটায় টি। সাড়ে নটায় ডিনার । এরপর যার যা পড়াশুনো বা কিছু কাজ বাকি আছে, সেরে নিয়ে স্ট্রিক্টলি রাত এগারোটার মধ্যে বাংলোর সমস্ত লাইট বন্ধ হয়ে যাবে। আর এই যে সময়গুলো, ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার , বা শুতে যাওয়ার সেই সময়ের কখনো দুমিনিট এদিক-ওদিক হয়না । পাক্কা ন’টা পঁচিশ মিনিটে রাত্রিবেলা আমাদের ডিনার টেবিলে হাজির থাকতে হতো। সাড়ে নটায় ডিনার সার্ভ হত । কুক খাবার সার্ভ করে দিত। সার্ভ করার সময় তাকে অ্যাপ্রন এবং ক্যাপ অবশ্যই পড়ে থাকতে হতো । একদিন সে ক্যাপ পরতে ভুলে গেছিল বলে কাকিমার সেকি বকুনি । প্রতিটা ক্ষেত্রেই এই রকম । কেউ একটু এদিক ওদিক করে ফেললে ঘোরতর বিপদ । শুধু সময়ের পাংটুয়ালিটি বলেই নয়, টাওয়েলটা আলনায় ঠিক কোথায় কিভাবে থাকবে, কতটা ঝুলবে ; বুক শেলফ থেকে বই নিলে তা কোথায় বসে কিভাবে পড়তে হবে, তারপর বইটা কিরকম ভাবে সেলফে আবার ঢুকিয়ে রাখতে হবে; বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে একটু চারপাশটা ঘুরতে বেড়োলে ঠিক কটার মধ্যে ফিরে আসতে হবে ; অজিত কাকু দিনে কতবার চা খাবেন; বান্টি সকালের ব্রেকফাস্ট এর সঙ্গে ঠিক কতটা ফ্রুটজুস খাবে ; বাথরুমে স্নান করতে গেলে কোন কোন কল বা শাওয়ার কিভাবে খুলতে হবে , কে কোন বাথরুমটা কখন ব্যবহার করবে ; সমস্তটাই ভীষণ ভাবে নির্দিষ্ট ছিল। আমার জন্য সম্পূর্ণ একটা আলাদা বাথরুমের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল । আমার বাথরুমে ভুলেও কখনো কাউকে ঢুকতে দেওয়া হতো না । সপ্তাহের কোন দিন কি কি ফুল কোন কোন ঘরের ফ্লাওয়ার ভাস এ কত ঘন্টা করে রাখা হবে , -এই সমস্ত কিছুই সেখানে নির্দিষ্ট । তার আর কোন নড়চড় হওয়ার উপায় নেই । যেন সবাই দম দেওয়া পুতুল । প্রত্যেকের দম দেওয়ার নভ অপারেট করছেন কাকিমা ।

একটা মেয়ে, যে পুরুলিয়ার গ্রামে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতো , খেলাধুলা করত, ছুটোছুটি করত, সমবয়সী বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে মিশতো, সম্পূর্ণ স্বাধীন একটা জীবনযাত্রা , সে এমন এক জায়গায় এসে পড়ল , যেখানে সারাদিনের মধ্যে এক মিনিটের স্বাধীনতা ভোগ করা যায় না । বাংলোয় যতক্ষন আছি। শুধু কলেজ আওয়ার্স টুকু একটু নিজের মত থাকা যায় । তাও আবার সম্পূর্ণ নতুন জায়গা, নতুন এনভারমেন্ট , নতুন কলেজ। তার ওপর আমি পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে । কথা , আচার আচরণের মধ্যে প্রচুর অসঙ্গতি প্রত্যেকের নজরে পড়তো। গ্রাম্য ভাব ।

ভামিনী কাকিমা তো আমার তেল মাখা জবজবে চুল , দুটো বিনুনি , কথা বলার পুরুলিয়া ঘেঁষা গ্রাম্য একটা টান , চলাফেরা, বসা, শোয়া , কোন কিছুর মধ্যেই কোন শিষ্টতা বা সফিস্টিকেশনের তিলমাত্র ছোঁয়া দেখতে পেতেন না । আমাকে মানুষ গোত্রের মধ্যে ফেলতেই তাঁর আপত্তি ছিল। অজিত কাকুর ওপর তিনি ভীষণ রকম ক্ষুব্ধ ছিলেন। কোথাকার একটা গেঁও ভূতকে এভাবে তাঁর সাজানো গোছানো সংসার, টিপটপ চোখ ধাঁধানো বাংলোর মধ্যে হঠাৎ করে এনে ফেলার জন্য । আমাকে নিয়ে তাঁর অভিযোগের কোন অন্ত ছিল না। ভীষণ রকম হীনমন্যতায় ভুগতে আরম্ভ করলাম । নিজেকে মানুষ বলেই মনে হতো না। কতখানি যে নিকৃষ্ট প্রাণী বলে মনে হতো নিজেকে, তা বলে বোঝাতে পারবো না । মনে হতো, আমি কিছুতেই ভদ্র সমাজের উপযুক্ত নই। কোন শিক্ষা-দীক্ষা শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ কিছুই আমার নেই। রাত্রিবেলা শুয়ে শুয়ে সেই হীনমন্যতার কারণে প্রতিদিন টুপ টুপ করে ঝরে পড়ত চোখের জল । বালিশ ভিজে যেত ।

কোথায় গেল সেই খোলা প্রান্তর ,স্বাধীনতার আকাশ, নিজের মনের মত ছুটে বেড়ানো, বাবা-মায়ের কাছে যখন যা খুশি আবদার…কোথায় গেলো বাবা মায়ের চোখের মণি করে রাখা সেই তরু । হারিয়ে গেল । একটা নতুন মেয়ে জন্ম নিল । যে সর্বক্ষণ ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে । অসম্ভব রকম হীনমন্যতায় ভোগে। একটা বাড়িতে রয়েছি , অথচ তার কোনো কিছুই নিজের নয় । যেকোনো জায়গায় হাত ছোঁয়াতে ভয় পেতাম । মনটা ঠিক যেন শামুকের খোলসের ভেতর ঢুকে সমস্ত দরজা-জানলা বন্ধ করে দিল নিজে থেকে। চারিদিকে অত সুন্দর পরিবেশ , চা বাগান , অথচ সে কোনো কিছুই আপন করে নেওয়ার মতো মনটা অবশিষ্ট রইল না । সে কেন্নোর মতো গুটিয়ে গেল । ঠিক খোলা আকাশের নিচে একটা পাখিকে দাঁড়ের ওপর শিকল বেঁধে রেখে দিলে যেমন হয় । চোখের সামনে খোলা আকাশ , অথচ উড়ে যাওয়ার উপায় নেই।

ক্রমশ..