হলদে প্রজাপতি পর্ব-৬+৭

0
201

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

ছয়

(পূর্বকথা : তরুশী একটি ছোট টি এস্টেট এর ম্যানেজার হয়ে নর্থ বেঙ্গল এ আসে। সে অবিবাহিত । অবিবাহিত একজন মহিলার চা বাগানের ম্যানেজার হয়ে আসা নিয়ে সেখানে অনেকেরই অনেক প্রশ্ন রয়েছে । বিশেষ করে ওই রকম ফাঁকা জায়গায় একটা বাংলায় একজন মহিলা হয়ে সে কি করে একা থাকবে? এস্টেটের লেবার’রাও মহিলা একজন ম্যানেজারকে পেয়ে খুশি নয় । তরুশীর চা-বাগানে প্রায় দেড় যুগ আগের অনেক স্মৃতি রয়েছে । সে এস্টেটের কাজকর্ম সামলানোর পাশাপাশি সেই সমস্ত স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকে। )

রায় ভিলা ।
অজিত কাকুদের বাংলোটা ছিল অসম্ভব সুন্দর। একেবারে ছবির মতো সাজানো । বাইরে এবং ভেতরে । দোতলা বাংলোর মধ্যে ঘর যে খুব বেশি ছিল তা নয় । গ্রাউন্ড ফ্লোরে ছ’টা , ফার্স্ট ফ্লোরে পাঁচটা । কিন্তু ঘরগুলোর আয়তন ছিল বিশাল বড় বড়। কিচেনই ছিল মিডিয়াম সাইজের একটা বেডরুমের মত । সেরকম চোখধাঁধানো টাইলস বসানো , আল্ট্রা মডার্ন সমস্ত গেজেটে ভর্তি । এমন অনেক গেজেট কিচেনে ছিল যা আমাদের দেশে তখনও তেমন চল হয়নি। আমি শুধু কিচেনের বাইরে থেকে পেরোনোর সময় ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখতাম । আমাদের কারোর কিচেনে ঢোকার পারমিশন ছিল না। আমার তো একেবারেই নয়। এছাড়া প্রত্যেকটা রুম, বেডরুম, ডাইনিং স্পেস , লিভিং রুম , টয়লেট ; ঘরের বিভিন্ন আসবাবপত্র, সবই একেবারে চোখ ধাঁধানো। এক একটা রুমের ভেতরে ঢুকলে মনে হবে যেন সেটা একটা শুটিং সেট । এত সুন্দর ওয়াল পেইন্টিং। তার সাথে কালার কনট্রাস্ট করা আসবাবপত্র । বাংলোর বাইরে বিস্তৃর্ণ বেশ অনেকখানি জায়গা জুড়ে সবুজ লন। বাংলো থেকে যে রাস্তাটা চলে গেছে গেট পর্যন্ত, তার দুপাশে বেড়া গাছ লাগানো। সেগুলো নিয়মিত মেনটেন করা হয় যে, তা বলাই বাহুল্য। বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছ। যাকে একটা ছোটখাটো নার্সারিও বলা চলে। তার সাথে পিছনের দিকে আমগাছ , ভালো ল্যাংড়া প্রজাতির, জাম ,কাঁঠাল , একটা দারচিনি গাছ, বিভিন্ন ধরনের শাক সবজির বাগান, এমনকি একটা চৌকোনা বাঁধানো পদ্মপুকুর পর্যন্ত ছিল। বাংলোর সামনে কিছুটা ডান পাশ ঘেঁষে ছিল একটা হার্ট সাইন এর মত করে বাঁধানো জলাশয়। সেটাতে এক ডজন রাজহাঁস জলকেলি করে বেড়াতো। বাংলোটাই ছিল একটা ঘুরে দেখার মত বস্তু। সমস্ত কিছু সেই আমি কাকিমার দেখভালে চলতো। পান থেকে চুন খসার উপায় নেই । বাড়িতে প্রায় ছ’ থেকে সাত জন কাজের লোক। বিভিন্ন খাতে। তারা প্রত্যেকে যন্ত্রের মত কাকিমার নির্দেশ অনুসারে কাজ করে যাচ্ছে ।

কাকিমা নিজেও দেখতে অপরুপ সুন্দরী । অজিত কাকু সঙ্গে ম্যাচিং একেবারেই ঠিকঠাক নয়। অজিত কাকু একজন নিতান্ত সাদামাটা দেখতে, রোগাটে, লম্বা চেহারার মানুষ । গায়ের রং কালো। মাথাতেও হালকা টাক আছে। অজিত কাকু কম বয়সেই ব্যবসায় অনেক উন্নতি করার জন্য ভামিনী কাকিমার সঙ্গে বিয়ে সম্ভব হয়েছিল । আ্যরেঞ্জড ম্যারেজ। শুনেছিলাম কাকিমা নাকি খুবই সাধারণ ঘরের মফস্বল এরিয়ার একজন মেয়ে ছিলেন । কিন্তু বিয়ের পরে তাঁর আমূল পরিবর্তন হয়ে যায় । রূপচর্চা, অ্যাটিটিউড, মেইনটেনেন্স কস্ট, শখ ,ডেকোরেটিভ আইডিয়া, নিয়মানুবর্তিতা, শুচিবাই, সবই অজিত কাকুর ব্যবসার লভ্যাংশের সঙ্গে চক্রবৃদ্ধি সুদ হারে বাড়তে থাকে। অতএব সেই বাংলোর মধ্যে সবকিছুই বেশ মানানসই । এক আমি ছাড়া । অজিত কাকুর চেহারাটা মানানসই ছিল না বটে। তবে ভামিনী কাকিমা সেটাকে আপাদমস্তক পালিশ করে বিদেশী মোড়কে ঢেকে বেশ কিছুটা মানানসই করে ফেলেছেন । মাঝখান থেকে কোথাকার একটা কোন গেঁও ভূত এসে সবকিছু মাটি করে দিল । প্রথম প্রথম তিনি আমার ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলতেন এবং অজিত কাকু ও মেয়ে বান্টিকে কিছুতেই আমার কাছাকাছি ঘেঁষতে দিতেন না। যেন আমার মধ্যে কোন একটা সংক্রামক রোগ রয়েছে। কাছে এলেই হয়ে যাবে । এমনটা কিছুদিন চলার পরে তাঁর মনে হলো, এভাবে চলতে পারে না। কারণ যতই যাই হোক, আমি তাঁর বাংলোয় রয়েছি , অর্থাৎ বাংলোরই একজন সদস্য । সেটা সকলেই জানে । সেই বাড়ি থেকেই বেরিয়ে কলেজে যাচ্ছি । অর্থাৎ আমার পরিচয় তখন তরুশ্রী ঘোষ নয় মোটেও , আমি তখন রায় ভিলার’ একজন সদস্য । অর্থাৎ আমাকে ওইভাবে গেঁও ভূতের মত থাকতে দেওয়া যেতে পারে না কিছুতেই ।

মাস দুয়েক কাটার পর ভামিনী কাকিমা আমাকে নিয়ে পড়লেন । যেভাবেই হোক , যতটুকু সম্ভব প্রেজেন্টেবল করে তুলতেই হবে আমাকে । যেখানে আমি তাঁর মেয়ে বান্টির সঙ্গেই এক গাড়িতে যাতায়াত করি । বান্টির চেহারা এবং গেটআপ দেখতে হয় । একবার দেখলে আর চোখ ফেরানো যায় না । কিশোরী সে তখনও। টিনেজ বয়েস। অথচ তখনই কি অসম্ভব সুন্দরী । পাতলা পাতলা গোলাপী ঠোঁট , যেন শিল্পীর হাতে আঁকা, মোম এর মত গায়ের রং , চাঁপা কলির মত আঙ্গুল । সত্যিই অজিত কাকু আর কাকিমার ভাগ্য আছে বলতে হবে । না হলে বান্টি তো কাকিমার মতো দেখতে না হয়ে অজিত কাকুর মতোও দেখতে হতে পারত। তখন কেমন হতো? কিন্তু হয়নি । ওর দাদা , জয়ন্তদাকে আমি দেখিনি। ইউনিভার্সিটির পরীক্ষার আগে মাসখানেকের যে ছুটিটা দেয়, তখন আমি বাড়ি চলে আসতাম । সেই সময় জয়ন্তদা ঘুরে গিয়েছিল । তাই আমার সঙ্গে আর তার দেখা হয়নি। কিন্তু শুনেছিলাম, সেও নাকি খুব সুন্দর দেখতে। পড়াশোনাতেও যেমন ভালো, দেখতেও তেমনি । সত্যি , কিছু কিছু মানুষের জীবনটা কত সুন্দর ! তেমনই পড়াশুনায় ভালো। এদের কথা ভাবলে হিংসা নয়, তবে সত্যি কথা বলতে কি, কষ্ট হয়। কষ্ট এই ভেবে হয়, আমি কি দোষ করেছিলাম? আমার জীবনটা কেন এরকম স্মুথ হলো না?

যাইহোক, মাস দুয়েক কাটার পর ভামিনী কাকিমা আমাকে নিয়ে পড়লেন। আমার গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা সমস্ত জামাকাপড় ফেলে দেওয়া হলো। আমার কোনো অনুমতি না নিয়েই। সেগুলো জাস্ট ডাস্টবিনে থ্রো করে দেওয়া হলো । আমার জন্য এলো নতুন জামা কাপড়ের সেট। ডজনখানেক । চুলে তেল মাখার ওপর সম্পূর্ণভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি হল। দুটো বিনুনি করা চলবে না । একটা বিনুনি করতে হবে বা পনিটেল। অল্টারনেট ডে’তে মাথায় শ্যাম্পু করতে হবে। মাথার চুল অত লম্বা রাখা চলবে না । লেন্থ কমিয়ে ফেলতে হবে । ঘাড়ের কিছুটা নিচ পর্যন্ত স্টেপ কাট করা থাকবে। বিউটি পার্লার থেকে হেয়ার এক্সপার্ট এসে আমার চুল কেটে দিয়ে গেল । চুলের বিনুনি বেশি না করাই ভালো, বিশেষ করে যখন বাইরে বেরোনো, তাতে করে বেশি রকমের গাঁইয়া লাগে । পনিটেল করতে হবে একটা । একটু আধটু স্পোকেন ইংলিশ জানতে হবে । বান্টি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়লেও তাকে বাড়িতে পড়াতে একজন স্পেশাল স্পোকেন ইংলিশের টিচার আসতেন । তার কাছে আমাকেও বসে কিছু কিছু স্পোকেন ইংলিশ শিখতে হবে । খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম দুটো মাস আমার ছাড় ছিল। আমি হাতে করে নিজের মতো করে মেখে খেতে পারতাম। কিন্তু তাতে করে ভামিনী কাকিমার অসুবিধা এই যে, বাড়িতে যখন গেষ্ট আসেন, তখন তার সামনে বসেও আমি ওইভাবেই হাতে করে খাই । একবার ওনার ভাই আর ভাইয়ের বউ এসেছিল বেড়াতে ।
ডিনার টেবিলে বসে আমাকে হাতে করে ফ্রাইড রাইস আর চিকেন মেখে খেতে দেখে নাক সিঁটকে কাকিমার ভাইয়ের বউ বলেছিল, সেকি গো দিদি ! এ কোথা থেকে এসেছে ?এভাবে তো তোমাদের বাড়িতে আগে কোনদিন কাউকে খেতে দেখিনি।
ভামিনী কাকিমার ভাইও কিন্তু খুব সাধারন একজন মফস্বল এরিয়ার ছেলে। সে নাকি অজিত কাকুর কাছ থেকেই বেশ ভারী কিছু টাকা ধার নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিল এবং পরে তাতে বেশ উন্নতিও করে । অনেকখানি বেশি বয়সে সুন্দরী বড়লোকের বাড়ির মেয়ে বিয়ে করে। সব মিলিয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। সাধারণ নিয়মে খাওয়া, তাতেও তাদের আপত্তি । ফলে এই ঘটনার পরেই আমার হাতে করে ভাত মেখে খাওয়া বন্ধ হল। ট্রেনিং চলতে লাগলো কিভাবে ফর্ক-নাইফ ব্যবহার করে খেতে হবে । খাওয়ার ক্ষেত্রে একটু যা নিজস্বতা বজায় ছিল , সেটুকুও গেল। যতটা পারতাম কম খেতাম। কাঁটাচামচ চালাতে কোনো ভাবে ভুল করে ফেললে সেও আবার আরেক বিপদ।

অজিত কাকু সবটাই দেখতেন, বুঝতেন যে আমার খুব অসুবিধা হচ্ছে । অথচ খুব একটা কিছু করে উঠতে পারতেন না। তিনি তাঁর স্ত্রীকে রীতিমত ভয় পেতেন। সেই সংসারে সকলেই পেত । ভামিনী কাকিমা চিৎকার-চেঁচামেচি অশান্তি করতেন না । কিন্তু হাবেভাবে এমন ভাবে মানুষকে ছোট প্রতিপন্ন করতেন যে , সেটাই সবচেয়ে খারাপ লাগতো। তার চেয়ে যদি চিৎকার করে দুটো কথা শোনাতেন, বকতেন , সেটা বরঞ্চ অনেক ভাল ছিল। কাকু আমার সঙ্গে খুব বেশিক্ষণ ধরে কথা বলতে পারতেন না । বললেও , খাবার টেবিলে টুকটাক। আলাদা করে আমার ঘরে এসে কথাবার্তা বলার কোন পারমিশন ছিল না । তবুও তিনি আমাকে ছেঁড়া ছেঁড়া কথার দ্বারা এটুকু বোঝাতে পেয়েছিলেন যে , কিছুদিন ধৈর্য্য ধরে থাকতে পারলে, আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে। আমি নিজের মতো করে যা বুঝেছিলাম তা হল , কাকু নিজেও বুঝতে পারেননি যে কাকিমা আমাকে নিয়ে অতখানি বাড়াবাড়ি আরম্ভ করে দেবেন। জানলে হয়তো তিনি আমাকে বাড়িতে নিয়ে এসে রাখার প্রস্তাব উত্থাপন করতেন না বাবার কাছে। কাকিমা বরাবরই যে সংসারটাকে কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে চালনা করেন সেটা কাকু জানতেন । কিন্তু, আমার জন্য সেটাই যে বিধিনিষেধের পর্যায়ে চলে যাবে এবং সেটা ঐরকম নির্মম, সেটা তিনি বুঝতে পারেন নি । কিন্তু তখন আর পিছিয়ে যাওয়ার কোনো রাস্তা ছিল না । আমার দমবন্ধ অবস্থাটা তিনি বুঝতে পারতেন । আমি মাঝেমধ্যে কাকুর কাছে গিয়ে, খুব সাবধানে যেতে হতো যাতে কোনোমতেই কাকিমার চোখে না পড়ে, গিয়ে এমনটাও বলেছিলাম, আমাকে যেন কাকু ওই কলেজ থেকে ছাড়িয়ে গ্রামের বাড়িতে রেখে দিয়ে আসেন । আমার এক বছর যায় যাক । আমি পরের বছর আবার ওখানকার কোন কলেজে ভর্তি হব । অজিত কাকুর ওপরে ভীষণ রাগ হতো, অভিমান হতো। কাকু আমাকে বোঝাতেন নানা রকম ভাবে । কিন্তু তাতে অবস্থার কিছু পরিবর্তন হতো না। আমি আস্তে আস্তে এও বুঝতে পেরেছিলাম, কাকু কেন আমাকে নিয়ে এসেছিলেন নিজের বাংলোয়। আমার ভালো চেয়ে তো বটেই , অজিত কাকু মানুষটা ভালো । সত্যিই ভালো । তবে সেখানে নিজেরও একটা ক্ষুদ্র স্বার্থ ছিল। সেটা হল ,কাকুর মেয়ে বান্টি ওই দমবন্ধ পরিবেশে থাকতে-থাকতে মানসিকভাবে বিকশিত হওয়ার কোন সুযোগ পেত না । কোন স্বাধীনতা নেই । যেখানে মেপে মেপে হাঁটাচলা করতে হয় , সেখানে মানসিক বিকাশের সম্ভাবনা থাকে না । এইরকম দমবন্ধ পরিবেশে যেকোনো কারোর পক্ষেই থাকাটা খুব কষ্টের । বান্টি যাতে অন্তত গল্প করার জন্য , ঘুরে বেড়ানোর জন্য , একটা দিদির মত বন্ধু পায়, সেই জন্য কাকু আমাকে নিজের বাংলোয় রেখে পড়াশোনা করাতে চেয়েছিলেন । বান্টির তাতে কতখানি লাভ হয়েছিল আমার জানা নেই , তবে আমার খুবই ক্ষতি হয়েছিল । অবশ্য সমস্তকিছুই আপেক্ষিক । সত্যি করে ভেবে দেখতে গেলে , ভামিনী কাকিমা তখন ঠিক যা যা ট্রিটমেন্ট করেছিলেন আমার সঙ্গে, সেটা তখনকার জন্য দমবন্ধকর লাগলেও, ভবিষ্যতে নিজের গেটআপের, আচার-ব্যবহারের, কথাবার্তার, সেই পরিবর্তনটা কাজে লেগেছিল আমার। কাকিমা আমার কথাবার্তার ওপরেও পাহারা বসানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। যখনই কোন বাংলা শব্দের গ্রাম্যতা ঘেঁষা ভুল উচ্চারণ করতাম, উনি সঙ্গে সঙ্গে সেটা সংশোধন করতেন এবং একই ভুল আবার করলে সেটাও কম বিপদের ছিল না। তার সাথে প্রথম প্রথম স্পোকেন ইংলিশ শেখাটা আমার পক্ষে খুবই দুরূহ এবং লজ্জাকর হলেও, পরবর্তীতে সেটাও কাজে লেগেছিল । লজ্জাকর এই কারণে ছিল, বান্টি আমার থেকে অনেকটা ছোট হয়েও বিশুদ্ধ ইংরেজি গড় গড় করে বলে যেত। সেখানে আমাকে একটা শক্ত ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ করতে হলেও হোঁচট খেতে হতো। খুবই সিঁটিয়ে থাকতাম। কিন্তু তবুও কিছু করার নেই । কড়া নির্দেশ । মিনিমাম কাজ চালানোর মত স্পোকেন ইংলিশ শিখতে আমায় হবেই। শুধু বাংলা বললে সেটা নাকি খুবই লজ্জার ।

ওই দমবন্ধ পরিবেশের মধ্যে আমার শুধু দুটো ভালোলাগার জায়গা ছিল । এক নম্বর হলো , বান্টি আমার খুবই ন্যাওটা হয়েছিল । ছেলেমানুষ সে তখন । অত সব কম্প্লেক্সিটি তার মাথায় ঢুকতো না । সে তার জেনারেশনের কিছুটা বড় একজন দিদির মত মানুষকে পেয়ে খুবই খুশি হয়েছিল । সে সব সময় আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকতে চাইতো । কিন্তু সে অনুমতি ছিল না । ফলে, মাঝে মাঝেই লুকিয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখে নিত মা ধারেপাশে কোথাও আছে কিনা, না থাকলে পা টিপে টিপে চলে আসতো আমার ঘরে । আমার ঘরটা ছিল দোতলার পূর্ব দিকের কোণের ঘর । বান্টির ঘরটা দোতলার দক্ষিণ দিকে । বান্টি প্রতিদিন সন্ধ্যে বা রাত্রিবেলা একবার করে চলেই আসতো আমার সঙ্গে গল্প করতে । মাঝে মাঝে আবার এক আধদিন লুকিয়ে লুকিয়ে আমার ঘরে রাত্রিবেলা শুতেও চলে আসতো। সেই দিনগুলোতে দুজনে মিলে খুব গল্প করতাম । শুধুমাত্র ওই একটা মানুষই সেখানে আমার সঙ্গে খুব আন্তরিক ভাবে মিশতো । যেন সত্যিই সে আমার ছোট বোন । আমরা দুজনে স্কুল আর কলেজ থেকে ফিরে আসার পর একটুখানি ঘুরতে বের হতাম। মাঝে মাঝে আবার গাড়িতে করে একটু দূরে কোথাও যেতাম । এই লীস্ নদীর পাড়েই এসেছি কতবার । সেই সময়টা যদিও সারা দিনের মধ্যে ঘণ্টাখানেকের বেশি ছিল না। তবুও আমার সবচেয়ে ভালো লাগার সময় ছিল সেই সময়টা। বান্টি আমার সঙ্গে কত কিছু গল্প করতো। খোলা মনে আমিও কত গল্প করতাম । আমাদের গ্রামের গল্প, স্কুলের গল্প, বন্ধু-বান্ধবদের গল্প, বান্টি হাঁ করে শুনতো ।

দ্বিতীয় ভাললাগার জায়গাটা ছিল – আমরা, মানে আমি, বান্টি আর অজিত কাকু, তিনজনে মিলে উইকেন্ডে মাঝেমধ্যেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতাম । সারাদিনের মতন। মাসের মধ্যে একবার কি দুবার ছুটির দিন দেখে এটা হতো । সেই একটা দিন অনেকটা সময় প্রকৃতির মাঝে খুবই ভালো লাগতো । যেন নিঃশ্বাস নিয়েও শান্তি । কখনো কখনো আবার কাকু জঙ্গল সাফারির ব্যবস্থা করতেন। তাও করতাম ।

এরই মধ্যে কয়েকটা ঘটনা আমার মনের মধ্যে ভীষণ রকম প্রভাব ফেলেছিল । যেমন একদিন নদীর ধারে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ দেখতে পেলাম একটা বাঁশপাতি পাখি ডানায় চোট পেয়ে পাথরের খাঁজে এসে পড়েছে । উড়তে পারছেনা বহু চেষ্টাতেও । দেখে খুব কষ্ট হয়েছিল । পাখিটাকে দুই হাতের মধ্যে তুলে নিয়ে বাংলোয় ফিরে এসেছিলাম। সেদিন দেখেছিলাম ভামিনী কাকিমার রুদ্রমূর্তি। চিৎকার-চেঁচামেচি অবশ্য কিছুই করেননি ।
আমার দুই হাতের তালুর মধ্যে ধরা পাখিটার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে আমার দিকে তাকিয়ে শুধু বাঁ হাতটা তুলে আঙ্গুল দিয়ে বাইরের দিকে দেখিয়ে বলেছিলেন, পাখিটাকে বাইরে ফেলে আসবে । ওই সমস্ত নোংরা জিনিস আমি ঘরের মধ্যে ঢোকাই না ।
আমার দুচোখ ভরে জল আসার উপক্রম । এসে থেকে কখনো কাকিমার মুখের ওপর কোনো কথা বলিনি । সেদিনও বললাম না। তবে কাকুতি-মিনতি করে অনুরোধ করলাম, কাকিমা পাখিটাকে ঘরে রাখতে দিন না । আমি আমার ঘরে নিয়ে গিয়ে ঝুড়ি বা সেরকম কিছু চাপা দিয়ে রাখবো । তলায় কাগজ পেতে দেব। কিছু নোংরা হবে না । যদি কিছু হয় , আমি সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার করে দেবো। পাখিটাকে বাইরে ফেলে এলে এখনই বিড়ালে কুকুরে খেয়ে নেবে ।
আমার মুখে এতগুলো কথা শুনে কাকিমার দুটো চোখ আর মুখ রাগে লাল টকটকে হয়ে উঠলো। নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে । সে কি মূর্তি! আমি সেই মূর্তির দিকে তাকিয়ে ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম ।
কাকিমা বললেন , এই যে এত টিপটপ করে সাজিয়ে গুছিয়ে বাংলোটাকে রাখার জন্য প্রচুর মাথা খাটাতে হয় । এই সমস্ত পাখি, জীবজন্তু, আমি ঘরে তুলি না। বাড়ি এটা, চিড়িয়াখানা নয় ।
আমি পাখিটাকে হাতের মধ্যে ধরে কাঠের মত দাঁড়িয়ে রইলাম । দুচোখ বেয়ে জল পড়তে লাগলো ।
আমি কোনরকম নড়াচড়া করছি না দেখে কাকিমা ঠান্ডা গলায় ইস্পাতকঠিন স্বরে বললেন , পাখিটাকে বাইরে ফেলে এস। ওটাকে নিয়ে তুমি ঘরের ভেতরে ঢুকতে পাবে না।
মুখ নিচু করে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে পাখিটাকে গেটের বাইরে ফেলে , ফিরে এলাম নিজের ঘরে । সারাটা সন্ধ্যে সেদিন কেঁদেছিলাম । দুচোখ কেঁদে কেঁদে লাল হয়ে ফুলে গেছিল। পরের দিন ভোরবেলা বেরিয়ে গিয়ে দেখতে চেষ্টা করেছিলাম পাখিটা রয়েছে কিনা । দেখেছিলাম কয়েকটা সবুজ পালক পড়ে রয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে । এক আধ ফোঁটা রক্ত ! অসম্ভব কষ্ট পেয়েছিলাম আমি ঘটনাটায়। পরের দু-তিনদিন ভালো করে খেতে পারিনি । সর্বক্ষণ কান্না পেত। ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতাম, এমন কিছু একটা ম্যাজিক করতে , যাতে , হয় আমি সেখান থেকে ফিরে যেতে পারি। আর নয় তো , সেখানে থাকলেও যেন আমার মন ভাল করার মত কিছু একটা ঘটে যায় । কলেজ ছেড়ে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত শুধু বাবার জন্য নিতে পারতাম না । কোন মুখে ফিরে যাব ? আবার বাবাকে অশান্তি দেবো, নতুন কলেজে পরের বছর আমাকে ভর্তি করানোর জন্য? বাবা কত গর্বের সঙ্গে সকলকে জানিয়েছে, ভবেশ ঘোষের মেয়ে ভালো কলেজে পড়াশোনা করতে গেছে । সেখান থেকে ফিরে যাব ? বাবার মাথাটা নিচু করবো সকলের সামনে? তাই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম না ।

এইরকম একটা মানসিক টালমাটাল সময়ে হঠাৎ করে সত্যি ঈশ্বর আমার জীবনে একটা ম্যাজিক করলেন । একজন ম্যাজিকাল মানুষ এল। প্রেম এলো আমার জীবনে । প্রেম আশেপাশের অনেক দুঃখ , যন্ত্রণা , ভুলিয়ে দিয়ে , নিজস্ব কিছু চাওয়া-পাওয়া, হাসি-কান্নার ভার চাপিয়ে দেয় । মনে হয় যেন অন্য জগতে চলে গেছি। কিছুই আর আগের মত নেই । নেশা ! ভালবাসার নেশা মানুষকে বিভোর করে দেয়। সেই ভালোবাসা এলো আমার জীবনে ।

একদিন সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে শুনলাম কাকু আর কাকিমা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন ,
— কালকে রাতে তো জয় ফোন করে ফাইনালি জানিয়ে দিয়েছে আজকেই শৌণক এসে পড়বে । ওর থাকার ব্যবস্থা তাহলে ওই ম্যানেজারের বাংলোতেই করেছ তো ?
কাকিমা উত্তর দিলেন, এখনো ব্যবস্থা কিছু করা হয়নি । কনফার্ম কিছু জানায়নি বলে । কালকে রাতে তো সবে কনফার্ম করলো । এবার ব্যবস্থা করব ।

………………………………………………

— .. দিদি.. ! দিদিমণি..! দিদি…
হঠাৎ করে হুঁশ ফিরলো। ঘাড় তুলে তাকিয়ে দেখলাম জগন্নাথ একদম কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ।
বলল, দূর থেকে ডাকছিলাম , আপনি শুনতে পাননি ।

আমি যেন তেপান্তরের মাঠ থেকে ফিরে এলাম বর্তমান সময়ে ।
বললাম , হ্যাঁ বলো কি বলছিলে ।
— একদম তো সন্ধ্যা হয়ে গেল । ফিরবেন কখন ?
মুখ ফিরিয়ে আমি পশ্চিম আকাশে চোখ রাখলাম। দেখলাম , সূর্য ডুবেছে। সন্ধ্যারাগ ছড়িয়ে পড়েছে আকাশের গা’য় । নদীর চিকচিকে জলের ওপর । কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে খেয়ালই করিনি । এখন খেয়াল পড়তে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ালাম ।
— সেইতো, বসে থাকতে থাকতে লক্ষই করিনি। ঝুপ করে কখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। চলো , চলো এক্ষুনি ফিরতে হবে বাংলোয়..

ক্রমশ..

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

সাতার

(পূর্বকথা : তরুশী একটি ছোট টি এস্টেট এর ম্যানেজার হয়ে নর্থ বেঙ্গল এ আসে । সে অবিবাহিতা । অবিবাহিত একজন মহিলার চা বাগানের ম্যানেজার হয়ে আসা নিয়ে সেখানে অনেকেরই অনেক প্রশ্ন রয়েছে । বিশেষ করে ওই রকম ফাঁকা জায়গায় একটা বাংলায় একজন মহিলা হয়ে সে কি করে একা থাকবে? এস্টেটের লেবার’রাও মহিলা একজন ম্যানেজারকে পেয়ে খুশি নয় । তরুশীর চা-বাগানে প্রায় দেড় যুগ আগের অনেক স্মৃতি রয়েছে । সে এস্টেটের কাজকর্ম সামলানোর পাশাপাশি সেই সমস্ত স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকে। )

হারানদা সেদিন সকালে বাংলোর সামনের দিকের ফুল গাছগুলোর গোড়ার মাটি আলগা করে দিচ্ছিল । টগর চা দিয়ে গেল দু’কাপ। আমারটা সাদা, হারান দা’রটা কালো। সারাদিনে আর যত বারই চা খাই, দু তিনবার তো হয়েই যায় , অফিস টাইমে এক বা দু’বার, বাড়িতে ফিরে এসে সন্ধ্যাবেলা একবার, প্রতিবারই র’চা খেলেও , সকাল বেলায় চা’টা বেশ ঘন করে দুধ দিয়ে না হলে আমার চলে না । হারানদা চা খেতে চাইত না । আমিই ওকে সকাল বেলায় চা ধরিয়েছি । তবে র’চা খায় । বাগানের ট্যাপ কলে হাত ধুয়ে এসে হারানদা উবু হয়ে আমার সামনে মাটিতে বসে পড়লো । আমাদের দুজনের সকালের চা খাওয়ার ব্যবস্থাটা এই লনেই করা হয়। দুটো চেয়ার , একটা বেতের টুল ।
— আরে ! আরে ! কি করছো ! এই তো চেয়ার রাখা রয়েছে পাশে । মাটিতে বসলে কেন ?
— আর দিদিমুনি , মাটিতেই আমাদের কাজ । এই মাটির ‘বাস যে কি ভালো লাগে, তা আপনারা বুঝবেন না ।
— বোঝালে বুঝবো বৈকি ! বুঝবো না কেন ?
চায়ের কাপটা তার হাতে ধরিয়ে দিলাম। বিস্কুটের ডিশটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, হারানদা দুটো নাও ।
হারানদা দুটো বিস্কুট তুলে নিয়ে চায়ে ডুবিয়ে এক কামড় দিল ।
আমিও চায়ের কাপে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে বললাম , হ্যাঁ হারানদা, বলো-
হারানদা বিস্কুট চিবোতে চিবোতে বলল, এই মাটির বুকেই জম্মেছি । কত ধুলো-মাটি-কাদা মেখে হেলেদুলে বড়টা হয়েচি । আজকে যে এই বুড়োটা হয়েচি, সেও তো সেই মাটি কুপায়ে । মাটি ঠিকঠাক না রাখলে কি আর গাছ হয় দিদিমুণি?
বললাম, নতুন কিছু গাছ এনে লাগাবে নাকি হারানদা?
— তা লাগাবো বৈকি। এই এখানে বর্ষার মৌসুমে কত পেঁয়াজ ফুল ফুটবে দেকবেন না। একেবারে ঝকঝকে ।
— পেঁয়াজ ফুল মানে কি তুমি রেন লিলির কথা বলছো?
— আমি অতো সব ইংরিজি-টিংরিজি নাম জানিনা বাপু। ফুল-ফল ভালোবাসি। গাছ সব চিনি । আমাদের বাংলা নাম না কেন? বাংলা নাম কম কিসে? সব সময় এত ইংরিজি কপচানো কিসের ?
হেসে বললাম , যস্মিন দেশে যদাচার। তুমি এদিকে তাও বাংলা নাম বললে সবাই বুঝবে হারানদা । কলকাতার দিকে বেশিরভাগ সবাই এই ইংরেজি নামগুলোই জানে যে। তা এখানে কোন কালারের রেন লিলি লাগাবে শুনি ?
— গোলাপি, গোলাপি হয় না যেটা ? সেইটা বড় সুন্দর । লাগাবো দেখবেন না, কেমন গোটা মাঠটা ভর্তি হয়ে গোলাপি গোলাপি ফুল ফোটে।
— হুঁ, জ্যাফাইরানথিস রোজিয়া। পিঙ্ক রেন লিলি। বড় সুন্দর ফুল। খুব প্রিয় ফুল আমার ।
শেষের দিকের কথাগুলো যেন স্বগোতক্তির মত বললাম। মনে পড়ে গেল সেই কলেজে পড়ার সময়ের কথা । একজন , সেই ‘সে’জন দিয়েছিল একটা পিংক রেন লিলি । বড় ভালোবেসে বুকে করে রেখেছিলাম ।

হারানদা বলল , কাল রাতে বিষ্টি হয়েচে। গাছগুনোর সব ডালপালা পাতায় বিষ্টির জল পেয়েচে দেখলে বড় আনন্দ পাই দিদিমুণি । গাছগুনোর কত্ত আরাম হয় বলুন দিকিন। ওরা নাইতে পায় । আরাম পায়। খুশি হয়ে ওঠে । আমিতো মোটে ওদের গোড়াতেই জল দিই কিনা ? মোটে গোড়ায় জল পেয়ে কি হয় ? জল যে ওদের খাবার । সেই খাবার টুকুন পায়। নাইতে পায় তো ওরা বিষ্টি হলে। ভগবান জল ঢালেন আকাশ থেকে । ওরা নেয়ে নেয় ।
— ওরা যে আনন্দ পায়, তা তুমি বোঝো হারানদা ?

মানুষটার এই কথাগুলো বড় ভালো লাগলো । উনি অনুভব করেন শুধু গাছের যে প্রাণ আছে তাই নয়, গাছের অনুভূতি , ভালোলাগা-মন্দলাগা, আবেগ , সবকিছু মিলিয়ে গাছগুলো যেন এক একটা মানুষ !

হারানদা বলল , দিদিমুণি বুঝতে পারি বৈকি। ছোট ছোট গাছগুনোয় ঝাড়ি দিয়ে জল আমি দিয়ে দিই । কিন্তু বড় বড় গাছের ডাল পাতায় কি আর হাত পাই মোটে ? এই বিষ্টির জলে নেয়ে নেয় ওরা। পাতাগুলো কেমন ধারা ঝকঝক্ করে । ফুলের পাপড়িতে জল জমে থাকে শিশিরের মতো । ওরা ভারি খুশি হয়ে যায়। আমি দেখতে পাই তো।
নরম হাসি হেসে তাকালাম হারান’দার দিকে। কত বড় মনের মানুষ না হলে এমন ভাবে গাছেদের ভালোবাসা যায় , অনুভব করা যায়। সমাজ স্ট্যাটাসের একটা ডিফারেন্স রেখেছে তাই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে পারলাম না । মনে মনে প্রণাম জানালাম হারান’দাকে ।

— গুড মর্নিং ম্যাডাম ।
ঘাড় তুলে তাকিয়ে দেখি শিশির এসেছে। শিশির ছেলেটি একেবারে ধোপদুরস্ত হিট বাবুটি। সবসময় ফিটফাট হয়ে থাকে । মাথায় হালকা কোঁকড়ানো চুল । বাঁদিকে সিঁথি করে পেতে আঁচড়ানো । গায়ের রং ফর্সা । না রোগা , না মোটা দোহারা চেহারা । চামড়ায় বেশ একটা চকচকে ভাব আছে । ক্লিন শেভড। বেশিরভাগই সাদা বা হালকা রঙের শার্ট পরতে পছন্দ করে । কথাবার্তা বেশ মার্জিত । আমার থেকে হয়তো বছর দুই তিনেকের ছোট হবে ।
–আরে গুড মর্নিং, শিশির । বোসো বোসো। টগর-
একটু গলা তুলে ডেকে বললাম , আর একটা চা দিয়ে যাও।
— যাই মেম।
বলার সঙ্গে সঙ্গে সে একেবারে কান পর্যন্ত হেসে এসে হাজির হলো । বলল, ওমা ! শিশিরবাবু এয়েচেন । তাইলে , আর এক কাপ দুধ চা করে আনি মেম?
— হ্যাঁ আনো।
শিশিরের দিকে তাকিয়ে বললাম, কি? কি চলবে বলো? সাদা না লাল?
— ম্যাডাম , আবার চা-টা কি দরকার?
— সে আবার কি ? আমার আর হারান’দার তো খাওয়া হয়ে গেল । গল্প করতে করতে দুজনে মিলে খেয়ে নিয়েছি । আর একটু আগে এলে তিনজনে এক সঙ্গে গল্প করতে করতে খেতাম। তবে সকাল বেলায় তো কখনই এই সময়ে আসো না এদিকে। নিজের ঘরে বসেই যা পারো করে নাও । আজকে এসেছ যখন, এক কাপ চা, দুটো বিস্কুট খাও।
— আচ্ছা ম্যাডাম, দুধ চা’ই বলে দিন তবে।
— টগর, তাহলে একটা দুধ চা’ই করে আনো।
— আচ্ছা মেম ।
একটা লাজুক লাজুক হাসি ফুটে উঠল টগরের মুখে । চায়ের খালি কাপগুলো নিয়ে সে চলে গেল।
আমি শিশির’এর দিকে ফিরে বললাম, বোসো।
সে বসল চেয়ারে ।
বললাম, তারপর বলো । কাজকর্ম সব ঠিকঠাক চলছে তো? আজকে কিন্তু একমাসের রিপোর্ট’টা পাঠাতে হবে হেড অফিসে । ওখানে যে পয়েন্টগুলো তোমাকে বলেছিলাম সেগুলো আ্যড করে দিয়ে আজকে আমাকে ফরোয়ার্ড করে দিও। আমি সেন্ড করে দেব ।
— হ্যাঁ ম্যাডাম হয়ে গেছে । আমি আজকে ফার্স্ট আওয়ারেই আপনাকে সেন্ড করে দেব ওটা ।
— গুড । দেখতে দেখতে এক মাস হয়ে গেল , ভাবা যায় ! এই সেদিন এলাম । কোথা দিয়ে যে একটা মাস কেটে গেল বুঝতেই পারিনি ।
— কাজের মধ্যে রয়েছেন ম্যাডাম । তা ছাড়া বাকি সময় এইসব চা গাছের বাগানে চোখ বোলাতে বোলাতেই কেটে যায় । কি বলেন ? কি ভালো জায়গা ।
— তা বটে । ইঁট-কাঠ-পাথরের জঙ্গলে বসে বসে কাজ সামলানোর থেকে সবুজের প্রকৃতির মাঝে বসে সামলানো অনেক সহজ । আচ্ছা শিশির, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করা হয়নি ।
— বলুন ম্যাডাম ।
— তুমি কি আগের ম্যানেজারের সময়ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলে?
— না ম্যাডাম । আমার এই টি এস্টেট এর কাজ এই প্রথম। আগে অন্য টি এস্টেটে কাজ করেছি। আমার এই আপনি জয়েন করার দুদিন আগে জয়েনিং। তারপরে আমি বিশেষ একটা প্রয়োজনে বাড়ি গেছিলাম একটা সপ্তাহের জন্য।
— ও তাহলে তো তুমি বলতে পারবে না ।
— কিসের কথা বলছেন ম্যাডাম ?
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। ভাবলাম , কথাটা কি শিশিরকে বলা উচিত হবে?
শিশির আবার বলল, বলুন ম্যাডাম। কি বলছেন।
আমি আনমনে বেতের টুলটার ওপর ভাঁজ করে রাখা আজকের নিউজ পেপারটা তুলে নিয়ে চোখ বুলোতে বুলোতে বললাম, তোমার এখানে ঘরে একা সব কাজকর্ম সামলাতে অসুবিধা হচ্ছে না তো?
— না না , অসুবিধা কিসের? আমি তো এর আগেও এরকম কাজ করেছি ।
কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে বললাম, ফ্যামিলি ম্যান তো নাকি ? বউ আছে?
ঘাড় কাত করে শিশির বলল, তা আছে ম্যাডাম ।
— বাঃ, ছেলে মেয়ে?
— একটি মেয়ে, চার বছরের।
— সেইতো , এখানে তো তাদের নিয়ে আসা তোমার পক্ষে অসুবিধাজনক । এখন তো সব বাচ্চারা হাঁটতে শিখেই স্কুলে ভর্তি হয়ে যায় ।
একটু হেসে শিশির বলল, তাইনা বটে। না ওদেরকে এখানে নিয়ে আসার অসুবিধে।
— তোমার বাড়ি কোথায়?
— শিলিগুড়িতে ।
টগর চা নিয়ে হাজির হল । টেবিলের ওপর চায়ের কাপ ডিশ নামিয়ে রেখে বলল, দেকে নিন বাবু, মোটা দুধ দিই করিচি।
সে আড়চোখে তাকালো শিশিরের দিকে।
আমি বললাম, হ্যাঁ খেয়ে দেখো । টগরের হাতের চা খেলে কিন্তু প্রতিদিন সকালে তোমাকে এদিকে চলে আসতে হবে।
বলে হাসলাম ।
শিশির চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে বলল, তাই নাকি? দেখি তবে-
ও চায়ের কাপে চুমুক দিল । আমি খবরের পাতায় চোখ রাখলাম। কিছুক্ষণ পর কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে শেষমেষ মনে যে প্রশ্নটা ছিল সেটা করেই ফেললাম । বললাম,
— আচ্ছা, এই সমস্ত লেবাররা চা-বাগানের, এদের সঙ্গে আমি কথাবার্তা বলে ফ্রী হওয়ার চেষ্টা করে দেখেছি । কিন্তু এরা আমার সাথে কিছুতেই ফ্রি মনে কথা বলতে চায় না । বোধহয় মহিলা ম্যানেজার বলে আজব কোন একটা প্রাণী ভাবে । অথচ আগের ম্যানেজার চলে যাওয়ায় যে এরা খুশি হয়েছে সেটা বুঝতে পারি।

শিশির আমার কথার মাঝখানেই বলে উঠলো , ম্যাডাম এদের সঙ্গে বেশি মেশামেশি করতে যাবেন না । প্রভু-ভৃত্যের মধ্যে একটা ডিসটেন্স থাকাই ভালো । আপনার কাজ তো এদের কাজ করিয়ে নেওয়া ।

— তোমার এই পয়েন্টটা আমি মানতে পারলাম না শিশির । আর প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক কিসের ? সত্যি কথা বলতে কি, আমিই বলো, কিংবা চা বাগানের শ্রমিকরা , সকলেই সেই বাগানের মালিকের এমপ্লয়ী । তাই তো ? ঠিক কিনা ? কিছু ভুল বললাম কি ?
— ওদের কাছে আপনিই মালিক। আসল মালিককে ওরা চোখেও দেখেনা, জানেও না । ওদের যে কাজ করায়, সে’ই ওদের কাছে মালিক ।
— সে যাই হোক , এই সমস্ত তর্কে না গিয়েই বলছি , আমি ওদের সাথে মেলামেশা করলে ক্ষতি কি ? আমার তো মনে হয় তাতে করে ওদের আমাকে একসেপ্ট করে নিতে সুবিধা হবে ।
— ম্যাডাম আপনি যত ওদের সঙ্গে মিশবেন ততো ওরা বিভিন্ন আর্জি জানাবে আপনাকে । সেগুলো আপনি ফুলফিল করতে পারবেন না স্বাভাবিকভাবেই । প্রথমেই মাইনে বাড়াতে বলবে। কিন্তু মাইনে বাড়ানো তো আর আপনার হাতে নেই ম্যাডাম । সেই জন্যই বলছি, ওদের শুধু টুক করে কম্যান্ডটা দিয়ে দিন । ব্যাস্, মেলামেশা না করাই ভালো ।
এই ব্যাপারে শিশিরের সঙ্গে আর কথা বাড়ালাম না আমি । কথা শুনে মনে হল যেন , ওই আমার ম্যানেজার। একগাদা জ্ঞান দিচ্ছে । আমি একটা এস্টেট এর ম্যানেজার হয়ে এসেছি। চা গাছের সঙ্গে তো আর বন্ধুত্ব করা যায় না । কিন্তু যাদের সঙ্গে করা যায় , তাদেরকে দূরে সরিয়ে রাখলে আমার কাজটা সম্পন্ন হবে কি ? আমার তো মনে হয়, হবে না । কারণ কোনো কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে গেলে শুধু মেকানিক্যালি কাজ করে গেলে হয়না। সেখানে ইমোশনাল টাচ থাকতে হয়। মানুষের মনের সঙ্গে যোগাযোগ, মনের সেতু, বড় ম্যাজিক করতে পারে। সেই ম্যাজিক কখনো শুধু হাত-পা নেড়ে কাজ করে করা যায় না।
— ঠিক আছে , শিশির।
উঠে পড়লাম আমি, বললাম , এবারে আস্তে আস্তে টুকটাক কিছু কাজ করে নিয়ে অফিসে বেরোনোর জন্য রেডি হতে হবে, বুঝলে ?
— হ্যাঁ ম্যাডাম । আমিও উঠবো ।
— তুমি বরঞ্চ মাঝেমধ্যে এস্টেটের কাজ সেরে সন্ধ্যেবেলা ঘরে আসার পর আমার বাংলোয় এসো। তখন বেশ সময় করে গল্প করা যাবে।
— ঠিক আছে ম্যাডাম।
উঠে পড়ে আড়চোখে একবার আমার বাংলোটার দিকে তাকিয়ে পিছন দিকে ওর ঘরের দিকে হাঁটা দিল।

সেদিন অফিস আওয়ার্স এর মধ্যেই এক মাসের কাজের রিপোর্ট মালিকের হেড অফিসে মেইল করে দিলাম । তারপর অফিসের কাজকর্ম সেরে বেরোলাম বাগানগুলোর কাজ পরিদর্শন করতে । আজকে আর জগন্নাথ আসেনি । তাই আমাকে নিজেকেই গাড়ি ড্রাইভ করতে হচ্ছে । অবশ্য জগন্নাথকে আমি আসতে বারণ করে দিয়েছিলাম । সকালে ও ফোন করে বলেছিল ওর কালকে রাত্রে থেকে বেশ জ্বর এসেছিল। এখন যদিও গায় আর জ্বর নেই । তবে শরীর খুব দুর্বল । আমি যখন নিজে ড্রাইভ করতে পারি, তখন আর শুধু শুধু শরীর খারাপের মধ্যে আবার ওকে টেনে এনে কি হবে ?

চা বাগানগুলো দেখতে দেখতে, আস্তে আস্তে গাড়ি ড্রাইভ করছিলাম । এই একমাসে ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ওদের সম্পর্কে বেশ কিছু ইনফরমেশন কালেক্ট করেছি। এই যে , জীর্ণ রং চটা একটা করে শার্ট আর প্যান্ট কিংবা আটপৌরে করে গাছকোমর করে আঁচল জড়ানো একটা করে ময়লা শাড়ি, মাথায় বেল্টের মত পরে পিঠে একটা ঝুড়ি ধরে রেখেছে , তা নিপুণ হাতে ভরে উঠছে সদ্যতোলা চা পাতায় । এই চিরাচরিত চা বাগানের ছবির পেছনে যে কত রকম গল্প রয়েছে, দুঃখ কষ্টের , তা আমরা যখন বেড়াতে গিয়ে চা বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করি, তা বুঝতে পারি না । জানার চেষ্টাও করি না । আমরা তো যাই আনন্দ পেতে। তবে আনন্দ কি ওই ময়লা শাড়ি জামার পেছনে আর নেই? আছে। তবে আনন্দের খবর এরা আমাকে সেভাবে দেয় না । দুঃখ কষ্টের খবরই বেশি দেয়। অভাব-অনটনের সংসারের কথাই বেশি বলে। এই কদিনে আমি যেন ওদের একটু কাছাকাছি যেতে পেরেছি। প্রথমদিকের বিদ্রোহ ভাবটা আর নেই । এখনো পর্যন্ত ঠিক মেনে নিতে না পারলেও, এদের আমাকে নিয়ে এখন কৌতুহল বা পিছনে হাসাহাসির বহরটা কমেছে । আমার উপস্থিতিটা এখন এরা এতটা হালকা ভাবে নেয় না । আমাকে আসতে দেখলে যে যার কাজ মনোযোগ দিয়েই করে । এই চা পাতা তোলার দৃশ্য এমন এক চিরন্তন সৌন্দর্য, যা সারাদিন ধরে দেখেও আমার চোখ ক্লান্তি বোধ করে না। এদের মধ্যে খুব অল্প কিছু পাহাড়ি , নেপালি , এছাড়া সমতলের রাজবংশী, নাথ, আদিবাসী, গেন্নাই, তেলি , নমঃশূদ্র , ইত্যাদি বিভিন্ন জাতি সম্প্রদায়ের মানুষজন বিভিন্ন চা বাগানে কাজ করেন। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ। অভাব-অনটনের সংসার। খাটতে পারেন প্রচুর । শরীরে যেন কোনো ক্লান্তি নেই। আর মনগুলিও বড় সতেজ । আমরা অল্প কিছু দুঃখের আঘাতেই ঝড়ে ভেঙে নুয়ে পড়ি । সেখানে এরা কত দুঃখ কষ্ট মাথায় নিয়ে একে অপরের সঙ্গে হাসতে হাসতে ,গল্প করতে-করতে ,গান করতে করতে কাজ করে। কাজেই এদের আনন্দ ।

সবুজ চা বাগানে চোখ রেখে হঠাৎ করে একটা ইচ্ছা মাথার মধ্যে চাগাড় দিয়ে উঠলো। আজকে তো জগন্নাথ আসেনি । গাড়ির স্টিয়ারিং আমার হাতে। আমি যেখানে ইচ্ছা যেতে পারি । শুনেছি অজিত কাকুদের বাংলোটা এখন সম্পূর্ণ খালি পড়ে রয়েছে । কাকু মারা গেছেন আজ প্রায় তিন বছর হলো । কাকিমা জয়ন্তদার সঙ্গে ব্যাঙ্গালোরে থাকেন। বান্টির বিয়ের পরে সে তার হাজবেন্ডের সাথে ইউএসএ চলে গেছে। এখন বাংলোটা একজন কেয়ারটেকারের হাতে। তাই শুনেছিলাম। হঠাৎ করে ইচ্ছেটা আমার মধ্যে ভীষণভাবে পেয়ে বসলো । দেড় যুগ আগে ফেলে আসা সেই সমস্ত স্মৃতিমাখা জায়গাগুলোর এত কাছে থেকেও, এখনো পর্যন্ত একবারও চাক্ষুষ করিনি । সেখানে আমার স্মৃতিরা কেমন ভাবে ঘুমিয়ে রয়েছে দেখে আসা হয়নি । একবার গেলে হয়না ? মোটামুটি আইডিয়া করে আশেপাশে চা বাগানের শ্রমিকদের জিজ্ঞাসা করে ঠিকই মনে হয় চলে যেতে পারবো । সেখানে কতদিন ধরে ঘুমিয়ে রয়েছে আমার প্রেম । না চেয়ে পাওয়া, না পেয়ে ভুলতে চাওয়া- আমার সেই এক এবং অদ্বিতীয় প্রেম ! জীবনে ভালোবাসা পাওয়া আর ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাওয়া- দুটো কি সমার্থক? আমি কি দুটোই এক কালে পেয়েছিলাম? এই প্রশ্নের উত্তর আমি আজ এতগুলো বছর ধরে খুঁজেছি । আজও খুঁজে চলেছি।
এই এক মাসে মোটামুটি আশেপাশের জায়গা সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে । সেই ধারণার ওপর নির্ভর করে গাড়ি চালিয়ে দিলাম।

ক্রমশ..