হিমির নাকফুল পর্ব-০৪

0
1677

#হিমির_নাকফুল(৪র্থ পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda

পেনড্রাইভ ওপেন করে আমি কিছু ভিডিও দেখলাম এবং সেই সাথে কিছু পিক একটা ফাইলে রাখা। যে পিক গুলো দেখে আমি হতবম্ভ হয়ে গেছি।

ভিডিও গুলো আস্তে আস্তে ওপেন করে দেখলাম যে অনিক ছেলেটা অনেক মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করেছে। এবং বিভিন্ন ভাবে কলা কৌশলে মেয়েদের ব্ল্যাকমেইল করেছে। কিন্তু একটা চিন্তার বিষয় যে মেয়েটা আমাকে অনিক এর সমস্ত ডকুমেন্টস গুলো দিলো সে এসব কিছু পেল কোথায়?

তবে এসবের মাঝে হিমির কোন কিছু আমি দেখতে পেলাম না। আর এসব দেখে হিমি মুক্তি পাবে তারও কোনো সম্ভাবনা নেই। নির্দোষ করার কোন প্রমাণ নেই পেনড্রাইভ এর মধ্যে।

তবে একটা বিষয় ক্লিয়ার অনিক যে এসব করেছে এবং বিভিন্ন ভাবে মেয়েদের ঠকিয়েছে তা আমি শিওর। কিন্তু এইসব এখন আমি থানায় শো করতে পারবোনা। আর শো করলেও আমি কোন ফলাফল পাবো না। শুধু শুধু থানায় এই বিষয়ে প্রশ্ন জাগবে যে এসব আমি কোথায় পেলাম। তার জন্য হয়তো আমিও কোন ধরনের ঝামেলা পরতে পারি। কোন কিছু করার আগে যে মেয়েটি আমাকে ডকুমেন্টগুলো দিয়েছে সেই মেয়েটির সাথে আমার যোগাযোগ করতে হবে। কিন্তু সে তো আমাকে নিষেধ করে দিয়েছে যে আমি যেন তাকে ফোন না দেই সে নিজেই আমাকে ফোন দিবে।

দুই দিন পার হয়ে গেলো তারপরেও সেই মেয়েটি আমাকে ফোন দিল না। অন্যদিকে আমার কাকা-কাকি আমাদের বাসা থেকে তাদের বাড়ি চলে গেছে। আমি এখন আমার বাসার পুরো একা। না পারছি ঠিকমতো ঘুমাতে না পারছি ঠিকমত খাইতে।

অনেক ইচ্ছা হয় আমি আমার বোনের কাছে গিয়ে একটু কথা বলি ওকে একটু দেখে আসি। কিন্তু আমি কোন মুখ নিয়ে যাবো? আমি তো হিমির জন্য কিছুই করতে পারিনি। আমি হিমির একটা ব্যর্থ ভাই। আমি ভাই হয়ে হিমির এতোটা শাস্তি দেখতেছি। হিমি কষ্ট পাচ্ছে কিন্তু আমি কিছুই করতে পারতেছিনা।

কোন দিশা না পেয়ে আমি রেডি হলাম। আমার মূল উদ্দেশ্য আমি আমার মামাদের সাথে দেখা করবো। তাদের কাছে আমি এই ব্যাপারে জানাবো।

পরের দিন সকালের গাড়িতে মামা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি। তাদের বাসায় গিয়ে পৌঁছেতে আমার সময় লেগেছে প্রায় ছয় ঘন্টার মত। তাদের বাড়িটা আমার চিনতে খুব কষ্ট হয়েছে। অনেক আগেই মামা বাড়িতে গেছিলাম তখন আমি খুব ছোট। তাদের বাসাটা কোথায় তা আমার ঠিক মনে ছিল না। তারা যে এলাকায় থাকে সেই এলাকায় গিয়ে মানুষের কাছে মামাদের নাম বলতে বলতে খুঁজতে খুঁজতে আমি তাদের বাসার সামনে এসে পৌঁছলাম। তাদের গেটের সামনে এসে আমি আমার মামাদের খুঁজতে লাগলাম। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে গেটের সামনে দাঁড়ালাম। কারো কোন সাড়া শব্দ পেলাম না। আমাকে শুধু আমার ছোট মামা চিনে কারণ আমার মা মারা যাওয়ার পরে ছোটমামা গিয়েছিল আমার মাকে দেখতে। এছাড়া তার আর কোন ভাইয়েরা যায় নি।

একজন মুরুব্বী লোক আমাকে দেখে ডাক দিলো। আমি গুটি গুটি পায়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন….

– কে তুমি? তোমার নাম কি? অনেকক্ষণ ধরে দেখতে ছিলাম যে তুমি আমাদের বাসার সামনে ঘুরঘুর করতেছো।আর এই বাড়িটার দিকে তাকাচ্ছো।

– আমার নাম হাবিব। আমি আমার ছোট মামা মানে আশফাক মামার সাথে দেখা করতে এসেছি। তিনি কি বাসায় আছেন তাকে আমার খুব দরকার।

– কোন হাবিব? তোমাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না,,আর তুমি আমাকে চেনো?

– না। আমি আসলে আশফাক মামা বাদে আর কাউকে চিনি না। আমার মায়ের নাম নীলিমা।

আমার মায়ের নামটা বলার পরপরই সেই লোকটার চোখটা ছল ছল করে উঠলো। আমি স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাচ্ছি যে লোকটার সাথে এতক্ষণ কথা বলেছিলাম সেই লোকটার চোখে জল চলে এসেছে। তিনি চোখের জলটা আড়াল করে আমাকে বললেন…

– আচ্ছা তুমি ভিতরে আসো। আর তুমি আমাকে চিনতে পারছ না আমি কে?

– না আমি আপনাকে চিনতে পারতেছি না।

– আমি তোমার বড় মামা। তোমার মা যখন মারা গেছে তখন আমি আসলে দেশের বাহিরে ছিলাম। তখন আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাইতো আশফাক একাই গিয়ে ছিলো। আমাদের ওপর তোমাদের এত অভিমান ছিল? একটা বারও কি তোমাদের কখনো ইচ্ছে হয়নি যে মামা বাড়িতে বেড়াতে আসবা।

– কিভাবে আর আসবো আপনারাই বলুন! আমরা তো সেই ছোটবেলায় আপনাদের কাছে অবহেলিত ছিলাম। আমার বাবার একটা ভুলের কারণে সেই ভুলের শাস্তি আপনারা আমাদের দুইটা ভাই বোনকে দিয়েছেন।তখন তো আপনারা আমাদেরকে আপন করে নিতে পারলেন না। আমার বাবা মারা যাওয়ার পরে তো আমাদের আর কেউ ছিল না। আপনারা তো একটা বার আমাদের বাসায় যেতে পারতেন। আপনার বোন যখন বেচেছিলো তখন তো তাকে দেখতে যেতে পারতেন। আর আমরা দুইটা ভাই-বোন কেমন আছি কি করতেছি আমাদেরও তো কোনো খোঁজখবর নিতে পারতেন।

– আচ্ছা হাবিব তুমি এখানে বসো আমি একটু পরে আসছি।

ড্রইং রুমে বসে আমি চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতেছি। দেখতে দেখতে একটা ছবি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই ছবিতে আমার মা রয়েছেন।কতটা হাসিখুশি মুখ নিয়ে আমার মা তাকিয়ে আছে। সেখানে আমার নানা নানি মামারা আর আমার মা সবাই বসে আছেন। অনেক পুরনো একটা ছবি। আর এই সময়টা হয়তো আমার মায়ের বয়স খুবই অল্প ছিল। কিন্তু আমার মায়ের আগের যে রকম চেহারা ছিল আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত একই রকমের চেহারা ছিলো। চেহারার কোনো পরিবর্তন হয়নি।

কেন জানি নিজের অজান্তেই আমার চোখ থেকে পানি বেরিয়ে আসলো। মায়ের ছবিটা আমার চোখের সামনে পরাতে হুহু করে কেদে উঠলাম। শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে তাকিয়ে দেখি অনেকেই আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

আমার বড় মামা এসে একে একে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। আমি সবার ভালোবাসা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। আসলে সময় যখন থাকে তখন কেউ ভালবাসে না। আর যখন সময় ফুরিয়ে যায় তখন সবারই ভালোবাসা পাওয়া যায়। আমার মা বেঁচে থাকতে কত ছটপট করেছেন তাদের কাছে আসার জন্য। স্বজনদের জন্য কত রাত যে কান্না করেছেন আমার মা। আমি নিজের চোখে দেখছি। কিন্তু তারপরেও এই বাড়িতে আসার সাহস পাননি এবং আমাদের একটা বার আমার মা বলতেও পারে নি যে আমাদের সাথে করে তার বাবার বাড়িতে আসবে।কারণ, ওই যে আমরা যদি তাদের কাছে অপমানিত হই বা তারা যদি আবার আমাদের অবহেলা করে? তখন আমার মা আমাদের কি জবাব দেবে? একেবারে খালি হাতে ফিরে আসতে হবে. অথচ আজ আমার মা বেঁচে নাই আমার বোনটা কারাগারে বন্দি অথচ সবাই আমাকে ভালোবেসে সবাই আমাকে তাদের কাছে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

অনেক রাতে আমার ছোট মামার ফিরে আসলেন বাসায় সবাইকে একসাথে নিয়ে আমি তাদের কাছে বললাম….

– আপনারা সবাই জানেন আমার মা প্রায় দেড় মাস আগে আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে। আমার মা ছিলো আমার একটা পৃথিবী,তারপরে আর একটা পৃথিবী আমার বোন হিমি। হিমির কথা আপনাদের মনে আছে? যখন খুব ছোটবেলায় আপনাদের বাসায় আপনাদের বোন আমাদেরকে নিয়ে এসেছিলো! তখন আমার বোন হিমি নানার কোলে যাওয়ার জন্য অনেক কান্নাকাটি করেছিল। সেই ছোট্ট হিমিকে আপনারা কেউ একটু ভালোবাসেন নি। খুব অভিমান করে আমার মা বাসায় চলে গেছে।

আপনারা কি জানেন সেই ছোট্ট হিমিটা অনেক বড় হয়ে গেছে? আর হিমি এখন কোথায় আছে তা কি আপনারা জানেন? জানেন না! কারন আপনার একটা বার আমার এবং আমার বোন হিমির খোঁজখবর নিতে পারেননি। আমার মা মারা যাওয়ার পরে আমরা এখন এতিম আমাদের মা বাবা কেউ নেই আমার বোন থেকেও এখন অনেক দূরে।

আমি আপনাদের কাছে সাহায্য চাইতে এসেছি যদি আমাকে ভিক্ষার স্বরূপ সাহায্য করেন তাহলে আমি আমার আরেকটা পৃথিবী মানে আমার বোন হিমিকে ফিরে পাবো।আপনাদের সাহায্য ছাড়া আমি আমার বোনকে বাঁচাতে পারবো না।প্লিজ আমাকে ফিরেয়ে দিবেন না।আমি শুধু আপনাদের সাপোর্ট চাই।টাকা পয়শা কিছু দিতে হবে না।

আমার মা মারা যাওয়ার একমাত্র কারণ হিমি। একটা ভুল মিথ্যে প্রমাণ এর কারণে আমার বোন খুনি। সে এখন জেলখানায় বন্দি। আর এই শোক সহ্য করতে না পেরে আমার মা বড্ড অভিমান নিয়ে আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে।আর সেই দিনটি ছিলো হিমির বিয়ের দিন।

– হিমি এখন কোথায় কি অবস্থায় আছে ওর সাথে কি তোমার কথা হয়েছে।

– আমি কোন মুখ নিয়ে হিমির সামনে গিয়ে দাড়াবো? আমি তো হিমিকে শাস্তির হাত থেকে বাঁচাতে পারিনি। কোন আশ্বাস তো দিতে পারবো না। এখন আপনারা যদি আমাকে একটু সাহায্য করতেন তাহলে হয়তো আমি আমার মুখটা নিয়ে যেতে পারতাম। আপনারা চাইলে পারবো আমার বোনকে বাঁচাতে।আমার বোনকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যবস্থা করবেন তো?

– আমরা সবাই তোমাকে সাহায্য করবো।যত ধরনের সাহায্য লাগে তোমার,সব কিছুই করবো।আমরা একটু হিমিকে দেখতে চাই।

তাদের সাথে কথা বলতে বলতে একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করলাম এবং আমি খুব চমকে গেলাম। আমার মামাতো বোনের নাকে একটা ডায়মন্ডের নাকফুল। যেমন একটা নাক ফুল আমার বোন হিমিকে দিয়েছিলাম।

পরক্ষনেই আমার মনে হলো হিমির সেই নাকফুল টা কোথায়?……..

[চলবে…….]