হিয়ার টানে পর্ব-০৯

0
265

#হিয়ার_টানে
#৯ম_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা

–“আবির, তুমি কি হিয়াকে সত্যিই ভালবাসো?”

শাহিল ভাইয়ার মুখে এমন কথা শুনে আবির ভাইয়া একবার আমার দিকে আর একবার শাহিল ভাইয়ার দিকে তাকালো৷ তারপর বলল,

–“আমি আর কতবার বলব? হ্যাঁ আমি হিয়াকে ভালবাসি৷ ভীষণ ভালবাসি। কেন?”

–“হিয়াকে বিয়ে করতে পারবে?”

–“ভালবাসি যখন বিয়েতো অবশ্যই করবো। ”

–“আরে আমি সে কথা বলিনি। তুমি কি এখন হিয়াকে বিয়ে করতে পারবে?”

আবির ভাইয়া যেন একটু চিন্তায় পড়ে গেলো। মলিন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

–“আমি হিয়াকে এভাবে পেতে চাইনা। আমার পরিবারের সবাইকে কষ্ট দিয়ে আমরা কি সুখী হতে পারবো? সবার সম্মতিতেই আমি হিয়াকে নিজের করে পেতে চাই৷ আর এখন আমার নিজেরই কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই৷ হিয়াকে ভালো রাখবো কি করে?”

–“কিন্তু তোমার পরিবার যদি সেটা না চায়? তারা যদি তোমাদের বিয়েতে রাজি না হয়? অথবা তুমি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই যদি হিয়া অন্যকারো হয়ে যায়? তখনও কি তুমি তোমার পরিবারের সম্মতির আশাতেই থাকবে? নাকি দাঁড়িয়ে থেকে হিয়াকে অন্যের হাতে তুলে দিবে?”

শাহিল ভাইয়ার এই কথায় আবির ভাইয়া কিছুটা রেগে গিয়ে বলল,

–“আপনি নেগেটিভ কেন ভাবছেন? পজিটিভ ভাবুন! আমি আর হিয়া যদি দু’জন দু’জনকে পছন্দ করি তাহলে তারা মেনে কেন নেবে না? আমরাতো বিয়েই করতে চাইছি। কোনো পাপ কাজতো নয়৷ আর আমাদের চাওয়ার মধ্যে কোনো কলুষতা বা অপবিত্রতা নেই! তাহলে কেন তারা আমাদের ভালো চাইবে না? আমার বিশ্বাস আছে যে, আমার পরিবার অবশ্যই আমার আর হিয়ার ভালবাসাটা মেনে নিবে। ”

–“আর যদি না নেয়?”

আবির এইবার অনেকটা রেগে গিয়ে বলল,

–“দেখুন আমি হাসপাতালের মধ্যে আছি বলে কিছু বলছি না। আমাকে রাগাবেন না। আপনি বারবার একি বুলি কেন আওড়াচ্ছেন?”

শাহিল ভাইয়া এইবার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

–“কারণ তোমার মতো ভুল বিশ্বাস আমারো ছিলো আবির৷ আমিও ভেবেছিলাম যে, পরিবারের মানুষ আমাদের এত ভালবাসে! তাহলে আমাদের সুখের কথা ভেবে অবশ্যই আমাদের কথাই শুনবে! আমাদের পছন্দমতোই আমাদের জীবনসঙ্গী বাছাই করতে দিবে! কিন্তু বাস্তবে তা হয়না! বাস্তবতা বড় নিষ্ঠুর! একটা গল্প শুনবে?”

আমার যদিও ভালো লাগছে না৷ আর একমুহূর্ত এখানে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু শাহিল ভাইয়ার কথাগুলো শুনতে কেন জানি ভালো লাগছে। উনার গল্পটা শোনার জন্য বুকের ভেতরটা আকুপাকু করছে। প্রথম দিন উনাকে দেখে ভেবেছিলাম যে, উনি খুব হাসি-খুশি একজন মানুষ! কিন্তু আজ উনার কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছে যে, একবুক কষ্ট নিয়ে উনি মুখে হাসির প্রলেপ দিয়ে থাকেন!

আবির ভাইয়া ভাবছিলো কি বলবে না বলবে। আমি শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে জোরে করে বলে উঠলাম,

–“আমি শুনবো!”

আমার কথাশুনে শুধু আবির ভাইয়া আর শাহিল ভাইয়া নয়, আশেপাশের আরো অনেকেই তাকালো। আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। শাহিল ভাইয়া আমাদের উদ্দেশ্য করে বলল,

–“আমার রুমে চলো৷ ওখানে গিয়ে বসে শুনবে। ”

আবির ভাইয়া আমার দিকে রাগী চোখে তাকালো৷ যেন উনি আমায় বলতে চাইছেন যে,’হিয়া! তুই অসুস্থ! তার উপর বাড়ি যাওয়ার প্যারা! সেখানে গিয়ে কি হবে সে প্যারা! এখন কি করব না করব তা বুঝতে পারছি না! আর তোর এখন এই ছেলেটার গল্প শুনতে হবে!’

আমি আবির ভাইয়ার থেকে চোখ নামিয়ে নিয়ে শাহিল ভাইয়ার পিছনে যেতে লাগলাম। শাহিল ভাইয়া আবির ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিলো। কিছু বলল না৷ আবির ভাইয়াও উপায় না দেখে চুপচাপ আমাদের সাথে গেলো।

শাহিল ভাইয়ার রুমে বসার পর উনি উনার গল্প বলা শুরু করলেন।

–“অনেক বছর আগের কথা! আমি সবে কলেজে ভর্তি হয়েছি৷ সেখানেই পরিচয় হয় আমাদের কলেজের ম্যাথ স্যারের মেয়ে অরুনিতার সাথে। আস্তে-আস্তে পরিচয়, ভাললাগা তারপর কখন যে দু’জন দু’জনকে ভালবেসে ফেলি তা আমরা কেউ-ই বুঝতে পারিনি। আমরা যেহেতু ক্লাসমেট ছিলাম তাই ফ্রেন্ড হিসেবেই মেলামেশা করতাম।

আমি ওকে অরু বলে ডাকতাম। আর ও আমাকে শাহি বলতো। আমাদের ভালবাসাটা ছিলো বোবা ভালবাসা! মানে কেউ কাউকে সরাসরি বলিনি যে, ভালবাসি! তবে দু’জন-ই দু’জনকে ভালবাসতাম তা বুঝতে পারতাম। আর এটা যে শুধু আমরা বুঝতে পারতাম তা নয়! কলেজের সবাই একসময় জেনে যায় যে, আমি অরুকে ভালবাসি!

সবাই জানলেও ক্ষতি ছিলো না! কিন্তু অরুর বাবা জানতে পেরে ভীষণ রেগে যান! উনি একজন শিক্ষক মানুষ আর উনার মেয়ে কিনা একটা ছেলের সাথে প্রেম করে বেড়াচ্ছেন! উনি ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি৷

আমাদের এইচ এস সি পরীক্ষার আগেই ওর কলেজে আসা বন্ধ করে দেয়। আমারতো পড়াশোনা, নাওয়া-খাওয়া সব যেন বন্ধ হয়ে যায়! ওর সাথে সব রকমের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়! ওর চিন্তায় চিন্তায় আমিও অসুস্থ হয়ে পড়ি। ওর বাবাকে অনেক অনুরোধ করি অরুর সাথে একবার দেখা করার জন্য! কিন্তু উনি আমাকে পরীক্ষা দিতে দিবেন না বলে হুমকি দেয়৷ আমার বাবাকে ডেকে অপমান করে! বাবা আমাকে বকা দিতে চাইলেও পারে না! কারণ তখন আমার অবস্থা এমনিতেই খারাপ! ”

এটুকু বলেই শাহিল ভাইয়া আমার আর আবির ভাইয়ার দিকে তাকায়৷ তারপর বলে,

–“আরো শুনবে? আবির, তোমাকে বলছি। পুরোটা শুনবে কি? না শুনতে চাইলে জোর করবো না!”

আবির ভাইয়া মাথাটা নিচু রেখেই আস্তে করে বলল,

–“তারপর? বলুন। শুনছিতো। আর কি অরু আপুর সাথে আপনার দেখা হয়নি? উনার কি বিয়ে হয়ে গেছে?”

শাহিল ভাইয়া একটা হাসি দিয়ে বললেন,

–“বিয়ে হয়ে গেলেওতো একটা সান্ত্বনা থাকতো যে ও এখনো বেঁচে আছে!”

একথাটা শুনেই আমার বুকের ভেতরটা যেন শুন্যতায় ভরে গেলো। আমি শাহিল ভাইয়ার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বললাম,

–“অরু আপু কি বেঁচে নেই?”

শাহিল ভাইয়া বললেন,

–“শেষ পরীক্ষার দিন ও ওর বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমার কাছে এসেছিলো। আমাকে বারবার বলেছিলো ওকে নিয়ে যেন পালিয়ে যাই কোথাও। ওকে যেন বিয়ে করে নেই! তারপর যা হয় দেখা যাবে! আমি তখন অনেক ছোট! ওই সময় বিয়ে! আমি অরুকে বুঝাতে চেষ্টা করি যে, আস্তে-আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা ভার্সিটিতে উঠলে তখনতো আর কেউ পাহারা দিবেনা! ভার্সিটি আলাদা হলেও আমরা যোগাযোগ রাখবো! আর পড়াশোনা শেষ করেই আমরা বিয়ে করে নেবো! ও সেদিন অনেক কান্না করেছিলো! কিন্তু সেই কান্নার সুরগুলো আমার কানে তখন পৌঁছেনি! আজ আমার কানে সেই সুর বাজে! মাঝেমধ্যেই আমি অরুর সেই নিদারুণ কান্না শুনতে পাই! ”

শাহিল ভাইয়াকে থামিয়ে আমি বললাম,

–“কিন্তু অরু আপু মারা গেলো কীভাবে?”

–“সেদিন ওর বাবা আমাদের খুঁজে বের করে। তারপর আমাকে আর অরুকে বুঝায় যে,আমাদের পড়াশোনা শেষ হলেই উনি নিজে আমাদের বিয়ে দিবে। অরু উনার সাথে সেদিন যেতে চাইছিলো না। আমিই জোর করে ওর বাবার সাথে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। ওর সেই করুণ চাহনিটা আজও আমার চোখের সামনে ভাসে! সেদিন যদি ওকে যেতে না দিতাম!”

বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আবির ভাইয়া চুপচাপ দর্শক হয়ে কথাগুলো শুনছে। আমি বললাম,

–“তারপর কি হলো?”

আবির ভাইয়া আমাকে ধমক দিয়ে বললেন,

–“বলছেতো তারপর, মন দিয়ে শোন!”

শাহিল ভাইয়া বলল,

–“তারপর আবার ওর সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। আমি ভাবলাম যে, হয়ত বাসায় পড়াশোনা করছে। আমিও মেডিকেলের জন্য কোচিং করায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমাকে যে, অরুর জন্য কিছু করতে হবে! আমি ভেবেছিলাম যে, মেডিকেলে চান্স পেলে অরুর বাবা আমাকে হাসিমুখে মেনে নেবে!

তারপর সেদিন আমার এডমিশন ছিল। সকালে একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসলো৷ আমি রিসিভ করতেই অরুর কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। অরু কান্না করে বলেছিলো যে, ওর বাবা নাকি ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে৷ সেদিন ওর বিয়ে ছিলো। অনেক কষ্টে একজনের ফোন থেকে লুকিয়ে আমাকে ফোন করেছিলো। আমি বলেছিলাম যে, পরীক্ষাটা দিয়েই আমি ওর বাসায় যাবো! ওর বাবার সাথে কথা বলব। ও অনেক কান্না করেছিলো সেদিনও৷ আর আমি এডমিশন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম! আমরা কত স্বার্থপর!

সেইটুকুই ছিল অরুর সাথে আমার শেষ কথা! অরু সেদিন আমার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলো! আমিও গিয়েছিলাম তবে দেরি করে! অরু আমার অপেক্ষায় থেকে-থেকে যখন ওর বিয়ের জন্য কবুল পড়াতে আসে তখনি নিজের কাছে থাকা মারাত্মক একটা বিষ ঢকঢক করে পান করে নেয়! সবার সামনে নতুন বধুবেশে অরু ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে! কেউ জানেনা যে সেই বিষ ও কোথায় পেয়েছিলো! হাসপাতালে নিয়েও লাভ হয়নি! ”

এতক্ষণ পর আবির ভাইয়া বলল,

–“আপনি গিয়ে কি উনার লাশ দেখতে পেয়েছিলেন?”

–“হ্যাঁ, আমি ওর বাসা থেকে সোজা হাসপাতালে চলে যাই! আর সেখানেই আমার অরুকে বউসাজে প্রাণ ভরে দেখে নেই! শেষদেখা!… আচ্ছা আবির, আজ যদি হিয়ার কিছু হয়ে যেতো তুমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারতে? এইবার বলো?”

আবির ভাইয়া আস্তে করে বলল,

–“আমি হিয়াকে বিয়ে করতে চাই। আপনি সাহায্য করবেন?”

–“অবশ্যই! চলো আমার সাথে।”

আমি আর আবির ভাইয়া নিরবভাবে শাহিল ভাইয়ার পিছু যেতে লাগলাম। আবির ভাইয়া বলে উঠল,

–“আমাদের সাথেতো কোনো কাগজ-পত্র নেই। তাহলে?”

শাহিল ভাইয়া একটা হাসি দিয়ে বললেন,

–“ওসব কিছুই লাগবে না। তুমি চলো আমার সাথে।”

তারপর উনি আমাদের ওই হাসপাতালের মসজিদের সামনে দাড় করিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। আমি আর আবির ভাইয়া চুপচাপ উনার অপেক্ষা করতে লাগলাম।

কয়েক মিনিট পর শাহিল ভাইয়া বাইরে এসে বললেন যে, ব্যাবস্থা হয়ে গেছে। তারপর আমাদের মসজিদের বারান্দার মতো একটা জায়গায় নিয়ে বসালেন। তারপর ইমাম সাহেব আবির ভাইয়া আর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

–“তোমরা কি সত্যিই এভাবে বিয়ে করতে চাও? কোনো কাগজ-পত্র নেই! শুধু ইসলামের শরিয়ত মোতাবেক কবুল পড়াতে পারবো আমি! কাগজ-পত্র তোমরা যেকোনো সময় করে নিতে পারবে। বলো রাজি?”

আমি আর আবির ভাইয়া একে অপরের দিকে তাকালাম। শাহিল ভাইয়া বলল,

–“ওরা কি বলবে! আমি এখন ওদের গার্জিয়ান। আপনি বিয়ে পড়ান।”

আবির ভাইয়া কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। আমিও আর কিছু বললাম না। ইমাম সাহেব আমাদের দু’জনের নাম-ধাম সব জিজ্ঞেস করে নিলো।

ইমাম সাহেব প্রথমে আমাকে তারপর আবির ভাইয়াকে কবুল পড়ালেন৷

আমার ভাবতেও অবাক লাগছে যে, আবির ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে সব যেন স্বপ্ন!

শাহিল ভাইয়ার মুখে অফুরন্ত হাসির রেখা ফুটে উঠলো। আমি আর আবির ভাইয়া শাহিল ভাইয়াকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য রওয়ানা হলাম।সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রাস্তাঘাট অন্ধকার হতে শুরু করেছে। সাথে আমাদের আশাগুলোও। জানিনা বাড়িতে আমাদের জন্য নতুন কোন ঝড়-তুফান অপেক্ষা করছে!!!

চলবে…