হিয়ার টানে পর্ব-০৮

0
270

#হিয়ার_টানে
#৮ম_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা

আমি আশেপাশে তাকিয়ে আরো অনেক লোকজন দেখতে পেলাম। বোঝাই যাচ্ছে যে, এটা কোনো সরকারি হাসপাতাল। আমি নড়াচড়া করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম যে, আমাকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে৷ মাথাটা এখনো ঝিম-ঝিম করছে। সামনে একজন ডাক্তারকে দেখতে পেয়েই তাকে ডাকতে লাগলাম,

–“এক্স-কিউজ মি! ডাক্তার সাহেব?”

আমার ডাক শুনে ডাক্তারটা আমার দিকে তাকালো৷ ডাক্তারকে দেখেই আমার আবার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা! আমি আস্তে করে বললাম,

–“শাহিল ভাইয়া আপনি এখানে?”

শাহিল ভাইয়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলল,

–“এখন কেমন লাগছে? আপনি ঠিক আছেনতো? কি হয়েছিলো? ”

–“এতগুলো প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দিবো? তার আগে এটা বলুন যে, আমি এখানে কি করছি? আর আপনিই বা এখানে কেন?”

–“তোমার কি কিছুই মনে নেই?”

আমি কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললাম,

–“মনে থাকলে কি আর জিজ্ঞেস করতাম!”

–“আমি যেহেতু ডাক্তারের এপ্রোন পড়ে আছি, নিশ্চয়ই আমি ডাক্তার! আর তুমি যেহেতু রোগীর বেডে শুয়ে আছো তারমানে তুমি রোগী!সিম্পল ব্যাপার! এতে না বুঝার কি আছে!”

–“কিন্তু আমিতো বাসে ছিলাম। তাহলে….?”

এটুকু বলার পরেই আমার সবটা মনে পড়ে গেলো। ওই মহিলা! ওই পাউরুটি! তারপর আরকিছুই মনে করতে পারলাম না। আমি বিচলিত হয়ে বললাম,

–“আমি এখানে কতক্ষণ ধরে আছি?”

আমার প্রশ্ন শুনে শাহিল ভাইয়া একটু চিন্তাভাবনা করে বলল,

–“ঘন্টা দু’য়েক হবে হয়তো। আমিতো একটু আগে ডিউটিতে এসে তোমাকে দেখে অবাক হয়ে গেছি! প্রথমে ভেবেছিলাম যে, হয়তো আমার মনের ভুল! কিন্তু পরে দেখি না….”

–“আপনার ফোনটা দেওয়া যাবে?”

–“চিন্তা করো না। আমি তোমার বাসায় জানিয়ে দিয়েছি। ”

উনি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। আমি উনাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,

–“আপনি আমার থেকে না শুনে আমার বাসায় কেন কল করলেন?”

শাহিল ভাইয়া একটু রেগে গিয়ে বললেন,

–“হাউ স্ট্রেঞ্জ! আমি আপনার উপকার করলাম আর আপনি আমাকেই এভাবে বলছেন? জানেন আপনাকে যে মেডিসিন দিয়ে অজ্ঞান করা হয়েছে তা অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যবহার করলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে! আপনার ভাগ্য অনেক ভালো যে, ডোজ একদম অল্প ছিলো৷ আপনি অসুস্থ! আর আমি আপনার বাসায় জানাবো না!”

আমার জোরে কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে। তাই একটু আস্তে করেই বললাম,

–“না বলবেন না। কারণ আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। এখানে আমাকে আর কতক্ষণ থাকতে হবে?”

–“স্যালাইনটা শেষ হলেই আপনি বাসায় যেতে পারবেন। তবে কয়েকদিন রেস্টে থাকতে হবে। আর আপনি পালিয়ে এসেছেন মানে?”

–“আচ্ছা আপনি আমাকে ‘আপনি’ করে বলছেন কেন? আমি আপনার অনেক ছোট, তুমি করে বলতে পারেন।”

কথাটা বলার পরেই আমার বাড়ির কথা মনে পড়লো৷ তারপর তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলাম,

–“বাড়ি থেকে কেও আসছে আমাকে নিতে?”

–“না! আবির এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।এইবার বলো, পালিয়ে কেন এসেছো বাড়ি থেকে? তাও আবার একা-একা? ”

আবির ভাইয়া আসবে শুনে আমি অনেকটা খুশি হয়ে বললাম,

–“আবির ভাইয়ার জন্য। আচ্ছা আবির ভাইয়া কখন আসবে বলেছে?”

–“মানে? কি বলছো তুমি এসব?আবির ভাইয়ার জন্য মানে?”

–“আমি আবির ভাইয়াকে ভালবাসি। তাই….”

আমি আরকিছু বলার আগেই কেউ শাহিল ভাইয়াকে ডাকতে লাগলো। তারপর উনি আমার পুরো কথা না শুনেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো।

শাহিল ভাইয়া যেতেই আমার মনে পড়লো যে, উনাকে আমি আবির ভাইয়ার কথা কেন বললাম! এখন যদি উনি বাড়িতে সব বলে দেয়? ওই মেডিসিনের প্রভাবে কি সত্যিই আমার জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে? আমি যাকে-তাকে সব বলে দিচ্ছি!

প্রায় ঘন্টা দু’য়েক পর আমার স্যালাইন শেষ হলো। একজন নার্স এসে স্যালাইনের সূচটা খুলে দিলো। এরমধ্যে শাহিল ভাইয়া আর একবারও আসেনি। হয়ত ব্যস্ত আছে! কিন্তু আবির ভাইয়াও এখনো আসছে না কেন? আমার খুব চিন্তা হচ্ছে!

একজনের কাছ থেকে সময় জানতে পারলাম যে, প্রায় ৩টা বেজে গেছে। আমি একটা বিষয়ে অবাক হচ্ছি! আমি হাসপাতালে অথচ আমার বাড়ির কেউ আসলো না? আবির ভাইয়া কখন আমায় নিয়ে যাবে সেই আশায় আছে? আমাকে নিয়ে কারোর কোনো মাথা-ব্যাথা নেই? পরক্ষণেই মনে হলো যে, আজ আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো! আর সেখান থেকে আমি পালিয়ে এসেছি! বাড়ির লোকতো আমার উপরে ভীষণ রেগে আছে! তাই বলে একবার দেখতেও আসবে না?

শরীরটা বড্ড ক্লান্ত। সকাল থেকে না খাওয়া৷ শাহিল ভাইয়া এক নার্সকে দিয়ে কিছু ফলমূল আর পানীয় কিনে পাঠিয়েছে। কিন্তু আমার কিছু খেতে মন চাইছে না, তারপরেও একা-একা নিজেকে এতিমের মতো লাগছে৷ সবার পাশেই কেউ না কেউ আছে৷ অথচ আমার পাশে কেউ নেই! অনেকেই এসে জিজ্ঞেস করছে যে, কি হয়েছিলো। শেষে বিরক্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরে পড়ে রইলাম৷ আর কারোর কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে মন চাইছে না!

কতক্ষণ এভাবে শুয়ে ছিলাম মনে নেই। হঠাৎ মাথায় কারো হাতের ছোঁয়া পড়তেই চোখ দু’টো আপনা-আপনি খুলে গেলো। আমি চোখ খুলে আবির ভাইয়াকে দেখে লাফ দিয়ে বেড থেকে উঠে বসলাম।তারপর চোখেমুখে খুশির আভা ফুটিয়ে তুলে বললাম,

–“আপনি এসেছেন? এত দেরি করলেন কেন? আমি কখন থেকে একা-একা আপনার জন্য ওয়েট করছি! জানেন বাড়ি থেকে কেউ আমাকে দেখতে আসেনি! ”

কথাটা বলেই আমি কান্না শুরু করে দিলাম।আমাকে কান্না করা দেখে আবির ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে বলল,

–“গাধী! তুই বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিস! ধরতে গেলে বিয়ের আসর থেকে। বাড়ির সবাই ভীষণ রেগে আছে! ছেলেপক্ষকে জানিয়েছে যে, কিছু ঝামেলার কারণে আজ আর বিয়েটা হবে না। বাড়ির কেউ চায়না যে, তোর পালিয়ে আসার ব্যাপারটা গ্রামের কেউ জানুক। তাই কেউ আসেনি। আমাকে বলেছে সন্ধ্যার পর তোকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে। দিনের বেলায় গেলে সবার চোখে পড়লে নানা প্রশ্ন করবে। গ্রামের মানুষ বুঝিস-ইতো। তিলকে তাল বানাবে!”

–“তাই বলে আপনিও এত দেরি করে আসবেন? জানেন আমার এখানে কত খারাপ লাগছিলো।”

–“আরে পাগলী আমারতো তখনি ছুটে আসতে ইচ্ছে করছিলো যখন শুনলাম যে, তুই হাসপাতালে! কিন্তু ভাইভা শেষ না করে কি করে আসি বল! আর শাহিল ভাইয়া আছে শুনে আরেকটু নিশ্চিত হলাম!”

–“আমি আর এখানে থাকবো না। আমি বাড়ি যাবো! আমার ব্যাগ! টাকা! ফোন! কিছুই নেই! সব নিয়ে গেছে।”

–“তুই ঠিক আছিস এটাই আমার কাছে অনেক৷ শাহিল ভাইয়া বলেছে যে, মেডিসিনের ডোজ একদম অল্প ছিলো৷ কিছুদিন রেস্ট করলেই ঠিক হয়ে যাবি৷ এইতো একটু পরেই আমরা বের হবো। কিছু খেয়েছিস?”

আমি না সূচক মাথা নাড়ালাম। আবির ভাইয়া আমার পাশে রাখা খাবারগুলো দেখলেন। তারপর উনার নিজের আনা কমলার খোসা ছাড়িয়ে আমার মুখে পুরে দিলেন। ইচ্ছে না হলেও এবার আমি রাজরানীর মতো খেতে লাগলাম৷ এই প্রথম আবির ভাইয়া নিজ হাতে আমাকে কিছু খাইয়ে দিচ্ছে!আমি আবির ভাইয়ার হাতে খাচ্ছিলান আর দু’চোখ ভরে উনাকে দেখছিলাম৷ আবির ভাইয়ার চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় আমি নিজের চোখ নামিয়ে নিলাম।

সন্ধ্যার আগেই শাহিল ভাইয়ার সাথে দেখা করে আমরা বাড়ির পথে রওয়ানা দিচ্ছি৷ তখন শাহিল ভাইয়া আবির ভাইয়াকে লক্ষ্য করে বলল,

–“যে মেয়েটা তোমার কাছে আসার জন্য এতবড় রিস্ক নিলো তাকে কখনো কষ্ট দিও না আবির। এমন ভালবাসা কোথাও পাবে বলে আমার মনে হয়না।”

শাহিল ভাইয়ার মুখে এমন কথা শুনে আবির ভাইয়া কিছুটা বিস্ময় নিয়ে আর রাগ নিয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি বুঝতে পেরে মাথাটা নিচু করে নিলাম। আবির ভাইয়া এইবার শাহিল ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মুখে কিছুটা হাসি আনার চেষ্টা করলো। তারপর বলল,

–“অবশ্যই ভাইয়া। আর থ্যাংকস আজ সারাদিন ওর খেয়াল রাখার জন্য। আপনি কি এই কথাটা বাসার কাউকে জানিয়েছেন?”

আবির ভাইয়ার এই প্রশ্ন শুনে শাহিল ভাইয়া বলল,

–“আমি নিজে একজনকে ভালবাসতাম৷ কিন্তু আমার ভুলের জন্য তাকে হারিয়েছি। ভালবাসা হারানোর কষ্টটা আমি বুঝি। চিন্তা করো না, আমি কখনো তোমাদের বিপদের কারণ হবো না। আর কোনো হেল্প লাগলে আমি আছি।…. হিয়া, তোমার বাসার সবাই মনে করেছে যে, তুমি আমার কাছে চলে এসেছিলে। কিন্তু আমি তোমাকে পাত্তা দেইনি! তাদের ফোন করে সবটা জানিয়ে দেওয়ার জন্য আমাকে থ্যাংকস জানিয়েছে৷ আর তোমার হয়ে ক্ষমাও চেয়েছে। আবিরের জন্য এসেছো জানলে এতক্ষণে হয়ত…”

শেষের কথাগুলো শাহিল ভাইয়া আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল। তারমানে আমার বাবা-মা ভেবেছে যে, আমি শাহিল ভাইয়াকে ভালবাসি! হায় আল্লাহ!শাহিল ভাইয়ার মুখে কথাগুলো শোনার পর আবির ভাইয়া আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

–“আমি হিয়ার সুখের জন্য সব করতে পারি। আল্লাহর কাছে লাখ-লাখ শুকরিয়া যে, আজ হিয়ার কিছু হয়ে যায়নি! নইলে আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারতাম না।”

শাহিল ভাইয়া আবির ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–“কীভাবে তুমি ওকে রক্ষা করবে আবির? কি অধিকার আছে তোমার ওর উপর? ”

আবির ভাইয়া জোর গলায় বলল,

–“ভালবাসার জোর। আমি হিয়াকে অনেক ভালবাসি। আর সেই জোর দিয়েই আমি ওকে রক্ষা করবো!”

শাহিল ভাইয়া মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললেন,

–“আদৌ কি সেটা এত শক্তিশালী? ”

আবির ভাইয়া বোকার মতো শাহিল ভাইয়ার দিকে ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে বলল,

–“মানে?”

–“হিয়া বাসায় যাওয়ার পরেই ওই ছেলেটার সাথে জোর করে হিয়ার বিয়ে দিয়ে দিবে। ওই ছেলে জানে যে, হিয়া সাজার জন্য পার্লারে এসেছে৷ তাই এত দেরি হচ্ছে। এ কারণেই তোমাদের বাসা থেকে কেউ আসতে পারেনি৷ সবাই হিয়ার পৌঁছানোর অপেক্ষায় আছে। আর একবার হিয়ার বিয়েটা হয়ে গেলে..

–“আমি কিছুতেই হিয়ার এই বিয়ে হতে দেবো না। কিন্তু আমাকেতো বলেছে যে, বিয়ে পিছিয়ে গিয়েছে!”

–“কারণ তুমি যদি হিয়াকে বলে দাও! তাই। আর কীভাবে তুমি হিয়ার বিয়ে আটকাবে? তুমিতো হিয়াকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছো! আর ওখানে গেলে কেউ তোমার কথা শুনবে না!”

আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। পাশের একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। তারপর কান্না করতে-করতে বললাম,

–“আমি বাড়ি যাবো না। আমি অন্যকাউকে বিয়ে করতে পারবো না। আমার বাবা-মা আমার সাথে এমন কেন করছে? আমি অসুস্থ! আর তারা আমার বিয়ে নিয়ে পড়ে আছে! আমি এখন কি করবো?”

শাহিল ভাইয়া আস্তে করে বলে উঠলেন,

–“একটাই রাস্তা আছে। যদিও তা অনেক রিস্কি! কিন্তু এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই এই বিয়ে আটকানোর।”

শাহিল ভাইয়ার মুখে এমন কথা শুনে আমি আর আবির ভাইয়া একসাথে বলে উঠলাম,

–“কি সেটা?”

চলবে….