হৃদমাঝারে তুমি ছিলে পর্ব-১৫

0
591

#হৃদমাঝারে_তুমি_ছিলে❤
#পর্ব____১৫
#কায়ানাত_আফরিন❤
কানের লতিতে আয়াতের ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে খানিকটা কেপে উঠলো মাইশা। অনুভূতিসমূহ যেন সবদিক দিয়ে ওকে গ্রাস করে ফেলেছে। ছেলেটার উষ্ণ নিঃশ্বাস আবছাভাবে মাইশার কাঁধের এক অংশ স্পর্শ করে চললো। পাথরের ন্যয় দাঁড়িয়ে আয়াতের সেই ভুবনভুলানো কথাগুলো মাইশা স্মৃতিচারণ করে চলছে।এতটা মধুময় কেনো আয়াতের প্রতিটি কথা? মাইশাকে এতটা হতভম্ব তে দেখে তীর্যক হেসে ওর কাছ থেকে সরে আসলো আয়াত।
চোখের প্রগাঢ় চাহিনী স্থির করে রেখেছে মাইশার বিচলিত মুখমন্ডলের দিকে।মাইশা কিছু বলতে যাবে তখনই আয়াত বলে ফেললো,

–”আর যেনো কাজে ফাঁকি না দিয়ে হাসাহাসি করতে দেখি তোমাকে ! যদি আমার কথার অমান্য করো , তোমারই লস ! আফটার অল ”আরহাম আয়াত” মানুষটাকে এখনও তুমি চিনোনা বেইব !”

এই বলে আয়াত গটগটিয়ে এখান থেকে প্রস্থান করলো। মাইশা এখনও নিজের মধ্যে নেই। এই ছেলেটার কথাবার্তায় এক জিনিস প্রকাশ করছে আর ভাবভঙ্গিমায় প্রকাশ করছে অন্যকিছু। দু’তিনবার লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে মাইশাও এখান থেকে চলে গেলো অডিটোরিয়ামের স্টেজের দিকে।

অদূরেই আনান-সামাদ-পৃথা-আর অর্পিকে বসে থাকতে দেখা গেলো। মূলত চারজন কোনো একটি জিনিস নিয়ে টানা হ্যাচড়া করছে। এদৃশ্য দেখে ভ্রু কুচকে এলো মাইশার। তিন চার কদম এগিয়ে বিস্ময়ের স্বরে ওদেরকে প্রশ্ন করলো,

–”কি টানা-হ্যাচড়া করছিস তোরা?”

সামাদ হাহাকার সুরে বললো,

–”মাইশা………..এই আনান আর অর্পিরে কিছু বল্। হারামী দুইটা ক্রেডিট কার্ড নিয়ে গেসে। এই ক্রেডিট কার্ড টা আমার না তোর………..”

সামাদের কথার মাঝেই আনান ব্যঙ্গসুরে বললো,

–”তোর মরা বউয়ের ক্রেডিট কার্ড হলেও আজ এইটা দিয়া আমি অর্পি আর পৃথা জমপেশ শপিং করুম। মাইশু ! এই সামাইদ্দার কথা বাদ দে তো। তুইও শপিং করবি নি বল্।”

–”এভাবে অন্য একজনের ক্রেডিট কার্ড দিয়ে শপিং করা ঠিক হবে না-রে। এটাতো সামাদের না।”

–”আরে না ! সামাইদ্দা মিথ্যা বলতেছে। মিয়া যেই কিপ্টা ! আমরা খরচ করুম দেইখা এমন কইতাসে।”

মাইশা ওদের এমন টানা-হেচাড়ামি দেখে না বিরক্ত হয়ে আর পারলো না। মলিন সুরে বললো,

–”তোরা তোদের কাজ কর্। আমি আমার কাজে গেলাম।”

এই বলে মাইশা স্টেজের এক কোণে স্ক্রিপ্ট লিখতে বসে গেলো। কিন্ত এত হৈ হুল্লোড়ের মাঝে স্ক্রিপ্ট লিখা এতটাও সহজ নয়। শাওন ওদিকে কয়েকজনকে লাইটিং এর ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছে আর আয়াত সবার কাজ বুঝিয়ে দিতে ব্যস্ত। আরও কিছু সিনিয়র স্টুডেন্টস আছে যারা আয়াত-শাওনের মতই সমানতালে কাজ করে চলছে। মাইশা সেদিকে একপলক চোখ বুলিয়ে কানে ইয়ারফোন গুজে গান শুনতে শুনতে লিখার জন্য ব‍্রতী হলো যাতে বাইরের কোনো ডিস্ট্রাকশন না আসতে পারে।

এদিকে আয়াত ক্লান্ত । প্রচন্ড কথা বলার সুবাদে গলা আর ঘাড় কেমন যেন ম্যাজ ম্যাজ করছে। কিন্ত এতকিছুর পরেও একটি কাজ অসম্পূর্ণ হয়ে রইলো। তা হলো ইভেন্টের স্ক্রিপ্ট। দায়িত্বটা ছিলো মাইশার কাছে। আয়াত নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় একবার এদিক সেদিক তাকালো কিন্ত মাইশাকে কোথাও দেখতে পেলো না।
বেশ কয়েকজনকে মাইশাকে ডাকতেও পাঠালো কিন্ত সবাই কাজের ব্যস্ততার জন্য আয়াতের কাজটি করে দিতে পারলো না। কপালে বিরক্তির ভাঁজ পড়লো আয়াতের। এই উড়নচন্ডী মেয়েটার অহেতুক কর্মকান্ড ধাপে ধাপে আয়াতকে যেন বিরক্তির চরম সীমানায় পৌঁছে দিয়েছে। শাওন তা দেখে বললো,

–”কি হলো ? এভাবে ফায়ার হয়ে আছিস ক্যান?”

–”আমরা কাজ করে কুল পাইতাসি না আর ওই জংলী বিড়ালটা লাপাত্তা হয়ে আছে। ”

–”গলার ভলিউম বাড়িয়ে একটা ডাক দে তো !”

–”তিনবার দিয়েছি। আবার সাউন্ড বাড়ালো লোকে তো আমারে আগেকার সালমান শাহ্ এর মুভির মতো প্রেমিক পুরুষ বলে দাবি করবে। শুধু পার্থক্য থাকবে একটাই ; মুভিটে ওইটা রোম্যান্স আর বাস্তবে তা গণধোলাই।”

হো হো করে হেসে উঠলো শাওন। আয়াত কড়া গলায় বললো,
–”আর হাসতে লাগবো না। আমিই মাইশারে খুঁজতে যাচ্ছি। এদিকটা তুই তিথিরে নিয়ে সামলে রাখ।”

বেশ কিছুক্ষণ হণ্য হয়ে মাইশাকে খোজাঁর পর। স্টেজের এক কোণে মাইশাকে দেখতে পেলো আয়াত। কানে ইয়ারফোন গুঁজে মেয়েটা একধ্যানে কিছু একটা লিখে চলছে । আয়াত এবার প্রচন্ড পরিমাণে ক্ষেপে গেলো। তড়িৎ গতিতে মাইশার কাছে গিয়ে একটানে ইয়ারফোন খুলে নিজের পকেটে ঢুকাতেই বড় বড় চোখ করে মাইশা তাকালো আয়াতের দিকে। আয়াতের নজরে স্পষ্ট ক্রোধ ভাবটা ফুটে উঠেছে। মাইশা বিক্ষিপ্ত সুরে বললো,

–”এ কেমন ধরনের অসভ্যতা? আমার ইয়ারফোন এভাবে খুলে নিলেন কেনো?”

আয়াত ওর কথায় পরোয়া না করে বললো,
–”আমি যে এতক্ষণ কাউয়ার মতো তোমায় ডাকছিলাম সে হদিস কি তোমার আছে?”

–”না তো?”

–”তা থাকবে কিভাবে? কানে তো বাঁশ ঢুকিয়ে রেখেছিলে?”

–”বাঁশ বললেন কেনো? এর দাম জানেন? গুণে গুণে ২৫০০ টাকা। গুলিস্তান থেকে নিয়েও দাম কম পড়েনাই।”

–”আই ডোন্ট কেয়ার অ্যাবাউট ইটস প্রাইস। তোমাকে কখন থেকে ডেকে চলছি এর খবর রাখো? সব কাজ শেষ জাস্ট তোমার স্ক্রিপ্ট দেখাটাই বাকি। আর তুমি? আরামসে গান শুনছো আর লিখছো?আল্লাহই জানে এইসব বোকার নাগরিক কই থেকে আমার মাথায় টপকে পড়ে?”

চুপসে গেলো মাইশা। আয়াতের ধমক খেয়ে আনমনে হাত কচলিয়ে যাচ্ছে। আয়াত আবার বললো,

–”এখন কি আমার সাথে যাবে নাকি পালকি করে নিয়ে যেতে হবে?”

–”যাচ্ছি তো?”

চোখ-মুখ ছোট ছোট করে মাইশা বললো। কেউ কি বলবে এই ছেলেটা গতকাল বৃষ্টি-বাদলের দিনে কতগুলো প্রেমের কথা শুনীয়েছিলো? আর আজ তো পুরাই রূপ পাল্টে নিয়েছে ছেলেটা। আয়াতের পিছে পিছে মাইশা স্টেজ থেকে নেমে সেই জায়গাটিতে গেলো যেখানে আয়াত সব কাজকর্ম করেছিলো। একটা চেয়ার নিয়ে মাইশার মুখোমুখি বসলো আয়াত। মাইশা তখনও কাগজগুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আয়াত গহীন স্বরে বললো,

–”পড়া স্টার্ট করো। শুনি একটু তোমার পুচকে মাথায় কি এসেছে?”

আয়াতের কথায় মাইশার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। এতক্ষণ চুপ থাকলেও মন যেন আর সায় দিচ্ছে না। তাই কিছুটা ক্ষোভের সাথে স্ক্রিপ্ট পড়া শুরু করলো। শাওন তা দেখে বললো,

–”আরে আস্তে আর ঠান্ডা মাথায় পড়ো ম্যাডাম? তোমার থ্রেডস্টাইলে স্পিচ শুনে অতিথিরা তো লুঙ্গি মাথায় নিয়ে পালাবে।”

–”আমি জানতাম ওরে দিয়ে এসব হবেনা। এই মেয়ে তো থাপড়া-থাপড়ি আর ঝগড়াঝাটি করতেই ওস্তাদ !”

এতক্ষণের সব পুষে থাকা রাগ আর রাখতে পারলো না মাইশা। রাগের বসে কাগজ ছুঁড়ে ফেলে আয়াতকে বললো,

–”আপনি জানেনই বা কি আমার ব্যাপারে?তিন বছর ধরে আমি ভার্সিটর ইভেন্টে প্রেজেন্টেশন করছি আর আমারে দিয়ে এসব হবেনা আপনি বলছেন?হ্যা , মানছি যে আপনি রেডিওতেও জনপ্রিয় একজন উপস্থাপক তাই বলে এই না যে আমার কাজ খারাপ।”

হঠাৎ আয়াতের সাথে এভাবে রুড বিহেভ করাতে সবাই সেদিকে নজর দিয়ে দিলো। আয়াত শক্ত চোখে তাকিয়ে আছে মাইশার দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–”বিহেভ ইউরসেলফ মাইশা ! ”

মাইশা বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে আয়াতের ব্যবহারে। ছেলেটা সবার সামনে দেখায় যে মাইশার ওর কোনো সম্পর্ক হতেই পারে না তবে আসলে ভেতর ভেতর অন্যকিছু।মাইশার শুধু এটাই মনে হচ্ছে যে আয়াত ওর দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে। এগুলো ওর মোহ ছাড়া আর কিছুই না। মাইশাও দৃঢ় গলায় বললো,

–”সরি ! মিঃ আরহাম আয়াত। আমি পারছিনা নিজেকে কন্ট্রলে রাখতে। আমি গেলাম। আপনার কাজের জন্য অন্যকাউকে নিতে পারেন।”

–”কাজ তো তোমাকেই করতে হবে।”

–”আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপনি জোর করার ট্রাই করছেন?”

–”ইয়াহ্”

দুজনের মধ্যে এমন ভয়ঙকর সংঘর্ষ দেখে শাওন আয়াতকে শান্ত হতে বললো। এদিকে অর্পিও মাইশাকে বলছে,” দোস্তোওও। কুল ডাউন।”

কিন্ত কে শোনে কার কথা। গতকালও যেই চোখে অনুভূতির খেলা ছিলো আজ সেখানে প্রকাশ পাচ্ছে একরাশ ক্ষোভ।আয়াত বাকা হেসে এগিয়ে এলো মাইশার দিকে। মিহি গলায় বললো,

–”যতই রাগ দেখাও না কেনো? ধরা তো আমার কাছে দিতেই হবে !”

কথাটা আয়াত এমনভাবে বললো যে মাইশা ছাড়া আর কেউই শুনতে পারলো না।মাইশা এবার দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–”নির্ঘার্ত ক্যাম্পাসে দেখেই কিছুই বললাম না। নাহলে যা শুধু করেছেন না ; এমন এক থাপ্পড় দিতাম এই গাল আর গাল থাকতো না……..ফুটবল মাঠ বানিয়ে ফেলতাম । লুচুবাঘ কোথাকার !”
.
.
.
.
.
~চলবে……….ইনশাল্লাহ