হৃদমাঝারে তুমি ছিলে পর্ব-১৬

0
501

#হৃদমাঝারে_তুমি_ছিলে ❤️
#পর্ব_১৬
#কায়ানাত_আফরিন

নিজের ঠোঁটজোড়া চেপে একপ্রকার ঠায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মাইশা। সবকিছু মিলিয়ে কেমন যেন একটা বিভ্রান্তিকর অস্থিরতা।
মাইশার কথায় আয়াত ভ্রুক্ষেপ না করে সিটি বাজাতে বাজাতে চলে গেলো বাইরে। যাওয়ার আগে অবশ্য শাওনকে বলে গিয়েছে যে এখন মাইশার সাথে কথা কাটাকাটি করার মুড ওর একেবারেই নেই। এ কথা শুনে মাইশাও রেগে গজগজ করতে করতে আয়াতের পিছু পিছু যাচ্ছে। একপর্যায়ে বলেই ফেললো,

“এভাবে চলে যাচ্ছেন কেনো আমার কথা না শুনে?”

আয়াত মাইশার এ কথা শুনে পেছনে ঘুরে দাড়ায়। ঠোঁটের কোণে ঝুলে আছে দুষ্ট হাসি। মাইশা সরু চোখে আয়াতের দিকে তাকিয়ে আছে। আয়াত হালকা ঝুকে মাইশার মুখের কাছাকাছি এসে বলে,

” তো কি শুনবো তোমার কথা? আমার সাথে বয়ফ্রেন্ড-গার্লফেন্ড টাইপ কথা বলবে নাকি?”

“ইসসস! শখ কত! আমার তো যেনো আর কাজ নেই।”
মাইশার বিদ্রুপ কন্ঠ।

আয়াত আলতো হাসে। মাইশার মুখের কাছাকাছি খানিকটা ঝুঁকে থাকার কারনে সেই হাসিটি মাইশার কাছে অমায়িক মনে হলো। ছেলেটার হাসি এত মারাত্মক কেন? এক হাসিতে মুহূর্তেই যে কাউকে ঘায়েল করে দেওয়া যাবে।

“তো তোমার কোনো কথা না থাকতে পারলে আমি কি যেতে পারি? আর যদি কথা থাকে তো বলো, হাতে হাত ধরে পার্ফেক্ট কাপলের মত দুষ্ট মিষ্টি কথা বলবো। কি বলো?” (চোখ টিপে)

মাইশা সাথে সাথে দু কদম পিছিয়ে যায়। মুখে রয়েছে প্রচন্ড পরিমানে অস্বস্তি আর বিভ্রান্তি। আয়াত কিছু না বলে মুচকি হেসে মাইশাকে পাশ কাটিয়ে মুখে শিষ বাজাতে বাজাতে চলে গেলো। মাইশা একবুক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আয়াতের এভাবে চলে যাওয়াতে। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,

“মাইশা?”

সাথে সাথেই পেছনে ঘুরে মাইশা যা দেখলো তা দেখে অবাক না হয়ে আর যেনো পারলো না। ঠা ঠা রৌদ্রময় দিনের এ সময়ে ভুল দেখছে না-তো? কেননা অদূরেই নুহাশ দাঁড়িয়ে আছে৷ হঠাৎ মাইশার মনে এক অজানা শঙ্কা হলো। কেননা একটু আগেই আয়াত ওর সাথে মোটামুটি ঘনিষ্ঠ হয়েই কথা বলেছিলো। এটা কি তবে নুহাশ ভাই দেখে ফেলেছে?

ভাবতেই মাইশার মুখশ্রী ক্রমশ যেন শুকিয়ে এসেছে। নুহাশের চোখ-মুখে কেমন যেন শক্ত আভা। আমতা আমতা করে ভাইয়া বললো,

“ভ-ভাইয়া? ত-তুমি?”

“এখানে একা একা দাঁড়িয়ে কি করছিস?”

মাইশা বুঝলো যে নুহাশ আয়াতকে দেখেনি। এটা ভেবেই মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে নিলো। তারপর মেকি হাসি দিয়ে বললো,

” কিছুনা। এভাবেই দাঁড়িয়ে আছি।”

“সামাদ কোথায়? ”

” সামাদ অডিটোরিয়ামের ভেতরেই আছে। কিন্ত কেনো?”

“মানে? সামাদ তোকে কিছু বলেনি?”

” না– তো! কি বলবে আমাকে?”

কপালে বিরক্তির ভাজ পড়লো নুহাশের। এমনিতেও আজ ফর্মাল স্টাইলে না থাকা সত্বেও প্রচন্ড গরম লাগছে আবার সামাদ মাইশাকে কিছুই বলেনি দেখে বিরক্তিটা আরও যেন চরম সীমায় চলে গিয়েছে। চুলগুলো কপালের একপাশে গুছাতে গুছাতে বললো,

” আনানের সাথে থাকতে থাকতে সবগুলা দায়িত্বহীন হয়ে যাচ্ছে। ”

নুহাশের কথা শেষ হতে না হতেই এক এক করে আনান, সামাদ, অর্পি, পৃথা সবগুলো অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে ওদের কাছে দাঁড়ালো। সামাদকে দেখেই নুহাশ বললো,

” তোমায় না বলেছিলাম ক্রেডিট কার্ডটা মাইশার কাছে দিতে? দিয়েছো?”

নুহাশের বিক্ষোভ কন্ঠ। সামাদের আত্না যেন শুকিয়ে গিয়েছে এমন কন্ঠ শুনে। কিন্ত আজ ভয় পেলে চলবে না। এই আগ্নেয়গিরিটা দিয়ে আনানকে প্যাদানি দেওয়ার মত ভয়ংকর বাসনা জেগেছে ওর মনে। তাই কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখর চেষ্টা করে বললো,

” না ভাইয়া। আমি দিতে চেয়েছিলাম। তবে আনান বললো ক্রেডিট কার্ডটি ও নিজের কাছে রাখবে। তারপর জমপেশ শপিং করবে। এটাই তো বলেছিলি। তাই না আনান?”

সামাদের কথা শুনে আনানাের প্রাণপাখী ফুড়ুৎ করে যেন উড়ে গেলো। সামাদকে ফিসফিস করে বললো,

” শালা! আমারে আগে কস নাই ক্যান যে এই কার্ডটা এই নুহাশ ব্যাটার?”

“আমি তো বলতেই চাইছিলাম। তুই কি শুনলি?”

মুখে শয়তানি হাসি চেপে সামাদ বললো।আনানের এবার কাঁদো কাঁদো অবস্থা। তবুও মনে করুনা চেপে বললো,

” তোর বেইমানি আমি কষ্মিককালেও ভুলুম না। আজকে চুপ থাকলাম। তবে সময়মতো ঠিকই এর শোধ নিয়া ছাড়মু আমি।”

আনান আর সামাদের ফিসফিসানো কথার মাঝেই নুহাশ এবার বললো,

“এভাবে ফিসফাস করে কোন প্রেমের কথা তোমরা দুইজনে বলছো আমিও একটু শুনি?”

“কিছু না ভাই।”
সামাদের মুখে ঝুলে আছে মেকি হাসি। নুহাশের এবার ইচ্ছে করছে এই দুইটাকে ঠাটিয়ে দুইটা চড় মারতে। তবেই এদের আক্কেল ঠিকানায় আসবে। নুহাশ কোনোমতে নিজেকে শান্ত করে বললো,

“সামাদ! তোমাকে আমি বলেছিলাম যে কার্ডটা তুমি মাইশাকে দিবে। বাট তুমি তো অন্যকিছুই করলে।”

তখনই মাইশা বলে ফেললো,
“হঠাৎ ক্রেডিট কার্ড? ”

” আম্মুর সাথে তুই শপিংয়ে যাবি তাই। অফিসে কাজ ছিলো বলে আমি ভেবেছিলাম যে আমি যেতে পারবো না। তখন রাস্তায় সামাদ কে পাই বলে ওকে বলেছিলাম কার্ডটা তোমায় দিয়ে দিতে৷ভাগ্যক্রমে অফিসে কাজ আজকে জলদি শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই তো এই গর্দেভ দুইটার কাহিনি দেখলাম।”

আনান বারকয়েক শুকনো ঢোক গিলে কার্ডটি এগিয়ে দিলো মাইশার কাছে৷ মিহি গলায় বলে ফেললো,

” নে তোর ভাইয়ের বক্ষের ধন। বাপ রে বাপ! বিয়ার পর তো নিজের বউরেও এমনে রাখবো না।”

“কিছু বললে?” ( নুহাশ)

আনার সাথে সাথেই বললো,
” মোটেই না ভাই। আমার কি এত সাহস আছে যে আপনার নামে কথা বলবো? আমরা তাহলে গেলাম ভাই। সুন্দরমত শপিং কইরেন। আসসালামু আলাইকুম। ”

এই বলে একে একে সবগুলা চলে গেলো। নুহাশ এবার মাইচাকে বললো,

“গাড়িতে গিয়ে উঠ৷ আম্মু ওয়েট করতাসে আমাদের জন্য”

————————————

সন্ধ্যার দিকে বাইরে হালকা হালকা বাতাস। পথে ঘাটে ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে আলোতে ঢাকা যেন এক নতুন রূপ নিয়েছে। দু হাত ভর্তি ব্যাগ নিয়ে ক্লান্তি পায়ে শপিং মল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য উদ্যত হলো মাইশা। কিন্ত পারেনি। ওর আম্মু এবার নুহাশের জন্য পাঞ্জাবি কিনবে। মাইশা আর নুহাশ দুজনের মুখেই এবার বিরক্তির রেশ। কতক্ষণ ধরে এই দুই ভাইবোন আম্মুকে নিয়ে এই দোকান ওই দোকান বিচরণ করে চলছে এর যেন কোনো ইয়াত্তা নেই। এবার তাই নুহাশ ক্লান্তিমাখা মুখ করে বললো,

“আম্মু! আজ পান্জাবি কিনতে হবে না আমার জন্য। এখন বাসায় চলোতো!”

” ওমা! বলিস কি? দুদিন পর মেয়ে দেখতে যাবি আর পুরান পান্জাবি পড়বি? মোটেও না। চল তো আমার সাথে।”

অগত্যাই আম্মুর সাথে পান্জাবির দোকানে ঢুকে পড়লো নুহাশ আর মাইশা। বিভিন্ন আলোর সংমিশ্রণে চাকচিক্যময় পান্জাবির রংগুলো অনন্য লাগছে। মাইশা এদিক ওদিক একপলক চোখ বুলিয়ে নিলো। জেন্টস শো রুমে তেমন একটা আসা হয়না মাইশার। আর যদি কখনও আসে সেটা আনান-সামাদ আর আব্বুর সাথেই। নুহাশের সাথেও না। শারমিন বেগম ছেলের সাথে পান্জাবিগুলো একের পর এক দেখে চলছেন। মাইশা তা দেখে নজর সরিয়ে নিতেই হঠাৎ ওর চোখ পড়লো একটা ধূসর রঙের পান্জাবির দিকে। হলুদ আলোতে বুকের কাছের নকশাটি স্ফটিকের ন্যায় চিকচিক করছে। কেন যেন এই পান্জাবিটি দেখেই মাইশার মনে ভেসে উঠলো আয়াতের প্রতিচ্ছবি। এই পান্জাবিতে আয়াতকে আসলেই কোনো রাজপুত্র থেকে কম লাগবে না এটা ভাবতেই মিহি হেসে ওঠে মাইশা। মন আজকাল বড়ই অবাধ্য হয়ে ওঠেছে। না চাইতেও বারবার যেন আয়াতের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে।

“মাইশা! চল এখন। ”

নুহাশের গলা শুনে মাইশা নুহাশের দিকে তাকালো। মিহি কন্ঠে বললো,

” কেনা শেষ? ”

” হ্যাঁ…….”

” চলো তাহলে।”

ব্যাগ নিয়ে সবাই ইতিমধ্যে শপিং মল থেকে বের হয়ে গিয়েছে। আম্মু-মাইশা-নুহাশ তিনজনই নিজেদের মধ্যে কথা বলতে ব্যস্ত। হঠাৎ ভীড়ের মধ্যে একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা যে কখন মাইশার সামনে এসে পড়লো মাইশা তা টের পায়নি। ঘটনাচক্রে নিচে পড়ে গেলো মহিলাটি। মাইশা হাটু গেড়ে সাথে সাথেই সেই মহিলাটিকে ওঠানোর জন্য উদ্যত হলো। কাতর কন্ঠে বলে ওঠলো,

” আই এম এক্ট্রেমলি সরি আন্টি! আপনি যে কখন আমার সামনে এসে পড়লেন আমি টেরই পাইনি।আমার হাত ধরে উঠুন।”

এদিকে সেই মহিলার সাথে মাইশার আম্মুর চোখাচোখি হতে দুজনেই যেন স্তব্ধ হয়ে গেলো। টলমল করছে তাদের চোখজোড়া। মাইশা হঠাৎ কেমন যেনো বোকা বনে গেলো।এই মহিলাটি কি তবে ওর আম্মুর পূর্বপরিচিত? শারমিন বেগম কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,

“আপা?”

নুহাশের বুক ধক করে উঠলো। নিজের আম্মুর কথা শুনে একটু হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে র‍্যে এই মহিলাটি কে হতে পারে। এটাই কি তবে সেই খালামনি যার সাথে আব্বুর ভুল বোঝাবুঝির জন্য এত বছর সম্পর্কহীন ছিলো? নুহাশ বড় বলে আবছা আবছা জানে এই ব্যাপারে যে এই খালামনি আর উনার পরিবারকে আব্বুজান ঘৃণা করে। এমনকি আম্মু যদি উনাদের সাথে যোগাযোগও করে তবে আব্বু আম্মুকে তালাক দিতেও ভাববে না। নুহাশ সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে এবার মাইশার দিকে তাকালো।মাইশা এ ব্যাপারে কিছুই জানে না বিধায় সবকিছু যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে।মনে মনে যেন প্রশ্ন জাগছে,

” কে এই মহিলাটি?”
.
.
.
.
চলবে…..ইনশাল্লাহ