হৃদমাঝারে তুমি ছিলে পর্ব-১০

0
514

#হৃদমাঝারে_তুমি_ছিলে❤
#পর্ব_১০
#কায়ানাত_আফরিন❤

দৃষ্টি নামিয়ে নিচের ঠোঁটটি গভীরভাবে চেপে ধরলো মাইশা।বুকের ধুকধুকানি ক্রমশ যেন বেড়েই চলছে। আর বাড়বেই না বা কেনো? নিজের কল্পনার পুরুষকে হুট করে যদি কেউ নিজের ক্লাসে দেখে ফেলে সেক্ষেত্রে এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আনান, অর্পি, সামাদ , পৃথা সবাই ক্লাসে বসে শফিক স্যারের পাশে দাঁড়ানো শাওন আর আরহাম আয়াতের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। এমনকি বাকি স্টুডেন্টরাও। এমন নজরকাড়া একজন ছেলেকে হুট করে ক্লাসরুমে দেখে তোলপাড় শুরু হবে এটাও স্বাভাবিক। যদি সে পাবলিক ফিগার হয়, তবে তো আর কথাই নেই।

শফিক স্যার একটু কাশি দিলেন। তারপর সবার উদ্দেশ্যে বললেন,

–”এটেনশন প্লিজ ! আজ জরুরি কিছু কথা নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি স্টুডেন্টস । আমার সাথে যেই দুইজন দাঁড়িয়ে আছে তাদেরকে আপনারা চিনেন?”

সবাই জোর গলায় উত্তর দিলো, ”হ্যাঁ !”

শফিক স্যার বললেন,

–”তবুও অনেকে না চিনে থাকলে ওদের পরিচয় দিয়ে দেই। আরহাম আয়াত এবং শাওন চৌধুরি। দুজনেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে পড়াশোনা করছে। কিছুদিন পরই মাস্টার্সের এক্সাম দিবে। তবে আরহাম আয়াতের আরও একটি পরিচয় আছে , গতবছর ”All about travel” নামের লন্ডনের বিখ্যাত ম্যাগাজিনে ওর ট্রাভেল স্পর্কিত ভিডিও নিয়ে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। সেই সুবাদে এখন ঢাকার বিখ্যাত রেডিও প্রতিষ্ঠানে RJ হিসেবে কর্মরত ।
আর ওর সকল কাজের background helper হলো শাওন। ভিডিও এডিট থেকে শুরু করে ওর ট্রাভেল পার্টনার হিসেবে কম জনপ্রিয় নয়। (শাওনের দিকে তাকিয়ে)ঠিক বললাম তো?”

–”জ্বী স্যার !”
শাওন মুচকি হেসে জবাব দিলো।

মাইশা কিছুটা শঙ্কা নিয়ে ওদের দিকে তাকালো। অনুভূতি, আবেগ, পরিস্থিতি সবকিছু মাথায় যেন তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। আয়াত এখানে কি করছে এটাই ওর বোধগম্যে যেনো এলো না। শফিক স্যার এবার বললেন,

–”আগামী সপ্তাহে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি fest এর আয়োজন করা হবে। আর আমাদের নিমন্ত্রন করা হয়েছে সেই অনুষ্ঠানে। তাই সেখানের অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য প্রত্যেক ডিপার্টমেন্ট থেকে একজন স্বচ্ছাসেবীকে নেয়া হবে। তোমরা কেউ কি ইচ্ছুক?”

পুরো ক্লাস নীরব। এরমধ্যে একজন ছেলে বললো,
–”কিন্ত স্যার আমাদের গাইড কে করবে?”

–” প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টেই জাহাঙ্গীরনগর ভারস্িটির দুজন সিনিয়র স্টুডেন্টকে তত্তাবধানে দেয়া হবে। তোমাদের ডিপার্টমেন্টেও তেমনি ওরা দুইজন গাইডে থাকবে।”

অবাকের রেশটি আরও বিস্তৃতভাবে দেখা গেলো মাইশার চোখে-মুখে। স্যারের কথাগুলো যেনো কোনোক্রমেই মেনে নিতে পারছেনা। আয়াতের সাথে এভাবে মিরাকেলের মতো বারবার দেখা হয়ে যাওয়াটা যেন মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে মাইশার।স্যার আবারও বললেন,

–”তোমাদের মধ্যে উপস্থাপনা ভালোমতো কে করতে পারে?”

স্যার এই প্রশ্ন করার সাথে সাথে জুটি বেধে সবাই বলে ফেললো মাইশার নাম। কেননা ভার্সিটির প্রথম বছর থেকে এই পর্যন্ত অত্যন্ত নিপুণতার সাথে এই দায়িত্ব বেশ ভালোমতো পালন করেছে ও। কিন্ত আজ মাইশা যেন আয়াতের মুখোমুখি এসে বোকা বনে গিয়েছে। নিজের নাম সবার মুখে এভাবে নুপুরের মতো বেজে ওঠাতে অস্বস্তি নিয়ে তাকালো সবার দিকে। একপলক আয়াতের দিকেও চোখ বুলিয়ে নিলো।

কিন্ত আয়াত নির্বিকার। ঠোঁটদুটো চেপে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন এইসময় মাইশার দিকে মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকালে বড়সড় কোনো রাস্ট্রদ্রোহী হয়ে যাবে। শফিক স্যার মাইশার উদ্দেশ্যে বললো,

–”আপনি অবশ্যই যুক্ত হবেন মিস মাইশা। আপনার উপস্থাপনার দক্ষতা ভালো। ”

মাইশা আমতা আমতা করে বললো,

–”কিন্ত স্যার আমি ইচ্ছুক না।”

–”কেনো জানতে পারি।”

শফিক স্যারের ভারক্রান্ত কন্ঠ। মাইশা মিহি গলায় বললো,

–”এভাবেই !”

–”কারন না বললে তো হবে না। আপনার উপস্থাপনার গুণ আছে। তাহলে কাজে লাগাতে চাচ্ছেন না কেনো? আমি এ ব্যাপারে কোনো না শুনবো না। আর কিছু বলবেন?”

–”নো স্যার !”

–”আর কেউ যদি স্বেচ্ছাসেবী হতে ইচ্ছুক ভার্সিটির অডিটোরিয়াম রুমে যাও। সেখানে তোমাদের কাজ বুঝিয়ে দেয়া হবে।”

ইচ্ছুক সবাই একে একে ক্লাস থেকে বের হয়া শুরু করলো। এমনকি মাইশাও। আড়চোখে একবার আয়াতকে দেখে নিলো মাইশা। আয়াত শাওনের সাথে কোনো গুরুত্ব পূর্ণ আলাপনে মশগুল আছে।মাইশা যতবারই চায় আয়াত থেকে দূরে থাকতে ঠিক ততবারই যেনো পরিস্থিতি আয়াতের সাথে পরিচয় করে দিতে থাকলো। সময়ের তালে ক্রমশই তা যেন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে।

—————————————-

অডিটোরিয়ামে ছটফট করে এদিক ওদিক বিচরণ করছে মাইশা। উদ্দেশ্য শাওন আর আয়াতের সাথে দুদন্ড কথা বলা। অডিটোরিয়ামে রীতিমতো ১৫-২০ জনের ভীড় হয়ে গিয়েছে কিন্ত ওই মহান দুই গুণোধর ব্যক্তির কোনো হদিস নেই। সেই যে টিচার্স রুমে ঢুকেছে, আর বের হলো না। আনান ক্যাবলার মতো স্যান্ডউইচ খেতে খেতে একবার মাইশার দিকে তাকাচ্ছে তো একবার ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে অডিটোরিয়ামের দরজার দিকে তাকাচ্ছে। মেয়েটাকে এতটা অস্থির হয়ে দেখে এবার আনান বলে ফেললো,

–” কি হইসে তোর? এভাবে শুয়োপোকার মতো ছটফট করছিস কেনো?”

–”লুইচ্চার বদনাটার জন্য।”
বিড়বিড়িয়ে বলে ফেললো মাইশা। আনান অপ্রস্তুত হয়ে বললো,

–”কি বললি?”

–”ম-মানে………………আয়াত ভাইয়ের জন্য ওয়েট করছিলাম?”

–”কেনো ? আবারও চড় দিবি নাকি?”

আনানের কথায় বিরক্ত হলো মাইশা। এই শালা হারামিটা সবসময়ই মাইশার মুডটা নষ্ট করার জন্যই উঠেপড়ে থাকে। প্রসন্ন গলায় বললো,
–না………..রে। আমি উপস্থাপনা করবো না। এটা বলার জন্য।”

ওদের কথার মাঝেই কাগজপত্র নিয়ে ছুটে চলে এলো আয়াত আর শাওন। সবাই তো রীতিমতো হা করে তাকিয়ে আছে সেদিকে। আয়াতের ফর্মাল গেটআপটা এককথায় মারাত্নক।তাই বলে শাওনকেও কম সুন্দর দেখাচ্ছে না। যদিও শাওনের তুলনায় আয়াতের গায়ের রঙ কিছুটা চাপা তবুও দুজনের সৌন্দর্যই রীতিমতো যেন প্রতিযোগিতায় ছুটে চলছে।মাইশাও বেক্কলের মতো সেই দৃশ্যে ডুবে যেতে মগ্ন।কোনোরকম নিজের মাথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সব মাইয়াই যে যার জায়গায় হ্যাং মেরে দাঁড়িয়ে আছে। অক্ষিকোটর থেকে চোখ যেন এবার উপচে ফ্লোরে পড়ে যাবে।আনান বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠলো,

–”হালা মাইয়াগুলার চোখ তো একটুপর পইড়া যাইবো এমনে পেত্নীর মতো তাকিয়ে থাকলে। এগুলি সব মর্গে বিক্রি করতে হইবো।”

আয়াত অডিটোরিয়ামের মাঝখানে চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসলো। একপলক সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বললো,
–”একে একে সবাই লাইনে দাঁড়াও। তোমাদের কাজ বুঝিয়ে দেয়া হবে।”

আয়াত এমনভাবে কথাটি বললো যেন মাইশা যে এতক্ষণ ক্যাবলার মতো ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো সেদিকে ওর কোনো নজর নেই।ছেলেটার এটিটিউট দেখে মাইশার মাথা চক্কর দিয়ে ওঠলো। এমনিতেতো মাইশাকে কম জ্বালান জ্বালায়নি এবার অ্যাটিটিউডের জ্বালায় যেন মাইশা পাগল বনে যাচ্ছে।এদিকে আনান রীতিমতো মাইশাকে গুতিয়েই চলছে। তাই এবার আনানের হাতে খামচি দিয়ে বলে ওঠলো,

–”কি হইসে তোর?”

–”মাথায় কি গান্জা ঢুকাইছোস তুই? একটু আগে না কইলি আয়াত ভাইরে না বলবি কাজের জন্য এখন পায়ে গিট্টু লাগাইয়া রাখছোস ক্যান?”

মাইশা বিড়বিড়িয়ে বললো ,”তাইতো !” । ব্যাগটা কোনোরকম কাধে চেপে দ‍্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো আয়াতের দিকে। অ্যারোগেন্ট এই ছেলেটা শাওনের সাথে কথাবার্তা চালিয়ে সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিতে মগ্ন। আহা কি মারাত্নক ওর ভাবভঙ্গি। মাইশা আবারও যেন ঘোরে পড়ে গেলো। এই ছেলেটাকে এত মনে ধরে কেনো ওর? আয়াতের পাশে দাঁড়ানো শাওনও তো কম সুন্দর নয়। আনান কমেডি কিং হলেও ওর সৌন্দর্যও মেয়েকে ভাবুক করে তুলবে। তবে আয়াতকে নিয়ে ওর মনে এত কল্পনা কেন?

কল্পনাটা পানি দিয়ে গিলে ফেললো মাইশা। এই পাবলিক ফিগারের সৌন্দর্যের মায়ায় পড়া যাবে না। ছেলেটাকে না দেখে রেডিওতে জাস্ট ওর কন্ঠ শুনেই হাজার মেয়েরা মরিয়া হয়ে গিয়েছে সেদিকে মাইশাতো জাস্ট তুচ্ছ বিন্দু।মন আর প্রাণকে জোড় করে বোঝালো,

–”আয়াত জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট । অন্যকিছু না !”

হালকা পায়ে ওদের সামনে দাঁড়ালো মাইশা। শাওন তা দেখে হেসে বললো,
–”আরে মাইশা নাকি? দেখ আয়াত ! সকাল সকাল তোরে চড় মারতে চলে এসেছে।”

–”ওরে বলে দিও আমি কোনো জংলী বিড়ালরে কোলে তুলি নাই।”
আয়াত নির্বিকার ভাবে মাইশার দিকে না তাকিয়ে বলে ফেললো। শাওন আর আয়াতের কথোপকথন শুনে মাইশা শুকনো ঢোক গিলে। দুইটাই বদমাইশের হাড্ডি। না জানি কি পরিকল্পনা করছে। আয়াত আবার বললো,

–”তো এভাবে দৌঁড়ে আসছিলে কেনো? কুকুর তাড়া দিয়েছিলো নাকি?”

আয়াতের ঠোঁট নাড়ানোটা অদ্ভুত সম্মোহনীতে ফেলে দিলো মাইশাকে।এতক্ষণের সব পরিকল্পনা মাথায় তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলে মাইশা তৎক্ষণাৎ বললো,

–”আমি উপস্থাপনা করবো না।”

আয়াতের মুখ লাল হয়ে উঠে মাইশার কথা শুনে। এই মেয়েটার এসব হুটহাট অদ্ভুত কাজগুলো ওকে বিরক্তির চরম শীর্ষে পৌঁছে দেয়। ইশারায় অডিটোরিয়াম সবাইকে খালি করতে বললো।
–”আগামীকাল সেম টাইমে সবাই এখানে হাজির হবে প্লিজ। আজ আর নয়।”

শাওনের একথা শোনামাত্র শাওন সহ সবাই এক এক করে অডিটোরিয়াম ছেড়ে চলে যায়। এখন এখানে শুধু মাইশা আর আয়াত। মাইশা চোখ-মুখ খিচে আয়াতের লাল হওয়া মুখপানের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্ত আয়াত এভাবে রেগে গেলো কেনো এ কথায়? মাইশা ভেবে কূল-কিনারা পেলো না।

–”উপস্থাপনা কেন করবেনা জানতে পারি কি?”

ঠোঁটদুটো হালকা নাড়িয়ে বলে ফেললো আয়াত। মাইশা এবার ঘোরে চলে গিয়েছে। আয়াতের লাল হয়ে যাওয়া গাল-নাক, হালকা ভেজা ঠোঁটজোড়া , বাতাসের তালে ওড়া কোমল চুলগুলো ওকে মোহে ফেলে দিচ্ছে।

মোহনীয়তার ঘোরে অবশেষে বলে ফেললো,
–” আপনার গালের জন্য। আগে থাপ্পড় দিতে মন চাইতো এখন খালি চুমু দিতে মন চায়।”

বলেই মুখ চেপে ধরলো মাইশা। হায় আল্লাহ ! ঘোরে কি বলে ফেললো এটা?আয়াত ফ্যালফ্যাল করে মাইশার চোখে-মুখে তাকিয়ে আছে। হয়তো এতটা হতভম্ব জীবনে কখনও হয়নি আয়াত। অবাকপ্রসন্ন গলায় বলে উঠলো,

–কি বললে?

.
.
.
.
.
~চলবে…………ইনশাল্লাহ
সবার মতামত জানতে চাই। কেমন হয়েছে জানাবেন প্লিজ !