হৃদমাঝারে তুমি ছিলে পর্ব-১১

0
499

#হৃদমাঝারে_তুমি_ছিলে❤
#পর্ব__১১
#কায়ানাত_আফরিন❤
–” আপনার গালের জন্য। আগে থাপ্পড় দিতে মন চাইতো এখন খালি চুমু দিতে মন চায়।”

বলেই মুখ চেপে ধরলো মাইশা। হায় আল্লাহ ! ঘোরে কি বলে ফেললো এটা?আয়াত ফ্যালফ্যাল করে মাইশার চোখে-মুখে তাকিয়ে আছে। হয়তো এতটা হতভম্ব জীবনে কখনও হয়নি আয়াত। অবাকপ্রসন্ন গলায় বলে উঠলো,

–কি বললে?

পরিবেশটা মাইশার কাছে ভয়ঙ্কর রকমের বিভ্রান্তিকর। মন-মস্তিষ্ক কাজ করা যেন অস্বাভাবিকভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নিজেকে ধিক্কার জানালো মাইশা। ঘোরে এই কথাটা না বললে কি হতো না?আয়াত আবারও মাথা টা হালকা বাকিয়ে বললো,

–”তুমি কি ‘চুমু’ টাইপ সামথিং কিছু বললে?”

লজ্জার সাগরে ক্রমশই তলিয়ে গেলো মাইশা। সবদিক দিয়ে আয়াত নামক অনুভূতির বেড়াজাল যেন ওকে গ্রাস করে ফেলেছে। আয়াতের এখনও সেই হতভম্ব চাহিনী। যেন মাইশার গালে চুমু দেওয়ার মতো সাড়াজাগানো কথাগুলো কোনোক্রমেই বিশ্বাস করতে পারছে না। মাইশা কোনোক্রমে আমতা আমতা করে বললো,

–”আমি উপস্থাপনা করবো না ব্যস !”

–”এইটাই বলো। আর আমি কি-না কি শুনলাম। (বিড়বিড়িয়ে) চুমু দিতে মন চায় আমার গালে? লাইক সিরিয়াসলি !

শেষের কথাগুলো আয়াত বিড়বিড়িয়ে বললো বিধায় মাইশা শুনতে পারলো না ভালোমতো। তাই মিহি কন্ঠে বললো,

–”কিছু বললেন?”

–”না………..কিছুনা। তবে তোমাকেই অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করতে হবে। কোনো এক্সকিউজ আমি শুনবো না। (মাইশার মুখের কাছে এগিয়ে)এমনকি আমি রিলেটেড এক্সকিউজও না। বুঝেছো ?”

হুট করে আয়াতের এভাবে এগিয়ে আসাতে মাইশা দু কদম পিছিয়ে এলো। আয়াতের এভাবে হুটহাট কাছে আসাতে ওর মনে হয় যে বুকে বোধহয় ক্রমাগত কেউ হাতুড়ি পিটাচ্ছে। আয়াতের নির্বিকার দৃষ্টি এখনও মাইশার দিকে। আয়াত আবার বললো,

–”আজ কোনো কাজ করবে না। এই টাইমেই আবার অডিটোরিয়ামে এসে পড়ো। এখন যেতে পারো।”

আয়াত বলামাত্রই মাইশা ব্যাগ নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো অডিটোরিয়াম থেকে। আকাশটা আজ মেঘলা। ক্যাম্পাসের সকল প্রান্তেই কিছু মানুষ জুটি বেধে আড্ডা দিচ্ছে। বেশিরভাগের মধ্যেই আলোচনা হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বিশাল ইভেন্ট নিয়ে। অনুষ্ঠানটি যে বেশ বড় রকমের হবে এ নিয়ে কোনো ক্রুটি নেই। শোনা গিয়েছে অনেক নামিদামি ব্যক্তিবর্গরা থাকবে সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে।তা না হলে কি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্বাবিদ্যালয়ের সিনিয়র স্টুডেন্টসরা অন্য ভার্সিটির জুনিয়র স্টুডেন্টসদের গাইড করতো?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাইশা। প্রকৃতি অদ্ভুত নিয়মেই ওর সাথে খেলা করে যাচ্ছে। একটু আগে নিজের বোকানিমূলক কথাগুলো মনে করে মিনমিনিয়ে হাসছেও বটে। এতটা খামখেয়ালী হলে কি চলে? আজ তো মুখ ফসকে চুমুর কথা বলে দিয়েছিলো। আল্লাহই জানে সামনে কি না কি করে বসবে।

–”মাইশু?”

মেয়েলি কন্ঠ শুনে ধ্যান ভাঙল ওর। অর্পি কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো একপাশে তুলি দিয়ে আটকানো। ফর্সা মুখে চিকন ফ্রেমের হাই পাওয়ারের চশমা।এতেই মেয়েকে কোনো অপ্সরী থেকে কম মনে হচ্ছেনা। মাইশা স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় সেপানে এগিয়ে গেলো অর্পির দিকে। অর্পি এবার বলে ওঠে,

–” জানু ! তুই কত্ত লাকি। আরহাম আয়াতের আন্ডারে তুই কাজ করবি। আবার উনার সাথে আছে চকলেট বয় শাওন চৌধুরি । দুইটার রূপই যেন মুক্তার মতো ঝরে পড়তেছে। আগে জানলে আমিও উপস্থাপনা করতাম। তবে তো আর এই সুযোগ মিস করতে পারতাম না।”

–”কি সুযোগ?”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো মাইশা।

–”এই চার্মিং বয় দুইটার সাথে ফ্লাটিং করার সুযোগ । তুই অডিটোরিয়াম থেকে সুস্থ হয়ে আসলি কিভাবে? এমনিতেও সেই রাতে এদের ট্রেনে দেখে বড়সড় হার্টব্রেক করছিলাম এবার তো অজ্ঞান হয়ে মরেই যেতাম !”

মাঝে মাঝে অর্পির খাপছাড়া কথাগুলো শুনলে মাইশার মন চায় এই মেয়েটাকে ইচ্ছেমতো ড্রেনের পানিতে চুবাতে। কিন্ত অডিটোরিয়ামের কথাগুলো মনে পড়তেই কেমন যেন ওকে আর চুবাতে ইচ্ছে হলো না মাইশার। একটা মেকি হাসি দিয়ে বললো,

–”ফুচকা খাবি?”

–”তো? এটা কি আর বলতে হয়?”

–”তো চল তাহলে।”

মেঘাচ্ছন্ন আকাশের সমানতালে উড়ে চলছে মোহময় হাওয়া। ক্ষণে ক্ষণে নাম না জানা ফুলের অপূর্ব ঘ্রাণ। কানের কাছে সুরের মতো একটু পর পর ধেয়ে আসলো রিক্সার নিজস্ব টুংটাং শব্দ। রাস্তার ওপাশে ঝালমুড়ি আর আখের শরবতের টং বসেছে। আর এপারে বসেছে ফুচকার স্টল । জনমানবের বাহার নেই বললেই চলে। এমন সময় নিজের প্রিয় মানুষের সাথে রোডসাইট খাবারের আলাদাই এক আনন্দ আছে । সেই আনন্দের সাথে অর্পিকে নিয়ে উপভোগ করছে মাইশা। তাও আবার ফুচকা খেয়ে। বলা বাহুল্য, ঝালের প্রতি মাইশার বড্ড অনীহা। খাবারে ঝালের পরিমাণ একটু বেশি হলেই এই মেয়ের তৎক্ষণাৎ অজ্ঞান হয়ে যাবার মতো সম্ভাবনা আছে। তাই ফুচকাতে কম ঝাল দিয়ে খাচ্ছে বলে অর্পির কষ্টের কোনো সীমা নেই। হতাশ কন্ঠে বললো,

–”দোস্তো…………….তুই কবে ঝাল খাওয়া শিখবি রে? ঝাল ছাড়া ফুচকাতে কি কোনো স্বাদ আছে? কেমন যেন পানসে পানসে লাগে।”

–”তোর ঝাল পছন্দ , তাহলে তুই-ই খা। আমি এসব খেতে পারবো না-রে বাবা।”

–”আচ্ছা আমার থেকে এক পিস নে না? ট্রাই করে দেখ।”

–”মোটেও না।”

–”প্লিজ? জাস্ট একবার?”

অর্পির আকুতিভরা কন্ঠ। এই মেয়ে কিছু পারুক আর না পারুক, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল ভালোমতই করতে পারে। আর এই আকুতি মাইশার পক্ষে কখনোই ফেরানো সম্ভব নয়। পরিশেষে অর্পির কথায় ওর প্লেট থেকে এক পিস নিয়েই নিলো ও। ফুচকার ওপর লাল মরিচের গুড়োঁগুলো অনিমেষ ভঙ্গিতে যেন মাইশার দিকে তাকিয়ে আছে। শুকনো ঢোক গিললো মাইশা। অর্পিকে মিহি গলায় বললো,

–”দোস্ত আমি পারুম না রে। এইটা খেয়ে যদি অজ্ঞান হয়ে যাই নুহাশ ভাই আমার গাল ফাটিয়ে দেবে।”

–” একটা খাইলে কিছুই হবে না। আর তোর ভাইরে আমি দেখুম নে। চেহারা তো সালমান শাহ্ এর মতো। অথচ রাগ ! নাকের ডগায় নিয়া ঘুরে।”

চোখ ছোট ছোট করে ফেললো মাইশা। বন্ধুমহলে নুহাশের রাগ নিয়ে কম কথা শুনতে হয়নি। একবার অর্পি নুহাশকে প্রপোজ করেছিলো বলে নুহাশ অর্পির গাল ফাটিয়ে দেয় চড় দিয়ে। সাথে আনানেরও। কারন আনানই অর্পিকে এই ডেয়ার দিয়েছিলো। তখন থেকেই মাইশার বড় ভাই নুহাশ যেন ওদের চিরশত্র্রু। কিন্ত নিজের ভাইয়ের নামে খারাপ কথা শুনলে কারই না খারাপ লাগে। মাইশাও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। ঠোঁট উল্টে তাই বলে ফেললো,

–”আচ্ছা খাচ্ছি তো। কিন্ত ভাইরে কিছু বলিস না !”

–”এইবার আইসো লাইনে জানু। নাও। টুপ করে খেয়ে নেও।”

মাইশা এবার চোখ বন্ধ করে নিলো। খাওয়ার আগে বললো, ”বিসমিল্লাহ্!”
ফুচকাটা মুখে নেওয়ার ৪ সেকেন্ডের মধ্যেই মরিচের গুড়ঁা নিজের কাজ শুরু করে দিয়েছে। কান থেকে ক্রমাগত যেন গরম ধোঁয়া বের হলো মাইশার। ফুচকাটা আসলেই প্রচন্ড রকমের ঝাল। কোনো রকম ফোঁপাতে ফোপাতে মাইশা বললো,

–”পানি দে অর্পি।”

–”পানি তো নেই।”
ফট করে বলে ফেললো অর্পি। মাইশার এখন গলা ছেড়ে কাদতে মন চাচ্ছে। কোনোমতে নিজের রাগ সংযত করে বললো,

–”ঝাল ফুচকা খাস কুত্তা অথচ পানি খাস না?”

–”পানি তো কখনও দরকার পড়ে না।”

কাচুমাচু স্বরে বললো অর্পি। এদিকে একটি ফুচকা খেয়েই কাহিল অবস্থা মাইশার। আশেপাশে তেমন দোকানও নেই। আর ফুচকার দোকানের সেই পানি মাইশা কখনোই খায় না। একই গ্লাসে না ধুয়ে সবাই পানি খায়, ব্যাপারটা বিশ্রী বটে। হঠাৎই মাইশার মুখের কাছে কেউ পানি এিগিয়ে দিলো। পুরুষালি কন্ঠে শোনা গেলো,

–”পানিটা খেয়ে নাও।”

ঠান্ডা পানির বোতল দেখে মাইশা বাঘিনীর মতো বোতলটি ছিনিয়ে ঢকঢক করে পানি খেতে লাগলো। উদ্দেশ্য একটাই , মুখের ঝালভাবটা কমাতে হবে। বেশ কিছুক্ষণ পরেই স্বাভাবিক হতে থাকলো ও। মুখ দিয়ে ক্রমাগত শ্বাস নিচ্ছে আর ছাড়ছে। ঝালভাবটা কমে গেলেও পুরোপুরি কমেনি। মাইশা উদ্দেশ্যহীনভাবে আগন্তুকের কাছে ধন্যবাদ জানাতে গিয়েই দাঁড়িয়ে যায়। কেননা , আগন্তুকটা আয়াত ছিলো। সরু চোখের নির্লিপ্ত চাহিনী নিক্ষেপ করেছে এই ঝালভীতু মাইশার দিকে। একটা বিদ্রুপ হাসি দিয়ে আয়াত বললো,

–”ঝাল যখন খেে পারোনা তবে খেতে গিয়েছিলে কেনো? একটু খেয়েই হাউ-মাউ-কাউ-কাউ অবস্থা ! ”

‘হাউ-মাউ-কাউ-কাউ’ অবস্থা নামে বাংলা অভিধানে আদৌ কোনো শব্দ রয়েছে কিনা মাইশার অজানা। এতক্ষ ঝালের জন্য যে মরি মরি অবস্থা ছিলো আয়াতের আগমনে আর অদ্ভুত সব কথাবার্তায় তা আরও বিস্তৃতরূপ ধারন করেছে। কোনোমতে লম্বা শ্বাস নিয়ে মাইশা বললো,

–”আমার খেতে ইচ্ছে করেছে। হয়েছে?”

বিরক্তির সহিত উত্তর দিলো আয়াতকে। ভ্রু কুচকে ফেললো আয়াত। মেয়েটার ঝালে কাহিল রূপেও তেজ যেন বিন্দুমাত্র কমেনি। তা দেখে আয়াত হেসে ফেললো সশব্দে। হাসিটিতে বিদ্রুপের রেশ থাকলেও এমন তোলপাড় করে দেওয়া হাসি দেখলে যে কেউ বিমোহিত হতে বাধ্য। বাতাসের তালে আসা চুলগুলো হাত দিয়ে পেছনে সরিয়ে আয়াত অপার্থিব কন্ঠে বললো,

–”তোমার উদ্ভট সব কান্ড দেখে না হেসে পারিনা মাইশা। আমাদের দেখার সূচনা থেকে এই পর্যন্ত তুমি যে সব কান্ড ঘটিয়েছো তা আর নাই বা বললাম…………কিন্ত এখন? ঝাল খেতে না পেরেও ঝাল খেয়েছো?উমমম ! কারনটা আমি একটু আন্দাজ করতে পেরেছি।”

হকচকিয়ে যায় মাইশা। ঠোঁটদুটো অদ্ভুতভাবে তিরতির করে কাঁপছে। অর্পি এখন এই ত্রিসীমানায় নেই। কারন আয়াত ইশারায় চলে যেতে বলেছে ওকে । মাইশা মিনমিনিয়ে আয়াতকে বললো,

–”ক-ক-কি আন্দাজ করতে প-পেরেছেন?”

আয়াত ঠোঁট কামড়ে কোনোমতে হাসি দমিয়ে সিরিয়াস হওয়ার ভাব নিলো। তবে ঠোঁটের কোলে এখনও সেই স্মিত হাসি ঝুলে রয়েছে। ফুচকাওয়ালাকে নিজের মানিব্যাগ থেকে টাকা দিয়ে মাইশার সন্নিকটে এগিয়ে এলো আয়াত। কিন্ত মাইশার পা জোড়া আবদ্ধ রাস্তার কনক্রিটের ঢালে। আয়াত এবার মাইশার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,

–”আমার গালে চুমু দিতে পারছোনা বলে সেই দুঃখ দূর করার জন্য এখানে অর্পির সাথে ফুচকা খেতে এসেছো। ঠিক বললাম তো? তবে আমার মনে হয় তোমার হাতের চড় খাওয়ার চেয়ে তোমার চুমুটাই আমার গালের জন্য পার্ফেক্ট। ”

বিস্ফোরিত নয়নে মাইশা এবার তাকালো আয়াতের দিকে। আয়াত ততক্ষণে মাইশার কানের কাছ থেকে ঠোঁট সরিয়ে একটা চোখ টিপ দিয়ে দিলো। ভড়কে যায় মাইশা। মন-মস্তিষ্ক-স্নায়ু সর্বত্রই যেন চলছে অনুভূতির জোয়ার। এগুলো কি তবে আয়াতের লাগামহীন কথার জন্য। তবে তো একদিন এই কথার স্রোতে তলিয়ে যেতে হবে মাইশাকে। ইসসস ! কি নির্লজ্জ এই আয়াত !
.
.
.
.
.
#চলবে………..ইনশাল্লাহ