হৃদমাঝারে তুমি ছিলে পর্ব-১২

0
482

#হৃদমাঝারে_তুমি_ছিলে❤
#পর্ব___১২
#কায়ানাত_আফরিন❤

–”আমার গালে চুমু দিতে পারছোনা বলে সেই দুঃখ দূর করার জন্য এখানে অর্পির সাথে ফুচকা খেতে এসেছো। ঠিক বললাম তো? তবে আমার মনে হয় তোমার হাতের চড় খাওয়ার চেয়ে তোমার চুমুটাই আমার গালের জন্য পার্ফেক্ট। ”

বিস্ফোরিত নয়নে মাইশা এবার তাকালো আয়াতের দিকে। আয়াত ততক্ষণে মাইশার কানের কাছ থেকে ঠোঁট সরিয়ে একটা চোখ টিপ দিয়ে দিলো। ভড়কে যায় মাইশা। মন-মস্তিষ্ক-স্নায়ু সর্বত্রই যেন চলছে অনুভূতির জোয়ার। এগুলো কি তবে আয়াতের লাগামহীন কথার জন্য। তবে তো একদিন এই কথার স্রোতে তলিয়ে যেতে হবে মাইশাকে। ইসসস ! কি নির্লজ্জ এই আয়াত !

মাইশার কটাক্ষ স্বরে বললো,

–”সাধে কি আপনারে আর লুইচ্চার বদনা বলি? কি আবোল-তাবোল বলছেন এসব?”

–”আমি বললে দোষ আর তুমি ভাবলে দোষ না।”

আয়াতের সপ্রতিভ চাহিনী। মিহিয়ে গেলো মাইশা। এই ছেলের সাথে কথায় পেরে ওঠা ওতটাও সহজ নয় যতটা মাইশা আনান, সামাদ, পৃথা বা অর্পির সাথে পারে।মাইশা আর কোনো প্রতিউত্তর না দিয়ে পানির বোতলটি আয়াতের হাতে রাখলো। মিনমিনিয়ে বলে ওঠলো.

–”এই নিন আপনার পানির বোতল আর ধন্যবাদ। আমি বাসায় চলে যাবো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

–”এই ভরদুপুরে রিক্সা কোথায় পাবে তুমি?”

–”সেটা আপনার না দেখলেও চলবে। আমি গেলাম।”

কোনোরকম ভাবনার জালে উত্তর দিয়ে বড় বড় পা ফেলে চলে গেলো মাইশা। এই আয়াতের সামনে আর এক সেকেন্ড দাঁড়ানো মানেই লজ্জার ছায়াছবিতে হারিয়ে যাওয়া। আয়াত হেসে ফেললো আনমনে। এক হাত দিয়ে চুলগুলো আবারও পেছনে ঠেলে দিয়ে বলে ওঠলো,

–”পাগল একটা?”

————————————————

মেঘাচ্ছন্ন আকাশে তুমুল গতিতে ছুটে চলছে ছাই রঙের কুন্ডলী পাকানো মেঘের স্তর।সূর্যের তেজস্ক্রীয় রশ্নি ছুটি নিয়ে যেনো মামার বাড়িতে চলে গিয়েছে।প্রকৃতিতে শীতল শীতল ভাব থাকলেও মাইশার কাছে মনে হচ্ছে ভ্যাপাসা গরম।এত সুন্দর আবহাওয়ার মাঝেও রাস্তায় কোনো রিক্সা না পাওয়াতে স্পষ্ট মুখশ্রীতে দেখা গিয়েছে বিরক্তির রেশ। ভরদুপুরে রিক্সা না পাওয়ার মতো বিরক্তির জিনিস যে অন্য কিছু হতে পারেনা সেটা হয়তো সামান্য কিছু মানুষই অনুভব করতে পারে।

অবশেষে উপায়ান্তর না পেয়ে হাঁটাই শুরু করলো মেয়েটা। পায়ে সাদা স্নিকার্স পড়ার কারনে হাঁটতে তেমন অসুবিধে না হলেও কতক্ষণই বা এভাবে হাঁটা যায়?রাস্তার ধারের দেবদারু গাছগুলো অন্যন্য সুন্দর লাগছে। কিন্ত মাইশা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বার কয়েক রাস্তায় চোখ বুলিয়ে নিলো। নাহ ! রিক্সার কোনো অস্তিত্ব নেই। এখন একটাই উপায় আছে। মেইন রোডে গিয়ে বাস ধরতে হবে নয়তো নুহাশ ভাইয়ের অফিস থেকে গাড়ি নিয়ে যেতে হবে।

কিন্ত বাসের ভীড়-ভাট্টা ধাক্কাধাক্কি বরাবরই এড়িয়ে দিতে চায় মাইশা। কেননা বাসের ভীড়ে ভদ্র মানুষরূপী কিছু জঘণ্য কাপুরুষ থাকে যারা চলন্ত বাসেও কোনো নারীর শরীর স্পর্শের সুযোগ ছাড়ে না। তাই মাইশা সিদ্ধান্ত নিলো যে, নুহাশ ভাইয়ের অফিসে যাওয়াটাই বোধহয় ভালো হবে। নুহাশের অফিসে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই আচমকা পা জোড়া থেমে গেলো ”মাইশা” নাম উচ্চারনকৃত কারও পুরুষালি কন্ঠ শুনে।

ঘাড় বাকিয়ে পেছনে তাকালো মাইশা। রাস্তার কোণে বাইকে আয়াতকে বসা অবস্থায় দেখতে পেয়ে একটু অবাক হয়ে যায়। মনে মনে একটি জিনিসই তালগোল পাকাচ্ছে , ”এই ছেলে কি কোনোভাবে ওকে অনুসরণ করছে না-তো?”
উমমম না ! চেহারা দেখে তো মাইশার ওমন মনে হয় না। তবে এর চমৎকার পার্সোনালিটির প্রেমে পড়ে হাজারো মেয়ে যে উনার পিছু নিয়েছে এই নিয়ে মাইশার মনে অন্তর্দ্বন্দের যেন কমতি নেই।

এতক্ষণে বাইক থামিয়ে মাইশার দিকে মনোনিবেশ করেছে আয়াত। এই ঠান্ডা পরিবেশেও মেয়েটার কপালে ঘামের কণা আছে। চুলগুলো কাটা দিয়ে আটকানো থাকলেও অবাধ্য চুগুলো কপালের দুপাশে সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিয়েছে মাইশা। আয়াত চাঁপা গলায় বললো,

–”রিক্সা পাওনি এখনও?”

–”না।”

মাইশার স্বাভাবিক কন্ঠ। আয়াত মাইশার দিক থেকে নজর সরিয়ে বাইক স্টার্ট করলো পুনরায়। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

–”ভরদুপুরে এখানে একা না থাকাটাই ভালো। আশেপাশে মানুষজন কম। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি রিক্সা নিয়ে এতক্ষণে চলে গিয়েছো । কিন্ত আমারই বোঝা উচিত ছিলো যে এই অসময়ে এই রাস্তায় রিক্সা পাওয়া টাফ্ট ব্যাপার। আমার বাইকে উঠো। আমি পৌঁছে দিচ্ছি তোমাকে।”

আয়াতের একসাথে এতগুলো বলা কথা মাইশা যেনো কোনোক্রমেই হজম করতে পারলো না। নীরবে নিভৃতে তাই একই স্থানে ঠাঁই হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। আয়াত ওকে স্থিরভাবে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখে ভ্রু কুচকে ফেলে। বিরক্তির স্বরে বললো,

–”এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? বাইকে বসতে বলেছি। বিয়ের পিড়িতে বসতে বলিনি যে শ্বশুড়বাড়ি নিয়ে যাবো। ডাফার কোথাকার। জলদি উঠো ! আমার কাজ আছে।”

আয়াতের তিক্ত কথাগুলো মাইশা কোনোক্রমে হজম করে বাইকে উঠে বসলো। একমুহূর্ত বলতে ইচ্ছে করেছিলো যে, ”আপনার কাজ থাকলে আমায় বাসায় দিয়ে আসতে বললো কে?”কিন্ত মাইশা কিছুই বলো না। এখন বাড়িতে যাওয়াটাই মুখ্য বিষয়।

আয়াত আবার বললো,

–”যদি বাইক থেকে ফটাস করে পড়ে যাওয়ার ইচ্ছে না থাকে তবে আমায় কাঁধ ধরো। আর খবরদার ! ঘেষাঘেষি করবে না। এক্কেবারে বাইক থেকে ফেলে দিবো কিন্ত।”

–”আমার তো আর কাজ নাই যে আপনার সাথে ঘেষাঁঘেষি করতে যাবো। যত্তসব !”

–”আমার গালে চুমু দেয়ার মত ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করে থাকলে এইটাও তোমার কাছে বড় কিছু না।”

মিহিয়ে গেলো মাইশা। এই ছেলে যে সবসময় এই কথা বলে ওকে জ্বালিয়ে মারবে সেটা বুঝতে যেন আর দেরি হলো না মাইশার। মুখ ফুলিয়ে তাই আয়াতের কাধ আলতোভাবে ধরল ।

ফুরফুরে বাতাসটা এখন দমকা বাতাসে রূপ নিয়েছে। সেই বাতাসের আনাগোনায় সাবধানে বাইক ছুটিয়ে চললো আয়াত উত্তরার ২ নং সেক্টরের উদ্দেশ্যে।এতক্ষণের মেঘাচ্ছন্ন আকাশটি হয়তো এটাই বলছিলো যে ”বৃষ্টি হবে ! তুমুল ধারায় একঝাঁক জল গরিয়ে পড়বে মেঘ চিরে ! সেই জলের অবাধ্য ধারায় ভিজে চলবে একদল বৃষ্টিপ্রাণোসী !”
মাইশার চুলের মিষ্টি সুবাসটি ভেসে আসছে আয়াতের নাকে। বাইকের ব্যাক মিরর দিয়ে একপলক অবলোকন করে নিলো মাইশাকে। মেয়েটা মুখ ভার করে বসে আছে। একচিলতে পাগলাটে হাসি ফুটলো আয়াতের ওষ্ঠ্যদ্বয়ে। মেয়েটার মুখ ভার অবস্থাটা সাহিত্যের পাতার রমনীদের মতো সুন্দর।

কিছুক্ষণ পার হওয়ার পর দুজনেই বেশ ভালোমত বুঝতে পারলো ভালো ঝড়ো হাওয়া বইছে। বৃষ্টির পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এটি হয়তো থামবেনা। আয়াত মাথাটা হালকা পেছনে ঘুরিয়ে মাইশাকে বললো,

–”চোখ বন্ধ করে রাখো মাইশা। ধুলো ঢুকবে। ”

–”ঠিক আছে।”

প্রতিউত্তরে মাইশার স্বাভাবিক কন্ঠস্বর থাকলেও ঝড়ো হাওয়ার ন্যায় এলোমেলোভাবে ছুটে চলছে ওর উদাসীন মন।

।।
ভিজে জবজবে শরীর নিয়েই আয়াত আর মাইশা এসে পড়ল উত্তরায়। এখনও তুমুলগতিতে বৃষ্টি চলছে। এই সময় চাইলে দুজনেই পারত কোনো একটি জায়গায় বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করতে কিন্ত কেউ চায়নি সেটা। আয়াত হয়তো বৃষ্টি উপভোগের তাড়নায় আর মাইশা? যতটা সম্ভব আয়াতের সাথে কম সময় কাটানোর ভাবনায়। মাইশার অবাধ্য মন এমনিতেও আয়াত নামের প্রতি দুর্বল, তাই ও চায় না এই দুর্বলতার সীমাটি অতিক্রম করতে।

মাইশা মিহি কন্ঠে বললো,

–”এখানে থামিয়ে দিন।”

মাইশার ভেজা কন্ঠ শুনে ব্রেক কষলো আয়াত। মাইশা ততক্ষণে বাইক থেকে নেমে গিয়েছে। ভিজে দুজনেরই জুবুথুবু অবস্থা। আয়াতের আজকাল বিরক্ত লাগে এমনভাবে আবহাওয়া পরিবর্তনে। আয়াত সংকীর্ণ কন্ঠে বললো,

–”এখানে থামতে বললে কেনো?”

–”এই গলিতেই আমার বাসা। তাই এখন আমি যেতে পারবো। ”

–”গতবারও তোমার বাসার সামনে গাড়ি থামাওনি । কিন্ত কেনো? ভয় হয় যে আমি হুুট করে এসে পড়বো কি-না?”

–ব্যাপারটি তা না। তবে আপনি একজন ছেলে। বাড়ির সামনে একজন ছেলের বাইক থেকে নামতে দেখলে লোকে অন্য কিছু ভাববে। আর………….”

–”আর কি?”

দম নিলো মাইশা। আয়াতের চোখে চোখ রেখে বললো,

–”আর আমি চাই না যে আপনাকে আমার সাথে এভাবে দেখে মানুষ অন্য কিছু বলুক। আমার পরিবারের সম্মান আমি নষ্ট করতে চাইবো না আর আপনার এতদিনের গড়া ইমেজেও আঙুল তুলতে দেবো না।”

আয়াত কিছু না বলে আলতো হাসলো শুধু।বৃষ্টির পানিগুলো ওর চুল থেকে চুয়ে চুয়ে মুখশ্রীতে ছড়িয়ে পড়ছে।মাইশা একপলক ওর মুখে চোখ বুলিয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই আয়াত বললো,

–”আমার সম্মানের জন্য তোমার চিন্তা কেনো জানতে পারি কি?”

মাইশা এবার চুপ। ওর জানা পুরো মনমস্তিষ্কে এর উত্তর খুঁজে পেলো না।বাইক থেকে নেমে আয়াত সপ্রতিভ চাহিনী নিয়ে এগিয়ে এলো মাইশার দিকে।পানির স্পর্শে ঠোঁটদ্বয় মারাত্নক লাগছে আয়াতের।আয়াত ঠোঁটজোড়া হালকা নাড়িয়ে বলে উঠলো,

–”আমার প্রতি তোমার দুর্বলতাটির কি নাম তুমি বলতে পারবে?বলতে পারবে বারবার আমায় আড়চোখে দেখার কারন? তোমার বন্ধুদের কথায় বোঝা যায় চরম আত্নমর্যাদাসম্পন্ন মেয়ে তুমি। তবে আমায় দেখলে এসব কাজকর্ম করো কেনো? এর উত্তর জানো? লোকে তো বলে প্রেম নাকি মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধিকে কল্পনাপ্রবণ করে তোলে।তবে কি আমার প্রতি প্রেম অনুভূতি তোমার? কানের কাছে নুপুরের ন্যায় কি বেজে ওঠে যে #হৃদমাঝারে_তুমি_ছিলে?”

বৃষ্টির অবাধ্য ধারায় এক অন্য আয়াতকে দেখতে পেলো মাইশা। এ যেন এক তৃষ্ণার্থ প্রেমিক পুরুষ।এই প্রখর চাহিনী এড়ানো সম্ভব নয় মাইশার পক্ষে।চুপটি করে তাই আয়াতের বুকে মিশে ঠায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পঞ্চগড়ের সেই রাতের মত অনুভব করতে থাকলো আয়াতের দেহের নেশাজড়ানো ঘ্রাণ।

~চলবে…………ইনশাল্লাহ