হৃদয়ম পর্ব-০১

0
142

গল্প:— #হৃদয়ম
পর্ব:—০১
Sharifa Suhasini

একজন জেলখাটা মেয়ের সাথে বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন। আর তুমি আমার মা হয়ে তার সিদ্ধান্ত মেনে নিচ্ছো? আমি কোনো অশিক্ষিত ছেলে নই যে, যাকে তাকে ধরে এনে তার সাথে আমার বিয়ে দেবে। দুনিয়ায় কী মেয়ের অভাব পড়েছে নাকি? তোমাদের কী এমন দায় পড়ে গেল যে, এই মেয়ের সাথেই আমার বিয়ে দিতে হবে? আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো, তবুও কোনো জেলখাটা মেয়েকে বিয়ে করতে পারবো না।”

বাবা-মায়ের সাথে জীবনে এই প্রথমবারের মত গলার স্বর উঁচু করে কথা বলছে হৃদ, পুরো নাম হৃদ সারওয়ার। তার বাবা সারওয়ার হাবীব পেশায় একজন জেলা জজ। ঝিনাইদহ জেলার অধিকাংশ ভদ্র মানুষ একনামে মানুষটাকে চেনে। তবে এই চেনার পেছনেও বড়সড় কারণ আছে।

সরকারীভাবে বিশেষ কোনো নিয়মে তিনি ছয় বছর এই জেলায় দায়িত্ব পালন করার পর আবার গত তিনমাস হলো এখানে বদলি হয়েছেন। আর বদলি হবার কারণে তিনি যে মনে মনে প্রচন্ড খুশি, তা তার হাবভাব দেখলেই টের পাওয়া যায়। প্রতিদিন সকাল-বিকাল নানান ফরিয়াদির বাড়ি থেকে তার সরকারি কোয়ার্টারে কৈ মাছ, মাগুর মাছ আর গরুর খাঁটি দুধ আসে। ফরিয়াদিরা সাথে করেই নিয়ে আসে। আর সারওয়ার হাবীবও খুব যত্ন সহকারে সবার উপহার সাথে সাথে ফেরত পাঠান। এ অভ্যাস তার আজ নতুন নয়। বহু পুরনো। কিছুক্ষণ আগেও বারান্দায় বসে মেডিটেশন করার সময় দারোয়ানকে ডেকে সবাইকে সসম্মানে এক এক করে জিনিসপত্র গেটের বাইরে রেখে ভিতরে যেতে বলে দিয়েছিলেন। লোকগুলো এসেছে, নিজেদের নিরপরাধী আসামীর পক্ষে বয়ান করেছে, তারপর সালাম দিয়ে চলে গেছে। ঝিনাইদহ জেলার মানুষ যে আজও তাকে ভরসা করে, ব্যাপারটাতে তিনি আশ্চর্যই হন।

মজলিশ ছেড়ে ঘরে ঢুকতেই তিনি শুনতে পান, তার আটাশ বছর বয়সী বড় ছেলে হৃদ মায়ের সাথে চেঁচামেঁচি করছে। ছেলের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে তিনি চায়ের কাপ নিয়ে সোফায় বসলেন। কিছুক্ষণ পরেই আটটার সংবাদ শুরু হবে। টেলিভিশনের শব্দের ভলিউম বাড়িয়ে দিয়ে তিনি এক একবার চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন আর চোখ বন্ধ করছেন।

হৃদ কথা বলতে গিয়ে বাবার এই আচরণে বেশ বিরক্ত হচ্ছে। হাবীব সারওয়ার সাহেবের তবুও সেদিকে মনোযোগ নেই। বাধ্য হয়ে সে বাবার ডানপাশে পেতে রাখা আরেক সারি সোফার একটি সিটে বসে বললো,
—বাবা, আমি কিছু বলছি আপনাকে।

—হ্যাঁ? আমাকে বলছো? কই, আমার কাছে তো এতক্ষণ আসোনি। তুমি তোমার বয়সের জোর দেখিয়ে মায়ের সাথে চিৎকার করছো। করতেই পারো। এখন যুবক হয়ে গেছো, গলায় আওয়াজ এসেছে, গায়ের জোর বেড়েছে। এখন ক্ষমতা দেখাবে না তো কখন দেখাবে?

বাবার কথায় হৃদ শুধু শান্তই হলো না, বেশ লজ্জাও পেল। সারওয়ার সাহেবের এই গুণটা চমৎকার। ছেলেমেয়ের সাথে তিনি রাগারাগি করেন না। ঠান্ডা মাথায় তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি বিশ্বাস করেন মানুষকে বকাবকি করে, নেতিবাচক কথা বলে, গালাগালি করে কখনো আয়ত্বে রাখা যায় না। এতে শত্রুত্ব এবং দূরুত্ব বাড়া ছাড়া এর বেশি আর কিছুই ঘটে না। আর এই বিশ্বাসের জোরেই সম্ভবত নেতা থেকে আসামী সবার নিকটেই তিনি অতি পছন্দনীয়।

হৃদের কাছেও তার বাবা একজন আদর্শ মানুষ। সেই বাবার সামনে এভাবে চেঁচানোটা উচিত হয়নি তার। সে মাথা নিচু করে বললো,
—বাবা, আই এম সরি। আসলে সকালবেলা আম্মার থেকে আমার বিয়ের ব্যাপারটা জানার পর মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিলাম।

জবাবে সারওয়ার হাবীব একটি বাক্যও উচ্চারণ করলেন না। তার স্বীকৃতির বহিঃপ্রকাশ পাওয়া গেল টেলিভিশনের শব্দের ভলিউম কমে আসাতে। হৃদ রান্নাঘরে মায়ের দিকে একবার চেয়ে আবার বাবার মুখের দিকে তাকালো। তারপর নরম সুরে বললো,
—বাবা, আপনি আমার সাথে একটি মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছেন। যদিও আমি গত বছর মাস্টার্স শেষ করে নিজের আইটি প্রতিষ্ঠান খুলেছি। এখনই বিয়ের প্ল্যান ছিল না। এরমধ্যেই আপনি বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। তবুও যা করতে চেয়েছেন, নিশ্চয় আমার ভালোর জন্যই আপনার এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু বাবা, দুনিয়ায় এত মেয়ে থাকতে একটা জেলখাটা আসামী মেয়েই কেন! মানে আমার মত শিক্ষিত একটা ছেলে কোনো আসামীর সাথে সংসার করবে,এটা শুনলে লোকে কী বলবে?

সারওয়ার সাহেবের জবাব দেবার আগেই তার মেজো ছেলে ওম সারওয়ার মায়ের থেকে একটি শুকনো পরোটা নিয়ে চিবোতে চিবোতে ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়ালো। পরোটার ঠুকরো চিবোতে চিবোতে সে ভাইকে বলে,
“বিয়ে করলে বরকত বাড়ে। আমার কথা নয়, দাদি বলেছেন। কাল রাতে এটাই বললেন। তোমার আয় রোজগারে বরকতের জন্যই বিয়ে দেওয়া হবে।”

নিজের বাক্য শেষ করে ওম হো হো করে হাসার অভিপ্রায় করতে যায়। কিন্তু বাবার চোখে চোখ পড়তেই নিজের আনন্দ গিলে নিয়ে চুপচাপ বসে পড়ে। তার দাদি সায়রা বানু তাকে একথা যে সত্যি সত্যিই বলেছিল, সেকথা প্রমাণের চেষ্টা বৃথা।

সারওয়ার হাবীব ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন,
—তুমি যতটা শুনে রাগ দেখাচ্ছো, ততটা আলোচনা আমাদের হয়নি। হলে আমি নিজেই তোমার সাথে কথা বলতে বসতাম। শোনো হৃদ, তাকে বিয়ে করার জন্য তোমাকে জোর করবো না। ওটা করে সন্তানের চোখে ভিলেন হবার অপচেষ্টা করে আমার সম্মানের ক্ষতি। তবে আমি তোমাকে একটি আদেশ করতে চাই। তুমি একটু মেয়েটার সাথে দেখা করো। আমার জন্য এইটুকু পারবে না?

হৃদের ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু বাবার প্রতি সম্মান রেখে সে এইটুকুর জন্য আর না করতে পারলো না। দেখাই তো করবে। এটা বিশেষ কোনো ব্যাপার না। সারওয়ার সাহেবের দিকে সে হ্যাঁ’বোধক মাথা দুলিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সারওয়ার হাবীব তখনই জানিয়ে দিলেন, মেয়েটার সাথে আজ দেখা করতে হবে। মেয়েটার নাম শিশির। তানজিয়া শিশির। বয়স একুশ। এই মুহুর্তে ওর নিজস্ব ফোন নাম্বার নেই। তবে ওর বাবার নাম্বার হৃদের দাদির কাছ থেকে নিয়ে নিতে হবে। তারপর সেই নাম্বারে কল দিয়ে মেয়েটার পছন্দমতো জায়গায় দেখা করা লাগবে।
আচ্ছা ঝামেলার কাজ তো!

বিকালবেলা মেয়েটার জানানো লোকেশন অনুযায়ী হৃদ হাজির হলো। শিল্পকলা একাডেমির পাশে ব্রীজের উপর। ব্রীজ দিয়ে গাড়িঘোড়া, সাইকেল, পথচারী সবার চলাচল। এত ব্যস্ত রাস্তায় দেখা করার কোনো মানে হয়? তবুও বাবার মান রক্ষার্থে সে এসেছে। তবে চারটার কথা বলে ঠিক এক ঘন্টা পর। ব্রীজের উপর উঠে হৃদ খেয়াল করে বেগুনি রঙের জামার উপর ছাই রঙের সোয়েটার পরে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি নদীর জলের দিকে নিবন্ধ। মাথার চুল ব্যান্ড দিয়ে বাধা থাকার কারণে চুলের দৈর্ঘ্য বোঝা গেল না। হৃদ অবাক হয়ে দেখে, এই সময় এই সংকীর্ণ রাস্তায় বাইক আর অটো ছাড়া খুব একটা গাড়ি চলে না। সে কিছুটা ধীর গতিতে শিশিরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
—এক্সকিউজ মি, মিস। আপনি শিশির?”

—জি, আমিই শিশির। কিন্তু আপনি এক ঘন্টা তিন মিনিট দেরিতে এসেছেন। ঘড়িতে এখন পাঁচটা তিন বাজে। অথচ বাবার ফোনে আপনার সাথে যখন কথা হলো, আপনি বিকাল চারটার কথা বলেছেন।

শিশির নদীর জলের দিকে দৃষ্টি রেখে কথা বলে যাচ্ছে। হৃদ কী বলবে, ভেবে পাচ্ছে না। মিথ্যে বলার স্বভাব কিংবা অভ্যাস কোনোটাই তার নেই। কিন্তু এই মুহুর্তে নিজেকে অপরাধী বানানো যায় না। সে কিছুটা ইতস্তত হবার ভঙ্গিতে জানায়,
—আসলে হুট করে কিছু কাজ পড়ে গেছিল। সেজন্য লেইট করে ফেললাম। তবে আপনি যে এতক্ষণ অপেক্ষা করবেন, এটা আশা করিনি।

—আপনার জবাব দিতে ইচ্ছে না করলে দিবেন না। কিন্তু মিথ্যে বলবেন না। আপনি জেলা জজের ছেলে। বাবার সম্মানের খাতিরে কিছুটা সততা বজায় রাখুন।

কথা বলতে বলতে শিশির ওর দিকে ফিরে তাকালো। ‘ছিমছাম গোলগাল মুখ। চোখে কাজল দেয়নি, তবে ঠোঁটে নিশ্চয় রঙিন কাজলের আভা টেনে দেওয়া। উঁহু, কাজল আবার রঙিন হয় নাকি? তাও আবার ঠোঁটে! হতেও পারে। মেয়েটাকে ভয়ংকর সুন্দরী বলা যেতে পারে। নাকি তার থেকেও বেশি। না, না, অযথাই বেশি হচ্ছে। এর চেয়েও ঢের সুন্দরী মেয়ে আমি দেখেছি। কিন্তু কিছু একটা সৌন্দর্য তাকে ভয়ংকর সুন্দরী ডাকাতে বাধ্য করছে। সেটা কী হতে পারে?’

মনে মনে বিড়বিড় করছে হৃদ। কিছুক্ষণের জন্য যেন কথাই আটকে গেল তার। শিশিরের সৌন্দর্যের মোহে পড়ে নয়, তাকে সঠিক সঙ্গায় ঠিকঠাক উপমায় ব্যাখ্যা করার জন্য। কিন্তু কোনো উপমাই সঠিকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না। তার ধ্যানভঙ্গ করে শিশির আবার বললো,
—আপনি না এলেও আমি ছয়টা পর্যন্ত থাকতাম। ফোনে আপনাকে বলেই দিয়েছি। সন্ধ্যা ছয়টায় আমাকে বাসায় ফিরতে হবে। তাই ততক্ষণ অপেক্ষা করা আর নদীর শেওলা ধরা পানি দেখা ছাড়া এই মুহুর্তে আমার কোনো পরিকল্পনা ছিল না।

হৃদ এবার জবাব দেবার মত দ্বিতীয় কোনো ভাষাই খুঁজে পায় না। আজকে সকাল থেকেই সে সবার কাছে নিজের কথা আর কাজের জন্য লজ্জিত হচ্ছে। খামোখা মিথ্যেটা না বললেও হত। কী বলে এই প্রসঙ্গ কা*টাবে, তা ভাবতে ভাবতে সে হঠাৎ বলে বসলো,
—কিন্তু এত জায়গা থাকতে আপনি আমাকে এখানে কেন ডাকলেন? কফিশপ, রেস্টুরেন্টের কি অভাব পড়েছে এই শহরে?

—না, অভাব পড়েনি। তবে আপনি আমাকে দেখেননি, আমিও আপনাকে দেখিনি। তাই সেসব জায়গায় গেলে চিনে নিতে কষ্ট হত। সেকারণে এখানে আসতে বললাম। এরকম অদ্ভুত জায়গায় আলাদা করে কোনো ছেলেমেয়ে দেখা করার প্ল্যান করবে না।

হৃদ ওর কথা শুনে অবাক হলো। এই মেয়েটি কোনো জেলখাটা আসামী হতেই পারে না। অথচ সে তার মায়ের কাছে শুনেছে, মেয়েটি দীর্ঘদিন জেলে ছিল। বাবাও সত্যি কথাটা স্বীকার করেছেন। আর এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ, মেয়েটির কাছে ফোন নেই। তার মানে এ সপ্তাহেই ছাড়া পেয়েছে সে। হৃদ কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। এরকম ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মেয়ে জেলখানায় কেন থাকবে? তার তো থাকার কথা শহরের সবচেয়ে সাজানো গোছানো মালীর বাগানে। তার সেই সাজানো বাগানের মালী কী তবে সারওয়ার হাবীব নিজের বড় ছেলে হৃদকেই মনে করেছেন?

হৃদ ইতস্তত স্বরে শিশিরকে জিজ্ঞাসা করে,
—আপনি জেল থেকে কবে ছাড়া পেয়েছেন?

শিশির ওর দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকালো। হৃদ নিজের কন্ঠস্বর সংবরণ করে আবার বললো,
—মানে জেল থেকে এসেছেন?

—গতকাল সন্ধ্যায়। তবে আপনার সাথে দেখা করার কথা এক সপ্তাহ আগেই শুনেছিলাম। জেলের ভিতর থাকতে। আপনার বাবা নিজে গিয়ে জানিয়েছেন।

হৃদ সম্পূর্ণ হতভম্ব হয়ে শিশিরের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে মেয়েটার ভিন্ন ভিন্ন কথায় ভিন্ন ভিন্ন অনুধাবন হচ্ছে তার। সে যে মিথ্যে বলছে না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত। কিন্তু এমন একটি মেয়ে জেল কেন খাটবে? হৃদ সংকোচ রেখে আবার প্রশ্ন করলো,
—আপনার জেল খাটার কারণ কী?

এর জবাবে শিশির ওর দিকে চেয়ে মৃদু হাসলো। সেই হাসিতে রহস্য এবং অর্থহীন কিছু একটা খেলা করছে। শিশির মাথা দুলিয়ে বললো,
—আপনার বাবা তো সবই জানেন। আপনাকে বলেননি?

(চলবে…)