হৃদয়ম পর্ব-০৩

0
107

#হৃদয়ম /পর্ব:—০৩
Sharifa Suhasini

-মা শোনো, বাবার পছন্দের ওই মেয়েটাকে আমি বিয়ে করছি না। আমার একদমই ভালো লাগেনি।

ঠোঁটেমুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে হৃদ নিজের ঘরে ঢুকতেই বাইরে বৃষ্টি শুরু হলো। হৃদ অবাক হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। সন্ধার আকাশে মেঘ হয়েছিল কি-না, সে জানে না। তবে বিকেলের ওই চকচকে গোধুলির পর এভাবে বৃষ্টি শুরু হতে পারে? হৃদ চমকে ওঠে বিকালের কথা ভেবে। শিশির তাকে এই কথাটিই বলেছিল। তখন সে আকাশের দিকে চেয়ে যাচাই করেছিল আজ বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা আছে কি-না। ছিল না। স্বচ্ছ আকাশ৷ রক্তিম সূর্য। মনে মনে মেয়েটার সাথে তর্ক করতে গিয়েও সেই তর্কের আবেগ সে গিলে নিয়েছিল নিজের ভেতর। তাহলে শিশির সেসব কথা কীভাবে জানলো? নিশ্চয় আবহাওয়ার অগ্রীম খবর সে জেনে নিয়েছে।

নিজের মনকে সে নানান ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিয়ে বুঝালেও শেষ পর্যন্ত কোনো যুক্তিতেই মন ভরলো না। ব্যাপারটা একটু বাজিয়ে দেখার দরকার।

রাতে হৃদের আর তেমন ঘুম হলো না।

৩.
পরদিন সকালে সারোয়ার হাবীব যোগাসনে বসলে হৃদ ধীর পায়ে ডাইনিংয়ে ঢুকে বাবার অপেক্ষা করতে লাগলো। তার মা ইতোমধ্যেই রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আমাতুন-নেছার সকালের নামাজ শেষে এছাড়া দ্বিতীয় কোনো অপশন নেই। সে যুগে বি.এ পাশ করেছিলেন। সরকারি স্কুলে চাকরিও জুটে গেছিল তার। এমন মোক্ষম সম্ভাবনার সময় হৃদ জন্ম নেয়। চাকরি-বাকরি আর করা হয়ে ওঠেনি তার। এ নিয়ে তার আফসোস আছে কি-না, তা কেউ জানে না। তবে মাঝেমাঝে কীসের যেন দীর্ঘশ্বাস নামে তার বুক থেকে।

সকাল সাড়ে সাতটা পার হয়ে গেলেও সায়রা বানুর ঘর থেকে কোরআন তিলওয়াতের শব্দ ভেসে আসছে। ছোটভাই ওম’র ঘর বাইরে থেকে সিটকিনি দেওয়া। সে বাসায় নেই। রাতে কোন বন্ধুর কাছে জরুরি কাজে গিয়ে আটকে গেছে। গভীর রাত হওয়ায় আর ফিরতে পারেনি।

নিজেকে এই মুহুর্তে গণ্ডমূর্খ বা গোয়ার গলদ লাগছে হৃদের। বাসার সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। সবার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, গতকাল তাকে যে এতবড় ব্যাপারে পাঠানো হলো সে নিয়ে কারোর মাথাব্যথা নেই। মায়ের কাছ থেকে কী বাবাও শোনেননি?

শোনার কথা। তবে শুনেও তিনি চুপ করে আছেন। ব্যাপারটা সুবিধার ঠেকছে না। প্রবল ঝড়ের আগে পরিবেশ এমনই থমথমে হয়ে যায়।

হৃদের বিরক্তির মাত্রা যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল, তখন ভিতরে এলেন সারোয়ার হাবীব। শরীরে নরম তোয়ালে জড়িয়েছিলেন। বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে সকালের মিঠে রোদ গায়ে পড়ে। সেটুকু সামলাতেই এই চেষ্টা। ছেলেকে এভাবে চুপচাপ সোফায় বসতে থাকতে দেখে সন্দেহের ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলেন,
—শরীর খারাপ নাকি?

—না।

—এভাবে মুখ ভার করে বসে আছো কেন?

—আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই। শিশিরের ব্যাপারে। আপনি আমাকে খোলাসা করে সবটা বলবেন।

—বাহ, একজন সরকারি জজকে জেরা করতে এসেছো? কী দিনকাল এলো রে বাবা! হা হা হা। বলো বলো, কী জানতে চাও শুনি।

কথা বলতে বলতেই তিনি শব্দ করে হেসে উঠলেন। তার হাসির মাত্রা এত অধিক ছড়ালো যে ছেলের প্রশ্ন শুনে তিনি সম্ভবত মজা পাচ্ছেন। হৃদ বাবার হাসি থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করলো। তারপর বললো,
—আপনি শিশিরের সাথে আমার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন কেন?

—তুমি তো ক্যান্সেল করে দিয়েছো।

—হ্যাঁ, দিয়েছি। তবে এর বাইরেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। আমি আশা রাখবো, আপনি বাবা হিসেবে সেই প্রশ্নের উত্তরগুলো দিবেন।

সারোয়ার হাবীব কথা বাড়ালেন না। স্ত্রীকে ইশারা করে লুচি পাঠাতে বলে দিলেন। কাজের মেয়েটা একটা একটা করে লুচি তুলছে প্লেটে। সেদিকে দৃষ্টি নিবন্ধ রেখে তিনি বললেন,
—শিশির অত্যন্ত বুদ্ধিমতী একটি মেয়ে। তুমি যেটা জানো না, অদ্ভুতভাবে সে সেটাও জানে। না, দুনিয়ার সবকিছুর তথ্য তার কাছে পাবে না। তবে কিছু কিছু ব্যাপারে সে আর সব মেয়ের থেকে আলাদা। ওকে আমি যখন প্রথম দেখতে পারি, তখন এখানে একটি জরুরি কেসের ব্যাপারে এসেছিলাম। যদিও আমার তখন শরিয়তপুরে পোস্টিং। সেই সময় এসে দেখি শিশিরের বিচার চলছে। খু*নের বিচার।

হৃদ বাবার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বারান্দার দিকে তাকালো। খু*নের কথা সে জানে। এ ব্যাপারে তার আগ্রহ নেই। শুধু শিশিরকে নিয়ে তার মনের ভিতর দ্বিধাদ্বন্দ একসাথে খেলা করছে। বাবা কী সেটা বুঝতে পারছেন না? সাত সকালে এত রাজ্যের আলাপ শুনতে কার ভালো লাগে? না,না, বাবা যখন বিস্তারিত বলছেন, তার মানে এরমধ্যে নিশ্চয় অনেক কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে। সে আবার বাবার কথা শোনায় মনোযোগ দিলো। সারোয়ার হাবীব তখনও বলে যাচ্ছেন,

—আমি এজলাসে ঢোকার সাথে সাথে সবাই সালাম দিলো। তখনকার দায়িত্বপ্রাপ্ত জজ ইকরামুল হক বিচার করছেন। আমার কাজও ওখানেই ছিল। সামনের একটি আসনে বসে উকিলের কাছে কেসের বিস্তারিত শোনার আগ্রহ প্রকাশ করলে সে জানায়, মেয়েটি তার একজন শিক্ষিকাকে খু*ন করেছে। তিনি আবার শুধু শিক্ষিকা নন, ভাইস-প্রিন্সিপাল। খু*নের মোটিভ বিশেষ কিছু নয়। তার কোনো এক দারিদ্র্য বান্ধবীর সাথে ভাইস-প্রিন্সিপাল সাহেবা নিজের ছেলের বিয়ের আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। সেই মেয়েটির বয়স তখন পনেরো কিংবা ষোলো। আমার খেয়াল নেই। ভাবতে পারো, বাল্যবিবাহ আটকাতে? না। ওই প্রিন্সিপাল নিজের প্রতিবন্ধী ছেলের সাথে মেয়েটির বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাচ্চা মেয়েটি ভিতরে ভিতরে নারাজ হলেও আনুসাঙ্গিক নানান ভয়ে না করতে পারেনি। আর শিশির ওই মেয়েটির বান্ধবী হওয়ায় ক্লাসে মেয়েদের সামনে বলে বসেছিল,‘তোর সাথে এমন কিছু হবার আগে আমি ম্যামকেই খু*ন করে ফেলবো। এরপর দেখি উনার পাগল ছেলের সাথে তোর মত সুস্থ মেয়েকে বিয়ে দিয়ে কীভাবে বংশ রক্ষা করে।’

এ পর্যন্ত বলে সারোয়ার হাবীব কথা থামালেন। হৃদের কাছে শিশিরের কেসটা জটিল, তবে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে। মেয়েটার একটা মহৎ উদ্দেশ্য ছিল। গতকাল শিশির বলেছে, যে খু*ন না করলেও তার পক্ষ থেকে মোটিভ পেয়েছে। পাবারই কথা। ক্লাসে সমস্ত মেয়েদের সামনে রাগান্বিত মুহূর্তে সে কড়া প্রতিবাদের কথা বলেছে। তদন্ত কমিটি নিশ্চয় তার ক্লাসমেটদের কাছে প্রশ্ন করে এর উত্তর খুঁজে পেয়েছিল।

তবে এতকিছুর ভিড়েও হৃদ এখন পর্যন্ত শিশিরকে নিয়ে বাবার আগ্রহের মূল কারণ খুঁজে পেল না। তার বাবা অত্যন্ত ভালো মানুষ। তার চোখে তো ফেরেশতা সমতুল্য। তাই বলে যত বড় মহান উদ্দেশ্য নিয়েই শিশির এমন একটি কাজ করুক, তিনি নিজের সন্তানের ঘরে এমন একটি আপদ এনে বসাবেন না। একজন জজ হয়েও জেলখাটা মেয়ে নিজের ঘরে এনেছেন, ছেলের বউ করেছেন- এত এত কটুক্তির সুযোগ করে দেওয়া মানুষ তিনি নন। তাছাড়া, নিজের ছেলেদের ভালো-মন্দ নিয়ে তিনি সবসময় অতিরিক্ত রকমের সচেতন মানুষ। তিনি এমনটা কেন করবেন? হৃদ প্রশ্ন করার জন্য বাবার মুখের দিকে তাকালো, কিন্তু লজ্জায় আর সঙ্কোচে সাহস হলো না। এক কাজ করা যেতে পারে, ওই ভাইস-প্রিন্সিপালের খোঁজ করলে বাকি বিস্তারিতও জানা যাবে। আর শিশিরের মধ্যে যে বিশেষ কিছু আছে, এটা বাবার থেকে ঠিকানা নিলেই আবার জানতে পারবে সে।

সে ভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে জিজ্ঞাসা করলো,
—ওই ভাইস-প্রিন্সিপালের নাম কী? উনি কী মা*রা গেছেন? কোন স্কুলে চাকরি করতেন তিনি?

সারোয়ার হাবীব ছেলের প্রশ্নটা না শোনার ভান করে স্ত্রীকে এক গ্লাস পানি দিয়ে যেতে বললেন। হৃদ স্পষ্ট টের পেল, তার বাবা তার প্রশ্নটাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছেন৷ হৃদ আবার জিজ্ঞাসা করলো,
—কাল শিশিরের ঠিকানা জানা হয়নি। ওর বাসাটা…

—তুমি না বিয়েটা ক্যান্সেল করেছো? এখন এত প্রশ্ন করে লাভ কী?

(চলবে…)