হৃদয়ম পর্ব-০২

0
121

#হৃদয়ম /পর্ব:—০২
Sharifa Suhasini

—আপনি জেল থেকে কবে এসেছেন?”

—গতকাল সন্ধ্যায়। তবে আপনার সাথে দেখা করার কথা এক সপ্তাহ আগেই শুনেছিলাম। জেলের ভিতর থাকতে। আপনার বাবা নিজে গিয়ে জানিয়েছেন।”

সে যে মিথ্যে বলছে না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত। কিন্তু এমন একটি মেয়ে জেল কেন খাটবে? হৃদ সংকোচ রেখে আবার প্রশ্ন করলো,
—আপনার জেল খাটার কারণ কী?

এর জবাবে শিশির ওর দিকে চেয়ে মৃদু হাসলো। সেই হাসিতে রহস্য এবং অর্থহীন কিছু একটা খেলা করছে। শিশির মাথা দুলিয়ে বললো,
—আপনার বাবা তো সবই জানেন। আপনাকে বলেননি?

হৃদ সম্পূর্ণ হতভম্ব হয়ে শিশিরের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে মেয়েটার ভিন্ন ভিন্ন কথায় ভিন্ন ভিন্ন অনুধাবন হচ্ছে তার। শিশিরের সঙ্গ এই মুহুর্তে ছাড়াটা উচিত হবে না। মেয়েটার সম্পর্কে বিস্তর জানা প্রয়োজন। বিয়ের জন্য নয়। কিন্তু কিছু একটা নিগূঢ় রহস্য কিংবা মায়াজালের অধিকারিণী এই নারী। বর্তমান সময়ে ডেডিস প্রিন্সেসদের ভিড়ে মাত্র ঊনিশ বছর বয়সী এই মেয়েটি সবার থেকে আলাদা। না, ঊনিশ হবে কেন? এখানে আসার আগে তো সে জেনেছিল, শিশিরের বয়স একুশ। এখন এসবই চোখের ভ্রান্তি।

এই মেয়েটা বিশেষ জ্ঞান বুদ্ধিসম্পন্নই বটে। সে শিশির। সকালের স্নিগ্ধ কোমলতায় কিংবা সন্ধ্যের অস্তমিত মলিলনতায়-দুটি মুহুর্তেই তাকে অপার মুগ্ধতা নিয়ে অবলোকন করা যায়। হৃদ ব্রীজে হেলান দিয়ে শিশিরকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—আমরা কী এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবো?

—আপনার অসুবিধে না হলে এবার কোথাও বসা যেতে পারে। কী বলেন? অবশ্য, এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। বৃষ্টি হতে পারে।

হৃদ মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকালো। আকাশ পরিষ্কার, বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা নেই। বিষয়টা শিশিরকে ক্লিয়ার করা উচিত ছিল, কিন্তু সে সেটি করলো না। আলাপের শুরতেই অযথা তর্ক করতে ভালো লাগবে না নিশ্চয়?
সে কাঁধ দুলিয়ে ওর কথায় সায় দেয়।

এরপর কিছুক্ষণ আকাশপাতাল চিন্তা করে বিশেষ সিদ্ধান্তে নিজের মনকে উপনিবেশ করে। পায়রা চত্ত্বরের পাশে একটা পুরনো কপিশপ আছে। সেখানেই বসা যেতে পারে। আরাপপুর মোড়েও যাওয়া যেত। কিন্তু এখন আর ওদিকে যাবার ইচ্ছে নেই শিশিরের। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো পোস্ট অফিসের সামনে একটি কফিশপে বসবে তারা। কফিশপের ছাদে সুন্দর ডেকোরেশন আছে। এই সময় সেখানে বিকেলের সোনা রোদ এসে চিকচিক করে। কথা বলার জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত জায়গা আর কিছু হতে পারে না। কিছুদিন আগে স্থানীয় এক পুরনো বন্ধু ওকে নিয়ে গেছিল।

সে শিশিরকে ডান হাত দিয়ে সামনে এগোতে নির্দেশ দিয়ে নিজে তার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলো। রিক্সা নেওয়া দরকার। শিশিরকে একবার জিজ্ঞাসা করে নিলে কেমন হয়? মনে মনে ভাবতে ভাবতেই সে শিশিরের পাশাপাশি হাঁটা ধরলো। তারপর চাপা স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,
—রিক্সা ডাকি?

—তিন মিনিটের রাস্তা। এরমধ্যে এত বেশি অটো আর রিক্সা ঢুকবে যে,রিক্সায় বসেই বিশ মিনিট পার হয়ে যাবে। আপনি কী তাই চান?

হৃদ সেটা চায় কি-না বুঝতে পারলো না। আর বুঝতে না পারার কারণে হ্যাঁ কিংবা না কোনো জবাবই দিলো না। শিশিরের পাশে থেকে হাঁটতে হাঁটতেই পোস্ট অফিসের সামনে এসে দাঁড়ালো। সন্ধ্যার আগে আগে শহরে মানুষজনের ভিড় গিজগিজ করছে। তাদের সবাইকে পাশ কাটিয়ে যেতে হলো কফিশপে।

ওয়েটার ছেলেটা অর্ডার নিয়ে গেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই কফি এসে যাবে। অথচ এই সময়ের ভেতর দুজনের কেউই কথা বললো না। শিশির বাইরের আকাশটার দিকে একমনে তাকিয়ে আছে। মনে মনে সে যে বুক ভরে শ্বাস নিতে চেষ্টা করছে, তা ওর চোখমুখ দেখলেই টের পাওয়া যায়। ওই মুখের দিকে চেয়ে হৃদের বারবার মনে হলো- না, না, এই মেয়েটা আসামী হতেই পারে না। তার শুনতে ভুল হয়েছে। অবশ্যই ভুল হয়েছে।

শিশির একবার ওর দিকে ফিরে তাকালে চোখাচোখি হয়ে যায়। সে হৃদকে জিজ্ঞাসা করলো,
—আপনার আইটি কোম্পানিটা কোথায় দিচ্ছেন তবে? আপনার বাবা তো সম্ভবত এখানেই জমি কিনে বাড়ি করবেন। আপনার অফিস দেওয়া নিয়ে তো তাহলে বিশাল ঝামেলা পোহাতে হবে।

—ওসব ঝামেলার ধার আমি ধারি না। ঢাকার মিরপুরে। পলবী, মিরপুর। আমার এই জেলায় থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। বাবা কেন থাকতে চান, তাও আমার কাছে ক্লিয়ার না।

—আপনার বাবা আমার কারণে থাকতে চান৷ উনি আমাকে প্রচন্ড পছন্দ করেন। কিন্তু হৃদ সারোয়ার, আমি আপনার বাবাকে অতটা পছন্দ করি না। কেন করি না, সে জবাবও আমার কাছে নেই।

হৃদ এ নিয়ে কথা বাড়ালো না। প্রসঙ্গ পাল্টে সে বললো,
—আপনি কি সত্যিই আমাকে বিস্তারিত জানাবেন না?

—ইচ্ছে করছে না আর।

—আপনি জানেন, আপনার সাথে আমি কেন দেখা করতে এসেছি?

—জানবো না কেন? মেয়েরা সব জানে। কোন পুরুষটি তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলছে, কে ভদ্র চোখে তাকাচ্ছে, কে নষ্ট চোখে তাকে কামনা করছে, সবই টের পায়। শুধু টের পায় না সেই মানুষটার ব্যাপারে, যার কাছে সে ধরা খায়। আপাতত আপনাকেও আমি বুঝতে পারছি। আপনার বাবা চান, আপনার সাথে আমার বিয়ে হোক, ঘর সংসার হোক। কিন্তু এরপরেও আমি ওসব পুরনো কথা আপনাকে এখন বলবো না। আমার হাতে আছে আর একুশ মিনিট। এরমধ্যে আমাকে বেরিয়ে পড়তে হবে। আর গল্প শুরু করলে তা শেষ হতে লাগবে দেড় ঘন্টার মত। কিন্তু আমি তো দেরি করতে পারবো না৷ সন্ধ্যার আযানের পর আমি কোথাও থাকি না। সমস্যা আছে।

শিশির একনাগাড়ে কথা বলে গেল৷ কী এমন ইতিহাস,যেটা বলতে ওর দেড় ঘন্টা লাগবে? ব্যাপারটা নিয়ে হৃদের আগ্রহ কাজ করলেও বিশেষ উৎসাহ দেখালো না। ‘এই মুহুর্তে ওর রীতিমতো বিরক্ত লাগছে। শিশির ইচ্ছে করেই রহস্য রাখছে, নিজের ব্যাপারে খোলসা করে কিছুই বলতে চাইছে না। এমতাবস্থায় সে একা একা কীভাবে কথা এগোবে?’’
এসব ভাবতে ভাবতে হৃদের নিজের উপরেও রাগ হলো। বাড়ি থেকে বের হবার সময় তো সে মনস্থির করেই নিয়েছে, কোনো জেলখাটা মেয়েকে সে কখনোই বিয়ে করবে না। তাহলে শিশিরকে জানার জন্য এত উতলা হবার তো কোনো মানেই হয় না।

ভাবতে ভাবতে যখন সে ভাবনার অতল তলে হারিয়ে যেতে লাগলো, তখনই শিশির বলে বসে,
—আমি একটা মহিলাকে খু*ন করেছিলাম। যদিও সত্যি সত্যি খু*ন করিনি৷ কিন্তু আমার বিরুদ্ধে খু*নের মোটিভ ছিল, প্রমাণও ছিল। কীভাবে আমি তাকে খু*ন করেছি, সেটা আমি নিজেও জানি না। ভদ্রমহিলা আমার স্কুলের শিক্ষিক। সহকারী প্রধান শিক্ষক। উনার বয়স তখন চল্লিশের কাছাকাছি, হাফহাতা ব্লাউজ পরতেন৷ চোখে কাজল দিতেন বাচ্চাদের মত লেপ্টিয়ে। উনার নাম শুনবেন?

হৃদ জবাব দিতে পারে না৷ ওয়েটার কফি নিয়ে চলে এসেছে। তবে সেই কফি খাওয়ার জন্য শিশির ব্যস্ত হলো না। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
—আমার সময় হয়ে গেছে। যেতে হবে৷ আযান পড়ে গেলে আর বাড়ি ফিরতে পারবো না আজ।

শিশির শান্ত, ধীর গতিতে নেমে গেল। হৃদ তার পথের দিকে চেয়ে থেকে আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে বসেছে। শিশির যদি কোনো মহিলাকে খু*ন করেই থাকবে, তবে এখানে তো দুঃসাহসিক কিছুই দেখার নেই। তাহলে বাবা ওর সাথেই কেন বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলেন?

হৃদের প্রশ্ন উত্তর বাড়িতেই আছে, তার বাবার কাছে। সারোয়ার হাবীবকে চেপে ধরলেই সব গড়গড় করে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু বাড়ি ফিরে এসে এসবের কিছুই করলো না।

হাসি হাসি মুখে ঘরে ফিরে মাকে বললো,
—মা, আমি কাল ঢাকায় যাবো। আর শোনো, বাবার পছন্দের ওই মেয়েটাকে আমি বিয়ে করছি না। আমার একদমই ভালো লাগেনি।

ঠোঁটেমুখে হাসির রেখে ফুটিয়ে হৃদ নিজের ঘরে ঢুকতেই বাইরে বৃষ্টি শুরু হলো। হৃদ অবাক হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। সন্ধার আকাশে মেঘ হয়েছিল কি-না, সে জানে না। তবে বিকেলের ওই চকচকে গোধুলির পর এভাবে বৃষ্টি শুরু হতে পারে?

(চলবে…)