হৃদয়াবেগ পর্ব-০৫+০৬

0
563

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ০৫
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

‘আমি এবার আমার সাথে করে নাযীফাহ কে নিয়ে যাবো। ওকে এভাবে মৃত্যুর মুখে ফেলে যেতে পারবো না। আর না পারবো ওকে এখানে রেখে ঢাকা গিয়ে শান্তিতে থাকতে। ওই বিকৃত মস্তিষ্কের লোকটা যে পুনশ্চ হামলা করবে না তার জামিনদার কে হবে? অনেক তো হলো ছেলেমানুষী। এখন না হয় বুঝদার হওয়ার পালা।’

চমকিত নাযীফাহ, আতঁকে উঠলো সে।আত্মা কেঁপে উঠলো তার। অজানা নয় তার ঢাকা গেলে তাকে বন্ধি জীবন কাটাতে হবে। ওখানে না আছে খেলার মাঠ আর তার সাথী সঙ্গী। অপরিচিত জায়গায় সে কোনো ভাবে থাকতে পারবে না। বাবার অভিমুখে নেত্রপাত করলো সে। আঁখি পল্লবে যেন এক্ষুনি ভারি বর্ষন হবে। খালেদ মোশাররফ মেয়ের মনের অবস্থা উপলব্ধি করতে পেরে মাথা অধঃকৃত করে ফেলে। নিরুপায় তিনি। মেয়ের এই অসহায় চোখ মুখের ভাবাবেগ দৃঢ় মুষ্টিতে আঁকড়ে ধরা তার সাজে না। তার একমাত্র আত্মজার জীবন ম’র’ণের প্রসঙ্গভূত বিষয়। অধিকন্তু বর্তমানে তাহমিদ নাযীফাহ’র অভিভাবক। তার একমাত্র মেয়ের সকল দায়িত্ব এখন তাহমিদের। নত মস্তকে বাবাকে দেখে নাযীফাহ প্রতীত হলো তার ঢাকা যাওয়া নিশ্চিত। একবার যখন তাহমিদ ভাই মুখ দিয়ে বের করেছে ঢাকা নিয়ে যাবে তো নিয়েই যাবে।

____________________________________________

ওয়াহিদা বা ফাহমিদা কারোর পক্ষেই সম্ভব না ঢাকা গিয়ে থাকা। ঠিক হলো নাযীফাহ কে সঙ্গ দেওয়ার জন্য আমেনা বেগমই যাবেন। উপরন্তু তাহমিদ নারাজ নাযীফাহ’র সাথে দাম্পত্য জীবন শুরু করতে। সে তার সিদ্ধান্তে অটল, আগে নাযীফাহ স্বীয় মঙ্গল অমঙ্গল বুঝবে তারপর বাকিসব। তথাপি এইখানেও সে নাযীফাহ কে রাখবে না। তাহমিদ আর ফাহিম দুই রুমের একটা ফ্ল্যাটে থাকে। খুঁত খুঁতে স্বভাবের ফাহিম। তার জন্যই আলদা ফ্ল্যাটে থাকা তাহমিদের।

সবকিছু গোছগাছ করছেন ফাহমিদা বেগম। নাযীফাহ মায়ের দিকে নির্নিমিখ আঁখিতে তাকিয়ে আছে। নয়নবারিতে টইটম্বুর কনীনিকা। এক্ষুনি সম্ভবত নিন্মমুখী হবে অক্ষিযুগলের সেই অতি মূল্যবান অম্বু। মেয়ের মায়াময়ী আননে দৃষ্টিপাত করেও করলো না ফাহমিদা বেগম। মেয়ের জন্য তার বক্ষস্থলেও অদৃশ্য র’ক্ত’ক্ষ’র’ন হচ্ছে। কিন্তু তা মেয়েকে বুঝতে দেওয়া চলবে না। তাহলে তার অবুঝ মেয়েটা আর শহরে যেতে চাইবে না। সবকিছুর উর্ধ্বে মেয়ের নিরাপত্তা।

নাযীফাহ’র সকল প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গাড়িতে উঠানো হলো। এক্ষুনি তারা ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দিবে। সবাই উপস্থিত তবে নেই শুধু ফাহমিদা বেগম। তিনি দূরে দাঁড়িয়ে নয়ননীর বিসর্জন দিচ্ছেন। অবুঝ মেয়েটার অভিমান ভরা অঙ্গরেখার দিকে তাকানোর সাহস তার নেই। কাল বিকেল থেকে কিছু খায়নি নাযীফাহ। যতবারই খাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে ঠিক ততবারই নাযীফাহ কঠিন গলায় বলেছে, ‘গ্রাম থেকে তো শহরে চলেই যাচ্ছি। একেবারে না হয় শহরে গিয়েই খাবো।’

নাযীফাহ’র বরাবর অগ্রসর হলেন খালেদ মোশাররফ। তিনি ঢাকা যেতে চাইলে তাহমিদ বাঁধা দেয়। কি দরকার এই অসুস্থ শরীরটা নিয়ে টানাহেঁচড়া করার। বিষন্ন হেসে মেয়ের মাথায় হাত রাখতেই দু’কদম পিছিয়ে গেলো নাযীফাহ। ছলছল চোখে মুখ ফিরিয়ে সে। মুহূর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে গেলো খালেদ মোশাররফের মুখমণ্ডল। বাবাকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না নাযীফাহ। গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলো।

মেয়ের এমন মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় ব্যথিত হলো খালেদ মোশাররফ। বিষন্ন স্বরে তাহমিদের দু’টো হাত ধরে বলে উঠলো,

‘তোর হাতে আমার বুকের মানিকরে তোলে দিলাম বাপ। আমার মেয়েটা পুরোদস্তুর বাচ্চা। দুনিয়ার মারপ্যাচ কিছুই বোঝে না। তুই কষ্ট করে সামলে নিস। মেয়েটা আমার একমাত্র তোর কথাই ঠিকমতো শুনে। খাওয়া নিয়ে হাজারও বায়না তার। তুই সামনে বসিয়ে খাওয়াবি। না হলে সারাদিনে মুখে কিছু তুলবে না। আমার মেয়ের উপর দিয়ে এতোবড় ঝড় না গেলে আমি কখনো আমার মেয়েকে কাছ থেকে দূরে পাঠাতাম না।’

মামুকে আশ্বস্থ করে গাড়িতে উঠে তাহমিদ। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলো। পিছনের সীটে বসেছে আমেনা বেগম, নাযীফাহ আর ফাহিম। আর সামনে তাহমিদ আর ড্রাইভার। গাড়ি চলা শুরু করতেই নাযীফাহ আমেনা বেগমের বক্ষকে অবলম্বন করে অশ্রুপাত করতে লাগলো।

গ্রামের কাঁচা রাস্তা ছেড়ে বড় রাস্তায় উঠেছে গাড়ি। দিনের ঔজ্জ্বল্যতা ক্রমশ হ্রাস পেয়ে নক্ষত্রমন্ডলে মেঘেরা ভির করেছে। আঁধারে ছেয়ে গেছে চারপাশ। অল্পক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি বর্ষিত হওয়া আরম্ভ হলো। বজ্রপাতহীন মুষলধারে বৃষ্টি। বারিবিন্দু আছড়ে পড়ছে জানালার কাঁচে। নাযীফাহ মাথা তুলে ক্ষীণ স্বরে ড্রাইভারকে বলে,

‘জানালার কাঁচটা খুলে দিন না দয়া করে।’

নাযীফাহ’র দিকে অপাঙ্গে চাইল তাহমিদ। ড্রাইভার সামনে দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই জবাব দিলো,

‘ যেই পরিমাণে বৃষ্টি হচ্ছে, এখন জানালার কাঁচ আধখোলা রাখলে ভিজে যাবেন।’

অগত্যা মন খারাপ করে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো নাযীফাহ। তাহমিদ ইঙ্গিতে ড্রাইভারকে বলল
কাঁচ খুলে দেওয়ার জন্য। ইঙ্গিত বুঝতে পেরে উনি এসি বন্ধ করে গাড়ির লক খুললেন।তারপর ফাহিমকে বললেন জানালার কাঁচ খুলে দেওয়ার জন্য। বৃষ্টির ছিটকানো পানি মুখে এসে পড়তেই অধর কোণে হাসি ফুটে উঠলো।উৎফুল্ল, প্রানবন্ত হয়ে উঠলো মন। হাত বাড়িয়ে দিলো বহির্ভাগে। আড়চোখে নাযীফাহ’র উৎফুল্লতা লক্ষ্য করছে তাহমিদ। করতলে বৃষ্টিবিন্দু জমিয়ে ভেতরে আনে হাত।

‘এগুলো বৃষ্টি না গ্রাম ছেড়ে চলে আসায় আমার চোখের নোনাজল এগুলো। আমার চোখের পানি বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে ঝরছে।’

নাযীফাহ’র অর্থহীন কথা শুনে নৈঃশব্দে হাসলো তাহমিদ। ড্রাইভার মিটিমিটি হাসছে।তবে শব্দ হচ্ছে না। এতোক্ষণ বহুকষ্টে চেপে রাখা হাসিটা আর আঁটকে রাখতে পারলো না ফাহিম। শব্দ করে হেসে উঠলো সে।

‘তাইলে বইন তুই দয়া কইরা তোর মনের কান্দন থামা। নাইলে আশমান ভেদ করে ঝরা তোর চোখের পানিতে দেশ ভেসে যাবে। এই অবলা মানুষদের উপর রহম কর বইন রহম কর।’

করতলে থাকা অম্বু ফাহিমের সম্মুখ বরাবর নিক্ষেপ করে নাযীফাহ।

____________________________________________

কোথাও একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। সেজন্য বন্ধ ছিলো যান চলাচল। সেই জ্যামে প্রায় ঘন্টা তিনেক আটকা পড়েছিল তাদের গাড়ি। ঘেমে-নেয়ে একাকার একেকজন। নাযীফাহ মনে মনে কঠোর ভাষায় তিরস্কারও করলো। গোধূলির আকাশে রক্তিম আভা যখন সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত হলো ঠিক তখনই জ্যাম ছাড়লো। স্নিগ্ধশীতল বাতাস গাত্র ছুঁয়ে দিতেই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেলো নাযীফাহ। অপরদিকে আমেনা বেগম ভর্ৎসনা করতে লাগলো, আগে জানলে কখনো আসতো না। তার আছরের নামায আর মাগরিবের নামায কাজা হয়ে গেলো।

সন্ধ্যার পরপর বাসায় থাকার কথা। অথচ রাত সাড়ে ন’টা ছুঁই ছুঁই মাত্র গাড়ি বাসার নিচে থামলো। ফাহিম তার বলল,

‘ভাইয়া এরা দু’জন তো গভীর ঘুমে নিমগ্ন।’

তাহমিদ ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে উঠলো,

‘ডাক দু’জনকে।’

ফাহিম পরপর কয়েকবার আমেনা বেগমকে ডাকতে পিটপিট করে তাকালো। কিন্তু নাযীফাহকে এতোবার ডাকার পরও চোখ মেলল না। ফাহিম নিরাধার চক্ষে তাকালো ভাইয়ের দিকে।

‘ভাইয়া তোমার শিশু পত্নী চোখ খুলছে না।’

হাসি পেল তাহমিদের। কিন্তু চোখে-মুখে তা ফুটে উঠলো না। চোখ রাঙায় সে ফাহিমকে।

‘তুই আগে মালপত্র বের কর। আমি আগে ভাড়া মিটিয়ে নেই।’

ফাহিম মাথা নেড়ে সায় জানায়। চলে যায় গাড়ির ডিকির কাছে। ড্রাইভারকে ভাড়া দিয়ে তাহমিদ সতর্কতার সহিত নাযীফাহ কে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। নাযীফাহ’র মাথাটা বুকে রাখতেই শীতল হাওয়া বয়ে গেলো। হাসলো সে। একটু একটু করে এই অবুঝ মেয়েটার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছে সে। যখন শুনলো নাযীফাহ কে পাওয়া যাচ্ছে না। তখন মনে হয়েছিল তার গলায় কেউ চি’পে ধরেছে।

বাসায় এসে নাযীফাহকে বিছানায় শুইয়ে আগে তাহমিদ ফুডপান্ডায় খাবার অর্ডার করলো। অন্য রুমে খাট নেই তাই ফ্লোরে ম্যাট্রেস পাতলো দুই ভাইয়ের জন্য। এখন থেকে এখানেই থাকবে তারা।

সবকিছু গোছগাছ করা শেষ। আমেনা বেগম নামায পড়ছেন। ঠিক সেই সময় ডেলিভারি বয় এলো খাবার নিয়ে। খাবার নিয়ে বিপাকে সে।প্লেট দুইটা অথচ মানুষ চারজন। দু’টো প্লেটে খাবার নিয়ে আগে সে দাদিকে দিলো।আরেকটা প্লেটে খাবার নিয়ে রুমের দিকে গেলো। ফাহিম এসব দেখে সুদীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলল।

‘আহা কি মহব্বত। এইদিকে ছোট ভাই না খেয়ে বসে আছে সেদিকে নজর নেই।’

তাহমিদ মৃদু স্বরে নাযীফাহকে ডাকছে। এপাশ-ওপাশ করে জবাব দিলো সে। তাহমিদ খাওয়ার কথা বলতেই ঘুমন্ত অবস্থায় তার চোখ মুখ কুঁচকে এলো। ঘুম ঘুম গলায় বলে উঠলো,

‘খাবো না আমি। আমার শরীর কেমন জানি করছে।’

‘কাল থেকে না খাওয়া তুই। সেজন্য তোর শরীর দূর্বল। এখন কিছু না খেলে সকালে আরো নেতিয়ে পড়বি।’

নাযীফাহ ‘খাবো না’ বলে আবার ঘুমিয়ে যেতে উদ্যত হতেই আকস্মিক ধমকে উঠে তাহমিদ। কেঁপে উঠে নাযীফাহ। দূর্বল শরীরটা নিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে। তৎপরে ঠোঁট উল্টে বলে,

‘আপনি আমাকে ধমক দেওয়া, রাগ দেখানো এসবের জন্য গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছেন। আমি জানি তো।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাহমিদ।

‘খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে গেলে আর বকবো না।’

‘খেতে হলে ওয়াশরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুতে হবে। আমার এসব কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না। তাই আমি খাবো না।’

‘তাহলে আমি খাইয়ে দেই?’

কথাটা কর্ণকুহরে পোঁছানো মাত্রই বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাহমিদের দিকে তাকায় নাযীফাহ।

____________________________________________

পাশের ফ্ল্যাটের প্রবেশদ্বারের সামনে দন্ডায়মান তাহমিদ। কলিং বেল চাপবে কি চাপবে ইতস্তবোধ করছে। এই সাতসকালে কারো বাসায় যাওয়াটা কেমন দেখায় না। মনের সাথে যুদ্ধ করে কলিং বেল চাপলো তাহমিদ। খানিক সময় পর একজন ২৯ কি ৩০ বছরে নারী দরজা খুলে দেয়। তাহমিদকে দেখে মৃদু হাসলো সে। জবাবে তাহমিদও হাসলো। সৌজন্যতার খাতিরে নারীটি বলল,

‘আরে তাহমিদ যে, ভেতরে এসো। নিতুর বাবা নাস্তা করছে। নাস্তা করে যাও।’

জবাবে তাহমিদ বলে,

‘না ভাবি। আসলে একটা সাহায্যের জন্য এসেছিলাম।’

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় উনি।

‘আসলে ভাবি এতোদিন তো আমি আমার ভাই থাকতাম। কাল গ্রাম থেকে আরো দু’জন এসেছে। আমার দাদি আর মামাতো বো,,,’

বলতে গিয়েও থেমে যায় সে। নিতুর মা জিজ্ঞেস করে,

‘দাদি আর কে?’

নিরব, নিশ্চুপ তাহমিদ।

#চলবে

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ০৬
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

শব্দহীন ভাবে অধর জোড়া প্রসারিত করে তাহমিদ বলল,

‘আমার অর্ধাঙ্গী।’

‘অর্ধাঙ্গী’ ধ্বনিটা শ্রবণ গ্রন্থিতে ধাক্কা দেওয়া মাত্রই উনি চমকিত, স্ফুরিত নয়নে তাকায় তাহমিদের দিকে।

‘বিয়ে করে ফেলেছো?’ হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে তাহমিদ। নিতুর মা কিছুটা মন খারাপের অভিনয় করে বলে,

‘বিয়ে করে ফেললে অথচ দাওয়াত দিলে না। এটা কিন্তু ঠিক না। আমরা নিরীহ মানুষদেরও তো একটা হক আছে।’

মুখে হাসি বজায় রেখে তাহমিদ বলে,

‘আনুষ্ঠানিকতা কিছুই হয়নি। শুধু আকদ হয়েছে। বিয়ে হয়েছে এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ। সংসার জীবনে পা রাখতে বহু দেরি।’

নিতুর মা বিস্মিত হয়ে বলে,

‘তাহলে এখানে নিয়ে এলে যে?’

‘আসলে ভাবি গ্রামে ওর জীবটা হুমকির মুখে আছে। তাই সাথে করে নিয়ে এসেছি। তাই একটু সাহায্যের জন্য এসেছিলাম। আমি বা ফাহিম তো দিনের বেশির ভাগ সময় বাসায় থাকবো না একটু যদি তাদের সময় দিতেন। নিতু গিয়ে নাযীফাহকে সময় দিলেই চলবে।’

নিতু সময় দেওয়ার কথা বলতেই কপালে ভাঁজ পড়ে নিতুর মায়ের।

‘নিতু সময় দিবে? ও তো বাচ্চা মেয়ে।’

নির্বেদ গলায় তাহমিদ বলে,

‘বউ আমার গায়ে গতরে বড় হয়েছে। শিরা উপশিরায় শুধু বাচ্চামি। নিতু গেলে আর কাউকে ওর লাগবে না।গ্রামীণ পরিবেশে বড় হয়েছে তো হঠাৎ করে শহুরে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারবে না। উপরন্তু বাড়ির জন্যও মন খারাপ করবে। নিতু গিয়ে সময় কাটালে ওসব নিয়ে ভাবার সময় পাবে না।’

নিতুর মা প্রশস্ত হেসে জবাব দিলো,

‘সমস্যা নাই নিতুর স্কুল ছুটি হলে তোমার বাসায় পাঠিয়ে দিবো। দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলছো ভেতরে এলে না?’

‘না ভাবি, নিচে যাবো। সবার জন্য নাস্তা আনতে হবে।’

‘আচ্ছা যাও তাহলে।’ নিতুর মা দরজা আঁটকাতে নিলেই তাহমিদ অবিলম্বে বলল,

‘ আরে ভাবি যেটার জন্য এসেছিলাম, একটা বুয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন? টাকা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।দাদিকে তো রান্না করতে দিবো না। আমার বউ তো বাচ্চা। ও আরো আগে রান্না করবে না। আমিও দিবো না রান্না করতে। দুই একদিনের ভেতরে একজন বুয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?’

উনি স্মিত হেসে জবাব দিলেন,

‘তুমি চিন্তা করো না আমার ছুটা বুয়া আসলে আমি জিজ্ঞেস করবো এই ব্যপারে।’

____________________________________________

দুপুরের দিকে ধানি জমি দেখতে গিয়েছিল খালেদ মোশাররফ। বাড়িতে আসার পর শরীর ক্লান্ত থাকায় বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেলেন উনি। ঘুম ভাঙে মেঘের গর্জনে। চোখ মেলে খালেদ মোশাররফ দেখতে পান বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বক্ষস্থলে মোচড় দিয়ে উঠলো। আজ দু’দিন হলো বাড়িটা একেবারে নিরব। দু’দিন আগেও কেউ একজন খিলখিল করে হাসতো আর আজ? হতাশা মিশ্রিত শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ান তিনি। দুপুরে খাওয়া হয়নি ঘুমিয়ে ছিলেন বিধায়। নিশ্চয়ই নাযীফাহ’র মাও কিছু খায়নি। হাত মুখ ধুয়ে তিনি বসার ঘরে আসলেন। বসার ঘরে এসেই খালেদ মোশাররফের চোখ ছানাবড়া। ফাহমিদা বেগম এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে দরজা খুলে স্থির দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু ফোঁটা ঘরে এসে সব ভিজিয়ে ফেলছে। উনি তড়িৎ গতিতে দরজা বন্ধ করলেন। ফাহমিদা বেগমকে বললেন,

‘নজর কই তোমার ফাহমিদা? ঘরের সব ভিজে গেলো যে।’

ফাহমিদা বেগম বিবশ চক্ষুতে তাকালেন খালেদ মোশাররফের অভিমুখে। আঁখি পল্লবে অশ্রু টলমল করছে। এই আকাশের ন্যায় তার চোখেও বর্ষণ হবে।

‘আজ তো দরজা খুলে বসে ছিলাম। অথচ কেউ এসে অনুনয় করলো না বৃষ্টিতে ভিজবে বলে।কেউ বললো না, ওমা যাই না শুধু পাঁচ মিনিট ভিজবো। ওমা যেতে দাও না। পুরো বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। একটা ফোন দাও না মেয়েটাকে। সামনাসামনি তো দেখতে পারবো না গলার স্বরটাই না হয় শুনি।

খালেদ মোশাররফের অন্তস্তল থেকে নির্গত হলো ভারী শ্বাস। স্ত্রীর পাশে বসে হাতটা মুঠোয় নিয়ে বললেন,

‘মেয়ের জন্যও তো আমারও ভিতর পুড়ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। এখন ফোন দিলে মেয়ে কথা বলবে না। অবুঝ মেয়ের অভিমান সম্পর্কে তো জানোই। রাগ পড়লে দেখবে নিজেই ফোন দিবে।’

‘মেয়ের জন্য যে ভিতরটা পুড়ছে।মন যে মানছে না।’

____________________________________________

নিগূঢ়, দুর্ভেদ্য, নিস্তব্ধ নিশি। রাস্তায় সোডিয়ামের হলদেটে আলোয় ঝলমল করছে চারপাশ।মাঝে মাঝে রাস্তার কুকুরগুলো হাঁক ছেড়ে ডাকছে। মাঝরাতে চাপা কান্নার মৃদু শব্দে নিদ্রা হালকা হয়ে আসে আমেনা বেগমের। বয়স হয়েছে তাই ঠাহর করতে পারছেন না। নাযীফাহ’র গায়ে হাত দিতেই অনুভব করলো তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমেনা বেগম বুঝতে পারলেন মেয়েটা নিঃশব্দে কাঁদছে। হয়তো এই মাঝরাতে মা বাবার কথা খুব মনে পড়ছে। তিনি বার কয়েক ডাকলেন। কোনো সাড়াশব্দ নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মমতার সাথে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। পরক্ষণেই পাশা ফিরে আমেনা বেগমকে ঝাপটে ধরে নাযীফাহ। আমেনা বেগমও সহ্লাদে আগলে নিলেন। কান্নার মাত্রাটা কয়েকগুণ বাড়লো।

‘মা-বাবার কথা কি খুব মনে পড়ছে?’

কোনো জবাব দিলো না নাযীফাহ।

‘তাহমিদ কে বলবো কল দিতে?’ বাঁধন আলগা করে দূরে সরে গেলো নাযীফাহ।

‘আমি আর তাদের সাথে কখনো কথা বলবো না। তাঁরা কেউ আমাকে ভালোবাসে না। ভালোবাসলে কখনো এভাবে এইখানে পাঠাতো না।’

অক্রূর হাসলেন আমেনা বেগম।

‘ভালোবাসে বলেই তো এইখানে পাঠিয়েছে। সন্তানের বিপদের কথা শুনলে কোনো মা-বাবাই স্থির থাকতে পারে না। মনে কর এতেই তোর ভালো।’

নাযীফাহ’র অভিমানী গলা,

‘আমার এমন আদর ভালোবাসার দরকার নাই। যেই ভালোবাসায় বাবা মা কে ছেড়ে দূরে থাকতে হয়।’

কোনো উত্তর করলেন না আমেনা বেগম। এখন যতই বুঝাক না কেন নাযীফাহ কোনো বুঝ মানবে না।

____________________________________________

ক্লান্ত, অবসন্ন, পরিশ্রান্ত অপরাহ্ন। সারাদিনের প্রগাঢ় উষ্ণতার শেষে পরিবেশ একটু একটু করে শীতল হতে শুরু করেছে। পূর্বাভিমুখে আবার একটু একটু মেঘ জমছে। সারাদিনের প্রখর তাপদাহ আর সন্ধ্যা হলেই শুরু হয় ভারী বর্ষণ।

গেইটে প্রবেশ করেই মুখোমুখি হয় তাহমিদ আর নিতুর মা। দুজনেই সৌজন্য হাসলো। মুখে হাসি বহাল রেখেই নিতুর মা বলল,

‘আরে তাহমিদ তোমাকেই খুঁজছি। সময় করেই উঠতে পারছি না দেখা করার জন্য।’

তাহমিদও মুখে হাসি বহাল রেখে জবাব দিলো,

‘ধন্যবাদ ভাবি বুয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমাকে খুঁজছেন কেন ভাবি?’

‘তোমার বউ তো দেখি একেবারে বাচ্চা। তোমার বউ সেদিন নিতুকে বলেছে খেলনা বাটি থাকলে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ভাবা যায় তাহমিদের মতো বুঝদার ছেলে একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করেছে।’

তাহমিদ স্মিত হাসলো। আকাশের দিকে আঙ্গুলিসঙ্কেত করে বলে,

‘সব উপরওয়ালার ইচ্ছা। তিনিই জোড়া মিলাইছে। তবে বউ আমার শুধু বাচ্চাই না প্রচন্ড অভিমানীও।’

শব্দযোগে হাসলো দু’জন।

‘তবে তুমি কিন্তু ভাগ্যবান। আজকাল প্রাপ্ত বয়সের মেয়েরা বেশির ভাগই হারাম সম্পর্কে লিপ্ত থাকে। সেক্ষেত্রে তোমার বউ বাচ্চা হয়ে ভালোই হয়েছে। সে যখন একটু একটু করে অনুভূতি বুঝতে শিখবে তার অনুরাগ আর স্পর্শেন্দ্রির শুরুতেই তুমি থাকবে। তার অনুভূতির অন্বেষণটাই হবে তোমাকে দিয়ে। তাকে একটু কেয়ার করবে,যত্ন নিবে, প্রতিকূল পরিবেশ থেকে আগলে রাখবে ব্যস এইটুকুই। কখনো অবহেলা করবে না। নাযীফাহ’র ভিতর বাহির সবখানেই থাকবে তোমার বিচরণ। মাঝে মাঝে বাসায় যাওয়ার আগে কিছু ফুল, চকলেট, চুড়ি যেও।এগুলো বেশি দামী না। তুমি যত ওকে কেয়ার করবে ও তত তাড়াতাড়ি অনুভূতির সাথে পরিচিত হবে। সে যখন তোমাকে উচ্ছ্বসিত হয়ে কিছু দেখাতে চাইবে বা বলবে তখন হাজার ব্যস্ত থাকা সত্বেও তার কথা মনযোগ দিয়ে দুই মিনিট শুনবে। মেয়েরা এই জিনিস গুলো খুব করে চায়।’

এতটুকু বলে থামলেন উনি।

‘কি বললাম বুঝতে পেরেছো তো?’

মাথা নাড়ায় তাহমিদ। তারপর উনি সহাস্যে বলেন,

‘তাহলে শুরু করে দাও অদৃশ্য প্রণয়। যে প্রণয় হালাল। আছে শুধু পবিত্রতা আর আল্লাহর রহমত। আচ্ছা যাই তবে।কিছু কেনাকাটা বাকি আছে।’

সামনে এগিয়ে গেলো নিতুর মা।তাহমিদ সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। নিতুর মা কিছুটা পথ এগিয়ে গিয়েও পিছু ফিরে ডাকলো তাহমিদকে।তাহমিদ তাকায় উনার দিকে।

‘অভিমানী মেয়েরা কিন্তু খুব করে ভালবাসতে জানে। এদের ভালোবাসায় কোনো ভেজাল থাকে না।’

____________________________________________

মেয়ের রুমে এসেছে ফাহমিদা। নাযীফাহ ঠিক যেই জায়গাটায় ঘুমাতো সেই জায়গায় এসে শুয়েছেন তিনি।পিছু পিছু নাযীফাহ’র বাবাও এসেছেন। নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন ফাহমিদা বেগম। শিয়রের কাছে গিয়ে বসলেন খালেদ মোশাররফ।

‘তুমি বুঝের মানুষ হয়ে এভাবে কান্না করলে না জানি আমার অবুঝ মেয়েটা কিভাবে কি করছে।’

‘আমার মেয়েরে এনে দাও।আমার অশান্তি লাগে। আমার বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে। মনে হয় কত বছর দেখি না।’

‘মেয়েটা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। তারেক সাহেবকে পুলিশ নিয়ে গেছে মানলাম। উনার কোনো চেলা পেলা যে আমার মেয়ের কোনো ক্ষতি করবে না তার কোনো গ্যারান্টি দিতে পারবে? এর চেয়ে ভালো মেয়েটা দূরে থাক। অন্তত অক্ষত, অনাহত তো থাকবে।’

স্তব্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো চারপাশ

____________________________________________

বাসায় এসে ফ্রেশ হয়েছে তাহমিদ। আমেনা বেগম ছোট্ট ড্রয়িং রুমটায় বসে তছবিহ জপছে।তোয়ালে দিয়ে মাথার চুল মুছতে মুছতে আমেনা বেগম জিজ্ঞেস করলো নাযীফাহ’র কথা। উনি রুমের দিকে ইশারা করলেন।

দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে তাহমিদ সুস্থির, অচঞ্চল গলায় ডাকল,

‘নাযীফাহ?’

নাযীফাহ’র ভণিতা বিহীন উত্তর,

‘আমার এখানে দম বন্ধ লাগে তাহমিদ ভাই।’

#চলবে