হৃদয়াবেগ পর্ব-০৭+০৮

0
525

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ০৭
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

দিনের ঔজ্বল্যতা কিভাবে ক্ষীনালোকে পরিনত হয় তাই এক মনে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলো নাযীফাহ। তখনই তাহমিদের স্নিগ্ধ শীতল স্বর তার কর্ণকুহরে পৌঁছায়। সম্মুখে চাহনি স্থির রেখে সে বলে,

‘আমার এখানে দম বন্ধ লাগে তাহমিদ ভাই।’

কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া করে না তাহমিদ।খুব সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে নাযীফাহ’র পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। নির্বিকার নাযীফাহ অপলক তাকিয়ে আছে বহির্ভাগে।আর তাহমিদ নির্নিমেষ তাকিয়ে দেখছে নাযীফাহকে।

‘গ্রামে যেতে ইচ্ছে করছে?’

উত্তর দিলো না নাযীফাহ।

‘মামু আর মামির কথা মনে পড়ছে?’ এবারও নিষ্ক্রিয়ভাবে দাঁড়িয়ে রয় সে।

‘মামুর সাথে কথা বলবি কল দিবো?’ বলেই মোবাইল আনার জন্য রুমের দিকে কদম বাড়াতেই আটকায় নাযীফাহ।

‘আমি কারো সাথে কথা বলবো না তাহমিদ ভাই।’

‘তাহলে?’

বিষাদভারাতুর মুখে নাযীফাহ বলে,

‘এই চার দেয়ালের মাঝে নিজেকে কেমন জেলখানার আসামী আসামী মনে হয়।আমি একটু বাইরে গিয়ে প্রাণখোলা নিঃশ্বাস নিতে চাই।’

থমকে যায় তাহমিদ। পুনরায় অগ্রসর হয় নাযীফাহ’র দিকে।পুনশ্চ পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো সে।

‘রাতের ঢাকা শহর দেখবি নাযীফাহ? সোডিয়াম আলোয় ঝলমলে ঢাকা শহর?

____________________________________________

‘দাদি বাইরে ঘুরতে যাবো তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।’ কথাটা তাহমিদ বলা মাত্র প্রখর দৃষ্টিতে তাকায় আমেনা বেগম। আমেনা বেগমের এমন খর দৃষ্টি দেখে ভরকে যায় তাহমিদ।

‘কি, এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’

আমেনা বেগমের কাঠকাঠ গলায় বললেন,

‘তোমাদের শরীরে রং থাকলে তোমরা যাও। আমি এখানেই ঠিক আছি। তোমাদের সাথে ঘুরতে যাই আর সেদিনের মতো আমার নামাজ কাযা হউক।’

‘আরে দাদি এশার নামাজের সময় তো বেশি থাকে।’

‘থাকুক তারপরও আমি যাবো না।’

হাজার বার বলার পরও যেতে রাজি হলেন না আমেনা বেগম। অগত্যা বাধ্য হয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো সে। রুমে গিয়ে দেখলো ফাহিম মনযোগ দিয়ে পড়ছে।

‘রেডি হয়ে নে নাযীফাহ আর তোকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যাবো।’

বইয়ের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে ফাহিম বলে,

‘দাদি যাবে না?’

‘না। তার নামাজ কাযা হয়ে যাবে।’

‘এশার নামাজও কাযা হয়ে যাবে?’

‘হুম।’

‘তাহলে আমিও যাবো না।দাদিকে বাসায় একা রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। তাছাড়াও একটা দামড়া ছেলে আর একটা অবুঝ শিশুর কেমিস্ট্রির শুরুতে আমি বাঁধা দিতে চাই না।’

চোখ গরম করে তাকায় তাহমিদ। ফাহিম ভয় পাওয়ার অভিনয় করে বলে,

‘এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমার ভয় করে তো। এই দেখো আমি ভয়ে কাঁপছি।’

তাহমিদ কিছু না বলে চলে যায় রেডি হতে।

____________________________________________

কোলাহলপূর্ন ঢাকা শহর। যে যার মতো হেঁটে যাচ্ছে। কারো দিকে কারো নজর নেই।চারপাশের দোকান থেকে আসা বাহারি রঙের আলোর সাথে সোডিয়ামের আলোয় মোটামুটি সব কিছুই স্পষ্ট। ফাঁকা জায়গায় ফুচকার স্টল, আবার কেউ কেউ পিয়াজু, আলুর আরো নানারকম ভাজাপোড়া বিক্রি করছে। ফুটপাত ধরে হাঁটছে তাহমিদ। তার এক পেছনে নাযীফাহ। নাযীফাহ ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক সবকিছু দেখছে।ওয়েস্টার্ন পড়া কাউকে দেখলে বা হাতে হাত রেখে হাঁটতে থাকা কোনো কাপল দেখলে কপাল কুঁচকাচ্ছে। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট দৃশ্য এটা। হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে তাহমিদ। কপাল কুঁচকায় নাযীফাহ। তাহমিদ পিছনে ফিরে বলে,

‘এতো পিছনে হাঁটছিস কেন? হারিয়ে যাবি তো।’

তারপর নাযীফাহ’র অগোচরে বিড়বিড় করে বলে,

‘আমার একমাত্র শিশু বউ। হারিয়ে গেলে পাবো কোথায়?

দু’কদম এগিয়ে এসে তাহমিদ এর সমান সমান হয়ে দাঁড়ায় সে।

‘মাত্রই এক হাত পিছনে। এতো পিছনে কই হাঁটলাম?’

তাহমিদ অকস্মাৎ নাযীফাহ’র হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্দি করে।বিস্মিত, স্তম্ভিত, চমকিত নাযীফাহ। শিউরে ওঠে তার শরীর। বিস্ফোরিত নয়নে একবার মুঠোবন্দি হাতের দিকে আর একবার তাহমিদের দিকে তাকায়।

‘আব,,,,,,।’

তাহমিদ কোনো তোয়াক্কা না করে বলল,

‘নে এইবার হাটঁ। এইবার আর হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই। না হলে তোকে ছেলেধরা নিয়ে যাবে।’

ছেলেধরার কথা শুনে ভয়ে সিটিয়ে গেলো নাযীফাহ। ছোটবেলা থেকেই তার ছেলেধরাকে ভয় লাগে। এটাই অবশ্য স্বাভাবিক।

মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও মনে মনে হাসলো তাহমিদ। সে ইচ্ছে করেই নাযীফাহ’র হাত ধরেছে। সামনে এতো এতো কাপল দেখে তারও ইচ্ছে হলো অর্ধাঙ্গিনীর হাতে হাত রেখে হাঁটতে। এখানে কোনো পাপা নেই। এই স্পর্শ সম্পূর্ণ পবিত্র। মনের অদম্য ইচ্ছেটাকে আর দমিয়ে রাখতে পারলো না। তাই অযুহাতে ধরেই ফেলল অর্ধাঙ্গীর হাত।

তিমিরাচ্ছন্ন, নিষ্প্রভ পথে তাল মিলিয়ে হাঁটছে দু’জন। একজনের মুখে আতংকের ছাপ। আর আরেকজনের মুখে অদৃশ্য ক্রুর হাসি।

‘ফুচকা খাবি?’

বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলো নাযীফাহ। না বোধক মাথা নাড়ে সে। বিস্মিত হয়ে তাহমিদ বলে,

‘মেয়েরা তো ফুচকা পাগল আর তুই ফুচকা খাবি না?’

‘কে বলে খাবো না? খাবো তো তবে পরে এখন না। আগে আমাকে একটু মুক্ত হাওয়া গায়ে লাগাতে দিন।মনে হচ্ছে জেলখানা থেকে বের হয়েছি। কতদিন পর বাইরের পরিবেশ দেখলাম। আগে একটু প্রাণখোলা নিঃশ্বাস নেই। আচ্ছা ঢাকা শহরে মানুষ এভাবে বন্দি হয়ে থাকে কিভাবে?’

আবছা, নীহারিকাবেষ্টিত আলোয় নাযীফাহ’র দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো তাহমিদ। প্রদোষকালের এই অস্পষ্ট আলোয় অপূর্ব মায়াবী লাগছে নাযীফাহ’র মুখশ্রী। আরো একটা অদম্য ইচ্ছা জাগ্রত হলো তাহমিদের অন্তর্দেশে। নাযীফাহ’র কপালে তার অধর জোড়ার সস্নেহ স্পর্শ দিতে মন চাইলো। হাত ধরার ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখতে না পারলেও তার মনের এই সুপ্ত বাসনা না চাইতেও দমিয়ে রাখতে হলো । অকস্মাৎ এমন স্পর্শ করলে তাহমিদ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা মনে পোষণ করবে নাযীফাহ। তার চেয়ে বরং অপেক্ষা করুক এমন একটা সময়ে। যখন নাযীফাহ মরিয়া হয়ে থাকবে তাহমিদের অনুরাগ মিশ্রিত, ভালোবাসাপূর্ণ স্পর্শ পাওয়ার জন্য। সবুরে তো মেওয়া ফলে। আর ধৈর্যের ফল তো বরাবরই মিষ্টি হয়।

‘কি হলো কথা বলছেন না যে?’

তাহমিদ নাযীফাহ’র প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল,

‘আমার সাথে রোজ রাতে হাঁটতে বের হবি? তাহলে আর তোর কাছে নিজেকে বন্দি মনে হবে না। আর আশপাশটাও চিনে রাখলি।’

না বোধক মাথা নাড়ে সে। তাহমিদ ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘কেন?’

‘কারণ আপনি সারাদিন নিজে পড়াশোনা করে তারপর কোচিং-এ ক্লাস করে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেন। ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নিয়ে আবার সন্ধ্যায় টিউশন যান। আবার আমাকে নিয়ে বাইরে বের হওয়া আপনার জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে।’

তাহমিদের জন্য নাযীফাহ’র এমন উদ্বিগ্নতা দেখে প্রশান্তিতে ছেয়ে গেলো মন। অধর কোণ প্রসারিত হলো তার।

‘ওসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই শুধু সময়মতো রেডি হয়ে থাকবি।’

আবারও নিরবে চলতে শুরু করলো দু’জন। পথিমধ্যে দুইটা কুকুর দেখে তাহমিদের শার্ট খামচে ধরলো নাযীফাহ।অবুঝ অর্ধাঙ্গিনীর ভরসার স্থান হতে পেরে শব্দহীন শান্তিপূর্ণ হাসলো সে।

____________________________________________

রাতের শান্ত পরিবেশকে উপভোগ করতে বের হয়েছে সাবিহা। অপ্রত্যাশিতভাবে তাহমিদকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। প্রথমে মনের ভুল ভাবলেও পরে খেয়াল করে দেখলো আসলে তাহমিদ। আর তার পাশে কোনো মেয়েকে দেখে বক্ষস্থলে ছ্যাৎ করে উঠে তার। তার মানে কি স্যার প্রেম করে। চোখের কোণে অশ্রুকণা ভির করতে লাগলো। তারমানে কি মনের কথা বলতে সে দেরি করে ফেলল? আবছা আলোয় মুখ অস্পষ্ট হলেও মেয়েটার দৈহিক গঠনে সাবিহা বুঝতে পারলো মেয়েটা তার থেকেও বয়সে ছোট। তার ধারণা স্যার কখনো এতো ছোট মেয়ের সাথে প্রেম করবে না। ওদের অলক্ষ্যে পিছু নিলো সাবিহা।

প্রায় অনেকক্ষণ যাবৎ হাঁটার পর দু’জন একটা ফুচকা স্টলে গিয়ে বসলো। তাহমিদ ফুচকাওয়ালাকে ডেকে বলল,

‘মামা, এক প্লেট ফুচকা দিয়েন ঝাল ছাড়া।’

কপালে ভাজ পড়লো নাযীফাহ’র। ঝাল ছাড়া ফুচকা খেয়ে আধৌও কোনো টেস্ট পাওয়া যাবে। নাযীফাহ ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ফুচকা ঝাল ছাড়া হলে আমি খাবো না।’

‘ঝাল খাওয়া যাবে না।পেট ব্যথা করবে।’

‘করলে করুক তারপরও আমি খাবো। নতুবা আমি খাবো না।’

তাহমিদ বাধ্য হয়ে ফুচকাওয়ালাকে বলল ঝাল বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য।

‘আপনি খাবেন না ফুচকা?’

তাহমিদ একমনে মোবাইল টিপছিল। নাযীফাহ’র কথায় মাথা তুলে তাকাল সে।তারপর আবার মোবাইলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল,

‘আমি এসব আনহাইজেনিক খাবার খাই না।’

মুখে কিছু না বললেও নাযীফাহ মনে মনে বলল,

‘এ্যাহ্ আসছে আমার স্বাস্থ্য সচেতন লোক।’

তাহমিদের পশ্চাতে দুই হাত দূরে বসেছে সাবিহা।যেন তাকে তাহমিদ দেখতে না পায়। তবে দুইজনের কথা শুনার আপ্রান চেষ্টা করছে সে।

ফুচকা খেয়ে নাজেহাল অবস্থা নাযীফাহ’র। ঝালে চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। জিহ্বা বের করে হাত দিয়ে বাতাস করছে সে।নাযীফাহ’র দিকে তীক্ষ্ণধার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাহমিদ। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘আমি তখন নিষেধ করেছিলাম না এতো ঝাল খাওয়ার জন্য। এখন বোঝ মজা।’

নাযীফাহ একটু জোরে বলল,

‘তাহমিদ ভাই আপনি পরে বকাবকি করেন।আগে আমাকে পানি এনে দেন।’

তাহমিদ দাঁত কটমট করে বলল,

‘তুই এখানেই থাকবি। কেউ কিছু বললে জবাব দিবি না। আমি যাবো আর আসবো।’৷ সম্মতিতে মাথা নাড়ে নাযীফাহ।

‘তাহমিদ ভাই’ এটা শুনে ঠোঁটে হাসি ফুটে সাবিহার। আত্মায় পানি আসলো তার। এতোক্ষণ যেন দমটা আঁটকে ছিলো। পরপর কয়েকটা শ্বাস নিলো। মনে মনে ভাবলো,

‘তার মানে মেয়েটা স্যারের বোন। হয়তো গ্রাম থেকে এসেছে বলে স্যার হাঁটতে বের হয়েছে ওকে নিয়ে।’

তাহমিদের অগোচরে সেখান থেকে চলে এলো সাবিহা। না হলে দেখলে বলবে,

‘পড়াশোনা না করে বাইরে কি করো সাবিহা। পরেও ঘুরতে পারবে। এখন পড়াশোনা করো মন দিয়ে।’

স্যারের গম্ভীর কন্ঠের কথা ভাবতেই হাসি পেলো তার। যাক তার বাইরে বের হওয়া সার্থক হয়েছে। সেদিনের পর অনেকগুলো দিন অতিবাহিত হয়েছে। আর আজ দেখলো। পুলকিত হলো তার মন।

____________________________________________

আমেনা বেগম আর ফাহিমের জন্য চিকেন চাপ আর নানরুটির পার্সেল নিয়েছে তাহমিদ। দুজনেই রিক্সায় বসে। নাযীফাহ আচমকা রিক্সাওয়ালাকে রিক্সা থামাতে বলেই লাফ দিয়ে নেমে গেলো।

#চলবে

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ০৮
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

একটু একটু করে রাত বাড়তে শুরু করেছে। খাওয়া দাওয়া মাত্রই শেষ করলো তাহমিদ আর নাযীফাহ। ফাহিম আর আমেনা বেগমের জন্য পার্সেল নিয়ে বের হয় রেস্টুরেন্ট থেকে। বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে রিক্সায় গিয়ে বসতেই নাযীফাহকে বাঁধা দেয় তাহমিদ। ভ্রু কুঞ্চিত হয় নাযীফাহ’র। তাহমিদ নিজে আগে রিক্সায় উঠে বসলো।

‘রিক্সায় মেয়েরা ডানপাশে বসে না। মেয়েদের বামপাশে বসতে হয়। এটা সেইফ জোন।’

নাযীফাহ ঘুরে গিয়ে বামপাশে বসে।নাযীফাহ বসতেই তাহমিদ তার একহাত দিয়ে নাযীফাহকে কটিবন্ধ করে। রিকসাওয়ালা রিক্সার প্যাডেল ঘুরাতেই লোডশেডিং হয়। ক্ষীন আলো আচ্ছাদিত হয়ে যায় প্রগাঢ় তমসাচ্ছন্নে। এই প্রগাঢ় আঁধারে ভয়ে তাহমিদের কটিবন্ধ হাত খামচে ধরে নাযীফাহ। নাযীফাহকে আশ্বস্ত করে তাহমিদ বলে উঠে,

‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি আছি তো পাশে। এখনই সব দোকানে জেনারেটর চালু করবে।’

কয়েক মিনিটের মাথায় আবারও প্রদীপ্ত হয় চারপাশ। খামচে ধরা হাতের বাঁধন হালকা করে নাযীফাহ। বাসার কাছাকাছি আসতে শীতল হাওয়া বইতে লাগলো। আর উপক্রমণিকা হয় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির।যে ক্ষুদ্রাকার বারিবিন্দু কায়া স্পর্শক হওয়া মাত্রই অখিল কায়া প্রশান্তিতে ছেয়ে যায়।

‘আপনি রিক্সাটা একটু থামান না?’ নাযীফাহ’র কথায় রিক্সা থেমে যায়। তাহমিদ নাযীফাহ’র উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে রুঢ় দৃষ্টিপাত করে। নাযীফাহ দেখেও না দেখার ভান করলো। তাহমিদের রুঢ় দৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করে তাহমিদের হাত সরিয়ে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে।

‘বকুনি দিবেন না তাহমিদ ভাই। আজ বহুদিন পরে অভ্রভেদ করা বারিবিন্দু ছুঁয়ে দেওয়ার সুযোগ হয়েছে। মনে হচ্ছে কত বছর পরে বৃষ্টির ফোঁটা আমাকে আলিঙ্গন করছে।’ বলেই এই নিস্তব্ধ, নিঝুম রাতে দু-হাত মেলে বারিবিন্দু নিজের গাত্রে ছোঁয়াতে লাগলো সে।

নাযীফাহ’র এমন উৎফুল্লিত, আনন্দিত, প্রানোচ্ছল মুখশ্রী দেখে কিছু বলার আর সাহস হলো না তাহমিদের। ভাড়া মিটিয়ে নাযীফাহ’র গা ঘেঁষে দাঁড়ালো সে। নাযীফাহ’র কটিদেশ একহাতে স্পর্শ করতে গিয়েও গুটিয়ে নিলো তার হাত। তার মন বলছে, অপেক্ষা কর। অপেক্ষাতেই একপ্রকার শান্তি আছে। সে সামলে নিলো নিজেকে। নাযীফাহ চোখ বন্ধ করে বারিবিন্দু অনুভব করছে।

‘মাঝরাস্তায় এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। সামনেই বাসা হাঁটতে হাঁটতে বৃষ্টির ফোঁটাকে অনুভব কর।’

চোখ মেলে তাহমিদের দিকে নেত্রপাত করে নাযীফাহ। সামনের দিকে পা ফেলে সে।তাহমিদ ও দু’কদম দিয়ে নাযীফাহ’র সমান সমান হয়ে হাত আঁকড়ে ধরে। কপালে ভাঁজ পড়ে নাযীফাহ’র

‘এখানে হাত ধরেছেন কেন তাহমিদ ভাই? এখন তো হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই।’

উত্তর দিলো না সে। সামনের দিকে তাকিয়ে সোজা হাঁটতে লাগলো।

একজনের মনে এক আকাশ সমান অনুভূতি থাকলেও আরেকজন অনুভূতির ‘অ’ ও টের পাচ্ছে না। বুঝতে পারছে না তার করা এক তাগড়া যুবকের বুকের ভেতরের তোলপাড়। কোনো একদিন আসবে যখন হাতে হাত রেখে হাঁটার প্রতিটা কদমে থাকবে অনুভূতির ছড়াছড়ি। হাঁটা থামিয়ে নাযীফাহ খুব শান্ত, সুস্থির, কাতর গলায় বলল,

‘তাহমিদ ভাই, ফুপি কে একটা ফোন দিবেন?’

‘হঠাৎ মাকে ফোন দিতে বলছিস?’

‘খুব ইচ্ছে করছে কথা বলার জন্য।’

‘মায়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে নাকি মামির সাথে।’

নাযীফাহ কপট রাগ দেখিয়ে বলে, ‘আপনি কল দেওয়ার হলে দিন। এতো কথা বলবেন না।’

তাহমিদ স্মিত হেসে ফোন লাগায় মায়ের নাম্বারে। দু’বার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ করে ওয়াহিদা।

‘তোমার সাথে কথা বলতে চায় নাযীফাহ।’

ঘুমিয়ে পড়েছিল ওয়াহিদা। নাযীফাহ কথা বলতে চায় শুনে তন্দ্রাভাব কেটে গেলো তার। উৎফুল্ল হয়ে বলে,

‘দাঁড়া, দাঁড়া আমি তোর মামুর বাড়ি আছি। তোর মামিকে ডেকে নিয়ে আসি। ফাহমিদা সেই কবে থেকে মেয়ের গলার স্বর শুনার জন্য আকুল হয়ে আছে।’

তাহমিদ মোবাইল এগিয়ে দিলো নাযীফাহ’র দিকে। নাযীফাহ কানে ধরেই বলে,

‘কেমন আছো ফুপি?’

‘এতোদিন পরে ফুপির কথা মনে পড়লো? ঢাকা গিয়ে তো আমাদের ভুলেই গেছিস?’

মলিন হাসলো নাযীফাহ।

‘বললে না তো কেমন আছো?’

‘আমরা ভালো আছি। তোর মা বাবাও ভালো আছে।’

‘তুমি রাতে খাবার খেয়ে ঔষধ খেয়েছো।’

মুখ টিপে হাসে ওয়াহিদা।

‘রাতে খাওয়ার পর আমার কোনো ঔষধ নেই। তবে তোর বাপ প্রেশারের ঔষধ আর তোর মা খাওয়ার আগে ইনসুলিন নিয়েছে।’

ওয়াহিদার কাছে বসে থাকা নাযীফাহ’র মা এতোদিন পরে মেয়ের গলা শুনতে পেয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছেন।

‘তোমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না?’

‘আমারও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তোর বাবা মায়েরও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।’

‘তুমি বার বার তাদের কথা বলছো কেন? আমি তাদের কথা জিজ্ঞেস করেছি?’

‘না মানে…….

কাঠকাঠ গলায় বললো,

‘তাদের কথা আর বলবে না।’

ওয়াহিদা বাধ্য গলায় বলল,

‘আচ্ছা।’

‘বিচ্ছু বাহিনীর দল আমার খোঁজে আসে?’

ওয়াহিদার বক্ষস্থল থেকে নির্গত হয় দীর্ঘশ্বাস। বড্ড ভারী এই দীর্ঘশ্বাস। কন্ঠে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তুলে বলে,

‘রোজ জিজ্ঞেস করে তোর কথা। তুই কবে আসবি। পুকুর পাড়ের মাঠে এখন আর খেলা জমে না। কারন দলনেত্রী নেই।’

নাযীফাহ’র চক্ষুযুগলে ভির করে অভিমানী অশ্রু। মনে হয় সে কত বছর তার গ্রাম কে দেখে না।গ্রামের বৃষ্টি ভেজা মাটির ঘ্রাণ নেয় না। তারপর দুজনেই চুপ করে কানে মোবাইল ধরে রেখেছে। নিরবতা ঘুচলো ওয়াহিদার কথায়,

‘এখন কি ঢাকা বৃষ্টি হচ্ছে?

‘হুম, কেন বলো তো?’

‘তোরা কি বৃষ্টিতে ভিজছিস?’

‘হুম। একটু হাঁটতে বের হয়েছি তাহমিদ ভাইয়ের সাথে। কিন্তু কেন?’

‘না কিছু না। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।’

অশ্রুসিক্ত নয়ন কিন্তু ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো ফাহমিদা বেগমের। নিশ্চয়ই বৃষ্টি দেখে মায়ের কথা মনে পড়ছিলো। তাই সুকৌশলে মায়ের সব খবরাখবর নিয়ে নিলো মেয়েটা।

কথা শেষ করে আবারও দু’জন হাঁটছে। তাহমিদ মনে মনে হাসছে সে। পুচকি চালাক আছে। কেমন করে কৌশলে মা বাবার খবর জেনে নিলো। মা বাবার খবর জানতে না চাইলে প্রথম কথাতেই বলে দিলে পারতো। কিন্তু না সে রাগ দেখালো সব জানার পরে।

____________________________________________

বাসায় এসে পোশাক বদলেছে দুইজন।তারপর বাহির থেকে আনা খাবার দুই প্লেটে নিয়ে ফাহিম আর আমেনা বেগমকে খাবার দিলো নাযীফাহ। ফাহিম এখনো পড়ছে। তাহমিদ কপালে হাত ঠেকিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। ফাহিমের সামনে প্লেট রেখে নাযীফাহ বলল,

‘তাহমিদ ভাই?’

নাযীফাহ’র ডাকে কপাল থেকে হাত নামালো সে। তারপর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই নাযীফাহ পুনশ্চ বলল,

‘একটু চিকেন চাপ নিতুকে দিয়ে আসি? ও আমাকে ছাড়া কিছু খায় না।’

‘এখন রাত হয়ে গেছে। এতোরাতে কারো বাসার কলিং বেল বাজানো দৃষ্টিকটু। কাল বরং আবার আমি কিনে আনলে নিতুকে নিয়ে দিস।’

মাথা নেড়ে সায় জানায় নাযীফাহ। পুনরায় ফাহিমের কাছে গিয়ে বলে,

‘শুন ফাহিম্মা, যতটুকু দিয়েছি সবটা শেষ করবি। প্লেটে যদি একটুও থাকে তোর খবর আছে। রেস্টুরেন্টে একঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে এই পার্সেল এনেছি।’

ফাহিম বাঁকা হেসে বলে,

‘তাইলে চিন্তা কর তুই কি পরিমাণ মুটি। তোরে রেস্টুরেন্টের কর্তৃপক্ষও চেয়ারে বসতে দিলো না। যদি চেয়ার ভেঙে যায় সেই ভয়ে।’

নাযীফাহ দাঁত কটমট করে বলে,

‘তুই মুটি, তোর বউ মুটু, তোর চৌদ্দ গোষ্ঠী মুটি।’

ফাহিম মাছি তাড়ানোর ভান করে বলল,

‘একে তো শুকনা পাটকাঠি।দ্বিতীয়ত আমার বউ নেই যে মুটি হবে। তবে আমার ভাইয়ের বউ খুব মুটি।’

নাযীফাহ কথায় না পেরে হনহন করে চলে গেলো। নাযীফাহ’র এমন অবান্তর কথা শুনে নৈঃশব্দ্যে হাসলো তাহমিদ।

____________________________________________

গভীর, নিগূঢ়, ঘুটঘুটে আঁধার।এলোমেলো শুয়ে আছে নাযীফাহ। ছোট ছোট অবাধ্য চুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মুখে।আমেনা বেগম একপাশে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছেন। তাহমিদ সতর্কতা অবলম্বন করে শব্দহীন পায়ে হেঁটে রুমে আসলো। নাযীফাহ যেই পাশে শুয়েছে সেই পাশে গিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বসলো। নিমিষহারা তাকিয়ে রইলো তিন ‘কবুল’ বলে গ্রহন করা স্ত্রীর দিকে। এ যেন এক অন্যরকম মানসিক তৃপ্তি। ঘুমন্ত প্রেয়সী যেন চক্ষু শীতলকারী। এই পবিত্র চেহারার অধিকারী রমনীর দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যাবে বছরের পর বছর। এলোমেলো চুল গুলো মুখ থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়েও হাত গুটিয়ে নিলো সে। পাছে যদি নাযীফাহ জেগে যায়। ছুঁয়ে দেওয়ার অধিকার আছে কিন্তু বিবেক বাধা দেয়।মায়াবী গড়নের কিশোরীটি তার শুধুই তার। এই কিশোরীকে দেওয়া প্রতিটা স্পর্শে থাকবে পবিত্রতা। কিন্তু ছুঁয়ে দিতে মানা। উঠে দাঁড়ায় সে।এখানে থাকা আর সম্ভব না। অবাধ্য মন বার বার ঘুমন্ত কিশোরীকে ছুঁতে চাইছে। তার শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয় বারবার ওই কপালে উষ্ণ স্পর্শ দিতে চাইছে। এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টসাধ্য হবে।

সামনে দিকে পা বাড়াতেই থমকে যায় তাহমিদ। তাহলে কি ধরা পড়ে গেলো সে?

#চলবে