প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-৩২+৩৩+৩৪

0
540

প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-৩২+৩৩+৩৪
ইসরাত জাহান তানজিলা
_____________________
হঠাৎ একদিন শ্রাবণীর কাছে একটা চকলেট বক্স আসলো। বড়সড় সাইজের। কে পাঠালো? যে পাঠিয়েছে সে হয়ত জানে না শ্রাবণী চকলেট খেতে পছন্দ করে না। ওর প্রথমেই পাবেলের নামটা মনে আসে। আজকাল শ্রাবণীর প্রতি তার ভালোবাসা, যত্ন আত্তি বেড়েছে। শ্রাবণী এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অবিচল। ও এসবে গলছে না আর। শ্রাবণীর ধারণা ওকে বাড়িতে নেওয়ার মতলবে পাবেল এসব করছে। বেশ কয়েকদিন ধরে পাবেল ঘন ঘন আসা শুরু করেছিল ওর সাথে দেখা করার জন্য। দিন দুয়েক ধরে হঠাৎ করে আবার আসা বন্ধ করে দিয়েছে।
খুব ভোরে শ্রাবণীর ফোনটা ভাইব্রেট হতে থাকে বালিশের নিচে। ওর ঘুম ভেঙে যায়। পাবেল ফোন দিয়েছে বোধ হয়। এর আগেও দু’দিন‌ এভাবে ভোর সকালে ফোন দিয়ে শ্রাবণীর ঘুম ভাঙিয়েছে। ও কঠিন গলায় বলেছিল, এত ভোরে ফোন দিবেন না। রাতে পড়া শেষ করতে করতে একটা-দুইটা বেজে যায়। সেজন্য সকালে একটু বেশি ঘুমোতে হয়। নয়ত শরীরটা খারাপ লাগে। ঠিকঠাক ঘুম না হওয়ার দরুন চোখ জ্বলছে। মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। অসহ্য যন্ত্রণা। ও চোখ না মেলেই বালিশের নিচ থেকে হাতড়ে ফোনটা বের করলো। হঠাৎ এভাবে ঘুম ভাঙার ফলে মস্তিষ্কের জড়তা যেন এখনো কাটেনি। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কল রিসিভ করলেও নম্বরটা খেয়াল করেনি। ফোনটা কানের কাছে ধরেই রাগী গলায় বলল,
–‘রোজ এত সকালে ফোন দেন কেন বলুন তো? আমি রাত দুইটার পরে ঘুমিয়েছি।’

জবাবে ওপাশ থেকে কেউ মৃদু গলায় বলল,
–‘হ্যালো শ্রাবণী।’

কণ্ঠটা চিনতে শ্রাবণীর দুই সেকেণ্ড লাগলো। ও ঘুম ছেড়েছুড়ে চমকে প্রায় লাফিয়ে ওঠে বসে। চোখ দু’টো ভালো করে মেলে ফোন নম্বরটা দেখে। যাইফ ফোন করেছে কয়েক মাস পরে। শ্রাবণীর মুখ থেকে এখন আর কথা বের হচ্ছে না। যাইফের সাথে রাগ, অভিমান, জেদ করে লাইন কেটে দেওয়া উচিত? না-কি স্বাভাবিক ভাবে কথা বলা উচিত? এনিয়ে ভাবতে ভাবতে মিনিট দুয়েক কেটে গেল। যাইফের উপর কিসের জন্য অভিমান করবে? ওভাবে হুট করে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য? মায়ের কথা মতন যাইফ শ্রাবণীর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করেছে। আর সেলিনা চৌধুরী কেন যাইফকে শ্রাবণীর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে বলেছে তারও পরিষ্কার ব্যাখ্যা শ্রাবণীকে তিনি দিয়েছেন। শ্রাবণীও তার কথা যৌক্তিক ধরে নিয়েছে। এরপর তো আর যাইফের ওপর রাগ, অভিমান হওয়ার কোনো মানে নেই। তবুও যেন কেন মনের এক কোণে খানিক অভিমান জমা হয়ে রয়েছে। এই অভিমানের কারণ শ্রাবণী ব্যাখ্যা করতে পারবে না। পৃথিবীতে সব অভিমানের ব্যাখ্যা থাকে না। কিছু অভিমান অযথা, অকারণে মনের কোণে পড়ে থাকে। যাইফ হ্যালো, হ্যালো করে যাচ্ছে। শ্রাবণী স্বাভাবিক ভঙ্গিতে একটু হেসে বলল,
–‘কেমন আছেন যাইফ ভাই?’

–‘কতক্ষণ ধরে হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছি। ফোন ধরে লাপাত্তা তুই।’

–‘কথা শোনা যাচ্ছিলো না। নেটওয়ার্কে সমস্যা করছে বোধ হয়।’

–‘তোর কি অবস্থা বল? এখন কেমন আছিস? লেখাপড়া ঠিকঠাক চলছে? হোস্টেল জীবন কেমন‌ লাগছে?’

–‘আপনি জানলেন কিভাবে আমি ভর্তি হয়েছি?’

–‘মায়ের সাথে তোর নাকি প্রায়ই কথা হয়? মা বলেছেন।’

–‘হুম কথা হয়।’

–‘শ্রাবণী তুই কি আমার উপর রাগ করেছিস?’

শ্রাবণী চমকে যায়। চমকানো ভাবটা প্রকাশ‌ করে না। হালকা গলায় বলে,
–‘আপনার উপর রাগ করবো কেন?’

–‘আচ্ছা মা তোকে ফোন দিয়ে কিছু বলেছিল?

–‘ফুফু তো কত কি-ই বলে।’

–‘তোর আর আমার ভিতরকার সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলেছে? তোকে কি বলেছে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করতে?’

এই প্রসঙ্গ আসতেই শ্রাবণী চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে। এসব নিয়ে যাইফের সাথে কথা বলতে ওর অস্বস্তি লাগবে। আর যাইফ হঠাৎ ফোন দিয়ে এসব জানতে চাচ্ছে কেন? শ্রাবণী কিছু না বোঝার ভান করে জিজ্ঞেস করে,
–‘না, না ফুফু এসব কেন বলবে? আমিই ভীষণ ব্যস্ত হয়ে গেলাম হঠাৎ। এর ভিতর আপনাকে কয়েকবার ফোনও করেছিলাম। আপনি ধরেননি।‌ পরে কল ব্যাকও করেননি। আপনিও হয়ত ব্যস্ত ছিলেন। এজন্য আর কথাবার্তা হয়ে ওঠেনি।’

–‘আমার ধারণা তুই মিথ্যে বলছিস। মা তোকে নিশ্চয়ই কিছু বলেছি।’

–‘আপনার কেন মনে হচ্ছে ফুফু আপনার আর আমার ব্যাপার নিয়ে কিছু বলেছে?’

শ্রাবণী একটু থেমে বলল,
–‘আপনি হঠাৎ করে ফোন দিয়ে এসব জানতে চাইছেন কেন?’

যাইফ প্রসঙ্গ পাল্টায়। বলে,
–‘তোর লেখাপড়া কেমন চলছে?’

–‘ভালো।’

–‘পাবেলের সাথে তোর সম্পর্ক কেমন এখন? সব ঠিকঠাক চলছে?’

–‘আমি কলেজে ভর্তি হয়েছি, হোস্টেলে থাকছি এসব কিছু যখন ফুফুর কাছে জিজ্ঞেস করে জেনেছেন, এটাও জেনে নিন।’

–‘রাগ করছিস কেন তুই?’

–‘কই রাগ করলাম। আমি তো ঠাণ্ডা গলায় বললাম।’

–‘যে কারণে তোকে ফোন করা। আমি একটু জরুরি কাজে তোদের এখানে এসেছি। কলেজের কাছেই। ভাবলাম একবার তোর সাথে দেখা করে যাই। আজ তো শুক্রবার। তোর কলেজ বন্ধ। সময় পেলে আসিস বিকালের দিকে।’

এই বলে যাইফ ফোন রাখে। শ্রাবণী কিছু বলার সুযোগ পেলো না। দ্বিধায় পড়লো, যাবে কী যাবে না? বিকালে ফ্রি আছে একদম। যে মানুষটি খারাপ সময়ে ওকে এত সাপোর্ট দিলো তার সাথে দেখা করতে যাওয়া নিয়ে এত দ্বিধাদ্বন্দ্বের কি আছে? বিকালে যাবে বলে ঠিক করলো ও ।

দুপুরের দিকে আরেক বিপত্তি ঘটলো। পাবেল কল করল। রিসিভ করতেই বলল,
–‘শ্রাবণী চকলেট পেয়েছো?’

শ্রাবণী জবাব দেয়,
–‘পেয়েছি কিন্তু আমি চকলেট পছন্দ করিনা।’

–‘তা তো আমি জানতাম না। আচ্ছা আমি যে দুইদিন ধরে আসছি না, তুমি কি আমায় মিস করো?’

শ্রাবণী কয়েক সেকেণ্ড ভেবে বলল,
–‘না।’

–‘সত্যি মিস করো না?’

শ্রাবণী এবারও আগের ন্যায় বলল,
–‘না।’

পাবেল একটু থেমে থাকে। শ্রাবণীও নিশ্চুপ। কয়েক মুহুর্ত এভাবেই কাটলো। হঠাৎ পাবেল নরম গলায় বলল,
–‘শ্রাবণী আমার একটা আবদার রাখবে?’

শ্রাবণী সঙ্গে সঙ্গে চিন্তায় পড়ে গেল। সামান্য আগ্রহী গলায় প্রশ্ন করে,
–‘কি আবদার? রাখার মত হলে রাখবো।’

–‘আমার গায়ে ভীষণ জ্বর। আমি রাঙ্গামাটি থেকে তোমাকে যে শাড়িটা এনে দিয়েছি সেটা পরে একবার আমার বাসায় আসবে?’

শ্রাবণীর‌ আগেই মনে হয়েছিল পাবেল এমন কিছু বলবে। পাবেলের প্রতি ওর এখন বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। এরকম আবদার ও পূরণ করতে পারবে না। আর ওই বাড়িতে গেলেই ফরিদা বেগম আর জয়নাল সাহেবের তোপের মুখে পড়তে হবে আবার। চিৎকার, চেঁচামেচি, হাউকাউ, ঝগড়াঁঝাটি শুরু হবে‌‌। পাবেল বলল,
–‘শ্রাবণী কিছু বলছো না যে? আজ তো তোমার কলেজ, প্রাইভেট বন্ধ। আজ আর ওই অজুহাত দেখাতে পারবে না। আজকে রাতটা শুধু থাকবে।’

রাতে থাকার কথাও বলছে? ওখানে গেলেই শ্রাবণীর মানসিক অশান্তি শুরু হয়। হাঁসফাঁস লাগে কেবল। ও বলল,
–‘আপনাদের বাসায় যেতে ইচ্ছে করে না আমার।’

পাবেল তীব্র ভাবে অনুরোধ রাখে,
–‘তার মানে তুমি আসবে না? শ্রাবণী আমি ভীষণ অসুস্থ। অস্থির লাগছে। এসো প্লিজ।’

–‘ডাক্তার দেখান। সেরে ওঠবেন।’

শ্রাবণী বড়ো দোটানায় পড়ে গেল। যাবে না বলে ঠিক করলেও মনের ভিতর কেমন খচখচ করতে লাগলো। এত অনুরোধ ঠেলে দেওয়া যায়? ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে। তবুও কিছুক্ষণ পর পর নাড়া দিয়ে ওঠে‌। এটাকে কি পিছুটান বলে? শ্রাবণীর তা জানা নেই। ওদিকে বিকালে যাইফও দেখা করার জন্য বলেছে।
_______________
শ্রাবণী বিকালে যাইফের সাথে দেখা করার জন্য বের হয়। যাবে না পাবেলকে দেখতে। পাবেল এখনো দিব্যি মেয়ে মানুষ নিয়ে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। সেদিনও শ্রাবণী দেখেছে বাইকের পিছনে এক মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে। পাবেল মেয়েদের নিয়ে যা ইচ্ছে তা করুক সে নিয়ে শ্রাবণীর বিশেষ কোনো মাথা ব্যথা নেই। ও অভ্যস্ত হয়ে গেছে এসবে। কিন্তু সারাদিন এসব করে বেড়িয়ে দিন শেষে যখন শ্রাবণীর প্রতি ভালোবাসা দেখাতে আসে তখনই ওর মেজাজ চটে যায়।
যাইফ একটা সুপার শপের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণী বেশ দূর থেকে খেয়াল করলো। যাইফের পরনে কালো একটা শার্ট। গায়ের রঙ ফর্সা হওয়ায় কালো শার্টে অপূর্ব লাগছে। শ্রাবণী এগিয়ে গেল। সামান্য হেসে জিজ্ঞেস করে,
–‘কেমন আছেন ভাইয়া?’

–‘আমি বেশ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?’

–‘ভালো।’

–‘অনেক দিন পর দেখা। চল কোথায়ও বসে একটু কথা বলি।’

শ্রাবণী হ্যাঁ সূচক ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকায়। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই একটা কফিশপ দেখতে পায়। যাইফ বলল,
–‘চল এখানে বসি।’

কফিশপের সামনে বসেই সেই রবি নামের ছেলেটার সাথে দেখা হয়ে যায় শ্রাবণীর। রবি যাইফের দিকে এক বার তাকিয়ে সন্দিহায় গলায় শ্রাবণীকে বলে,
–‘পাবেল ভাই বলল তুমি তার বউ। এখন দেখছি আরেক ছেলের সাথে ঘোরাঘুরি করছো। পাবেল ভাই আমায় এত বড়ো মিথ্যা কেন বলল বলো তো? তার কথা আমারও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি। সবে কলেজে পড়া একটা মেয়ে তার বউ হয় কিভাবে। আর পাবেল ভাইয়ের বউ হলে তার বাসা রেখে হোস্টেলে কেন থাকবে।’

শ্রাবণী শক্ত গলায় রবিকে জবাব দেয়,
–‘এত সব দিয়ে আপনার কি দরকার বলুন তো?’

এইটুকু বলেই ওরা কফিশপে ঢুকে যায়। যাইফ জিজ্ঞেস করে,
–‘ছেলেটা কে?’

শ্রাবণী বিরক্ত গলায় বলে,
–‘উদ্ভট একটা লোক। ছাড়ুন ওসব।’

ওরা মুখোমুখি বসে। যাইফ দুই কাপ কফির অর্ডার করলো। শ্রাবণী বলল,
–‘আমি কফি খাবো না। এক কাপ অর্ডার করুন।’

যাইফ কফির কাপে আয়েশী ভঙ্গিতে চুমুক দিতে দিতে বলল,
–‘পাবেলের সাথে তোর সম্পর্কের মোটেও উন্নতি হয়েছে?’

–‘আপনি কি এটা জিজ্ঞেস করতেই আমায় ডেকেছেন?’

–‘হ্যাঁ।’

এরপর যাইফ কিছু সময় চুপ করে থাকলো। কথা গোছাচ্ছে বোধ হয়। অনেকক্ষণ পর বলল,
–‘পাবেল আমায় বলেছিল, আমার জন্য তুই নাকি পাবেলের প্রতি মনোযোগী হতে পারছিস না। আমার জন্য তোদের ভিতর অশান্তি হচ্ছে। সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে। এরকম অনেক কিছু বলার পর শেষে বলল, তুমি শ্রাবণীর সাথে যোগাযোগ রেখো না। তাহলে আমরা ভালো থাকবো‌। তুই ভালো থাক এটা তো আমিও চেয়েছি। সে জন্য যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার জন্য তোদের ভিতর ঝামেলা হচ্ছে। তবে সেটা পাবেলের ঈর্ষা থেকে। পাবেল যে আমায় অতকিছু বলল তাও ঈর্ষা থেকে। তোর প্রতি ভালোবাসা থেকে না। এটাও বুঝেছিলাম।’

যাইফ একটু থেমে বলল,
–‘তারপর মা একদিন বললেন আমি যেন তোর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। তার ধারণা তোর আর আমার ভিতর অন্য কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠতে পারে। মায়ের একথা শুনে আমি মনে মনে হেসেছিলাম। আর যা-ই হোক কারো বিপদে সামান্য সান্ত্বনা দিয়ে গিয়ে তার প্রেমে পড়ে যাওয়ার মতন মানুষ অন্তত আমি না। আমার কাছে প্রেম এত সস্তা না। মা হয়ত তোকে ফোন করে বলেছেন তিনি নিষেধ করায় আমি তোর সাথে যোগাযোগ করছি না। আসলে সেরকম কিছু না।’

যাইফ থামলো। শ্রাবণী কেবল প্রত্যুত্তর করার জন্য উদ্যত হয়েছিল। এর ভিতর হঠাৎ পাবেল আর রবিকে কফিশপে ঢুকতে দেখে। শ্রাবণী থেমে যায়। পাবেলকে উদ্ভ্রান্তের মতন দেখাচ্ছে। অসুস্থ চেহারা। পাবেল এখানে হঠাৎ কেন আসলো? এই রবি কি ওকে যাইফের সাথে দেখে পাবেলকে জানিয়েছে- শ্রাবণীর চট করে এই চিন্তাটা ঢুকে পড়ে।
(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-৩৩)
ইসরাত জাহান তানজিলা
_____________________
পাবেল খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ওদের টেবিলের দিকে গেল। শ্রাবণী পাবেলকে দেখে অবাক হয়নি কিংবা ভয়ও পায়নি। কিন্তু সামান্য চিন্তা হলো। উন্মাদ লোক, এই পাবলিক প্লেসে কি কাণ্ড করে বসে ঠিক নেই। তাও আবার যাইফের সামনে। মানসম্মান জলে ভেসে যাবে। রবি নামক বদমাইশ ছেলেটাও পাবেলের পিছন পিছন আসলো। ভীষণ কৌতূহলী চেহারা তার। শ্রাবণী কি সত্যি পাবেলের বউ? আর যদি পাবেল মিথ্যা বলে থাকে তাহলে রবির রাস্তা পরিষ্কার। এই পরমা সুন্দরীকে দুই-চার দিনেই পটিয়ে নিজের করে ফেলবে। সে আছে তার ধান্দা নিয়ে। পাবেল ওদের টেবিলের পাশে দাঁড়ালো। যাইফ পাবেলকে দেখে কিছুটা চমকালো। তারপর আন্তরিক ভঙ্গিতে হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
–‘আরে পাবেল ভাই। কেমন আছেন? বসুন।’

পাবেলের দৃষ্টি শ্রাবণীর দিকে। পাবেল ধারণা করেছিল শ্রাবণীর চোখেমুখে অপ্রস্তুত ভাব থাকবে। ওকে দেখে ঘাবড়াবে, ভয় পাবে। হয়েছে তার উল্টো। শ্রাবণীর চেহারায় কেবল বিরক্তি। পাবেল নিজের মেজাজ ঠিক রাখলো ভীষণ কষ্টে। যাইফের দিকে তাকালো। হ্যান্ডসেক করলো। সামান্য হেসে বলল,
–‘আমার বউ নিয়ে যদি তুমি এভাবে টানাটানি করো তো আমি ভালো থাকি কিভাবে?’

যাইফ হতভম্ব এমন অনাকাঙ্ক্ষিত উত্তরে। শ্রাবণী পাবেলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বলল,
–‘মুখ সামলে কথা বলুন। আমি আমার ফুফাতো ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছি। আপনি সেখানে কেন এসেছেন? ঝামেলা করতে? বিয়ের পরও হাজারটা মেয়ে নিয়ে মত্ত হয়ে আছেন। সবাইকে নিজের মত ভাবেন?’

অপমানে পাবেলের মুখ কালো। এত বড়ো অপমান তাও রবি ছেলেটার সামনে। এই মেয়েটা ওকে বিন্দুমাত্র ভয় পায় না ওকে।‌ কারণ কি এর? পাবেল রবিকে ওখান থেকে সরে যেতে ইঙ্গিত করলো। অগত্যা রবির চলে গেল অনিচ্ছাকৃত ভাবে। যাইফ নিরব দর্শক। এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে তা জানলে কখনো শ্রাবণীর সাথে দেখা করতে চাইতো না। পাবেল নিজের রাগ সংযত করতে ব্যর্থ। ক্ষোভে ফেটে পড়ে যাইফকে বলল,
–‘তোকে বলেছিলাম না শ্রাবণীর সাথে যোগাযোগ রাখিস না? সমস্যা কি তোর? হাত-পা ভেঙে রাস্তায় বসিয়ে রাখবো একদম।’

যাইফের চোখ দুটো হঠাৎ রাগে ধিকধিক করে জ্বলে ওঠে। শ্রাবণী এবার ভয় পেয়ে গেল। অবস্থা বেগতিক। যাইফ বিক্ষুব্ধ হয়ে বলল,
–‘আমার মামাতো বোনের সাথে আমি যোগাযোগ রাখবো কি রাখবো না তা ঠিক করে দেওয়ার তুই কে? শালা চরিত্রহীন মাতাল। কি দায়িত্ব পালন করিস তুই শ্রাবণীর প্রতি? শ্রাবণী ওর বাপের টাকায় থাকে, পড়ে। সবাইকে নিজের মত চরিত্রহীন ভাবিস? কি যোগ্যতা আছে তোর?’

পাবেলের মাথায় রক্ত ওঠে যায়। খুন চাপে। রাগে দু’জনেই যেন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। কেউ কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলছে না। শ্রাবণী ভেবেছিল যাইফ শান্ত স্বভাবের। ও স্তম্ভিত। আশেপাশে লোক জড়ো হয়ে গেছে। কুৎসিত এক দৃশ্য। পাবেল যাইফের গায়ে হাত তুলতে উদ্যত হলে চারপাশে জড়ো হয়ে থাকা মানুষদের ভিতর থেকে দুই-চার জন ছুটে এসে বাঁধা দিলো। বাকী সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামশা দেখছে। শ্রাবণী কি করবে বুঝতে না পেরে যাইফকে হাত জোর করে অনুরোধ করে বলল,
–‘ভাইয়া আপনি এখান থেকে চলে যান দয়া করে।’

যাইফ শ্রাবণীর অনুরোধ রাখলো। সে চলে গেল। যাওয়ার আগে পাবেলের দিকে কয়েকবার চোখ লাল করে তাকিয়ে বলে গেল,
–‘কত বড়ো নেতা হয়েছিস তুই আমি দেখে নিবো।’

পাবেল গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল,
–‘শুয়োরের বাচ্চা তোর গলা কেটে ফেলব।’

কেউ বাঁধা না দিলে আজ বোধ হয় খুনাখুনি সত্যি হয়ে যেত। যাইফ লম্বা লম্বা পা ফেলে উগ্র রোষ নিয়ে বের হয়ে গেল কফিশপ থেকে। আশেপাশের লোকজন ইতিমধ্যে রটিয়ে ফেলেছে, স্বামী রেখে অন্যজনের সাথে ঘুরতে এসে স্বামীর হাতেনাতে ধরা পড়েছে এক মেয়ে। এনিয়েই মারামারি, ঝগড়াঝাঁটি। সবাই শ্রাবণীর দিকে বিচ্ছিরি দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। ও ভিড় ঠেলে বের হতে পারলো না। লজ্জা আর অপমানে মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। পাবেল হঠাৎ শ্রাবণীর হাত ধরে টেনে কফিশপ থেকে বের করল। পাবেলের এই অসুরে শক্তির কাছে ও ভীষণই দুর্বল। রাস্তার মাঝে বসেই শ্রাবণীর গালে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে কয়েকটা চড় মারলো। ওর ফর্সা গাল দুটো লাল হয়ে গেল। পাঁচ আঙুলের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠল। এক্ষুণি যেন রক্ত বেরুবে গাল থেকে। শ্রাবণী নির্বাক, হতবুদ্ধি। ওর মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেছে অনেক আগেই। এই মুহূর্তে কি করা উচিত, কি বলা উচিত মাথায় আসছে না। পাবেল ওকে গাড়িতে তুলল। শ্রাবণী কোনো বাঁধা দিলো না। পুরো ঘটনাটা ওকে বোকা, বিহ্বল করে দিয়েছে। পাবেল প্রচণ্ড ক্রোধান্বিত গলায় বলল,
–‘বাসায় যেতে বলেছিলাম তোকে। আর তুই এসেছিস ওর সাথে দেখা করতে? যত যা-ই করিস এখন তোকে আমি ভিডোর্স দিবো না। দরকার হলে খুন করবো। আর ওই শুয়োরের বাচ্চাকে কয়েক ঘন্টার ভিতর পৃথিবী থেকে বিদায় করবো।’

গাড়ি বাসার সামনে থামে । শ্রাবণীর হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে গাড়ি থেকে নামায়। টেনেহিঁচড়ে বাসার ভিতরে নিয়ে গেল। পুরো সময়টা জুড়ে শ্রাবণী একটা কথাও বলেনি। কোনো প্রতিবাদও করেনি। বাসায় ঢোকার সাথে সাথেই জয়নাল সাহেব আর ফরিদা বেগমের সামনে পড়লো। তারা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল। ফরিদা বেগম কিছু বললেন না। জয়নাল সাহেব কেবল জিজ্ঞেস করলেন,
–‘পাবেল কি হয়েছে?’

পাবেল উত্তর দিলো না। তাদের পাশ কাটিয়ে শ্রাবণীকে নিয়ে গেল রুমের দিকে। রুমের দরজা বিকট আওয়াজে বন্ধ করে। শ্রাবণীকে ধাক্কা মারে। ও গিয়ে ছিটকে খাটের উপর পড়ে। পাবেল ওকে টেনে তোলে খাট থেকে। ওর দুই কাঁধ ধরে জোরে ঝাঁকি দিয়ে বলল,
–‘কথা বলছিস না কেন তুই এখন? তোকে কত অনুরোধ করে বললাম বাসায় আসতে। ভালো ব্যবহারের অযোগ্য তুই। যাইফের সাথে কফিশপে তোর কি‌ কাজ? শুধু তোর জন্য আজ আমাকে অপদস্থ হতে হয়েছে। নয়ত ওই ইতরের বাচ্চা আমার সাথে উঁচু গলায় কথা বলার সাহস কোথায় পায়? ওকে তো আমি শেষ করবোই। এলাকার সবাই এখন জেনেছে আমার বউ অন্য পুরুষ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তুই কত বড়ো অপমান করেছিস আমায়।’

পাবেলের শ্বাস রোধ হয়ে আসে ক্রোধে। শ্রাবণী মুখ খোলে এবার। উঁচু স্বরে বলে,
–‘বাড়াবাড়ি আপনি করেছেন। সমস্ত দোষ আপনার। আপনি একটা অমানুষ, জানোয়ার। অপমান, অপদস্থ আপনি আমায় করেছেন। চিৎকার, চেঁচামেচি করে মানুষ জড়ো করেছেন। আপনি জানিয়েছেন এলাকার লোকজনকে। সবাই আমায় খারাপ ভেবেছে। আমি আমার ফুফাতো ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেছি ওখানে। আপনার সমস্যা কোথায়? আপনি একজনকে অযথা অপমান করলে সে আপনাকে তো ছেড়ে দিবে না। কিছু বলে দেখুন যাইফ ভাইকে। আমি নিজে আপনাকে পুলিশ দিয়ে ধরাবো।’

–‘ওকে আমি খুন করবো। দেখি পুলিশ আমায় কি করে। ওর প্রতি এত দরদ উথলে ওঠছে কেন তোর? আমাকে ও যা বলেছে সেগুলো তুই শুনিসনি? আমার এখন খুব ইচ্ছে করে তোর গলাটাও কেটে ফেলতে। কিন্তু আমি সেটা করবো না। তোর গায়ে হাত তোলার ইচ্ছেও ছিলো না। তুই আমাকে বাধ্য করেছিস‌। আমি তোর জন্য আস্তে আস্তে সব ছেড়ে দিচ্ছি। তবুও আমার প্রতি তোর কোনো অনুভূতি হয় না। আর ওই শুয়োরের বাচ্চা আমাকে চরিত্রহীন মাতাল বলে।’

–‘ঝামেলা আপনি শুরু করেছেন, যাইফ ভাই করেনি। দোষ আপনার, যাইফ ভাইয়ের না। লোকজন জড়ো করে নিজের বউকে চরিত্রহীন বানিয়েছেন। যে মানুষটাকে আমি ভাইয়ের মত জানি তার সাথে জড়িয়ে নোংরা কথা বলেছেন। ছিঃ। আপনার মত জঘন্য মানুষ আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি।’

শ্রাবণীর চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে। এই অপমান ও হজম করতে পারছে না কিছুতে। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দরকার। এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি দরকার। ও কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলল,
–‘ডিভোর্স চাই আমি। আপনার মত মানুষের সাথে আর এক মুহুর্তও থাকা সম্ভব না।’

পাবেল এসে শ্রাবণীর পাশে বসে। ভীষণ ঘনিষ্ঠ ভাবে বসে। বলে,
–‘আমার সাথেই থাকতে হবে তোকে। দিবো না ডিভোর্স। আর যাইফের মৃত্যুর খবর শীঘ্রই পাবি। কেউ কিছু করতে পারবে না আমায়। তুই বলিস পুলিশকে।’

শ্রাবণী আঁতকে ওঠে। পাবেলের দ্বারা এসব অসম্ভব কিছুই না। ক্ষমতা থাকলে মানুষ সব পারে। ও দিশেহারা হয়ে যায়। সত্যি যাইফকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছে পাবেল? নাকি শুধু রাগের মাথায় বলছে?

পাবেল একটা তোয়ালে হাতে ওয়াশরুমের দিকে যায়। লম্বা শাওয়ার নেয়। শ্রাবণী অনেকক্ষণ ধরে একই ভঙ্গিতে বসে আছে। নিঃশব্দে, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারায়। তুচ্ছ একটা বিষয় নিয়ে কত কি হয়ে গেল। একয়দিনে সমান্য হলেও পাবেলের উপর থেকে রাগটা কমেছিল। নিজের অজান্তে খানিক ভালোলাগাও কাজ করছিলো। কিন্তু আজ আগের চেয়ে তীব্র ঘৃণার জন্ম হয়েছে নতুন করে। পাবেল ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। শার্ট গায়ে দিলো, চুল আঁচড়ালো, গায়ে পারফিউম মাখলো। এর ভিতর ফরিদা বেগম আসলো। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল,
–‘কি হয়েছে পাবেল?’

পাবেল অনিচ্ছাকৃত ভাবে উত্তর দেয়,
–‘কিছু হয়নি।’

–‘এত ঝগড়াঁঝাটি, চিৎকার, চেঁচামেচি তারপরও বলছিস কিছু হয়নি।’

–‘যা হয়েছে আমাদের মাঝে হয়েছে। সব ব্যাপার কি তোমায় বলা যাবে? তুমি সবকিছুতে নাক গলাতে আসো কেন?’

ফরিদা বেগম নির্বাক। পাবেল তার সাথে এ কি ধরণের আচরণ করছে? তিনি বিস্মিত গলায় বলল,
–‘তোর হয়েছে কি?’

–‘কিছু হয়নি। দয়া করে যাও এখান থেকে।’

ফরিদা বেগম চলে গেলেন গম্ভীর মুখে। যাওয়ার আগে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো শ্রাবণীর দিকে। ফরিদা বেগম চলে যাওয়ার পর শ্রাবণী পাবেলকে বলল,
–‘যাইফ ভাইয়ের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।‌ তার সাথে এতদিন আমার কোনো যোগাযোগও ছিলো না। আপনি শুধু শুধু তাকে আজেবাজে কথা বলেছেন সেজন্য তার মেজাজ খারাপ হয়েছে। ওসব কথা শুনলে যে কারো মেজাজ খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। যাইফ ভাই আপনাকে চরিত্রহীন মাতাল বলেছে। ঠিকই তো বলেছে। সমস্ত দোষ যেখানে আপনার। আপনি জঘন্য দোষ করে উল্টো তাকে খুন করার কথা কেন বলেছেন? দয়া করে তার কোনো ক্ষতি করবেন না।’

পাবেল শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলো। আনন্দ‌ কিংবা খুশির হাসি না। এই হাসির মানে শ্রাবণী ঠিক ধরতে পারলো না। পাবেল বলল,
–‘আমি ওকে খুন করবো। তুমি আমায় পুলিশে দিবে। মন্দ হবে না ব্যাপারটা। আমাদের নিয়ে পেপার পত্রিকায় লেখালেখি হবে। টিভিতে দেখানো হবে। খুবই আকর্ষণীয় একটা গল্প হবে। হয়ত এটা নিয়ে নাটক, সিনেমাও তৈরি হবে। গল্প উপন্যাস লেখা হবে। আমরা থাকবো উপন্যাসের পাতায়। সেই উপন্যাসে তুমি থাকবে সবার প্রিয় চরিত্র। প্রিয় শ্রাবণী। আমি থাকবো ভিলেন। আর যাইফ? তুমিই বলো যাইফ কি থাকবে?’

হো হো করে হেসে ওঠল পাবেল। হাতে ঘড়ি পরতে পরতে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-৩৪)
ইসরাত জাহান তানজিলা
______________________
শ্রাবণী উদ্ভ্রান্তের মতন রুম থেকে বের হয় পাবেলের পিছনে পিছনে। পাবেল দোতলার সিঁড়ি ভেঙে নিচ তলার দিকে নামছে। শ্রাবণী প্রচণ্ড অস্থির গলায় ডেকে বলল,
–‘কোথায় যাচ্ছেন আপনি? আমার কথা শুনুন।’

পাবেল শ্রাবণীর কথা শুনলো না। পিছনে ফিরেও তাকালো না। আগের থেকে দ্রুত পা ফেলে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। শ্রাবণীও ছুটে গেল। পাবেল তখন বাসার গেটের কাছে। শ্রাবণী গিয়ে ওর সামনে দাঁড়ালো পথ আটকে। পাবেল গম্ভীর গলায় বলল,
–‘কি হলো? পথ আটকালে কেন?’

শ্রাবণী হাঁপিয়ে গেছে। চেহারায় দুর্ভাবনা। ক্লান্ত গলায় বলল,
–‘আপনি এভাবে কোথায় যাচ্ছেন?’

–‘কিভাবে?’

–‘বাড়াবাড়ি করছেন কিন্তু আপনি। যাইফ ভাইয়ের কোনো রকম ক্ষতি করলে..।’

–‘কি করবে? থানায় যাবে? থানায় আমার নামে পাঁচটা কেস পড়ে আছে। তুমি আরেকটা বাড়িয়ে দিয়ে আসো। মার্ডার কেস করবে? মার্ডার এখন পর্যন্ত হয়নি। হওয়ার পর করো।’

শ্রাবণী চাচ্ছে না ওর জন্য যাইফের কোনো ক্ষতি হোক। প্রয়োজন হলে ও পাবেলের কাছে মাথা নত করবে। ক্ষমা চাইবে। শ্রাবণী পাবেলের হাত ধরে অনুনয় করে বলল,
–‘আচ্ছা আমি মানছি সব ভুল যাইফ ভাইয়ের আর আমার।’

–‘তাহলে যাইফকে মাফ চাইতে বলো আমার কাছে।’

শ্রাবণীর অসহায় চাহনি। কোন মুখে ও যাইফকে মাফ চাইতে বলবে? পাবেল বলল,
–‘কি হলো? তুমি নিজেই এখন দেখো তুমি যাইফের জন্য কতটা উতলা, অস্থির হচ্ছো? আচ্ছা এতটা উতলা তুমি আমার জন্য কখনো হয়েছো?’

–‘একজন মানুষ আমার জন্য বিপদে পড়ুক এটা আমি কেন চাইবো? আর আপনার জন্য কেন আমি উতলা, অস্থির হবো? যাইফ ভাই আমাকে যতটা সাপোর্ট দিয়েছে, যতটা বোঝার চেষ্টা করেছে আপনি সেটা কখনো করেছেন? শুধু আপনি কেন, কেউই আমায় বোঝার চেষ্টা করেনি। আমার কথা শোনার মত কেউ ছিলো না, কেউ না।’

পাবেল বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বলল,
–‘জীবনে আমি এতটা অপমানের স্বীকার হইনি কখনো। আমার এলাকায় এসে ও আমাকে….। কত বড়ো সাহস। আমার মাথায় রক্ত উঠে গেছে। আমি ছেড়ে দিবো ওকে? কফিশপে বসেই ওকে খুন করে ফেলতাম। শুধু মানুষ ছিলো বলে।’

পাবেলের গলায় তীব্র রোষ। শ্রাবণী ওকে থামাতে ব্যর্থ হয়। কয়েক মুহুর্তের ভিতর পাবেলের বাইকটা শ্রাবণীর দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যায়। ও গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে থ হয়ে। কি করবে বুঝতে পারছে না। কান্না পাচ্ছে কেবল। দারোয়ান আনোয়ার মিয়া এগিয়ে আসে শ্রাবণীর দিকে। ভ্রু কুঁচকে তাকায় ওর দিকে। বলে,
–‘কি হয়েছে মা?’

আচমকা কথার শব্দে শ্রাবণী চমকে যায়। সম্বিত ফিরে ওর। হালকা গলায় বলল,
–‘কিছু না।’

তারপর প্রসঙ্গ পাল্টায়,
–‘কেমন‌ আছেন চাচা?’

–‘ভালো মা। তোমাকে অনেকদিন পরে দেখলাম। তুমি নাকি হোস্টেলে থেকে পড়ো? কলেজ তো কাছেই, হোস্টেলে থাকো কেন?’

শ্রাবণী এখন তীব্র বিরক্ত লাগছে কথা বলতে। ও দায়সারা ভাবে জবাব দেয়,
–‘এমনি থাকি।’

–‘মন খারাপ তোমার?’

–‘না।’

–‘পাবেলের সাথে কি বনাবনি হয় না তোমার? তোমাদের মাঝে কোনো সমস্যা হয়েছে?’

শ্রাবণী উত্তর দেয় না। উদাস চেহারা ওর। আনোয়ার মিয়া ব্যগ্র হয়ে অপেক্ষা করছে উত্তরের। তিনি আবার করলেন প্রশ্নটা। এই লোকের এত আগ্রহ কেন ওদের ব্যাপারে? শ্রাবণী মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হয়। প্রকাশ করে না। বলে,
–‘না, আমাদের মাঝে কোনো সমস্যা হয়নি।’

এই বলে গেটের সামনে থেকে বাসার দিকে এগিয়ে আসে। বাসার সামনে আম গাছটার নিচে ইট সিমেন্ট দিয়ে পাতানো বেঞ্চটাতে বসলো। মনের ভিতর ছটফট করছে। এবার আর এই ঝামেলা শেষ না করে বাড়ি থেকে বের হবে না। নয়ত এতক্ষণে হোস্টেলে চলে যেত।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। শ্রাবণী বাসার ভিতরে যায়। জয়নাল সাহেব আর ফরিদা বেগমের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। পুরো বাসা জুড়ে নীরবতা। থেকে থেকে রান্নাঘর থেকে আওয়াজ আসছে। আসমা রান্নাঘরে। শ্রাবণী ওর রুমে যায়। পাবেল কি করে বসে সেই ভয়ে বুকের ভিতর কেঁপে ওঠছে। ও ফোনটা হাতে নেয়। যাইফের নম্বরে ডায়েল করে। সুইচ অফ। শ্রাবণীর শঙ্কা বাড়ে। দিশেহারা হয়ে যায়। কি করবে ভেবে না পেয়ে পাবেলের কাছে ফোন দেয়। তিন বার রিং হলো। রিসিভ করলো না। এরপর সেলিনা চৌধুরীর কাছে ফোন দিলো। ফোন ধরেই তিনি হেসে বললেন,
–‘আমি মাত্র ফোনটা হাতে নিলাম তোর সাথে কথা বলার জন্য। এর ভিতর দেখি তুই ফোন দিয়েছিস।’

শ্রাবণী গলার স্বর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলে,
–‘কেমন আছো ফুফু? যাইফ ভাই কেমন আছে?’

সেলিনা চৌধুরী অবাক হয়ে বলে,
–‘যাইফের সাথে তোর দেখা হয়নি? ও তো তোদের ওদিকে গেছে। আমি ওকে বললাম তোর সাথে দেখা করে আসতে। দেখা করেনি?’

শ্রাবণী থতমত খেয়ে গেল। সেলিনা চৌধুরীই যে যাইফকে ওর সাথে দেখা করতে বলেছে তা তো ও জানে না।
–‘হ্যাঁ, হলো তো দেখা। সব সময় ফোন দিয়ে এটা জিজ্ঞেস করতে করতে অভ্যাস হয়ে গেছে।’

সেলিনা চৌধুরী হেসে বললেন,
–‘তোর গলা এমন শুনাচ্ছে কেন? ঠাণ্ডা লেগেছে?’

–‘হ্যাঁ ফুফু। আচ্ছা যাইফ ভাই বাসায় ফিরেছে?’

–‘না, ওর ফিরতে রাত হবে অনেক।’

–‘ওহ।’

শ্রাবণীর চিন্তা কমে না বরং বাড়ে। আসমা রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,
–‘ভাবি চাচায় আপনারে ডাকে।’

চাচা মানে জয়নাল সাহেব। তিনি হঠাৎ কেন ডাকছেন? শ্রাবণী গেল। জয়নাল সাহেব জিজ্ঞেস করল,
–‘পাবেল তোমাকে ওভাবে টেনেটুনে বাসায় নিয়ে আসলো। এসে ঝগড়াঁঝাটি করে আবার বের হয়ে গেল। কোথায় গেছে ও? কি ঝামেলা হয়েছে?’

শ্রাবণী নতমুখে দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে। জয়নাল সাহেব পুনরায় বললেন,
–‘উত্তর দিচ্ছো না কেন? কাকে খুন করার কথা বলছে ও?’

–‘আমার ফুফাতো ভাইয়ের সাথে ঝামেলা হয়েছে।’

–‘কি নিয়ে?’

শ্রাবণী উত্তর দেয় না। জয়নাল সাহেবের চোখমুখ অস্থির দেখালো। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। চাপা স্বরে বলল,
–‘তুমি ওকে আটকাওনি কেন? আমাকে কেন ডাকোনি? ও ড্রাগ এডিক্টেড শ্রাবণী। যা খুশি তাই করতে পারে।’

জয়নাল সাহেব সঙ্গে সঙ্গে পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইল বের করলেন। পাবেলের নম্বরে ক্রমগত ডায়েল করতে থাকলো। জয়নাল সাহেবের ফোনও ধরছে না। উপয়ান্তর না পেয়ে তিনি সাব্বিরের কাছে ফোন করল। সাব্বির পাবেলের চাচাত ভাই। এক সাথে ওঠাবসা তাদের।
–‘সাব্বির, পাবেল তোর সাথে?’

–‘না চাচা। পাবেলের গায়ে নাকি জ্বর? কয়েকদিন ধরে দেখছি না। সেদিন পিকনিকে ডাকলাম আসেনি।’

–‘আচ্ছা একটু খোঁজ নিয়ে দেখ তো ও কোথায় আছে। ওর বন্ধুবান্ধব কারো নম্বর থাকলে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস কর।’

–‘কেন কি হয়েছে? কোনো ঝামেলা হয়েছে?’

–‘তোকে খোঁজ নিতে বলেছি তুই খোঁজ নে।’

জয়নাল সাহেব ফোন রাখে। শ্রাবণী তখনো দাঁড়িয়ে আছে। ফরিদা বেগম আসেন। তিনি বিলোপ জুড়ে দেন,
–‘তোমার ছেলে আমায় বলে আমি নাকি সব ব্যাপারে নাক গলাই। ওর রুম থেকে আমাকে বের হয়ে যেতে বলল। এরকম আগে কখনো বলেছে? বিয়ে করার পর মাথাটা গেছে ওর। এই মেয়েটাই সব ঝামেলার মূলে।’

ফরিদা বেগম শ্রাবণীর দিকে আঙুল তুলে। একটু থেমে আবার বলে,
–‘ওকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করো বাসা থেকে।’

জয়নাল সাহেবের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। সত্যি সত্যি খুনখারাবি করে বসলে বিপদ। তিনি গায়ের পুরাতন পাঞ্জাবিটা ছেড়ে ভালো একটা পাঞ্জাবি পরে। ফরিদা বেগম বলে,
–‘কোথায় যাচ্ছো তুমি এই রাতে?’

–‘দেখি পাবেল কোথায় আছে।’

–‘আন্দাজে কোথায় খুঁজবে তুমি ওকে?’

জয়নাল সাহেব উত্তর দেয় না। বাসা থেকে বের হয়। শ্রাবণী বসে আছে নিস্তেজ শরীর নিয়ে। ফরিদা বেগম ওকে যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছে। এগারোটার দিকে জয়নাল সাহেব বাসায় ফিরেন। ব্যগ্র গলায় বলে,
–‘পাবেল কি ফিরেছে?’

ফরিদা বেগম বলেন,
–‘না।’

জয়নাল সাহেব সোফায় বসেন। ক্লান্ত লাগছে তাকে। এর ভিতর তার ফোন বেজে ওঠে। সাব্বির ফোন দিয়েছে। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
–‘চাচা পাবেলকে পাওয়া গেছে। একটা রাস্তার পাশে। রক্তাক্ত অবস্থায়। অবস্থা খুব খারাপ।

সাব্বিরের গলায় আতঙ্ক। জয়নাল সাহেব বোবা হয়ে রইলেন। ফরিদা বেগম অস্থির গলায় প্রশ্ন‌ করল,
–‘কি হয়েছে? কে ফোন করেছে? কথা বলছো না কেন? পাবেল ঠিক আছে? ওর কিছু হয়নি তো?’

জয়নাল সাহেব কথা বলতে পারছে না। তার বুকের ভিতর ধড়ফড় করছে। হৃদযন্ত্রটা বিকল হয়ে যাবে বোধ হয়। শ্রাবণী রুমে বসে তাঁদের কথা শুনে বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছে। ও ছুটে আসে। দিশেহারা হয়ে প্রশ্ন করে,
–‘বাবা কি হয়েছে?’

জয়নাল সাহেব কয়েকবার থেমে থেমে বললেন,
–‘পাবেলকে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পাশে পাওয়া গেছে। ওর অবস্থা খারাপ।’

তার গলার স্বর আটকে আসছে। ফরিদা বেগম কিছুক্ষণ স্তম্বিত হয়ে থেকে প্রায় চিৎকার করে কেঁদে ওঠলেন। শ্রাবণী যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ওর পা দুটো অসাড় হয়ে আসছে। ফরিদা বেগম হঠাৎ কান্না বন্ধ করে পাগলের মত ক্ষীপ্তবৎ হয়ে ছুটে যায় শ্রাবণীর দিকে। ওর গলা টিপে ধরে বলে,
–‘তুই মারিয়েছিস আমার ছেলেকে? তোকে আমি গলা টিপে মেরে ফেলবো।’

আসমা ছুটে আসলো। ফরিদা বেগমের হাত থেকে শ্রাবণীকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো।‌ ফরিদা বেগমের শক্তির সাথে ও পেরে ওঠে না। শ্রাবণীর চোখ উল্টে গেছে। জয়নাল সাহেব এসে রেহাই দেয় শ্রাবণীকে। তিনি ফরিদা বেগমকে বলেন,
–‘ওকে আর ওর বাপকে পরে দেখে নিবো। হাসপাতালে চলো এখন।’

জয়নাল সাহেবের চোখ ছলছল করছে। ছেলে হারানোর শঙ্কা মনে উঁকি দিচ্ছে। তার আন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। পাবেল তার একমাত্র সন্তান। পাবেলের কিছু হয়ে গেলে সে নিঃস্ব হয়ে যাবে। ফরিদা বেগমের শরীর টলমল করছে। মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম। এখুনি ঢলে পড়বে যেন মেঝেতে। জয়নাল সাহেব তাকে শক্ত করে ধরে। সাব্বির আবার ফোন করেছে। জয়নাল সাহেব ফোন ধরার সাহস পাচ্ছে না। কি খবর জানাতে ফোন দিয়েছে সাব্বির? কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন ধরে। সাব্বির ব্যস্ত গলায় বলে,
–‘চাচা আপনি কাকিমাকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে আসেন।’

জয়নাল সাহেব কোনো প্রশ্ন করতে পারে না। তিনি ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে আসতে বলে। শ্রাবণী এই মুহূর্তে কিছুই ভাবতে পারছে না। ওর ভাবনা শক্তি লোপ পেয়েছে। ড্রাইভার এসে গাড়ি বের করে। শ্রাবণী তাদের সাথে হাসপাতালে যেতে চাইলে ফরিদা বেগম বিশ্রী রকমের গালাগাল দেয়। ওর যাওয়া হয় না। আসমা মেয়েটাও তাদের সাথে চলে গেছে। পাবেলের দাদা-দাদীও। এত বড়ো বাসায় শ্রাবণী একা। ও ফ্লোরে বসে পড়লো। কে বা কারা মেরেছে পাবেলকে? যাইফ ভাই করেছে এই কাজ? ওর সাথে পাবেলের সম্পর্ক যতই খারাপ থাকুক, ও যতই অপছন্দ করুক পাবেলকে কিন্তু এমনটা কখনো চায়নি। শ্রাবণীর বুকের ভিতর হাহাকার করে ওঠে। চোখ দু’টো ভিজে যাচ্ছে বার বার। পাবেলের যেন কিছু না হয়। সে সুস্থ হয়ে যাক। আজ পাবেলের কিছু হয়ে গেলে এই দোষ সারাজীবন ওর বয়ে বেড়াতে হবে। সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই সমস্ত দোষ ওর ঘাড়ে ঠেলে দিবে।
(চলবে)