#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur(ছদ্মনাম)
Part–44
নিউইয়র্কে আজকের ব্রেকিং নিউজ হলো হুট করে আবারো করোনা সংক্রান্ত বেড়ে যাচ্ছে। সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে সরকার থেকে৷ যদিও বা আমেরিকায় করোনা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক হিসেবে নিতে বলা হয়েছে৷তারপরও আতঙ্ক থেকেই যায়। কেননা, করোনা ভাইরাসের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো এটা ছোঁয়াচে, খুব দ্রুত সংক্রমিত হয়। তার উপর গতসাল মানে দুই হাজার বিশ সালে কোভিড নাইন্টিনের তাণ্ডবে বহু মানুষ মারা গেছে।অসুস্থ হয়েছিল৷ গতবার আমেরিকার অবস্থা খুব বাজে ছিল। আবার নতুন ভ্যারিয়েন্ট দেখা দিয়েছে। যেটা আরো দ্রুত সংক্রামিত হয়৷ হলরুমের টিভিতে নিউজ প্রচার হচ্ছিল। সাদ, হাসনাহেনা আর মিরা খাওয়ার টেবিলে বসা। ইমান কফি বানাতে গেছে। হাসনাহেনা বলে উঠে, ” এই করোনার মধ্যে কত আপন মানুষ হারালাম। পাশের বাসার মিসেস ডায়ানা তো গতবছর করোনায় মারা গেল। এতো খারাপ লেগেছিল ওই সময়। কিন্তু তাকে শেষ বার দেখতে পারিনি। আমার মিষ্টার থমাসের জন্য খুব কষ্ট হয়। ওনার হাসবেন্ড।”
উনি মূলত মিরার সঙ্গে কথা বলছেন। সাদ নাস্তা খাওয়ায় ব্যস্ত৷ আর এদিকে মিরা যেন কানে কিছু শুনতে পাচ্ছে না। সবকিছু ব্ল্যাংক লাগছে৷ ওর বিধ্বস্ত চেহারা দেখে হাসনাহেনা প্রশ্ন করে, ” আর ইউ ওকে? খাচ্ছো না কেন? সিক ফিল হচ্ছে? ”
মিরার কান্নার দমকা আটকে রেখে বলে, ” হ্যাঁ। অসুস্থবোধ হচ্ছে।”
–” তুমি তাহলে আরো কিছুক্ষণ রেস্ট কর। আর এই শীতের মধ্যে এতো সকালে শাওয়ার নেওয়ার কি দরকার ছিল? ঠাণ্ডা সহ্য হচ্ছে না তোমার। ”
হাসনাহেনার প্রশ্নে মিরা চকিত দৃষ্টিতে তাকায় তার পানে। এরপর উশকুশ করে বলে, ” আমার খেতে ইচ্ছা করছে না, আন্টি৷ পরে খাব।”
–” আচ্ছা। ”
মিরা উঠে চলে যাওয়ার এক সেকেন্ডের ব্যবধানে ইমান কিচেন থেকে ফিরে আসে৷ কফি নিয়ে। মিরার চেয়ার ফাকা দেখে সে ভ্রু কুচকে তাকালো৷ কিন্তু কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করল না৷ কফির মগ টেবিলে রাখতেই হাসনাহেনা বলে, ” মিরা তো খাবে না।”
ইমানের মেজাজ খারাপ হলো৷ ইমান রান্না করেছে জন্য খায়নি নিশ্চয়ই ঘাড়ত্যাড়া মেয়েটা। অসহ্যকর! আর কতভাবে বোঝালে বোকাবতী বুঝবে সে সত্যি তাকে ভালোবেসে ফেলেছে? ষ্টুপিড গার্ল একটা।
হাসনাহেনা বলে, ” মিরার মনে হয় শরীর খারাপ। এজন্য খাবে না।”
ইমান মুখ কালো করল। এরপর মনে মনে বলে, ” শরীর খারাপ না ছাই। আমি রান্না করেছি জন্য খাবে না। সে প্যানকেকটা কে নাইফ দিয়ে টুকরো টুকরো করছিল। তারপর গম্ভীর মুখে বলে, ” আমি কাউকে ব্রেকফাস্ট করতে জোর করিনি। যার ইচ্ছা হবে খাবে না৷”
সাদ জুস গ্লাসে নিয়ে বলে মেকি হেসে বলে, ” গুড নিউজ কবে পাচ্ছি বিগ ব্রো? তোমার গুড নিউজ সেরে গেলেই আমারটা ক্লিয়ার।”
ইমান নাইফ থামালো। সে বুঝতে পারল না কোন গুড নিউজের কথা বলছে তার ছোট ভাই৷ পরক্ষণে মনে পড়ে যায়, কোন এক সময় ইমান তাকে বলেছিল প্রোমোশন পেলে নিজের ফ্ল্যাট কিনে শিফট হবে। সে আঠারো বছর বয়সের পরপর বাসা ছেড়ে হোস্টেলে শিফট হতে চেয়েছিল৷ কিন্তু বাবা যেতে দেয়নি। সেইম কেস সাদের জন্যও। অথচ আমেরিকানরা এইট্টিন প্লাস হলেই পূর্ণ স্বাধীনতা পায়। যেটা তারা দুই ভাই এখনো পাইনি। সাদ তার কোন গার্লফ্রেন্ডকে বাসায় আনতে পারেনা। বেচারা এটা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে৷ ম্যাক্সিমাম বাঙ্গালী ফ্যামিলি গুলোতে ছেলে-মেয়েরা বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে। সাদ নিশ্চয়ই তার বাসা ছাড়ার গুড নিউজের কথা বলছে। সে চলে গেলে, সাদও আলাদা হতে পারবে। আগা হাল যেদিকে যায়, পিছা হালও ওইদিকেই যাবে। তাছাড়া তাকে এখন অন্যখানে শিফট হতে হবে। এখন তার নিজের ফ্যামিলি হয়েছে। বউ আছে৷ সংসার আছে৷ সে মনে মনে ঠিক হলো, মিরা যেখানে এডমিশন নিবে তার আশেপাশে ফ্ল্যাট রেন্ট নিবে। আপাতত তার আরো কিছুদিন লাগবে ফ্ল্যাট কিনতে৷ দু’রুমের বাসা কিনবে? যদি তাদের দুইটা বেবি হয়, তখন কি করবে? দুই সিবলিং একসঙ্গে থাকতে চাইবে? আচমকা নিজের ভাবনার শাখা-প্রশাখার শ্রী দেখে সে চমকে উঠে। এরপর সাদকে বলে, ” খুব দ্রুত গুড নিউজ পাচ্ছো।”
সাদ লাগিয়ে উঠে বলে, ” সত্যি ভাইয়া?”
–” ইয়েস।”
সাদ মায়ের দিকে তাকালো। হাসনাহেনা মুচকি হাসলো।
মিরার নরম শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল কান্নার দমকে৷ মাথাটা তার দেয়ালের সঙ্গে ঠেকানো৷ সামনেই সেই বিশাল স্বচ্ছ কাঁচের জানালা৷ তার বুকটা অসহনীয় যন্ত্রণায় উপদ্রব করছে৷ কিন্তু আশ্চর্যজনক হলো তার চোখ ফেটে অশ্রুবর্ষণ হতে চাচ্ছে না। এ সময়টা খুব যন্ত্রণাদায়ক। রুমের দরজা, জানালা বন্ধ থাকায় তার দমবন্ধ লাগছে। রুম হিটার চলছে। রুম হিটার চলার জন্য বাইরের শীতের প্রকোপ বোঝা যায় না৷ উষ্ণতা বিরাজ করে৷ রুমের দরজা খোলার শব্দে সে নিজেকে ধাতস্থ করল।
ইমান এসেছে বোধহয়। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে হাসনাহেনা উপরে উঠে এসেছেন তার সঙ্গে দেখা করতে৷ মিরা ওনাকে দেখে ম্লান হাসে৷ উনি আশপাশে তাকালো। এরপর বলে, ” দোতলায় আমি কোনদিন আসিনি৷ এই প্রথম তোমার জন্য আসলাম। ইমান তো দারুণ সুন্দর ভাবে রুম সাজিয়েছে৷ তুমি কি ওইপাশে থাকছো?”
–“জি৷”
–” বোঝাই যাচ্ছে। পর্দা দিয়ে পার্টিসন দেওয়া। প্রথম দেখায় যেকেউ দুটো ভিন্ন রুম ভাববে। তোমার কী এভাবে থাকতে আনইজি ফিল হয়?”
মিরা উত্তর দিল না। উনি নিজ থেকে বলে উঠে, ” আসলে আমার মনে হলো তুমি কমফোর্ট নও। কিন্তু আমিও নিরুপায়৷ আমাদের কোন এক্সট্রা গেস্টরুম নেই। তবে তুমি চাইলে হলরুমে আলাদা ফ্লোরিং করে দিতে পারি। কিন্তু ওটা খুব চোখে লাগবে৷ পারসোনাল স্পেস পাবে না৷ তার চেয়ে এখানেই ভালো আছো।”
মিরাকে চুপ থাকতে দেখে উনি বলে উঠে, ” তুমি রেস্ট কর। তোমার কী মাথাব্যথা নাকী?”
–“হ্যাঁ, আন্টি।”
হাসনাহেনা আগ বাড়িয়ে মিরার মাথা টিপে দিতে লাগলেন। সে বারবার মানা করছিল৷ উনি বারং শুনলেন না৷ মিরার নড়াচড়ার কারণে তার ওড়না অসাবধান বশত সরে আসে। হাসনাহেনার চোখ আটকে যায় তার গলায় সদ্য ক্ষতপ্রাপ্ত লালচে রক্ত জমাটের দিকে৷ উনি ভ্রু কুচকে বলে, “তোমার গলায় ওটা কিসের দাগ মিরা?”
সে আরেকদফা চমকে উঠে। ভড়কে যায়৷ দৃষ্টি অচঞ্চল হয়ে এক জায়গায় থমকে যায়। স্মৃতির মানসপটে আজকের ভোরের দৃশ্যপট ভেসে উঠে। বাক্যহারা হয়ে পরে সে। উত্তর দেওয়ার মতো কোন শব্দ তার ডিকশনারিতে মজুদ নেই৷ উত্তর কী দিবে? আপনার গুনধর ছেলে এমন করেছে?
সে আস্তে বলে উঠে, ” খেয়াল নেই।”
উনি কেমন সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকালো তার পানে। মিরার ভারী অস্বস্তি বোধ হতে লাগলো। উনি কী তাকে সন্দেহ করছে? মিরা বলে উঠে, ” ডিভানে ঘুমাই আমি। অসর্তক থাকার ফলে ব্যথা পেয়েছি মনে হয়। পোকা কামড়াতে পারে।”
তার বলা কথাতে বুঝি ওনার সন্দেহ দূর হলো। প্রানবন্ত হেসে বলে, ” তোমার জন্য মশারীর ব্যবস্থা করতে হবে। আসছি তাহলে।”
উনি যাওয়ার পরপর ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিল মিরা। বড্ড ঘুম পাচ্ছে তার। চোখ অটোম্যাটিক্যালি বন্ধ হয়ে এলো। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে জানে না। তবে তার ঘুম ভাঙ্গে কারো কণ্ঠস্বরে। কেউ কথা বলছে৷ কি বলছে তা ঠিকমতো শোনা যাচ্ছে না। পুরোপুরি ভাবে তার ঘুমের রেশ কেটে গেলে, সে শুনতে পায় ইমান কথা বলছে কারো সঙ্গে। সে বলছে, ” বেবি, বেবি! হেই বেবিটা আমার! ”
ওর কণ্ঠে বলা কথাগুলো কানে আসতেই মিরার বুক কেঁপে উঠে। ইমান তাকে ফাঁকি দিয়ে এভাবে প্রেমালাপ চালায়? ও নিশ্চয়ই ভেবেছিল মিরা এখন জাগবে না। এই সুযোগের সঠিক ব্যবহার করল। ছিঃ! বুক ফেটে খা খা করছে তার৷
ও আরো আদুরে গলায় বলে উঠে, “কাম ইনটু মাই আর্মস, সুইটহার্ট।”
” সুইটহার্ট” শব্দটা কর্ণকুহরে যেতেই খট করে লাগল তার হৃদয়ে৷ এরপর দু’মিনিট নীরবতা তারপর আবারো ইমান হাসতে হাসতে বলে, ” আচ্ছা রাগ করেছো নাকি? ঠিক আছে, আমাকে একটা কি/স দাও বেবি। আ-দ-র করে দিয়ে যাও।”
মিরা আর সহ্য করতে পারল না। এতোক্ষণ দাঁতে দাঁত পিষে মেনে নিয়েছে প্রেমালাপ। কিন্তু এবার সে বাড়াবাড়ি করছে। একই রুমে, বউয়ের সামনে আরেকজনের সঙ্গে! ছিঃ! রুচিতে বাঁধে না।
মিরা তড়িৎ বেগে পর্দা সরিয়ে ওদিকে প্রবেশ করে বলে, ” এনাফ।”
ইমান তার চেচানোর শব্দে পেছনে তাকিয়ে বলে, “তুমি উঠো গেছো। এতো দ্রুত?”
–” কেন? আমি উঠে যাওয়ায় ডিস্টার্ব হচ্ছে?”
–” ডিস্টার্ব কেন হবো?”
–” ঢ-লা-ঢ-লি করতে পারবেন না। গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে র/সা/লো কথা বলা যাবে না। চু*মু খাওয়া যাবে না৷জেগে গিয়ে খুব মুশকিলে ফেলে দিলাম আপনাকে।”
ইমান তার কথার আক্রমনে হা হয়ে যায়। বাপ রে, মেয়েটা এতো ক্ষেপেছে কেন?আর কিসব আজগুবি কথা বলছে৷ কিছুই বুঝতে পারছে না সে। কোথায় যেন পড়েছে সে, বউদের ভাষা আলাদা। বেশিরভাগ পুরুষই বউয়ের কথা বুঝে না। তবে সে খেয়াল করে, মিরা রেগেমেগে একাকার। তার নাকের ডগায় ঘাম জমেছে। মেয়েটার রাগ চাপলেই নাকের ডগায় বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমে যায়৷ ভ্রু কুচকে গেলে ওই চোখের মণি আরো গভীর হয়। থেকে থেকে ওর মুখশ্রীর ঐশ্বরিক সৌন্দর্য ভেসে উঠে কচুরিপানা ফুলের মতো। সে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। যেন কোন ঘোরে আটকা পড়েছে৷
মিরা রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে ছিল। অপেক্ষায় ছিল ওর তরফ থেকে কিছু শোনার আশায়৷ কিন্তু ব্যাটা খচ্চর কিছু বলছে না। গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে গল্প থামিয়ে দিয়েছ ধরা পড়ার ভয়ে৷ মিরার টনক নড়ে যখন ঘরের ভেতর কুকুর ছানার কুই কুই ধ্বনির কান্নার আওয়াজ শুনে৷ সে চকিত কুকুরছানার দিকে তাকালো। কুকুরটার জাত সম্ভবত আমেরিকান এস্কিমো। ধবধবে সাদা লোমশ দেহ। সাইজে ছোট। ওর এক গাছি লোম একজোট করে পনিটেল করা৷ আবার কুকুরটার পনিটেলে লাল বো বেঁধে দেওয়া আছে। শুধু তাই না পিংক কালারের বেবি ফ্রক পরে আছে। কুই কুই করতে করতে সে ইমানের পায়ের কাছে এসে জিভ বের করে লেজ নাচাতে লাগল। ইমান আবারো তার দিকে তাকিয়ে হেসে আদুরে গলায় বলে, ” হেই বেবি, আর ইউ ডান ইউথ ইউর পটি?”
কুকুরটা কী বুঝল কে জানে সে কুইকুই করে উঠে সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু খুব আস্তে। ইমান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, ” তুমি কি জানি বলছিলে মিরা? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না৷ ক্লিয়ার করে বলো।”
মিরা চুপ হয়ে গেল। কুকুরছানাটার নজর তার দিকে। হ্যাঁ পাপ্পিটা অনেক কিউট৷ কিন্তু সে ডগ ভয় পায়। ভীষণ ভয় পায়। ওদের দেখলেই গা কেমন করে উঠে৷ অথচ ইমান কুকুরটাকে ঘরে এনে ছেড়ে রেখেছে৷ আচমকা কুকুর ছানাটা ইমানের পায়ে সুরসুরি দেওয়া বন্ধ করে লেজ নাচাতে নাচাতে মিরার দিকে দৌড়ে যায়৷ মিরা সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে ছুট লাগায়৷ কুকুরটা তার পিছু ছুটে৷ উপায় না পেয়ে মিরা বিছানায় উঠে দাঁড়ায়৷
ইমান ওর কাণ্ড দেখে হেসে ফেলে। মিরার আতঙ্কগ্রস্থ চেহারার পানে তাকিয়ে বললো, ” ওকে ভয় পাবার কিছু নেই। ইমা ইজ এ গুড বেবি৷ কিছু করবে না তোমাকে। শুধু আদর করতে চায় তোমাকে। মনে হয় তোমাকে ওর খুব পছন্দ হয়েছে৷ তোমার পা এগিয়ে দাও৷ পায়ে চু*মু দিয়েই ইমা চলে আসবে৷”
মিরা চিৎকার দিয়ে বলে, ” আপনার ইমার চু*মু নেওয়ার শখ নেই আমার।”
— “তাহলে কী আমার কাছ থেকে চু*মু নেবে?”
মিরা বিষ্ফোরিত চোখে তাকালো। সকালের কথা সে এখন অব্দি ভুলে নি। আসলেই কী জুই নামের মেয়েটার সঙ্গে ওর কোন রিলেশন আছে?
মিরাকে বেডের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইমান গিয়ে কুকুরছানাটাকে নিজের কোলে তুলে বললো, ” চল আমরা নিচে যাই ইমা। তোমার আন্টি ভয় পাচ্ছে তোমাকে।”
মিরা প্রশ্ন করে, ” ওর আন্টি কে?”
ইমান রুমের বাইরে যেতে যেতে বলে, ” কে আবার? তুমি। আমি ওর আংকেল আর তুমি ওর আন্টি। সিম্পেল।”
মিরা হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল৷ ইমা নামক কুকুরছানাটা ইমানের নেইবার মিষ্টার থমাসের পালিত কুকুর। মিসেস ডায়ানা গতবছর করোনায় মারা যান৷ ওনার আদরের পেট ডগ এনিও তার সাত মাস পর মারা গেল৷ কুকুর এনির বাচ্চা হলো ইমা। আপাতত ইমার দেখাশোনা মিষ্টার থমাস করেন৷ উনি নাকি ইমানের নাম থেকে শুনেই ইমা নাম দিয়েছেন৷ মিষ্টার থমাস খুব একলা হয়ে গেছেন স্ত্রী মারা যাওয়ার পর৷ ইমানের দেখা বেস্ট কাপল ছিল ওরা।
নিচে এসে সে ইমাকে ছেড়ে দিয়ে কেক বানানোর প্রস্তুতি নিল৷ আজকে রাতের জন্য তার খুব চমৎকার একটা প্লান আছে৷ হোপফুললি ইট উইল ওয়ার্ক।
______________________
ফ্লোরে পড়ে যেতেই ইরা ভীষণ জোরে কেঁদে উঠল। কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দ বেরিয়ে বাইরে প্রকাশ পেল না৷ সারা শরীর ঝিম মেরে যায়৷ ওদিকে অনিক তার পা বাঁধার জন্য একটা কাপড় আনে। ইরার চোখ তখনই খয়েরী বোতলের দিকে গেল৷ নিচ থেকে উঠার শক্তি পাচ্ছে না সে। কিন্তু তাকে যে উঠতেই হবে। নাহলে সারা জীবনের জন্য সে কলঙ্কিত হয়ে যাবে। ফুটফুটে জীবনটায় কালো দাগ এসে ছোবল মারবে৷ অপরদিকে অনিক তার কাছাকাছি এসে আ-প-ত্তি-ক-র জা/য়/গা/য় ছো-য়ার চেষ্টায় ব্যাকুল। ইরা বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে নিজের দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে উঠে দাঁড়ালো এবং একটু দূরে অবস্থান করা ম-দে-র বোতল হাতে তুলে ভীষণ জোরে অনিকের কপালে আঘাত করে। সঙ্গে সঙ্গে ওর কপাল থেকে গ-ল-গ-ল করে র-ক্ত বেরুতে শুরু করে৷ ইরা ভীষণ ঘাবড়ে যায়। ঘাম ছুটছে তার৷ তখনই বেল বেজে উঠে। অনিক বেল বাজার শব্দে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও তাকে ধরার চেষ্টা চালায়। কিন্তু তার আগেই ইরা লক খুলে পালিয়ে যায়। মেইনডোরের দরজা খুলতেই সে সুপ্তি বেগম তথা তার মাকে দেখতে পায়৷ সঙ্গে সঙ্গে মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পরে কেঁদে উঠে। বাজার থেকে ফেরত আসা সুপ্তি বেগমের মেয়ের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে বুক কেপে উঠে। অতি শোকে মুখ দিয়ে তার কথা বেরুচ্ছে না। তবে রাগে-ঘৃণা-দুঃখে এই তিনটা অনুভূতির মিশ্রণে তার মাথা ঝিম মেরে উঠে।
_________________
ইমানকে কেক বানাতে দেখে হাসনাহেনা আর রান্নাঘরে ঢুকলেন না। ও আবার পারসোনাল কাজে হস্তক্ষেপ পছন্দ করেনা৷ হলরুমে বসে তিনি কল লাগালেন জুইকে। তিনবার রিং হতেই ওপাশ থেকে জুই রিসিভ করে বলে, ” গুড নুন আন্টি।”
–” কেমন আছো তুমি? ”
–” বেশ আছি৷ মিষ্টার খানের জন্য আমি অনেক হ্যাপি। ওর প্রোমোশনের খবর পেয়েছেন? ”
–” সকালে শুনলাম। তোমার বাবা কেমন আছে?”
–” ভালো। আচ্ছা আন্টি একটা প্রশ্ন করি? আসলে করব করবে করে করা হচ্ছে না। আমি খুব কনফিউজড।”
–” কর।”
–” ইমান কী ওর ফিমেইল কাজিনের সঙ্গে একরুমে থাকছে? আই মিন……”
হাসনাহেনা শুধরে দিয়ে বলে, ” তুমি ভুল বুঝছো। ওর রুমটা তো দেখেছোই তুমি। কতবড়। দু’রুমের সমান৷ একসঙ্গে থাকছে না। আলাদাই আছে। আর ইমান কে তুমি চেনো না? ও কেমন জানো তো। আমার সৎ ছেলে হয় ও। তাও বলতে বাধ্য ওর ক্যারেক্টার নিট এন্ড ক্লিন তোমাকে ছাড়া অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে দেখিনি৷ ৷সেখানে তুমি ওর পছন্দের, ভালোবাসার মানুষ হয়ে সন্দেহ করছো? প্লিজ এসব মাথা থেকে ঝারো। ট্রিপিকাল চিন্তা বাদ দাও। আর মেয়েটা তো ওর কাজিন। বয়সে বেশ ছোট। খারাপভাবে নিও না।”
জুই কিছু বললো না। আন্টির কথা শুনে তার বুকে ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে৷ মিষ্টার খান তাহলে বাসায় ওকে নিজের ” ভালোবাসার মানুষ” হিসেবে পরিচিত দিয়েছে? নিশ্চয়ই দিয়েছে। নাহলে আন্টি একথা কেন বলবে। মাই গড, উনি তলে তলে ওতোদূর এগিয়ে গেল৷ অথচ জুইকে কিছু জানালো না। সে লাফ দিয়ে উঠে। এবং লাফানোর জন্য সোফায় বিকট শব্দ তৈরি হলো।
রাতের দিকে ইমান দোতলায় ফিরল ইমাকে নিয়ে৷ ইমাকে ছেড়ে দিতেই ও নাচতে নাচতে মিরার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ডিভানে গিয়ে চার পা তুলে বসলো৷ মিরা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এ কান্ড দেখে অবাক। ইমান বললো, ” আজ ইমা এখানেই ঘুমাক।”
–” তাহলে আমি কোথায় শুব।”
তার প্রশ্নে ইমান চমকে উঠে। আশ্চর্য তাদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে। তাহলে এখন আলাদা শোয়ার মানে কী? সে বলে, ” বিছানায়।”
–” অসম্ভব। ”
–“আমাদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে মিরা। এখন একসঙ্গে থাকলে সমস্যা কোথায়?”
মিরার খুব করে বলতে ইচ্ছা হচ্ছে আমাদের মধ্যে কিছুই ঠিক হয়নি৷ ওটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট ছিল। নিজের মধ্যে ছিলাম আমি এজন্য এতো কাছে ঘেঁষতে পেরেছিলেন।
সে কুকুরভীতির জন্য হলেও বেডের মাঝে এসে শুলো বিরক্তমুখে৷ এবং সঙ্গে সঙ্গে ইমান তাকে বেড থেকে তুলে, কোলে নিয়ে রুমের বাইরে হাঁটা দেয়৷ একদম ছাদে নিয়ে গেল। এবাসায় ছাদ আছে সে জানত না। কিন্তু ওদের ছাদটা খুব সুন্দর। গাছ দিয়ে ভরা। দোলনা আছে। ঘরের মতো বক্স আকারে হলদে বাতি জ্বালানো। স্নো পরা থেমেছে তখন৷ তবুও বাতি, দোলনা, গাছে স্নো পরে ঝলমলে করছে৷ অন্ধকার রাত। ধূসর মেঘ৷ দূরে কোথাও নাম না জানা পাখি ডাকছে। বাতাসের তোড়ে পাতার মড়মড় আওয়াজ ভেসে আসছে। বায়ুতে স্নিগ্ধতার সুগন্ধি। টেবিলের উপর কেক, একটা ডায়মন্ড রিংয়ের বক্স এবং দুটো ক্যান্ডেল জ্বালানো। ক্যান্ডেল থেকেও কড়া একটা স্মেল ভেসে আসছে৷ মিরার শীত করতে লাগল৷ ইমান তাকে নামিয়ে দিলেও কোমড় জড়িয়ে ধরেই আছে। কোথা থেকে যেন চাদর বের করে এনে দিয়ে গায়ে জড়িয়ে দিল৷ এরপর চোখে চোখ রেখে বলে, ” আজকের আকাশটা দেখো?”
মিরা আকাশের দিকে তাকালো না। ইমান তার বাহু ধরে নিজের কাছে টেনে আনে। এরপর কোমড় শক্ত করে ধরে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে শূন্যে তুলে৷ মিরা সামান্য চিৎকার তুলে। ইমান বলে, “ঐ দূরের আকাশটা দেখো, আকাশের বুকে টিপটিপ করে হাসতে থাকা তারা, নক্ষত্র গুলো দেখো! কী অদ্ভুত সুন্দর তাই না? মিরা, আমি তোমার জীবনে ওই সুন্দর দীপ্তমান নক্ষত্র হতে চাই। অফিশিয়ালি প্রোপোজ করছি। “আই লাভ ইউ” বলব না। শুধু বলব, আই নিড ইউ লাইক এ স্কাই নিডস দ্যা মুন। তোমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হতে চাই।”
মিরা চোখ জুড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে৷ আজ বোধহয় পুর্নিমা। শীতের রাতের চাঁদও যে এতো অপূর্ব হয় জানা ছিল না। কী সুন্দর কিরণ ছড়িয়েছে৷ মিটমিট করে হাসছে যেন৷
ইমান তাকে নিচে নামিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে রিং হাতে নিয়ে তার সামনে এগিয়ে দিল। মিরা হাত এগিয়ে দিলে সে আংগুলে রিং গুজে দিয়ে ওকে সিলগালা করে ফেলবে ফাইনালি। অবশ্য আগে থেকেই তারা একজন অপরজনের৷ তবুও আজকের ব্যাপারটা ভিন্ন৷ কিন্তু মিরা হাত বাড়িয়ে দিল না। তাকে নিরাশ করল ভীষণ বিশ্রী ভাবে৷ এবং ক্রোন্দনরত সুর তুলে বলে, ” আমি আপনাকে ভালোবাসি না। নিজের অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনে কোন নক্ষত্র চাই না।”
চলবে৷
#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–45
প্রেয়সীর পানে নিষ্পলক নয়নে তাকালো ইমান। সরাসরি প্রত্যাখ্যান তার বুকের সব ক’টা অনুভূতিকে কেটে-কুটে ক্ষত-বিক্ষত করছে৷ “না” ই যদি উত্তর হয়, তাহলে কেন এত্তো ঘনিষ্ঠ হলো সে? কেন-ই বা সুদূর সাত সাগর তের নদী পাড় করে তার কাছে ছুটে এলো? কেন এতো মায়া বাড়িয়ে ভেতর থেকে ইমানকে দুর্বল করে ফেললো? কেন করল এমন? কেন? কেন? কেন? এতোকিছুর উত্তর সে কার কাছে চাইবে?
মিরা তাকে উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে নিচে নেমে যেতে ধরলে, ইমান খপ তার হার ডান হাত চেপে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে মিরা হাত ছাড়ানোর চেষ্টায় উঠে-পড়ে লেগে যায়৷ একটা সময় সে ক্ষুব্ধ হয়ে গেল এবং ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে, ” হাত ছাড়ুন প্লিজ। সবসময় জোর খাটিয়ে লাভ হয়না৷ আপনি জোর করে নিশ্চয়ই আমার কাছ থেকে ভালোবাসা আদায় করতে পারবেন না?”
–” সম্ভব হলে করতাম কিন্তু আফসোস জোর করে ভালোবাসা যায় না।”
–” এই মোহাব্বত এতোদিন কোথায় ছিল? আমাকে ফেলে এসে একটা বারও খোঁজ নেননি। বিয়ের পরের অবহেলা করার দিনে এই মাখো-মাখো ইশক কোথায় ছিল ইমান?”
ইমান হাতের বাঁধন হালকা করতেই মিরা নিজের হাত সরিয়ে নিল। সে অবশ্য উত্তরের কোনরুপ প্রত্যাশা করে না৷ প্রতারকের কাছে কখনোই সঠিক উত্তর থাকে না৷
ইমান বলে উঠে, ” আমি জানি না আমার কী হয়েছে৷ এমন হওয়ার কথা ছিল৷ আমি তোমাকে কখনোই ভালোবাসতে চাইনি৷ বরং ঘৃণা করার চেষ্টা করেছি৷ প্রতিশোধ নিতে বিয়ে করেছিলাম। ভেবেছিলাম বিয়ে করে সম্পর্ক ভেঙে দিয়ে তোমার বাবাকে মানসিক কষ্ট ভোগ করাব৷ কিন্তু দেখো, তোমাকে কষ্ট দিতে সম্পর্ক ভাঙ্গার বদলে নিজেই ভেঙে গুড়গুড় হচ্ছি। এই প্রতিশোধময় বিয়ের জালে আটকা পরে গেছি। শক্র স্বামী থেকে সত্যিকারের স্বামী হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে যাচ্ছি।”
মিরা তার অধিকাংশ কথাই শুনল না। সে বড় বড় পা ফেলে অবিন্যস্ত কিন্তু চঞ্চল পায়ে ছাদ থেকে নিচে নেমে পরে। ইমান ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। আবহাওয়া এতোক্ষণ যাবত অনুকূলে ছিল। বরফ পড়ছিল না৷ কিন্তু রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীত যেন হুহু মাত্রায় আরো বাড়ল। বরফ পরা আরম্ভ হলো। তিরতির করে পেচা তুলোর মতো নরম তুষারও ইমানের গায়ে পাথর নিক্ষেপের ন্যায় ব্যথা দিচ্ছে৷ আসলে মনের বিষ সর্বাঙ্গে প্রবাহিত হচ্ছে। বহু দিন পর এতো খারাপ লাগছে তার। ঝাকে ঝাকে মন খারাপেরা উড়াল দিয়ে ঠিক বুকের মাঝে হামলে পরছে। এমন কষ্ট এর আগেও পেয়েছিল। বাবা যখন দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন৷ ওই সময়কার কষ্টের মতোই আজও সেইম ব্যথা হচ্ছে৷ যন্ত্রণা হচ্ছে। দু’বার ই তার অবচেতন মন বুঝে গেছে আপনজন হারানোর যন্ত্রণা। আচ্ছা, আপনজন হারিয়ে যায় কেন? নিজ দোষে? কিংবা নিয়তির সাপলুডু খেলায়? সে জ্বলজ্বল করে আস্তে আস্তে নিভতে থাকা ক্যান্ডেলটার দিকে তাকালো। বরফ পড়তে আরম্ভ করায় ক্যান্ডেলও বাতাসের তোড়ে নিভে গেল। মুহূর্তেই আঁধার ছেয়ে গেল। অট্টহাসিতে ফেটে পরা চাঁদটাও দূরে সরে গেল৷ ইমান আধো অন্ধকারেই কেকটা হাতে তুলে সজোরে মেঝেতে ফেলে দিল। এরপর পরপর দুবার বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয়৷ সে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতেই চোখে পরে নিচতলা থেকে অল্প বাতির আলো জ্বলছে। সম্ভবত হলরুমে বাতি জ্বালানো আছে। এতোরাতে কখনোই লাইট অন থাকার কথা নয়। সে হলরুমের দিকে আগালো। সেখানে পৌঁছাতেই দেখল, মিরা সোফায় চুপচাপ হেলান দিয়ে বসে আছে।
সে চোখ বন্ধ করে আরেকবার শ্বাস নিল। তৃষ্ণা পেয়েছে বেশ৷ পানি খেতে পারলে ভালো হত৷ সে বলে উঠে, ” রুমে আসো মিরা। কোন সিন ক্রিয়েট চাই না।”
মিরা তার দিকে ঘুরেও তাকালো না। বরঙ কানে হেডফোন গুঁজে মোবাইল চালানোতে ব্যস্ত হলো। ইমানের উপস্থিতি তার কাছে ঠুনকো হয়েছে যেন। কেন যে এই উপেক্ষা সে নিতে পারল না। ধুপধাপ করে শব্দ তুলে উপরে উঠে গেল৷ মিরা ভুলেও পেছনে তাকায় না। দোতলা থেকে বিকট শব্দ ভেসে আসে। কিছুক্ষণ পর ইমান নিচে নামল। এ্যাশ কালারের জ্যাকেট পরিধান করে। হাতে গাড়ির চাবি৷ মুখটা রাগে থমথমে হয়ে আছে৷ এই মুহূর্তে তাকে স্কুলের সবচেয়ে রাগী টিচার মনে করলে ভুল হবে অনেকের। মিরা তাকে একবার দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। কিন্তু মনে মনে বেশ চিন্তিত হলো সে। খচখচ করতে লাগলো। এমন ওয়েদারে ওর বাইরে যাওয়াটা শোভা দিচ্ছে না। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারছে না। দ্বিধার দেয়াল এসে তাদের দুজনের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে৷ ও বেরিয়ে যেতেই সে ফোন টেবিলের উপর রেখে দিল। মেইনগেট বেশ শব্দ করে লাগানোর ভয়ংকর শব্দে বুক কেঁপে উঠে। সেও দ্রুত মেইনডোরের সামনে এসে দাড়ালো। নিউইয়র্কের তাদের বাসাটার মেইনডোরের পাশেই ছোট সাইজের একটা জানালা। জানালার গ্রীলে ফেইরিলাইটস দেওয়া আছে৷ কখনো-সখনো বুঝি জ্বালানো হয়। শুধু তাই না, ফাঁকা জায়গায় টবে করে গাছ লাগানো আছে। টবের মধ্যে নুড়ি শ্বেত পাথর দেওয়া আছে। কাচের জানালার পর্দা সরাতেই নজর পড়ল এ্যাশ জ্যাকেট পরা লম্বা ছেলেটার উপর। গাড়ির কালো কভার সরাচ্ছে সে-ই সঙ্গে গাড়িতে লেগে থাকা স্নো সরিয়ে সে ড্রাইভিং সীটে বসে সাইসাই করে বেরিয়ে গেল। তিন সেকেন্ডের মধ্যে সে অদৃশ্য হয়ে যায়। গাড়ির স্পিড কী বেশি তুলেছে? এই রাত্রিটা মিরার আজীবন মনে থাকবে৷ স্মৃতির পাতায় স্মরণীয় এক রজনী। ধবধবে সাদা বরফের উপর জোছনার আলো ঝলমল করছে৷ জোৎস্নারা বুঝি খেলাধুলা করছে৷ ধূসর মেঘে আকাশ সামান্য ছেয়ে গেলেও, অন্য একপাশ মেঘহীন৷ মেঘহীন সেই আকাশে থালার মতো চাঁদটা মিটমিট করে জ্বলছে। দূর, বহু দূর থেকে নক্ষত্ররাজী তীক্ষ্ণ কিরণ বিলাচ্ছে মেদেনীতে৷ জোছনার আলোর তীব্রতায় সারা রাস্তা জুড়ে পরে থাকা বরফ জ্বলজ্বল করছে। এটা ভারী অদ্ভুত একটা দৃশ্য। গ্রামাঞ্চলে দিঘির জলে চাদের প্রতিচ্ছবি যেমন দেখায় ঠিক তেমন, তবে তফাত হলো সম্পূর্ণ রাস্তায় জ্বলছে, ঝলমল করছে। ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে মিরা বিড়বিড় করে বলে, ” রাগ কী শুধু আপনার হয়? আমার রাগ লাগে না? আমার অনুভূতির কোন মূল্য নাই আপনার কাছে? যখন মন চাইবে কাছে টানবেন, আবার ইচ্ছা হলেও দূরে সরে আসবেন। আমি তো ফেলনা না৷ আমাদের বাসররাতে আপনার দুর্ব্যবহার সহ্য না করে, আমিও রেগে বাসা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারতাম৷ দূরে সরে বা পালিয়ে যাওয়া সমাধান হলে,আজকে পৃথিবীতে কোন ঘর থাকত না।”
_____________________
মোবাইলের স্ক্রিনে দুর্দান্ত একটা রোমান্টিক সীন চলছে। জুইয়ের সবটা মনোযোগ সেই সিনের দিকে। রিসেন্ট রিলিজ হওয়া নেটফ্লিক্সের একটা সিরিজ দেখছে সে। তের তম এপিসোডে আছে। কাজের ফাকে অবসরে দেখতে বেশ লাগে। আজকে দশটায় বসেছিল ফোন নিয়স৷ একটানা পাঁচটা এপিসোড দেখল সে। এখন ঘড়ির কাটা দু’টো ছুঁইছুঁই। মোবাইলে ল্যারির কল আসায় সে বিরক্ত হলো। ল্যারির কাজ কি এখন? সে দু’ সপ্তাহ ধরে ক্লাবে যায় না। টাকাও সব পে করা আছে। তাহলে ফোন দিচ্ছে কেন?
ফোন রিসিভ করতেই ল্যারি বলে উঠে, ” ইমান এসেছে দেখলাম। তুমি ও কী এসেছো জুই?”
–” ক্লাবে?”
–” হ্যাঁ। এসেছো তুমি? ”
–” না। আমি বাসায়৷”
–” ইমান কিছুক্ষণ আগেই এসেছে৷”
জুইয়ের মন চাইলো বলতে ইমান এসেছে তো আমি কী করব? এরপর সে নিজেকে শুধালো। মিষ্টার খানের সবকিছুই তার জন্য বিশেষ এবং গুরুত্বপূর্ণ।
জুই বলে, ” কী করে ও?”
–” প্রচুর ড্রিং/ক করছে৷ ও তো এতো ড্রিং/ক করে না কোনদিন।”
–” মুডে আছে বস। ওর প্রোমোশন হলো না? এজন্য চিল করছে। লেট হিম ইনজয়৷”
–” ওকে।”
ল্যারি ফোন কেটে দিল। এরপর ক্লাবের ভেতরে ঢুকে ইমানের দিকে তাকালো। ওকে দেখে মোটেও মনে হচ্ছে না, ও হ্যাপি বা মজা করছে।বরং উদাস লাগছে। দুঃখী, ভারাক্রান্ত মনে হচ্ছে। বাঙ্গালী-ইন্ডিয়ানদের এই একটা দোষ। ওরা জানেই না জীবনটা কিভাবে উপভোগ করতে হয়। সারা জীবন খালি আক্ষেপ করা পাবলিক ওরা। বিরক্ত লাগে ল্যারির। আরে বাপ, এতো কষ্ট কিসের তোদের? মজা কর না ভাই! ওভার ইমোশনাল পিপল।
জুই ফোন রেখে ভাবল আরেকটা এপিসোড দেখবে৷ কিন্তু রাত বেশি হয়েছে৷ ইচ্ছেও করছে না। বরংচ ফোনের গ্যালারি ঘাটা যাক। সে নিজের সপ্তম তম জন্মদিনের ছবি দেখল। কী কিউট ছিল দেখতে! পাপা কতো ইয়ং আর হ্যান্ডসাম ছিল। আর এখন সব চুল পেকে যাচ্ছে। পাপা ওকে নিয়ে ডিজনিল্যান্ড ঘুরতে বেড়িয়েছিল সেইদিন৷ বাবা-মেয়ে অনেক মজা করেছিল সেদিন৷ এরপর তার স্কুল ইউনিফর্ম পরা ছবি স্ক্রিনে ভেসে উঠে। হাই স্কুলে উঠার সময়কার ছবি। স্কুলের লাইফের কথা সে কোনদিন ভুলবে না৷ এই সময়গুলো তার জীবনের গোল্ডেন ডেজ। স্কুল লাইফেই ইমানের সঙ্গে তার পরিচয়। প্রথম দেখা এবং প্রেমে পরে যাওয়ার দিনটা স্মৃতির মানসপটে ভেসে উঠে। সে হাইস্কুলে নিউ স্কলে টান্সফার হলো। এজন্য মন খারাপ থাকত বেশিরভাগ সময়। বন্ধুদের সঙ্গে আলাদা হওয়ার কষ্টে সে স্কুলে একা একা থাকত, ঘুরত। টিফিন পিরিয়ডে মুখ কালো করে বসে থাকত৷ একদিন সে কি ভেবে যেন ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে হাটা ধরে টিফিন ব্রেকে৷ হাটতে হাটতে প্লে গ্রাউন্ডে আসতেই অঘটন ঘটে গেল। কোথায় থেকে যেন একটা বাস্কেটবল তার গায়ে এসে ধাক্কা খেল। সে ভীষণ ব্যথাও পায়। মাঠে থাকা স্টুডেন্টরা হাসাহাসি শুরু করে দেয়। ভীষণ লজ্জা লাগে তার৷ মনে মনে বাস্কেটবল তার গায়ে মারা প্লেয়ারকে গালি দেয় খুব। সে সামনে থাকা দেখল, চারটে ছেলে তার দিকে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা ছেলেটা সিরিয়াস ভঙ্গি করে বলে, “সর্যি৷ আশা করি তোমার বেশি ব্যথা লাগেনি৷”
ওই এক পলের মধ্যে জুইয়ের যেন কী হলো। ওর কণ্ঠে নিশ্চয়ই ব্যথা কমানোর মেডিসিন ছিল। তার ব্যথা ঘায়েব হয়ে গেল।
ওর কথা শুনে বাকি তিনজন হেসে দিল। তাদের হাসতে দেখে জুই কেদে ফেলে৷
ছেলেটা আবারো বলে, “সিরিয়াসলি গার্ল! এই সিলি রিজনেও কাদতে হয়?”
এরপর সে বেজায় বিরক্ত হয়ে বল হাতে নিয়ে তিন কি চারবার হাত দিয়ে জমিনে টাচ্ করে আপ এন্ড ডাউন করালো। জুই তাকিয়ে থাকল৷ এরপর সে বল নিয়ে ছুট লাগায় মাঠের দিকে। সেদিন প্রথম দেখা এবং প্রেমে পরা৷ জুই অবশ্য তার জুনিয়র ছিল। ইমান চিনত ই না তাকে। দীর্ঘদিন লুকিয়ে লুকিয়ে এক তরফা ভালোবেসেছে সে মিষ্টার খানকে!
__________________
— খামোখা আমার ছেলেকে দোষ দিবেন না সুপ্তি আপা। আপনি খুব ভালো করেই জানেন আপনার মেয়ের চরিত্র কেমন?”
কথাগুলো অনিকের মা বিনু বলে উঠলেন। তিনি সাপের মতো ফেনা তুলে ফোস ফোস করছে রাগে। তার একমাত্র আদরের ছেলেকে ইরা আঘাত করেছে এটা মানতে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ছেলের দোষ বা অন্যায় বা অপরাধ কোনটাই তিনি চোখ খোলা অবস্থায় দেখতে পারছেন না৷ সুপ্তি বেগম সম্ভবত এমন কিছু শ্রবণ করার ধারণাও করেনি। তিনি মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে, ” আমার মেয়ের চরিত্র বলতে কী বুঝাতেন চাচ্ছেন ভাবী?”
বিনু ভাবী কঠিন স্বরে বলে, ” আপনার মেয়ে আমার ছেলের রুমে কী করছিল? খুব তো বলছো আমার ছেলের চরিত্র ভালো না। শুনেন আপা, আমার ছেলে কিন্তু আপনার মেয়ের রুমে যায়নি। আপনার মেয়ের প্রয়োজন তাই সে আমার ছেলের রুমে এসেছিল। ফাকা বাসায় ও কেন একটা পরপুরুষের ঘরে ঢুকবে? প্রশ্ন করেন আপনার মেয়েকে।এখন ঢং করছে। বে/হা/য়া মেয়ে৷ সারাদিন চ্যাট-চ্যাট করে কথা বলবে। আপনার মেয়ে তো ও-ড়-নাও ঠিক ভাবে নেয় না৷ আমার ছেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে৷ বড় বোন আমেরিকান ছেলেকে পটায় বিদেশ গেল এখন ছোটটা আমার ছেলেকে বশ করার চেষ্টায় আছে৷”
মামীর কথা শুনে ইরা হাউমাউ করে কেঁদে দিল৷ এই ছোট জীবনে এতো অপমান সে কোনদিন সহ্য করেনি। সুপ্তি বেগম অনুভূতিহীন দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকেন। এরপর ইরার হাত ধরে তাদের রুমে ফিরে আসলেন। দরজা লাগাতেই ইরার কান্নার বেগ বেড়ে যায়৷
সুপ্তি বেগম বলে, ” জীবনের পথচলা এতো কঠন হবে জানলে ওই বাসায় মাটি কামড়ে পরে থাকতাম। ইরা জিনিসপত্র গুছা৷ আমরা আর এক মুহূর্ত এবাসায় থাকব না৷”
__________________
সকাল সাতটার দিকে যখন হাসনাহেনা ঘুম থেকে উঠে নিজের রুম থেকে বের হলেন, উনি দেখলেন মিরা জেগে গেছে৷ হলরুমে বসে আছে৷ এ’কয়েকদিনে সে মিরাকে এতো আর্লি উঠতে দেখেনি। সে সামনে এগিয়ে এসে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “আজ এতো সকালে উঠলে যে?”
মিরা চকিতে উঠে আন্টির কণ্ঠ শুনে। সে রাত থেকেই এক জায়গায় বসে আছে। কিছুক্ষণ আগেই অহেতুক কেদেছে৷ আন্টি তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সে দ্রুত চোখ মুছে ফেলে তার দিকে তাকিয়ে বলে, ” ঘুম আসছিল না।”
–” ও।”
যথারীতি নতুন আরেকটা দিন শুরু হলো। আজকেও তুষারপাত হচ্ছে। তবে আগেরদিনের চেয়ে তুলনামূলক কম। নাস্তার টেবিলে সাদ বলে, ” আজকে ভাইয়ার সাকসেস পার্টি। বেস্ট এমপ্লয়ি এয়ার্ড পাবে। আমাদের সবাইকে ভাইয়া বিকেলের মধ্যে যেতে বলেছে। মম তুমি যাবে না?”
হাসনাহেনা ব্রেডে বাটার লাগাতে লাগাতে বলে, ” আজকে রাতে তোমার বাবা ফিরবে৷ আমি বরং থেকে যাই।”
মিরা সুযোগ বুঝে বলে, ” সাদ তুমি যাও৷ আমার শরীর ভালো না।”
হাসনাহেনা বলে, ” তোমরা না গেলে আবার ইমান রাগ করবে। মিরা তুমি সারাদিন রেস্ট নাও। বিকেলে কিছুক্ষণের জন্য যেও। তোমার জন্য আমি একটা গাউন বের করে দিচ্ছি৷ সেটা পরো। আমি আমি সাজিয়ে দিব। কত শখ ছিল একটা মেয়ে হবে আমার। ওকে নিজের হাতে সাজাব। তা আর হলো কই।”
ঘড়ির কাঁটা যখন বিকেল হাসনাহেনা জোর করে মিরাকে সাজাতে বসালো। মেকাপ করে দিল। চুল বেধে দিল। এরপর গোলাপি রঙের একটা গাউন হাতে ধরিয়ে দিল পরার জন্য। সাদ আর সে সন্ধ্যা ছয়টায় রওনা হলো৷ মিরার যাওয়ার একদম ইচ্ছা নাই। তাকে তো একবারও বলেও নি!যাইহোক, ক্যাবে করে তারা বিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যায়৷ খুব সুন্দর একটা বিল্ডিংয়ের এগারো তলায় পার্টিটা হচ্ছে। পার্টি সেন্টারে গিয়ে দেখা গেল অনেক গেস্ট চলে এসেছে৷ মিরার চোখ কেবল ইমানকে খুজছে। কালকে রাত থেকে ও বাসায় ফেরেনি। সারাটা দিন বাইরে ছিল৷ অবশেষে ইমানের দেখা মিলল। হুয়াইট শার্ট আর ব্লাক স্যুট পরা। হাতে দামী ঘড়ি। ব্লাক সু পরেছে৷ সাদের দিকে এগিয়ে এসে বলে, ” এতো দেরি হলো কেন?”
সাদ মিরার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। যার কারনে ইমান আর তার মধ্যকার দূরত্ব বলতে গেলে একহাতের কম। ওকে দেখেই বুক ছ্যাত করে উঠে মিরার। চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণা করেছে। পা কেমন টলছে ওর। কথা বলার সময় মুখ দিয়ে বা-জে গন্ধ আসছিল৷ মিরা সচকিত দৃষ্টিতে তার পানে তাকালো। ইমান তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পা বাড়ায়৷ মিরা দৌড়ে এসে তাকে জিজ্ঞেস করে, ” এতো ড্রিংক কেন করেছেন? ”
–” তাতে তোমার কী? হু আর ইউ? আমাকে প্রশ্ন করার কে তুমি? জাস্ট গেট লস্ট। এখানে কেন এসেছো? ”
চলছে।