#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২৩|
“ওখানে আমার একমাত্র আমানত তুমি। মেয়ে, নিজের প্রতি এত রাগ কীসের? তোমার না হলেও আমার একমাত্র আমানতের খেয়াল রেখো। যেভাবে রেখে এসেছিলাম, সেভাবেই আমার চাই। আর বেশি সময় না। একটু। একটু নিজের খেয়াল রেখো। তারপর তো তুমি আমারই। সম্পূর্ণরূপে, সমগ্র অধিকারে…”
অগণিত-বার চিরকুটটি পড়লাম। কতবার যে কাগজের পৃষ্ঠে অধর ছুঁইয়েছি, তার ইয়াত্তা নেই। আপি রাতের খাবার খাইয়েই কিছু মেডিসিন দিয়েছিল। হয়তো তারই প্রভাবে ঘুমেরা এই অশ্রুসজল নেত্রে বাসা বেঁধেছে, অনেক আগেই। তবুও জোরপূর্বক চোখ মেলে রেখেছি। এই চিরকুটটি যে আমায় পড়তে হবে আরও অনেকবার। স্পেসিফিকালি বলা যাবে না— ঠিক কতবার! কিছু জিনিস থাকুক না, অনির্দিষ্ট… অসঙ্গায়িত!
_________
পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সে খেয়াল আমার নেই। শেষবার ঘড়িতে দেখেছিলাম, তিনটে বিশ বাজে। সেই হিসেবে ঘুম ভাঙার কথা বেলা এগারোটার পর। কিন্তু না! তার বেশ আগেই, ফোনের কলিং টিউনে ঘুম আমার উবে গেল। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে ডান হাত দিয়ে ফোন খুঁজতে গেলেই ব্যথায় মৃদু চিৎকার করে উঠলাম। ভুলেই গেছিলাম এর কথা। গোপনে নিজেকে শাসাতে লাগলাম। কার হতে গোপন করতে— তা জানা নেই।
ওদিকে মুঠোফোনটা বাঁজখাঁই আওয়াজে ননস্টপ বেজে চলেছে। থামার কোনো নামগন্ধও নেই। ইচ্ছে করছে, ফোনের ভেতরে ঢুকে ওপাশের ব্যক্তিটির গলা চেপে দেয়ালে ঠেসে ধরে আলে-গালে চার-পাঁচটা চড়-থাপ্পড় বসিয়ে সিংহী আওয়াজে বড্ড বিনম্র ভঙ্গিতে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে, “ওহে ভদ্রলোক/ভদ্রমহিলা! আপনাকে যদি আদা-জিরার সাথে ব্লেন্ড করি, আপনি কি কিছু মনে করবেন? কিছু মনে করবেন না, প্লিজ! আমি আপনার পেস্ট তরকারিতে দিয়ে সুস্বাদু করে রান্না করে বড্ড আয়েশের সাথে চিবাব। আপনাকে ভোজ করতে পেরে আমি হব আনন্দিত অ্যান্ড দ্যি গ্রেট নবুর ভোজন হতে পেরে ইউ শ্যুড বি গর্বিত, ভদ্রলোক/ভদ্রমহিলা। নিন, আরেক থাপ্পড়।”
উফফ! এখনও বেজেই চলেছে। বিরক্তিকর ভঙ্গিমায় বাঁ হাতটি বিছানায় হাতড়িয়ে ফোনটা পেলাম। কলার আইডি চেক না করেই কল রিসিভ করলাম। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললাম, “হ্যালো! পাবনা থেকে বলছি, স্যার, শুধু আপনার জন্য না কি আপনার হোল ফ্যামিলির জন্য সিটের বুকিং দিতে হবে? স্যার, কাইন্ডলি জানাবেন— আপনার ফ্যামিলি মেম্বার্স ক’জন। ধন্যবাদ।”
প্রতিটি শব্দের মাঝে আমার কঠোর বিরক্তিভাব প্রকাশ পেয়েছে। ওপাশ থেকে সেকেন্ড পাঁচেকের নিরবতার পরপর চাপা হাসির শব্দ ভেসে এলো। যা শুনতেই আমার সর্বাঙ্গ বয়ে কিছু একটা উঠল। পুরোপুরি ভাবে ঘুম আমার চোখ থেকে নিমিষেই কোথাও একটা উধাও হয়ে গেল। শরীরের প্রতিটি লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল। চোখ দু’টো কাঁটাকাঁটা লাগছে, কেমন যেন জ্বলছে। ঠোঁট দু’টো সামান্য প্রসারিত হয়েছে। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলাম, “কুঞ্জ ভাই!”
ওপাশের হাসির শব্দ থেমে গেল। কেউ কোনো কথা বলছি না। কথা খুঁজে পাচ্ছি না। ভাবলাম— হয়তো আর কথাই হবে না। বরাবরের মতোই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন কাটার জন্য উদ্যত হলাম।
কিন্তু, নাহ! উনি কথা বললেন, “কেমন আছ?”
আমি ফোনটা স্পিকারে দিয়ে রেখেছিলাম আগেই। আমি সবসময় ইয়ারফোন নিয়ে কিংবা স্পিকারে দিয়ে কথা বলি। ফোন কানে নিয়ে কথা বলার অভ্যেস আমার নেই। তাই স্পিকারে রাখা ছিল। ওপাশের কথা শুনতেই আমি হাত থেকে ফোনটা খানিকটা দূরে বিছানার উপর রেখে দু’হাতে মুখ চেপে ডুকরে উঠলাম, যাতে কান্নার আওয়াজ উনি না শুনতে পারেন। এত এত অশান্তির মাঝে রেখে আবার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে— কেমন আছ! উনি কি জানেন না নাকি– তাঁকে ছাড়া আমি কেমন থাকতে পারি? জানেন না? আমি প্রাণপণে চেষ্টা করছি, এই ব্যথা ওঁকে না দেখানোর।
নিজেকে খানিকটা সামলে নিতেই ওপাশ থেকে কুঞ্জ ভাই আবারও বলে উঠলেন, “কাঁদবে না, নবনী।”
আমি নাক টানতে টানতে বললাম, “হুহ! মোটেও না। কে কাঁদছে, হ্যাঁ?”
“ব্যথা করছে?”
“কীসের ব্যথা? কোনো ব্যথা নেই। দিব্যি আছি।”
“হুম, বুঝলাম।”
“কী?”
“শরীরের ব্যথার চেয়ে মনের অভিমানটা তীব্র।”
“ছাই বুঝেছেন।”
“তোমাকে বুঝেছি।”
“হাসালেন।”
“তাচ্ছিল্যের?”
“আদৌ বুঝেছেন?”
“তোমার আগা-গোড়া আমি মুখস্ত করে নিয়েছিলাম।”
“তাই তো ভুলে গেছেন। বুঝে নিতেন আমাকে, আজন্ম আমি আপনার হয়ে থাকতাম।”
“এখন বুঝি অন্য কারো?”
“এক পুরুষের প্রেমে কাতর রমনী অন্যত্র সুখ পায় না।”
“সেই পুরুষের কাছে আরও বেশি অসুখী সে, যুগে যুগে।”
“প্রিয় পুরুষটির দেওয়া অসুখও হাজার সুখের চেয়ে দামি।”
“যদি সে সাক্ষাৎ মরণঘাতি কোনো অসুখ হয়?”
“আমি মরতে রাজি সহস্রবার।”
“জেনেশুনে?”
হাসলাম আমি। কিছুটা সুর করেই বলে উঠলাম, “জানিয়া-শুনিয়া আমি বিষ করিয়াছি পান। বিষের তরে শপিয়াছি প্রাণ।”
“সবটা জানো না তুমি।”
“জানি না?”
“উঁহু।”
“বেশ। তবে আরও ভালো।”
“ভালো?”
“হু…”
“কী করে?”
“তাঁকে জানার ইচ্ছে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আকর্ষণও প্রত্যহ বেড়ে চলবে। সেই সাথে বাড়বে জিবনভর একসঙ্গে কাটানোর ইচ্ছে। আর, জিবনের শেষদিনে গিয়েও দেখব— আগ্রহ কমেনি। বুঝলেন?”
“হুম… বুঝলাম।”
“কচু বুঝেছেন।”
“একবার ছাই, একবার কচু। তুমিবাদে কি আমি পুরো দুনিয়ার বাকি সব কিছু বুঝে ফেলেছি?”
খিলখিল করে হেসে বললাম, “তবে তাদের সাথেই সংসার পাতুন।”
“তারা অভিমান করতে জানে না যে!”
“এটা তো সুবিধা।”
“তবে কার অভিমানী দৃষ্টিতে আমার বক্ষ কম্পিত হবে? কার জন্য ভোরবেলা শহর খুঁজে বেলি ফুলের মালা খুঁজব? সবাইকে ফাঁকি দিয়ে কার বাসার ছাদে উঠব? কাকে খুশি করার জন্য, ছাদ থেকে তার ব্যালকনিতে ফুলের মালার ছোড়াছুড়ি করব?”
“মানে?”
“অভিমানীনির অভিমান আমার বড্ড প্রিয়, সাথে স্বয়ং অভিমানীনিও। বারান্দায় গিয়ে দেখো, দুটো মালা আছে। তিনটে কিনেছিলাম। কিন্তু… যাই হোক।”
হঠাৎ কী যেন হলো, আমি কাঁপতে লাগলাম। ভেজা সুরে শুধালাম, “আ.. আপনি এসেছিলেন?”
মুহূর্তেই ওপাশ থেকে হট্টগোলের আওয়াজ এলো। উনি ফোন কেটে দিলেন। ফোনটার দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। খুব ইচ্ছে করছে, তাঁকে একটুখানি জড়িয়ে ধরতে।
তখনই ফোনে একটা ম্যাসেজ এলো। চোখের পানি মুছে ফোনটা হাতে তুলে নিলাম। সেখানে লেখা,
“আমাকে যে আসতেই হতো। সে যে জেনেশুনে বিষ পান করেছে। মরণযন্ত্রণা ভোগ করবে না?”
___________
ঘড়িতে বাজে সকাল ৮টা। কুঞ্জ ভাই ফোন করেছিলেন ৭টায়। ফোন রাখার ২০ মিনিট পর উঠে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছি। পরনের পোশাকও পরিবর্তন করে নিয়েছি। রুম থেকে বেরোতেই ডাইনিংয়ে আব্বুকে দেখে এগিয়ে গেলাম। আম্মু খাবার বেড়ে দিচ্ছে। আমাকে দেখেই আব্বু বলে উঠলেন, “এই যে! শুভ সকাল, মা।”
আমি মুচকি হেসে বললাম, “শুভ সকাল, আব্বু। শুভ সকাল, আম্মু।”
আব্বু ভ্রু-কুঁচকে বললেন, “এত আগে তৈরি হয়েছেন যে! কোথায় যাবেন? কোচিং তো ১০টা থেকে।”
“আসলে একেবারেই রেডি হয়ে নিলাম। খেয়ে মামার বাসায় যাব। এরপর কোচিং।”
“ওহ্! আচ্ছা। বসুন পাশে।”
আমাকে এটুকু বলেই আম্মুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মেয়েকে পরোটা দাও তো।”
আম্মু পরোটা দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, “রজনী কই? এখনও ওঠেনি?”
আমি রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে বললাম, “না মনে হয়।”
“আচ্ছা, খেতে থাকো। আমি ডেকে আনছি।”
আম্মু যেতেই আব্বু বলে উঠলেন, “মন খারাপ আমার মায়ের?”
আমি জোরপূর্বক হেসে বলে উঠলাম, “না-না! বেশ আছি। পড়ালেখার একটু প্রেশ্যার, এই যা!”
আব্বু সামান্য হাসলেন। বললেন, “আমাকে মিথ্যা বলার চেষ্টা করছেন?”
আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। আব্বু আবারও কিছুটা হাসলেন। এই হাসতে হাসতেই চমৎকার এক উপদেশ দিয়ে ফেললেন। আমি অবাক হয়ে আব্বুর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
কানে শুধু আব্বুর কথাটিই বেজে চলেছে, “প্রতিটি মানুষের জিবনে প্রবলেম’স আসে। কেউ কেউ তা সইতে পারে না, ডিপ্রেশনে চলে যায়। কিন্তু, মা! আমি আপনাকে খুব স্ট্রং করে মানুষ করেছি। আপনাকে বিপদের মোকাবিলা করতে শিখিয়েছি। সমস্যাগুলোকে ফেইস করতে হবে। বুঝলেন? ইউ হ্যাভ টু ফেইস ইট।”
আব্বুর কথাটি আমি বুঝলাম কি না জানি না। তবে এটুকু বুঝেছি যে, আই হ্যাভ টু ফেইস হিম। উনি আমার কাছে না-ই বা আসলেন। আমি তো যেতেই পারি!
________
বাসা থেকে বেরিয়েছি। ব্যাগ থেকে বেলিফুলের মালা দুটো বের করে বা হাতে জড়িয়ে নিলাম। ওঁর সাথে সকালে কথা শেষে ছুটে ব্যালকনিতে গেছিলাম। গ্রিলে একটা মালা, আরেকটা ফ্লোরে পড়ে ছিল। দুটো বুকে চেপে যে কতক্ষণ বসে ছিলাম! খুব, খু-ব অনুভব করছিলাম ওঁকে।
এগারো নম্বর রোডটির এপাশে মানুষের আনাগোনা বড্ড কম। এর ডান দিকে মামার বাসা। আমি বাঁ দিকে গেলাম। তিন কদম এগোতেই সামনে একটা বেলি ফুলের মালা ধুলোমাখা রাস্তার কিনারায় পড়ে থাকতে দেখলাম। সামান্য হেসে এটাও তুলে ব্যাগে পুরে নিলাম। এটা ঠিক আমার ব্যালকনির নিচ বরাবর রাস্তা। যৌক্তিক হিসেবে, যখন কুঞ্জ ভাই ছাদ থেকে আমার ব্যালকনিতে ফুলের মালা ছুড়ছিলেন, এটা বাতাসের ভূমিকায় অন্যদিকে পড়ে গেছিল।
হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা এগিয়েই বাসে উঠে পড়লাম আমি। গন্তব্য হচ্ছে আমার মি.প্রবলেম…
চলবে…
#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২৪|
দীর্ঘ সময় ধরে বাসে বসে আছি। ব্যস্ত শহরটা আজ বোধহয় একটু বেশিই ব্যস্ত। তাই তো বাস পিপীলিকার চেয়েও স্বল্পগতিতে চলছে। মাঝামাঝির দিকের একটা সিটে বসে আছি। মাথাটা জানালায় ঠেকিয়ে দিতেই মস্তিষ্কে পুরোনো কাহিনির বিচরণ শুরু হলো।
ঘটনা খুব আগের না। এই তো! আমি সে বছরের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী আর কুঞ্জ ভাই দ্বাদশের ছাত্র। বয়সের দিক থেকে দু’জনেই তখন ইমম্যাচিউরিটিতে পিএইচডি করে ফেলেছিলাম। কথায় কথায় মণির কাছে ওঁর নামে অভিযোগের ঝুলি খোলা ছিল নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। ওদিকে কুঞ্জ ভাইয়েরও যেন এতে কিছুই হতো না। আমি মণির কাছে নালিশের ফাঁকফোকর দিয়ে যখন কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকাতাম, তখন তাঁর স্থির-নির্বিকার সেই দৃষ্টি আমার বুকের ঠিক এই বাঁ পাশটায় আঘাত হানত। বোঝাতে পারব না সেই অনুভূতির প্রখরতা।
রাহীর সাথেও তখন আমার তেমন একটা কথা হতো না। একই স্কুল, একই কোচিং, তার উপর মামাতো বোন! তবুও কোনো সখ্য ছিল না। রাহী বরাবরই একটু চুপচাপ প্রকৃতির মেয়ে ছিল, এখনও আছে। তবে আমি আগে অন্যরকম ছিলাম। একটু বেশিই একগুঁয়ে। কেউ নিজ থেকে এগিয়ে আমার সাথে কথা বলতে আসার আগ অবধি আমার মুখ থেকে টু শব্দটি বের করতে পারত না।
কুঞ্জ ভাই ছোটো থেকেই আমাকে পড়াতেন, এদিকে মণি আর মামাও আমাকে ঠিক নিজেদের সন্তানদের মতোই আদর করতেন। তাই তাদের সাথে ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে লাগল নিবিড় সম্পর্ক।
আমার মতো কুঞ্জ ভাইও তখন অন্যরকম ছিলেন। একদম অ-ন্য-র-ক-ম। কখনও আমাকে বকতেন না, কখনই ধমক দিতেন না। একটু রাগী ছিলেন, তবে তা প্রকাশ করতেন না। সবসময় শান্ত থাকতেন। কখনও বিচলিত হতেন না। তাঁর নির্বিকার চাহনি ছিল খুব তীক্ষ্ণ, অসম্ভব রকমের ধারালো। কথা কম বলতেন। খু-ব মেপে মেপে। তবে তা ছিল বেশ গোছানো, পরিপাটি। তাঁর ব্যাক্তিত্ব আমাকে কেমন করে যেন টানত! বলাবাহুল্য, তাঁর অনমনীয় পৌরুষের কাঠিন্যতায়-ই হয়তো আমার মরণ ঘনিয়েছিল!
এমনও হয়েছে, উনি আমাকে লিখতে দিয়ে বসে থাকতেন। লিখতে গিয়ে আমার হাত খুব কাঁপত। কেননা আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তখন অনুভব করত, ওঁর তীর্যক দৃষ্টি যে আমাতেই সীমাবদ্ধ।
বুঝতে পারতাম— আমাকে পড়া-লেখায় ব্যস্ত রাখাটা নিছক এক বাহানা, উনি ভীষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন আমায়; যেন আমি ওঁর এইচএসসি সিলেবাস আর উনি সেই বোর্ড র্যাঙ্ক করা স্টুডেন্ট!
আমি তখন মোটেও তাড়াহুড়ো করতাম না। এক ঘণ্টার জায়গায় দু’ঘণ্টা ধরে লিখতাম। আনমনেই আমাকে তৃপ্তি নিয়ে দেখার সময়সীমা ওঁর জন্য আরও বাড়িয়ে দিতাম।
উনি শত ব্যস্ততার মাঝেও আমাকে পড়াতে আসতে মিস দিতেন না। রোজ ৩ টায় কলেজ শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে আমাকে পড়াতে আসতেন। আম্মু অবশ্য বলত, এত কষ্টের প্রয়োজন নেই; অন্য টিচার খুঁজে নেবে।
উনি তখন শক্ত কণ্ঠে বলতেন, “আমি আছি। সমস্যা হচ্ছে না আমার।”
ব্যাস! আম্মু এর বিপরীতে কোনো কথা বলার আর সুযোগ পেত না। যখন কলেজের কোনো কাজে আটকে পড়েন, কিংবা খুব বেশিই ব্যস্ততায় জেঁকে বসেন; তখন আম্মুর ফোনে কল দিয়ে আমাকে শুধাতেন, “নবু, শুনছিস?”
বরাবরই বিছানায় কিংবা চেয়ারে পা দুলাতে দুলাতে ছোট্ট করে জবাব নিতাম, “হুঁ?”
তখন রোজকার মতোই ওঁর মুখস্ত প্রত্যুত্তর ছিল, “তোর কুঞ্জ ভাই আজ খুব খু-ব বেশিই বিজি। কাল এক্সট্রা সময় নিয়ে আসব। এখন আলমারিতে দ্যাখ, নতুন শাড়ি রেখেছি। তুই কি একটু সাজবি? এরপর না-হয় পিকগুলো হোয়াটসঅ্যাপ করে দিস। ঠিক আছে?”
কথাটি বলায় আমি অবাক হতাম না। মাঝে মাঝেই আলমারির সাইডের ড্রয়ারটিতে শাড়ি পেতাম। আমি জানতাম, এগুলো কার কীর্তি। দেখে সামান্য হেসে জায়গা মতোই থাকতে দিতাম। এরপর কুঞ্জ ভাই যখন এভাবে, এতটা আবদারের সুরে সেগুলো পরতে বলতেন, আমি তখন খুব যত্ন করে সাজতাম। আমি সেজে অনেকগুলো ছবি তুলতাম। ভালো-খারাপ সবটাই ওঁকে দিতাম।
উনি অনলাইন হয়েই আমার ইনবক্সে আসতেন। এরপর সেগুলোর সাথে কী করতেন, আমি জানতাম। কীভাবে জানতাম— এটা জানা নেই। শুধু জানতাম —উনি ছবিগুলো সেইভ করবেন এবং বাকিটা বিনিদ্র রাত মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে যাবেন।
আমি এসবের চাক্ষুস সাক্ষী নই, তবুও অকপটে বলতে পারি— উনি তাই করতেন। তবে, তবে, তবে! কখনও প্রকাশ করেননি উনি। অপ্রকাশিত অনুভূতিগুলো চমৎকার হয়, তাই-না?
কিন্তু! সেদিন উনি আসেননি। একা বাসায় অপেক্ষা করেছি সন্ধ্যে অবধি। অথচ, অপেক্ষাকৃত সুখ আমার এলেনই না! সেদিন উনি কল দিয়ে বলেননি, “নবু, তোর কুঞ্জ ভাই আজ খুব বিজি। তুই কি একটু সাজবি?”
কিচ্ছু বলেননি। সেদিন প্রথমবারের মতো নিজে থেকে শাড়ি পরেছি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম, চোখের কাজল চিন্তায়-ঘামে লেপ্টে গেছে। বিনুনি গাঁথা চুলগুচ্ছ সামনে থেকে দু’গাছি বেড়িয়ে গেছে। এভাবে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। প্রথমবার কিশোরী নবনীতাকে এই রূপে আবিষ্কার করেছি আমি। খারাপ নয়, কেমন যেন বড়ো বড়ো লাগছে।
আপিকে না বলেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেছি। আম্মু বাসায় নেই, জানি না— কোথায়। ডানে-বামে না তাকিয়ে সোজা মামার বাসায় চলে এসেছি। বেশ কয়েকবার থেমে থেমে কলিং বেল বাজানোর পর রাহী দরজা খুলে দিয়েছিল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রাহীর ফরসা লালচে মুখখানা দেখতে পেলাম। থেকে থেকে ফোঁপাচ্ছিল ও। ওর এই অবস্থা দেখে অজানা এক ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠল। আমি দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করে ওকে শুধালাম, “কী হয়েছে, রাহী? কাঁদছ কেন?”
রাহীর ফোঁপানো এবার সত্যি সত্যিই কান্নায় পরিণত হলো। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, “জানো? ভাইয়া খুব সিক। আমি ওকে কখনও এভাবে দেখিনি। কেমন করে মাকে জড়িয়ে ধরে ছিল ও! আমার.. আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ওর জন্য।”
আমি কী বলব— বুঝতে পারছিলাম না। রাহীর সাথে আমার আবেগ বিনিময়ের সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু মানবতার খাতিরে হলেও তখন আমার কিছু একটা বলা খুব প্রয়োজন ছিল। হয়তো অসুস্থতার খবর অন্য কারো হলে আমি ওর কাঁধে হাত রেখে কিংবা দু’হাতের বেষ্টনীতে ওর মুখটি তুলে ধরে বলতাম, “ইশশ্, পাগলী মেয়ে! কেঁদে কেঁদে এত সুন্দর মুখখানির কী হাল করেছ! চিন্তা কীসের, হুঁ? আমরা দু’জন আছি না? জাদু করে তোমার ভাইটার সব অসুখ দূ-র করে দেব। তুমি একদম কাঁদবে না। কাঁদলে তোমায় কষ্টের দেবী লাগে। তুমি হাসবে। খুব হাসবে। চলো, অসুস্থতাকে বিদায় জানাব, এক্ষুনি। আমার রাহী হাসবে কি এবার?”
কিন্তু এসব কথা বলা হলো না। আমার মন তখন বিষাদে ডুবে গেছে। রাহীর কথাগুলোকে একপ্রকার উপেক্ষাই করলাম, তবে এই মেয়েটিকে করতে পারলাম না। ভরসার হাতটি দিয়ে শক্ত করে ওর হাতটি চেপে ধরে সামনে এগোলাম। সেই হাত কি মেয়েটি ছাড়তে পেরেছিল?
কুঞ্জ ভাইয়ের রুমের সামনে এসে দেখি, মণি ওঁর হাত ধরে মাথা নিচু করে কাঁদছে। আম্মু স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছে আর উনি বিছানায় হেলান দিয়ে খেয়ে যাচ্ছেন। রক্তিম চোখ দুটো দেখেই বোঝা যাচ্ছে, জ্বর ১০২° এর উপরেই হবে। মুখটি কেমন শুকনো দেখাচ্ছে! এক দিনের জ্বরেই কী অবস্থা!
কুঞ্জ ভাই হয়তো কিছুক্ষণ আগের বলা কোনো কথার পরিপ্রেক্ষিতেই বলে উঠলেন, “এখন ঠিক আছি আমি। তোমরা শুধু শুধু চিন্তা করছ! মা, কান্না থামাও না রে! ভালো লাগে না তোমার কান্না।”
মণি কান্না থামানোর অযথা চেষ্টা করছে। আম্মু রাগী স্বরে বলল, “এভাবে জ্বর বাঁধিয়ে বলছ, চিন্তা না করতে? সুস্থ হয়ে নাও, আমাদের হাতে মার পাওনা রইলে।”
এরই মাঝে মণি আমাকে দেখে ফেলল। ততক্ষণে মণির ফোঁপানোও প্রায় বন্ধ হয়েছে। আমাকে দেখে মলিন হেসে বলল, “কী রে! নবু, এসেছিস?”
আমি কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, “হুঁ।”
সেদিকে তাকিয়েই রাহীর হাত ধরে ভেতরে প্রবেশ করলাম। কুঞ্জ ভাই তাঁর আধখোলা গাঢ় বাদামি চোখের ঘোলাটে দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। অসুস্থ কুঞ্জ ভাইটা যেন আফিমের চেয়েও নেশালো এক নেশাদ্রব্য। আমি দৃষ্টি মেলাতে পারলাম না। লোকটার এই অবস্থা! অথচ কেউ আমাকে জানায়নি! জানাবেই বা কেন? কে আমি? কারোও কেউ না।
তীব্র অভিমানি দৃষ্টি মণির দিকে নিবদ্ধ করে শুধালাম, “তা তোমার গুণধর ছেলের এ-দশা হলো কী করে?”
আম্মু সঙ্গে সঙ্গে ধমক দিয়ে উঠলেন, “আহ, নবনী! হচ্ছেটা কী? বড়োদের সাথে এভাবে কথা বলতে হয়? আর এই সন্ধ্যায় এখানে একা এলে কেন? বারণ করেছি না, সন্ধ্যার পর রাস্তায় একাকী চলতে?”
আমি গাল ফোলালাম। মণি আমাকে এভাবে দেখে হেসে ফেলল। এতক্ষণে নালিশ করার উপযুক্ত কাউকে পেয়ে গেল। অভিযোগের সুরে বলে উঠল, “আর বলিস না! রাতে বৃষ্টিতে ভিজেছিল। এর আবার বৃষ্টি সয় না। কয় ঘণ্টা ভিজে এরকম জ্বর বাঁধিয়েছে, এই গাঁধাটা বলছেই না। কখন ভিজল… জ্বর বাঁধাল— কিচ্ছুটি জানি না। সকালে কলেজের জন্য না উঠায়, এসে দেখি বিছানা নিয়েছে এটা। তারপর গা কাঁপিয়ে জ্বর বাড়ল। সন্ধ্যার পরপর নেমেছে।”
প্রথমবারের মতো আমি অগ্নি ঝরানো চোখে কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। গতরাতে বৃষ্টি হয়েছিল। ১১টা থেকে ভোর ৬টা অবধি। আমি শুরুর দিকে ছাদে ভিজেছিলাম। এরপর ধোঁয়া ওঠানো কফি নিয়ে ভোর অবধি বৃষ্টি বিলাসে মত্ত ছিলাম। নিকষ কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে হঠাৎ বজ্রপাত হওয়ায় আলোর একছটা গিয়ে পড়ে পাশের রাস্তাটিতে। সেই আলোতে ভিজে জুবুথুবু হয়ে একদৃষ্টিতে আমার ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে থাকা ব্যক্তিকে এক ঝলক দেখে কুঞ্জ ভাই ভেবে বসাটা তবে নিছকই আমার মনের ভুল ছিল না!
চলবে…