সুখের প্রেমাসুখ পর্ব-০১

0
567

#সুখের_প্রেমাসুখ(০১)
#ওয়াসেনাত_আরাবী

আজ মাহার বিয়ে। পাত্র অপরিচিত কেউ নয়। তারই খালাতো ভাই মাশহুদ তার পাত্র। পাত্র বললে ভুল হবে। কারন মিনিট দশেক আগে সে ভাই থেকে পাত্র এবং পাত্রের পাঠ চুকিয়ে স্বামী নামক সম্পর্কে পদার্পণ করেছে। বাড়ির সবাই আনন্দিত, প্রসন্ন। শুধু স্বামী-স্ত্রী দুজন বাদে। ছোট থেকে তারা একে অপরকে ভাইবোন বলে ভেবে এসেছে। একে অপরকে এই পরিচয়ে স্নেহ এবং সম্মান করেছে। হঠাৎ করে কয়েকদিনের রদবদল তাদের সম্পর্কে দোটানা ঠিকই সৃষ্টি করেছে তবে সেটা একেবারে অস্বাভাবিকভাবে নয়। তাদের আম্মাজানদের ইচ্ছে ছিল দুবোন থেকে বেয়াইন হওয়ার। যে কথা সবাই জানতো। কিন্তু প্রথমদিকে কেউ এ ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নেয়নি। নেহাতই একটা মশকরা ভেবেছিল। নয়তো মাহা পেটে আসামাত্রই মাশহুদের মা, মাহার মায়ের কাছে তার ছোট মেয়েকে বউমা করার প্রস্তাব দেন?

জন্মের পূর্বে ঠিক করে রাখা এই বিয়েটাকে মাহা গুরুত্ব দেয়নি। মাহার মনে হলো, প্রথম থেকেই বিয়েটার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা উচিত ছিল। তাহলে কোনো না কোনো ফন্দিফিকির খাটিয়ে ভাইকে জামাই বানানো থেকে বিরত থাকা যেত। মাহা যতটুকু জানে মাশহুদেরও একই মনোভাব তার প্রতি। মাশহুদ তাকে শুধু বোনই ভাবতো। এজন্যই তো যখন তার একটি মেয়েকে পছন্দ হয়, তখন সে মাহাকে নিয়েই তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। মাহার ভাবি পছন্দ করা নিয়ে মাশহুদ বেশ নিশ্চিন্ত ছিল। কারন মাহার পছন্দের ওপর ও চোখ বুজে বিশ্বাস করতে পারে। সেই বোন মাহাকে, বউ হিসেবে মানতে কষ্ট হবে বৈকি!

মাহা এবং মাশহুদের এই বিয়েতে যেমন অনিহা ছিল। তেমনই তাদের দুজনেরই স্বভাব বাধ্যতা। বাবা মায়ের কথার ওপর আজ অবধি তারা কখনও কথা বলেনি। যা’ই হয়ে যাক না কেন বাবা-মায়ের আগে কোনোকিছু নয়। সর্বদা জীবনের সর্বপ্রথম প্রায়োরিটি মা এবং বাবা। শুধু ওদের নয়। ওদের বাকি ভাইবোন এবং মামাতো ভাইবোনদেরও একই অবস্থা। একই শিক্ষায় শিক্ষিত সবাই। তাই নিজেদের পছন্দকে দূরে রেখে তারা হাসি মুখে বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েছে। তারা যদি বিয়েতে খুশি হয় তাহলে সেটাই আদেশ মাশহুদদের জন্য।

মাহার কোনো পিছুটান ছিল না। তবে মাশহুদের পছন্দের মেয়ে প্রেমা,তাকে নিয়ে মাশহুদ বেশ সিরিয়াস ছিল। মাহা জানতো সব। ভাইয়ের ভালোবাসা যাতে না হারায় তাই বিয়েটা ভাঙার দায়িত্বও নিতে চেয়েছিলো। এতে সবাই মাহাকে ভুল বুঝতো বলে মাশহুদ মাহার ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে নিজে শুদ্ধপুরুষ সাজতে চায়নি।

মাহাকে বাসরঘরে বসিয়ে দিয়ে গেল তার বড়বোন রাহা। মাশহুদেরও বড় রাহা। বিবাহিত। যমজ পুত্রসন্তানের জননী। মাহাকে বিয়ের রাতের সকল বিষয় রাহা বুঝিয়ে দিয়ে গেল। মাহা গোপন এবং নতুন তথ্যগুলো জেনে লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। মাহা বরাবরই শান্ত স্বভাবের। পড়াশোনায় মনোযোগী। তাই প্রেম জিনিসটা তার নিজের পক্ষে করে ওঠা হয়নি। চারপাশে বন্ধুদের প্রত্যক্ষ প্রেম যতটা চোখে পড়েছে ততটুকুই তার প্রেমের জ্ঞান।

রাত গভীর হয়। সাড়ে দশটা বাজে। ঘড়ির কাটার টিক টিক আওয়াজের সঙ্গে আরও একটি আওয়াজ মাহা স্পষ্ট টের পায়। সেটা হচ্ছে, হৃদস্পন্দনের লাব-ডাবের আওয়াজ। হাত ঘামছে, কপাল ঘামছে। পা ঝিমঝিম করছে একটানা আধঘন্টা একইভাবে বসে থাকার জন্য। মাহা ঘোমটা মাথার ওপর তুলে দরজার পানে তাকায়। বাইরে মাশহুদ ভাইয়ের গলা শোনা যাচ্ছে। কথা কাটাকাটি হচ্ছে। মাহা টের পেল বাকি ভাইবোনরা বাসর সাজিয়েছে বলে টাকা চাচ্ছে। মাহা দ্রুত ঘোমটা টেনে দিল। মাশহুদ ভাই এলো আরও পনেরো মিনিট পরে। ঘরের দরজা লাগিয়ে মাশহুদ বলল,

“তোর ওযু আছে? না থাকলে করে আয়। নামাজ পড়ে তারপর কথা বলবো।”

“ওযু আছে।”

দুজনে সালাত আদায় করে বিছানায় বসে। মাশহুদের চোখ ফোনে। কিছু একটা দেখছে সে। মাহা মাথায় পিন দিয়ে গুজে রাখা ওরনা খোলার চেষ্টা করছে। মাশহুদ সেটা লক্ষ করে বলল,

“দাড়া আমি খুলে দিচ্ছি।”

মাশহুদ এগিয়ে আসতেই মাহা ভয়ে, আতঙ্কে পিঁছিয়ে গেল। রাহা বলেছে মাশহুদ যা বলবে তাতে সায় দিতে। এটা দাদি এবং নানির তরফ থেকে আদেশ। কিন্তু মাহা জড়তার পাশাপাশি একটা অস্বস্তিভাব অনুভব করছে। সারাজীবন ভাই বলে জানা মানুষটা, যার স্পর্শ সর্বদা ভাইয়ের স্নেহ হিসেবে নিয়েছে তার স্বামীরূপের স্পর্শ হঠাৎ নিতে পারছে না। কেমন অদ্ভুত লাগছে।

লোকে বলে বিয়ে হলেই আলাদা টান তৈরি হয়ে যায়। মাহারও হয়েছে। সম্মান বেড়েছে, আনুগত্য বেড়েছে। কিন্তু এই মাশহুদ ভাইয়ের এত স্বাভাবিক আচরণ মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যেখানে সে জানে মাশহুদ ভাই একটি মেয়েকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। হোক সেটা একতরফা তবুও তো বাসতেন। সাতদিনের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। হয়তো কন্টিনিউ করতে পারেনি বাকি দিনগুলো। কিন্তু তার মনে অন্যনারী ছিল। মাহার মনে এই স্মৃতিটা দাগ ফেলে দিয়েছে। হঠাৎ চাপা অভিমান মনে বসে গেল। মাহা ভাবছে সে তো কখনও কাউকে মন দেয়নি। তাহলে তার সঙ্গে এমন মানুষের বিয়ে কেন হলো যার জীবনে বিশেষ একজন নারী ছিল যাকে সে প্রেয়সীরূপে চেয়েছিল।

মাশহুদ মাহার সরে যাওয়ার একটা কারন ভেবে বলে, “দেখ মাহা, তুই যেমন বিয়েটা হোক সেটা চাসনি। আমিও চাইনি। প্রেমার কথা তো জানিসই। তবুও আমি চেষ্টা করছি। স্বামী হিসেবে না হোক, আগের মত বন্ধু হিসেবে ভাব আমাকে। তাছাড়া এসব বিয়ে তো তোর জীবনে আঠারো বছর পরে এসেছে। কিন্তু জন্মের পর থেকে যে মাশহুদ ভাই তোর জীবনে এসেছিলো তাকে মনে করেই নাহয় স্বাভাবিক হ।”

“আপনি কি সম্পর্কটা সত্যিই কন্টিনিউ করতে চান মাশহুদ ভাই? প্রেমা আপুকে ভালোবাসেন না?”

“বাসি হয়তো। কিন্তু এখন আমি বিবাহিত। পরকীয়ার সম্পর্কটা আমার কাছে ঘৃণ্য একটা ব্যাপার। তাই চাপ নিস না। নিজের পাশাপাশি তোকেও বদনাম করার চেষ্টা করবে না তোর মাশহুদ ভাই। ওহ! এখন তো ভাইও বলা যাবে না। দাদি-নানিদের কড়া আদেশ স্বামীকে ভাই বলা নিষিদ্ধ। তুই বরং নাম ধরেই ডাক। আমার কোনো আপত্তি নেই।”

“ওহ।”

“আমাকে নিয়ে মনে ভয় পুষে রাখিস না। আমার সীমা আর তোর পরিস্থিতি দুটি সম্পর্কেই আমি অবগত। তোকে সবসময় বোন ভেবেছি, হঠাৎ বউ হয়ে গেলেই তো বউ ভেবে বসা যায় না। তোর ক্ষেত্রেও সেম কাহিনি। তাই সম্পর্কটাকে সময় দে। হয়তো একসময় ঠিক হবে। নয়তো তোর যা ইচ্ছে হয় করিস।”

“আমার যা ইচ্ছে মানে?”

“যদি সম্পর্কটা মানিয়ে নিতে অসুবিধে হয় তাহলে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। সারাজীবন অসুখী হয়ে কাটানো, একটা অসুস্থ সম্পর্ক বয়ে, কষ্ট পাওয়ার পার্মানেন্ট ব্যবস্থা থেকে নাহয় তোকে মুক্ত করে দেবো।”

মাহার বুক ভার হয়ে আসে। মাশহুদ এখনও ওকে নিয়ে, ওর ভালো, ওর সুখ নিয়ে ভাবছে। মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। মাহার উচিত নয়, মাশহুদকে অপরাধির কাঠগড়ায় দাড় করানো। স্বাভাবিক ব্যবহার না করলে মাশহুদ নিজের কাছে ছোট হয়ে থাকবে। মনে মনে কষ্ট পাবে, মাহার পরিবর্তনে। তাই মাহা নিজেও হাসার চেষ্টা করে বলল,

“আপনি যখন চেষ্টা করবেন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার, তখন আমিও চেষ্টা করবো সবটা মানিয়ে নেওয়ার।”

“গুড। বুঝলি মাহা, আমরা আমাদের মা-বাবাকে এতটা ভালোবাসি। সৃষ্টিকর্তা এই ভালোবাসার উত্তম নিয়ামত দান করবেন। আমাদের তার ওপর ভরসা রাখা উচিত। কষ্ট পাস না। আফসোস করিস না। মনে কষ্ট জমিয়ে না রেখে মনে যখন যা আসবে আমাকে বলবি। ঠিক আছে?”

মাহার বলতে ইচ্ছে করলো, “আপনিও আমাকে আপনার মনের সব কথা বলবেন।” কিন্তু বলতে পারলো না। কোথায় যেন বেঁধে যাচ্ছে। কন্ঠের স্বর মন্হর হয়ে আসে। মাশহুদ মাহাকে শুতে বলে একপাশে। মাহা শুয়ে পড়ে নিশ্চুপ। মাশহুদ লাইট অফ করে পিঠে বালিশ ঠেকিয়ে বসে। ফোনের আলোয় তার গম্ভীর চেহারা ভেসে ওঠে। চিন্তিতভাব স্পষ্ট। মাহার ঘুম আসে। কিছুসময়ের মধ্যেই ঘুমের অতলে হারিয়ে গেল সে।

হঠাৎ মাশহুদের চিৎকারে মাহার ঘুমটা কাঁচা হয়ে গেল। সে বেশ জোড়েই বলছে, “এসব হয়েছে সন্ধ্যায়। আর তোরা এখন বলছিস? ওকে হসপিটালে নেওয়া হয়েছে? কেমন আছে এখন? জ্ঞান ফিরবে কখন?”

এমন আরও বাক্য ভেসে আসে কানে। মাহা উঠে বসে। মাশহুদ মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ে। চোখের কোনায় পানি জমে আছে। সে যথাসম্ভব চেষ্টা করছে বারিধারা বর্ষিত হতে না দেওয়ার। মাশহুদকে এভাবে দেখে মাহার মস্তিষ্ক থমকে গেল। অনুভূতিশূণ্য হয়ে পড়লো মুহূর্তেই। মাশহুদকে এভাবে এমন অবস্থায় খুব কম দেখা যায়। মাহা এগিয়ে গিয়ে বরাবরের মতো মাশহুদের হাতে হাত রেখে রুদ্ধস্বরে শুধায়,

“কী হয়েছে?”

মাশহুদ অস্পষ্ট গলায় বলল, “প্রেমা সুইসাইড অ্যাটেম্ট করেছে। এখন হসপিটালে ভর্তি।”

চলবে..