তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব-৩৮+৩৯

0
492

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:৩৮

সবেমাত্র চোখ দুটোতে তদ্রা এসে ভর করেছে, ওমনি সারা মুখে ঠান্ডা পানির ফোঁটার অস্তিত্ব অনুভব করলাম। প্রথমে অলসতার কারণে চোখ মেলতে ইচ্ছে করল না। কিন্তু পরপর কয়েকবার একই ঘটনা ঘটায় অলসতা কাটিয়ে চোখ খুলতেই হলো। চোখ খুলতেই চোখ-কপাল কুঁচকে এল। ঝট করে উঠে বসে মুখের পানি মুছতে মুছতে তেতে উঠলাম,
“কী সমস্যা আপনার?”
“এই প্রশ্ন তো আমার তোকে করা উচিত। কী সমস্যা?” অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাতের পানির গ্লাসটা টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন তাজ ভাই।
আমি ওনার কথাটা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ত্যাড়াভাবে উলটো প্রশ্ন করলাম,
“আপনি পারমিশন ছাড়া আমার রুমে এসেছেন কেন?”
“তুই নিজে কবে পারমিশন নিয়ে আমার রুমে গিয়েছিস?”
“আপনি যান তো। এই রাতবিরেতে ভূত চেপেছে মাথায়? পানির ছিটা দিলেন কেন?”
“ডিনার করিসনি কেন?” টেবিল থেকে খাবারের প্লেট হাতে নিতে নিতে প্রশ্ন করলেন তাজ ভাই।
সঙ্গে সঙ্গে আমি শক্ত মুখে বললাম,
“খাব না আমি। আপনাকে এত দরদ দেখাতে কে বলেছে? যান এসব নিয়ে।”
আমার কথা তোয়াক্কা না করে তাজ ভাই আমার মুখোমুখি বসে ধমকে উঠে বললেন,
“সাট আপ স্টুপিড। বাড়তি কথা শুনতে চাই না। তোর এসব আজাইরা বকবক শোনার সময় নেই আমার। শখে আসিনি আমি।”
আমার চোখ দুটো হঠাৎ করেই ছলছল করে উঠল। মুখটাও শক্তপোক্ত হয়ে গেল। আমার এটুকু কথাতেই এভাবে ধমকে উঠলেন উনি। কই? জেসিকার সাথে তো এমন করেন না। সবসময় কী মিষ্টি করে কথা বলেন। তো আমি কি দোষ করলাম?
“তো আসেন কেন আমার আজাইরা বকবক শুনতে? আমি কি বলেছি আসতে? নিজেই তো যেচে আসেন আমার মাথা খেতে। চলে যান, আসবেন না আর আমার রুমে। কারো দরদের দরকার নেই আমার। আপনার দরদের জন্য আমি মরে যাচ্ছি না। আপনি আসার আগেও আমি বেঁচে ছিলাম।”
কাঁদো কাঁদো গলায় কিছুটা জোরেই কথাগুলো বলে আমি দ্রুত বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালাম। যেন সারাদিনের সমস্ত রাগ একবারে উপড়ে দিলাম। তারপর আর ওনার দিকে ফিরেও তাকালাম না। হনহন করে হেঁটে সোজা বেলকনিতে চলে গেলাম। দুহাতে শক্ত করে রেলিং আঁকড়ে ধরে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম লক্ষ্যভ্রষ্ট দৃষ্টি বাইরে নিবদ্ধ করে। এভাবে কোনোদিন আমি কারো সাথে চেঁচামেচি করে কথা বলেছি বলে আমার মনে পড়ে না। এতটা রাগও কাউকে দেখানোর সুযোগ হয়নি। আম্মু চলে যাবার পর তো বাবাই একমাত্র সঙ্গী। রাগ দেখাব কার সাথে? হঠাৎ করে যে এমন আচরণ করে ফেলব তা বুঝে উঠতে পারিনি। এভাবে রিয়্যাক্ট করা কি ঠিক হয়েছে? না হোক, আমার কি? আসে কেন জোর দেখাতে? আমি কখনও বলি ওনার অনুগ্রহ প্রয়োজন আমার? যেচে আসবে, আর আমাকেই ধমকে যাবে কেন সবসময়? মগের মুল্লুক পেয়ে বসেছে। মাথাটা রাগে দপদপ করছে। কেন জানি চোখের কার্নিশ বেয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আমি চোখ বন্ধ করে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ পেছনে পদধ্বনি শুনতে পেলাম। জানি তাজ ভাই এসেছেন, তবু ঘুরে দাঁড়ালাম না। একইভাবে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। বাহুতে হাতের স্পর্শ পেলাম। আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তাজ ভাই নিজেই হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে। ওনার অবাক হওয়ার কারণ বুঝতে আমার অসুবিধা হলো না। দ্রুত হস্তে চোখের নিচের পানিটুকু মুছে ফেললাম। ফাঁকা একটা ঢোক গিলে অন্যদিকে মুখ করে আমতা-আমতা করতে লাগলাম। তাজ ভাই সশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর দুহাতে আমার মুখটা আলতো করে তুলে ধরলেন। সস্নেহে চোখের পানি মুছে দিতেই আমি বললাম,
“আমি……।”
“হুঁশ, একদম চুপ। এসব কী হ্যাঁ? বাচ্চা তুই? কাঁদছিস কেন? এটুকু বকুনিতেই এভাবে কাঁদা লাগে? এমন তো প্রতিদিনই বকি। একদিনও তো এভাবে কাঁদতে দেখলাম না।” আমার কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে নরম কন্ঠে বললেন তাজ ভাই।
আমি থমথমে গলায় বললাম,
“কাঁদছি না।”
“আমি অন্ধ নই।”
আমি আর উত্তর দিলাম না। গাল থেকে ওনার হাত দুটো আস্তে করে সরিয়ে পুনরায় ঘুরে দাঁড়িয়ে রেলিংয়ে হাত রাখলাম। পরক্ষণেই তাজ ভাইয়ের আকস্মিক কান্ডে চমকে উঠলাম। উনি পেছন থেকে আমার দুহাতের ওপর হাত ঠেকিয়ে কাঁধে থুতনি রাখলেন। আমি কিছু সময়ের জন্য থমকে গেলাম। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যাওয়ার সাথে সাথে কেমন গা ছাড়া ভাব এসে ভর করল সারা শরীরে। শুকনো একটা ঢোক গিলে কাঁপা গলায় বললাম,
“কী করছেন? সরে দাঁড়ান।”
উনি আমার কথা কানে না নিয়ে কাঁধে থুতনি রেখেই আমার নত মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“জেসিকা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমরা সেইম ইয়ার। ভাইয়ার বিয়ের পর জেসিকার সাথে সবসময় চলাফেরা করতে করতে ফ্রেন্ডশিপ হয়ে যায়। ও মেয়ে হিসেবে খুবই ভালো। ওর মন সুন্দর বলেই ফ্রেন্ড হিসেবে ওকে খুব ভালো লাগে আমার। আমার থেকে বেশি ও আমাকে ভরসা করে। ওর ভাষ্যমতে আমি থাকতে ওর আর কোনো ফ্রেন্ডের প্রয়োজন পড়ে না। সমস্যা হচ্ছে ও আমার নামটা শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতে পারে না। তাজ বলতে গেলে টাজ বলে ফেলে। এতে ও নিজেই বিরক্ত হয়, তাই হানি ডাকে। আমরা এটাকে অস্বাভাবিক মনে করলেও ওর কাছে স্বাভাবিক। তাছাড়া ওর বয়ফ্রেন্ড আছে। তো? আর কোনো প্রশ্ন আছে এই মোটা মাথায়?”
আমি স্তব্ধ হয়ে পুরো কথাগুলো শুনলাম। উনি যে আমার রাগের আসল কারণটা আন্দাজ করতে পেরেছেন তা ভেবে আমি খানিক লজ্জায় পড়ে গেলাম। নতজানু হয়েই মিনমিনে গলায় বললাম,
“আমি এসব জেনে কী করব?”
তাজ ভাই ক্ষীণ আওয়াজে হাসলেন, কিন্তু কোনো উত্তর দিলেন না। আমি কাঁচুমাচু মুখে পুনরায় বলে উঠলাম,
“আমি আসলে ওভাবে রিয়্যাক্ট করতে চাইনি। কীভাবে হয়ে গেল জানি না। সরি।”
“সরি কেন?”
“চেঁচামেচি করার কারণে।”
“তো?”
“আপনার হয়তো খারাপ লেগেছে।”
“আমি কি একবারও বলেছি আমার খারাপ লেগেছে? আজকাল দেখছি ওভার থিংকিংয়ে মাথা বিগড়ে যাচ্ছে।”
কথাটা যে আমাকে খোঁচা মেরে বলা হয়েছে তা আমার কাছে স্পষ্ট। তবু আমি প্রতিউত্তর করলাম না। চুপ মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম। তাজ ভাইও আর কথা বাড়ালেন না। না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম উনি মোহাচ্ছন্ন হয়ে আমার মুখের পানে তাকিয়ে আছেন। ওনার প্রতিটা নিঃশ্বাস এসে আমার গলার কাছে আছড়ে পড়ছে। এদিকে আমি একচুলও নড়তে পারছি না। একে তো উনি ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন, তার ওপর আবার রেলিং ধরা হাত দুটোও মুঠোবন্দী করে রেখেছেন। এভাবে বেশিক্ষণ থাকা সম্ভবপর হয়ে উঠল না। শরীর জুড়ে শিরশির অনুভূতি হচ্ছে। শুকনো ঠোঁটটা জিব দিয়ে ভিজিয়ে বার কয়েক ঢোঁক গিলে আমি মৃদু স্বরে বললাম,
“আপনি একটু সরে দাঁড়ান প্লিজ।”
“কেন?” নিচু স্বরে প্রশ্ন করলেন তাজ ভাই।
আমি চোখ-মুখ কুঁচকে বললাম,“আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। প্লিজ।”
উনি পুনরায় হাসলেন। ওনার হাসির দমকে আমার বুকের মধ্যে হাতুড়িপেটা শুরু হলো। পরক্ষণেই উনি সরে গেছেন টের পেয়ে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। দুপা পিছিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই উনি আমার হাত টেনে ধরলেন। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকাতেই উনি আমাকে টানতে টানতে রুমে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,
“আমার সারারাত জেগে থাকার শখ নেই। কাল অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে। একদিকে কাজ, আবার আরেকদিকে ভাইয়া-ভাবি বলেছে কাল বিকেলে সবাই মিলে বাইরে বেরোবে। খাবারটা খেয়ে আমাকে উদ্ধার করুন ম্যাম।”
আমাকে পুনরায় বিছানায় বসিয়ে দিয়ে তাজ ভাই খাওয়ানো আরম্ভ করলেন। এবার আর আমি দ্বিরুক্তি করলাম না। খাবার মুখে নিয়ে প্রশ্ন করলাম,
“আপনি খেয়েছেন?”
ওনার ছোট্ট জবাব,“হুম।”
“কাল আমরা সবাই বাইরে যাব?”
“হুম।”
আমি কিছুক্ষণ আপন মনে ভেবে আমতা-আমতা করে প্রশ্ন করলাম,
“শ্রেয়ান ভাইয়াকে আসতে বলবেন?”
উনি স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলেন,
“আচ্ছা।”
“উনি হঠাৎ করে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন কেন বলুন তো?”
“আমি কীভাবে জানব? তোদের ব্যাপার।”
“কী জানি! আমার তো বিশ্বাস হয় না শ্রেয়ান ভাইয়া ইচ্ছে করে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিবে।”
“ও তো বাচ্চা না। ইচ্ছে থাকলে অবশ্যই যোগাযোগ করত।”
“এটাই তো প্রশ্ন। আমাকে প্রপোজ করার পরদিনই উনি চুপ মেরে গেলেন। ব্যাপারটা কেমন যেন অবিশ্বাস্য না?”
“তো তোকে যোগাযোগ করতে বারণ করেছে কে?”
“ভেবেছি করব। নিজে থেকে ফোন করতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। আপনি কিছু জিজ্ঞেস করেননি?”
“কোন ব্যাপারে?”
“এই যে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো।”
“কাজের প্রচুর চাপ এখন। অন্য কোনো বিষয়ে কথা বলার সুযোগ হয় না, আর মনেও থাকে না তখন।”
“ওহ্।”
বিভিন্ন কথায় কথায় খাওয়া শেষ হওয়ার পর তাজ ভাই সস্নেহে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“শুয়ে পড়।”
আমি ওনার কথামতো চুপটি মেরে শুয়ে পড়লাম। উনি আমার পাশে বসে মিনিট খানেক তাকিয়ে থেকে হঠাৎ গলা ঝেড়ে নিচু স্বরে বললেন,
“মাঝে মাঝে সুইডেন আর বাংলাদেশের মধ্যকার তফাত মাপার নিয়মটা ভঙ্গ করা কি গুরুতর অপরাধ বলে গণ্য হবে পিচ্চি?”
লজ্জায় আমার কান লাল হয়ে গেল। চোখ দুটো বড়ো করে আমি ঝট করে বিপরীত দিকে ঘুরে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজলাম। ভেতরের সত্ত্বা লাজুক কন্ঠে বলল,“অবশ্যই অপরাধ, দণ্ডনীয় অপরাধ। আমি যদি দম বন্ধ হয়ে মরে-টরে যাই, তবে?”
তাজ ভাই এবার মৃদু শব্দ তুলে হেসে উঠলেন। ‘গুড নাইট’ বলে উনি পাশ থেকে উঠে গেলেন। পরমুহূর্তেই পদধ্বনি কানে ভেসে আসতেই বুঝলাম উনি চলে যাচ্ছেন।

________________________

আজ সারাদিন আমি বেশ উত্তেজিত ছিলাম। সবাই মিলে একসাথে বাইরে ঘোরাঘুরি করব ভেবেই মনটা বারবার আনন্দে নেচে উঠছিল। রাজ ভাইয়াদের সাথে এই নিয়ে অনেক প্ল্যানিংও হয়েছে। প্ল্যান মতো বিকেল হতেই আমরা রেডি হয়ে তাজ ভাইয়ের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তাজ ভাইয়া ড্রাইভিং সিটে আর রাজ ভাইয়া তার পাশে। আমি, জেনিফার ভাবি আর জেসিকা পেছনের সিটে।‌ রাজ ভাইয়া ঘোষণা করলেন, এত বছর পর যেহেতু দেশে ফিরেছে, সেহেতু আজ সে ঘুরেঘুরে শুধু খাবে। তার কথায় সবাই সম্মতি জানাতে বাধ্য হলো। আমিও একই সুবর্ণ সুযোগটা কাজে লাগাতে ভুললাম না। চট করে ফুসকা খাওয়ার বায়না ধরে বসলাম। তাজ ভাই আজ আর ধমকাতে সক্ষম হলেন না। শুধু সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”বাইরের খাবার বেশি খাওয়ার দরকার নেই। খেলেও কম পরিমাণে খাবে।”
রাজ ভাইয়া সঙ্গে সঙ্গে ওনার মাথায় টোকা মেরে বললেন,
“এত বছর পর দেশে এসে দেশী খাবার খাব না? গাধা। এই তুই আমার ভাই হয়েছিস কোন আক্কেলে বল তো। শালা নিরামিষ একটা।”
তাজ ভাই ভ্রুকুটি করে বললেন,
“হেই ব্রো, আমি তোমার কোন জন্মের শালা?”
জেনিফার ভাবি বলল,
“ঠিক আসে। ও টোমার শালা, আর আমার ভাই। এইবার বোলো, টুমি আমার ভাইকে নিরআমিষ বললে কেনো?”
রাজ ভাইয়া হতাশ গলায় বলল,
“ব্যস, শুরু হয়ে গেল দেবরের পক্ষে কথা বলা।”
তাজ ভাই বিশ্ব জয়ের হাসি দিয়ে জেনিফার ভাবিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“লাভ ইউ ভাবি। আমার এই বলদ মার্কা ভাইকে এভাবেই জব্দ করবে।”
রাজ ভাইয়া কপাল কুঁচকে বললেন,
“ওই তুই নিরামিষ না তো কি? আজীবন ভালো খাবারে তোর অনীহা। তোর জন্য ছোটো বেলায় আমিও ভালো ভালো খাবারগুলো খেতে ব্যর্থ হতাম। শালা, ওসব মনে পড়লে দুঃখে কলিজা ফেটে যায়।”
আমি আর জেসিকা এতক্ষণ ঠোঁট টিপে এদের কথা শুনছিলাম। এবার দুজনেই একসাথে খিলখিল করে হেসে উঠলাম। পরমুহূর্তে জেসিকা মুখ খুলতেই আমি চুপ মেরে গেলাম। অসহায় মুখে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম জেসিকার কথা শুনে বাকিরা বেজায় হাসছে। ইংরেজির গোষ্ঠীর তুষ্টি উদ্ধার করতে চাওয়া আমার মনকে বহু কষ্টে দমিয়ে রাখলাম। পথে ফুসকার দোকানের সামনে গাড়ি থামানো হলো। আমি তো পারলে নেচে উঠি। তাজ ভাইয়ের বিরক্তভরা মুখটা লক্ষ্য করে মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ পেলাম। শয়তান লোকটা আমাকে কখনও একটু শান্তিতে ফুসকা খেতে দেয় না। আজ রাজ ভাইয়ার সাথে জমিয়ে খাব। মহানন্দে ফুসকা খাওয়ার সময় শ্রেয়ান ভাইয়ার কথা মনে পড়ল। একমাত্র শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথেই শান্তিতে ফুসকা খেতে পারতাম। লোকটার কী হলো কে জানে? আজ বাড়ি ফিরে খোঁজ নিতেই হবে। তাজ ভাই ছাড়া আমরা বাকিরা সবাই বেশ তৃপ্তি নিয়ে ফুসকা খেলাম। ফুসকার বিল মিটিয়ে সবাই গাড়ির দিকে পা বাড়ানোর সময় আমার দৃষ্টি চলে গেল রাস্তার ওপারে। হাওয়াই মিঠাই। অনেকদিন ধরে খাওয়া হয় না। দেখেই লোভ লাগছে। কিন্তু কিনতে হলে রাস্তার ওপারে যেতে হবে। হুট করে আমি তাজ ভাইয়ের বাঁ হাতটা চেপে ধরলাম। উনি দাঁড়িয়ে পড়ে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকালেন। আমি ইশারায় রাস্তার ওপারে দেখিয়ে বায়না ধরলাম,
“হাওয়াই মিঠাই এনে দেন না।”
সঙ্গে সঙ্গে উনি নাকোচ করে বলে বসলেন,
“দরকার নেই। মাত্র ফুসকা খেয়েছেন, এরপর আরও কী কী খাওয়া হয় আমার ভাই জানে। শরীরের অবস্থা বেহাল করে বসে থাকবেন তারপর।”
আমি অসহায় মুখ করে হাত ঝাঁকিয়ে বললাম,
“দিন না। এমন করছেন কেন? অনেকদিন ধরে খাই না। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ।”
“পারব না। হাত ছাড়।”
আমি ঝাঁকি মেরে ওনার হাতটা ছেড়ে রাগত স্বরে বললাম,
“থাক, আনতে হবে না আপনাকে। রাজ ভাইয়াকে বলছি।”
গাল ফুলিয়ে গাড়ির দিকে পা বাড়াতেই তাজ ভাই আমার হাত টেনে ধরে বাঁধা দিলেন। আদেশের সুরে বললেন,
“চুপচাপ দাঁড়া, নিয়ে আসছি।”
আমি মনে মনে খুশি হলেও প্রকাশ করলাম না। আমাকে ফুটপাতে দাঁড় করিয়ে রেখে তাজ ভাই খুব সাবধানে রাস্তা পার হলেন। আমি এক দৃষ্টিতে ওনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। রাজ ভাইয়ারা গাড়িতে উঠে বসেছিলেন। আমাদের দেরি দেখে জানালা দিয়ে মাথা বের করে উচ্চ স্বরে বলল,
“ইলু, আসছিস না কেন? তাজ কই গেল?”
আমি সেদিকে তাকিয়ে জবাব দিলাম,
“আসছি ভাইয়া। তাজ ভাই রাস্তার ওপার গেছেন।”
রাজ ভাইয়া ‘আচ্ছা’ বলে গাড়ির ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে বসলেন। আমি পুনরায় রাস্তার ওপারে তাকালাম। দেখলাম তাজ ভাই দোকানীর টাকা মিটিয়ে দুটো হাওয়াই মিঠাই হাতে নিয়ে এপারে আসার জন্য পা বাড়িয়েছেন। আমি অজান্তেই মৃদু হাসলাম। দৃষ্টি ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকাতেই হঠাৎ দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। কেউ একজন পেছন থেকে বেশ শক্তপোক্ত করে মুখ চেপে ধরেছে। আমি চিৎকার করতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম। রাস্তা পার হওয়া মানুষটার দিকে তাকানোর সুযোগটুকুও পেলাম না। তার আগেই আমাকে টেনেহিঁচড়ে সেখান থেকে সরিয়ে একটা গাড়ির মধ্যে ঢুকানো হলো। যতটুকু দেখলাম, মুখে রুমাল বাঁধা এক বলিষ্ঠদেহী পুরুষ আমার মুখ চেপে ধরে রেখেছে। আমি অনেক চেষ্টা করলাম মুখ থেকে লোকটার হাত সরানোর। কিন্তু সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো। গাড়িতে ওঠাতেই কেউ একজন পাশ থেকে মুখে কিছু স্প্রে করে মুখটা বেঁধে দিচ্ছিল। বেশ বুঝতে পারলাম আমাকে কিডন্যাপ করা হচ্ছে। এরা কি আমাকে বাঁচতে দিবে না? তবে? আমি কি আর ছাড়া পাব না এদের হাত থেকে? বাবা, তাজ ভাই। পাগল হয়ে যাবে মানুষ দুটো। আমার চোখ দুটো তখন মুদে আসছিল। অসাড় মস্তিষ্ক চিৎকার করে আকুতি করে উঠল,“আল্লাহ্ রক্ষা করো। আমি বাঁচতে চাই।”

চলবে…………………🍁

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:৩৯

জ্ঞান ফেরার পর পিটপিট করে চোখ খুলতেই মাথায় খানিকটা ব্যথা অনুভব করলাম। চোখ-মুখ কুঁচকে চারদিকে চোখ বোলাতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার ছাড়া কিছুই নজরে পড়ছে না। এত অন্ধকার কেন? লোড সেডিং হলো না কি? চারদিকের নিস্তব্ধতায় আমার মনে ভয়ের উদয় ঘটাল। মাথাটা ঝাঁকুনি দিয়ে নড়াচড়া করতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম। হাত-পা নাড়াতে পারছি না। পুনরায় চেষ্টা করলাম, নাহ্, হচ্ছে না। পরক্ষণেই অনুভব করলাম হাত পা কিছুর সাথে আটকে আছে। আশ্চর্য! এসব কী? মনে তো হচ্ছে এখন রাত। তো আমি কোথায়? বাবাকে ডাকব, না কি তাজ ভাইকে? সঙ্গে সঙ্গেই হুট করে মনে পড়ল, আমি তো ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তাজ ভাই হাওয়াই মিঠাই নিয়ে আসছিল, তারপর কেউ মুখ চেপে ধরে গাড়িতে ওঠাল। মুখে কিছু একটা স্প্রে করেছিল, তারপর? তারপর কী হয়েছিল? কিচ্ছু মনে নেই। আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। কোথায় আটকে রেখেছে আমাকে? এখন কী হবে? আমি বাড়ি ফিরব কীভাবে? আমাকে কি ছাড়বে না? ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেল। আমাকে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে বাবার কী অবস্থা হয়েছে? তাজ ভাই? নিশ্চয়ই পাগলের মতো খুঁজছে। আমি কি আর কোনোদিনও তাদের দেখতে পারব না? বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হলো। চিৎকার করতে গিয়েও কন্ঠনালি আটকে গেল। চোখ দুটোতে শ্রাবণের ঢল নেমেছে কিডন্যাপের কথা কথা মনে পড়তেই। তার ওপর চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। মাথা ব্যথাটা আরও বেড়ে গেল। একে তো অন্ধকারে আমার প্রচন্ড ভয়। তার ওপর আবার অচেনা জায়গা, আতঙ্ক, আশংকা। কিছু সময় পর আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। ‘কেউ আছেন’ বলে বারবার গলা ফাটিয়ে ডাকতে লাগলাম। কিন্তু ফলাফল সেই নিস্তব্ধতা। অন্ধকার জায়গায় আমার চিৎকারের শব্দ ক্ষণে ক্ষণে প্রতিধ্বনিত হয়ে আমার কানেই বেজে উঠল। কতক্ষণ চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে অনবরত চিৎকার চেঁচামেচি করলাম জানা নেই। ভয়ে সারা শরীর বারবার শিউরে উঠছে। তারপর হঠাৎ মাথার মধ্যে চক্কর দিয়ে উঠতেই পুনরায় জ্ঞান হারালাম।

কারো কর্কশ কন্ঠের চেঁচামেচি কানে ভেসে আসতেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। অবশ শরীরে রাজ্যের অলসতা এসে ভর করেছে। তবু বহু কষ্টে চোখ খুলতেই হলো। চোখ খুলতেই আমি ভীষণভাবে চমকে উঠলাম। চোখের সামনে বিশালদেহী চারজন লোক কঠিন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কপাল কুঁচকে চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, বেশ বড়োসড়ো একটা ঘরের একপাশে একটা চেয়ারে বসিয়ে আমার হাত-পা মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। ঘরটা অপরিষ্কার। চারপাশে কী সব কাগজপত্র, বাক্স, গ্লাস, বোতল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। লোকগুলোর দিকে পুনরায় তাকাতেই আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে আবার দুচোখ বেয়ে উত্তাল স্রোত বয়ে গেল। লোকগুলো নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। আমি শুকনো ঢোক গিলে মাথা নিচু করে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললাম,
“আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ।”
আমার কথা শুনে একটা লোক এগিয়ে এল। লোকটা এসে আমার ঠিক সম্মুখে দাঁড়াল। তারপর হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে ডান হাতে আমার চিবুক ধরে মুখটা তুলে ধরল। লোকটার লোলুপ দৃষ্টি দেখে আমার সারা শরীরে কম্পন ধরে গেল। লোকটা বিভৎস হেসে একটানে আমার গলা থেকে ওড়নাটা কেড়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। আমি আঁতকে উঠলাম। এতক্ষণের আশংকা সত্যি করে দিয়ে লোকটা আমার গালে আঙুল ঘঁষে নিচু গলায় বলল,
“ভয় পাচ্ছ কেন বাবু? আমরা কি তোমাকে মেরেছি? এমন কচি, মিষ্টি সোনামনিকে কি মারা যায়? তোমাকে তো আদর করব, খুউউব আদর করব। কাঁদে না সোনা।”
আমি মাথাটা পিছিয়ে নিতে চাইলেও চেয়ারের জন্য আটকে গেলাম। কাঁদতে কাঁদতে আকুতি করে বললাম,
“প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন। আপনার পায়ে পড়ছি। আমাকে ছোঁবেন না। হাত সরান,‌ প্লিজ।”
লোকটা হো হো করে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল। পরক্ষণেই দাঁতে দাঁত পিষে আমার গাল চেপে ধরে বলল,
“আমার পেছনে লাগার ফল এবার হারে হারে টের পাবে বিচ্ছু ডিটেকটিভ। আমার পেছনে লাগা? এইবার দেখি কী করে?”
আমার পিলে চমকে উঠল। লোকটা যে তাজ ভাইয়ের কথা বলছে তা বুঝতে অসুবিধা হলো না। আমি সেদিকে কান না দিয়ে গাল ব্যথায় ককিয়ে উঠে চোখ কুঁচকে ফেললাম। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আরও জোরে কেঁদে উঠলাম। বারবার আকুতি করা সত্ত্বেও লোকটার পাষাণ মন একটুও গলল না। উলটো সে আমার গাল থেকে গলায় হাত নামাল। আমি পুনরায় চিৎকার করে ছটফট করতে লাগলাম। এবার বুঝি আর রক্ষা নেই। অমানুষগুলো আমাকে বাঁচতে দিবে না তা আমি নিশ্চিত। আর বাঁচিয়ে রাখলেও আমাকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে ছাড়বে। কাঁদতে কাঁদতে ইতোমধ্যে গলা ভেঙে গেছে। মাথাটা প্রচন্ড ভার লাগছে। নিমেষেই এই নিষ্ঠুর দুনিয়াটা আমার কাছে অতি বিষাক্ত মনে হচ্ছে। যেন নিঃশ্বাসটুকু বন্ধ হয়ে গেলেই বাঁচি। কাঁদতে কাঁদতে চোখ বন্ধ করে প্রথমেই তিনজন মানুষকে স্মরণ করলাম। আম্মু, বাবা, তাজ ভাই। এই পর্যন্ত এই তিনজন মানুষই আমাকে আগলে রেখেছে। আর আজ? সব শেষ হওয়ার পথে। জঘন্য স্পর্শ গলা গলিয়ে নিচে নামতে শুরু করতেই আমার সারা দুনিয়া জুড়ে অন্ধকার নেমে এল। এবার শুধু নিঃশ্বাস বন্ধ হবার অপেক্ষা।

আমার অপেক্ষা সফল হলো না। কানে কারো কথার শব্দ ভেসে আসতেই বুঝে গেলাম আমি বেঁচে আছি। কিন্তু আমি তো এটা চাইনি। ওই লোকগুলো? আমার সাথে কি খারাপ কিছু করেছে? কপাল কুঁচকে নড়ার চেষ্টা করলাম। আশ্চর্য! এবার তো আমি নড়াচড়া করতে পারছি, হাত-পা মুক্ত। তাছাড়া আমি বোধ হয় বিছানা জাতীয় কোথাও শুয়ে আছি। নড়াচড়া করার পরপরই কেউ পরপর তিনবার ‘ইলু’ বলে ডাকল। ডাকটা ভালোভাবে কর্ণগুহরে পৌঁছনোমাত্র আমি ঝট করে চোখ খুললাম। এবার আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। এ তো আমার রুম। মুখের ওপর ঝুঁকে রাজ ভাইয়া আমার গালে মৃদু চাপড়ে বারবার ডাকছে। আমি দ্রুত উঠে বসলাম। উঠতে গিয়েও হাত-পায়ে তীব্র ব্যথা অনুভব করলাম। শরীরে চোখ বুলিয়ে দেখলাম ড্রেস চেঞ্জ করা। রাজ ভাইয়া ব্যস্ত হয়ে বলল,
“ইলু? ঠিক আছিস? শরীর কেমন লাগছে?”
রাজ ভাইয়ার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই দেখলাম সামনে জেনিফার ভাবি, জেসিকা, বাবা আর শ্রেয়ান ভাইয়া চোখে-মুখে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে আমার মুখের দিকে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছে। কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ করলাম না। বাবাকে দেখেই আমার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল‌। কান্নারা গলায় এসে দলা পাকিয়ে বসেছে। ঠোঁট জোড়া ভীষণভাবে কেঁপে উঠে আমার চোখ দিয়ে পানি গড়াতে লাগল। বাবা আমার অবস্থা দেখে বোধ হয় ঘাবড়ে গেল। দ্রুত পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতেই আমি দুহাতে মুখ চেপে ধরে গলা ফাটিয়ে ‘বাবা’ বলে আর্তনাদ করে উঠলাম। বাবা ততক্ষণে এসে আমাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরেছে। অনুভব করে বুঝলাম তার শরীর অসম্ভব কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা কান্নামাখা গলায় সে ‘আম্মা’ বলে ডাকছে। আমি সারা দেওয়ার শক্তি পেলাম না। শরীরটা অবশ লাগছে। বাবা আমার অবস্থা দেখে কেঁদেই ফেলল। বারবার আমাকে ডাকছে আর বলে চলেছে,
“আম্মা? কাঁদে না আম্মা। বাবা আছি তো। শান্ত হও। কান্না থামাও আম্মা। আমার কষ্ট হয়।”
বাবার কথাগুলো আমার কানে এলেও আমি সাড়া দিলাম না। আমার মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেলাম। পরমুহূর্তেই শ্রেয়ান ভাইয়া নরম গলায় বললেন,
“ইলোমিলো? শান্ত হও। তোমার শরীর এমনিতেই দুর্বল। তুমি এমন করে কাঁদলে আঙ্কেলও পরে অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
অতি নরম কন্ঠের মাঝেও যে কোনো এক লুকায়িত ব্যথা জড়িত ছিল, তা বুঝি আমি একাই টের পেলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে পুনরায় বললেন,
“প্লিজ শান্ত হও। তোমার কিচ্ছু হয়নি, বিশ্বাস করো। সম্পূর্ণ সুস্থভাবে বাড়ি নিয়ে এসেছি তোমাকে। আর কেঁদো না।”
শ্রেয়ান ভাইয়ার কথাটা বিশ্বাস করেও করলাম না। বারবার ওই জঘন্য লোকটার লালসাভরা মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এমন বাজে পরিস্থিতিতে আমি এর আগে কোনোদিনও পড়িনি, তাই শকটা নিতে পারছি না। বাবা নিজের কান্না থামিয়ে আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। অনেকক্ষণ পর আমি কিছুটা শান্ত হলাম। বাবা আমার চোখ মুছে দিয়ে রিতাকে বলল আমার জন্য খাবার নিয়ে আসতে। শ্রেয়ান ভাইয়া কিছুক্ষণ থেকে রাজ ভাইয়ার সাথে কী সব কথা বলতে বলতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। লোকটা আমার দিকে খুব একটা তাকাচ্ছেও না। এখন তো এসব নিয়ে ভাবতেও পারছি না। অনেকদিন পর আজ বাবা নিজ হাতে আমাকে খাইয়ে দিলো। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা ছিল, বিধায় নাকোচ করলাম না। চুপচাপ কিছুটা খাবার খেয়ে বাকিটা রেখে দিতে বললাম। বাবা আজ আমার জন্য অফিসেও যেতে পারেনি। জেনিফার ভাবির কথায় বুঝলাম বাড়িসুদ্ধু সবাই গতকাল রাত থেকে উপবাসে আছে আমাকে না পাওয়ার দুঃখে। জেনিফার ভাবি বাবাকে বলল গিয়ে খেয়ে নিতে। আমিও তার সাথে একই কথা বললাম। বাবা আমার কপালে আদরমাখা চুমু খেয়ে চলে গেল। সে যাওয়ার পর জেনিফার ভাবি আর জেসিকা এসে আমার পাশে বসল। জেনিফার ভাবি আমার গালে হাত বুলিয়ে আমাকে নানাভাবে বোঝাতে লাগল। তার কথায় বুঝলাম ওই লোকগুলো আমার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম বলে হয়তো আবার একা ফেলে রেখেছিল। লোকগুলো যখন আমাকে কিডন্যাপ করেছিল তখন আমার কাঁধে ঝুলানো ব্যাগে ফোন রাখা ছিল। শুনলাম আমাকে না পেয়ে তাজ ভাই সঙ্গে সঙ্গে আমার নাম্বার ট্রেক করে লোকেশন জেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু লোকগুলো আমাকে আটকে রাখার পর হয়তো ব্যাগ থেকে ফোনটা নিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল। তাই তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া লোকেশন অনুযায়ী পৌঁছাতে পারলেও, ঠিক কোন জায়গায় রেখেছে তা বুঝে উঠতে পারেননি। গতকাল সারারাত না কি তারা সার্চ করে কাটিয়েছে। সকাল সাড়ে আটটার দিকে তারা সঠিক স্থানে পৌঁছাতে পেরেছিল। তারপর আমাকে অজ্ঞান অবস্থাতেই বাড়ি নিয়ে এসেছিল। জেনিফার ভাবি রাজ ভাইয়ার মুখে যতটুকু শুনেছে ততটুকুই আমাকে বলল। আমি এবার কিছুটা শান্তি পেলাম। ডাক্তার এসে না কি আমাকে দেখে গেছে আর বলেছে রেস্টে থাকতে। জেনিফার ভাবি অনেকক্ষণ বসে কথা বলার পর আমি নিজেই তাদের বললাম ব্রেকফাস্ট করতে যেতে। তারাও হয়তো ক্ষুধার্ত ছিল। আমার কথায় আপত্তি করল না। জেনিফার ভাবি আর জেসিকা চলে যেতে নিতেই আমি জেনিফার ভাবিকে পিছু ডাকলাম। দুজনেই থেমে গিয়ে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। জেনিফার ভাবি প্রশ্ন করল,
“কিচু বোলবে?”
আমি আমতা-আমতা করে বললাম,
“তাজ ভাইকে দেখছি না যে?”
“ভাই টো বাড়ি নেই। এসে যাবে টাড়াটাড়ি।”
“আচ্ছা।”
“টুমি রেস্ট নাও। রুম ঠেকে বেরোবে না, ওকে?”
“ওকে”, মাথা দুলিয়ে বললাম আমি।
তারা চলে যেতেই ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিলাম। কিছুই ভালো লাগছে না। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার, লোলুপ দৃষ্টি, বাজে স্পর্শ মনে করে ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। শ্রেয়ান ভাইয়া বাড়ি এল, আর রাজ ভাই বাইরে কেন? এই মুহূর্তে যে ওনাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করছে, তা কি উনি বোঝেন না?

শরীর দুর্বল বলে লম্বা এক ঘুম দিলাম। ঘুম থেকে যখন উঠেছি তখন দুপুর বারোটা। ঘুম থেকে উঠে জেনিফার ভাবিকে পাশে পেলাম। আমি ঘুম থেকে উঠতেই সে মিষ্টি হেসে বলল,
“ইলু, শরীর কেমোন লাগচে?”
“ভালো।”
“টাহলে শাওয়ার নাও গিয়ে। আমিও যাই।”
“আচ্ছা।”
জেনিফার ভাবি চলে যাওয়ার খানিক পরেই আমি ওয়াশরুমে ঢুকলাম। লম্বা সময় শাওয়ার নিয়ে তবেই বেরোলাম। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সম্মুখে দৃষ্টি পড়তেই থমকে গেলাম। তাজ ভাই খাটের সাথে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। একি অবস্থা লোকটার! মলিন মুখটা ঘামে ভিজে আছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। পরনে গতকাল বিকেলের সেই একই শার্ট। গতকালের আয়রন করা শার্টটা এখন কুঁচকে গেছে। জায়গায় জায়গায় ময়লাও লেগে আছে। শার্টের দিকে চোখ পড়তেই আমি আঁতকে উঠলাম। গলার ঠিক নিচে করা ব্যান্ডেজটায় এখনও তাজা রক্ত ভেসে আছে। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ওনার গলার নিচের ব্যান্ডেজে হাত ছোঁয়ালাম। সঙ্গে সঙ্গেই উনি চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। উনি ‘ইলু’ বলে ডাকতেই আমি ওনার সামনে বসে কাঁপা গলায় বললাম,
“র-রক্ত কেন?”
আমার বলতে দেরি হলো তাজ ভাইয়ের শার্টের কলার টেনে ব্যান্ডেজটা ঢাকতে সময় লাগল না। আমি ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করলাম,
“কী হয়েছে? দেখতে দিচ্ছেন না কেন? দেখি।”
ছলছল চোখে কথাগুলো বলে ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি স্থির হয়ে গেলাম। মানুষটার চোখ দুটোও ছলছল করছে। এমনিতেও চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে আছে। কাল সারারাত না ঘুমানোর কারণে, না কি কেঁদেছেন? এই তো এখনও চোখ জোড়া পানিতে টইটুম্বুর। উনি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হয়তো চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করলেন। কেন জানি এই মুহূর্তটা আমার একদমই সহ্য হলো না। হুট করে ওনার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মরা কান্না জুড়ে দিলাম। উনি আমাকে ধরলেন না। নিশ্চল মুর্তির মতো একভাবেই বসে রইলেন। এবার যেন আমি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠলাম। দুহাতে ওনার পিঠের কাছের শার্ট খামচে ধরে এতটাই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম যেন পারলে ওনার বুকের মধ্যে ঢুকে পড়ি। তবু উনি নিশ্চুপ। শুধু একবার কাঁপা গলায় ‘ইলু’ বলে ডাকলেন। পরক্ষণেই আমি আহাজারি করে বলতে লাগলাম,
“অন্ধকার ঘরে আটকে রেখেছিল আমায়। ভয়ে হাজার চিৎকার করেও কারো সাড়া পাইনি। প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম আমি। আর আজ সকালে, ওই খারাপ লোকটা আমার দিকে কীভাবে তাকিয়ে ছিল! পায়ে পড়ার কথা বলেছি, তবু শোনেনি। আমার ওড়না কেড়ে নিয়েছিল। গাল চেপে ধরেছিল। বাজেভাবে স্পর্শ করতে চেয়েছিল আমায়।”
কথাগুলো বলতে বলতে আমি আরও জোরে আর্তনাদ করে উঠলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাজ ভাই দুহাতে আমাকে জাপটে ধরলেন। নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে হয়তো নিজের কান্নাটুকু আটকানোর চেষ্টা চালালেন। ধরা গলায় বললেন,
“শুনতে চাই না আর। একদম চুপ। কিচ্ছু হয়নি ইলু, কিচ্ছু হয়নি। এই তো তুই আমার কাছে আছিস। আর কেউ নেই, কিচ্ছু হয়নি পিচ্চি।”
আমি বুক থেকে মুখ তুলে ওনার মুখের দিকে তাকালাম। ধারণা সত্যি। উনি নিঃশব্দে কাঁদছেন। আমি তাকাতেই উনি মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। আমি অসহায় মুখে বললাম,
“আপনি এত দেরি করেছেন কেন? আর একটু তাড়াতাড়ি গেলে কী হত? ওই লোকটা আমার সাথে এমন আচরণ করতে পারত না। আমার শরীর এখনও ঘিনঘিন করছে। বারবার ওসব মনে পড়ছে।”
তাজ ভাই একহাতে নিজের চোখের পানিটুকু মুছে ফেললেন। তারপর আমার মুখটা দুহাতে নিয়ে নাক টেনে নিচু স্বরে বললেন,
“আমি সরি ইলোনি। খুব, খুব সরি। আর কোনোদিনও এমন পরিস্থিতি আসতে দিব না, প্রমিস।”
আমি ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলাম। ওনার কথা শুনে মনে পড়ল এর আগে চিরকুটে উনি আমার নাম ‘ইলোনি’ লিখেছিলেন। আর আজ প্রথম মুখে বললেন। আমি কান্নার মাঝেও ভ্রুকুটি করে বললাম,
“ইলোনি?”
তাজ ভাই বোধ হয় একটু থমকালেন। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল না কি? এখন নিশ্চয়ই কথা ঘুরিয়ে ফেলবেন। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে তাজ ভাই আমাকে বিস্ময়ের চরম শিখরে পৌঁছে দিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে ফিসফিস করে আওড়ালেন,
“তাজওয়ারের অস্তিত্বের নাম।”

চলবে………………..🍁