তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব-৩৬+৩৭

0
448

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:৩৬

দরজায় হেলান দিয়ে আমি মাথা নত করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছি। মাঝে মাঝে আড়চোখে সামনের মহাবিপদকে দেখছি। মস্তিষ্ক বারবার দশ নাম্বার বিপদ সংকেত দিয়ে চলেছে। না জানি কখন এক রামধমকে লাফিয়ে উঠি। দুরুদুরু বুকে পুনরায় আড়চোখে সামনে তাকাতেই তাজ ভাই গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,
“কয়টা সাবজেক্টে ফেইল করেছিস?”
প্রশ্নটা শুনে ভয় আরও দ্বিগুণ বাড়ল। প্রথমে শান্ত কন্ঠ মানে পরে টর্নেডোর সংকেত। উত্তর খুঁজে না পেয়ে চুপ মেরে দাঁড়িয়েই রইলাম। তাজ ভাই পুনরায় প্রশ্ন করলেন,
“বলছিস না কেন?”
টর্নেডো আসার আগে যেভাবে হোক মুখ খুলতে হবে। নইলে পরে আমার চৌদ্দটা বেজে যাবে। মনে কিছু পরিমাণ সাহস জুগিয়ে মিনমিনে গলায় বললাম,
“এক সাবজেক্টে।”
“রেজাল্ট কবে দিয়েছে?”
“গতকাল।”
সঙ্গে সঙ্গে উনি ধমকে উঠলেন,
“থাপ্পড় দিয়ে যে কটা দাঁত উঠেছে সব ফেলে দিব, স্টুপিড। এক সপ্তাহ আগে রেজাল্ট দিয়েছে আর আমাকে বুঝাচ্ছিস গতকাল দিয়েছে। ভালোই তো মিথ্যা বলতে শিখেছিস। কথায় কথায় মুখ ফসকে তোর ফ্রেন্ড না বললে তো মনে হয় আগামী এক বছরেও জানতে পারতাম না।”
কথাটা শুনেই মোহনার ওপর রাগটা দ্বিগুণ বাড়ল। বাচালটা কোনো কথা পেটে রাখতে পারে না। কী দরকার ছিল তাজ ভাইয়ের সাথে এত বকবক করার? মাঝ থেকে আমাকে বড়োসড়ো এক বাঁশের বাগানের মালকিন বানিয়ে দিলো। মনে মনে যখন মোহনাকে হাজারটা বকা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ঠিক তখনই আবার সেই শক্তপোক্ত কন্ঠস্বর,
“খুব পেকে গেছিস, তাই না? পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করে না? দাঁড়া, মামুকে বলে আজই তোর বিয়ের ব্যবস্থা করছি। পড়াশোনা লাটে উঠিয়ে সংসার করবি, তা-ও ভালো। ওহ্, এতেও তো দারুণ সমস্যা আছে। তোর মতো অকর্মা মেয়ের দ্বারা সংসার হবে কি না সন্দেহ, বিরাট সন্দেহ। আজ থেকেই রান্না শিখবি। ঘরের সমস্ত কাজ শেখার পর তোকে বিদায় করব। বুঝেছিস?”
আমি এবার মাথা তুলে ভ্রুকুটি করে তাকালাম। বললাম,
“কিসের মধ্যে কী, পান্তা ভাতে ঘি। রেজাল্টের মধ্যে আবার এসব কথা ঢুকান কেন?”
“মুখের ওপর কথা বলছিস আবার”, পাশের টেবিলে সজোরে থাপ্পড় মেরে ধমকে উঠলেন তাজ ভাই।
আমি খানিক চমকে উঠলাম। মুখটা ছোটো করে মিনমিনে গলায় বললাম,
“এমন করছেন কেন? প্রশ্নগুলো খুব কঠিন ছিল। আপনি বুঝবেন কী করে?”
“না, আমি তো বুঝবই না। আমি তো জীবনে কোনোদিন পড়াশোনা করিনি। এমনি এমনি ডিটেকটিভ হয়ে গেছি। তাই না?”
আমি গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তাজ ভাই বেলকনির দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললেন,
“মামু আসুক আজ বাড়িতে। তারপর তোর ব্যবস্থা করছি। ফাঁকিবাজ মেয়ে।”
আমি চোখ বড়ো করে ছুট লাগালাম তাজ ভাইয়ের পেছনে। ততক্ষণে উনি বেলকনির রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়েছেন। আমি ওনার পাশে দাঁড়িয়ে মিনতি করে বললাম,
“শুনুন না। বাবাকে বলবেন না প্লিজ। এখন থেকে আমি খুব ভালোভাবে পড়ব, প্রমিস।”
উনি আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে বললেন,
“আমাকে পটানোর চেষ্টা করে লাভ নেই।”
“প্লিজ। আপনার সব কথা শুনব আমি, তবু দয়া করুন।”
“আমি দয়া ভিক্ষা দেই না। আর তোকে তো একদমই না।”
আমার রাগ উঠে গেল। শক্ত মুখে আপন মনে বিড়বিড় করলাম,
“শয়তান কোথাকার!”
সঙ্গে সঙ্গে তাজ ভাই সরু চোখে আমার দিকে তাকালেন। শুনে ফেললেন না কি? আমি আমতা-আমতা করতে লাগলাম। উনি হঠাৎ আমার দুই পাশে রেলিংয়ে হাত ঠেকিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালেন। ওনার শরীরের গন্ধ নাকে এসে লাগতেই আমি তীব্রভাবে চমকে উঠলাম। পরক্ষণেই ওনার গভীর দৃষ্টি দেখে সারা শরীরে কম্পন ধরে গেল। ফাঁকা ঢোক গিলে চঞ্চল দৃষ্টি এদিক-ওদিক বিচরণ করতে লাগলাম। অথচ ওনার কোনো হেলদোল নেই। মগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছেন তো আছেনই। কিছুক্ষণ উস-খুস করে আমি নিজেই কাঁপা গলায় অস্ফুট স্বরে বললাম,
“সরুন।”
“স্পর্শ তো করিনি। তবে কাঁপছিস কেন?” গভীর দৃষ্টি স্থির রেখেই কোমল কন্ঠে তীরের মতো প্রশ্ন ছুঁড়লেন তাজ ভাই।
আমার কন্ঠনালি রোধ হয়ে গেল। আমার অবস্থা দেখে উনি বাঁকা হাসলেন। খানিক ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বললেন,
“এটুকুতেই এত ভয়? যখন আরও কাছাকাছি থাকব, তখন?”
আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। কম্পিত হাতে আমি পেছনের রেলিং চেপে ধরে নতজানু হয়ে বারবার শুকনো ঢোক গিললাম। তাজ ভাই মৃদু শব্দ তুলে হাসলেন। আমার মনের শোচনীয় অবস্থা করে এখন মহারাজ বিশ্ব জয়ের হাসি হাসছেন। আবার খানিক সময় নিস্তব্ধতা বিরাজ করল। তাজ ভাই একইভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। এদিকে আমি ওনার দুহাতের মাঝে অবস্থান করে অসহায়ের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছি। নড়াচড়া করারও শক্তি পাচ্ছি না। এই লোকের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে না উনি এক চুলও নড়বেন। কিছু সময় পর বাধ্য হয়ে নিজেকেই আবার মুখ খুলতে হলো। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে নিচু স্বরে বললাম,
“সরুন, যেতে দিন। বাবা আসার সময় হয়েছে।”
“ঘড়ির কাঁটা খুব ভালোভাবে চিনি আমি। সবেমাত্র সন্ধ্যা নেমেছে”, ত্যাড়াভাবে বললেন উনি।
ওনার ত্যাড়া কথা শুনে আমার বিরক্তি আরও একধাপ বাড়ল। এভাবেই সারারাত স্ট্যাচু বানিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখবে না কি আমাকে? সাধে কি বিপজ্জনক লোক বলি? এই লোক যেখানে, বিপদ বাবাজিও সেখানে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম কীভাবে ওনাকে সরানো যায়। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মাথায় বেশ ভালো একটা বুদ্ধি উপস্থিত হলো। আমি জিব দিয়ে শুকনো ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিয়ে গলা ঝেড়ে বললাম,
“একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
তাজ ভাই মুখে উত্তর না দিয়ে চোখের ইশারায় অনুমতি দিলেন। ভাব যতসব! আমতা-আমতা করে বলেই ফেললাম,
“শ্রেয়ান ভাইয়ার কোনো খবর নেই কেন?”
তাজ ভাই চোখ দুটো সরু করতেই আমি পুনরায় বলে উঠলাম,
“না মানে, ওইদিনের পর তো আর উনি আমাদের বাড়িতে আসেননি। আমার উত্তর শোনার জন্য ফোনও করেননি। আটদিন কেটে গেল, অথচ ওনার কোনো খবরই নেই। কেন বলুন তো?”
আমি নিশ্চিত ছিলাম আমার মুখে শ্রেয়ান ভাইয়ার কথা শোনামাত্র উনি রেগে বোম হয়ে যাবেন। এ অছিলায় হয়তো আমি ছাড় পেয়ে যাব। কিন্তু তার কিছুই হলো না। আমাকে হতাশ করে দিয়ে উনি স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলেন,
“নতুন একটা কেস নিয়ে বিজি। সময় পেলে তো আসবেই। আর তোকে ফোন করে না কেন তা আমি কীভাবে জানব? কেন, তুই করিস না?”
“আমার নিজে থেকে ফোন করতে ইচ্ছে করে না। জেনেবুঝে ঢং করছেন?” কপাল কুঁচকে চুপসানো মুখে বললাম আমি।
তাজ ভাই মৃদু হেসে আমার বাঁ হাতটা নিজের ডান হাতের মুঠোয় নিলেন। স্বভাবতই চুড়ি দুটো নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। ওনার এই কাজটা দেখলে কেন জানি আমার সব রাগ উড়ে যায়। আবদ্ধ হাতের দিকে তাকিয়ে আমার ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসির রেখা ফুটে উঠল। পরক্ষণেই তাজ ভাই চুড়ি দুটোতে চুমু খাওয়ার সময় যখন আমার হাতেও ওনার ঠোঁটের স্পর্শ লেগে গেল, তখন আমি দারুণ অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রইলাম। উনি হয়তো আমার অবস্থাটা বুঝতে পারলেন। উনি আমার থেকে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়াতেই আমি আর ডানে-বায়ে তাকালাম না। ভোঁ দৌড় দিয়ে প্রস্থান করলাম। আর একটু সময় ওখানে থাকলেই হয়তো আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যেতাম। হুটহাট লোকটা এমন এমন পরিস্থিতি তৈরি করে, ঠিকমতো নিঃশ্বাস নেওয়াও মুশকিল হয়ে পড়ে। কবে যে এর থেকে আমার মুক্তি মিলবে!

_____________________________

আজ শুক্রবার। অথচ আমার ছুটি নেই। ব্রেকফাস্ট করেই তাজ ভাই আমাকে ধমকে বই নিয়ে বসিয়ে দিলেন। নিজেও ল্যাপটপ আর দুটো ফাইল নিয়ে আমার পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। তার কড়া আদেশ, আজ থেকে পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়া চলবে না। সে নিজে আমাকে পড়তে বসাবেন। কথাটা শুনেই আমার বিরক্তি তরতর করে কয়েক ধাপ বেড়ে গেল। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলাম না। উলটো মুখে প্লাস্টিক মার্কা হাসি ঝুলিয়ে সম্মতি জানাতে হলো। কারণ উনি আমার এক্সামে ফেইলের ব্যাপারটা বাবাকে না জানিয়ে আমাকে ধন্য করেছেন। আমার হয়েছে মরণ। ফোনটাও উনি নিজের জিম্মায় রেখেছেন। এদিকে আমি গাল ফুলিয়ে পা দোলাতে-দোলাতে গুনগুন করে পড়ে চলেছি। থামলেই বারবার রাম ধমক শুনতে হচ্ছে। টানা পনেরো মিনিট পড়ার পরই আমার বিরক্তি আকাশ ছুঁলো। আমি হঠাৎ পড়া থামিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বললাম,
“তাজ ভাই? শুনলাম গতকাল আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল, আর আপনি না কি না বলে দিয়েছেন? ছেলেটা না কি খুব হ্যান্ডসাম ছিল?”
তাজ ভাই ল্যাপটপ থেকে চোখ উঠিয়ে ভ্রুকুটি করে আমার দিকে তাকালেন। সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“এসব কে বলল তোকে?”
আমি দাঁত কেলিয়ে হেসে বললাম,
“রিতা।”
“ওই বিচ্ছু মেয়ের তো কাজই এসব”, কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে বললেন তাজ ভাই।
আমি বললাম,
“আমাকে তো তাড়াতে পারলে বাঁচেন। তো না বললেন কেন? হ্যাঁ বললেই তো ভালো হত। আপনিও শান্তি পেতেন, আর আমিও এসব পড়াশোনার বালাই থেকে মুক্তি পেতাম।”
সঙ্গে সঙ্গে উনি ওনার বিখ্যাত ধমক দিয়ে বলে উঠলেন,
“চাপড়ে দাঁত ফেলে দিব, বেয়াদব। বড়োদের সামনে নির্দ্বিধায় বিয়ের কথা বলতে লজ্জা করে না। মাথায় কি গোবর ঠাসা? পড়ায় ফাঁকি দেওয়ার ধান্দা সব? সোজা হয়ে বোস, পড় তাড়াতাড়ি।”
আমি সোজা হয়ে বসে চুপসানো মুখে মিনমিন করে বললাম,
“এভাবে ধমকান কেন? খারাপ কী বলেছি আমি? আমার তো বিয়ের বয়স হয়েই গেছে। এখন ধুমধাম করে বিয়ে করব, সংসার করব। তা না, কিসের পড়াশোনা করে অযথা সময় নষ্ট করছি।”
তাজ ভাই শক্ত মুখে গম্ভীর গলায় বললেন,
“ইদানীং মুখে খুব বুলি ফুটেছে দেখছি। কথায় আছে, পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে। গান কিন্তু সাথেই আছে, শুট করব?”
আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,
“আজাইরা ব্ল্যাকমেইল। আপনার সাথে যে এখন গান নেই তা আমি ভালোভাবেই জানি। কথায় কথায় ব্ল্যাকমেইল করা তো আপনার স্বভাব। মাফিয়া ডিটেকটিভ।”
“ইলু”, চোয়াল শক্ত করে ধমকে উঠলেন তাজ ভাই।
আমি মেকি হেসে বইটা কাছে টেনে নিয়ে বললাম,
“পড়ছি।”
তাজ ভাই ল্যাপটপে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে আদেশের সুরে বললেন,
“আর একটা কথাও যেন না শুনি। তাড়াতাড়ি পড়া শেষ কর। আমাকে বেরোতে হবে।”
আমি উত্তরে কিছু বলতে যাব তখনই হঠাৎ এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। চোখের সামনে দেখলাম একটা মেয়ে ছুটে এসে ‘হানি’ বলে চিৎকার করে তাজ ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরল। শুধু তাই নয়। তাজ ভাইয়ের গালে গাঢ় একটা চুমুও খেল। আমি হতবিহ্বল হয়ে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটার বেশভূষা দেখে আরও ঝটকা খেলাম। ধবধবে ফরসা মেয়েটার বয়স বোধ হয় আমার থেকে কিছু বেশি হবে। পরনে হাঁটু অব্দি একটা কালো রংয়ের স্লিভলেস টপস। চুলগুলো সোনালী রংয়ের। দেখতে কোনো বিদেশিনীর মতো লাগছে। তাজ ভাই চমকে উঠে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমার মতোই বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু পরক্ষণেই দেখলাম উনি একপ্রকার লাফিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর উচ্ছসিত কন্ঠে বলে উঠলেন,
“জেসিকা! ইউ! হাউ ইজ ইট পসিবিল ইয়ার? ইজ ইট রিয়েল?”
কথাটা বলতে বলতে তাজ ভাই এক হাতে মেয়েটাকে হালকা করে জড়িয়ে ধরলেন। মেয়েটা প্রশস্ত হেসে দ্রুত মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“ইয়েস হানি। ইটস্ রিয়েল।”
আমার মাথার মধ্যে তখন ভনভন করে চক্কর দিতে শুরু করেছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে তাজ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। মেয়েটার মুখের ‘হানি’ ডাক আর তাজ ভাইয়ের মুখের উপচে পড়া খুশি আমার বুকে এসে প্রবল ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ল। তাজ ভাই তখনও মেয়েটাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে আছেন। চোখ দুটো হঠাৎ ভীষণভাবে জ্বলতে শুরু করল। আমি কি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি? তা-ই যদি হয়‌, তবে আমি মনেপ্রাণে চাই এটা যেন দুঃস্বপ্নই থেকে যায়। তা না হলে চোখের সামনে এমন ভয়ঙ্কর দৃশ্য আমি সত্যি বলে মানতে পারব না, কিছুতেই না।

চলবে………………..🍁

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:৩৭

জেসিকা নামক মেয়েটা হঠাৎ তাজ ভাইয়ের মতো আমাকেও জাপটে ধরায় আমি হকচকিয়ে উঠলাম। পরক্ষণেই মেয়েটা আমার গালেও গাঢ় করে চুমু খাওয়ায় আমি চোখ-মুখ কুঁচকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম। মেয়েটি হাস্যোজ্জ্বল মুখে স্পষ্ট ইংরেজিতে বলল,
“হেই ইলোরা। হাউ আর ইউ?”
আমার মুখটা বিস্ময়ে হা হয়ে গেল। এই মেয়ে আমার নাম জানল কীভাবে? তাজ ভাই বলেছে না কি? কিন্তু তাজ ভাই আমার নাম এই মেয়ের কাছে বলতে যাবে কেন? আমি ফট করে উত্তর দিলাম,
“ভালো, আপনি?”
মেয়েটা আমার কথা শুনে ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে ফেলল। তারপর তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অসহায় মুখ করে বলল,
“হানি, হোয়াট ডিড সি সে?”
তাজ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ও বাংলা বোঝে না, মাথামোটা।”
আমি বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে বললাম,
“ফাইন, অ্যান্ড ইউ?”
“অলসো ফাইন। ইউ আর সো কিউট অ্যান্ড আদরাবল।”
“থ্যাংকস। ইউ আর অলসো কিউট।”
মেয়েটার মুখে আবার হাসি ফুটল। মেয়েটা পুনরায় শুদ্ধ ইংরেজি ভাষায় বেশ দ্রুত কিছু বলল। কিন্তু আমি তার এক রত্তিও বুঝতে পারলাম না। একে তো ইংরেজিতে দুর্বলতা আছে, তার ওপর আবার মেয়েটা রকেটের গতিতে কথা বলে। একটা শব্দ বোঝারও উপায় নেই। মেয়েটার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে দারুণ কোনো প্রশ্ন করে আমার উত্তরের অপেক্ষায় আছে। এবার আমার মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। চুপসানো মুখে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মহাশয় আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছেন। আমি কিঞ্চিত রাগত স্বরে বললাম,
“মজা নিচ্ছেন?”
তাজ ভাই এবার হুঁ-হা করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতেই জেসিকার দিকে তাকিয়ে ইংরেজীতে কিছু বললেন। জেসিকাও হাসিমুখে উত্তর দিলো। জেসিকার উত্তর শোনার সাথে সাথেই তাজ ভাইয়ের চোখে-মুখে উচ্ছলতা খেলে গেল। উনি আমাকে আর জেসিকাকে ফেলে রেখেই দরজার দিকে ছুট লাগালেন। তার পেছনে জেসিকাও ছুটল। আমি হাবাগোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তাদের কান্ড দেখে অগত্যা নিজেও তাদের পেছনে ছুট লাগালাম। ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই এক ঝটকা খেলাম। সোফায় বসা নর-নারীকে দেখে মনটা আনন্দে নেচে উঠল। তাজ ভাই ছুটে গিয়ে দুহাতে তাদের দুজনকে জাপটে ধরলেন। উচ্ছসিত কন্ঠে বললেন,
“ভাইয়া-ভাবি! ওহ্ মাই গড! হোয়াট অ্যা প্রেজেন্ট সারপ্রাইজ!”
রাজ ভাইয়া তাজ ভাইয়ের পিঠ চাপড়ে বলল,
“সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যই তো হুট করে চলে এলাম।”
তাজ ভাই তাদেরকে ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
“কেমন আছো তোমরা?”
জেনিফার ভাবি মিষ্টি হেসে ভাঙা ভাঙা বাংলা ভাষায় বলল,
“বালো আছি, টুমি?”
তাজ ভাই বললেন,
“এই তো, একদম ফাটাফাটি আছি। না জানিয়েই চলে এলে!”
“সারপ্রাইজ।”
আমি উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে আছি। ভেতরে চাপা উত্তেজনা থাকলেও এত বছর পর কেমন যেন বোধ হচ্ছে রাজ ভাইয়াকে দেখে। একসময় এই মানুষটা আমায় কত কাঁধে নিয়ে ঘুরেছে। এত বছর পর তার সামনে যেতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। রাজ ভাইয়া নিজেই এগিয়ে এল। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আদুরে গলায় ডেকে বলল,
“ইলু? কেমন আছিস?”
আমি ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে বললাম,
“ভালো, তুমি?”
“এই তো, দিব্যি আছি বলেই চলে আসতে পারলাম। ফোনে তো খুব বুলি আওড়াতে দেখলাম। এখন সামনে আসার পর বুলি কোথায় গেল?”
বলতে বলতে রাজ ভাইয়া এক হাত আমার অপর বাহুতে ঠেকিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরলেন। আমি হেসে ফেললাম। জেনিফার ভাবি আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“ভাইকে পেয়ে ভাবিকে বুলে গেসো ইলু?”
আমি রাজ ভাইয়ার থেকে সরে এগিয়ে গিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে ভাবিকে জড়িয়ে ধরলাম। সঙ্গে সঙ্গে সে-ও জেসিকার মতোই টুকুস করে গালে চুমু খেয়ে বসল। ইচ্ছে করল কপাল চাপড়াতে। তবু নিজেকে ধাতস্থ করে মৃদু হেসে বললাম,
“ভুলব কেন ভাবি? এমন মিষ্টি ভাবিকে ভোলা যায়? কেমন আছো?”
“ওনেক বালো, টুমি কেমন আচো?”
“ভালো।”
“জেসিকার সাঠে পরিসয় হয়েচে?”
“না”, জেসিকার দিকে তাকিয়ে বললাম আমি।
তাজ ভাই বললেন,
“ভাবির ছোটো বোন। মানে ভাইয়ার একমাত্র শ্যালিকা।”
“আচ্ছা আমি বাবাকে ফোন করে বলছি তোমাদের কথা”, ঘুরে দাঁড়িয়ে উলটো দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে কথাটা বললাম আমি।
পেছন থেকে রাজ ভাইয়া বাঁধা দিয়ে বলল,
“আমি মামুকে বলেই এসেছি। মামু আগে থেকেই জানত, তোদের বলতে নিষেধ করেছিলাম আমি।”
তাজ ভাই এগিয়ে এসে বলল,
“ব্রো, এটা একদম ঠিক করিসনি। মামুকে বললি আর আমাকে বললি না? আমাকে বললে আমি এয়ার পোর্ট থেকে রিসিভ করে নিয়ে আসতাম।”
আমি বললাম,
“আরে বললে কি আর সারপ্রাইজ হত?”
“রাখ তোর সারপ্রাইজ।”
“আপনি তো একটা মিষ্টি কুমড়া। ভালো কিছুতে ইন্টারেস্ট নেই।”
“কী বললি? আবার বল, আবার বল।”
বলতে বলতে তাজ ভাই আমার দিকে এগিয়ে আসতে নিতেই আমি দ্রুত রাজ ভাইয়ার পেছনে লুকিয়ে পড়লাম। পেছন থেকে উঁকি মেরে কপাল কুঁচকে বললাম,
“সত্য কথার ভাত নেই।”
রাজ ভাইয়া হেসে বলল,
“আচ্ছা থাম। এসেই তোদের খুনসুটি দেখতে চাই না। ফ্রেশ হতে হবে আমাদের। রুম দেখিয়ে দে। নিচে না ওপরে থাকতে হবে?”
“ওপরে।”
“আচ্ছা চল। জেসিকা, কাম অন।”
জেসিকা এবারও তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে ফটফট করে কী যেন বলল। উত্তরে তাজ ভাই বললেন,
“আমি নিচেই থাকি। নিচের কোনো রুম খালি নেই জেসি। তোমাকে ওপরেই থাকতে হবে।”
জেসিকা মুখ গোমড়া করে ওপর-নিচে মাথা দোলালো। আমার মেজাজটাই বিগড়ে গেল। বেশ বুঝতে পারলাম এই সোনালী চুলওয়ালী জেসিকা তাজ ভাই নিচে থাকে বলে নিজেও থাকতে চায়। বোনের দেবরের সাথে এত ঘেঁষাঘেঁষি কিসের? ঢং! তাজ ভাই একটা লাগেজ হাতে তুলে বললেন,
“চল আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।”
জেনিফার ভাবি বললেন,
“ইলোরা, চলো। আমরা গোলপো কোরবো।”
আমি হেসে বললাম,
“তোমরা ফ্রেশ হও গিয়ে। তারপর গল্প করা যাবে। আমি কিচেনে যাচ্ছি একটু।”
“আচ্চা।”
ওনারা চারজন ওপরে চলে গেলেন। আমি আর গেলাম না। রান্নাঘরে গিয়ে বলে এলাম রাজ ভাইয়াদের জন্যও রান্না করতে। রিতা চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
“আপু গো, ওই সোনালী চুলের মহিলা এত খচ্চর কেন?”
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
“কেন? কী করেছে?”
“এসেই গণহারে সবাইকে চুম্মা-চুম্মি দিতাছে, ইয়াক।”
আমি ফিক করে হেসে দিলাম। হাসতে-হাসতে বললাম,
“তোকেও দিয়েছে?”
পাশ থেকে মিতাও রিতার মতো মুখ করে বলল,
“সবাইকে দিয়েছে।”
মারজিয়া খালা বললেন,
“তবে এটা বুঝা গেল যে মেয়েটার মধ্যে কোনো অহংকার নেই। থাকলে আমাদের সাথে এত মিষ্টি আচরণ করত না। যদিও কথার আগামাথা কিছুই বুঝি না।”
“হেহে, আমি নিজেই বুঝি না”, মেকি হেসে বললাম আমি।
রিতা অবাক হয়ে বলল,
“তুমি বোঝো না?”
“নাহ্। ইংরেজিতে বরাবরই ফাঁকি দিয়ে এসেছি। অত ইন্টারেস্ট ছিল না। এখন মনে হচ্ছে এই জেসিকা-ফেসিকার কথার উত্তর দিতে হলে আমাকে ইংরেজি শিখতে হবে।”
মিতা-রিতা আমার কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল। মিতা বলল,
“তার মানে ওনারা যতদিন থাকবে ততদিন ওই সোনালী চুলের মেয়ের থেকে দূরে থাকতে হবে।”
“কেন?” রিতা প্রশ্ন করল।
“ইংরেজি থেকে বাঁচার জন্য।”
“আরে ধুর। ওই মহিলা ইংরেজিতে ফটর-ফটর করলে আমিও বাংলায় ফটর-ফটর করতে থাকব। ওই মহিলাও তো বাংলা বোঝে না। আমার বাংলা ফটর ফটর শুনলে এমনিতেই চুপ মেরে যাবে।”
“আর আমি?” অসহায় মুখ করে বললাম আমি।
রিতা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“তুমি বড়ো ভাইয়ার থেকে অর্থ জিজ্ঞেস করে নিবে। তারপর বাংলায় উত্তর দিয়ে বড়ো ভাইয়াকে বলবে ইংরেজি বলে দিতে।”
মারজিয়া খালা বললেন,
“রিতা, তাজ বাবাকে বড়ো ভাইয়া, বড়ো ভাইয়া করেছ এতদিন। এখন তো তারও বড়ো ভাইয়া এসে গেছে।”
রিতা মাথা চুলকে বলল,
“তাই তো! তাহলে এখন বড়ো ভাইয়ার বড়ো ভাইয়াকে কী ডাকব?”
আমি শব্দ তুলে হেসে বললাম,
“বড়ো ভাইয়ার বড়ো ভাইয়াই ডাকিস।”
“ওহ্! ভালো বুদ্ধি দিয়েছ তো আপু।”
মারজিয়া খালা প্রশ্ন করলেন,
“রাজ বাবার বউ এত সুন্দর বাংলা বলে কীভাবে রে?”
আমি হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললাম,
“তার বাবা-মা তো বাঙালি। সে তার মায়ের থেকে একটু-আধটু বাংলা শিখেছে। বাকিটা রাজ ভাইয়ার অবদান। বউকে পুরো বাংলা ভাষা শিখিয়ে ছেড়েছে সে।”
“তাহলে ওই সোনালী চুলের মহিলা শিখল না কেন?” রিতা ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করল।
আমি ঠোঁট উলটে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম,
“কী জানি! আমি তো তাকে চিনতামই না। আজকেই জানলাম ভাবির একটা ছোটো বোন আছে।”
মিতা বলল,
“বাড়িতে ঢুকেই বড়ো ভাইয়াকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে দেখলাম।”
আমার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। ‘একটু তাড়াতাড়ি রান্না শেষ কোরো’ বলেই গটগট করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

_______________________________

আজকের দিনটা অন্য দিনগুলোর থেকে একটু বেশিই সুন্দর ছিল। নাহ্, একটু বললে ভুল হবে। অনেক বেশি সুন্দর। রাজ ভাইয়াদের সবার সাথে হাসি-গল্প-আড্ডায় বাড়িটা কেমন আনন্দমুখর হয়ে উঠেছে! বাবার মুখে বিস্তর হাসি। মনে হচ্ছে এ বাড়িতে আজ সম্পূর্ণ একটা পরিবার গড়ে উঠেছে। শুধু জেসিকার সব কথা বুঝতে না পারায় আমাকে বারংবার কপাল চাপড়াতে হয়েছে। তবে যতটুকু বুঝলাম, মেয়েটার ব্যবহার সত্যিই খুব মিষ্টি। খুবই মিশুক প্রকৃতির মেয়ে সে। দোষ একটাই, তাজ ভাইয়ের সঙ্গে অতিরিক্ত ঘেঁষাঘেঁষি করে। আর ওই লোকও মোমের মতো গলে যায়। জেসিকার সাথে হেসে হেসে কী মিষ্টি ভঙ্গিমায় কথা বলে! এভাবে কোনোদিন আমার সাথে এক সেকেন্ডও কথা বলেছে বলে আমার মনে পড়ে না। এই বজ্জাত লোক প্রশ্রয় দেয় বলেই জেসিকা এমন ঘেঁষাঘেঁষি করার উৎসাহ পায়। ইচ্ছে করে দুটোকেই চুবিয়ে মারি। আমার এই আনাড়ি ইচ্ছে তখনই বিগড়ে গেল, যখন দেখলাম সন্ধ্যার পর রাজ ভাইয়া আর তাজ ভাইয়ের সাথে জেসিকাও ঢেং-ঢেং করে বাইরে চলে গেল। আর মহারাজ আমাকে হুকুম করে গেছেন উনি ফেরার আগে যেন আমি পড়া শেষ করি। কে শোনে কার কথা? এতকিছুর পরও আমি ওনার হুকুম পালন করব? অসম্ভব। এমনিতেই রাগে মাথা ধপধপ করছে। না জানি কখন আবার ফেটেই যায়। রাগে-দুঃখে ফুঁসতে ফুঁসতে আমি বইখাতা ফেলে রেখে গাল ফুলিয়ে বসে রইলাম। তবে বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। জেনিফার ভাবি ডেকে নিয়ে গল্প জুড়ে দিলো। রাজ ভাইয়ারা ফিরল রাত সাড়ে নয়টার দিকে। রাজ ভাইয়া রুমে চলে গেল ফ্রেশ হওয়ার জন্য। আর তাজ ভাই রুমে যাওয়ার আগে আমাকে হুকুম করে গেলেন তার জন্য চা করে নিয়ে যেতে। মুখের ওপর বলতে ইচ্ছে করল ‘পারব না।’ তবু বললাম না। বাইরে থেকে এসেছে, মাথা ব্যথা-ট্যথা করলে আবার সমস্যা। মনে মায়ার উদয় হওয়ায় চুপচাপ গিয়ে চা করে রুমে নিয়ে গেলাম। রুমে ঢুকেই আবার মেজাজটা বিগড়ে গেল। রাগে মাথাটা দপ করে জ্বলে উঠল। জেসিকা তাজ ভাইয়ের বিছানার একপাশে বালিশের সাথে হেলান দিয়ে বসে ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করতে ব্যস্ত। ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকিয়ে বুঝলাম তাজ ভাই ওয়াশরুমে আছেন। আর এরইমধ্যে এই মেয়ে বোধ হয় কোনোরকমে ফ্রেশ হয়ে আবার এসে গেছে ঘেঁষাঘেঁষি করতে। আমি এগিয়ে যেতেই জেসিকা মিষ্টি করে হেসে বলল,
“হেই ইলোরা। আর ইউ লুকিং ফর হানি?”
জেসিকার এই কথাটা বুঝতে পেরে আমি স্বস্তি পেলাম। রাগটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে চোয়াল শক্ত করে মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম,
“ইয়াহ্।”
মনে মনে আল্লাহকে ডাকলাম। এই মেয়ে না আবার এখন ফটর-ফটর শুরু করে। তখনই ওয়াশরুমের দরজা খুলে তাজ ভাই বেরিয়ে এলেন। ওনাকে দেখে রাগটা তরতর করে আরও একধাপ বেড়ে গেল। ‘আপনার চা’ বলে চায়ের কাপটা শব্দ করে বেড সাইড টেবিলে রাখলাম। যেন আমার চাপা রাগটা ওনাকে বুঝানোর ক্ষুদ্র প্রয়াস এটা। আমি আর ওখানে দাঁড়ালাম না। ওনাদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত প্রস্থান করলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম ডিনার করব না। ডিনার টেবিলে বসে আবার এদের নাটক দেখার আর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার। যখন দেখলাম বাবা আর রাজ ভাইয়া ডিনার টেবিলে বসেছে আর ভাবি তাজ ভাইয়ের রুমে যাচ্ছে তাদের ডাকতে,‌ তখনই আমি না খাওয়ার বিভিন্ন অজুহাত দাঁড় করিয়ে ওখান থেকে কেটে পড়লাম। বাবা আর রাজ ভাইয়া প্রথমে জোর করলেও পরে যখন বললাম সন্ধ্যায় ভাবির সাথে হালকা খাবার খাওয়ায় পেট ভরে গেছে। তখন দমে গেল। আমিও শুধু জেমির খাবারটুকু নিয়ে চুপচাপ রুমে চলে এলাম। জেমিকে খাইয়ে চুপটি মেরে শুয়ে পড়লাম। মনে মনে আল্লাহকে বললাম, ওই শয়তানটা যেন আবার খাওয়ার জন্য ডাকতে না আসে। ওনার তো আবার আমার খাওয়ার সাথে দারুণ বন্ধুত্ব। যেন একবেলা না খেয়ে থাকলেই বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবে। আমার দোআ হয়তো কবুল হলো। পনেরো মিনিট কেটে যাওয়ার পরও যখন দেখলাম তাজ ভাই আসেননি, তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আপাতত সব রাগ-দুঃখ মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে, চোখ বন্ধ করে ঘুমের প্রস্তুতি নিলাম।

চলবে………………….🍁