দিওয়ানেগি পর্ব-৪৩+৪৪+৪৫

0
522

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৪৩+৪৪+৪৫
#M_Sonali

ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য সবার সাথে বসে অপেক্ষা করছে মেহরিমা। মাথার মধ্যে নানারকম টেনশন কাজ করছে তার। সেইসাথে বুকের ভেতরে ধুকপুকুনি শুরু হয়েছে অনেক আগে। ভীষণ রকম ভয় করছে। কেন জানেনা বারবার মনে হচ্ছে ইন্টারভিউতে সে টিকতে পারবেনা। মেহেরকে দেওয়া সব আশা আকাঙ্ক্ষা টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে মিশে যাবে। চুপচাপ বসে থেকে এসব কথা ভাবতে ভাবতেই চোখের সামনে যেন গতকালকের দৃশ্যগুলো ভেসে উঠলো মেহরিমার।

গতকাল সরণকে অনেক বকাবকি করে তাড়িয়ে দেওয়ার পর। মেহেরকে নিয়ে বাসায় ফিরে সে। বাসার গেটের সামনে পৌঁছতেই দেখতে পায় ময়না বেগম ও খাদিজা বেগম অপেক্ষা করছে। ওদেরকে দেখে যেন তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে তারা। আবারও নানা রকম কথা শোনাতে থাকে। এবার আর মেহরিমা কোন উত্তর দেয় না। চুপচাপ মেহেরকে নিয়ে বাসার মধ্যে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেয়। এতে যেন আরো ক্ষিপ্ত হয়ে তারা এলাকাবাসীকে ডেকে এনে বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। বারবার বলেন, ওরা যদি এলাকা ছেড়ে না যায় তাহলে ওদের এক ঘরে করে দেওয়া হবে।

এসব ঘটনা দেখে মেহের অনেক কান্না করতে শুরু করে। মেহরিমারও চোখে পানি চলে আসে। ওই সময় যেন পৃথিবীর সবচাইতে অসহায় বলে মনে হচ্ছিল নিজেকে। বারবার চিৎকার করে কান্না করে বাবা-মাকে ডাকতে ইচ্ছা করছিল তার। কিন্তু মেহেরের জন্য সেটাও করতে পারেনি। নিজেকে যতটা সম্ভব শান্ত রেখে মেহের কে বোঝানোর চেষ্টা করেছে সে। বুঝিয়েছে কাল সে ভালো একটি চাকরি পাবে। তারপর ওই বাসা ছেড়ে আলাদা বাসা ভাড়া করে মেহেরকে নিয়ে থাকবে সেখানে। এতে মেহের ভীষণ খুশি হয়েছে। আনন্দের সাথে সকালে স্কুলে গিয়েছে সে। কিন্তু মেহরিমা এখন টেনশনে আছে। সে যদি এই দশজনের মধ্যে টিকতে না পারে? যদি এই চাকরিটা না পায়! তাহলে কিভাবে বাসা ভাড়া করে থাকবে? কিভাবে পূরণ করবে মেহেরকে দেওয়া কথা।

কথাগুলো ভেবে যেন মেহরিমার মাথা ঘুরতে শুরু করছে। সে যতই চাচ্ছে নিজেকে শান্ত রাখার। ইন্টারভিউয়ের দিকে মনোযোগ দেওয়ার। ততই যেন ওর মন বারবার গুলিয়ে যাচ্ছে। ভীষণরকম মাথা ঘুরছে টেনশনে। হঠাৎ নিজের নাম ধরে ডাকতে শুনে ধ্যান ভাঙে তার। ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য ডাক পড়েছে। মেহরিমা এবার চোখ বন্ধ করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজেকে যতটা সম্ভব শান্ত করে নেওয়ার চেষ্টা করে উঠে দাঁড়ায়। তারপর ডেস্কের মধ্যে ঢুকে সালাম দেয় সে। ডেস্কে দুজন মধ্য বয়সি পুরুষ এবং একটি মেয়ে বসে আছে। যারা ইন্টারভিউ নিচ্ছে। ওকে আসতে দেখে তিনজনেই মুচকি হাসি দেয়। মেয়েটি দাঁড়িয়ে ইশারা করে বলে,

“আপনি এখানে বসুন ম্যাম।”

ওনার এমন আচরনে মেহরিমা বেশ অবাক হয়। কিন্তু কিছু বলে না। চুপচাপ গিয়ে ওনার দেখানো চেয়ারে বসে পরে।

মেহরিমা নিজের হাতে থাকা কাগজপত্র গুলো উনাদের সামনে এগিয়ে দেয়। সবাই ওর কাগজপত্র গুলো নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে। তিন জনের মুখে মুচকি হাঁসি। মেয়েটি ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি কন্ঠে বলে ওঠে,

“কনগ্রেচুলেশন ম্যাম। আপনি আমাদের বসের পার্সোনাল এসিস্টেন্ট হিসেবে সিলেক্ট হয়েছেন। আগামীকাল থেকে চাকরিতে জয়েন করতে পারেন। তবে আমাদের কিছু কন্ডিশন আছে। যেগুলো আপনাকে পুরন করতে হবে এই জবটা করতে চাইলে।”

মেহরিমা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। কারণ ওকে তো তারা কোন রকম প্রশ্নই করেনি। অথচ ডাইরেক্টলি বলে দিচ্ছে সে চাকরিটা পেয়ে গেছে! তাও আবার পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট! মেহরিমা ভ্রু কুচকায়। সন্দেহের দৃষ্টিতে ওনাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“কিন্তু আপনারা তো ইন্টারভিউ তে আমাকে কোন প্রশ্নই করলেন না। তাহলে আমি সিলেক্ট হলাম কি করে?”

ওর কথার উত্তরে তিনজনের মাঝের মাঝখানে বসে থাকা লোকটি মুচকি হেসে বলে ওঠে,

“সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি সিলেক্ট হয়ে গেছো। তোমার কাগজপত্র বায়োডাটা দেখে আমাদের ভালো লেগেছে। তাই তোমাকে সিলেক্ট করা হলো। কাল থেকে চাকরিতে জয়েন করতে পারো। জয়েন করার পরেই, তুমি আমাদের কম্পানির তরফ থেকে একটি ফ্ল্যাট বাড়ি, অফিসে যাতায়াত এর জন্য একটি প্রাইভেট কার পেয়ে যাবে। আর তোমার মাসিক বেতন ৩৫ হাজার টাকা। তবে তার আগে তোমাকে আমাদের কিছু ফরম পূরণ করে দিতে হবে।”

মেহরিমার মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে ও যেন স্বপ্ন দেখছে। সবকিছুই স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে তার। যেনো ও যা চেয়েছিল তার চাইতে হাজারগুণ বেশি পেয়ে যাচ্ছে বিনা পরিশ্রমে। মেহরিমার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। চোখে পানি টলমল করছে। এ যে খুশির অশ্রু। সে কিছু বলার মতো পরিস্থিতিতে নেই খুশিতে। তবুও নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে নেয়। তারপর উচ্ছাসিত কন্ঠে বলে,

“কি কন্ডিশন আছে আপনাদের। কিসের ফরম পুরণ করতে হবে? দিন আমি পুরণ করে দিচ্ছি।”

“তেমন কিছু নয়। এই যে ফরমটি দেখতে পাচ্ছেন। এখানে লেখা আছে আপনি যে জবটা নিচ্ছেন। সেটা কোন পরিস্থিতিতেই অন্তত এক বছরের আগে ছেড়ে যেতে পারবেন না। কারণ আমাদের কম্পানিতে কেউ জব নিলে সেটা এক বছরের আগে ছাড়তে পারবে না। যদি ছাড়ার চেষ্টা করে, তাহলে কোম্পানিকে তার ৫০ লক্ষ টাকা দিয়ে যেতে হবে। আপনাকে এখানে সিগনেচার করতে হবে। তবে ভাববেন না এতে আপনার কোন সমস্যা হবে না। এটা শুধুমাত্র আপনাকে যে ফ্ল্যাট ও গাড়ি দেওয়া হবে সেগুলোর জন্য।”

এবার মেহরিমা কিছুটা টেনশনে পড়ে যায়। সই করবে কি করবে না এমন ভাবনায় কিছুক্ষণ চুপ থাকে সে। তারপর চিন্তাভাবনা করে সিগনেচার টা করেই দেয়। ওখানে সিগনেচার করা হয়ে গেলে সবার মুখে যেন বিজয়ের হাসি ফুটে ওঠে। মেয়েটি খুশি হয়ে বলে ওঠে,

“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ম্যাম। আমাদের কন্ডিশনটা মানার জন্য। আপনি কালকে সকাল থেকে চাকরিতে জয়েন করতে পারবেন। কাল অফিসে এলে আমাদের বস আপনাকে সব কাজ বুঝিয়ে দিবে। আর কালকেই আপনাকে গাড়ি এবং নতুন ফ্ল্যাটের চাবি দেওয়া হবে। এখন আপনি আসতে পারেন।”

মেহরিমা খুশিতে গদগদ হয়ে যায়। মুখে আনন্দের এক চিলতে হাসি নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা বাজারে চলে যায় সে। বাজার থেকে এক কেজি মিষ্টি কিনে বাসায় ফিরে আসে। মেহের শুনে কতটা খুশি হবে সেটা ভেবেই যেন আনন্দে বুকটা ভরে যায় তার।

মেহরিমা অফিস থেকে বেরিয়ে চলে যেতেই। ইন্টার্ভিউ নেওয়া মেয়েটি কেউ একজনের কাছে ফোন করে। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হতেই মেয়েটি উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলে,

“স্যার আপনার কাজ হয়ে গেছে। আপনি ঠিক যেমন যেমন বলেছিলেন, আমরা ঠিক তেমনটাই করেছি। আর ম্যাম কাগজে সিগনেচার করে দিয়েছেন।”

মেয়েটির কথা শুনে ও প্রান্তে থাকা লোকটার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে ফোনটা কেটে দিয়ে পিছন দিকে সোফার সাথে হেলান দিয়ে বসে। উপর দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে বলে,

“এবার কোথায় পালাবে জান? তোমাকে তো ঘুরে ফিরে সেই আলমির এর কাছেই ফিরে আসতে হবে। এবার দেখব আমার দিওয়ানগি থেকে তুমি কিভাবে পালাতে পারো।”
,
,
,
সকাল ৯:৩০ মিনিট
নিজেকে অনেক সুন্দর করে রেডি করে অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়েছে আলমির। আজ যে তার প্রিয়তমার সাথে নতুন করে দেখা হবে। যেন কত বছর পর দেখা হবে তার সাথে। ভালবাসাটা যেন নতুন করে শুরু হবে আজ। তাই নিজেকে যতটা সম্ভব স্মার্ট এবং হ্যান্ডসাম দেখানোর চেষ্টা করেছে সে। গাড়ি নিয়ে অফিসের কাছাকাছি পৌছে যখনই গাড়ি থেকে নামবে। তখনই হঠাৎ তার ফোনটা বেজে উঠল। ফোনের শব্দে বেশ বিরক্ত হলো সে। তবুও ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বললো। ওপাশ থেকে বলা কথাগুলো শুনতেই মুহূর্তে যেন তার মুখটা রাগে রক্তবর্ণ ধারণ করল। সে গাড়ি থেকে না নেমে ড্রাইভারকে বললো একটি জায়গায় নিয়ে যেতে।
,
,
প্রায় ২ ঘন্টা পর অনেক দূরে একটি নিরিবিলি জায়গায় একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল গাড়িটা। আলমির দেরি না করে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতর দিকে হাটতে শুরু করলো। তার পিছুপিছু ১০-১২ জন গার্ডও আসলো। বাসার দরজায় ঠকঠক করতেই ভেতর থেকে একজন দরজা খুলে দিল। ভিতরে গিয়ে দেখল অন্ধকারে রুমের মাঝখানটায় একজনকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার গালে এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় মাইরের দাগ। আলমির সোজা দৌড়ে গিয়ে তার বুকের উপর সজোরে লাথি মেরে দিল। ফলে চেয়ার উল্টে পিছনদিকে আছড়ে পরলো লোকটি। চিৎকার করে উঠে কাশতে শুরু করল সে। কিন্তু নড়ার মতো ক্ষমতা নেই তার। তাই সে ভাবেই পড়ে রইলো। আলমির দেরি না করে তাকে এক হাতে টেনে তুলে কলার চেপে ধরে মুখে একটা ঘুষি মেরে দিল। তারপর চিৎকার করে বললো,

“তোকে কুচি কুচি করে রাস্তার কুকুরকে খাওয়ালেও আমার মনে শান্তি আসবেনা। কি ভেবেছিলি শয়তান দিপু। তোকে আমি ধরতে পারবো না? তুই আমার মায়ের জীবনই শুধু শেষ করিস নি, সাথে আমার বাবা ছোট ভাই ও আমার দিদুনের জীবনটাও শেষ করেছিস। আমার জীবনটাকেও জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছিস। কি ভেবেছিলি সারা জীবন এভাবে আড়ালে লুকিয়ে থাকবি? তোর কোন হদিস পাবোনা আমি? আজকে বুঝবি কষ্ট কাকে বলে। যতটা কষ্ট তুই আমার মা-বাবা ভাই কে দিয়েছিস, তার চাইতে হাজারগুণ বেশি কষ্ট দিয়ে তিলে তিলে মারবো তোকে। তুই ভাবতেও পারবি না তোর মৃত্যু টা কতটা ভয়ানক হবে। কিন্তু তার আগে বল, তোর সাথে আর কারা আছে? কারা আমাকে মারার চেষ্টা করছে?”

ওর হাতের এমন ঘুষি এবং ভয় দেখানো শুনেও দীপু খলখলিয়ে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতেই মাতাল কন্ঠে উত্তর দেয়,

“তুই কি ভেবেছিস আলমির! আমাকে মেরে ফেললে সবকিছু শান্ত হয়ে যাবে? কখনোই না। তোর মৃত্যু অনিবার্য। তুই কল্পনাও করতে পারবি না তোর আসল শত্রু কারা। আর তাদের সাথে তুই কিভাবে জড়িয়ে আছিস। তারা তোকে এত সহজে মারবে না। তবে তোকে ভালোবাসার তোর শুভকাঙ্খী যারা থাকবে সবাই কে একে একে শেষ করবে তারা। প্রথমে তোকে একবারে একা করে ফেলবে। তারপরে তোকেও তিলে তিলে হত্যা করবে। তোর সমস্ত সম্পত্তি তাদের করে নিবে। শুধু অপেক্ষা কর। আমি তোকে দেখে ভয় পাই না। আমাকে মেরে ফেললেও আমি বলবো না তারা কারা। তাই বৃথা চেষ্টা করে লাভ নেই।”

এতোটুকু বলতেই ওর নাকের ওপরে সজোরে একটি ঘুষি মেরে দেয় আলমির। ফলে নাক থেকে গলগল করে রক্ত গড়িয়ে পড়তে থাকে। তাতেও যেন দিপুর কিচ্ছু হয়না। সে এখনো দাঁত কেলিয়ে হেসে যাচ্ছে। এতে আলমির আরও রাগে জ্বলে ওঠে। ওকে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি লাথি মারতে থাকে। অনেকক্ষণ এভাবে মারার পর প্রায় আধ মরা হয়ে ফ্লোরে পড়ে যায় দিপু। আলমির তার উপরে গিয়ে ওর চুলের মুঠি ধরে ঝাকিয়ে বলে,

“বল কারা তারা? আর এরপরের টার্গেট কে তাদের? কাকে মারতে চায় তারা? আমাকে ভালোবাসার মতো আর কে আছে? সবাইকে তো তোরা মেরেই ফেলেছিস।”

কথাটি বলতেই মনের মাঝে মেহরিমার কথা ভেসে ওঠে আলমির এর। সাথে সাথে যেন বুকের মাঝে ছ্যাত করে ওঠে তার। সে দ্রুত বলে ওঠে,

“তোরা কি মেহরিমা কে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছিস? ওর গায়ে যদি একটা ফুলেরও টোকা পড়ে তাহলে ধ্বংস করে ফেলব সব। তোর সঙ্গী সাথিরা যেখানেই লুকিয়ে থাকুক না কেনো কাউকে ছাড়বো না। সবাইকে জ্বালিয়ে ছাই করে ফেলবো।”

ওর কথার উত্তরে দিপু কিছু বলে না। তার অবস্থা খুবই খারাপ। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে বলে,

“মেহরিমার কিছুই হবে না। ও যেমন তোর জান পাখি। তেমনি সেই দুজনেরও জান পাখি যারা তোর সবচাইতে বড় শত্রু। মেহরিমা কে তুই যতটা না ভালোবাসিস তার চাইতে বেশি ভালোবাসে তারা ওকে। তাই ওর কিছুই হবে না। কিন্তু তোর কি হবে সেটা একবার ভাব।”

কথাটা বলেই একটি ক্রিমিনালি হাসি দিয়ে জ্ঞান হাড়িয়ে ফেলে দিপু।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৪৪
#M_Sonali

সকাল সকাল রেডি হয়ে অফিসের জন্য বের হতেই ময়না বেগম এবং খাদিজা বেগম এর সাথে একদফা কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে মেহরিমার। তবুও সে আজ দমে যায়নি। সব শেষে তাদের বলে এসেছে সে আজ বিকেলেই বাসা চেঞ্জ করে ফেলবে। এখানে আর থাকবে না। এমন জঘন্য মানুষের মাঝে জঘন্য পরিবেশে থাকার ইচ্ছা নেই তার। শুধুমাত্র বাবা মায়ের স্মৃতি বলেই বাড়িটা বিক্রি করবে না সে। ওর কথার উত্তরে তারা ভীষণ খুশি হয়েছে। তারাও যে চায় ওরা সেখান থেকে চলে যাক।

কিছুটা মন খারাপ নিয়েই মেহেরকে নিয়ে অফিসে পৌঁছায় মেহরিমা। আজ মেহেরের স্কুল ছুটি। তাই ওকে আর রেখে আসা হয়নি। সাথে করে নিয়ে এসেছে। যদিও মনের মধ্যে এক রকম ভয় কাজ করছে তার। অফিসের যদি কেউ কিছু বলে? তারওপর আজকে অফিসে তার প্রথম দিন। তাই মেহেরকে আগে থেকেই বুঝিয়ে নিয়ে এসেছে। সে যেন একদম চুপচাপ বসে থাকে। প্রয়োজন হলে তাকে একাই বাসায় পাঠিয়ে দেবে মেহরিমা।

অফিসের ভেতর প্রবেশ করতেই অফিসের সকল স্টাফ গুলো এমন ভাবে দাঁড়িয়ে মেহরিমাকে সালাম দেয়। যেন মেহরিমা এই কোম্পানির মালিক। সে বেশ অবাক হয়। সবার সালামের উত্তর নিয়ে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। তখনই পেছন থেকে ওর হাত টেনে ধরে মেহের। আস্তে করে ফিসফিস করে বলে ওঠে,

“কি ব্যাপার আপু! সবাই তোমাকে এত সম্মান করছে কেন বলতো? তুমি কি অফিসের বস নাকি?”

কথাটি বলেই মিটিমিটি হাসে মেহের। ওর হাসি দেখে চোখ গরম করে ওকে ইশারায় চুপ করতে বলে মেহরিমা। ও চুপ করে যায়। দুবোন মিলে হেঁটে হেঁটে সামনে এগিয়ে যায়। একটি ডেস্কের সামনে যেতেই কাচের ভিতর দিয়ে দেখে, গত কালকের ইন্টারভিউ নেওয়া সেই মেয়েটি বসে আছে। সে দিকেই এগিয়ে যায় মেহরিমা। দরজায় হালকা টোকা দিতেই মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে ওদের ভেতরে আসার অনুমতি দেয়। ওরা ভিতরে যেতেই মেয়েটি সালাম দিয়ে মুচকি হেসে বলে,

“কেমন আছেন ম্যাম? আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”

মেহরিমা এবার আরেক দফা অবাক হয়। এবার আর নিজের কৌতুহল চেপে রাখতে পারেনা সে। তাই প্রশ্ন করে বলে ওঠে,

“সরি ম্যাম, কিছু মনে না করলে একটি প্রশ্ন করতে পারি?”

ওর কথার উত্তরে মেয়েটি দ্রুত বলে উঠে,

“প্লিজ আমাকে ম্যাম বলে ডাকবেন না ম্যাম। আমার নাম পূর্ণিমা। আপনি আমাকে পূর্ণিমা বলেই সম্মোধন করবেন। আর বলুন কী বলতে চান। অনুমতির প্রয়োজন নেই।”

“আসলে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। অফিসের সবাই আমাকে এমন ভাবে সম্মান দিচ্ছে, যেন আমি এই অফিসের মালিকের আত্মীয়। আর আপনিও গতকাল থেকেই আমাকে ম্যাম ম্যাম বলে ডাকছেন। আমি কিছু বুঝতে পারছিনা। সবার এমন আচরনের কারণ কি?”

ওর কথার উত্তরে পূর্ণিমা মুচকি হাসে। ওর হাতটা আলতো করে ধরে বলে,

“আপনারা এখানে বসুন। তারপর আমি সব বুঝিয়ে বলছি।”

ওনার কথার উত্তরে মেহরিমা কিছু বলে না। মেহেরকে নিয়ে সামনে থাকা চেয়ারে গিয়ে বসে। সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে। মেয়েটি নিজের জায়গায় গিয়ে বসে মুচকি হেসে উত্তর দেয়,

“আসলে আপনার পোস্ট টা আমাদের অফিসের সবার চাইতে বড় পোস্ট। মানে বাকি সবাই আপনার নিচের স্থানে কাজ করে। তাই আপনাকে সবাই এত সম্মান দিচ্ছে ম্যাম। তাছাড়া আর কিছু নয়। আর বাকিটা স্যার আসলে বুঝতে পারবেন। একটা কথা তো বলতে ভুলেই গেছি। আজকে হয়তো স্যারের আসতে দেরি হবে। স্যার ফোন করে বলে দিয়েছে আপনার নতুন ফ্ল্যাট এবং গাড়ির চাবিটা বুঝিয়ে দিতে। গাড়ির চালানোর জন্য একজন ড্রাইভার কেও রাখা হয়েছে।”

উনার কথার উত্তরে মেহরিমা কিছু বললোনা। ভাবনায় পড়ে গেল সে। ওকে চুপ থাকতে দেখে মেয়েটি আবারও হেসে দিয়ে বলে উঠলো,

“ম্যাম স্যারের আসতে হয়তো আজকে অনেক লেট হবে। উনি বলেছিলেন আপনার ফ্ল্যাটটা দেখিয়ে দিতে। সাথে গাড়িটাও হাতে তুলে দিতে। চলুন আমার সাথে, আপনাকে আপনার জিনিসগুলো বুঝিয়ে দিয়ে আসি।”

কথাটি বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। মেহরিমা কোন প্রকার কথা না বলে মেহেরকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর ওর সাথে রওনা হল ফ্ল্যাট দেখার উদ্দেশ্যে।
,
,
দোতালা একটি বাংলো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেহরিমারা। বাড়িটা অনেক বড় আর চারি দিক থেকেই অনেক সাজানো-গোছানো সুন্দর। বাড়িটাতে অনেকগুলো কাজের লোক ও গেটম্যান রয়েছে। দেখে মনেই হচ্ছে না এটা ওকে কম্পানির তরফ থেকে থাকার জন্য দেওয়া হচ্ছে। মেহরিমা বেশ অবাক হল পূর্ণিমার দিকে তাকিয়ে বলল,

“পূর্ণিমা আপু আপনি যেমনটা বলেছেন এটাতো ঠিক তার উল্টো। দেখে মনে হচ্ছে না এটা কোন ফ্ল্যাট বাড়ি। যেটা চাকরির ক্ষেত্রে দেওয়া হয়েছে। বরং দেখে মনে হচ্ছে এটা আলিশান কোন বাংলোবাড়ি। সত্যি আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।”

ওর কথার উত্তরে পূর্ণিমা কিছু বলবে তার আগেই তার ফোনটা বেজে উঠল। এক্সকিউজ মি, বলে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে আলমির দ্রুত মেহরিমা কে নিয়ে অফিসে পৌঁছাতে বলল। পূর্ণিমা ওকে বলে ফোনটা কেটে দিয়ে বলল,

“ম্যাম অফিসের স্যার পৌঁছে গেছেন। আপনাকে নিয়ে অফিসে যেতে বললো। চলুন।”

মেহরিমা আর কোন প্রশ্ন করল না। মনের মধ্যে নানারকম খুতখুত ও চিন্তা ভাবনা নিয়ে রওনা হল অফিসের উদ্দেশ্যে।
,
,
,
মেহেরকে পূর্ণিমার ডিস্কে বসিয়ে রেখে স্যারের সাথে দেখা করতে তার ডেস্কে গেলো মেহরিমা। দরজার কাছে যেতেই বুকের মাঝে কেন জানেনা ভীষণরকম ধুকপুকানি শুরু হলো তার। অজানা এক ভয়ে শরীর ঘামতে লাগলো। তবুও বুকে সাহস নিয়ে দরজায় টোকা দিল সে। কিন্তু ভেতর থেকে কোন শব্দ পেল না। তাই ভিতরে একটু উঁকি দিয়ে বলল,

“মি আই কাম ইন স্যার?”

কিন্তু এবারও কোন উত্তর পেলনা। লোকটি অন্যদিকে ঘুরে বসে আছে। মাথার চুলগুলো ছাড়া শরীরের আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মেহরিমা বেশ বিরক্ত হলো। একটু জোরে চিউকার করে বলে উঠলো,

“স্যার আমি কি ভিতরে আসতে পারি?”

লোকটি এবার মুখে কিছু বলল না। হাত দিয়ে ইশারা করে তাকে ভেতরে আসতে বললো। মেহরিমা ভিতরে এসে ওর কাছাকাছি গিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড়ালো। হালকা গলা খাকারি দিয়ে বলল,

“স্যার আমাকে ডেকেছেন? আমি মেহরিমা। আপনার নতুন পিএ।”

আলমির অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেও তার বুকের মাঝের ধুকপুকানিটা যেন বেড়েই চলেছে। সেইসাথে মেহরিমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে মুখে এক বিশ্বজয়ী হাসি ফুটে উঠেছে। তার ইচ্ছে করছে এখনই দৌড়ে গিয়ে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। নিজের ভালোবাসায় রাঙিয়ে দিতে। কিন্তু নিজেকে যতটা সম্ভব সংযত করে রাখল আলমির। তারপর চেয়ার ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকাল। দেখল ও নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আলমির মুচকি হেসে আবেগি কন্ঠে বললো,

“welcome my dear personal assistant.”

আলমিরের কন্ঠ শুনতেই যেন এক মুহূর্তের জন্য হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেল মেহরিমার। বুকের মধ্যে ধক করে উঠলো তার। সে দ্রুত সামনে তাকাতেই যেন পুরো আকাশ ভেঙ্গে পড়ল তার মাথায়। আলমির মিষ্টি হেসে তার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। হাত পা কাঁপতে শুরু করলো মেহরিমার। সে যেন এই পরিস্থিতির কথা কল্পনাও করতে পারছে না। হা করে তাকিয়ে রইল আলমিরের দিকে। মুখে কোন কথা নেই।

ওর অবস্থা দেখে আলমির বেশ মজা পাচ্ছে। সে নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে ওর পাশে এসে দাঁড়াল। টেবিলের ওপর হালকা করে বসে ওর সামনে চুটকি বাজিয়ে বলল,

“কি হল আপনার? কোথায় হারিয়ে গেলেন আপনি?”

কথাটি বলেই একটি টেডি হাসি দিল আলমির। মেহরিমার যেন এতক্ষণ হুশ ফিরলো। সে দু পা পিছিয়ে গিয়ে রাগি চোখে তাকাল ওর দিকে। শক্ত কন্ঠে বলল,

“এসবের মানে কি? আপনি এখানে কি করছেন? এই কম্পানিটা তো আপনার নয়! আপনি তো অন্য কোম্পানির মালিক। তাহলে এখানে কি করছেন? আমার বস কোথায়?”

আলমির কোন উত্তর দিলো না। নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। ফলে মেহরিমা একপা একপা করে পিছিয়ে যেতে লাগল। পেছাতে পেছাতে একসময় দেওয়ালের সাথে পিঠ ঠেকে গেল তার। আলমির গিয়ে ওর দুপাশে হাত দিয়ে ওকে আটকে দিয়ে আবেগী কন্ঠে বলল,

“কেন মিস মেহু, আমাকে কি স্যার হিসেবে পছন্দ হচ্ছে না? আপনি কি ভুলে গেছেন আমি ঢাকার সবচাইতে বড় বিজনেসম্যানের এওয়ার্ড পেয়েছি। আমার কম্পানি মাত্র একটা, সেটা আপনাকে কে বলল? আমার অনেকগুলো কোম্পানি রয়েছে। তবে এই কম্পানিটা একদমই নতুন। শুধু মাত্র আপনার জন্য খোলা হয়েছে এটা। আপনারই নামে!”

মেহরিমা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়। আস্তে করে বলে উঠে,

“আমার নামে?”

আলমির আরো একটু ওর কাছে এগিয়ে যায়। আদুরে গলায় বলে,

“হ্যাঁ ম্যাডাম আপনার নামে। আপনি হয়তো খেয়াল করেননি। এই কোম্পানির নাম “মেহু গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ”

ওর কথা শুনে আর ওকে এত কাছে আসতে দেখে, মেহরিমা দ্রুত নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে দেয়। তারপর রাগী গলায় বলে,

“আমি এই জবটা করব না। আমি এখনই রিজাইন দিয়ে চলে যাব। আপনার মুখও দর্শন করতে চাই না। আপনি কি করে ভাবলেন আপনার কোম্পানিতে আমি আপনার পিএ হয়ে কাজ করব! এটা অসম্ভব।”

কথাটি বলেই সেখান থেকে চলে যেতে চাইলে আলমির ওকে আবারও দেওয়ালের সাথে আটকে দেয়। মুখের কাছে মুখ নিয়ে আদুরে গলায় বলে,

“কিন্তু সেটা তো তুমি পারবে না জান। আমি তোমাকে চারিদিক থেকে বন্দি করে ফেলেছি। ভুলে গেছো এই চাকরিতে জয়েন করার আগে সেই ফরম পুরনের কথা। চাকরিটা কোনো পরিস্থিতিতেই ১ বছরের আগে ছাড়তে পারবে না।”

ওর কথা শুনে এবার যেন নিজের মাথায় নিজেই বারি দিতে ইচ্ছা করছে মেহরিমার। সে না বুঝে কেন যে ফরম টাতে সই করতে গেল? নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। ওকে চুপ থাকতে দেখে আলমির ওকে ছেড়ে দিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে যায়। টেবিলের ওপর বসে বাঁকা হেসে বলে,

“এবার যাও। এখানে খাম্বার মত দাড়িয়ে না থেকে নিজের কাজে মনোযোগ দাও। আমি কিন্তু কাজে ফাঁকিবাজি একদম পছন্দ করি না। কোনো রকম ফাঁকিবাজি দেখলেই শাস্তি পেতে হবে।”

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৪৫
#M_Sonali

মেহরিমা কে একটি নতুন ডেস্ক দেওয়া হয়েছে। আলমিরের ডেস্ক এর ঠিক সামনেই। কাচের মধ্য দিয়ে ওকে স্পষ্ট দেখতে পায় আলমির। তবে মেহরিমা চাইলেই ওকে দেখতে পারে না। কারণ কাঁচটার শুধু এক প্রান্ত থেকে দেখা গেলেও আরেক প্রান্তে আয়নার মতন।

মেহরিমা নিজের ডেস্কে বসে কাজ করছে আর রাগে ফুঁসছে। কিছুক্ষণ পরপর নিজের মাথার চুল ধরে নিজেই টানছে। ওর পাশে একটি চেয়ারের উপর বসে আছে মেহের। হাতে তার চিপসের প্যাকেট। প্যাকেট টা তাকে আলমিরের কথায় পূর্ণিমা এনে দিয়েছে। সাথে অনেকগুলো চকলেট। সে চিপস খাচ্ছে আর বোনের অবস্থা দেখে মিটি মিটি হাসছে। সে যখন জানতে পেরেছে এটা আলমিরের কোম্পানি। তখন থেকে সে ভীষণ খুশি। সে যে চায় তার বোন দুলাভাই এর কাছে ফিরে যাক। সবকিছু আগের মত ঠিক হয়ে যাক। কিন্তু মেহরিমার ভয়ে এটা বলার সাহস পায় না সে।

আলমির সেই তখন থেকে চেয়ারে বসে কাচের মধ্য দিয়ে মেহরিমার সিন দেখছে। আর হাসিতে ফেটে পড়ছে। তার ভীষণ রকম মজা লাগছে ওকে এমন করতে দেখে। সে চেয়ার এদিকওদিক দুলিয়ে একটি কলম হাতে নিয়ে সেটা নাড়াচাড়া করছে আর হাসছে। মনে মনে বলছে,

“সবে তো শুরু জান। এখন’ই নিজের মাথার চুল ছিড়লে হবে! সামনে তো তোমাকে আরো অনেক প্যারা সহ্য করতে হবে। তাই রেডি থাকো।”

কথাগুলো ভেবে আবারও হাসতে লাগলো আলমির। তারপর কলমটা সামনে রেখে ফোনটা হাতে নিয়ে মেহরিমার সামনের টেলিফোনে কল করল সে। ফোনটা বেজে উঠতেই ভীষণ বিরক্তির সাথে ফোনটা রিসিভ করল মেহরিমা। ও প্রান্ত থেকে গম্ভির গলায় আলমির বলে উঠলো,

“মিস মেহরিমা, আমার জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে আসুন। কফিতে কোন প্রকার চিনি বা দুধ দিবেন না। ব্লাক কফি বানিয়ে আনুন। আর হ্যা দশ মিনিট সময়ের মধ্যে।”

মেহরিমা কোন উত্তর দিল না। রাগে ফোসফোস করতে করতে ফোনটা ঠাস করে টেবিলের উপর রাখল। মেহেরের দিকে তাকিয়ে দেখল সে মিটি মিটি হাসছে। ওকে হাসতে দেখে যেন আরো বেশি রাগ উঠে গেল তার। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠলো,

“এভাবে দাঁত কেলিয়ে হাসছিস কেন হুম? বেশি হাসি পেলে যা গিয়ে দাঁত মেজে আয়।”

কথাটি বলেই নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে বাইরে চলে গেল সে। অফিসের কিচেন রুমে গিয়ে কফি বানাতে শুরু করলো। মেজাজটা এতটাই খারাপ হয়ে আছে যে বলার বাইরে। এক কাপ গরম পানির মধ্যে একেবারে ৫ চা চামচ কফি পাউডার দিয়ে দিল সে। মনে মনে বলল,

“আজ আপনাকে জম্মের খাওয়া খাওয়াবো মিষ্টার রাক্ষস।”

কথাটি বলেই কফির মগটা নিয়ে আলমিরের ডেস্কে চলে গেল সে। দরজায় ঠকঠক করতেই ভিতর থেকে উত্তর এলো,

“নিয়ে আসো আর মাত্র এক মিনিট বাকি আছে। ১০ মিনিট পূর্ণ হতে।”

এতে যেন আরো বেশি মেজাজ বিগড়ে গেল মেহরিমার। কোন রকম কথা না বলে ভিতরে গিয়ে মগটা আলমিরের সামনে রাখলো সে। আলমির কফির দিকে একবার তাকিয়ে আবার ওর দিকে তাকিয়ে হালকা রাগি গলায় বলল,

“কফি বানানো শেখানোর জন্য কি নতুন মানুষ রাখতে হবে নাকি হ্যাঁ? এটা কপি বানিয়েছো নাকি কালি দিয়ে পানি গুলিয়ে এনেছো। এত কালো কেন দেখতে? কয় চামচ কফি দিয়েছো এতে?”

এবার মেহরিমা ভীষণ বিপাকে পড়ে গেল। কি বলবে বুঝতে পারছেনা সে। তাই দাঁড়িয়ে থেকে উসখুস করতে লাগলো। ওকে এমন করতে দেখে আলমির চেয়ারের সাথে পিছনদিকে হেলান দিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল,

“যাও এটা ফেলে দিয়ে আবার নতুন করে কফি বানিয়ে আনো। যে পর্যন্ত ঠিকঠাক করে কফি না বানিয়ে আনবে, সে পর্যন্ত তোমাকে কফি বানাতে হবে। আর এর পর খারাপ হলে সেটা তোমাকেই খাওয়াবো।”

এই মুহুর্তে মেহরিমার ইচ্ছা করছে আলমিরের গলা টিপে ধরতে। ওর চুলগুলো একটা একটা করে টেনে তুলে ফেলতে। দাঁত কিড়মিড় করে কফির মগটা হাতে নিয়ে আবারও কিচেনে চলে গেল সে। সবটুকু কফি ফেলে দিয়ে এবার ঠিকঠাক কফি বানিয়ে নিয়ে এলো।

আলমির কফির মগটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখে নিলো। তারপর আবারও সেটা টেবিলের উপর রেখে চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে কিছুটা দোল খেতে খেতে বলল,

“গুড এইবার ঠিক আছে।”

কথাটি বলেই কফি মগটা নিয়ে তাতে চুমুক দিল সে। মেহরিমা চলে যেতে নিলে ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

“কোথায় যাচ্ছো? এটা কে নিয়ে যাবে শুনি? জানো না স্বামীকে কিছু খেতে দিলে স্ত্রীর সেখানে দাড়িয়ে থাকতে হয়!”

ওর কথার উত্তরে রাগী দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল মেহরিমা। যখনই সে কিছু বলতে যাবে আলমির তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,

“মানে আমি বলতে চাইছিলাম বসকে কিছু খেতে দিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তুমি কি ভুলে যাচ্ছ আমি তোমার বস। কফিটা খাওয়া শেষ হলে তারপর যাবে।”

না চাওয়া সত্ত্বেও চুপচাপ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো মেহরিমা। ভীষণ বিরক্ত লাগছে তার। তখনই হঠাৎ করে তার চোখ পড়লো নিজের ডেস্কের দিকে। দেখল এই রুম থেকে সবকিছু একদম স্পষ্ট দেখা যায় ওর ডেস্কের। ব্যাপারটা খেয়াল হতেই যেন চমকে উঠল সে। মনে মনে ইচ্ছামত গালি দিতে লাগল ওকে। আলমির ওর মনের কথা বুঝতে পেরে হাসতে লাগল। কফি খাওয়া শেষ হলে ওকে মগটা নিয়ে যেতে বলল।
,
,
,
রাত ৮:০০ টা
গাড়ি নিয়ে এসে ওই বাড়িটির সামনে থামল আলমির। যেখানে দিপুকে আটকে রাখা হয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে গার্ডদের সাথে নিয়ে বাসার মধ্যে প্রবেশ করল সে। ছোট্ট একটি খাঁচার মধ্যে একদম গুটিসুটি মেরে বসে আছে দিপু। একটুও নড়াচড়া করার মত শক্তি নেই তার। আলমির শাস্তি হিসেবে তাকে এটাই দিয়েছে। এখন অব্দি একফোঁটা পানিও স্পর্শ করতে পারেনি সে। দুদিন হল কিছু না খেয়ে পানি না খেয়ে এভাবে আটকে আছে খাঁচার ভিতরে। তার ওপর শরীরে জায়গায় জায়গায় ক্ষত থাকায় সেখানে দিয়ে মাছি ভনভন করছে। ঘা হয়ে যাচ্ছে সেখানে। আলমির এবার চেয়ার পেতে তার সামনে এসে বসলো। ইশারা করে গার্ডকে বললো খাঁচা থেকে ওকে বের করে আনতে। খাঁচা খুলে দিলেও দিপুর বেরিয়ে আসার মত ক্ষমতা নেই। সে যেন পাথর হয়ে ওখানেই পড়ে রইল। তারপর দুজন গার্ড তাকে ধরাধরি করে খাঁচা থেকে বাইরে বের করে একটি চেয়ারের ওপর বসালো। প্রায় আধ মরা অবস্থা তার। আলমির হাতে একটি লাঠি নিয়ে সেটা দিয়ে ওর হাতে আলতো করে চাপ দিয়ে বলল,

“কি রে দিপু কি অবস্থা তোর? কেমন লাগছে এই শাস্তিগুলো পেতে। আশাকরি আপ্যায়নে কোনো কমতি হচ্ছে না!”

দিপু কোন রকম মাথা তুলে আলমিরের দিকে তাকাল। ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে বলল,

“আমাকে মেরে ফেল। এভাবে শাস্তি দেওয়ার চাইতে মৃত্যু দে আমাকে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।”

ওর কথার উত্তরে আলমির উচ্চস্বরে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল,

“এটুকুতেই হাঁপিয়ে গেলি? এটা তো শুধু শুরুমাত্র। তুই কি ভেবেছিস এত সহজেই তোকে আমি মরতে দিব! কখনোই না। তুই যেভাবে আমার মা-বাবা ভাইকে আমার থেকে কেড়ে নিয়েছিস। তার প্রতিটা হিসাব তোকে দিতে হবে। তিলে তিলে শেষ করবো তোকে আমি। যতক্ষণ না তুই তোর সাথীদের নাম বলবি। ততক্ষণ এভাবেই শাস্তি পেতে হবে তোকে। না পাবি মৃত্যু, না পাবি জীবন। মাঝখানে দুকেদুকে শেষ হবি তুই।”

ওর কথার উত্তরে কিছুক্ষণ চুপ থাকল দিপু। তারপর মাথা তুলে কান্না করতে করতে ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলল,

“আমি সবকিছু বলে দিব। কোন কিছু লুকাবো না। সব বলে দিবো তোকে। আগে আমাকে একটু পানি খেতে দে। মরে যাচ্ছি আমি পানি খেতে না পেরে।”

আলমিরের মুখে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল। সে দ্রুত গার্ডদের ইশারা করে বললো পানি নিয়ে আসতে। সাথে সাথে গার্ড দৌড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ পর একগ্লাস পানি নিয়ে আসলো। আলমির সেটা দিপুর সামনে ধরে বললো,

“এই নে পানি খেয়ে নে। তারপর বল কারা তোর সাথী। কারা লেগেছে আমার পিছনে।”

শরীরে এক বিন্দু শক্তি না থাকলেও পানি দেখে যেন শরীরে শক্তি ফিরে পেলো দিপু। সে দ্রুত হাত থেকে পানির গ্লাস টা নিয়ে ঢকঢক করে সবটুকু পানি খেয়ে ফেলল। তারপর গ্লাসটা নিচে রেখে কিছুক্ষণ চুপ থেকে জোরে জোরে হাফাতে লাগলো। আলমির বলল,

“কি হলো এবার বল কারা তারা। যারা আমার পিছনে পড়ে আছে।”

“তারা তোর দূরের কেউ নয়। সব সময় তোর আসে পাশে থাকে তারা। তোর খুব কাছের মানুষ সে। আর সে হল,,,!”

এতোটুকু বলতেই দিপুর মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত উঠে গেলো। কাশতে থাকলো সে। মুহূর্তেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পরলো সে।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,