দিওয়ানেগি পর্ব-৪০+৪১+৪২

0
460

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৪০+৪১+৪২
#M_Sonali

সন্ধ্যা ৭:০৫ মিনিট,
সবে মাত্র অফিস থেকে বাসায় ফিরেছে মেহরিমা। গতকাল অফিসে যাওয়া হয়নি তার। দিদুন ও শেফালী বেগমের মৃত্যুর জন্য। তার জন্য বসের থেকে অবশ্য বেশ বকাঝকাও শুনতে হয়েছে তাকে। সে ফোন করে কেন জানায়নি, হুট করে এভাবে অফিস বাদ দেওয়া যাবে না। তার ওপর তাঁর নতুন চাকরি। তবে সবকিছু অনেক ধৈর্য ও বুদ্ধির সাথে সামলে নিয়েছে মেহরিমা। অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরে সবে মাত্র সোফায় বসে মাথাটা পিছনে হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করেছে সে। তখনই তার আরামের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে দরজায় কেউ জোরে জোরে খটখট শব্দ করতে লাগল। এতে বেশ বিরক্ত হলো মেহরিমা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ৭:১৫ বেজে গেছে। ভ্রু কুঁচকে ভাবলো এসময় আমার কে এলো। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেল সে। ভেতর থেকে বিরক্তি মাখা গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“কে?”

বাইরে থেকে একটি কর্কশ কণ্ঠস্বর বলে উঠলো,

“দরজাটা খোলো মেহরিমা, আমি তোমার ময়না চাচি। আর আমার সাথে তোমার খাদিজা আন্টিও আছে।”

এমনিতেই ভীষণ বিরক্ত লাগছিল। তার ওপর ওনার কন্ঠ শুনে যেন আরো বেশি বিরক্ত ছেয়ে গেল মেহরিমার মনে। কারণ সে বেশ ভালো করেই জানে এই মহিলারা কতটা কর্কশ এবং কূটনীতিবাজ। তারা সবসময় এর কথা ওর কাছে এবং ওর কথা এর কাছে লাগাতে ভালোবাসেন। মানুষের দোষ খুঁজে বের করা যেনো এদের ব্যাক্তিগত অধিকার মনে করেন। আর সেই দোষ নিয়ে খোটা দেওয়া যেন তার ব্যক্তিগত অভ্যাস। মেহরিমা একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দরজাটি খুলে দিল। মুখে জোর পূর্বক হাসি ফুটিয়ে সালাম দিয়ে বললো,

“আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন আপনারা?”

ওর কথার উত্তরে ঘরের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে ময়না নামের মহিলাটি মুখের পান চিবাতে চিবাতে বলল,

“আছি ভালোই। তোমাদের দু বোনের খবর নিতে এলাম। আসলে সবসময় আসতে চাই। কিন্তু সময় হয়ে ওঠে না। তাই এখন সময় পেতেই খাদিজা ভাবিরে বললাম আমার সাথে আসতে।”

মেহেরিমা দরজা লাগিয়ে দিয়ে ওনাদের সাথে গিয়ে সোফা দেখিয়ে বলল,

“চাচি আপনারা একটু বসুন। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। আসলে মাত্র অফিস থেকে ফিরেছি। তাই শরীর অনেক ক্লান্ত।”

ওর কথার উত্তরে মহিলা দুটি সোফার উপর গিয়ে বসলো। তারপর খাদিজা নামের মহিলাটি এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে উঠলো,

“বাহ বেশ ভালোই সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছো তো বাড়িটা। ঠিক আগের মতই লাগছে। তোমার মা-বাবার জন্য বড্ড কষ্ট হয় বুঝলে। বড্ড ভালো মানুষ ছিলেন তারা।”

উনার কথার উত্তরে মেহরিমা একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মুখে কিছু বলল না। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে ময়না নামের মহিলাটি পান চিবিয়ে বলে উঠলো,

“তা মেহরিমা, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছিলাম। শুনেছি তোমার নাকি বিয়ে হয়েছে। আসলে বিয়ের কথা তো আর গোপন থাকে না। শুনলাম যেখানে এর আগে কাজ নিয়ে ছিলে। সেই বাড়ির মালিকের সাথেই নাকি বিয়ে হয়েছিল। তাহলে হঠাৎ এমন কি হলো যে সব ছেড়েছুড়ে এখানে এসে থাকছো?”

মেহরিমা এবার বিরক্তির চরমপর্যায়ে পৌঁছে গেল। না পারছে কিছু বলতে, না পারছে সইতে। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে গেল সে। তারপর কথা ঘুরিয়ে বলে উঠলো,

“চাচি আপনারা একটু বসুন। আমি ফ্রেশ হয়ে আপনাদের জন্য চা নিয়ে আসছি।”

কথাটি বলে ওদের আর কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত সেখান থেকে সরে পরল মেহরিমা। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসে কিচেনে চলে গেলো চা বানাতে। দু’কাপ চা বানিয়ে নিয়ে উনাদের সামনে আসতেই দেখল মেহের কে সামনে বসিয়ে নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করছে তারা। মেহের এতক্ষণ নিজের রুমে হোমওয়ার্ক করছিলো। মেহরিমার যেনো মেজাজটাই বিঘড়ে গেল। সে চায়ের ট্রে নিয়ে এসে সামনে রেখে চা কাপ দুটি উনাদের দুজনের হাতে দিয়ে বলল,

“এখন বলুন কি জানতে এসেছেন এখানে। আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি আমি। মেহের তুই ঘরে যা। গিয়ে পড়তে বস।”

মেহের যে এতক্ষন বিরক্ত হচ্ছিল সেটা ওর মুখ দেখেই বোঝা গেল। সে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সোজা নিজের রুমে চলে গেল। এবার মহিলা দুটি একটু নড়েচড়ে বসলেন। মুখে বাকা হাসি ফুটিয়ে চা কাপ টি হাতে তুলে নিয়ে খাদিজা বেগম বললেন,

” আসলে আমরা দুজন তোমাদের দেখতে এসেছি। কিন্তু কি বলতো, এইটা তো একটা ভদ্রলোকের পাড়া। তাই আমাদেরও তো উচিত সবার খোঁজখবর রাখতে। তোমার মান-সম্মান গেলে তো সেটা আমাদেরও গায়ে লাগবে। একি পাড়ায় থাকি যেহুতু। আচ্ছা মেহরিমা সত্যি করে বলতো, তোমার তো বিয়ে হয়েছিল। তাহলে এখানে এসে থাকছো কেন? আর তোমার স্বামী’ই বা কোথায়? আমরা যতদূর জানি তোমার স্বামী তো অনেক বড়লোক। তাহলে এমন বড়লোক একটা জামাই থাকতে নিজে জব করছো কেনো?”

এবার মেহরিমা বিরক্ত হলো না। মুখে কৃত্তিম হাসি ফুটিয়ে শক্ত গলায় বলল,

“আসলে কি হয়েছে বলুন তো আন্টি। এখানে আমরা এসেছি প্রায় ২০ দিন হয়ে গেল। অথচ এর মাঝে আপনারা একদিনো আমাদের খোঁজ নিতে আসলেন না। আমরা কি খাচ্ছি বেচে আছি নাকি মরে গেছি, আমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা তার কোনো খোঁজ আপনাদের কাছে নেই। কিন্তু দেখুন, আজকে আমাদের দোষ খোঁজার জন্য ঠিক হাটি হাটি পাপা করে চলে এসেছেন। আচ্ছা ঠিক আছে। তবুও আপনাদের প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। হ্যাঁ আমার বিয়ে হয়েছিল একটা বড় লোকের সাথে। কিন্তু তাকে আমার নিজের যোগ্য মনে হয়নি। তাই আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছি। আর নিজের পায়ে দাঁড়ানো যেহেতু আমার বাবা আমাকে শিখিয়ে গিয়েছে। তাই এভাবে দুবোন থাকতে আমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। আশা করি আমাদের ব্যাক্তিগত জীবনে আপনারা আর কোনো হস্তক্ষেপ করবেন না।”

ওর এমন শক্ত উত্তরে মহিলা দুটির মুখে যেন মেঘ ছেয়ে গেল। ময়না বেগম ভেংচি কেটে কাপটা টেবিলের উপর রেখে রাগী গলায় বলে উঠলেন,

“মেয়ের দেমাগ দেখো! দেমাগে যেন মাটিতে পা পড়ে না। শোনো মেয়ে তোমার বাবা-মা নিহাত ভালো মানুষ ছিল বলে তোমাদের খোঁজ নিতে এসেছি। নইলে আমাদের এত ঠেকা পড়ে নাই এখানে এসে তোমার কথা শুনার। আর তাছাড়া এটা একটা ভদ্রলোকের পাড়া। তোমার ভাই চুরি করে বাপ-মায়ের মান সম্মান সব ধুলোয় মিশিয়ে ছিলো। কিন্তু তুমিতো তার চেয়েও বেশি কিছু করলে। একা একাই বিয়ে করলে। আবার তাকে ছেড়েও দিলে। কিছুদিন হল দেখছি অন্য একটি ছেলে বাসার সামনে ঘুর ঘুর করে। তার সাথে তোমরা কথাও বলো। মাঝে মাঝে দেখি ওই ছেলেটার গাড়িতে উঠে কোথায় যেন যাও তোমরা। কি ভেবেছ আমরা কোন খোঁজ রাখি না? এমন নষ্টামি আমাদের পাড়ায় চলবে না। তোমাদের মান সম্মান না থাকতে পারে। আমাদের একটা মান সম্মান আছে।”

একনাগাড়ে এতগুলো কথা বলে থামলেন ময়না বেগম। উনার কথা শুনে এবার যেন মাথায় রক্ত উঠে গেলো মেহরিমার। সে উঠে দাঁড়িয়ে রাগী গলায় দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

“আপনারা আমার গুরুজন বলে এতক্ষণ সম্মান দিয়ে কথা বলছিলাম। কিন্তু এখন আপনাদের মুখ থেকে এমন কথা শোনার পরেও আপনাদের সম্মান করে চুপ থাকতে গেলে নিজের আত্মসম্মান খোয়াতে হবে। তাই আর নয়। আপনারা কোন মুখ নিয়ে এই কথাগুলো বলছেন আমাকে? খাদিজা আন্টি ভুলে গেছেন কি আপনার মেয়ের কথা। তার তো এ পর্যন্ত তিন তিনটে বিয়ে হয়েছে তাই না? শুনেছি দুই জায়গায় নাকি দুইটা বাচ্চা রেখে এসেছে সে। তিনটা বিয়ের পর এখন আপনার বাড়িতে আপনার বোনের ছেলের সাথে সংসার পেতেছে। আর ময়না চাচি আপনার ছেলেও তো দুইটা বিয়ে করেছিলো। যার একজনকে যৌতুক না পেয়ে আপনি সাথে থেকে অত্যাচার করে তালাক করিয়েছিলেন। কিছুদিন আগে পরকিয়া করতে গিয়ে ধরা খেয়ে মাইরও খেয়ে এসেছে। তারপর থেকে তো আপনার ছেলে এখন অব্দি খুরিয়ে খুরিয়ে হাটে তাইনা? তাহলে এসবে আপনাদের মানসম্মান কোথায় থাকে বলুন?”

ওর মুখে এমন কথা শুনে যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন দুজন। উঠে দাঁড়িয়ে কর্কশ গলায় বলে উঠলেন ময়না বেগম,

“তোমার সাহস তো কম নয় মেয়ে। ভেবেছিলাম এখানে এসে তোমাদের একটু ভালোমন্দ বুঝিয়ে যাব। কিন্তু তুমি তো দেখছি আস্ত একটা বেয়াদব। তোমার বাবা কত ভালো মানুষ ছিলেন। এই তার শিক্ষা? ভাবতেই তার শিক্ষা নিয়ে সন্দেহ লাগছে। এত বড় সাহস যে আমাদের মুখে মুখে তর্ক করো। গুরুজন বলে একটু সম্মানও দিতে জানোনা।”

“চাচি অপরাধ মার্জনা করবেন। কিন্তু আপনাদের আচরণের কারণেই আমার এ কথাগুলো বলতে হলো। আপনারা যদি এই কথাগুলো আমাকে বলার আগে একটু ভেবে চিন্তে বলতেন। একটু সহানুভূতি দেখাতেন স্নেহের সাথে। তাহলে আজকে আমার মুখ থেকে এই তিতাযুক্ত সত্যি কথাগুলো শুনতে হতো না। সে যাই হোক আপনারা এখন আসতে পারেন। আমার মাথাটা ভিষন ধরেছে।”

“যাচ্ছি যাচ্ছি। এত অপমানের পর এখানে বসে থাকতে আমাদের বয়েই গেছে। তবে তুমিও শুনে রাখো মেয়ে। আমাদের এই অপমানের ফল তোমার পেতে হবে। আমরাও দেখব কিভাবে এই এলাকায় থাকো তুমি। মুখে চুনকালি মেখে যদি এলাকা ছাড়া না করেছি তাহলে আমার নামও ময়না বেগম না হুহ। চলেন ভাবি এইখানে আর একমুহুর্তও না।”

কথাগুলো বলেই খাদিজা বেগম কে সাথে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল ময়না বেগম। মেহরিমা কিছু বলল না। একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর মাথা হাত দিয়ে চেপে ধরে চুপ করে বিছানার উপর বসে পড়ল। তখনই তার পিছনে এসে দাঁড়াল মেহের। তার চোখে পানি। সে আড়াল থেকে সবকিছু শুনেছে। ওর চোখে পানি দেখে মেহরিমা চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,

“কান্না করিস না বোন। শক্ত কর নিজেকে। এই দুনিয়ায় মেয়ে মানুষ হয়ে একা বেঁচে থাকতে হলে সবকিছুই মুখ বুঝে সহ্য করতে হবে। নইলে যে মেয়ে মানুষের বেঁচে থাকা বড়ই কষ্ট। এভাবে অনেকেই অনেক কথা বলবে। কিন্তু তাই বলে আমাদের ভেঙে পড়লে চলবে না। তুই কি ভুলে গেছিস বাবা কি বলতেন। তিনি সব সময় বলতেন কখনোই নিজের আত্মসম্মান এর সাথে কম্প্রোমাইজ না করতে। তাইতো আজ শক্ত হয়ে তাদের উত্তর দিয়ে দিলাম। তারা কিছুই করতে পারবেনা ইনশাআল্লাহ। তুই শুধু সব সময় সাবধানে চলাফেরা করবি। কারো সাথে কোন কথা বলবি না। সোজা স্কুল থেকে বাসায় এবং বাসা থেকে স্কুলে যাবি। কারো দেওয়া কিছু খাবিনা, বুঝলি। কার মনে কি আছে তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তাই আমরা সব সময় সাবধানতা অবলম্বন করে চলবো কেমন?”

মেহের মাথা নেড়ে সায় দিল। তারপর ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। ছোট বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৪১
#M_Sonali

রাত প্রায় ২:৫৫ মিনিট,
হঠাৎ দরজার বিকট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল মেহরিমা ও মেহেরের। দুজনেই চমকে উঠে কাচুমাচু হয়ে বসল। একে অপরের দিকে তাকিয়ে কিছুটা ভিতু হয়ে রইলো। মেহের ভিতু গলায় বলে উঠলো,

“আপু এত রাতে দরজায় ধাক্কা দেয় কে? আমার ভীষণ ভয় করছে!”

মেহরিমা মনে মনে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও মেহেরকে কিছু বুঝতে দিলো না। নিজেকে যতটা সম্ভব শান্ত রেখে বলল,

“ভয় করিস না মেহের। ভয়ের কিছু নেই। হয়তো বাতাসে শব্দ হয়েছে।”

কথাটি বলতেই আবারো দরজায় বিকট শব্দ হতে লাগলো। এবার মেহরিমা ও বেশ ঘাবড়ে গেল। মেহের দ্রুত এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,

“আপু যেও না প্লিজ। আমার ভীষণ ভয় করছে। এত রাতে এখানে কে আসতে পারে!”

মেহরিমা ওর কথার কোন উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাবতে লাগল। এভাবে কে শব্দ করতে পারে? অজানা এক ভয়ে বুকটা বার বার কেঁপে উঠতে লাগলো তার। তখনই দরজায় আবারো কড়ানাড়ার শব্দ হলো। এবার বুকে কিছুটা সাহস নিয়ে মেহেরকে নিজের থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল,

“একদম ভয় পাবিনা। আমি দেখছি কি হয়েছে।”

মেহের ওর কথা শুনতে নারাজ। ওর হাত চেপে ধরে বলল,

“প্লীজ আপু তুমি যেও না। বাসায় তুমি আর আমি ছাড়া অন্য কেউ নেই। যদি খারাপ কেউ হয়ে থাকে? আমার ভীষণ ভয় করছে।”

“ভয় পাস না। যেই হোক না কেন কিছুই হবে না আমাদের। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।”

কথাটি বলে মেহেরকে জোর করে নিজের থেকে সরিয়ে দিয়ে কিচেনে চলে গেলো। সেখান থেকে মাছ কাটা বঠি দা টা হাতে নিয়ে ভিতু পায়ে এগিয়ে গেলো দরজার কাছে। কর্কশ গলায় প্রশ্ন করে বলে উঠলো,

“কে আছে বাইরে? এত রাতে বারবার এভাবে দরজা ধাক্কাচ্ছেন কেনো?”

বাইরে থেকে কোনো প্রতি উত্তর আসলো না। বরং দরজায় আরো জোরে শব্দ হতে লাগলো। এতে কিছুটা কেঁপে উঠল মেহরিমা। তবুও বুকে সাহস নিয়ে আরেকটু চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,

“কথা বলছেন না কেন? কে আপনি? দরজায় এভাবে ধাক্কা দিচ্ছেন কেন?”

এবার ওই পাশে সব শান্ত হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর অতি পরিচিত একটি কন্ঠস্বর ভেসে আসলো। আলমির আবেগি গলায় বলে উঠল,

“দরজা খোলো মেহু। আমি তোমার আলমির।”

আলমিরের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেল মেহরিমা। একটি শান্তির নিশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করলো সে। ভয়টা যেনো এখন ১০০ শতাংশ কমে গেছে তার। পরক্ষণেই রাগে শরীর জ্বলে উঠলো। রাগি গলায় বলে উঠল,

“আপনি এত রাতে এখানে কেন এসেছেন? আর এভাবে অসভ্যের মত দরজা ধাক্কাচ্ছেন কেন? এটা একটা ভদ্রলোকের পাড়া। এখানে অন্তত নিজের ভদ্রতা বজায় রাখতে পারতেন।”

“প্লিজ মেহু এভাবে বলোনা। দরজাটা খোলো। তোমার সাথে পাঁচটা মিনিট কথা বলতে চাই আমি। প্লিজ দরজাটা খোলো।”

মেহরিমার কি হলো সে জানে না। না চাওয়া সত্ত্বেও দরজাটা খুলে দিল সে। দেখলো আলমির স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা তার একদম শুকিয়ে গেছে। বেশ কালচে লাগছে দেখতে। চুলগুলো একদম এলোমেলো হয়ে আছে। আচমকা আলমির তেড়ে এসে ওকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিল। ঘটনার আকস্মিকতায় যেন পাথর হয়ে গেল মেহরিমা। কোন কিছু আর বলার মত সাধ্য নেই তার। আলমির হু হু করে কাঁদতে লাগল ওকে জরিয়ে। চোখ থেকে পানি পড়ে মেহরিমার কাধের কাছের জামা ভিজে যেতে লাগলো। মেহরিমার হাত থেকে দা টা আপনাআপনি নিচে পড়ে গেল। ঝনঝন করে শব্দ হয়ে উঠল চারিদিকে।

এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ। মেহের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে ওদের সিন দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ মেহরিমার খেয়াল হতেই সে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে আলমির কে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল। তারপর রাগী গলায় চিৎকার করে বলল,

“এসবের মানে কি? আপনি এখানে কেন এসেছেন? কোন সাহসে আমাকে স্পর্শ করার সাহস দেখিয়েছেন! আপনি কি ভুলে গেছেন আমি আপনাকে ছেড়ে দিয়েছি। ডিভোর্স হয়েছে আপনার সাথে আমার। এই মুহূর্তে এখান থেকে বেরিয়ে যান। আর এক মুহুর্তর জন্যেও আপনার চেহারা দেখতে চাইনা।”

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল মেহরিমা। ওর কথা এতক্ষণ চুপচাপ করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুনছিল আলমির। ওর দিকে দু পা এগিয়ে এসে করুন গলায় বলল,

“প্লিজ মেহু, এভাবে বলোনা। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাবো আমি। জানো আজকে যখন একা রুমে ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ অনেক বাজে একটা স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নে দেখি তুমি আমার থেকে হারিয়ে গেছো। অনেক দূরে চলে গেছো দিদুন এর মত। আমি সহ্য করতে পারিনি। বিশ্বাস করো ঘুম ভাঙার সাথে সাথে বুকটা এতটা খালি খালি লাগছিল যে, মনে হচ্ছিলো এখনই দম বন্ধ হয়ে মারা যাব। তাই তো এত রাতে পাগলের মতো ছুটে এসেছি একা। আমার সাথে বাড়ি চলো মেহরিমা। আমি তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি।”

“আপনি কিভাবে ভাবলেন আলমির! যে আপনি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসলেই আপনার সাথে চলে যাব? আপনার এই মিথ্যে চোখের জলে ভুলার মত মেহরিমা অনেক আগেই মারা গেছে। যেদিন আপনি আমাকে অবিশ্বাস করে নষ্টা মেয়ে বলে গালি দিয়েছিলেন। বেল্ট এর আঘাতে বিনা দোষে আমার শরীরটা ক্ষতবিক্ষত করেছিলেন। সেদিন কেই আপনার জন্য মারা গেছে মেহরিমা। আপনি এখান থেকে চলে যান। আপনাকে সহ্য হচ্ছে না আমার। ডিভোর্স লেটার তো পাঠিয়ে দিয়েছি। আর কিসের জন্য অপেক্ষা করছেন আপনি? ছেড়ে দিন আমাকে। বাঁচতে দিন নিজের মত করে। আপনার ছায়াও মারাতে চাই না কখনো। চলে যান আপনি।”

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামল মেহরিমা। ওর কথার উত্তরে হাঁটু ভেঙে নিচে ঠাস করে বসে পড়ল আলমির। কান্না করতে করতে ওর সামনে হাত জোড় করে বলল,

“প্লিজ মেহরিমা ক্ষমা করে দাও। স্বামী হয়ে আমি তোমার কাছে হাতজোড় করছি। ভুল হয়েছে আমার। অনেক বড় পাপ করেছি আমি তোমাকে অবিশ্বাস করে। তোমার গায়ে হাত তুলে। কিন্তু কি করতাম বল! আমার পরিস্থিতিতে থাকলে হয়তো যে কেউই এমন কোন কাজ করে বসতো। ছোটবেলা থেকেই মায়ের প্রতি ঘৃণা তৈরি হয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে সেই ঘৃণা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে পৃথিবীর কোন মেয়েকে বিশ্বাস করতে পারতাম না। তবুও তোমাকে ভালোবেসে নিজের বউ করেছিলাম। কিন্তু তুমিও আমার কাছে সব লুকিয়েছো। চুরি করে দেখা করেছো আমার মায়ের সাথে। তুমি যদি সব কথা আমাকে আগেই বলতে তাহলে হয়তো ঐদিন এমন হত না। কিন্তু তুমি তো সবকিছুই আমাকে লুকিয়ে করেছিলে। তাই তো তোমার হাতে ছুড়ি এবং আমার মাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখে মনের মাঝে অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। সন্দেহ হয়েছিল তোমার উপর। রাগ যেন ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। সেই রাগ থেকেই তোমাকে আঘাত করেছিলাম। কিন্তু সেই আঘাতে শুধু তুমি কষ্ট পাও নি মেহু। তার চেয়ে বেশি কষ্ট হয়েছিল আমার। বারবার বিশ্বাস ভাঙার কষ্ট। ধোকা খাওয়ার কষ্ট। তুমি যখন হসপিটালের বেডে ছিলে তখন আমিও নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করেছি। এই দেখো তার প্রমাণ।”

কথাটি বলেই নিজের দুই হাতের শার্টের হাতাটা ওপরে তুললো আলমির। মেহরিমা ও মেহের দুজনেই ওর হাতের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল। দুটি হাতই একদম কুচি কুচি করে কাটা। যেন ব্লেড দিয়ে এলোপাথারি পোঁচ দেওয়া হয়েছে। হাতদুটো এখন পর্যন্ত ভালো হয়নি। থকথকে ঘা হয়ে আছে। শুকিয়েও যায়নি। কিন্তু এত কিছুর পরেও মেহরিমার মন শান্ত হলো না। সে একি ভাবেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। ওকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আলমির কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

“আমি বড্ড একা হয়ে পড়েছি মেহু। ওই বাড়িতে একা থাকতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আমার। আমার কাছে একমাত্র আশ্রয় ছিল আমার দিদুন। সেও আমায় ছেড়ে চলে গেছে। তুমি অন্তত আমাকে ফিরিয়ে দিওনা। আমার সাথে ফিরে চলো বাড়িতে। কথা দিচ্ছি আর কখনও একটি ফুলের আচোরও পড়তে দিব না তোমার গায়ে। পৃথিবী উল্টে গেলেও কখনো অবিশ্বাস করব না তোমায়। তুমি যদি নিজে হাতে আমাকে খু-ন করতে চাও। নিজের বুক পেতে দেব। তবুও একটা শব্দ করবো না। প্লিজ মেহু ফিরে চলো আমার সাথে। বড্ড ভালোবাসি তোমায়। হয়তো ভুল করেছি, কিন্তু এই ভুলের কারণেই ভালোবাসাটা আরও তীব্র হয়েছে তোমার প্রতি।”

ওর এমন কথা শুনে মেহরিমার চোখ থেকে অঝোরে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগলো। কিন্তু মনটা তবুও শক্ত রাখল সে। ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদতে কাঁদতে অসহায় কন্ঠে বলল,

“এখন কেন এসেছেন আলমির? কেন এসেছেন আমাকে ফিরিয়ে নিতে? কেনই বা এত ভালোবাসার লোভ দেখাচ্ছেন? আপনি যেমন একা হয়ে গেছেন। এর চাইতেও বেশি একা ছিলাম আমি। তবুও নিজের জীবন দিয়ে আপনাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলাম। সবসময় আপনার পাশে থেকেছি। কখনো আপনার আশেপাশে কোন বিপদ আসতে দেইনি। সব সময় সব কাজে আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। আপনার প্রতিটা কথা মেনে চলার চেষ্টা করেছি। তবুও আপনি কি ভাবে অবিশ্বাস করলেন আমাকে? একটিবার অন্তত সত্যটা জানার চেষ্টা করে দেখতেন। কিন্তু আপনি সেটা করেননি। নির্দয় এর মত অমানবিক অত্যাচার করেছেন আমার উপর। শুধু অত্যাচার করেই থেমে যাননি। নানা রকমভাবে বাজে ভাষা প্রয়োগ করেছেন। যেটা সবথেকে বেশি কষ্ট দিয়েছে আমায়। আমি আপনাকে চাইলেও ক্ষমা করতে পারছিনা। নিজের আত্মসম্মানে বাধছে। প্লিজ আপনি চলে যান। আর কোন ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করবেন না। এখান থেকে চলে যান প্লিজ। আমি আপনাকে সহ্য করতে পারছি না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিভোর্স পেপারে সাইন করে মুক্তি দিন আমায়।”

ওর কথার উত্তরে আলমির কিছু বলল না। কিছুক্ষণ চুপচাপ ওর দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। শার্টের হাতা ঠিক করে গম্ভীর গলায় বললো,

“আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার কথাই মেনে নিলাম। ফিরে যাচ্ছি আমি। তবে ভেবোনা তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমাকে ছারবোনা। ডিভোর্স তো দূরের কথা। প্রতিটি মুহূর্তে তোমার ছায়া হয়ে থাকবো আমি। তোমাকে যখন আঘাত করে দূরে সরিয়ে ছি। তখন ভালোবেসে যেভাবেই হোক জয় করে দেখাবো। তুমি চাইলেও আমার থেকে দূরে যেতে পারবে না। এটা আমার চ্যালেঞ্জ রইল তোমার কাছে। love you so much mehu. ”

কথাগুলো বলেই একটি ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিলো মেহরিমার দিকে। তারপর দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে সোজা গাড়ি নিয়ে চলে গেলো। মেহরিমা সেখানেই বসে চোখের জল বিসর্জন দিতে লাগলো। ওকে তাড়িয়ে যে নিজের বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। বড্ড বেশি কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তবুও নিজের আত্মসম্মানের সাথে কোনো কম্প্রোমাইজ করবে না সে।

এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে সবকিছুই দেখছিল মেহের। তার চোখ দিয়েও অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সে এবার মৃদু পায়ে এগিয়ে এলো মেহরিমার কাছে। ওর সামনে বসে আলতো হাতে চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,

“আপু এভাবে দুলাভাইকে তাড়িয়ে দিয়ে ঠিক করলে না তুমি। উনি নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে। কত করুণভাবে ক্ষমা চাইছিল তোমার কাছে। তোমার উচিত ছিল ওনাকে ক্ষমা করা। দুলাভাই এর জন্য আমার ভিষন কষ্ট হচ্ছে আপু।”

ওর কথার উত্তরে মেহরিমা কিছু বলল না। ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কান্না করতে লাগলো।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৪২
#M_Sonali

অফিসের জন্য রেডি হয়ে মেহেরকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তার কাছে পৌঁছাতেই, মেহরিমার পথ আটকে দাঁড়ায় আশেপাশের প্রতিবেশীদের সাথে নিয়ে ময়না বেগম। ওদের দুজনের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাত নাচিয়ে নাচিয়ে চিৎকার করে বলে,

“এইযে নষ্টা মেয়ের দল। রাত ভর নষ্টামি করে এখন কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি? এটা একটা ভদ্রলোকের পাড়া। বলি নিজের মরা মা বাপের কথা ভেবেও তো একটু ভদ্রতা বজায় রেখে চলতে পারো নাকি? এমন নষ্টামি করে চললে এ পাড়ায় থাকা যাবে না।”

ওনার কথায় মুহূর্তে যেন রাগ উঠে গেল মেহরিমার। সে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলে উঠল,

“এসব কি বলছেন চাচি? আপনার কি মাথা ঠিক আছে?”

“মাথা আমার ঠিকই আছে। কিন্তু তোমাদের মাথা ঠিক নেই। বলি কাল রাতে কাকে নিয়ে এসেছিলে বাসায়? সারারাত কাটিয়ে যাকে ভোররাতে বের করে দিয়েছো সবার চক্ষু আড়ালে?”

এবার মেহরিমা বুঝতে পারল উনি কেন এমন করছেন। তার মানে আলমির চলে যাওয়ার সময় নিশ্চয়ই উনি দেখেছিলেন। আর উনি তো এরকমই একটা সুযোগের অপেক্ষা করছিলেন। মেহরিমা মনে মনে নিজেকে শক্ত করল। এই মুহূর্তে নরম হলে চলবে না। শক্ত গলায় বলে উঠল,

“কখন থেকে যা নয় তাই বলে যাচ্ছেন। কোন কিছু না জেনে বলার আগে অন্তত একবার ভেবে বলা উচিৎ। কাল রাত্রে যিনি এসেছিল সে অন্য কেউ নয় আমার স্বামী আলমির। সে একটি দরকারে এসেছিল, আর দশ মিনিটের মত থেকে চলে গিয়েছে। ভুলভাল কথা বলে এভাবে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াবেন না চাচি প্লিজ।”

“বাব বাহ মেয়ের কথা শোনো। এই তো সেদিন বললে তুমি নাকি তাকে ছেড়ে দিয়েছো! আর আজ হঠাৎ করে সে তোমার স্বামী হয়ে গেল? বলি এসব নষ্টামি আমাদের এলাকায় চলবে না। এমন কথায় ভুলবোনা আমরা। ভালোই ভালোই বলে দিচ্ছি এলাকা ছেড়ে চলে যাও। তোমাদের দুবোনকে আর এখানে দেখতে চাই না। তোমরা নিজেরা তো নষ্টামি করবে’ই, পাশাপাশি এলাকার মেয়েদের কেও নষ্ট করে দিবে। কি বলেন আপনারা, সবাই চুপ করে আছেন কেন, কিছু তো বলুন।”

ওনার সাথে তাল মিলিয়ে আশেপাশের সবাই একই কথা বলে উঠল। মেহরিমা এবার ভীষণ মুশকিলে পড়ে গেল। সে বুঝতে পারলো এদের সাথে তর্ক করে কোন লাভ হবে না। এরা সবাই উঠে পড়ে লেগেছে ওদেরকে খারাপ প্রমাণ করতে। আর এসব কিছুই ওই ময়না চাচির চাল। সেদিনের কথার প্রতিশোধ নিচ্ছেন তিনি।

মেহরিমা মেহেরের দিকে তাকিয়ে দেখল ও কান্না করছে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে ওর। মেহরিমা সেখানে দাঁড়ালো না। ওর হাত ধরে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। পিছন থেকে একেকজন একেকরকম কথা বলতে লাগল। সে দিকে কান দিল না সে। মেহেরকে নিয়ে কিছুটা দূরে আসতেই মেহের থেমে গিয়ে বলে উঠলো,

“চলনা আপু, আমরা দুলাভাইয়ের কাছে ফিরে যাই। এভাবে বেঁচে থাকা অনেক মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। মানুষের এমন কটু কথা শুনতে আমার ভালো লাগে না। তারা আমাদের মৃত বাবা-মাকেও ছাড় দিচ্ছে না। মানুষ এতটা জঘন্য হয় কি করে? আগে এই মানুষগুলোই কত প্রশংসা করত আমাদের। আমাদের জন্য বাবার গর্ভে সবসময় বুক উঁচু হয়ে থাকতো। আজ দেখো তারাই কত নোংরা নোংরা বাজে কথা শোনাচ্ছে আমাদের। আজ বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো আবার মরে যেতেন এসব দেখে। আমার আর কিছু ভালো লাগছেনা আপু। চলো আমরা দুলাভাইয়ের কাছে ফিরে যাই। সেখানে অন্তত এসব কথা শুনতে হবে না।”

ওর কথার উত্তরে মেহরিমা কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো। কিছু একটা ভেবে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“চিন্তা করিস না মেহের। আমরা এই এলাকায় থাকবো না। অন্য কোথাও চলে যাবো। সত্যি এরা মানুষ নয়। এরা পশুর চাইতেও নিকৃষ্ট। কতটা নিচু মন এদের।”

“আমাদের বাড়িটা কি তবে বিক্রি করে দিবে আপু? কোথায় যাব আমরা?”

“না ওই বাড়িতে আমাদের বাবা-মার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ওটা আমি কখনোই বিক্রি করব না। তবে আমরা এখানেও থাকবো না। অন্য কোন এলাকায় বাসা ভাড়া করে চলে যাব। এখন তাড়াতাড়ি চল দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোকে স্কুলে রেখে আমাকে আবার অফিস যেতে হবে।”

কথাটি বলেই মেহেরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওর হাত ধরে রওনা হলো মেহরিমা।
,
,
,
অফিসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেশ দেরি হয়ে গেছে মেহরিমার। মনে মনে কিছুটা ভয় নিয়ে অফিরে প্রবেশ করে সে। কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করেই ভীষণ অবাক হয়ে যায় সে। দেখে সবাই কাজ বাদ দিয়ে বসের কেবিনের সামনে ভিড় করে আছে। সে অবাক হয়ে কাছে এগিয়ে যায়। কলিগ একটি মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞেস করে,

“কি হয়েছে বলতো, সবাই এভাবে বসের রুমের সামনে ভিড় করে আছে কেন, কাজ বাদ দিয়ে? আর বস’ই বা কোথায়?”

“সেকি তুমি জাননা! ঢাকার সবচাইতে বড় কোম্পানি থেকে আমাদের জন্য জবের অফার এসেছে। এই অফিস থেকে তিনজনকে সিলেক্ট করা হবে সেই কোম্পানির জন্য। আর সেখানে বেতন থেকে শুরু করে সব রকমের সুযোগ সুবিধা থাকবে। বিশেষ করে তিন জনের মাঝে একজনকে নেওয়া হবে সেই কোম্পানির বসের পার্সোনাল এসিস্টেন্ট হিসেবে। আর তাকে থাকার জন্য দেওয়া হবে একটি ফ্ল্যাট। এবং প্রতিদিন অফিসে যাতায়াতের জন্য একটি প্রাইভেট কার। সাথে অনেক টাকা বেতন তো থাকবেই। সেজন্যই তো সবাই বসের রুমের সামনে ভিড় করে আছে। কে এমন চাকরি হাত ছাড়া করতে চায় বলো। আমিও এ্যাপ্লাই করবো। আল্লাহ জানে ভাগ্যে কি জোটে। তুমিও এ্যাপ্লাই করে দেখতে পারো যদি ভাগ্য সহায় হয় তাহলে পেয়ে যাবে।”

মেয়েটির কথা শুনে মেহরিমা যেন একটু আশার আলো দেখতে পেল। কারণ মেহেরকে বাসা ভাড়ার কথা বলার পর থেকে সে অনেক টেনশনে রয়েছে। যে টাকা মাইনে পায় তা দিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকা প্রায় অসম্ভব। মেহেরের পড়াশোনার পিছনেও খরচ অনেক। এখন যদি এখানে সত্যি সত্যি ওই চাকরিটা নিতে পারে। তাহলে অন্তত একটু আশার আলো দেখা যাবে। মেহরিমা কথাগুলো ভেবে আর দেরি না করে দ্রুত বসের রুমের সামনে চলে গেল। সবার সাথে অপেক্ষা করতে লাগল বসের বের হওয়ার অপেক্ষায়। কিছু সময় পার হওয়ার পর বসের রুম থেকে বসের সাথে একটি মেয়ে বাইরে বের হয়ে আসলো। দুজনের মুখে মুচকি হাসি। বস সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“অ্যাটেনশন প্লিজ,
সবাই মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শোনো। তোমাদের সকলের সি’বি দেখেছেন উনি। সবার মধ্যে থেকে মোট ১০ জনকে সিলেক্ট করা হয়েছে। আগামীকাল ওনাদের অফিসে গিয়ে সেই ১০ জন ইন্টারভিউ দিবে। তাদের মধ্য থেকে তিন জনকে সিলেক্ট করা হবে উনাদের কোম্পানির জন্য। যারা ওনাদের সাথে কাজ করার সুযোগ পাবে। সিলেক্ট হওয়া সেই ১০ জনের লিষ্ট একটু পর টাঙিয়ে দেওয়া হবে। তখন সবাই দেখে নিও। এখন সবাই নিজেদের কাজে যাও। আর সময় নষ্ট নয়।”

মেহরিমা যাও একটু আশার আলো দেখেছিল, তাও যেন মুহূর্তে নিভে গেল। মুখটা গোমড়া হয়ে গেল তার। সে মনে মনে ভাবল, এতগুলো মানুষের মাঝে সে কখনোই সিলেক্ট হতে পারবে না। সবারই চাকরির অনেক এক্সপিরিয়েন্স আছে। কিন্তু সেতো চাকরিতে একবারে নতুন। তাই তার কোন কিছুতে সিলেক্ট হওয়া অসম্ভব। তাই এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নিজের কাজে চলে গেল সে। কিছুক্ষণ পরেই নোটিশ টানিয়ে দেওয়া হলে সবাই দৌড়ে চলে গেল সেখানে। মেহরিমা আর গেল না। কারণ সে জানে তার নাম ওখানে কখনোই থাকবে না। বেশ কিছুক্ষণ পর ঐ মেয়েটি হাসি মুখে ওর সামনে এসে দাড়ালো। ওর দিকে তাকিয়ে আনন্দিত হয়ে বলল,

“তুমি এখনও চুপচাপ এখানেই বসে আছো? অথচ দেখো গিয়ে ওখানে ১০ জনের মাঝে তোমার নামটাও দেয়া হয়েছে। আর আমিও সিলেক্ট হয়েছি। এবার শুধু ইন্টার্ভিউতে টিকে গেলেই ভাগ্য খুলে যাবে।”

ওর মুখে কথাটা শুনে যেন অবাক এর শীর্ষে পৌঁছে যায় মেহরিমা। সে দ্রুত নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে চলে যায় নোটিশ বোর্ডের কাছে। সেখানে গিয়ে খুঁজতে খুঁজতে দেখে সত্যিই সাত নাম্বারে তার নাম টি দেওয়া আছে। মনে আবারও আশার আলো জ্বলে ওঠে তার। যেভাবেই হোক ওই জবটা তার পেতেই হবে। নিজের সমস্ত চেষ্টা কাজে লাগাবে সে।
,
,
অফিস টাইম শেষ হলে অফিস থেকে বাইরে বের হতেই দেখে সরণ গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখতে পেয়ে মুচকি হাসি দেয় সে। কিন্তু ওকে দেখে মুহূর্তে যেন প্রচণ্ড রকম রাগ উঠে যায় মেহরিমার। সে মনে মনে ভাবে সকালে প্রতিবেশিদের অপমানের কথা। এখন যদি সরণের সাথে তাকে কেউ দেখে, তাহলে আবার নতুন কোন নাটক শুরু হবে। তাই ওকে দেখেও না দেখার ভান করে অন্য দিক দিয়ে চলে যেতে নেয় মেহরিমা। তখন’ই সরণ দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়ায় তার। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলে,

“কি বেপার মেহরিমা, আমাকে এভাবে ইগনোর করছো কেন? তুমি বুঝতে পারছ না আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি। তবু কেন দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছ।”

মেহরিমা বেশ রেগে যায়। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে ওঠে,

“বুঝতে যখন পারছেন আমি আপনাকে ইগনোর করছি। তবুও কেন নির্লজ্জের মত বারেবারে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছেন? আপনি কেন বুঝতে পারছেন না সরণ। আমার আপনার কোন রকম হেল্প চাই না। প্লিজ আমাকে একা চলতে দিন। আর কখনো আমার আশেপাশে আসবেন না। আপনার জন্য অনেক অপমানিত হয়েছি। নিজের এলাকার মানুষগুলোর কাছে। দয়া করে আর কোন সিন ক্রিয়েট করবেন না। আমি চাইনা আবার কোনো নতুন নাটকের সৃষ্টি হোক।”

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,