প্রতীক্ষা পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0
313

প্রতীক্ষা
৪র্থ ও শেষ পর্ব
শেখ জারা তাহমিদ

১৮.
আশফিক ভাবেনি এমন কিছু হতে পারে। সকালে আব্বার সাথে কথা শেষে ও ঘরে ঢুকে পড়েছিল। ক’দিনের জার্নিতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি। তাই ঘরে গিয়ে শুতেই চোখ ঘুমে জড়িয়ে এসেছিলো। আরাম করেই ঘুমোচ্ছিলো ও। বাইরের চেঁচামেচির শব্দে সেই ঘুম ভেঙে যা দেখলো তাতেই ওর মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

ওর মেঝ বোন জেসমিন নদীতে গিয়েছিল গোসল করতে। সেখানে ক্যামেলিয়ার ছোট বোন রোদমিলাও গিয়েছিলো বান্ধবীদের নিয়ে। রোদমিলাকে দেখেই নাকি জেসমিন শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছে ক্যামেলিয়া ভালো মেয়ে না! যেচে আশফিকের পেছনে পরেছে! আশফিকের অনেক টাকা দেখে ওকে বিয়ে করতে চেয়েছে! রোদমিলা প্রথমে বুঝতে পারেনি কী হচ্ছে। পরে বুঝতে পেরে খেপে গিয়ে প্রতিবাদ করেছে। তখনই জেসমিন আরও ফুঁসে উঠেছে। যা-তা কথা বলেছে। এতে করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছে রোদমিলা। আম্মাকে গিয়ে বলেছে। তিনি অবাক হয়েছেন। কি করবেন বুঝে উঠার আগেই ক্যামেলিয়ার আব্বার কাছে খবর পৌঁছে গেছে। গ্রামের নদীর ঘাটে হওয়া ঘটনা অনেকেই দেখেছে, শুনেছে। তাই ক্যামেলিয়ার আব্বা শুনে ফেলা কঠিন কিছু নয়। কোনো শব্দ না করে তিনি ক্যামেলিয়াকে আনতে লোক পাঠিয়েছেন। সত্যি মিথ্যা মেয়ের মুখ থেকেই শুনবেন।

জেসমিনের অমন কান্ডের খবর ঠিক একইভাবে ভুঁইয়াসাহেবের কান পর্যন্ত এসেছে। তিনি রাগের বশে মেয়েকে থাপ্পড় মেরেছেন। এতে জেসমিন কেঁদেকেটে মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। আশফিকের আম্মাও কাঁদছেন মেয়ের সঙ্গে। সোমত্ত মেয়ের গায়ে হাত তোলা তার অনুচিত মনে হয়েছে। মেয়েটা একটা ছোট্ট ভুলই না হয় করে ফেলেছে! তাতে মারতে হবে! তার এমন মনোভাব নিজের মনেই রেখেছেন অবশ্য। ভুঁইয়াসাহেবর সামনে বলার সাহস করেন নি। ক্ষণে ক্ষণে গুনগুনিয়ে কাঁদছেন কেবল। ভুঁইয়াসাহেব চিৎকার করে রাগ ঝারছিলেন তখনও। এতেই আশফিক উঠে এসেছে। সব জেনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরেছে। কিয়ৎক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ও ডাক্তারবাড়ি যাওয়ার জন্য বেরিয়ে গেলো। আব্বা প্রস্তাব নিয়ে ও বাড়ি যাবে সেটাই ওর ভাবনায় ছিলো। কিন্তু এখন সব অসম্ভব মনে হচ্ছে।

১৯.
পড়ন্ত দুপুরে আশফিককে দেখে ক্যামেলিয়ার আব্বা অবাক হলেন না। তিনি যেনো জানতেনই ও আসবে। খুব সহজে ঘাবড়ে না যাওয়ার প্রশিক্ষণ আশফিক একাডেমিতেই পেয়েছে। এ’কবছরের চাকরিতে সেটা আরও চমৎকারভাবে শিখেছে। এখনও ঘাবড়ালো না। ক্যামেলিয়ার আব্বা ঈগল দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলেও শান্ত, বিনয়ী ভাবটা ধরে রাখলো আশফিক। ক্যামেলিয়ার আব্বার কথা শুরুর অপেক্ষা করলো। নিজের কথাগুলো ততক্ষণে গুছিয়ে নিতে থাকলো।

“আমার মেয়েরে তোমার পসন্দ। সেই খবর আমি আরও দুইবছর আগেই পাইসি। তুমি চিঠিপত্তর দিসো, তার খবরও পাইসি। আবার আমার মেয়ে যে সেসব চিঠি কখনো নেয় নাই, সেইটাও জানি। বুঝোইতো মেয়ে দূরে থাকে। সব খবর রাখতে হয়।”, এভাবেই বলতে শুরু করেন ক্যামেলিয়ার আব্বা। আশফিক চমকায়। ডাক্তার সাহেব এই অজপাড়াগাঁয় থেকেও শুদ্ধস্বরে কথা বলছেন, এটায় ও অবাক হয়নি। উনি সরকারি ডাক্তার, এভাবেই কথা বলা বেশ স্বাভাবিক। ও চমেকেছে ডাক্তারসাহেব সবটাই জানেন সেটা জেনে। অবাক হচ্ছে এটা ভেবে কেনো সব জেনেও তিনি কিছু বলেননি!

ওর অনুচ্চারিত প্রশ্নের উত্তর দিলেন ক্যামেলিয়ার আব্বা, “তোমারে কিছু বলি নাই কারণ তুমি সীমা অতিক্রম করো নাই কখনো। আমার মেয়েরে জানাইসো। সে না করার পর বিদেশ চলে গেসো। কেনো গেসো এটা বুঝতে খুব চালাক হওয়ার প্রয়োজন নাই। গেসো যেনো ফিরে এসে সরাসরি বিয়ে করতে পারো। এইযে বিয়ে করবা এই ভরসা তুমি পাইসো আমার মেয়ের কাছ থেকে। সে তোমারে ফিরায় দিসে।কিছু বলে নাই। তবুও তুমি বুঝতে পারসো তার মনে কী আছে। তেমনি আমিও বুঝতে পারসি। মেয়েরে সময় দিসি। বিয়ের প্রস্তাব আসলেও আগ্রহ দেখাই নাই। মেয়ের সাথে সাথে আমিও তোমার অপেক্ষা করসি। তুমি ছেলে ভালো। জামাই হিসেবে মন্দ হবা না। তোমারে বিয়ে করলে মেয়েও এই গ্রামেই থাকবে। যখন-তখন আসতে-যাইতে পারবে। কিন্তু আজকের ঘটনার পর মনে হয় আরও ভাবার দরকার আছে৷ মেয়েরে আনতে লোক পাঠাইসি। তার সাথে সরাসরি কথা বলার সময় হইসে। তেমার পরিবার তারে পসন্দ করে না, এটা জেনে বুঝে সে মতামত দিক। তুমি আসায় আমি খুশি হইসি। তুমি যে আমার মেয়ের কথা ভাবসো, চিন্তিত হইসো, এটা আমার ভালো লাগসে।”

যতটা চমকেছিলো আশফিক, এবারে তারচেয়েও বেশি চমৎকৃত হলো। একজন মেয়ের বাবা এতো সুন্দর করে ভাবতে জানে! ওর হুট করেই মনে হলো, ক্যামেলিয়া ওকে পাত্তা না দিয়ে ঠিক করেছে। একদম উচিত কাজ করেছে।

২০.
আশফিকদের বাড়ির পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেছে। আম্মা ওর সাথে কথা বলছে না। আব্বাও চুপচাপ। বোনেরা ওকে এড়িয়ে চলছে। ভাইরা কথা বলছে, তাও আম্মাকে লুকিয়ে! আশফিক আম্মাকে অসম্মান করে একটাও কথা বলেনি। তবুও তার এই আচরণ! ও গিয়েছিলো আম্মাকে বোঝাতে। আম্মা কিচ্ছু শোনেনি। উল্টে বলেছে, “এই মাইয়া আওনের আগেই ঘরে অশান্তি হইসে। তর ছোডো বোনেরে মাইর খাইতে হইসে। তাও তুই অরে বিয়া করতি?” আশফিকের চেনা আম্মাকে অচেনা মনে হয়েছে। মাতৃস্নেহে তিনি যেনো অন্ধ হয়ে গেছেন। ও শুধু বলেছে, “আম্মা আমি কী আপনার ছেলে না? আমার প্রতি আপনার স্নেহ কোথায় গেলো? জেসমিন ভুল করেছে। অথচ আপনি ওকে শাসন না করে অন্ধস্নেহ করছেন।”

ক্যামেলিয়া মিঠাভাঙা ফিরেছে সেদিন বিকেলেই। আব্বার কথা শুনে লজ্জায় ওর মুখটা এতোটুকু হয়ে গেছিলো। কী বলবে বুঝতে পারে নি। আব্বা যেনো কষ্ট না পায় সেই চেষ্টা ও করেছে। তাও এমন হলো। ওর আশফিককে ভালো লাগে সেটা বুঝতে দেয়া উচিত হয়নি। না বুঝলেই এতদূর ব্যাপারটা গড়াতো না। আশফিক ওকে ডেকে পাঠিয়েছে সুলতানাদের বাড়ি। ও ঠিক করেছে যাবে। শেষ একটা বোঝাপড়া দরকার।

২১.
ক্যামেলিয়া যখন বললো ওদের একসঙ্গে পথ চলা হবে না, তখনও আশফিক ঘটনা বুঝতে পারেনি। ও ভেবেছে সববারের মতোই মনে এক, মুখে আরেক কথা বলছে ক্যামেলিয়া। কিন্তু একটু পরেই বুঝলো ক্যামেলিয়া সত্যি চাইছে না। আশফিককে আর চাইছে না। এই উপলব্ধি ওকে দুমড়ে মুচড়ে দিলো।

হেরে যাওয়া মানুষের মতো বাড়ি ফিরে গেলো। রাতটা কোনোরকমে কাটিয়ে সকালেই বাড়ি ছাড়লো। প্রচন্ড অভিমানে মিঠাভাঙা ছেড়ে গেছিলো ও। ক্যামেলিয়া কী জেনেছিল সেটা? অথবা আশফিকের আম্মা?

২২.
বর্তমান। ১৯৯৮ সাল৷ এপ্রিল মাস। ফিলিপাইন৷ ইলোইলো পোর্ট। ১৯৯৭’র ফেব্রুয়ারিতে ২৪জন মেরিনার নিয়ে যাত্রা করা জাহাজটির একবছরের ভয়েজ শেষ হচ্ছে আজ। গতকাল রাতের ফ্লাইটে নতুন মেরিনাররা এসে পৌঁছেছে। শেষ মুহুর্তের হ্যান্ডওভার হয়ে গেলেই নেমে পরবে পুরোনো নাবিকরা। প্রচন্ড ব্যস্ততার মাঝেও তাদের আনন্দ অনুভব করা যাচ্ছে। সন্ধ্যেয় তাদের ফ্লাইট। দেশে ফেরা নিয়ে সকলেই দারুন উৎফুল্ল। একমাত্র ব্যতিক্রম থার্ড ইন্জিনিয়ার আশফিক হামিদ। ওর ফেরার তাড়া নেই। ওর ফেরার অপেক্ষায়ও কেউ নিশ্চয়ই বসে নেই। বলা যায়, সবার থেকে ও বিচ্ছিন্ন। সিংগাপুর থেকে ফিরে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলো অবশ্য। জাহাজে উঠছে জানিয়েছিল। তখনই হেড অফিসে বলে এসেছিলো ওর চিঠি এলে সেটা রিজিওনাল অফিসে না পাঠাতে। মন পুড়লেও কিচ্ছু জানতে চায় না ও। নিয়ম করে প্রতিমাসে স্যালারির একটা নির্দিষ্ট অংশ বাড়ি পাঠিয়ে দায়িত্ব পালন করেছে।

২৩.
ছেলে বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় বলতে এসেছিল তার আম্মাকে। বিদায় নিতে এসেছিলো। রাগ দেখিয়ে তিনি কথা বলেননি। ছেলেকে বিদায় দেননি। এখন বেশ পস্তাচ্ছেন। বছর পার হয়েছে ছেলেকে দেখেননি! ছেলে কেমন আছে জানেন না! ছেলেকে তার আব্বা চিঠি লিখেন প্রতি মাসে, সেগুলোর উত্তর আসেনা। কণ্যাস্নেহে অন্ধ হয়ে পুত্রকে দূরে ঠেলেছেন। কী ভুল করেছেন সেটা টের পাচ্ছেন এখন৷ ছেলের সংসারে ছেলে ভালো থাকলেই হলো। তিনি কেনো সেটা বোঝেননি? আদতে সব স্বাভাবিক লাগে। কিন্ত তিনি বোঝেন ভুঁইয়াসাহেব সূক্ষ্মভাবে তাকে এড়িয়ে চলেন। এড়িয়ে চলে ছেলেরাও। প্রচন্ড অপরাধবোধ তাকে জাপটে ধরে রেখেছে। ইদানীং আতংকিত হন এই ভেবে, ছেলে যদি কখনো আর না ফেরে!

২৪.
আশফিক যখন বলেছিল, আব্বা আপনি ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখেন, আমরা পরে বসতেছি, তখন থেকেই ভুঁইয়াসাহেব ভাবছিলেন। বড়ছেলেটার রাগ আছে। জেদ আছে। কিন্তু আব্বার সামনে সে বরাবরই শান্ত। ভেবেচিন্তে কথা বলা ছেলে যখন কিছু বলেছে তিনি সবসময় সেটায় গুরুত্ব দিয়েছেন। সেই ছেলের পছন্দ যেমনই হোক, খারাপ হবে না। এটা তিনি কেনো তখন ভাবলেন না? ছেলে রাগ করে, কষ্ট পেয়ে চলে গেছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। কিন্তু প্রতিমাসে ঠিক টাকা পাঠাচ্ছে। দায়িত্ব ভুলে যায়নি। ছেলের সামর্থ আছে। চাইলেই নিজের বিয়ে নিজে করে ফেলতে পারতো। অথচ তার মত চাইলো। মায়ের মত চাইলো। না পেয়ে টু শব্দ করলো না। বোঝাতে চাইলো। ক্যামেলিয়া ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছে সেই খবরও তিনি পেয়েছেন। অথচ চাইলেই আশফিককে বিয়ে করে দূরে চলে যেতে পারতো। মেয়েটাও ভালো। কেনো বুঝলেন না?

২৫.
স্কুলে টানা দুটো ক্লাস নিয়ে ক্লান্ত লাগছে ক্যামেলিয়ার। টিচার্সরুমে বসে পানি খেলো ও। সকালের আকাশে তাকিয়ে ওর মন ছুটে গেলো হারিয়ে যাওয়া মানুষটার কাছে। সে কেমন আছে? ক্যামেলিয়াকে তার কি মনে পরে? সে কি খুব কষ্ট পেয়েছিলো সেদিন? ক্যামেলিয়া যখন বললো ওদের পথ আলাদা হয়ে গেছে, সে কেনো মেনে নিলো? সে কি আর ফিরবে না? মানুষটার জন্য ওর অপেক্ষা কী ফুরাবে না? আশফিক জাহাজে চলে গেছে খবর পেয়েছে গ্রামে থাকতেই। তারপরের মাসেই শহরের এই স্কুলটায় চাকরিতে ঢুকেছে ও। সেই থেকে প্রতিমাসে দুটো করে চিঠি পাঠাচ্ছে আশফিকের হেড অফিসে। কোনো উত্তর আসেনি। প্রথম প্রথম ভেবেছে হেড অফিস থেকে চিঠিগুলো পাঠানো হয় না। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছে আশফিকের স্ট্রিক্ট নিষেধ আছে। তবুও দমে যায়নি ও। নিয়ম করে চিঠি পাঠাচ্ছে। একসময় নিশ্চয়ই মানুষটার কাছে চিঠিগুলো পৌঁছবে। ক্যামেলিয়া অপেক্ষা করবে, যেমনটা আশফিক করেছে। তবে এই সবকিছু সম্ভব হতো না যদি না আব্বা সাপোর্ট দিতেন। কি চমৎকার ভাবে ওর মন পড়েছিলো আব্বা। সবার বিরুদ্ধে গিয়ে ওকে শহরে আসতে দিয়েছে। মেয়ের অপেক্ষায় শামিল হয়েছে। আকাশপানে বার্তা পাঠায় ক্যামেলিয়া, “জলদি ফিরুন ইন্জিনিয়ার সাহেব। অপেক্ষা মিটুক এবার।”

২৬.
ঢাকা। বাংলামোটর। ব্যস্ত হেড অফিসের পাঁচ তলায় বসে আছে আশফিক। জয়েনিং নিয়ে কথা বলতে এসেছিল। তার আগেই রিসেপশন থেকে আর্জেন্টলি ওকে পাঠানো হয়েছে জুনিয়র এইচআর কো-অর্ডিনেটর রেজা আহসানের কাছে। রেজার সাথে সখ্যতা আছে আশফিকের। বিস্ময় নিয়েই ওর কেবিনে এসেছে। রেজা ওকে দেখতেই বললো, “আশফিক ভাই, আপনি তো রেকর্ড করে ফেলেছেন। গত চৌদ্দমাসে সবার যত চিঠি আসছে, আপনার একলা তত চিঠি আসছে। স্ট্রিক্টলি না করলেন বলে একটাও চিঠি আপনাকে পাঠালাম না। জমতে জমতে ড্রয়ার উপচে পরার দশা। সব কাজ বাদ দিয়ে আগে চিঠিগুলা নেন।”

আশফিক বেশ অবাক হলো। এতো চিঠি কে পাঠাবে ওকে! আব্বা মাসে একটা করে পাঠালেও এতো চিঠি হওয়ার কথা না। তবে?

ওর প্রশ্নের উত্তর মিললো নিমেষেই। আব্বা, বন্ধুরা প্রতিনিয়ত চিঠি পাঠিয়েছে। ও বিস্মিত হলো আম্মার চিঠি দেখে। মোট আট’টা চিঠি পাঠিয়েছে আম্মা! তবে ওর বিস্ময় আকাশ ছুঁলো ক্যামেলিয়ার চিঠি দেখে। মেয়েটা তেরো দুগুণে ছাব্বিশটা চিঠি পাঠিয়েছে! এত চিঠি দেখে ও বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলো একেকটা চিঠি। সেইসাথে অভিমান গলে গলে পরলো। রেজা বোধহয় বুঝলো ওর অবস্থা। নরমস্বরে বললো, “আশফিক ভাই, আগে চিঠিগুলা পড়েন। জয়েন আল্লাহ চাইলে পরে করলেন।” ঘোরগ্রস্ত আশফিক হোটেলে ফিরে এলো। রুমে এসে একের পর এক চিঠি পড়লো। পড়ালেখা না জানা ওর আম্মা কাউকে দিয়ে চিঠি লিখিয়েছেন। এত আবেগ দিয়ে লিখিয়েছিন। ওর চোখ ভিজে এলো। আর ক্যামেলিয়া? সব ছেড়েছুড়ে ঢাকায় ওর অপেক্ষা করছে মেয়েটা। এও কী হবার ছিলো? আশফিকের চোখ আবারও ভিজে এলো। কে বলে ছেলেদের কাঁদতে নেই!

২৭.
আজকের সকালটা ক্যামেলিয়ার জন্য অন্যরকম। স্কুলে গিয়ে জেনেছে ওর প্রমোশন হয়েছে। কলিগরা যখন মিষ্টি খাবার বায়না ধরেছে, তখন পিয়ন এসে জানালো ক্যামেলিয়া ম্যাডামকে একজন খুঁজছে। এটুকু শুনতেই ক্যামেলিয়া পড়িমরি ছুটলো।

গেইটের বাইরে দাঁড়ানো সাদা শার্ট পরা আশফিক ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলো। শুধালো, “তুমি কি আমার সাথে মিঠাভাঙা ফিরবে, ক্যামেলিয়া?”

২৮.
আজকের বিকেলটা ভুঁইয়াসাহেবর জন্য অন্যরকম। একা একাই দৌলতপুর বাজারে গিয়েছিলেন। হাঁস কিনতে। ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। হুট করেই ডাক শুনলেন, “আব্বা, আপনি একা কেনো বাজার করছেন? সাথে কাউকে আনবেন না?”

২৯.
আজকের সন্ধ্যেটা আশফিকের আম্মার জন্যও অন্যরকম। সৌরবিদ্যুতের আলোয় উঠোনে বসে নকশী পিঠা বানাচ্ছিলেন সকলে মিলে। হঠাৎ শুনলেন, “এই সন্ধ্যেয় কিসের পিঠা আম্মা? কয়দিন পর আমার মতো চশমা ছাড়া দেখবেন না কিছু!”

৩০.
দূর থেকে জ্বলজ্বল করা মরিচবাতি, ইংরেজিতে যাকে বলে ফেয়ারি লাইট, সেটার দিকেই ক্ষণে ক্ষণে তাকাচ্ছে মিঠাভাঙার মানুষজন। ডাক্তার বাড়িতে আজকে বিয়ে। আবার ভুঁইয়া বাড়িতেও বিয়ে। দুই বাড়ির গেইটেই বড় বড় করে লেখা “আশফিক-ক্যামেলিয়ার শুভ-বিবাহ”।

সমাপ্ত।