প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-২৬+২৭+২৮
ইসরাত জাহান তানজিলা
_____________________
পাবেল মিথ্যা বলছে না-কি দারোয়ান? দারোয়ান কেন মিথ্যা বলবে? মিথ্যা বলে তার কি লাভ? অন্যদিকে পাবেল এমন ভাবে বলছে যে তাকেও অবিশ্বাস করা যায় না। দ্বিধায় পড়ে যায় শ্রাবণী সঙ্গে দোটানা। কাল দারোয়ানকে অবশ্যই ডাকবে আবার। পাবেল যখন বাসায় থাকবে না। বাসায় ডাকার সুযোগ না পেলে, ও নিজেই যাবে দারোয়ানের কাছে। শ্রাবণী এখন আর চেঁচামেচি করছে না। নিঃশব্দে গম্ভীর মুখে বসে আছে। পাবেল ভীষণ ধূর্ত, চতুর। কোন পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দিতে হয় তা সে ভালোই জানে। এই ধূর্ত লোকটাকে বিশ্বাস করা বড়ো কঠিন। দারোয়ান সহজ-সরল ষাটার্ধো বুড়ো লোক। সে মিথ্যা বলতে পারে না। পাবেল ক্লান্ত গলায় বলল,
–‘আজেবাজে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো শ্রাবণী। যাও রান্না বসাও। ক্ষুধা লেগেছে।’
শ্রাবণী হ্যাঁ না কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে গেল। পাবেল চেয়ে দেখল শ্রাবণী রান্নাঘরের দিকেই যাচ্ছে। ও ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ল্যাপটপ নিয়ে বসে। ঘন্টা দুয়েক পর রান্না শেষ করে যন্ত্রের মতন ডাকল শ্রাবণী,
–‘রান্না হয়েছে। খেয়ে নিন।’
পাবেল আসছি বলেও দশ ধরে মিনিট ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকে। আচমকা শ্রাবণী এসে ছোঁ মেরে পাবেলের সামনে থেকে ল্যাপটপটা নিয়ে বিছানার অপর পাশে ছুঁড়ে মারে। পাবেল পরম আশ্চর্যে শ্রাবণীর দিকে তাকায়। এই মেয়েটা আজকাল ওকে একদমই ভয় পায় না। পাবেল চাপা রাগ নিয়ে বলে,
–‘তুমি এটা কি করলে?’
শ্রাবণী ঝাঁঝালো গলায় বলে,
–‘কখন খেতে ডেকেছি আপনায়? খাবার টেবিলে বেড়ে প্লেটে তুলে দিতে হয় আপনাদের। প্লেটে নিয়েও মুখে তুলতে পারেন না। সেই কখন খাবার বেড়ে রেখেছি। খেতে বসে বলবেন, খাবার ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। গরম করে দেও। খাওয়ার সময় আবার সামনে বসে থাকতে হয়। এটা, ওটা এগিয়ে দিতে। আমি আপনাদের বাড়ির কাজের মানুষ? মাসে হাজার হাজার টাকা খরচ করতে পারেন। শুধু তিন-চার হাজার টাকা বেতন দিয়ে কাজের মানুষ রাখতে পারেন না। ছেলের বউ ঘরে তুলেই আপনার মা কাজের মানুষ বিদেয় করে দিয়েছে।’
–‘আজকাল দেখি খুব বেশি মুখ চলে তোমার। এত সাহস আসছে কোত্থেকে?’
–‘মানুষ যখন অধৈর্য, তিক্ত হয়ে যায় তখন সাহস আপনাআপনিই বেড়ে যায়।’
পাবেল কথা বাড়ায় না। যেন শ্রাবণীর রাগকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। খেতে বসে বলে,
–‘শ্রাবণী খাবার তো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। গরম করে দেও।’
শ্রাবণী দেখলো খাবার ঠাণ্ডা হয়নি, গরমই আছে। পাবেল হাসছে। শ্রাবণীর সাথে ঠাট্টা করছে ওর রাগ বাড়াতে। আশ্চর্য! এই লোকটা আজকাল এমন হাবভাব করছে কেন? শ্রাবণী রেগে গেলেও গুরুত্ব দেয়না। চিৎকার,চেঁচামেচি করলেও চুপ থাকে। পাবেল খাবার মুখে দিতে দিতে বলে,
–‘বুঝলে শ্রাবণী ঘরের বউয়ের রাগ যত কম গুরুত্ব দেওয়া যায় ততই ভালো। তারা চিৎকার চেঁচামেচি করে গলা ফাটিয়ে ফেললেও নীরব থাকতে হয়। তাহলে সংসারে শান্তির অভাব হয় না।’
শ্রাবণী চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে পাবেলের মুখের দিকে। তার মাথায় এই বদ বুদ্ধি ঢুকালো কে? পাবেল যেন শ্রাবণীর চিন্তাটা ধরে ফেলল,
–‘এসব রাজিবের কথা। রাজিবকে চিনো তো? আমার বন্ধু। আমাদের বাসায় এসেছিল কয়েকবার। দেখেছো না? আমিও আজকাল ওর বুদ্ধিটা কাজে লাগাচ্ছি। বিয়ে যখন করেই ফেলেছি তখন সংসারে একটু শান্তি বজায় রাখা উচিত। সারাদিন পর বাসায় ফিরে সামান্য শান্তি যদি না পাওয়া যায়!’
শ্রাবণী গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলে,
–‘সারাদিন বাসার বাইরে কি করেন? আপনার তো কোন কাজকর্ম নেই।’
–‘তোমায় কে বলেছে আমায় কাজকর্ম নেই? আজকে এমপি সাহেব এসেছিল। আমার সাথে খুব ভালো সম্পর্ক। ওখানেই ছিলাম।’
পাবেলের ভাত খাওয়া শেষ। সে আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসে। শ্রাবণীর মাথায় শুধু আনোয়ার মিয়ার বলা কথা গুলো ঘুরছে। পাবেলের মুখের দিকে তাকাতেই ঘেন্না হয়। এই মানুষটাকে বুঝতে ব্যর্থ ও।
সকাল বেলা পাবেল বাসা থেকে বের হওয়ার একটু পরই মিজান উদ্দিন বাজার নিয়ে আসে। মিজান উদ্দিন নামক লোকটা মাঝে মধ্যে এবাসায় টুকটাক কাজ করে দেয়। বাজার সদাই করে দেওয়া, বাগানের গাছে পানি দেওয়া, আগাছা পরিষ্কার করা- এই জাতীয় কাজকর্ম। শ্রাবণী মিজান উদ্দিনকে বলে,
–‘আপনি যাওয়ার সময় দারোয়ান চাচাকে বলেন আমি তাকে ডাকছি।’
মিজান উদ্দিন গেটের সামনে থেকে ফিরে এসে শ্রাবণীকে জানায় আনোয়ার মিয়া গেটে নেই। এই লোকটা শুধু ফাঁকিবাজি করে। হয়ত চা খেতে গেছে নয়ত চায়ের দোকানে বসে বসে সিনেমা দেখায় মজেছে। দুপুরের দিকে আনোয়ার মিয়া নিজেই আসলেন। শ্রাবণী তাকে দেখে বলল,
–‘সকালে কোথায় ছিলেন? এসে ভালো করেছেন। কথা ছিলো আপনার সাথে।’
আনোয়ার মিয়া সতর্ক গলায় বলে,
–‘পাবেল বাসায়?’
–‘উঁহু।’
–‘তুমি তাকে জিজ্ঞেস করেছো ওসব?’
–‘হুম।’
–‘নিশ্চয়ই অস্বীকার করেছে?’
–‘হ্যাঁ।’
–‘আমি আগে থেকেই জানতাম অস্বীকার করবে। এ বাসায় কাজ করি অনেক বছর ধরে। খুব ভালো করেই চিনি ওকে।’
গেটের সামনে গাড়ি থেমেছে। সেরকম শব্দই পাওয়া গেল। আনোয়ার মিয়া ব্যস্ত গলায় বলল,
–‘পাবেল এসে গেছে বোধ হয়। আমি আসছি এখন।’
আনোয়ার মিয়া দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগলো। নিচ তলার সিঁড়িতেই পাবেলের সাথে দেখা হয়ে গেল। পাবেল বাসায় ঢুকে শ্রাবণীকে জিজ্ঞেস করে,
–‘দারোয়ান চাচা বাসায় এসেছিল?’
শ্রাবণী কি বলবে ভেবে পেল না। আনোয়ার মিয়ার সাথে পাবেলের নিশ্চয়ই দেখা হয়েছে সিঁড়িতে। তিনি পাবেলকে কি বলেছে কে জানে। দুইজন যদি দুই রকম কথা বলে তাহলে পাবেল সন্দেহ করবে। পাবেল আবার বলল,
–‘কথা বলছো না যে?’
শ্রাবণী হালকা হেসে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,
–‘আমি ডেকেছিলাম একটু। বেডরুমের ফ্যানটা চলছে না কেন দেখেন তো একটু।’
শ্রাবণী চতুরতার সাথে কথা ঘুরায়। পাবেল ফ্যান ছেড়ে দেখলো ঠিকঠাক চলছে,
–‘ফ্যান ঠিকঠাক চলছে। কথা ঘুরাচ্ছো কেন? দারোয়ান কেন এসেছিল?’
পাবেল শ্রাবণীর থেকে এক কাঠি সরেস যেন। শ্রাবণী চমকে যায়। উত্তর খুঁজে পায় না। পাবেলও এই প্রসঙ্গে কিছু জিজ্ঞেস করে না ফের। শ্রাবণী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
_____________
দুইদিন পর শ্রাবণী এসএসসির রেজাল্ট দেয়। রেজাল্ট ভালো হয়। ওর শ্বশুর শাশুড়ি তখনো গ্রামে। পাবেল সেদিন অনেক রাত করে বাসায় ফিরে। এই মুহূর্তে শ্রাবণীর মাথায় সবচে বড় চিন্তা কলেজে ভর্তি নিয়ে। পাবেল কি রাজি হবে শ্রাবণীকে কলেজে ভর্তি করাতে? দেয়ালের টাঙানো ঘড়িটা ঢং ঢং করে জানিয়ে দেয় রাত বারোটা বাজে। শ্রাবণী পাবেলকে বলে,
–‘রেজাল্ট দিয়েছে আমার। ক’দিন বাদেই কলেজে ভর্তি শুরু হবে।’
–‘তুমি কি আরো পড়তে চাও?’
শ্রাবণীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কপালে ভাঁজ পড়ে। পাবেলের সুর ভালো লাগছে না। শ্রাবণী কিছু বলার আগেই পাবেল আবার বলল,
–‘বাবা-মা বাসায় ফিরুক। তাদের বলে দেখো তারা কি বলে।’
শ্রাবণী অবাক হয়। শ্রাবণীর কলেজের ভর্তির ব্যাপারে পাবেলের মতের চেয়ে জয়নাল সাহেব আর ফরিদা বেগমের মতের গুরুত্ব বেশি? ও নিচু গলায় বলল,
–‘তারা কবে ফিরবে?’
পাবেল আধশোয়া হয়ে সিগারেট ধরায়। কিছুক্ষণ পর বলে,
–‘জমিজমা নিয়ে ঝামেলাই শেষ হচ্ছে না। আরো কয়েকদিন লাগতে পারে।’
–‘আমি তো এবাড়িতে আসার পর থেকে আপনাকে কোনো কাজ করতে কিংবা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে আপনার বাবা-মায়ের উপর নির্ভরশীল হতে দেখিনি। এখন ভর্তির কথা বলতেই তাদের গুরুত্ব বেড়ে গেল?’
শ্রাবণীর শীতল গলায় চাপা রাগের ফুলকি। পাবেল বিরক্তি নিয়ে বলে,
–‘আহ শ্রাবণী! এত রাতে যন্ত্রণা করো না তো। আচ্ছা বিয়ের আগে কি এমন কোনো কথা ছিলো যে বিয়ের পর তোমাকে আমরা পড়াবো?’
শ্রাবণী দৃঢ় গলায় বলে,
–‘হ্যাঁ।’
–‘কে বলেছে পড়ানোর কথা? বাবা?’
–‘হুম।’
–‘তাহলে তুমি বাবাকেই বলো কলেজে ভর্তি করানোর কথা।’
পাবেল একটু থেমে বলে,
–‘বিয়ের পর মেয়েদের লেখাপড়া হয়? সংসার সামলায় না-কি লেখাপড়া?’
শ্রাবণী উত্তর দেয় না। পাবেল একটার পর একটা সিগারেট ধরাচ্ছে। শ্রাবণী একই ভঙ্গিতে বসে আছে অনেকক্ষণ ধরে। চেহারায় গুমোট ভাব।
–‘ওভাবে বসে আছো কেন? লাইট অফ করে শুয়ে পড়ো। পড়াশোনার ব্যাপারে এত সিরিয়াস তো এই বয়সে বিয়ে কেন করেছো?’
বিয়ে কেন করেছে- এই প্রশ্নটা কেন জানি শ্রাবণীর হৃদয়ে যন্ত্রণার সৃষ্টি করলো। বিচ্ছিরি তীব্র যন্ত্রণা। পিছনের সমস্ত দুঃখের স্মৃতি তাজা করে দিলো। ওর চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে বার বার। শ্রাবণী ওর দুঃখের আলাপ পাবেলের সাথে কখনো করে নাই। করার মত সম্পর্কও নেই। পাবেল বলল,
–‘রাত অনেক হয়েছে। লাইট অফ করে শুয়ে পড়ো শ্রাবণী। তোমার ভর্তির ব্যাপারে বাবার সাথে কথা বলবো কালকে। এখন কান্নাকাটি বন্ধ করো, শান্তিতে ঘুমাতে দেও।’
–‘আপনার বাবা যদি বলে ভর্তি করাবে না তাহলে?’
–‘এত কথা কেন বলছো? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখো কয়টা বাজে।’
শ্রাবণী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে দেড়টা বেজেছে। ওর ঘুম পেল না। লাইট বন্ধ করে ঝিম ধরে বিছানার এক কোণে বসে রইল। ঘুমালো না। লেখাপড়াই ওর জন্য একমাত্র উপায়; নিজের পরিচয় তৈরি করার, সুন্দর করে বাঁচার। নিজের আত্মসম্মান খুইয়ে এবাড়িতে শুধু খাওয়া, পরার জন্য পরে থাকার নাম তো জীবন নয়। জীবনের পথ চলা এখনো অনেক বাকী।
(চলবে)
প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-২৭)
ইসরাত জাহান তানজিলা
_______________________
শ্রাবণীর ভর্তির ব্যাপারটা নিয়ে পাবেল পুরোপুরি চেপে গেল। কেবল বলল, বাবা-মা গ্রাম থেকে ফিরুক। সেলিনা চৌধুরী শ্রাবণীকে ফোন করে জিজ্ঞেস করল রেজাল্ট কেমন হয়েছে। শ্রাবণী বলল,
–‘ভালো হয়েছে।’
শ্রাবণীর ফোন নম্বর সেলিনা চৌধুরীর কাছে ছিলো না। নিশ্চয়ই যাইফ দিয়েছে। সেবারের পর থেকে যাইফের সাথে শ্রাবণীর আর যোগাযোগ হয়নি। শ্রাবণীও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। শ্রাবণীর উপর যাইফের কিসের রাগ? রাগ করার যৌক্তিকতা কি? সেলিনা চৌধুরী বলল,
–‘কলেজে ভর্তি করাবে তোকে?’
–‘আমার শ্বশুর শাশুড়ি গ্রামে। তারা আসলে তারপর জানা যাবে।’
–‘পাবেল তো বাসায়। সে কি বলে?’
শ্রাবণী চুপ থাকে। সেলিনা চৌধুরী বলে,
–‘শোন শ্রাবণী, লেখাপড়া বাদ দিস না। যত যাই হোক লেখাপড়াটা অন্তত কর। ভবিষ্যত বলতে তাহলে কিছু একটা হবে।’
–‘আমার ফোন নম্বর তোমায় কে দিয়েছে? যাইফ ভাই? এসব কথা বলতে নিশ্চয়ই সে শিখিয়ে দিয়েছে।’
–‘তোর কেন মনে হচ্ছে এসব যাইফ বলতে বলেছে আমায়?’
–‘আমি বুঝি ফুফু। অস্বীকার করো না। যাইফ ভাই কেমন আছেন?’
–‘পড়াশোনার চাপে আছে খুব। সামনে অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা।’
সেলিনা চৌধুরী একটা দম ফেলে গাঢ় গলায় আবার বলে,
–‘আমিই যাইফকে বলেছি তোর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করতে। শ্রাবণী তুই আমার উপর রাগ করিস না। কষ্টে থাকা মানুষ যখন কারো কাছ থেকে সহানুভূতি পায় তখন তার প্রতি একটা ভালোলাগা তৈরি হয়ে যায়। আমি চাইনি তোদের ভিতরকার ভালোলাগাটা অন্য কিছুতে গড়াক। তাছাড়া এসব নিয়ে তোর আর পাবেলের ভিতরও ঝামেলা হচ্ছে। এভাবে চলতে চলতে হয়ত তোর আর যাইফের ভিতর একটা অনুভূতি সৃষ্টি হয়ে যেত। যেটাকে পরকিয়া বলে। হয়ত পরিবার আর সমাজের কথা ভেবে এই অনুভূতির কথা কেউই কাউকে বলতে পারতি না। দুইজনই জ্বলে পুড়ে মরতি।’
শ্রাবণী নীরব। ওর চোখ দুটো টলমল করছে। সেলিনা চৌধুরী বলে,
–‘আমাদের সমাজে একটা মেয়ে স্বামীর কাছে যতই অবহেলা, অত্যাচার, অনাদর পাক। তবুও তার মনোযোগ তার স্বামীর প্রতিই থাকতে হবে। সে একটু ভালোলাগা কিংবা ভালো থাকার খোঁজে কাউকে বন্ধু হিসেবে পাওয়ার ইচ্ছেও প্রকাশ করতে পারে না। তাহলেই সেটা পরকিয়া হয়। পরকিয়া মানে ভয়াবহ, জঘন্য পাপ।’
শ্রাবণীর চোখ থেকে নিঃশব্দে দুই ফোঁটা জল গড়ালো। ও কান্না চাপিয়ে বলল,
–‘ফুফু যাইফ ভাই আর আমার মাঝে ওরকম কোনো সম্পর্ক কিংবা অন্য কোনো অনুভূতি ছিলো না।’
–‘তা আমি জানি শ্রাবণী। আমি কি বলতে চেয়েছি সেটা কি তুই বুঝিসনি? তোদের ভিতর সবচেয়ে বড়ো সত্য তোরা দুজন ছেলে-মেয়ে। বন্ধুর মতন পাশে থাকতে থাকতেও গোপন একটা অনূভুতি তৈরি হয়ে যেতে পারে। তার উপর তুই বিবাহিতা। আমরা মানুষ। ভালোবাসার কাঙাল। ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমাদের সবার মনে আছে।’
শ্রাবণী এভাবে কখনো ভাবেনি। এসব ওর মাথায় আসেনি। কি বলবে খুঁজে পায় না। সেলিনা চৌধুরী ফের বলে,
–‘এসব কথা শুনে তোর আমার উপর রাগ হতে পারে, অভিমান হতে পারে। কিন্তু কথা গুলো তিক্ত হলেও সত্য।’
শ্রাবণীও এই সত্যি মেনে নিলো। আসলেই তো, সবচেয়ে বড়ো সত্য ওরা দুজন ছেলে-মেয়ে। শ্রাবণী বলে,
–‘না ফুফু আমি রাগ করিনি।’
–‘তোর শ্বশুর বাড়ির লোকজন যদি তোকে ভর্তি করাতে না চায়। তাহলে আমি তোকে ভর্তি করাবো। তোর লেখাপড়ার খরচ আমি দিবো।’
–‘মানুষের এত করুনা আমি নিতে পারবো না।’
–‘তার মানে তুই আমার উপর রাগ করেছিস? অভিমান করে এসব বলছিস?’
–‘অভিমান কোথায় দেখলে? অন্যের এত করুনা নিতে কারই বা ভালো লাগে? এখন রাখছি ফুফু। পরে কথা বলবো।’
শ্রাবণী ফোন রাখে। পাবেল ডাকছে। কাল বাসায় পাবেলের বন্ধুদের দাওয়াত করেছে। সেই নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত পাবেল। শ্রাবণীকে বলল,
–‘কাল বাসায় যারা আসবে তাদের ভিতর অনেকেই জানে না আমি বিয়ে করেছি। আমার কয়েকজন বন্ধুরা জানে কেবল। যারা জানে না, আমি তাদের জানাতেও চাচ্ছি না। ষোলো বছরের একটা মেয়ে বিয়ে করেছি। সবাই এটা নিয়ে ঠাট্টা করবে।’
শ্রাবণী তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে,
–‘তো আমি কালকে বাসা থেকে চলে যাবো?’
–‘আহ রাগ করছো কেন? আমি কি সেরকমটা বলেছি?’
–‘তো কি বলতে চাচ্ছেন?’
–‘কাল সবাইকে বলব, তুমি আমার কাজিন।’
–‘কাজিন বলবেন? বেশ। আপনাকে স্বামী হিসেবে পরিচয় দিতে আমারও খুব বেশি ভালোলাগে না।’
পাবেল ভেবেছিল শ্রাবণী বিষয়টা নিয়ে দুঃখ পাবে। পাবেল সামান্য অবাক হয়। সে হাসলো। কি মনে করে হাসলো কে জানে। কিছুক্ষণ পর বলল,
–‘আলমারিতে একটা খয়েরি শাড়ি দেখেছো না?ওটা তুমি পরো কাল। তোমায় ভালো লাগবে।’
–‘প্রথমত অত পাতলা ফিনফিনে শাড়ি আমি পরবো না। দ্বিতীয়ত ওটা অন্যের জন্য কেনা।’
এই প্রসঙ্গটা আসতেই শ্রাবণীর শাড়ির সাথের চিঠিটার কথা মনে পরলো। শ্রাবণী বলল,
–‘শাড়িটার সাথে একটা চিঠিও ছিলো…।’
–‘নিশ্চয়ই চিঠিটাও তুমি পরেছো। এখন তোমার মনে দুইটা প্রশ্ন, মেয়েটাকে আমি তুই করে বলেছি কেন? আর একটা বিবাহিত মেয়ের সাথে কি আমার সম্পর্ক ছিলো? হ্যাঁ, ছিলো সম্পর্ক। আর ও আমার ফ্রেন্ড ছিলো। ওর বিয়ে হওয়ার পরেও আমাদের মাঝে সম্পর্ক ছিলো। যেটাকে বলে পরকিয়া। ওসব অনেক আগের কাহিনী।’
শ্রাবণী অবাক হয়। কত সাবলীল ভাবে কথা গুলো বলছে পাবেল। অবাক না হয়ে পারা যায় না। পাবেল আবার বলল,
–‘এত গেঁয়ো হলে চলে না শ্রাবণী। আধুনিক হও। এটা তোমার বাপের বাড়ি না। এটা তোমার শ্বশুর বাড়ি। সব বিষয়ে আমাদের সাথে মানিয়ে চলতে হবে। তুমি কি এখন লম্বা ঘোমটা টেনে আমার বন্ধুদের সামনে যেতে চাচ্ছো? ওরা তাহলে আমায় নিয়ে হাসাহাসি করবে।’
–‘ফিনফিনে পাতলা শাড়ি পরা মানেই আধুনিকতা না। আচ্ছা আমি যাবো না আপনার বন্ধুদের সামনে।’
শ্রাবণীর গলায় কঠিন তেজ। পরদিন পাবেলের বন্ধুরা আসলো। শ্রাবণী রান্নাবান্না করলো। কিন্তু তাদের সামনে গেল না। পাবেল বেশ কয়েকবার সবার সামনে যাওয়ার জন্য বলল শ্রাবণীকে কিন্তু শ্রাবণী নিজের জেদ করে রাখলো। ও তিনতলার একটা রুমে চুপচাপ বসে রইল। হঠাৎ তিন তলায় ওঠার সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। কেউ তিনতলায় আসছে। শ্রাবণী জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলো পাবেল আর ওর বন্ধু মুনিম আসছে। শ্রাবণী যে রুমে আছে ওই রুমের পাশেই একটা ফাঁকা জায়গা আছে। সেখানে বসার জন্য চমৎকার ব্যবস্থা রয়েছে। ছোট একটা টেবিল আর দুই তিনটা বেতের চেয়ার রাখা। পাশেই অনেকগুলো ফুলের টব সাজানো। পাবেল মুনিমকে নিয়ে সেখানে বসলো। মুনিম ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
–‘আচ্ছা তোর বউ কি বাসায় না? এত রান্নাবান্না করলো কে?’
পাবেল গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,
–‘আছে বাসায়ই।’
–‘বাসায়? কোথায় বাসায়?’
–‘ও যাবে না কারো সামনে। আমিও তেমন জোর করিনি। অনেকেই জানে না আমি বিয়ে করেছি। ওইটুকু একটা মেয়েকে বিয়ে করেছি জানলে তো সবাই ঠাট্টা করবে।’
–‘তো বিয়ে কেন করেছিস?’
–‘সব আমার বাবার মর্জি। আমার বয়স হয়েছে বলে কি বয়স্ক একটা মেয়ে ঘরে আনবেন বউ করে? সুন্দরী কম বয়সী মেয়ে পছন্দ করলো। ওদিকে আমার তো বিয়ে করারই ইচ্ছে ছিলো না। ছোট বেলা থেকেই আমার সমস্ত কাজ নিয়ে বাবার রাগ। সবমিলিয়ে রাগটা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে বাবা বলল আমি যদি এবার তাদের না শুনি তো জায়গাজমি সব দান করে দিবে। তার মৃত্যুর পর আমি তো সব মদ, গাঁজা খেয়ে, বন্ধুবান্ধব নিয়ে উড়াবো। এরচেয়ে নাকি দান করে দেওয়া ঢের ভালো। এই অসহ্য চাপের মুখে পড়ে বিয়ে করেছি।’
পাবেল একটু থেমে বলল,
–‘তাদের কাছে স্বাভাবিক জীবন মানেই বিয়ে করে সংসার করা। আর বাচ্চাকাচ্চা জন্ম দেওয়া। আমি যে জীবনটা যাপন করেছিলাম সেটা তাদের কাছে বড়ো অস্বাভাবিক ছিলো। তাদের ধারণা, তারা আমায় বিয়ে করিয়ে স্বাভাবিক জীবন তৈরি করে দিয়েছে।’
–‘তোদের মাঝে সম্পর্ক কেমন?’
পাবেল নড়চড়ে বসে বলল,
–‘প্রথম প্রথম ওর গায়ে হাত তুলতাম। নিত্য চিৎকার, চেঁচামেচি, ঝগড়া চলতো। কিন্তু এতেও বাঁধ সাধলেন বাবা। তিনি বললেন, এটাও স্বাভাবিক জীবন না পাবেল। বউয়ের গায়ে হাত তোলা যাবে না। চেঁচামেচি, ঝগড়াঝাঁটি এসব করা যাবে না। তিনি আমার সুন্দর একটা সংসার দেখতে চান। আমায় অনুরোধ করে বললেন, অন্তত এই বুড়ো বয়সে আমাদের মানসিক শান্তি দে।’
পাবেল কথার মাঝে থামে। মুনিম আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করে,
–‘তারপর?’
–‘তারপর আর কি! বাবার অনুরোধটুকু রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু সংসার, বিয়ে এসবে আমার বিতৃষ্ণা। জোর করে হয় বল?’
–‘মেয়েটার সাথে এক ছাদের নিচে থাকছিস, এক বিছানাতে ঘুমাচ্ছিস। ওর প্রতি তোর কি কোনো অনুভূতি তৈরি হয়নি?’
–‘শ্রাবণী ভীষণ সুন্দর। ভালো লাগে দেখতে। প্রথম প্রথম যতটা বিরক্ত লাগত, এখন ততটা লাগে না। এটাকে বোধ হয় অনুভূতি বলা যায় না। আর কোনো মেয়ের প্রতিই আমার অনুভূতি দীর্ঘ স্থায়ী হয় না। নিত্য নতুন মেয়ে, মদ গাঁজায় চুবে থাকা কি শান্তির জীবন।’
মুনিম হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পাবেলের দিকে,
–‘তুই যেটাকে শান্তির জীবন ভাবছিস সেটা আসলে সত্যি শান্তির জীবন না। তোর বাবার কথাই ঠিক। ওটা অসুস্থ অস্বাভাবিক জীবন। মেয়েটার বয়স নাকি সবে ষোলো বছর। তোর মতন চৌত্রিশ বছর বয়সী এক পুরুষের সাথে বিয়ে হলো। ওইটুকুন একটা মেয়েকে কেন এত অশান্তি দিচ্ছিস?’
–‘উঁহু, আমি এখন ওকে কোনো অশান্তি দিচ্ছি না। আমি ওর সাথে যথেষ্ট ভালো আচরণ করছি।’
–‘তুই ওর সাথে যে ভালো আচরণ করছিস সেটা তো মন থেকে করছিস না। সবটা মেকি। তোর বাবার অনুরোধ রক্ষার্থে কিংবা বাসার ঝৈ ঝামেলা কমাতে। বাসার বাইরে তো তুই এখনো আগের মত যা ইচ্ছে তাই করছিস। তুই কি পুরোটা জীবন এভাবে কাটাতে চাস? এভাবে পুরোটা জীবন কাটানো কি সম্ভব?’
মুনিম একটু থেমে অনুরোধের স্বরে বলে,
–‘সব ছেড়েছুড়ে শ্রাবণীকে নিয়ে সুন্দর একটা সংসার তৈরি কর। মেয়েটাকে ভালোবাস। তুই যেটাকে শান্তি ভাবছিস সেটা সাময়িক মোহ। একটা সময় তুই সত্যিকারের ভালবাসার মানুষের অভাব বোধ করবি। তোর চারপাশটা ফাঁকা হয়ে যাবে। সেই দুঃসময় আসার আগেই নিজেকে বদলে ফেল। জানি ওসব তোর দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। ছাড়তে হয়ত সময় লাগবে। আমিও তো আগে তোর চেয়ে কম ছিলাম না। এখন বিয়ে করেছি, সংসার করছি। আমার মেয়েটা যখন বাবা বলে ডাকে তখন মনে হয় আমি যেগুলোকে তোর মত শান্তি ভেবেছি সেগুলো ভুল।’
পাবেলের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ও মুনিমের এসব কথা শুনতে আগ্রহ পাচ্ছে না। বিরক্ত হচ্ছে। প্রসঙ্গটা পাল্টে ফেলে,
–‘রাখ এসব কথা। দোতলায় চল। ওরা নিশ্চয়ই আমাদের খুঁজতে শুরু করছে।’
এই বলে পাবেল দ্রুত চলে গেল দোতলার দিকে। মুনিমও পিছনে পিছনে যায়। শ্রাবণী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে জানালার কাছ থেকে সরে যায়। দেয়ালের ওপাশের প্রতিটি কথা স্পষ্ট শুনেছে সে।
__________________
জয়নাল সাহেব, ফরিদা বেগম আর পাবেলের দাদা-দাদি গ্রাম থেকে ফিরেছে। শ্রাবণী সংকোচহীন ভাবে জয়নাল সাহেবকে বলল কলেজে ভর্তির কথা। জয়নাল সাহেব তৎক্ষণাৎ কিছু বলল না। নীরব ছিলেন। রাতের বেলা জয়নাল সাহেব বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে। ফরিদা বেগম রুমে ঢোকে। দরজায় খট করে শব্দ হয়। জয়নাল সাহেব সেদিকে একবার তাকায়। ফরিদা বেগম এসে জয়নাল সাহেবের পাশে বসে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল,
–‘তুমি কি শ্রাবণীকে কলেজে ভর্তি করাবে?’
জয়নাল সাহেব বইয়ের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই হালকা গলায় বলল,
–‘ওর বাবার সাথে তো এরকমই কথা ছিলো।’
–‘ওরকম কত কথা বিয়ের আগে থাকে। সুন্দরী মেয়ে। কলেজে ভর্তি করানোর পর চোখ ফুটে যাবে। তাছাড়া লেখাপড়া করবে নাকি সংসার সামলাবে? বিয়ে হয়েছে। সংসার করবে। এত লেখাপড়ার কি দরকার?’
–‘তুমি কি ওকে কলেজে ভর্তি করাতে চাচ্ছো না?’
ফরিদা বেগম শক্ত গলায় বলে,
–‘না, চাচ্ছি না। আর তুমি ওকে কলেজে ভর্তি করাতে পারবে না। এই পর্যন্তই। অন্যের মেয়ে আমরা কেন পড়াবো টাকা খরচা করে? এত শিক্ষিত বউয়ের দরকার নেই। ঠিকঠাক সংসার করুক। ওই যথেষ্ট।’
ফরিদা বেগমের এসব কথার পর জয়নাল সাহেব শ্রাবণীকে স্রেফ বলে দেয়, সংসার করো। আর লেখাপড়ার দরকার নেই। শ্রাবণীর মনে অদম্য ইচ্ছা সঙ্গে জেদ। এত সহজে ও হাল ছাড়বে না। শ্রাবণীর ভাগ্যটা বোধ হয় এবার সুপ্রসন্ন হলো। এর ভিতর একদিন সেলিম হোসেন ফোন বলে বলল,
–‘শ্রাবণী আমি তোকে কলেজে ভর্তি করাবো।’
শ্রাবণী বিহ্বল, বোবা হয়ে রয় অনেকক্ষণ। বলে,
–‘বাবা কি বলছো? তুমি টাকা কোথায় পাবে?’
–‘টাকা কোথায় পাবো তা তোর জানতে হবে না। তোকে আমি পড়াবো। তাহলে তোর আর তাদের টাকা খরচ করতে হচ্ছে না। তারপরও যদি তারা এব্যাপারে ঝামেলা করে তো তুই ওই বাসা ছেড়ে কলেজের হোস্টেলে গিয়ে থাকবি। সরকারি কলেজ। তত খরচা যাবে না।’
সেলিম হোসেন শ্রাবণীর শ্বশুর বাড়ির সবার অমতে ওকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেয়। পুরো বিষয়টা শ্রাবণীর কাছে স্বপ্নের মত লাগছে। শ্রাবণীর ভয় হয়, যেন ঘুম ভাঙতেই স্বপ্নটাও ভেঙে যাবে। সেলিম হোসেনের হঠাৎ এরকম পদক্ষেপে শ্রাবণী বার বার বিহ্বল, বিস্মিত হয়ে যায়। সেলিম হোসেন বলে,
–‘নতুন একটা কাজ ধরেছি। বেশ ভালো টাকা পাবো। তোর পড়াশোনার খরচ চালাতে অসুবিধা হবে না। এনিয়ে তুই চিন্তা করিস না।’
শ্রাবণীর এই প্রথম মনে হলো পৃথিবীতে ওর ভরসা করার মত শক্ত একটা জায়গা আছে। ওর মাথার উপরের প্রায় মৃত বটবৃক্ষটা যেন নতুন করে ডালপালা ছড়িয়েছে আবার। এত প্রশান্তি, এত স্বস্তি শ্রাবণীর জীবনে এই বোধ হয় প্রথম। সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে এভাবে কলেজে ভর্তি হওয়ার দুঃসাহস দেখে শ্রাবণীর শ্বশুর বাড়ির সবাই রোষানলে জ্বলছে। এমনকি পাবেলও। বাসায় তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গেল। কয়েকদিন ধরে এই ঝামেলা চলতেই থাকলো। ফরিদা বেগম শ্রাবণীর গালে থাপ্পড়ও মেরে বসলেন। সঙ্গে সঙ্গে শ্রাবণী সেলিম হোসেনকে ফোন দিয়ে বলল,
–‘বাবা তুমি কলেজের হোস্টেলে থাকার কথা বলেছিলে না? আমি কলেজের হোস্টেলেই থাকবো। তুমি ম্যানেজ করো।’
শ্রাবণী নিজের সমস্ত কাগজপত্র, কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিলো। পাবেল প্রচণ্ড অবাক সঙ্গে বাসার সবাই। শ্রাবণী বাসা ছেড়ে সত্যি বের হয়ে গেল। তারপর কলেজের হোস্টেলে গিয়ে ওঠলো।
(চলবে)
প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-২৮)
ইসরাত জাহান তানজিলা
______________________
আকাশি রঙের তিন তলা বাসাটা জুড়ে গুমোট ভাব। নিগূঢ় নৈঃশব্দ্যতা। পাবেল বাথটাবে গা ডুবিয়ে আছে বিক্ষিপ্ত মেজাজে। কি ভয়াবহ দুঃসাহস ষোলো বছর বয়সী ওইটুকু মেয়েটার! বাড়ির সবার তর্জন-গর্জন সমস্ত কিছু তুচ্ছ করে ব্যাগ, লাগেজ নিয়ে বের হয়ে গেল অবিচল ভাবে। পাবেলের রাগ চড়ে যায়। সংবরণ করতে পারে না কিছুতেই। শ্রাবণীর এত দুঃসাহস সহ্যাতীত। ইচ্ছে হয় এক্ষুণি ওকে কলেজের হোস্টেল থেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এসে জেলখানার মতন চার দেয়ালে বন্দি করে কয়েদি বানিয়ে রাখতে। হঠাৎ নৈঃশব্দ্যতা ভেঙে গলা ছেড়ে উচ্চ চিৎকার করে ওঠে ফরিদা বেগম,
–‘গরিব ঘরের মেয়ে এনেছি যাতে মাথা নিচু করে চলে। হলো তার বিপরীত। এখন আমাদের মাথার উপর দিয়ে চলছে। ছোট লোকের বাচ্চার সাহস দেখছো? কিভাবে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।’
ফরিদা বেগম রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছেন। জয়নাল সাহেব রুমের ভিতর আরাম কেদারায় বসে দোল খাচ্ছেন। মৌনভাবে খুব গম্ভীর হয়ে আছেন তিনি। ফরিদা বেগম বিকট শব্দে দরজা ঠেলে রুমে ঢোকে,
–‘মুখে এখন কথা নেই কেন তোমার? মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছো কেন? বার বার নিষেধ করেছিলাম তোমায় এ বিয়ে দিওনা। অত সুন্দরী বউয়ের দরকার নেই। সুন্দরী মেয়েরা ভালো হয় না, সাংসারিক হয় না। আমার কথার তো দাম দেওনি, তুচ্ছ করেছো। মানুষ দেখেই আমি বলতে পারি আচার, চরিত্র কেমন হবে। এই মেয়ে দেখেই আমার সুবিধার লাগেনি।’
জয়নাল সাহেব বিরক্ত ভঙ্গিতে মৃদু স্বরে কেবল বললেন,
–‘আহ ফরিদা। চেঁচামেচি বন্ধ করো।’
–‘কেন? কেন চেঁচামেচি বন্ধ করবো? শ্রাবণীর বাপের হঠাৎ এত তেজ বের হলো কোত্থেকে? আগে তো এত তেজ ছিলো না। বেয়াই বাড়ির মানুষদের দুইবেলা ভালো করে খাওয়ানোর মুরোদ নেই আবার মেয়ে পড়াবে।’
–‘আচ্ছা করো চেঁচামেচি। মহিলা মানুষ চেঁচামেচি ছাড়া আর কি করতে পারবে? বুদ্ধি জ্ঞান খাটিয়ে কোনো সমস্যার সমাধান তো আর করতে পারবে না। এত কষ্ট করে চিৎকার চেঁচামেচি করে মানুষকে না জানিয়ে একটা মাইক ভাড়া নেও। মাইক দিয়ে এলাকার সবাইকে জানিয়ে আসো। সবাই জানুক আমাদের বাড়ির বউ আমাদের মান্য করে না।’
ফরিদা বেগম আরো ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। এর ভিতর পাবেল আসে। সদ্য গোসল সেরেছে। ব্যস্ত গলায় বলে,
–‘মা, নাস্তা দিয়ে যাও। জলদি বেরুতে হবে।’
ফরিদা বেগম কর্কশ গলায় বলে,
–‘বানাইনি নাস্তা। কে বানাবে নাস্তা? আর এগারোটায় কিসের নাস্তা? রান্না করার মেজাজ নেই। আজ রান্না হবে না। দুপুরে বাইরে খেয়ে নিস।’
ফরিদা বেগম দম ফেলে আবার বলে,
–‘জরুরি ভিত্তিতে একটা কাজের মেয়ের খোঁজ করিস। সংসারের এতসব কাজকর্ম আমি করতে পারবো না।’
জয়নাল সাহেব বলে উঠলো,
–‘আগের কাজের মেয়েটা ভালো ছিলো। তাকে কেন বিদেয় করেছিলে? ঘরে বউ ছিলো বলে?’
–‘তো ঘরে বউ থাকতে কাজের মেয়ের কি দরকার? সংসারের সামান্য কাজটুকুও করতে পারবে না?’
জয়নাল সাহেব পাবেলকে বলে,
–‘শ্রাবণীকে হোস্টেল থেকে বুঝিয়েসুজিয়ে নিয়ে আয়। অল্পবয়সী মেয়েদের জেদ এমনিতেই বেশি। আরো পেয়েছে বাপের আসকারা। বাপটাও আস্ত একটা বদমাশ। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। শ্বশুর বাড়ির লোকজন ইচ্ছা হলে পড়াবে, না হলে নাই। তিনি আসছে মাতব্বরি করতে।’
ফরিদা বেগম শক্ত গলায় বলে বলেন,
–‘কিসের জন্য পাবেল ওকে আনতে যাবে? তুই একদম যাবি না পাবেল। শ্রাবণী আর ওর বাপের তেজ কতদিন থাকে দেখি। আর অমন মেয়ে ফের ঘরে না আনাই ভালো।’
জয়নাল সাহেব বললেন,
–‘তুমি কি ডিভোর্সের কথা বলছো?’
–‘হ্যাঁ বলছি। মেয়ের অভাব পড়েনি। ডিভোর্সের পরদিন আবার ছেলে বিয়ে করাতে পারবো।’
–‘ছেলেকে প্রতিদিন বারোটা বিয়ে করাতেও পারবে। কিন্তু বউ একটাও থাকবে না। বউয়ের প্রতি তার কোনো মনোযোগ আছে? বউয়ের চেয়ে মদ, গাঁজার প্রতি তার মনোযোগ বেশি।’
এই তিক্ত সত্য কথা গুলো শুনতে পাবেলের ভালো লাগছে না। ও গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এক বন্ধুর বাসায় ডিনারের দাওয়াত। সেখানে যাবে। বাসা ঢাকার বাইরে। যেতে যেতে সময় লাগবে, বিকাল হবে। পিচঢালা রাস্তার বুক চিরে তীব্র গতিতে চলে গাড়ি।
_____________
শ্রাবণী হোস্টেলে উঠেছে আজ তিন দিন। এখানে কারো সাথে তেমন আলাপ হয়নি ওর। শ্রাবণীর রুমে আরো তিনটা মেয়ে আছে। তাদের সাথে টুকটাক কথা হয়েছে। শ্রাবণী চাপা স্বভাবের। অপরিচিত কারো সাথে সহজে সখ্যতা গড়তে পারে না। স্কুলেও ওর তেমন ভালো কোনো বন্ধু ছিলো না। তাছাড়া শ্রাবণীর মন ভালো নেই। কথা বলতেও ভালোলাগে না। সারাক্ষণ চুপচাপ, গম্ভীর থাকে। চেহারা বিষণ্ণ, দুঃখী দুঃখী। গভীর একটা দুঃখ লুকানো যেন। অপরিচিত জায়গা, সম্পূর্ণ নতুন এক পরিবেশ, নতুন এক জীবন। চারপাশটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। শূণ্যতা, চরম একাকিত্ব। এখানকার খাবারদাবার ওর মুখে রোচে না। রান্না বাজে।
শ্রাবণীর পাশের বেডের তিথি নামের মেয়েটা মায়ের কাছে ফোন করে বাচ্চাদের মতন কাঁদছে। এখানে তার মন টিকছে না, খাবারদাবার ভালোলাগে না, বিস্বাদ লাগছে সবকিছু। শ্রাবণীর বুকের ভিতর হাহাকার করে ওঠে সঙ্গে আক্ষেপও হয়। মায়ের অভাববোধ ওর সারাজীবনই ছিলো, আমৃত্যু থেকে যাবে। তিথি মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ডাকলো,
–‘মা, মা।’
থেমে থেমে দু’বার বললো। আহারে! কি মধুর ডাক। কি গাঢ় মমতা। শ্রাবণী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। তিথি হঠাৎ শ্রাবণীর দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে ভেজা গলায় বলল,
–‘আম্মু তোমার সাথে কথা বলবে।’
শ্রাবণী ফোনটা নেয় অপ্রস্তুত ভাবে। ওপাশ থেকে তিথির মা ব্যাকুল গলায় বলে,
–‘তিথিকে একটু সঙ্গ দিও মা। আমার মেয়েটা একটু বোকা বোকা। কারো সাথে মিশতে পারে না। খাতির জমাতে পারে না। আমায় ছাড়া থাকতে পারে না। আমার হাতের রান্না ছাড়া মুখে তুলতে পারে না।’
শ্রাবণী ভদ্রমহিলাকে আশ্বস্ত করে। তিনি রুমের বাকি দুইজনকেও বললেন একথা। তিথি তার একমাত্র সন্তান। অনেক আদরের। তিথির বাবা নেই। মেয়ের সামান্য মন খারাপেও তিনি বিচলিত হয়ে যায়।
শ্রাবণী বাসা ছেড়ে চলে আসার পর কেউ ওর খোঁজ নেয়নি। খোঁজ নিবে বলেও আশা করেনি শ্রাবণী। পাবেল বোধ হয় হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। জয়নাল সাহেবের অনুরোধ রক্ষার্থে তার আর সংসারমুখী হওয়ার অভিনয় করতে হবে না। শ্রাবণীর পড়ায় মন বসছে না, ক্লাসে বার বার অমনোযোগী হয়ে যায়। না চাইতেও মাথায় নানান চিন্তা চলে আসে। ও স্বাভাবিক হতে পারছে না। কোথায়ও যেন খেই হারিয়ে ফেলেছে। ভয়াবহ এক মানসিক অত্যাচার, অশান্তি, দুশ্চিন্তা থেকে বের হয়ে এসেছে। সেজন্য বোধ হয় স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। নিজেকে সামলাতে একটু সময় দেওয়া প্রয়োজন। রুমের সবাই পড়ছে। শ্রাবণী বাদে। ওর মাথা ব্যথা করছে। নয়টা বাজতেই শুয়ে পড়লো। বাতির আলোতে শ্রাবণীর ঘুম হয় না, মাথা ব্যথা বাড়ে। তবুও কিছু করার নেই। চোখ বুজে শুয়ে থাকে। ছোট একটা বিছানা, একটা বালিশ, একটা কাঁথা। বিছানার পাশে টেবিলে বই খাতা রাখা। এই নিয়েই এখন শ্রাবণীর দুনিয়া। সেলিম হোসেন ফোন করেছে। শ্রাবণী ফোন ধরে। সেলিম হোসেন জিজ্ঞেস করে,
–‘আজও তোর শ্বশুর বাড়ি থেকে কেউ আসেনি? পাবেল বা তোর শ্বশুর শাশুড়ি?’
–‘না, বাবা। কেউ আসেনি। বোধ হয় আসবেও না। ডিভোর্সের কথা ভাবছে হয়ত তারা।’
–‘তোর মাথা ব্যথা কমেনি?’
–‘না, বাবা। মাথা ব্যথার জন্য পড়তে পারছি না।’
–‘তোর শ্বশুর বাড়ি থেকে কেউ আসলে আমায় জানাস।’
–‘জানাবো। এখন রাখছি।’
শ্রাবণী ফোন রাখে। রাত ক্রমশ বাড়ে। ওর ঘুম আসে না। হোস্টেলে এসেছে এই তিন দিন। এক রাতেও ঠিকঠাক ঘুম হয়নি। নতুন জায়গা বলে নাকি মন ভালো না বলে তা ঠিক বুঝতে পারছে না।
হোস্টেলে দুপুরে ডিম রান্না হয়েছে। শ্রাবণী একটু খেয়েই প্লেটে পানি ঢেলে উঠে পড়েছে। না হচ্ছে ঘুম, না খেতে পারছে খাবার। রাতেও খেতে পারেনি। শরীরও ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। বাইরে থেকে খাবার কিনে খাওয়ারও টাকা নেই। এক কানাকড়িও নেই ওর কাছে। সেলিম হোসেনের কাছে চাইতেও বিবেকে বাধে। ভর্তি, বই কেনা সব মিলিয়ে অনেক টাকা খরচা গেছে। রুমের বাকি তিন জনের ভিতর বেশ ভালো খাতির জমে ওঠেছে। তারা এক সাথে আড্ডা দেয়, গল্পগুজব করে। তিথি মেয়েটার কান্নাকাটিও কমেছে। তিথির মায়ের অনুরোধ শ্রাবণী রাখতে পারেনি। তিথিকে সঙ্গ দিতে পারেনি।
বিকাল বেলা। শ্রাবণী বই হাতে বসে বসে ঝিমাচ্ছে। ওর সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। কে এসেছে? পাবেল? শ্রাবণীর প্রথম পাবেলের নামটাই মনে আসে। সেলিম হোসেন আসলে অবশ্যই শ্রাবণীকে জানিয়ে আসতো। শ্রাবণীর ধারণা ঠিক। পাবেল এসেছে। ওর বুকের ভিতর ধ্বক করে ওঠে। পাবেল স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
–‘কেমন আছো শ্রাবণী?’
শ্রাবণী আস্তে করে কেবল বলল,
–‘ভালো।’
–‘তোমার সাথে জরুরি কিছু কথা আছে। এখানে বলা যাবে না। বাইরে চলো একটু।’
শ্রাবণী শক্ত গলায় বলে,
–‘আমি যাবো না আপনার সাথে বাইরে। যা বলার এখানেই বসেই বলেন।’
পাবেল যেন অবাক হয় শ্রাবণীর কথায়। ও ভ্রু কুঁচকে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বলে,
–‘কেন যাবে না আমার সাথে? ভয় পাচ্ছো? তোমায় খেয়ে ফেলবো আমি? নাকি মেরে ফেলবো?’
শ্রাবণী কিছু বলছে না। পাবেল আবার বলল,
–‘ভালো ভাবে বলছি, চলো আমার সাথে। এখান থেকে তোমাকে কোলে করে তুলে নিয়ে গেলেও আমায় কেউ কিছু বলতে পারবে না। তার উপর তুমি আমার স্ত্রী।’
কি মতলব পাবেলের? কেন এসেছে? শ্রাবণী ভয় পাচ্ছে। এই লোকটা উন্মাদ, পাগল। যা ইচ্ছে করতে পারে। পাবেল এবার চাপা রাগ নিয়ে বলল,
–‘তুমি কি চাচ্ছো এখানে বসে আমি চিৎকার করি?’
শ্রাবণী এবার পাবেলের সাথে গেল। কলেজ থেকে একটু দূরে গিয়েই বসলো ওরা। পাবেল বলল,
–‘বাসায় চলো শ্রাবণী। হোস্টেলে থাকতে হবে না। বাসায় থেকেই পড়ো।’
শ্রাবণী কড়া ভাবে বলে,
–‘আমি বাসায় যাবো না। হোস্টেলে থেকেই পড়বো।’
–‘বাসায় কাজের মানুষ রাখা হয়েছে। তোমার কাজ করতে হবে না। বাসায় থেকেই ভালো ভাবে পড়তে পারবে।’
এত সহজে পাবেলের কথা বিশ্বাস করার মত ভুল শ্রাবণী এবার আর করবে না। ও বলল,
–‘আমি আপনার কথা বিশ্বাস করিনা একদম।’
পাবেলের মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে,
–‘শ্রাবণী তোমার হাজবেন্ড আছে, সংসার আছে। সব ফেলে তুমি হোস্টেলে কেন থাকবে? মানলাম একটু ঝামেলা হয়েছে। এখন তো ঝামেলা মিটে গেল।’
–‘হাজবেন্ড, সংসার কোনোটাই আমার না। কোনোটাতেই আমার অধিকার নেই। আমি সবার অপ্রিয়, অনাদৃত।’
শ্রাবণীর গলায় তীব্র অভিমান, অভিযোগ। ওর বুকের ভিতর হুঁ হুঁ করে ওঠল হঠাৎ। ও আবার বলে,
–‘নিশ্চয়ই আপনার বাবা ঠেলেঠুলে পাঠিয়েছে আমায় নিতে? আপনি তো নিজের মর্জিতে আসেননি।’
–‘তুমি যাবে না আমার সাথে?’
শ্রাবণী দৃঢ় গলায় বলে,
–‘না।’
–‘হয়ত তুমি আজ আমার সাথে যাবে নয়ত আমাদের ডিভোর্স হবে। তুমি কোনটা চাও?’
শ্রাবণী নির্বাক। আগের মত অকপটে জবাব দিতে পারলো না। যে সংসারে শ্রাবণীর নিজের বলে নেই সেই সংসারটা ছাড়ার কথা ভাবতে আজ যন্ত্রণা হচ্ছে। কেন হয় এমন? নামে মাত্র সম্পর্কটার ইতি টানার কথা ভাবতেও কোথায় যেন সূক্ষ্ম চিনচিনে এক ব্যথা হচ্ছে। ওর কান্না পাচ্ছে। পাবেল বলল,
–‘কি হলো? কিছু বলছো না কেন? কোনটা চাও তুমি?’
শ্রাবণী হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে,
–‘আমি ভালোবাসা চেয়েছিলাম। আমি আপনার প্রিয় হতে চেয়েছিলাম। সত্যি আমি এর বেশি কিছু চাইনি।’
শ্রাবণী থামে। গলা ধরে আসছে ওর। একটু পর ভেজা গলায় আবার বলে,
–‘সম্পর্কটা আপনার কাছে এতই ঠুনকো যে আপনি দুইটা অপশন জুড়ে দিলেন। হয়ত আপনার সাথে যাবো নয়ত ডিভোর্স। এত ঠুনকো সম্পর্ক বয়ে বেড়ানোর কি দরকার বলুন? ডিভোর্সই হোক।’
শ্রাবণীর এখন হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। চারপাশে অনেক মানুষ। এখানে বসে কান্না করা যাবে না। ও দ্রুত পাবেলের পাশ থেকে ওঠে ছুটে যায় কলেজের দিকে। আজ ও বড্ড আবেগতাড়িত হয়ে গেছে। আবেগ জিনিসটাও মাঝে মাঝে বোকামি করে বসে। ভুল মানুষের সামনে নিজেকে প্রকাশ করে।
(চলবে)