#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব৬
#রাউফুন
কথা মতো সকাল আটটাই প্রশান্ত হাজির। আমি ওঁকে ব্রেকফাস্ট করার জন্য বলতেই ও না করে দিলো৷ কিন্তু আমি জোরপূর্বক ওঁকে আগে খাওয়ালাম তারপর পড়াতে বললাম। আর ওঁকে পড়িয়ে পার্লারে আসতে বললে ওঁ বললো,
‘আজকে ভার্সিটি করে বিকেলে গেলে সমস্যা হবে কি? কিছু নোট কালেক্ট করতে হবে।’
আমি বললাম,’কোনো সমস্যা নেই। তুমি চলে এসো।’
বাড়ি থেকে বেরোতে যাবো তখন আব্বু বললেন,
‘গহীন এই চেঙরা পোলার কাছে পড়বো পড়ুক। আবার পুতুলের কি দরকার ওর কাছে পড়ার৷ পুতুল মেয়ে মানুষ ও কেন ছেলে টিচারের কাছে পড়বে?’
মাথা টা মুহুর্তের মধ্যে গরম হয়ে গেলো। নিজেকে শান্ত করলাম। বাহিরের মানুষের সামনে আব্বুর সঙ্গে বা’জে ব্যবহার করতে চাই না। তাই শান্ত ভাবেই বললাম,
‘আব্বু পুতুল তো কোচিংও করে। ওখানেও ছেলে স্টুডেন্ট আর টিচার আছে। যদি টিচারের মধ্যে ছেলে মেয়েতে ভেদাভেদ হয় তাহলে কি আর পড়াশোনা হবে?’
‘পুতুল মেয়ে ওর পড়ে হবে টা কি শুনি?’
‘গহীন পড়লে ক্ষতি নেই তাহলে পুতুল পড়লে আপনার সমস্যা কোথায়?’ বললেন আম্মু।
‘আহ শিমলা তুমি বুঝবা না ব্যাপার টা। পুতুল শিয়ান মাইয়া। ওঁ বড় হইছে। আমি তো ভাবতেছি ওঁকে বিয়ে দেবো এইট পাস করার পর।’
আম্মু অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন মুহুর্তেই আব্বুর কথায়।
‘খবরদার গহীনের আব্বু! আপনি ভুলেও আমার মেয়ের বিয়ের কথা ভাববেন না। আমার এক মেয়ের জীবন টা তো শেষ করেই দিয়েছেন। তখন আমার বলার মুখ ছিলো না কিন্তু এখন আছে। এখন যদি আপনি ভেবে থাকেন আমার বাচ্চা মেয়ে পুতুলের জীবন টাও শেষ করে দিবেন তাহলে ভুল আপনি। এই পুতুল তুমি যাও গহীনকে নিয়ে পড়তে বসো। বাবা প্রশান্ত তুমি কিছু মনে করো হ্যাঁ!’
আম্মুর কথায় গহীন শুধু হাসলো। প্রথম দিন এসেই ছেলেটা কিনা বাড়ির অশান্তি দেখলো। এরকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরতে হইতো ভাবেনি। এই লোকটা জীবনে শুধরাবে না। আমি আব্বুকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
‘আপনি বলেছিলেন পুতুলের লেখাপড়ার দায়িত্ব আপনি নেবেন না এটা মেনে নিয়েছি। এখন যেনো পুতুলের পড়াশোনা নিয়ে কোনো কথা না হয়। এবং আমি চাই না আপনি এই বিষয় নিয়ে আর কোনো কথা বলেন কিংবা আমার ঠিক করা টিচারকে অসম্মান করেন আমার অনুপস্থিতিতে। আর হ্যাঁ একটা কথা কান খুলে শুনে রাখুন, আমি মালা বেঁচে থাকতে পুতুলের জীবন টা নষ্ট হতে দেবো না। জাষ্ট রিমেম্বার মাই ওয়ার্ড! ‘
প্রশান্ত গহীন আর পুতুল কে পড়ানোর জন্য আমার রুমে চলে গেলো। আমি চলে গেলাম পার্লারে। আজকে একটা বিয়ের কনে কে সাজাতে হবে। ফেসিয়াল থেকে শুরু করে সব করাবেন উনি আমার কাছে। বাজেট পঞ্চাশ হাজার টাকা। এতো বড় একটা প্রফিট হাত ছাড়া করা যাবে না। গায়ে হলুদ, বিয়ের দিন, বউ ভাত প্রত্যেক দিনের সাজ তিনি আমার কাছেই করাবেন এটা বিয়ের কনের আবদার। ভীষণ ব্যস্ততায় কা’ট’বে বাকি তিন দিন। আমি পার্লার যেতেই মালিহা আসলো আমার কাছে।
‘আপু একটা আপু এসে বসে আছে। আপুটা আপনার কাছে ছাড়া ফেসিয়াল করবে না। আপনার কথা বলে বলে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে।’
‘কিন্তু আমার তো বিয়ের কনের কাজ টা আগে করতে হবে।’
‘আমি উনাকে বলেছি আপু শুনছেই না। আর কনে এখনো আসে নি আপু।’
‘ঠিক আছে মালিহা। যেহেতু কনে এখনো আসে নি আমি উনাকে দেখছি। তুমি আর নিশি অন্য যারা আছে তাদের টা দেখো।’
‘ঠিক আছে আপু।’
‘এই আবিহা তুমি আমার কাছে থাকো। হাতের কাছে চাওয়া মাত্র সব প্রয়োজনী জিনিস এগিয়ে দেবে।’
‘ওকে আপু!’
ভেতরের রুমে যে সুজানা আপু আমার জন্য অপেক্ষা করছে এটা জানা ছিলো না। উনাকে দেখে চমকালেও চুপ রইলাম। সুজানা আপু এর আগে আমার পার্লারে আসে নি। দেখলাম সে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। আমি স্বাভাবিক ভাবেই এগিয়ে গেলাম তার কাছে। কিন্তু সুজানা আপু আমাকে দেখতেই মুখ বিকৃতি করে ছিলো অস্বাভাবিক ভাবে। আমার আপাদমস্তক দেখে বললো,
‘আরে মালা তুমি যে? তুমিও কি মেক-অভার করতে এসেছো নাকি! বাট তুমি যে এখানে, এই পার্লারে এসেছো, বিল পে করার ক্ষমতা আছে নাকি তোমার? এখানে শুধু মাত্র ফেসিয়াল করাতে কত টাকা খরচ হয় তোমার ধারণা আছে?’
‘না নেই।’ আমি বুকে হাত গুজে জবাব দিলাম।
‘তাহলে এখানে এসেছো কেন? যায় হোক সরো এখান থেকে! আমি আগে ফেসিয়াল করাবো পরে তুমি করাও। একটা বার্থডে পার্টি অ্যাটেন্ড করতে হবে আমাকে।’
‘কোথায় সরবো আপু? বসে পরুন জলদি।’
‘বসবো মানে?’
‘আপনার ফেসিয়াল, হেয়ার রিকোভার, আমিই করছি!’
‘তুমি করবে আমার ফেসিয়াল? তারমানে তুমি এখানে কাজ করো! হাউ এভার! এই মেয়ে তোমাকে তো বললাম এই পার্লারের যে অনার তাকে ডাকো! আমাকে এখন এই মালার কাছে আমার কাজ করাতে হবে?’
‘উনিই তো–!’
আবিহা কিছু বলতে নিলে ওঁকে বাঁধা দিয়ে বললাম,
‘আহ আবিহা চুপ করো। আমি দেখছি ব্যাপার টা।’
‘আসলে আপনি যার জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি আসবেন না আজকে। তার একটা জরুরি কাজ পরে গেছে। আজকের মতো আমিই করে দিচ্ছি।’
সুজানা আপু কটমট করলো কিছুক্ষন।
‘যদি ভুলভাল কিছু করেছো তোমার এখানের চাকরি টা যাবে মালা। ভেবে নিও কিন্তু!’
‘ভয় নেই আমি ট্রেইন্ড।’
অগত্যা উপায় নেই ভেবেই সুজানা আপু বসে পরলো। উনার মুখের অবস্থা খুবই খারাপ দেখে বুঝা যাচ্ছে। স্কিনে রেস দেখা যাচ্ছে আর ড্রাই ও হয়ে গেছে। আমার কাজ আর আমার পারদর্শীতা দেখে মনে মনে মুগ্ধ হলেও সুজানা আপু তা বুঝতে দিলো না আমাকে। আমি তাচ্ছিল্য হেসে ভাবলাম, ‘যার পার্লারিং না করালে চলেই না সে কি না রুপের বড়াই করছিলো সেদিন। হাহ!’
•
কনেকে গায়ে হলুদের জন্য সাজিয়ে সন্ধ্যায় চলে এলাম রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টের সাজসজ্জা দেখে বুঝলাম কোনো অকেশন আছে। ভেতরে গিয়েই জানতে পারলাম আজকের জন্য কেউ একজন পুরো রেস্টুরেন্ট বুক করেছে। অফ হোয়াইট কালার করা দেওয়াল জুড়ে ব্ল্যাক আর গোল্ড কালারের বেলুনস দিয়ে ডেকোরেশন করা। আর ছাই রঙের সিলিং টা সম্পুর্ন হলদে, লাল আলোই টিমটিম করছে। চমৎকার করে সাজানো হয়েছে। অসাধারণ! আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি! আমি সাজানো দেখতে এতোটাই ব্যস্ত ছিলাম যে খেয়াল করিনি কখন আমার পাশে প্রিহান এসে দাঁড়িয়েছে। উনি একদম আমার নিকট ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ভয়ে, আমি চমকে উঠে বুকে থু’থু’ দিলাম। প্রলম্বিত শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে উনার দিকে খেয়ে ফেলবো এভাবে তাকালাম।
‘আপনি আজকেও এখানে? কি চান বলুন তো আপনি?’
‘আমি তো আপনাকেই চাই!’ উনার লাগামহীন কথায় ভিমড়ি খেলাম আমি। কোনো লজ্জা নেই লোকটার? বে-সরম লোক।
‘আপনি এভাবে কেন ফলো করছেন আমায়?’
‘আপনাকে ফলো করাই তো আমার এক মাত্র কাজ৷ কি করবো বলুন তো। এমনিতেই তো পাত্তা পাচ্ছি না। আরও যদি ফলো করা ছেড়ে দিই তাহলে কি আপনি আমাকে মনে রাখবেন? তাই ফলো করতেই হচ্ছে।’
‘দেখুন আজকে এখানে একটা অকেশন আছে। আমি এখানে আপনার সঙ্গে কোনো রকম সিন-ক্রিয়েট করতে চাই না। দয়া করে আপনি চলে যান। প্লিজ!’
‘যদি না যায়?’
‘আপনি যাবেন!’
‘যাবো না কি করবেন?’
‘আপনাকে যেতে হবে। আপনি এখানে থাকতে পারেন না।’
‘একশো বার পারি। কারণ এই রেস্টুরেন্টে সবাই আসতে পারে। আপনি চাইলেও বাঁধা দিতে পারবেন না।’
‘আপনি প্লিজ আজকে চলে যান। প্লিজ!’
‘নাহ যাবো না।
‘যান প্লিজ!’ অসহায় মুখ করে অনুরোধ করলাম তাকে।
‘আপনার নাম্বার দিন তাহলে যাবো!’
‘আমার নাম্বার দেবো না আপনাকে।বিরক্ত না করে চলে যান।’
‘আপনি এতো বার করে চলে যেতে কেন বলছেন?’
‘কারণ আপনি থাকলে আমি বিব্রত বোধ করছি!’
‘এই সত্যিই আপনি বিব্রত হচ্ছেন।আপনি জানেন এটা ভালোবাসার পূর্ব লক্ষন?’ এক গাল হেসে বললেন প্রিহান।
আমি রেগে কিছু বলবো তখনই উনার কল এলো। জরুরি ভেবে উনি কল টা রিসিভ করলেন।আমি সরে আসছিলাম তখনই আমার কানে কিছু কথা এলো উনার৷ উনি কাউকে বলছিলেন,
‘সেদিন যারা ঔশীকে টা’র্গেট করেছিলো তাদের কি ট্র্যাস করতে পেরেছেন অফিসার? শুধু একবার ওঁদের কে পাওয়া গেলে আমি ওঁদের কাউকেই ছাড়বো না।আমার ঔশীকে যে বা যারা মা’র’তে চেয়েছিলো তাদের প্রত্যেককে আমি নিজে হাতে শা’স্তি দেবো!’
আমি চমকে উঠলাম উনার কথা শুনে।তার মানে ঔশীকে কেউ মা’রার চেষ্টা করেছিলো। এই নিষ্পাপ বাচ্চার সঙ্গে কার এতো শত্রুতা? আমাকে এর খোঁজ নিতে হবে। তখনই কোথা থেকে যেনো ঔশী এলো।আমার হাত ধরে রিনরিনে কন্ঠে বললো,
‘মিস্টেরিয়াস আন্টি তুমি এসেছো? আজকে আমার বার্থডে জানো?আমি মামু কে বলেছিলাম তোমাকে যেনো ইনভাইট করে দেই।মামু আমার কথা রেখেছে। ইয়েহ আমি খুব খুশি!’
আমি হাটু মুড়ে বসলাম দুই হাত ধরে। ওঁকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করলাম।অজান্তেই দু-ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো আমার।ওঁকে হ্যাপি বার্থডে উইশ করলাম। আজকে যে ওর বার্থডে সেলিব্রেট করা হচ্ছে তা তো জানা ছিলো না। যায় হোক আমার উচিত ঔশীকে আগলে রাখা। একবার যেহেতু ওঁকে মা’রার চেষ্টা করা হয়েছে সেহেতু আবার মা’রার চেষ্টা করতে পারে। কারণ যে ওকে মা’রা’র কন্সপিরেসি টা করেছিলো সেদিন সে সফল হয়নি। তাই সে নিশ্চয়ই আজও চেষ্টা চালাবে। কিন্তু এই আমি মালা থাকতে জীবনে এরকম টা হতে দেবো না। আমি ওঁর দিকে তাকিয়ে আরেকটা চু’মু দিয়ে আদর করলাম।
‘প্রা’ণ দিয়ে আগলাবো আমি তোমাকে। কিচ্ছু হতে দেবো না আমি তোমার। ছাঁয়ার মতো তোমাকে প্রটেকশন দেবো। এটা তোমার প্রতি আমার দায়িত্ব ঔশী!’
#চলবে