ফেইরিটেল পর্ব-৪২+৪৩

0
723

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–42

আমেরিকার একেক শহরের ওয়েদার একেকরকম হয়৷ এবছর নিউইয়র্কে শীতের প্রকোপ বেজায়৷ দু’দিন ধরে এ নিয়ে রিপোর্ট হচ্ছিল। তবে টেক্সাসে তেমন শীত ছিল না। বরং আবহাওয়ার এতো চমৎকার ছিল যা বর্ণনার বাহিরে। টেক্সাসের ওয়েদার ইমানের কেন যেন খুব চমৎকার লাগে৷ তবে ইমানের প্রিয় শহর হলো নিউইয়র্ক। এ নিউইয়র্কে সে হাজারো ব্যথা বুকে চেপে হেঁটে বেরিয়েছে। তার আনন্দে, উল্লাসে হেসেছে নিউইয়র্কও। টিন এইজ তো এ শহরেই কেটেছে৷ তাই এই শহরের জন্য মায়া বারংবার একটু বেশিই যেন৷ নিউইয়র্ক শহর আজ তুষার ঝড়ে একেবারে বেহাল দশায় রুপান্তর হয়েছে। চারিদিকে সাদা বরফে ছেয়ে গেছে৷ শীতে হাড় ভেঙে যাওয়ার উপক্রম কিন্তু ভাগ্যিস রুম গরম করার জন্য ফায়ার বক্স আছে৷ শৈত্যপ্রবাহের জন্য আজ সূর্য উঠেনি৷ এ দৃশ্যপট ইমানের জন্য আজকাল দুধভাত। কিন্তু তার বিপরীত প্রান্তে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা রমনীর জন্য এটা নিসন্দেহে বিরাট চমক। ইমান তার এক্সাইটমেন্ট উপভোগ করতে চায়৷ এখন ঘড়িতে বাজে কেবল ছোয়া পাঁচটা৷ কালকে রাতে তারা দেরি করে ঘুমিয়েছে৷ সাড়ে বারোটার পর। সম্ভবত একটা থেকে ওয়েদার খারাপ হতে শুরু করেছে৷ কালকে।গভীর ঘুম ঘুমিয়েছে৷

সে ঘুমিয়ে যাওয়ার জন্য আজকে মিরাকে বেডে এনে শোয়াতে পারেনি৷ নিশ্চয়ই বেচারীর এখন ঘার-কোমড় ব্যথা করছে৷ ওইটুকু ডিভানে শোয়া যায়? মেয়েটা প্রচুর জেদি তো। কথা তো শুনবেই না। বরং নিজে যা বলবে তাই। ইমান বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে খুব আস্তে পা ফেলে মিরার নিকটে যায়। এরপর হাঁটু মুড়ে বসে ফ্লোরে। ফ্লোর ঠাণ্ডা হয়ে আছে৷ সে নিজের ডান হাত মিরার গালে রাখে। এরপর খুব মোলায়েম কণ্ঠে ডাকে, ” ওয়াক আপ মিরা।”

মিরা সামান্য নড়েচড়ে উঠে। তার গলা অব্দি পাতলা কম্বল জড়িয়ে রাখা। ইমান কম্বল সরিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হলো, কম্বলটার জায়গায় সে থাকলে মন্দ হত না কিন্তু! আনমনে হেসে উঠে সে। এরপর আরো জোরে ডাকে, ” উঠবা না? উঠ।”

মিরা চোখ খুলে মুখের সামনে ইমানের হাসোজ্জল মুখটা দেখে ভারী অবাক হলো। বিষ্ময়ের তোড়ে সে চোখ কচলে বলে, “কী হয়েছে? ”

— ” নিউইয়র্কের সবচেয়ে সুন্দর সকাল দেখার নিমন্ত্রণ জানাচ্ছি। শেহজাদী আপনি কী কষ্ট করে উঠে চমৎকার সকালের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান?”

মিরা এবারে না উঠে পারল না৷ কী দেখাবে তাকে? হুট করে তার সঙ্গে এতো সুইট ব্যবহার কেন করছে? মিরা বলে উঠে, “কোথায় নিয়ে যাবেন?”

ইমান এক গাল হেসে তাকে উঠে দাঁড় করিয়ে ওর চোখ নিজের হাত দিয়ে ঢেকে দিল। মিরা তার হাতের উপর হাত রেখে বলে, “আরে করছেন কী?” চোখ হাত দিলেন কেন? তাহলে দেখব কীভাবে? পাগলামি না এসব?”

–” একটু চুপ করবে? ”

মিরা নীরব হয়ে গেল। ইমানের দেখানো পথে সে হেঁটে গেল। পায়ে পা বেজেছিল একবার। সে সামলে নিয়েছে৷ এরপর যখন ওর চোখ থেকে হাত সরিয়ে দিল এবং মিরা চোখ খুলে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ময়ে, খুশিতে তার হৃদয় কম্পিত হলো। বিশাল, ঝকঝকে, স্বচ্ছ জানালার দিকে তাকিয়ে সে চোখ ফেরাতে পারল না। যেদিকে চোখ গেল সেদিকেই পেচা তুলার ন্যায় বরফ। ঝাকে ঝাকে আকাশ থেকে বরফ পরছে৷ প্যাচানো তুলা উড়িয়ে দিলে যেভাবে উড়ে ঠিক সেইভাবে বরফ গুলো দিক-বেদিক হয়ে পতিত হচ্ছে৷ সামনের বাসার দোতলার সানসেট বরফে ঢেকে গেছে৷ ম্যাপেল ট্রি এখন রেড থেকে হুয়াইট হয়ে গেছে। বেঞ্চে স্তুপ আকারে বরফ পরে আছে৷ এছড়াও সবুজ গাছ গুলোতে বরফ লেগে আছে। রাস্তার চারপাশে বরফ আর বরফ৷ তবে অদ্ভুত রকমের ঘন কালো অন্ধকার চারপাশটা ঘিরে রেখেছে৷ জানালা আর বারান্দার দরজা একদম লক করা৷ খোলা যাবে না বুঝি। মিরার মন চাচ্ছে বাইরে গিয়ে বরফ ধরে দেখুক একবার। আদৌ কী সম্ভব! আসমান থেকে বরফ পরা৷ টিভিতে বহুবার দেখেছে এ দৃশ্য কিন্তু বাস্তবের দেখার মধ্যে অন্যরকম এক ভালো লাগা৷ নিজের চোখে বিশ্বাস হচ্ছে না। আজ তুষারপাত হচ্ছে৷ সে নিজ চোখে দেখছে৷ তুষারপাত দেখার ইচ্ছা তার ছোটকাল থেকে। কিন্তু এটা যে এতো দ্রুত পূর্ণ হবে তা কল্পনাও করেনি৷

ইমান পেছন থেকে বলে, “সারপ্রাইজটা কেমন ছিল?”

মিরা বরফ খন্ডের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, “আপনি জানতেন আজ তুষারপাত হবে?”

— জানতাম বলতে, ওয়েদার রিপোর্টে সো করেছিল তখন দেখেছি।”

–” আমার বাইরে গিয়ে ভিজতে মন চাচ্ছে। বরফ গুলো নিয়ে খেলতে মন চাচ্ছে। ”

–” বাচ্চারা বরফ দিয়ে খেলে। দুপুর হলেই দেখবে সব ক’টা নিচে নামবে ৷ হৈচৈ শুরু করে দিবে। স্নোম্যান বানাবে। তুমি কী বাচ্চা? অবশ্য বাচ্চাই বলা চলে। যারা ভুতে ভয় পায়, তারা নিশ্চয়ই আন্ডাবাচ্চা৷ ”

মিরা তুষারপাত দেখায় এতো মগ্ন যে ইমানের খোটা তার গায়ে মাখালো না। সে অদ্ভুত নয়নে চেয়ে আছে৷ কীভাবে ভূপৃষ্ঠের উপর বৃষ্টির ফোটা নিচে নামতে নামতে বরফ হয়ে যাচ্ছে৷ কী দারুণ লীলাখেলা!

ইমান আলমারি থেকে জ্যাকেট বের করে দিল। জেন্টস জ্যাকেট ছিল ওটা। তবুও বাইরে যাওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে মিরা জ্যাকেট পরে নিল। স্কাই ব্লু রঙের সেই জ্যাকেটে নিজেকে অন্য এক বেশে আবিষ্কার করে সে। নিজের এ রুপ এতোকাল কই লুকিয়ে ছিল? ইমানকেও দেখলো মোটা সোয়েটারের উপর কোট গায়ে দিল। এরপর দু’জোড়া বুট বের করল। নিজে এক জোড়া পরে। এবং মিরাকে ইশারায় পরতে বলে। মিরা নিজের পায়ে বুট পরিধান করে বুঝতে পারল সাইজে তার দ্বিগুণ এই বুট জুতো। তবুও কিছু বলল না। তার বাইরে যাওয়া চাই৷ ইমানের ওভার কোটটা ছাই রাঙা। সে দু’বার তার দিকে আড়চোখে তাকালো৷

ইমান বলে, ” বেশি দূর যাব না কিন্তু। সামনেই যাব। আর অল্প কিছুক্ষণ থাকব৷ লেটস গো।”

–” ওকে।”

মেইনডোর খোলামাত্র মিরার ফিল আসল সে ডিপ ফ্রিজের মধ্যে ঢুকে পরেছে। পুরা পৃথিবি যেন ফ্রিজ! ওয়েদার দুর্যোগপূর্ণ প্লাস এতো সকাল হওয়ায় সম্পূর্ণ এলাকা নির্জন। কোন গাড়ি নেই। নিউইয়র্কবাসী মনে হয় আরাম করে ঘুমাচ্ছে আজ৷ একটা শুধু একজনকে দেখা গেল। মেইন রাস্তা ধরে আগাচ্ছে ছাতা মাথায়৷ গ্লুমি আবহাওয়া। শুকনো গাছের ডালে ডালে বরফ টুকরো নিচে পতিত হওয়ার সময় আটকে যাচ্ছে। এবং খানিকক্ষণ পর টুপ করে জমিনে পরে যাচ্ছে৷ জমে থাকা বরফের জন্য ভীষণ পিচ্ছিল হয়েছে রাস্তা। বিপদজনক। মেঘ ডাকছে থেকে থেকে৷ মিরার কাছে মেঘকন্যার কাদার আওয়াজ বাদে সবকিছু নতুন। বাতাসে পেচা তুলার মতো আনন্দে মাতোয়ারা এই তুষার নতুন তার কাছে। গাছে-গাছে বরফ ছেয়ে যাওয়া,পিচ ঢাকা রাস্তা কালো থেকে সাদা হওয়া, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন পুরুষটার তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকানো সব নতুন তার কাছে৷ জীবনে প্রথম তুষার ঝড়ে তার আসা। প্রথম অভিজ্ঞতা। খুব শীত লাগছে মিরার। শীতের চেয়েও উত্তেজনা হাজার গুণ। তার চুলের উপর বৃষ্টি এসে সঙ্গে সঙ্গে সাদা বরফ হয়ে জমে যাচ্ছে। আবার তুষার এসে জমছে এবং ক্ষণেই গলে পানি হচ্ছে। কয়েক টুকরো আবার গলল না। চুলে পেচিয়ে রইল। সে ঠাণ্ডা সইতে পারছে না। ঠকঠক করে কাঁপছে৷ বাসা থেকে চার কদম এগিয়ে গেছে তারা। ইমান ওভার কোটটা খুলে তার গায়ে জড়িয়ে দিল। ওর পরনে মোটা সোয়েটার আছে৷ খুব শীত লাগছে না তার৷ এই কোটটার দরকার মিরার৷

ওভার কোট গায়ে দিলে ঠাণ্ডা লাগা কমল কিছুটা৷ মিরা হাঁটা শুরু করে। তিন কদম যেতেই পিচ্ছিল রাস্তায় টাল সামলাতে না পেরে এবং সাইজে বিড় বুট পরায় চলনে সমস্যা সৃষ্টির জন্য সে ধপাস করে পরে গেল। একদম পা পিছলে আলুর দম অবস্থা। অবশ্য পরে গিয়ে সে বিন্দুমাত্র ব্যথা পেল না। বরং হাত-পা ছুড়ে দিয়ে সে আয়েশী ভঙ্গিতায় শুয়ে পরে বরফের মাঝে। মাঝ রাস্তায়। নির্জন জন্য কেউ নেই তাকে ডিস্টার্ব করার জন্য।

ইমান আস্তে করে বলে, ” ওহ গড, কি করছো?”

মিরা দু’মিনিট গড়াগড়ি খেল রাস্তায়। শোয়া অবস্থায় এতো চমৎকার লাগলো তার৷ ধূসর আকাশ। সূর্য হাল্কা কিরণ দিচ্ছে৷ কিন্তু সাক্ষাৎ ঘটাচ্ছে না সরাসরি। লুকোচুরি খেলছে মেঘমালার সঙ্গে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। বাতাসের তোড়ে চোখের পাপড়ি বন্ধ হয়ে আসছে৷ তার ওভার কোটে, চুলে, বাহুতে বরফ লেগে গেছে। অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় আর পারল না সে। উঠে বসল৷ এরপর হাত দিয়ে গোল গোল করে বরফ গুলোকে বল আকার দিচ্ছে। আগে ছোটবেলায় সে আর ইরা ডিপ ফ্রিজের গায়ে লেগে থাকা বরফ চামচ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করে মাথায় দিত। গায়ে মাখত। ওইটাই খেলা ছিল তাদের৷ আম্মু সেজন্য বকত খুব৷ আচমকা সে খিলখিল করে হাসে। এরপর সামান্য বরফ তুলে মুখে দেয়। এবং ধুক করে মুখ থেকে ফেলে দিল। এই কাজটা সে কেন করল কে জানে!

ইমান বলে উঠে, ” চকলেট সিরাপ আনবো? বরফের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে পারবে৷”

মিরা চোখ-মুখ কুচকে ছিঃ বলে উঠে। এরপর হাতে দলা পাকানো বরফ ইমানের দিকে ছুঁড়ে মারে৷ আচানক আক্রমণে ইমান অবাক হলো। এরপর সেও বরফ তুলে নিয়ে তার দিকে ছুঁড়ে মারে। দুজনের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হলো কে বেশি বরফ ছুঁড়ে মারতে পারে৷ খেলা জমলো বেশ। একটা সময় দুজন ক্লান্ত হয়ে নিচে বসে পরে৷ মিরা আবারো বরফের মাঝে শরীর এলিয়ে দেয়৷

ইমান অপলক নয়নে তাকালো তার পানে। এতো এতো সৌন্দর্য তার চোখকে ভষ্ম করে দিয়ে যাচ্ছে যেন৷ এই মূহুর্তে তার নিজেকে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। এই মায়াবতী মেয়েটা তার৷ একান্ত তার৷ একটা সময় মেয়েটা তাকে মন-প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসত। সে ভালোবাসার মূল্য দিতে পারেনি। হুট করে অপরাধবোধে তার অন্তর বিষাদময় হয়ে উঠল। সে মিরার দিকে ঝুকে আসে। এরপর দু’হাত দিয়ে তাকে একটা সীমিত জায়গা অব্দি বন্দী করে৷ মিরার উপর নিজের মুখমণ্ডল এগিয়ে আনে সে। দুজনের মধ্যে দূরত্ব খুব কম৷

কয়েক পল সেভাবেই কেটে যায়৷ মিরার চোখের পলক যেন থেমে গেছে। সঙ্গে থেমে গেছে তাকে ঘিরে সমস্ত দুনিয়া৷ নজড়কাড়া আঁখি যুগল যেন পলক ভুলতে ভুলে গেছে৷ ওই মায়াবী ঘোলাটে চোখের মনির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ইমান যেন সম্মোহন হচ্ছে। বুকের বাম পাশটা লাফাচ্ছে শুধু। ফেটে যাবে নাকী! মিরার চোখে সে এক সাগর অনুভূতি দেখতে পাচ্ছে৷ সেই সাগরের মায়ায় ডুবে যাচ্ছে সে। অতলে, অনেক গভীরে। যেখান থেকে উঠে আসার উপায় নেই। ওই সাগরের পথভ্রষ্ট নাবিক হতে চায় সে।

টুপটুপ করে বৃষ্টির কণা ইমানের মাথায় পড়ছে। সেখান থেকে কপালে বেয়ে পড়ছে৷ কপাল থেকে চুইয়ে চুইয়ে বরফপানি মিরার চোখে-মুখে পড়তেই সে আবেশে চোখ বুজে ফেলে৷ এতেই তার ফর্সা টুকটুকে গালটা লালাভ আভায় ছেয়ে গেল। ইমান সেই লজ্জামাখা লালাভ আভামাখা গালে হাত ছুইয়ে বলে, ” আরেকবার কী সুযোগ দিবে? আই ওয়ান্ট এ চান্স। লাস্ট চান্স৷ আই থিংক আই লাভ ইউ। ওনেস্টলি স্পিকিং। আমি সত্যি এই সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রাখতে চাইছি। বেটার হাফ হিসেবে পেতে চাইছি তোমায়৷ মিরা, উইল ইউ গিভ এ আনাদার চান্স। আই উইল নট ডিজাপয়েন্ট ইউ এগেইন। ট্রাস্ট মি।”

তখনো মেঘেদের গুড়ুমগুড়ুম ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। খুব হুট করে বাতাসের প্রবাহ বেড়ে গেল। তেজ বৃদ্ধি পাচ্ছে চক্রবৃদ্ধি হারে৷ ঠাণ্ডা প্রকোপ বাড়তে লাগলো। মিরার ঠোঁট কাপছে। চোখ খুলেছে সে। কিন্তু নির্বাক। ইমান এমন কথা বলবে তা কল্পনাতেও ভাবেনি। বরফ গলে যেভাবে পানি হয়ন,ঠিক সেইভাবে কী মানুষের ঘৃণা গলে ভালোবাসায় পরিণত হয়?

এতো কাছ থেকে ইমানের উত্তপ্ত নিশ্বাস তাকে পাগল করে দিচ্ছে। ওর বলা প্রতিটা বাক্য তার বুকের ভেতর জলচ্ছাস বয়ে আনছে। হৃদয়টা ফালা ফালা করে দিচ্ছে৷ “উইল ইউ গিভ এ আনাদার চান্স” বাক্যটা কানে বাজছে শুধু। তিরতির করে কাপছে তার চোখের আইলেস৷ ঠোঁট জোড়া মৃদ্যু কম্পনমান৷

ইমান একাধারে তার দিকে তাকিয়ে আছে৷ মেয়েটার রুপ অপার্থিব। চোখ সরাতে মন চাইবে না৷ তার মুখ,গালে, চোখের পাপড়িতে পানির ছিঁটে৷ ইমান সামান্য হাসল। চোখে চোখ রেখেছে তারা। দৃষ্টিবিলাস চলছে৷ চোখে চোখে অনেক না বলা কথা চলছে৷ মিরার চোখে স্পষ্ট অভিমান দেখছে সে। আচ্ছা মেয়েদের অভিমান কীভাবে ভাঙ্গাতে হয়?

ইমান জবাবের আশায় তীর্থের কাক। কিন্তু ওর নীরবতা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাকে৷ অস্থির হয়ে পরে সে। এছাড়াও হুট করে আবহাওয়া প্রচুর খারাপের দিকে যাচ্ছে। বাসায় ফেরা উচিত৷ কিন্তু উত্তর না নিয়ে যাবে না সে।

ইমান নড়েচড়ে উঠে বরফের উপর মিরার নরম হাত দুটো চেপে ধরে৷ বরফের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে তাদের হাত। ইমান ওর গোলাপী কম্পনরত ঠোঁটযুগলে নিজের সিগারেট খাওয়া কালচে বর্ণ ধারণা করা পুরু ঠোঁ-ট ডু-বা-লো। দু’মিনিট আগেও আবহাওয়ার তান্ডবে শীত লাগছিল। মুহুর্তে সব শীত পালিয়ে কোথা থেকে ভ্যাপসা গরম এসে ভর করে দেহে৷ এটা কী ভালোবাসার উষ্ণতা? ইমানের খুশিতে নাচতে মন চাচ্ছে। অবশেষে সে “ভালোবাসা” এর মতো কটমট কঠিন টার্মটা বুঝতে সক্ষম।

Why love is so sweet?
Why life is so beautiful?

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–43 (বোনাস)

— ” মিরা বিরক্ত করো না প্লিজ।”

“উ-ম্ম-ম” শব্দ তুলে সম্ভবত মিরা কিছু বলতে চাইছে তখন থেকে৷ কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না। এছাড়া অতিমাত্রায় নড়চড়, হাতে চিমটি মারা তো আছেই ফ্রি। তার চোখে তখন দুর্ভেদ্য আঁধার নেমে এসেছে৷ কেমন যেন মাথা ঝিম মেরে আসছে তার। সব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মাথা ভোভো করছে। বুকের একপাশে চিনচিন ব্যথা করছে৷ চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল৷ তার বুকে যেন একটার পর একটা হাতুড়ির বাড়ি পরছে। সে পিটপিট করে তাকালো। খুব, খুব নিকটে ওর সুর্দশন মুখমন্ডল। বেচারা ঘেমে গেছে৷ মনে হয় এই প্রথমবার মিরা তাকে এতো কাছ থেকে অনুভব করছে। দুজন এতো কাছাকাছি যে সবটা মিলেমিশে একাকার। নাকী আগেও এসেছে এতো নিকটে? কী জানি, মনে পড়ছে না নাহ, কোনদিনও তারা ওতো কাছ আসেনি৷ ওর চাপ দাঁড়ির ঘঁ-ষা-য় সম্ভবত তার গ-লা লা-ল হয়ে গেছে৷ জ্বলছে মন, বুক, হৃদয় সঙ্গে দেহের প্রতিটা লোমকূপ৷ সমস্ত শরীর ব্যথায় ভেঙে যাচ্ছে। ব্যথায় মিরার মুখ লাল হয়ে গেছে৷

দূর থেকে একটা টর্চের আলো চোখে এসে লাগলো। সাইরেনের মতো ভোভো শব্দ কানে আসছে। সে আবারো নড়াচড়া আরম্ভ করে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করল৷ কিন্তু লাভ তেমন হলো না৷হুট করে আমেরিকান একসেন্টে ভরাট পুরুষালি কণ্ঠে কেউ বলে উঠে, হেই মিষ্টার, হুয়াট আর ইউ ডুয়িং উইথ দ্যা লেডি?”

কথাটা কর্ণকুহর অব্দি যেতেই ইমান ছিটকে সরে আসে। আবারো, আবারো তার রো/ম্যা/ন্স দুশমন হয়ে এই ব্যাটাকে আসা লাগলো? উফফ, এতো লজ্জা কোথায় রাখবে?

সে সরে আসতেই বুঝল, প্রকৃতি খুব ক্ষেপে আছে। ক্ষোভ প্রকাশ করছে৷ মুহুর্তের মধ্যে এতো অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। চারিদিকে রাতের মতো অন্ধকার। তীব্র বেগে তুষারপাত হচ্ছে। গায়ে হানছে খুব করে। মোটা কাপড়েও শীত নিবারণ হবে না। সে দুম করে নিশ্বাস ছেড়ে বললো, ” হ্যালো, অফিসার।”

অফিসার বিরষ মুখে তাকিয়ে আছে। চোখে তার শ্লেষ। ইশ! নিশ্চয়ই তাকে লুইচ্চা ভাবছে উনি৷ এ ধরনের কারবার কম বয়সী ছেলে-মেয়েরা করে ধরা খায়। তার মতো গ্রাজুয়েট, ভালো জব হোল্ড করা রেসপেক্টট কেউ এভাবে ধরা খায় কীনা সন্দেহ!

সে মিরার দিকে তাকালো। বেচারীর শীতে নাজেহাল অবস্থা। ঠকঠক করে কাঁপছে তো বটেই। দাঁতে দাঁত চেপে আছে। মুখে-চোখে ক্লান্তির ছাপ। চুল গুলো এলেমেলো হয়ে উড়ছে। চুলের ভাঁজে ভাঁজে স্নো গুঁজে গেছে। আহারে একদম মনের কুটরিতে বাস করা কোন তুষার কন্যা। স্নো হুয়াইট তাকে দেখলে নিশ্চয়ই কেঁদে বুক ভাসাত। তার চেয়েও সুন্দরী বরফকন্যা পৃথিবীতে আছে। এ কষ্ট কই রাখবে স্নো হোয়াইট?

অফিসার বলে উঠে, ” তোমাদের কী মাথা ঠিক আছে? হুশ নাই? রেড এলার্ট দেওয়া হয়েছে। বাসা থেকে বের হয়েছো কেন? তাও মাঝ রাস্তায় বসে এসব না করলেও পারো। রুম নেই তোমাদের? স্টুপিড!”

ষ্টুপিড উপাধি পেয়ে ইমানের মন চাচ্ছিল মাটির সঙ্গে মিশে যাক সে। আসলেই তো এমন আহাম্মক কবে থেকে হলো সে?

সে মাথা চুলকে বলে, ” সর‍্যি। সামনেই আমাদের বাসা।”

–” নিজের গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে রুমে যাও। এভাবে বাহিরে থাকার কোন অর্থ হয় না।”

ইমান হেসে ফেলে বলে, ” শি ইজ নট মাই গার্লফ্রেন্ড।”

অফিসার ভ্রু কুচকে বলে, ” তাহলে? মেয়েটা কে হয় তোমার? ”

— “ওয়াইফ।”

মিরা কথাটা শোনামাত্র সামান্য কেঁপে উঠে। অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বেয়ে গেল৷ সে উঠে দাঁড়ালো। এই প্রথম ভীনদেশে ইমান তাকে নিজের স্ত্রী হিসাবে কাউকে পরিচয় করিয়ে দিল। কেমন অচেনা একটা অনুভূতি সারা অঙ্গকে বশ করে ফেলছে৷ সে গা থেকে বরফ ঝারতে লাগল।

ইমান তার হাত ধরে নিজের বুকের বাম পাশে এনে চেপে ধরে বলে, ” থ্যাংকস ফর দ্যা কনসার্ন, অফিসার ”

উনি হেসে বলল, ” আই ডিড মাই জব, ম্যান৷ ইউর ওয়াইফ ইজ সো প্রিটি৷ জেসাস ব্লেস ইউ বোথ। ”

এখানে এমন ঝড়-তুফানে ফোর্স নিয়ে আশেপাশে পুলিশরা থাকে। টহল দেয়৷ তুফান থামলে সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা থেকে বরফ সরাতে উঠে-পড়ে লেগে যায়।

ইমান হাত ছাড়লো না মিরার। দু’কদম আগালো সে। ঠাণ্ডায় জমে বরফ হতে যাওয়া মিরা আবারো পায়ে স্লিপ কাটলো। আসলে বুট জুতোটা পরে সে হাঁটতে পারছে না৷ ইমান সেটা লক্ষ্য করে তার দিকে এগিয়ে এলো। এরপর বলে উঠে, ” মে আই হেল্প ইউ?”

মিরা চোখ তুলে তাকালো না। ওই চোখের দিকে সে আর কোনদিন তাকাতে পারবে না৷ সে বোধহয় অপেক্ষা করল কিছু শোনার জন্য। কিন্তু মিরার মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। ভীষণ শকে চলে গেছে সে। একটু আগে যা হয়েছে তার কোনটাই সে মেনে নিতে পারছে না৷ মাথা ঘুরাচ্ছে৷ আচমকা ইমান তার কোমড় চেপে ধরে পাজকোলে তুলে বড় বড় পা ফেলে আগাতে লাগে। পড়ে যাওয়ার ভয়ে সে ওর গলা জড়িয়ে ধরলে সে হাসতে হাসতে বলে, ” ডোন্ট ওরি। ফেলে দিব না তোমাকে। ঠাণ্ডা লাগছে খুব? উষ্ণ ওম চাই? ”

মিরা চোখ বুজে ফেলে তার হাত মুষ্টিমেয় করে ভীষণ জোরে আঘাত করল ওর কাঁধে এবং মুখে শুধু “ইশস” উচ্চারণ করে৷

ইমান আরেকবার হাসি উপহার দিয়ে বলে, ” আমি কিন্তু ডাবল মিনিং করিনি। তুমি নেগেটিভলি নিচ্ছো। আজকালকার আন্ডাবাচ্চা গুলোও ইথিলিন দিয়ে পেকে গেছে৷ শীতকালে আমরা রুম গরম রাখার জন্য অনেক পদ্ধতি অবলম্বন করি। যেমন আগুন ধরিয়ে রাখি। আর তুমি সবচেয়ে দু-ষ্ট পদ্ধতির কথা ভাবছ।”

মিরার লজ্জায় সেখান থেকে পালিয়ে যেতে মন চাইল। তারা বাসায় ফিরল ছয়টার দিকে। দোতলায় যেতেই মিরা গুটিসুটি মেরে বসে পরে। এতো শীত লাগছে যেন মনে হচ্ছে শীতের অত্যাচারে সে মরে যাবে৷ ইমান ব্লাংকেট এনে তার গায়ে জড়িয়ে দিল। টাওয়াল দিয়ে চুল মুছিয়ে দিতে দিতে বলে, ” কফি করে আনি৷ খেলে আরাম লাগবে। বাই দ্যা ওয়ে, ফাস্ট টাইম তো এজন্য এমন লাগছে। কয়েকবার এক্সপেরিয়েন্স হলেই ঠিক হয়ে যাবে।”

মিরা কটমট করে তাকালে ইমান দুষ্ট হেসে বলে, ” চোরের মন পুলিশ পুলিশ। আমি এবারেও ডাবল মিনিং করিনি কিন্তু। বলছিলাম তুষারের কথা। প্রথম বার জন্য সহ্য করতে কষ্ট হল। কয়েকদিন এমন তুষারের মধ্যে থাকলে তাপমাত্রার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যাবা। আমাকেই দেখো। আমিও তোমার সাথে ছিলাম। আমার অবস্থা কিন্তু এতো করুণ না৷ আর মেয়ে কীসব ভেবে বসে আছে। অবশ্য যা ভেবেছো সেটাও খুব একটা ভুল না। বরং লজিক্যাল। ”

মিরা ডিভান থেকে বালিশ ছুঁড়ে মারে তার গায়ে৷

________________

ইরা যখন লাল হয়ে যাওয়া হাতের যন্ত্রণায় তটস্থ তখন তার মামাত ভাই অনিক বেরিয়ে আসে। রান্নাঘরে তার সামনে এসে বলে, ” কী হইছে? এমন চিল্লাইস ক্যালা?”

তার কথায় ইরার গা জ্বলে যাচ্ছে৷ অশিক্ষিতদের মতো কথার ভাষা তার। দেখতেও বখাটে লাগে। মনে হয় নে-শা-পা-নি করে সারাদিন৷ মামা-মামী ওকে কিছু বলে না। পড়াশোনা বাদ দিয়ে আজাইরা কাজ করে বেড়ায়। তাও তাদের ছেলে নাকি সোনার টুকরো।

ইরা বলে উঠে, ” হাতে ব্যথা পেয়েছি।”

–” উফ বাপ! তাতেই এমন চিক্কর পাড়তেছোস। দেখি তোর হাত দেখা।”

–” সিরিয়াস কিছু না৷”

–” সিরিয়াস কিছু না হলে চেচালি ক্যান? হাত দেখা।”

–” তুমি তো ডাক্তার না যে চিকিৎসা দিবে ভাইয়া। ”

–” ডাক্তার নাতো কি হইছে। বেশি মুখ চলে তোর। মাইয়া মানষের এতো কথা কওন ভালো না৷ ”

ইরা তার দিকে ক্ষুব্ধ চোখে তাকালো। অনিক ভাইয়ার মতিগতি ভালো না৷ কেমন টলছে। চোখ অতিরিক্ত লাল। গায়ে শার্ট নেই। স্যান্ডোগেঞ্জি পড়া শুধু।

অনিক বলে উঠে, ” আম্মা কই? ফুপু কই?”

–” বাইরে।”

বাইরে শব্দটা শোনামাত্র অনিক তার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকালো। এরপর বলে উঠে, ” তোর হাতে মলম লাগাইতে হইব। নইলে ফোসকা পরে যাবে৷ আমার রুমে মলম আছে। যা নিয়ে আয়।”

ইরা বিরক্তিতে চ বর্ণ উচ্চারণ করে বলে, ” প্রয়োজন নেই।”

সে জোরাজোরি করে বলে, ” তোর ভালোর জন্যই করতেছি। পড়ার টেবিলের সেকেন্ড ড্রয়ারেই আছে।”

ইরা তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অনিকের রুমের দিকে আগালো। হাতে মলম লাগিয়ে সে নিজের রুমে দরজা দিয়ে থাকবে৷ অনিকের রুমে ঢুকতেই বিশ্রী গন্ধ ভেসে উঠে৷ বমি পেয়ে যায় তার। টেবিলের উপর খয়েরী রঙের দুটো খালি বোতল। ইরা সেকেন্ড ড্রয়ার খুলতেই রুমের দরজা লাগানোর আওয়াজে কেঁপে উঠে। সে ঘার ঘুরিয়ে দেখে অনিক তার সামনে দাড়ালো। ভীষণ ভয় পেয়ে যায় সে। খারাপ চিন্তা মনে বাসা বাঁধে৷ কিন্তু অনিক ভাইয়া ওর কাজিন। ভাইয়াকে নিয়ে খারাপ কিছু চিন্তা করতেও তার কেমন লাগছে৷

সে মনে বল ফিরিয়ে এনে বলে, ” দরজা বন্ধ করলে কেন?”

অনিক একটা হাই তুলে বলে, ” ছে-ম-ড়ি তুই এতোও নাদান না। ভং কম ধর৷”

ইরার চোখ ফেটে পানি উপচে পড়তে চাইছে। ভয় এসে সমস্ত শরীর কে অবশ করে দিল। অনিক তার দিকে তেড়ে আসে। ইরা চোখে অন্ধকার দেখছে৷ সবকিছু কালো তার চোখের সামনে। শুধু চোখ ফেটে জল গড়াচ্ছে৷ মা, মা করে কয়েকবার ডাকল সে। ধস্তাধস্তি চলছে। রুম থেকে কান্নার চাপা আর্তনাদ ভেসে আসছে। ততোক্ষণে অনিক ওর মুখ বেঁধে ফেলেছে ওড়না দিয়ে৷ ইরার মস্তিষ্কে আচমকা তাদের পিটি মিসের বানী ভেসে উঠে। তাদের স্কুলে ডিফেন্স কেয়ার বলে মেয়েদের জন্য ক্লাব আছে৷ প্রতি শনিবার পয়তাল্লিশ মিনিট ধরে ম্যাম ব্রিফিং দেন৷ বিভিন্ন প্রতিরক্ষা মুলক ভিডিও দেখান৷ উনি বলেছিলেন, ” মেয়েরা মনে রাখবে ওইসব পুরুষ দুর্বল হয়। প্রচুর দুর্বল। এজন্য এমন স্টেপ নেয় তারা৷ সাহসী পুরুষরা এমন করেনা। এমন পরিস্থিতিতে ঘাবড়ে না গিয়ে সাহস রাখা দরকার বুকে। সাহস বুকে থাকা মানে অর্ধেক যুদ্ধ জয় করা।

অনিক তখন ওর হাত বাঁধার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং বলছে, ” এতো ঝামেলা করস কিল্লাই? চুপচাপ শু-ই-তে পারোস না? যত্তোসব। তোদের দুই বোনের কীসের দেমাগ রে? সুন্দরী দেইখ্যা? তোগো মতো সুন্দরী পকেটে নিয়ে ঘুরি৷ তোর চাপার জোর আজকে ভা-ই/ঙ্গা ফে-লা-মু।”

ইরা তার পা দিয়ে অনিকের পায়ে একটা লাথি মারে৷ কিন্তু বেশি সুবিধা করতে পারল না৷ বরং ও আরো ক্ষেপে গেল৷ ইরাকে ভীষণ জোরে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারে৷ ফ্লোরে আছড়ে পড়ার দরুণ আহত হয় ইরা। ব্যথায় সারা শরীরের অস্থি ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। সে চোখ বন্ধ করে ডুকরে কেঁদে উঠে।

_____________________

জহির খান একটু আগেই তার স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলল৷ সে আগামীকাল ফিরে আসছেন বাসায় একথা জানাতেই মূলত কল দেওয়া। কিন্তু কল দিয়ে সে অনেক কিছু জানতে পারল৷ ইমানের কাজিন এসে থাকছে কিছুদিন ধরে। এতে বিচলিত হওয়ার কোন কারণ ছিল না৷ আল্লাহ দিলে একটা মানুষের খাওয়া খরচ দেওয়া তার জন্য কোন ব্যাপার না৷ কিন্তু যখন জানলো, ওর কাজিনের বাবা আজিজ তালুকদার। সঙ্গে সঙ্গে তিনি চমকে উঠে। এবং ভরাট কণ্ঠে হাসনাহেনা কে বলেন,” কত দিন থাকবে ওই মেয়ে? দ্রুত আপদ বিদায় কর।”

তার কথায় সম্ভবত হাসনাহেনার কষ্ট হলো। ফোন দেওয়া থেকেই ওই মেয়ের প্রশংসা করছিল। জহির সাহেব ঘামছেন৷ একবার ভাবল পিটারকে কিছু বলবেন না৷ পরক্ষণে ভাবল, জানিয়ে রাখা ভালো আগেভাগে। পরবর্তীতে কিছু ঘটলে সে দায়ী থাকবে না৷ পিটারকে কল লাগাতেই পিটার বলে উঠে, ” জহির কতদিন পর কল করলে? ভুলেই গেছো আমাকে।”

–” পিটার, তুমি আমার দুর্দিনের বন্ধু। তোমাকে কখনোই ভুলব না আমি।”

পিটার হেসে বলে, ” তোমার জন্য আমি আমার লাইফের সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন পেয়েছি। আমিও তোমাকে ভুলব না, মাই ফ্রেন্ড। ”

জহির খান গম্ভীরমুখে বলে উঠলেন,” আজিজের মেয়ে আমার বাসায় এসে উঠেছে পিটার।”

–” আজিজ?”

— ” আজিজ তালুকদার। ভুলে গেছো নাকী?”

–” ওকে ভোলা অসম্ভব। বাই এনি চান্স, ওর মেয়ে কী সব জেনে এসেছে নাকি এমনিতেই এলো? কোন উদ্দেশ্য আছে? ”

–” জানি না।”

–” আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ও সব জেনেই এসেছে।”

–” আমি কিছুই জানি না। জানলে তোমাকে জানাব।”

–” দুশ্চিন্তায় ফেলে দিলে আমাকে।”

–” দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এছাড়া তালুকদারের দিন ভালো যাচ্ছে না। রাখি তাহলে। ”

_______________________

সকাল সাতটার দিকে যখন সবাই জাগ্রত হলো। ইমান ঘোষণা দিল সে আজ সবার জন্য ব্রেকফাস্ট তৈরি করবে। আজ অফিস ছুটি তার। সবাইকে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াবে৷ হাসনাহেনা অবাক হয়ে বলে, ” আজকে তুমি অনেক হ্যাপি নাকি?”

এ প্রশ্ন শুনে ইমান হেসে বলে, “হ্যাঁ।”

তখন ওর চোখ সরাসরি মিরার দিকে গেল। মিরা মনে হয় লজ্জা পেল৷

সে বলে উঠে, ” আমাকে সাহায্য করার জন্য চাইলে কেউ থাকতে পার।”

হাসনাহেনা বলে, ” প্রতিদিন তো আমি রান্না করি। আজকে রেস্ট নিই।”

সাদ যেন শুনেও শুনেনি ভাইয়ের কথা৷ অগত্যা মিরা এগিয়ে এলো কিচেনের দিকে৷ সে কিচেনে যেতেই ইমান কিচেন এপ্রোন দিল তাকে৷ নিজেও কিচেন এপ্রোণ পরে নিয়েছে৷ মিরা ভেবেছিল ইমান রান্না করতে পারবে না৷ কিন্তু তাকে ছয় মিনিটের মাথায় ভুল প্রমানিত করল সে। ওর হাতের স্প্রিড অনেক ফাস্ট। ছয় মিনিটের মধ্যে দু’রকম জুস বানালো। মিক্সড ফুট্রুস জুস আর স্ট্রবেরি জুস। এরপর প্যান কেকের জন্য ময়দা গুলে নিল৷ ইস্ট দিল আর কী কী সব যেন দিয়ে প্যানে বসিয়ে বানাতে লাগলো৷ ইলেকট্রনিক চুলায় রান্না করা সহজ। ইমান দ্রুত ক্যাশোনাট বের করে ভাজল। এরপর শশা, গাজর, টমেটো, ক্যাপসিকাম কেটে সালাদ বানালো৷ চিকেন মেগনেট করাই ছিল। সেটাও মিক্সড করল। এক ধরনের সসও দিল। মিরা শুধু চেয়ে আছে। ইমানের তার সাহায্যের কোন প্রয়োজন নেই। অযথা দাঁড়িয়ে আছে সে। এরপর ওমলেটও বানালো চারটে৷ চীজ স্যান্ডউইচ বানালো। তাকে কিছু করা লাগল না। ব্রেড আর চীজ স্যান্ডউইচ মেকার দিতেই তা তৈরি হয়ে গেল। ওয়াফেলও সেভাবেই বানালো। ওয়াফেল আবার দু’ ফ্লেভারের করল। চকলেট আর ব্লু-বেরি। এতোকিছু মাত্র একঘন্টায় করে সে আটটার দিকে ব্রেকফাস্ট টেবিলে আসল৷

এরপর সবার উদ্দেশ্য বলে, ” একটু আগেই খবর পেয়েছি৷ আমার প্রোমোশন হয়েছে৷ নেক্সট মান্থ থেকে স্যালারি অলমোস্ট ডাবল পাচ্ছি।”

সাদ চেচিয়ে উঠে বলে, ” ব্রো আই ওয়ান্ট এ গ্রেট ট্রিট। ইউ বিকাম রিচ। ”

ইমান হেসে দিয়ে বলে, ” কফি করে আনছি।”

মিরার আচমকা মন খারাপ হলো। ইমান তার মানে এজন্য এতো খুশি। অথচ ও কী ভেবে বসেছিল!

সাদ তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” ভাইয়া কেমন সংসারী হয়ে গেছে মম দেখো!”

হাসনাহেনা হেসে বলে, ” যেই ছেলেগুলো ঘরছাড়া স্বভাবের হয়, ওদের বিয়ের হাওয়া লাগলে ঘরকোণে স্বভাবের হয়ে যায়। ”

–” বিয়ের হাওয়া মানে?”

— “আমার মনে হয় ইমান খুব দ্রুত জুইকে বিয়ে করছে৷ কিছু তো বলে না৷ কিন্তু বোঝা যায়৷সংবাদ বাতাসে ঘোরে৷”

সাদ হেসে বলে, ” ফাইনালি লাভ বার্ডস একসঙ্গে হচ্ছে। হুররেএ।”

মিরার সামনেই তারা আলোচনা করছিল। সবটা শুনে ফেলে সে। মুহূর্তে তার পৃথিবী ঘুরে যায়৷তাহলে….. তাহলে ইমান আরো একবার তার সঙ্গে প্রতরণা করলো?

চলবে৷