#বউপাখি
#পর্ব_৩
#লেখনিতে_সিনথিয়া
-‘তোমাকে নাতি-নাতনী গিফট করতে যাচ্ছি বাবা, এখন প্লিজ ছেড়ে দাও, নয়তো সব এনার্জি এখানেই শেষ হয়ে যাবে!’
আরাফ কথাটা বলেই তিতিরের দিকে তাকিয়ে হেসে চোখ মারলো। মরে গেলো! তিতির জাস্ট লজ্জায় মরে গেলো তখন।
-‘বাঁদরামোর একটা লিমিট থাকা দরকার! এই শিখিয়েছো তুমি তোমার ছেলেকে আফিয়া?’
আফিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলে উঠলেন আহনাফ চৌধুরী। ভয়ে কেঁপে উঠল আফিয়া বেগম আর সাথে তিতিরও। তারপর আবার ছেলের দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বললেন-
-‘এই মেয়েকে রেখে আমার রুমে আসো, তোমার সাথে আমার আলাদা বোঝাপড়া আছে।’
_____________________________________
আরাফ তিতিরকে কোল থেকে নামালো একেবারে ওর রুমে নিয়ে গিয়ে। তারপর নিজের কিং সাইজ বেডের ওপর তিতিরকে বসিয়ে নিজে হাঁটু গেড়ে বসল ওর সামনে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল-
-‘আমি বাবার সাথে একটু কথা বলে আসছি, মিষ্টি তোমার খাবার নিয়ে আসবে। খেয়ে নিও কেমন। তুমি না আমার লক্ষী বউপাখি। হুমম?’
তিতির চুপ করে রইলো। একটু আগের ঘটনায় প্রচন্ড রেগে আছে ও আরাফের ওপর।
তিতিরের মৌনতার কারণ আরাফ খানিকটা আচঁ করতে পারলেও মুখে কিছু বলল না। মনে মনে ভাবতে লাগলো রাতে কোন কোন ভাবে আদর করলে ওর বউপাখিটার রাগ ভাঙানো যাবে। মাথায় আবারো দুষ্টু বুদ্ধি আসলো আরাফের। মনে মনে নিজেই নিজেকে বলল – ‘আরাফ তুই আসলেই একটা বউপাগল’। তারপর আবার নিজেই নিজের ভাবনায় ঠোঁট টিপে হাসলো।
তিতির আরাফের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবতে লাগলো -‘পাগলরা মনে হয় এভাবেই মনে মনে হাসে’!’
তারপর উঠে যাওয়ার আগে আরেকবার তিতিরের মাথায় হাত বুলিয়ে রুম থেকে বের হলো আরাফ। রুম থেকে বের হওয়ার সময়ও তিতিরের দিকে তাকিয়ে আরাফ এমনভাবে চোখ মারলো যে তিতির না চাইতেও ওর মুখটা হা হয়ে গেলো। পাগল দেখেছে কিন্তু এমন পাগল জীবনেও দেখেনি তিতির।
আরাফ রুম থেকে বের হতেই খাবার নিয়ে রুমে ঢুকলো মিষ্টি। সম্পর্কে সে আরাফের ছোট বোন। বয়স বেশি না। তিতিরের থেকে দুই বছরের ছোট। এবার অনার্স এ উঠবে। তবে মোটেও সে আরাফের মতো নয়। নিজের নামের মতোই মিষ্টি আর ভদ্র। তিতিরের বেশ লাগলো মিষ্টিকে।
-‘যাক অন্তত কেউ একজন সুস্থ মস্তিষ্কেরও রয়েছে এ বাড়িতে।’
বিরবির করে বললো তিতির। কিন্তু মিষ্টি শুনে ফেললো সেটা। তারপর তিতিরের হাত দুটো নিজের হাতের আঁজলে নিয়ে বলল-
-‘ ভাবিপা আমি জানি তুমি ভাইয়ার কান্ড কারখানায় খুবই বিরক্ত। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমার ভাইয়া খারাপ মানুষ না ভাবিপা। পাগলের মতো ভালোবাসে ও তোমাকে। তুমি যদি বলো ভাইয়াকে তোমার জন্য আকাশের চাঁদ এনে দিতে, ও মনে হয় সেটাও তোমার হাতে এনে দেবে।’
মিষ্টির কথাগুলো শুনে হাজারো প্রশ্ন দানা বাঁধলো তিতিরের মনে। মানুষটার কান্ড কারখানা গুলো কি আসলেই বিরক্ত করছে তিতিরকে? না তো! তিতির কি আসলেই ভুলে গেছে ঐ মানুষটাকে? হাজার চেষ্টা করেও কেনো অতীতের কোনো ঘটনা মনে করতে পারছে না তিতির? কিন্তু ওকে তো সবটা জানতে হবে। সবটা মনে করতে হবে। মিলিয়ে দেখতে হবে এরা সবাই সত্যি বলছে কি না, আরাফ সত্যি বলছে কি না! নাহলে যে এই রহস্যের কোনো কুল কিনারা খুঁজে পাবে না ও।
আর এখন ওকে ওর সব প্রশ্নের উত্তর একমাত্র মিষ্টিই দিতে পারবে। তাই মিষ্টিকেই চেপে ধরলো তিতির। বলতে বলল তিতিরের এ বাড়ির সাথে জুড়ে থাকা অতীতের সব ঘটনা। তবুও মিষ্টি কোনো কিছু বলতে রাজি হলো না।
আসলে ভাইয়ের ভয়েই মিষ্টি কিছু বলল না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে মিষ্টি ওর ভাইয়ের আলমারি খুলে কিছু একটা বের করে দিলো তিতিরের হাতে। একটা লক করা ডায়রি। তিতিরই লিখেছিলো সেই ডায়রিটা ওর স্মৃতি চলে যাওয়ার আগে, আর মিষ্টিকে বলেছিলো যখন তিতিরে স্মৃতি চলে যাবে তখন যেনো মিষ্টি এই ডায়েরিটা তিতিরকে পড়তে দেয়।
– ‘এই ডায়েরির লেখা গুলো পড়লে তোমার সব মনে পড়ে যাবে ভাবিপা।’
মিষ্টির কথা শুনে তিতির ডায়রিটা খানিকক্ষণ উল্টে পাল্টে দেখলো। তারপর মিষ্টিকে জিজ্ঞেস করলো-
– ‘কিন্তু এই ডায়রিটা তো লক করা। চাবি কোথায় এটার?’
মিষ্টি কিছুটা আমতা আমতা করেই বলল-
-‘ চাবিটা আসলে ভাইয়ার গলার চেইনের সাথে আছে। কেউ যদি আবার তোমার ডায়রিটা পড়ে ফেলে তাই চাবিটাকে একেবারে সে তার চেইনের লকেট বানিয়ে পড়ে থাকে সবসময়।’
তিতির বেশ বিরক্ত হলো ওর কথাগুলো শুনে। এখন ও কিভাবে পাবে ডায়রির চাবি। সরাসরি চাইলে নিশ্চয়ই ভয়ানক কোনো শর্ত দিয়ে আবার তিতিরকে লজ্জায় ফেলতে চাইবে ঐ পাগলটা। নাহ্! এবার তিতির এমন আর কোনো সুযোগই দেবে না ঐ পাগলটাকে।
তারমানে আরাফের থেকে চুরিই করতে হবে চাবিটা তিতিরকে। ‘মিশনে নেমে পড় তিতির, এবার সাকসেসফুল তোকে হতেই হবে।’ মনে মনে এটা বলে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো তিতির। মিষ্টি দেখিয়ে দিলো তিতিরকে, ওদের বাবার রুমটা, যেখানে গিয়েই ও দেখতে পেলো আরাফকে। ব্যাস এখন শুধু চাবি টা চুরি করার অপেক্ষা।
মিষ্টিকে বিদায় দিয়ে একপা দু’পা করে এগিয়ে গেলো ও আহনাফ চৌধুরীর রুমের দরজার দিকে, যেখান থেকে আরাফ আর ওর বাবার কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পেলো তিতির।
-‘তুমি তিতিরকে কেনো কিডন্যাপ করেছো বাঁদরছেলে?’
-‘নিজের বউকে বাড়িতে নিয়ে আসা যদি কিডন্যাপ হয়, তাহলে তো বলবো তুমিও মা’কে কিডন্যাপ করেছো বাবা!’
বেশ আয়েশ করে কথাটা বলল আরাফ। মুহুর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো ওর বাবার।
-‘তিতিরের বাবার হাতে মরার এতোই যখন শখ হয়েছিলো তোমার, তাহলে আমাকেই বলতে পারতে, আমিই মেরে দিতাম তোমাকে’
নিঃশব্দে হাসলো আরাফ। তারপর দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বলল-
-‘টেনশন করো না বাবা, তোমার এই ছেলে তোমাকে ডজন খানেক নাতি-নাতনি না দিয়ে মরবে না.!’
-‘ জাস্ট শাট্ আপ! ভোটের দিন ভরা মঞ্চে ওর বাবার লোকেরা যে তোমাকে গুলি করেছিলো, ভুলে গেছো সে কথা তুমি?’
আবারও ফিচলে হাসলো আরাফ। তারপর দুই হাত পকেটে গুঁজে বলল-
– ‘শশুর জামাইয়ের মধ্যে একটু আধটু খুনসুটি হবে এটাই তো স্বাভাবিক বাবা! তোমার মেয়ের আগে বিয়ে দাও, তখন দেখবে, তোমারও এমন খুনসুটি করতে ইচ্ছে করবে! ট্রাস্ট মি!’
নাহ কোনোভাবেই নিজের ছেলেকে বোঝাতে পারছেন না উনি। কিন্তু তবুও শেষবারের মতো বললেন-
-‘তিতিরের বাবা তোমার অপজিশন পার্টির নেতা। এবারে তোমার ভোটে জেতাটাও ভালোভাবে নেননি উনি । তাই তো তোমাকে প্রাণে মারতে চেয়েছিলেন! তারপরও তুমি পরপর দুবার একই ভুল করলে। ঐ মেয়েটাকে নিজের জীবনের সাথে জড়ালে?’
আহনাফ চৌধুরী কথাগুলো বলেই ধপ করে বসে পড়লেন খাটের উপর। অপেক্ষায় থাকলেন ছেলের উত্তর শোনার জন্য। দরজার ওপাশে অপেক্ষায় থাকলো আরো একজন, সে হলো তিতির।
আরাফ একটা লম্বা শ্বাস নিলো, তারপর দেয়ালের সাথে হেলান দিয়েই তাকালো সিলিং এর দিকে আর বলল-
-‘ তিতিরকে আমি শুধু আমার জীবনের সাথে না, আমার প্রতিটা শিরায়-উপশিরায়, আমার প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে ফেলেছি। ও না থাকলে আমি এমনিতেই মরে যাবো বাবা, তার থেকে এইটুকু লাইফ রিস্ক নিয়ে বেঁচে থাকাই কি ভালো না?’
-‘ইডিয়েট’
একই সুরে বলে উঠলো আহনাফ চৌধুরী আর তিতির।
(চলবে)…