#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২২
দুপুরে প্রচন্ড রোদের তাপ। সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলের গ্রাম। সাধারণ মানুষের মাঝে দেখা যায় নানান উপজাতিদের। গ্রাম দিয়ে হেঁটে চলেছে ঐশানী, অভয় সহ পুরো পরিবার। গ্রামের জায়গা গুলো বেশিভাগ উঁচুনিচু। উঁচু জায়গাগুলো তে চায়ের বাগান। সাথে কমলা গাছের বাগানও রয়েছে। ঐশানী জানে সিলেট অঞ্চল কেমন হয়। কারণ সে এখানেই বড় হয়েছে। তবে এই গ্রামে নয়। আরো দুটো গ্রাম পড়ে তাদের গ্রাম। গ্রামের কাঁচা রাস্তা। দুপাশে সুপারি গাছের বাহার। রাস্তাটিকে আরো মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে।
অভয় রেগে বম হয়ে হাঁটছে। সবাই নানানরকম কথাবার্তা বলতে ব্যস্ত থাকলেও ওর মুখটা গোমড়া। হওয়ারই কথা। বাসে তো আর কম কান্ড হয়নি! ভাগ্যিস শেষ মূহুর্তে ঐশানীর ঘুম ভেঙেছিল সেই সঙ্গে ওর পরিবারের সবাই বলেছিল যে ঐশানী তার স্ত্রী। নয়ত ওতগুলো লোকজনের গণধোলাই খেয়ে সিলেট নয় হসপিটালে আসতে হতো। মিটমিট করে হাসতে হাসতে হাঁটছে ঐশানী। বাসে অভয়ের নাস্তানাবুদ হওয়ার বিষয়টা বেশ মজা পেয়েছে সে। ওরা দুজনই পেছন পেছন হাঁটছে নানানরকম লাগেজ নিয়ে। বাকি সবাই বেশ এগিয়ে হেঁটে চলেছে। গ্রামে থাকা লোকজন বেশ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাদের দিকে লক্ষ্য করছে।
–“এই তুমি হাসি বন্ধ করবে? অন্যসময় তোমার হাসি আমার প্রাণ জুড়িয়ে দেয় বিশ্বাস করো! তবে এখন যেই হাসি দিচ্ছো সেটা আমার কাটা গায়ে নুনের ছিটা দেওয়া হচ্ছে।”
অভয়ের রাগি স্বরের কথাগুলো শুনে ঐশানীর হাসির শব্দ বেড়ে যায়। তাতে দাঁতে দাঁত চেপে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয় অভয়। ঐশানীর তালে তাল মেলাতে কষ্ট হয়। অভয় লম্বা মানুষ তার বড় বড় পায়ের ধাপের সাথে কি আর ঐশানীর পায়ের ধাপ মেলে? তবুও চেষ্টা চালাতে চালাতে একসময় হঠাৎ করেই একজন বয়স্ক মহিলা এসে দাঁড়াতেই নিজেকে সামলে দাঁড়ায় ঐশানী। রাস্তার মাঝে এভাবে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ায় খানিকটা বিরক্তও হয় সে। সরু চোখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে এই বয়স্ক মহিলাকে কি সে চেনে? নাহ, একদমই চেনে না।
–“তোমাকে দেখে তো এই গ্রামে নতুন মনে হচ্ছে। তোমার নাম কি?”
মহিলাটির কথায় অপ্রস্তুত হয়ে ঐশানী জবাব দেয়….
–“ঐশানী।”
–“এখানে কি বেড়াতে এসেছো?”
–“জ্বী।”
–“কার বাড়িতে?”
–“খান বাড়িতে।”
অভয় হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করে ঐশানী তার পাশে নেই। পেছন ফিরে চেয়ে দেখে মেয়েটা কার সাথে যেন কথা বলছে।
–“মেয়েটাও না! আসার সাথেই কার সাথে যে গল্প জুড়ে দিয়েছে কে জানে?”
বলেই পেছন ফিরে হেঁটে এসে দাঁড়ায় অভয়। ঐশানীকে ইঙ্গিত করে বলে….
–“কি হলো যাবে না তুমি?”
–“হ্যাঁ যাব কিন্তু…..”
কথাটি পুরোপুরি শেষ না হতেই হুট করেই মহিলাটি আবার প্রশ্ন করে বসেন।
–“তুমি কে হও খান বাড়ির?”
ঐশানী এবার ভাবনায় পড়ে যায়। কি বলা উচিত? খান বাড়ির বউ? এটা বলা কি ঠিক হবে? সে তো পুরোপুরি সেই বাড়ির বউ হতেই পারেনি। অভয় জবাব দেওয়ার আগেই ঐশানী দুম করে বলে বসল….
–“কয়েকদিনের অতিথি হিসেবে রয়েছি।”
ঐশানীর কথাটি অভয়ের বুকে তীরের মতো গিয়ে বিঁধে যায়। ও নির্বাক হয়ে শুধু চেয়েই থাকে। ওর দৃষ্টি হয়ে পড়ে শূন্য। অতঃপর ঐশানী অভয়ের দিকে তাকিয়ে বলে…..
–“যাওয়া যাক?”
অভয় নিজের যন্ত্রণা ঢক গিলে নিজের মাঝে মিশিয়ে দেয়। হালকা মাথা দুলিয়ে হাঁটতে শুরু করে। সেই সঙ্গে পিছু পিছু হাঁটে ঐশানী।
অনেকক্ষণ হলো বাড়ির উঠানে বসে নিজের ছেলে, বউমা, নাতি-নাতনি এবং নাতবউয়ের অপেক্ষা করছেন আয়েশা বেগম। গায়ে সাদা ধবধবে শাড়ি পড়ে গোসল করে দ্রুত এসে উঠানে বসেছেন উনি। কতবছর পর নিজের ছেলেকে আর তার পরিবারকে দেখবেন উনি ভাবা যায়? উনার মনে কাজ করছে চাপা উত্তেজনা। অপেক্ষার অবসান অবশেষে ঘটে। রাহাত সাহেবের ‘আম্মা’ ডাকটি শুনেই উনি চিনে ফেলেন। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান তৎক্ষনাৎ। পা ধীরে ধীরে চালিয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই ছেলে আর বউমার দেখা পান উনি। মুখে ফুটে ওঠে উল্লাসের হাসি।
–“আসসালামু আলাইকুম আম্মা, কেমন আছেন?”
এসেই হাসিমুখে কথাগুলো বললেন মিসেস. তনয়া। আয়েশা বেগমের হাসিটা আরো প্রসারিত হলো। সালামটি নিয়ে উনি বলেন…..
–“ভালা কেমনে থাকুম? তোমরা তো বুড়ি রে ভুইলা গেছো। আমার কথা আর কি মনে পড়ে?”
–“আরে আম্মা, জানোই তো বিদেশে ছিলাম। তোর নাতনির পড়ালেখা কমপ্লিট না হলে কিভাবে আসতাম!”
–“হইছে। তোমাগো আর বাহানা দিতে হইব না।”
মুখ বেঁকিয়ে বলেন আয়েশা বেগম। অনিন্দিতার আগমন হলে আরো কিছু কথাবার্তা বলে খোঁজখবর নিয়ে উনি দেখতে চান ঐশানী আর অভয়কে। আশেপাশে তাকিয়ে আগ্রহের সঙ্গে বলেন….
–“কই কই? আমার নাতি আর নাতবউ কই?”
–“ওইযে হেঁটে আসছে তোমার গুনধর নাতি আর নাতবউ।”
আয়েশা বেগম পেছনে বড্ড কৌতুহল নিয়ে তাকান। দূর থেকে দুজনকে হেঁটে আসতে দেখেন। সেখান থেকেই চোখজোড়া জুড়ান। কিটকিটিয়ে হেসে বলেন…..
–“নাতবউ ভালোই বেছেছিস রাহাত। আমার সুন্দর নাতির সাথে সুন্দরী নাতনি। ঐশানী রে তো আমার প্রথমেই পছন্দ ছিল নাতবউ বানানোর লাইগা। অবশেষে আমার সাধ পূর্ণ হলো।”
সবাই হাসেন উনার কথা শুনে। বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন ইশানের মা-বাবা, মিসেস. রজনী এবং আজিম সাহেব। সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষে বাড়িতে ঢোকে ওরা।
বাড়িতে খুশির আমেজ। বাড়িটা খুব একটা বড় নয় তবে বেশ সুন্দর। গ্রামের বাড়িগুলো দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। বাড়ির পেছনে জঙ্গল, পাশেই উঁচু জমিতে চা-বাগান। একতলা বাড়ি আর বাড়ির উঠান দিয়ে চিকন সিঁড়ি দিয়ে ছাঁদে ওঠার রাস্তা। মেয়েরা সকলে গল্পের মেতেছে। আর ছেলেরা অন্যদিকে। এতোকিছুর মাঝে অভয়কে না দেখতে পেয়ে অনিন্দিতার চোখ তার ভাইকে খুঁজতে থাকে। মায়ের থেকে জানতে পারে অভয় ছাঁদে উঠেছে। তা জেনে অনিন্দিতাও ছাঁদে ওঠে।
ছাঁদে উঠতেই কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা অভয়কে চোখে পড়ে অনিন্দিতার। কিনারায় কোনো পাঁচিল দেওয়া নেই। ভীতিকর সুরে চিল্লিয়ে অনিন্দিতা বলে….
–“এই ভাইয়া একটু সরে আয় পড়ে যাবি তো।”
অভয়ের ভাবান্তর হয় না। শুধু একবার তাকিয়ে আবারও বুকের হাত জড়িয়ে একদৃষ্টিতে আশপাশটা দেখতে থাকে। অনিন্দিতা এগিয়ে আসে। অভয়ের কিছু হয়েছে সে বেশ আন্দাজ করতে পারছে।
–“কি হয়েছে তোর?”
–“বড্ড খারাপ লাগছে। যতবার ঐশানীর কাছে যেতে চাইছি ঐশানী নিজ দায়িত্বে আমার মনকে বিষাদে ভরিয়ে তুলছে। এমনটা কেন হচ্ছে অনি? তুই তো বলেছিলি যত তাড়াতাড়ি নিজের মনের কথা স্বীকার করব ততই তাড়াতাড়ি আমার মাঝে যা দূরত্ব সব মিটে যাবে!”
অনিন্দিতা বেশ মনোযোগ দিয়ে অভয়ের বলা কথাগুলো শোনে। তার কথা শেষ হলে অনিন্দিতা বলার আরম্ভ করে…..
–“এমনটা হওয়া কি অস্বাভাবিক? তুই একটা মেয়েকে বারবার বলে আসছিস যে তুই অন্য কাউকে ভালোবাসিস। কিন্তু হঠাৎ করেই যদি তুই বলে বসিস তুই তাকেই ভালোবাসিস সে কি এতো দ্রুত বিশ্বাস করবে? বিষয়টা এক্সেপ্ট করা একটা মেয়ের জন্য ততটাই কঠিন। ওকে সময় দে। ওকে বুঝতে দে। তুই বেশি করে নিজের মনের কথা ওর কাছে প্রকাশ কর। আস্তে আস্তে ও তোকে বুঝবে। আরো যদি নিজের ভালোবাসার কথা বুঝতে দেরি করতিস তাহলে বিষয়টা আরো জটিল হয়ে দাঁড়াতো।”
–“না অনিন্দিতা। আমার মনে হয় ঐশানী আমার থেকে বারবার কিছু লুকায়। ওকে যতটা সরল অংকের মতো মনে হয় ও ততটাই জটিল অংক। ও অদ্ভুত। আমি ওর সঙ্গে একই ঘরে থাকি আমি সেটা বুঝতে পারি। যেন ও নিজের কোনো অস্তিত্ব লুকিয়ে ফেলতে চাইছে।”
অনিন্দিতা এবার নিজেও বিপাকে পড়ে যায়। ঐশানী আবার কি লুকাবে? খুব ভেবেচিন্তে বলল….
–“একারণেই তো তোকে বেশি করে ওকে জানতে হবে, চিনতে হবে, ওর সাথে মিশতে হবে। তাহলেই ও তোর কাছে পানির মতো সহজ হবে।”
দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে নিজেকে হালকা করে নেয় অভয়। মুখে মুচকি হাসির রেশ ফুটিয়ে অনিন্দিতার দিকে ঘুরে বলে……
–“অনেক তো জানলাম। অনেক বুঝলাম। শুধু এখন আমায় এটা বল যে ভালোবাসা সম্পর্কে তুই এতো কিছু জানলি কি করে? এতোটা ভালোবাসা সম্পর্কিত ধারণা কবে হলো তোর?”
অভয়ের হুট করে করা প্রশ্নে ভড়কে তাকায় অনিন্দিতা। নিমিষেই নামিয়ে ফেলে তার দুটো চোখ। লজ্জায় গুটিয়ে যায় সে। তার লজ্জা দেখে চোখ সরু হয়ে আসে অভয়ের। অনিন্দিতার কাঁধে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে…..
–“তোর লাল হওয়া গাল আর নামিয়ে নেওয়া চোখ কিন্তু অনেক কিছু বলে দিচ্ছে। কি সেই ভাগ্যবান ব্যক্তি?”
–“ইয়ে মানে ভাইয়া এখন কিছু জানতে চাইবে না প্লিজ। সময় হলে আমি নিজে বলব!”
অভয় আর জোর করে না। সে জানে তার বোন নিজেকে বোঝে। সময় অনুযায়ী ঠিকই তাকে জানাবে।
–“ঠিক আছে। সময় হলেই বলিস। জোর করছি না।”
অনিন্দিতা লজ্জামাখা হাসি দিয়ে নিচে নেমে যায়।
বিকেলের সময়। সকলে উঠানে বসেছে গল্প করতে। এতোদিন পর সবার দেখা পেয়েছেন আয়েশা বেগম। বয়ষ্ক মানুষ বলে কি গল্প জমে থাকবে না? নানানরকম কথাবার্তায় জমিয়ে তুলেছেন গল্পের আসর। শুধু ঐশানীই নেই সেই আসরে। দুপুরে খাবার খাওয়ার পর ঘুমিয়েছিল মেয়েটা। জার্নি করে অতিরিক্ত ক্লান্ত থাকায় এখনো তার ঘুম ভাঙনি। অভয়ও জাগিয়ে দেয়নি তাকে। কিছুক্ষণ পর গ্রাম ঘুরতে বের হবে তারা। তখন না হয় ঐশানীকে জাগিয়ে দেওয়া যাবে। উঠোনের বেশ কিছু দূরে মেইন দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হয়। মেয়েলি কন্ঠে ভেসে আসে।
–“বাড়িতে কেউ আছেন?”
আয়েশা বেগম জোরে জবাব দেন…..
–“কে?”
ভেতরে ঢুকে পড়েন একজন বয়স্ক মহিলা। খুব বেশিও বয়স না। আয়েশা বেগমের তুলনায় কম। আয়েশা বেগম উনাকে এক দৃষ্টিতেই চিনে যান।
–“আরে হালিমা তুমি? আসো আসো। এতোদিন পর আমার বাড়ির দরজায় কি মনে করে?”
–“বাড়িতে নতুন কিছু অতিথি দেখলাম তাই ভাবলাম পরিচয় হয়ে আসি।”
অভয়কে বেশ চেনা চেনা লাগে মহিলাটিকে। কিছুটা মনোযোগ দিয়ে দেখবার পরেই চিনে যায় মহিলাটিকে। এই মহিলাই তো ঐশানীর পথ আঁটকে কথা বলছিল।
–“আরে নতুন অতিথি না সব আমার পরিবারেরই সদস্য। অনেক বছর পর বিদেশ থেইকা ফিরল।”
হালিমা হেসে ভেতরে আসেন। সবার সাথে চেয়ারে বসেন। বেশ কথা হয় সবার মাঝে। কিন্তু হালিমা যেন খুঁজছেন অন্য কাউকে। সেটা খেয়াল করে অভয়। কথার মাঝে হুট করেই হালিমা বলেন…..
–“আমার একটা ছেলে আছে বুঝলেন আপা? বিয়ের উপযুক্ত! ভালো চাকরি করে। ভাবছি দেখেশুনে বিয়ে দেব।” (তার ছেলের ছবি দেখিয়ে)
মিসেস. তনয়া সঙ্গে সঙ্গে অনিন্দিতার দিকে তাকান। মেয়েটার বয়স তো কম হয়নি। তাকেও বোধহয় বিদায় দেওয়া সময় এসেছে।
–“বেশ ভালো কথা তো। দেখুন মেয়ে।”
–“আসলে বলছিলাম আপনাদের বাড়ির দিকে আসতেই একটা মেয়েকে দেখেছিলাম। ওই মেয়েটাকে এক দেখাতে আমার পছন্দ হয়। ও এদিকেই আসছিল।”
সবাই মনে করে হালিমা হয়ত অনিন্দিতার কথা বলছে। অভয় অনিন্দিতাকে দেখিয়ে দিয়ে বলে…..
–“অনির কথা বলছেন?”
–“আরে না না। আরেকটা মেয়ে। একটু খাটো করে কি যেন নাম তার! মনে পড়ছে না।”
সবাই কনফিউজড হয়ে পড়ে। হালিমা আবার কোন মেয়ের কথা বলছেন? সেই সময় ঐশানীকে উঠানে আসতে দেখতে পান হালিমা। তার দিকে তাক করে বলেন…..
–“ওইযে মেয়েটা। ঐশানী নাম। এই মেয়ে এদিকে শুনো।”
ঘুম থেকে আড়মোড়া ভেঙে সবে চোখমুখে পানি দিয়ে উঠানের দিকে আসছিল ঐশানী। এমন সময় সেই মহিলাকে আবার দেখে ভ্রু কুঁচকে যায় তার। তবুও ভদ্র ভাবে গায়ের ওড়না ঠিক করে এগিয়ে আসে। সবাই ঐশানীর দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। শেষমেশ বিষয়টা এমন দাঁড়াল যে শ্বশুড়বাড়িতেই বাড়ির বউয়ের দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তাব?
সবার চোখ কপালে। অভয় তো আকাশ থেকে পড়েছে? নিজের বউকে বিবাহিত রুপটি না দিতে পেরে বড়ই আফসোস হচ্ছে তার। অন্যদিকে ঐশানী এসবের কিছুই জানে না। সে শুধু ভাবছে সবাই তার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? সিরিয়ালের নায়িকার মতো তার চেহারা কি নিমিষেই পাল্টে গেল নাকি? চেক করার জন্য নিজের গাল-মুখে হাত দিল সে। মনে তো হচ্ছে সব ঠিকঠাকই আছে।
অভয়ের পাশে বসে ছিল ইশান। সে দাঁত বের করে হাসছে। হালিমা তার হাসির কারণ বুঝতে পারছেন না। বলা বাহুল্য বুঝতেও চাইছেন না। কারণ ছোট থেকেই ইশান বড্ড ফাজিল। আগুনে ঘি ঢালাতে অভয়ের কানের কাছে এগিয়ে যায় সে। গলা খাঁকারি দিয়ে ফিসফিস করে বলে….
–“অভয়! তোর বউকে নিজের করে রাখতে পারলি না রে। তোর তো নিমপাতা খেয়ে মরে যাওয়া উচিত। এখন ভেবে নে তোর বউকে দ্বিতীয় বিয়ে দিবি কবে? জাঁকজমক ভাবে দিবি নাকি নরমালি? বিয়েতে কিন্তু আমার স্পেশাল কাচ্চিবিরিয়ানি চাই।”
ক্রোধের সাথে সাপের মতো ফোঁসফোঁস করে তাকায় অভয়। ইচ্ছে তো করছে ঐশানীকে কয়েকটা ঠাটিয়ে থাপ্পড় মেরে গাল লাল করতে। ইশানকে হালকা ধাক্কা মেরে বলে…..
–“কাচ্চিবিরিয়ানি দিয়ে তোকে এমনভাবে চেপে দেব নিশ্বাস না নেওয়ার অভাবে মৃত্যু হবে তোর। সরে যা। রাগ বাড়াস না।”
হালিমা সবার রিয়েকশন দেখে কিছুই বুঝলেন না।
–“আপনারা সবাই এমনভাবে তাকালেন কেন? আমার তো এই মেয়েটাকে পছন্দ হয়েছে। কি মিষ্টি দেখতে। এমন ছেলের বউ চেয়েছিলাম আমি।”
কথাটা শোনামাত্র কাশি উঠে যায় ঐশানীর। তার মনটা বলতে থাকে….
–“তাহলে এই ছিল এই মহিলার মনে? কি লজ্জা! কি লজ্জা!”
নিজের বিস্ময় ভেঙে রাহাত সাহেব হাসার চেষ্টা করে বলেন….
–“কি বলছেন আপনি? ও তো বিবাহিত! আমার ছেলের বউ। এখন ওকে দ্বিতীয় বিয়ে দিই কি করে?”
হালিমা বড্ড চমকে উঠলেন। ঐশানীর দিকে এক পলক তাকিয়ে বললেন…..
–“দেখে তো মনে হয় না। শাড়ি পরেনি, নাকে ফুল নেই। কিভাবে বুঝব বিবাহিত নাকি অবিবাহিত? আর যখন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এই বাড়ির কে হও তখন ও উত্তর দিয়েছিল অতিথি হয়। এতে আমার দোষ কোথায়?”
অভয় আর চুপ থাকতে পারলো না। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। হাসি দিল। সেই হাসিতেও রাগ। নিজের রাগকে দমানোর চেষ্টা করে বলল….
–“তাই বলে এভাবে দুম করে বিয়ের প্রস্তাব আনা কি ঠিক হয়েছে? আরে আমরা স্বামী-স্ত্রী। আমাদের মনমালিন্য চলছিল। তাই হয়ত ঐশানী কয়েকদিনের অতিথি বলে ফেলেছে তাই না ঐশানী? আর তোমার নাকের ফুল কোথায়?”
ক্রুদ্ধ নয়নে তাকিয়ে প্রশ্ন করে অভয়। ঐশানীর চোখ তো বেরিয়ে আসার উপক্রম! কবেই বা ওদের মনমালিন্য হলো? আর এসব হচ্ছেই বা কি? তবুও মিনমিন করে উত্তর দিল…..
–“আসলে বাসে আসতে নাক ফুল খুলে পড়েছিল। ওটা আমি ধরে ফেলেছিলাম। তাই সেটা ব্যাগে রেখে দিই। আর পড়া হয়নি নাকে।”
–“তাহলে চলো আমি আজকে তোমায় নাক ফুলটা পড়িয়ে দিই?”
কথাগুলোতে অতিরিক্ত রাগ নিয়েই বলল অভয়। ঐশানীর হাতটা ধরে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গেল।
চলবে…..
#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৩
দরজায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অভয়। রাগে ভর্তি চোখজোড়া তার ঐশানীর দিকে স্থির। আয়নার সামনে হাতে ছোট নাক ফুল নিয়ে বেজায় বিপাকে পড়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐশানী। অভয়ের দৃষ্টির দিকে তাকানোর সাহসটা হচ্ছে না ওর। এরই মাঝে রাগে চিবিয়ে চিবিয়ে অভয় বলে……
–“কি অবিবাহিত দের মতো থাকতেই ভালো লাগছে? নাকে নোসপিন দিতে ইচ্ছে করছে না? ওহ ইয়েস, এভাবে থাকলে তো সবাই তোমায় অবিবাহিত ভাববে আর আবারও তোমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসবে!”
ঐশানী হালকা ভয় পেলেও তা প্রকাশ করে না। অবশ্যই সে অন্তত সাহসী মেয়ে। শ্যামলা ঘোড়ার ধমকানিতে দমে যাবে না সে কিছুতেই। ঠোঁট বাঁকিয়ে কাঁপতে কাঁপতে নাকের কাছে নোসপিন ধরল সে।
ঐশানী নাক ফুরিয়েছে বেশিদিন হয়নি। বিয়ের আগে নাক ফুরিয়ে দেওয়া হয়েছে তার। নোসপিন পড়তে হবে বলে। তাই সে নাকে নোসপিন দিতে সাহস পাচ্ছে না। বিয়ের দিন নাকে নোসপিন দিতে প্রচন্ড ব্যাথা পেয়েছিল। এবারও যদি তাই হয়?
এসব আকাশ-পাতাল চিন্তাভাবনা করতে করতে ঐশানীর কোনো হেলদোল না দেখে অভয় দূরন্ত গতিতে এগিয়ে আসে। ওর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। রাগের আগুনে সবটা জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কেন ওর স্ত্রীকে ওরই সামনে আরেকটা বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হবে? হয়ত ভুলটা ওর নিজেরই! সেই ভেবে আরো রাগ হয় তার। হুট করেই ঐশানীর নোসপিনটা ছিনিয়ে নিজের হাতে নিয়ে নেয় সে।
হঠাৎ এভাবে নিজের হাত থেকে নোসপিন নিয়ে নেওয়ায় চমকে ওঠে ঐশানী। পেছন ঘুরে তাকায় সে। অভয়কে নিজের এতোটা কাছে দেখে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে ঐশানীর। ঢক গিলতে চেয়েও বড্ড কঠিন হয়ে গেল তার কাছে। কি সেই হাড়কাঁপানো অনুভূতি!! অভয় আরেকটু কাছে যেতে চাই ঐশানীর। একটা হাসি দেয় সে। এই হাসিটা মোটেও সুবিধার নয়। আর একধাপ এগোতেই তার থেকে বাঁচতে ড্রেসিংটেবিলে বসে পড়ে ঐশানী। ড্রেসিংটেবিলটা বেশ আগের। যার কারণে বেশ নিচু। ঐশানী মাথা তুলে একভাবে তাকিয়ে থাকে। ঢক গিলে বলে…..
–“একটু সরে যান। আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।”
–“মানুষকে তো জড়িয়ে ধরলেও নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয় না। আর তোমার এতোটুকুতেই এই অবস্থা? আরো কাছে গেলে তো তোমার দম আঁটকে যাবে। সেই দায়ে কি আমায় জেল খাটতে হবে?”
বলেই আয়নায় দুটো হাত রেখে একটু নিচু হয় অভয়। ঐশানী দুটো চোখ এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। এটা যে কেমন অশান্তি সেটা বোঝাবার উপায় তার নেই। চোখমুখটা কুঁচকে জোরে বলার চেষ্টা করে…..
–“একটু সরুন না! আমার দম আঁটকে যাবে।”
–“নো ওয়ে। আমি তো সরছি না। পারলে সরে দেখাও।”
ঐশানী তো নড়তেই পারছে না অস্বস্তিতে। অভয়কে সরানো তো দূরেট কথা। ড্রেসিংটেবিল খামচে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা তার। মুখটা নিচু করে রেখে কিছু একটা বিড়বিড় করছে। অভয় বাম হাতে ঐশানীর থুঁতনি ধরে উঁচু করার চেষ্টা করে। ঐশানী উঁচু হতেই সরাসরি ডান হাতে থাকা সাদা পাথরের নোসপিন তার নাকে পরিয়ে দিতেই ব্যাথায় মৃদু চিৎকার দিয়ে ওঠে ঐশানী। অভয় ভ্রু কুঁচকে বলে…..
–“কি হয়েছে নাকে ব্যাথা পেয়েছো?”
ঐশানী কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে মাথা দুলায়। অতঃপরই ঝাঁঝালো গলায় উত্তর দেয়…..
–“আপনি আস্ত একটা হার্টলেস পারসন! হার্ট বলতে আদোও কিছু আছে? ইশশ….কিভাবে নাকে নোসপিন পড়িয়ে দিলেন?”
–“যদি এই হার্টলেস হওয়ার বাহানায় তোমার একটু কাছে আসতে পারি তাহলে এই হার্টলেস হতে আমি রাজি আছি।”
ঐশানীর বলা কথার উত্তরে এমন কিছু আশা করেনি। অভয়ের দিকে তাকাতেই তার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। অভয়ের এমন শীতল চাহনির স্বীকার আগে কখনো হয়নি সে। আর এমন মোহময় কন্ঠে এমন কথা যেন ঐশানীকে লজ্জায় মিইয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
–“এখনো নাকে ব্যাথা করছে?”
ঐশানী নিজের ধাতস্থ করে ছোট্ট করে ‘হু’ জবাব দেয়। ঠিক সেই মূহুর্তেই অভয় নিজের ঠোঁটজোড়া এগিয়ে নিয়ে গিয়ে ঐশানীর নাকের কাছে যায়। নাকের ডগায় ঠোঁটজোড়া স্পর্শ করে সেই কাজটা করেই বসে। হালকা শব্দ করে চুমু খেয়ে সরে আসে সে। এসব অভয়ও নিজের অজান্তে করেছে। সে যেন সম্মোহিত করে পড়েছিল। তবে ও যা করেছে এতে ওর কোনো আফসোস নেই। আফটার ওল ওর নিজের বউ ঐশানী। এই প্রথম অভয় স্বইচ্ছায় ঐশানীকে স্পর্শ করল, ভালোবাসার পরশ একে দিল। অনুভূতিটা যেন সত্যিই অন্যরকম!
অন্যদিকে ঐশানীর সর্বাঙ্গে কাঁপুনি ধরেছে। কয়েক সেকেন্ড আগের ঘটে যাওয়া ঘটনা তার চোখে ভাসছে। মূর্তির মতো হতভম্ব হয়ে বসে থাকল সে। ঠোঁটজোড়া আলাদা হয়ে হা হয়ে এলো। অভয় তা লক্ষ্য করে ঠোঁট কামড়ে হাসতে শুরু করে। ঐশানীর দিকে একটু হেলে শান্ত সুরে বলে…..
–“সামান্য একটা কিস এ যদি এমন অবস্থা হয় তবে আরেকটা কিস দিলে কি হবে?”
নড়েচড়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো ঐশানী। নিজের নাকের ডগা হালকা ঘষে মাথা ঝাঁকিয়ে তাকালো সে।
–“আ….আপনি আপনি একটা বিরক্তিকর লোক। বাইরে যান।”
নিজের লজ্জা ঢাকতে চিল্লিয়ে বলল ঐশানী। অভয় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের টাওজারের পকেটে হাত গুঁজে দিয়ে বলল….
–“হুমম যাব। আগে তুমি শাড়ি পড়বে তারপর। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি শাড়ি পড়োনি কেন? তোমাকে দেখতে একারণেই অবিবাহিত লাগছিল।”
–“তো আপনার মতো বুড়ো সাজাতে চান আমায়?”
বেশ ধীরে কথাগুলো বললেও অভয়ের কানে সেসব কথা স্পষ্ট হয়ে গেল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল….
–“হোয়াট ডিড ইউ সে?”
–“আপনার বয়স কত? ২৯ নাকি ৩০? যাই হোক। আমার বয়স সবে ২২ বুঝলেন? তাই আমাকে অবিবাহিত লাগায় স্বাভাবিক। আর আম্মু বলেছিল এই গরমে শাড়ি পড়তে হবে না। তার ওপর এখানে কারেন্টের ঠিকঠিকানা নেই। তাই পড়িনি।”
–“এতো রচনা আমি শুনতে চাইনি। শাড়ি পড়ে নাও।”
–“এই গরমে পড়ব না। আম্মু বারণ করেছে।”
অভয়ের মেজাজ টা খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটা বড্ড বাঁকা স্বভাবের। যা বলা হয় ঠিক তার উল্টোটা করতে লেগে পড়বে। শুধু লেগে নয় উঠেপড়ে লেগে পড়বে।
বিগড়ানো মেজাজ নিয়ে সে বলে…..
–“দেখো ভালোই ভালোই বলছি শাড়িটা পড়ে নাও। নয়ত….”
–“নয়ত কি?” (ভ্রু কুঁচকে)
–“নয়ত……”
ঐশানী চোখ সরু করে এগিয়ে আসে। হাত দিয়ে অভয়কে হালকা ধাক্কা দিতে দিতে বলে….
–“নয়ত কি বলুন বলুন?”
–“নয়ত আমি শাড়ি পড়িয়ে দিতে বাধ্য হবো। নিশ্চয় আমার হাতে শাড়ি পড়তে তোমার ভালো লাগবে না!”
ঐশানী দাঁত বের করে হাসতে থাকে। অভয় তার হাসিতে কনফিউজড হয়ে যায়। অভয় যা বলেছে এতে ঐশানীর লজ্জায় লাল টমেটো হবার কথা ছিল। কিন্তু হয়নি। মেয়েটার আবার কি মতলব?
ভাবতে ভাবতেই তার মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিল ঐশানী। অভয় হকচকিয়ে তাকালো! তবে এই ছিল এই মেয়ের মনে? ওকে ধাক্কা দিতে দিতে একেবারে বাইরে এনে দরজা লাগিয়ে দিল? চোয়াল শক্ত করে হাত মুঠো করে দরজায় থাবা দিল অভয়।
–“এই মেয়ে, আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করার সাহস কোথা থেকে পেলে তুমি? তোমার সাহসিকতা দেখে আমি অবাক হচ্ছি। দরজা খোলো।”
–“কস্মিনকালেও খুলছি না দরজা। কত শখ! আমাকে শাড়ি পড়িয়ে দেবে! স্বপ্নের মাঝে পড়িয়ে দিয়েন। তবুও স্বপ্নে ফাঁকি দেব।”
অভয় দরজা ধাক্কা দিলেও ঐশানীর কন্ঠ আর শুনতে পায় না।
রাত প্রায় দশটা। গ্রামের পরিবেশ। সকলে দ্রুতই খেয়ে শুয়ে পড়ে। এখানেও তার ব্যতিক্রম না। সকলের খাওয়া হয়েছে অনেকক্ষণ। অভয় ইশানের সাথে বাইরে টুকটাক কথা বলে সবে ঘরে ঢুকল। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে তার ফোন বাজতে থাকে। ফোনটা বের করে কল কেটে দেয় অভয়। কারণ সায়রা কল করছে। ওর জন্য তো ফোন বন্ধ রাখা সম্ভব না। কিন্তু যতবার কল কেটে দিয়ে চলেছে ততবারই কল করে চলেছে সায়রা।
–“সরি সায়রা। একসময় তোমার নম্বর আমার কললিস্টের সবার আগে থাকত। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। মায়া কেটে গেছে। কিন্তু আমি তোমার ফিলিংস কে অসম্মান করি না। কারণ তুমিও ভালোবাসায় তড়পাচ্ছ আর আমিও তাই। কিন্তু তোমার সাথে পড়ে কথা বলব আমি।”
নিজের আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে আসে অভয়। ঐশানী ঘরে চলে এসেছিল বিছানা ঠিকঠাক করতে। দরজা হালকা করে লাগিয়ে রাখায় কোনোরকম শব্দ না করেই ঘরে ঢুকে পড়ল সে। রুমে ঢুকতেই আবারও ফোনটা বেজে উঠল। অভয় সেদিকে খেয়াল না করে ঐশানীর দিকে তাকালো। ঐশানী কীসের যেন ঔষুধ খেতে দেখে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে অভয়ের। অভয়ের ফোনের রিংটোনে আঁতকে তাকায় ঐশানী। অভয় বাধ্য হয়ে নম্বর ব্লক করে তাকালো। দ্রুত নিজের হাতে থাকা ট্যাবলেটের প্যাকেট হাতের মুঠোয় লুকিয়ে ফেলে।
–“আপনি রুমে নক করে আসতে পারেন না নাকি?”
–“তোমার হাতে কীসের ট্যাবলেট ঐশানী? আর ইউ ওকে? কি এমন হয়েছে যে তুমি ঔষুধ খাচ্ছো তাও লুকিয়ে?”
অন্তত থমথমে গলায় প্রশ্ন করে বসল অভয়। তা শুনে ভড়কে যায় ঐশানী। চোখের ভেতরের কালো মনি এদিক ওদিক লাফিয়ে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকে। তা বুঝতে পেরে অভয় আবারও বলে….
–“আমার সাথে কোনো মিথ্যা নয়। আমি মিথ্যে সহ্য করতে পারি না। কি হয়েছে তোমার? আমাকে বললে আমি তো সলভ করতে পারি!”
–“অতিরিক্ত জার্নি করলে আমার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। সেকারণে ডক্টরের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে আমি ক্যালসিয়াম ভিটামিন ঔষুধ খাই। এতটুকুই!”
অভয়ের ঐশানীর কথা পুরোপুরি বিশ্বাস হলো না। অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে থাকল সে। গম্ভীর কন্ঠে বলল….
–“রিয়েলি?”
–“হ্যাঁ। এই সমস্যা আমার ছোট থেকেই। সত্যি বলছি।”
অভয়ের ভাবান্তর হলো না। সে একইরকম ভাবে তাকিয়ে থাকল। ঐশানী বিষয়টা এড়াতে বালিশ নিয়ে ঠিকঠাক করতে লাগল। কাঠকাঠ গলায় বলল….
–“তাছাড়াও আমি আপনাকে কেন মিথ্যে বলব? আমার ঘুম পেয়েছে আমি ঘুমাবো।”
অভয় দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলে……
–“হুমম ঘুমাও।”
ঐশানী বাঁকা চোখে তাকিয়ে বিছানার সাইডে বসে পড়ে। তবে সমস্যাটা হলো এই খাট টা বেশ ছোট। দুজনকে গায়ে গা লাগিয়ে ঘুমোতে হবে। নয়ত ঘুমের মাঝেই কপোকাত! সেটাই দেখছে ঐশানী। ঠোঁট উল্টিয়ে ভাবছে কি করা যায়? কিন্তু অভয় ওসব ভাবনাচিন্তা না করেই সটান হয়ে শুয়ে পড়ে অপরপ্রান্তে। ঐশানী ঠাঁই বসে থাকে। চোখ বুঁজে থাকা অবস্থায় বলে….
–“শুয়ে পড়ো। গায়ে গা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। আর এমনও না আমি তোমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব।”
অভয়ের লাগামহীন কথা শুনে ভেংচি কেটে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ে ঐশানী। অভয়ের নিশ্বাস তার পিঠে পড়ছে। তাই একটু একটু করে সরে যাচ্ছে সে।
–“পড়ে কোমড় না ভাঙতে চাইলে এদিকে এগিয়ে এসে শুয়ে পড়ো।”
–“আপনি একটু অন্যপাশ ফিরে ঘুমান না!”
–“পারলাম না। আমি তো আরো তোমার হাত ধরে ঘুমাবো। পড়ে গেলে তো দোষ টা আমারই হবে কি না।”
বলেই হাতের ওপর হাত রেখে শক্ত করে চেপে ধরে চুপ হয়ে যায় অভয়। ঐশানী ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও পারে না। অনেকক্ষণ ডাগরডাগর চোখজোড়া নিয়ে চেয়ে থাকে ওপরের দিকে। তার মাঝে অনুভূতির স্রোতধারা বইছে। মনে মনে সে বলে…..
–“হার্টবিট টা যে কেন শ্যামলা ঘোড়ার মতোই দৌড়াচ্ছে। উফফ…..!”
ঐশানী ঘুমিয়েছে। অভয় তা দেখে উঠে পড়ে আস্তে করে। আশেপাশে খুঁজতে থাকে ঐশানীর সেই ঔষুধগুলো। মোটামুটি দুই তিনটা ঔষুধের পাতা ছিল ঐশানীর হাতে। ঐশানীর কথা মোটেও বিশ্বাস হয়নি অভয়ের। যদি ঐশানীর কথা ঠিক হতো সে এতোটা লুকোচুরি করত না সামান্য বিষয় না। তারওপর সেদিন ও হসপিটালের ফাইল দেখতে গেলেও ঐশানীর অদ্ভুত ব্যবহারের সম্মুখীন হয়েছে। তার চিন্তা হয়। ভয় হয় ঐশানীকে হারিয়ে ফেলার। ভালোবাসা হয়ত এমনই হয়। যার নাম কিনা অভয় সে নিজের ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। খুঁজে না পেয়ে খাটে বসে ঐশানীর দিকে তাকায় সে। তারপর মনে করে, ঐশানী ঔষুধগুলো হাত থেকে কোথাও রাখেই নি। রাখলে সে টের পেতো। তার মানে কি ওর হাতেই আছে? নাহ হাতেও তো নেই।
হুট করেই শাড়ির আঁচলে দৃষ্টি যায় অভয়ের। ঐশানী শাড়ির আঁচলে কিছু একটা গিট্টু দিয়ে রেখেছে। ধীরে শাড়ির আঁচল খুলতেই ঔষুধ আবিষ্কার করে সে। হাতে নিয়ে নেয় সেসব। ঔষুধের নামগুলো দেখে নেয় সে। নামগুলো দেখে মনে হচ্ছে না এসব কোনো ভিটামিনের ঔষুধ হতে পারে। তবে এগুলো কীসের ঔষুধ? কেনই বা এসব ঔষুধ খায় ঐশানী? কি হয়েছে তার?
চলবে…..