বেলা শেষে শুধু তুমি পর্ব-২০+২১

0
408

#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২০

অফিসের কেবিনে কাঁচের টেবিলে হালকা ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে একমনপ কিছু ভেবে চলেছে অভয়। তার মনে কি চলছে সেটা সবারই অজানা। হয়ত তার নিজেরও। আর আজকে ও যা কান্ড করেছে তারপরে তো আরো ওকে চেনা কঠিন হয়ে যাবে। বিশেষ করে ঐশানীর কাছে। নিজের দুইভাগে বিভক্ত হওয়া থুঁতনির ওপর হালকা বড় বড় দাঁড়ি বুলাতে বুলাতে আনমনে বলে ওঠে…..
–“ঐশানী কি করছে এখন? ও কি বেশ অবাক হয়েছে? হওয়ারই কথা। একারণেই আমি অনিকে বললাম ঐশানীকে আর আমার মনের অনূভুতিকে সমান সময় দেওয়া উচিত। কিন্তু ও আমার মনে এমনই ভয় দেখালো যে না চাইতেই ঐশানীকে গড়গড় করে সব বলে ফেললাম।”

মুখ দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয় অভয়। রিমোট নিয়ে এসির পাওয়ার টা বাড়িয়ে দিয়ে পায়চারি করতে শুরু করে। নিজের মাথার চুলে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলে….
–“এখন আমার কি করা উচিত? আমি তো আজ ঐশানীর ওপর হাতও তুলে ফেলেছি। কি হয়েছে আমার? এতো অশান্ত কেন হচ্ছি? অভয়, তুই তো আগে এমন ছিলি না। কারোর প্রতি এতো রুড ভাবে রাগও প্রকাশ করতিস না। তোকে আবারও সেই গম্ভীর আর শান্ত অভয় হতে হবে।”
হাঁটা থামিয়ে আশেপাশে অশান্ত চাহনি নিয়ে আবারও বলে…..
–“এখন আমার কি করা উচিত? অবশ্যই ঐশানীর কাছে ক্ষমা চাওয়া আর ওর রাগ ভাঙানো। কিন্তু কি করে ভাঙাবো? ওর কি পছন্দ না পছন্দ তার ব্যাপারে তো আমি কিছুই জানি না।”

ঠোঁটে ঠোঁট কামড়ে বেশ কিছুক্ষণ ভাবতে ভাবতে হাতে ফোন তুলে নেয় সে। অনিন্দিতাকে মেসেজ করে বলে ঐশীর নম্বর নিতে। অনিন্দিতা ঐশীর নম্বর পাঠাতেই দ্রুত কল করে ঐশীর নম্বরে। নম্বর ওয়েটিংয়ে পেয়ে কেটে দেয় সে। আবারও কল লাগাতেই সাথে সাথে কল রিসিভড হয়।
–“আপনি কে মশাই? বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঠিকঠাক প্রেমালাপও করতে পারব না নাকি আপনার রং নম্বরের জন্য?”
ঐশীর এমন কথাবার্তা শুনে আগে হালকা কেশে নেয় অভয়। গম্ভীর কন্ঠে বলে…..
–“আমি তোমার অভয় ভাইয়া, ঐশী।”

বেশ কিছুক্ষণ ওপাশটা নিরব থাকে। হয়ত মেয়েটা ভয় পেয়েছে। অভয় নিরবতা দেখে নিজে থেকে বলে….
–“হ্যালো, ঐশী? শুনতে পাচ্ছো?”
–“হ্যাঁ ভাইয়া। সরি। কিছু মনে করবেন না ভাইয়া। আই এম সো সরি হ্যাঁ?”
–“আচ্ছা ওসব বাদ দাও। কেমন আছো?”
–“জ্বি ভালো। আপনি? হঠাৎ আমার নম্বরে কল করলেন। কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি আপুকে নিয়ে? হলেও কি করবেন বলুন। আফটার ওল ও আপনার বউ কিনা। আমি জানি ওর মাথায় একটুআধটু তার ছিঁড়া। মানবতার খাতিরে পাগলাগারদে পাঠানো হয়নি।” (দীর্ঘশ্বাস ফেলে)

অভয় ঐশীর কথায় হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারছে না। যেমন মেয়ে তার তেমন বোন। দুজনেরই বাড়তি কথা বলার স্বভাব রয়েছে। নিজেকে সামলে অভয় বলে…..
–“আসলে সেরকম কিছু না। একটা কথা জানার ছিল তোমার থেকে।”
–“হ্যাঁ বলুন না কি কথা?”
অভয় হালকা সঙ্কোচবোধ করে বলে…..
–“তোমার আপু কোন জিনিস সবথেকে বেশি পছন্দ করে? যেটা দেখলে তোমার আপু সব জরুরি কাজ ফেলে আসতে রাজি হবে? খুশিতে লুটিয়ে পড়বে?”
ঐশী ওপাশ থেকে অনেক ভেবে উত্তর পেয়ে লাফিয়ে বলে…..
–“হাওয়াই মিঠাই! ওটা দেখলে আপু যেখানেই থাকুক বা যেই প্রান্তেই থাকুক ছুটে আসবে।”

ঐশানীর পছন্দের কথা শুনে বড্ড হাসি পায় অভয়ের। হালকা করে হেসে বলে…..
–“হোয়াট? হাওয়াই মিঠাই?”
–“হুমম। আমি এটাই জানি। কিন্তু ভাইয়া কি হয়েছে বলুন তো? হঠাৎ আপুর পছন্দের কথা জানতে চাইছেন?”
–“না কিছু না। এখন রাখছি। এখন যত ইচ্ছে বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলো। তোমার এই ভাইয়া ডিস্টার্ব করবে না।”
বলে হেসে ফোন কেটে দেয় অভয়। সবে স্কুল পেরিয়ে কলেজে উঠেছে তাতেই প্রেম করা শুরু করেছে। সব ভাবনা বাদ দিয়ে নতুন ভাবনার উদয় হয় অভয়ের।
–“এখন এই হাওয়াই মিঠাই কোথায় পাবো?”

অভয়ের এই অনুভূতি, তার এই পরিবর্তন, তার ঐশানীর প্রতি ভাবভঙ্গি পাল্টে যাওয়া সবটার পেছনে একজন বিশেষ মানুষের হাত আছে। মানুষটা অভয়কে বুঝিয়েছে একরাতেই অভয়ের জীবনে ঐশানীর গুরুত্ব। তার জীবনে ঐশানীর স্থান কোথায় আর সায়রার স্থান কোথায়। সেসব কিছু অভয়কে একরাতেই বুঝিয়ে দিয়েছে অনিন্দিতা। হয়ত ও না থাকলে এসব বুঝতে ওর অনেকটা দেরি হয়ে যেতো। তখন হয়ত কিছু করা বা বলার মতো অবস্থা থাকতও না।

গতকাল রাতে……
ঘুম যেন অভয়ের চোখে ধরা দিতে চাইছে না। একবার এপাশ আর একবার ওপাশ ফিরছে বার বার। আবারও ঐশানীর দিকে ঘুরে স্থির হয়ে শুয়ে থাকল অভয়। ঐশানী ওপাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে। ওর পিঠ টা শুধু চোখে পড়ছে অভয়ের। আর মাথার এক গোছা এলোমেলো চুল! মেয়েটা ঘুমের মাঝেও এপাশ ফিরে তাকায় না। এটা ভেবে বেশ রাগ হয় অভয়ের। সে কি এতোই খারাপ দেখতে যে ও এপাশ ফিরেও ঘুমাতে চায় না? মাথায় আরো নানানরকম কথা ভাসতে থাকে অভয়ের। যেমন, বিকেল বেলা ঐশানীর বলা কথা। আবার একটু আগে বলা কথাগুলো। ঐশানী কি সত্যি অন্যকাউকে পেলে বিয়ে করে নেবে?

ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে সে। মাথার চুল দুহাত দিয়ে পাগলের মতো আউলিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলে…..
–“কেন করবে না ও বিয়ে? অবশ্যই করবে। তুই যদি সায়রাকে বিয়ে করতে চাস তাহলে ও কেন করতে পারবে না? কিন্তু তোর কি হবে অভয়? পাশে এই চঞ্চল মেয়েটির বদলে তখন সায়রা ঘুমাবে। তখন?”
অভয় এক মূহুর্তের জন্য ঐশানীর বদলে সায়রাকে নিজের পাশে কল্পনা করতেই অস্বস্তি হতে শুরু করে তার। ঘামতে থাকে দরদর করে। এসব আকাশকুসুম ভাবতে ভাবতে একসময় ঠিকঠাক নিঃশ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে যায় ওর। খোলা হাওয়ার বড্ড অভাব এখানে। আর এখন ছাঁদ ছাড়া খোলা হাওয়া পাওয়া দুষ্কর। বেড থেকে নেমে একবার ঐশানীর দিকে তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে ছাঁদের দিকে যায় সে।

ছাঁদে সোনালী চাঁদ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে অভয়। চাঁদেও অসংখ্য দাগ দেখতে পায় সে। একেই বোধহয় কলঙ্ক বলে! মাথা ঝাঁকিয়ে বলে…..
–“আমার কি করা উচিত? এমন হচ্ছে কেন? কে বলে দেবে আমায় আমার কি করা উচিত?”
–“তুই কি ঐশানী ভাবির ব্যাপারে ভাবছিস ভাইয়া?”
এই অসময় অনিন্দিতার গলা চিনে চমকে পেছনে তাকায় অভয়। চাঁদের আবছা আলোয় অনিন্দিতার গোলগাল মুখটা চিনতে ভুল হয় না অভয়ের। অনিন্দিতার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে পাল্টা প্রশ্ন করে….
–“তুই এতো রাতে এখানে?”

–“এই একই প্রশ্ন আমি তোকেও করতে পারি ভাইয়া। আমি তো তোর পিছুপিছু এসেছি। আমি এসাইনমেন্ট করছিলাম। করা শেষে পানি খেতে রুমের বাইরে এসে তোকে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে যেতে দেখি। এতো রাতে ছাঁদে কেন এলি সেটা দেখতেই এলাম।”
অভয় ছোট্ট করে ‘ওহ’ বলে আবারও আকাশ পানে চেয়ে চুপ করে রইল। অভয়ের ভাবভঙ্গি অনিন্দিতার কেমন জানি লাগল। তার ভাই তো এমন নয়। ওকে দেখে মনে হচ্ছে ও খুব দ্বন্দ্বে ভুগছে। অভয় তার থেকে অনেক বছরের বড় হলেও সে যতটুকু বেশি বুঝতে সক্ষম হয় অভয় ততটুকু বুঝতে পারে না। এক কথায় নিজের বোঝার ক্ষমতার থেকে বেশি ইগো আর জেদকে বেশি প্রধান্য দিতে ভালোবাসে অভয়।

অনিন্দিতা এগিয়ে এসে তার ভাইয়ার পাশে বসে। কিছুটা নরম সুরে বলে….
–“কি হয়েছে তোর? কোনো সমস্যা? আমায় বলতে পারিস।”
অভয় মলিন হেসে জবাব দেয়…..
–“সমস্যার কথা বললে কি সমাধান বের করে দিতে পারবি? আমি এমন সমস্যায় ভুগছি যে যেটা শুনলো তোর হাসি পাবে আর তাচ্ছিল্য করবি।”
–“উঁহু! ভুল বুঝিস না আমাকে ভাইয়া। তোর বোন তোকে সমস্যায় দেখে মোটেও হাসে না। আমাকে বল না প্লিজ। তুই ঐশানী ভাবিকে নিয়ে ভাবছিস তাই না?”

অভয় চোখভরা বিস্ময় নিয়ে তাকায় অনিন্দিতার দিকে। অনিন্দিতা মিটমিটিয়ে হাসছে।
–“তুই কি করে জানলি?”
–“আফটার ওল বেহেনা কিসকা হায়?”
অভয় হালকা হেসে নেয়। আবারও মুখটা মলিন হয়ে আসে তার। মাথা নাড়িয়ে বলে…..
–“আমি জানি না আমার কি হচ্ছে। অশান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে গলায় কাটা বিঁধে আছে। কোনো কিছুতে মন শান্ত হচ্ছে না।”
–“বিকেলবেলা ভাবি যখন বলেছিল সে অন্যকাউকে বিয়ে করতে পারে ভবিষ্যতে তখন থেকেই তোর এমন লাগছে তাই না?”

অনিন্দিতার এই কথায় চোখ বড় করে তাকায় অভয়। সে কি করে জানল ঐশানী এসব বলেছিল? অভিভূত হয়ে বলেই ফেলল….
–“তু…তুই কিভাবে জানলি??”
–“হাহাহাহা। আমি তখন বেলকনিতে বসে ছিলাম। আর বেলকনিটা তো বাগানের সামনেই। সবটা দেখতে পেয়েছি। আর ভাবির ওই কথা বলার পর তোর রিয়েকশনও আমার চোখ এড়ায়নি।”
অভয় নির্বাক হয়ে বসে থাকে। মাথাটা নিচু হয়ে শুধু নিরব শ্রোতা সেজে।
–“জেলাস ফিলিং??”
অনিন্দিতার কথায় শূন্য দৃষ্টিতে তাকায় অভয়। দম ফেলে বলে…..
–“হোয়াট? ওর জন্য জেলাস? নেভার।”

–“উফফ….ইগো আর জেদ কেটে ফেলে বল। খুব খারাপ লেগেছে না?”
অভয় আর লুকাতে পারে না। চোখজোড়া অসহায় নয়নে তাকিয়ে হালকা মাথা দুলায়। তা দেখে অনিন্দিতা আলতো হেসে বলে….
–“এটা তো হওয়ারই ছিল। নিয়তিকে হারাবে কে? আচ্ছা ওই একই কথা যদি এখন সায়রা বলে তোর কি এতোটাই রাগ হবে? খারাপ লাগবে? তোর রিয়েকশন কি হবে?”
–“ও তো মাঝে মাঝেই এমন কথা মজা করে বলতো। আমিও হেসে উড়িয়ে দিতাম।”
–“দ্যাটস দ্যা পয়েন্ট। ভালোবাসার আরেক রুপ জানিস? হিংসা। তুই কারোর সাথে নিজের ভালোবাসা শেয়ার করতে চাইবি না। এটা তোর কাছে বিষের মতো মনে হবে।”

–“তার মানে তুই বলতে চাইছিস আমি ঐশানীকে ভালোবাসি?”
হতভম্ব হয়ে বলে অভয়। অনিন্দিতা কারণ ছাড়াই বলে দিল….
–“অভিয়েসলি। এখনো ডাউট আছে?”
–“এটা হতেই পারে না। আমি ওকে কি করে? আমি তো সায়রাকে….. ”
বলতে বলতে থেমে যায় অভয়। সায়রাকে ভালোবাসি কথাটি আর পরিপূর্ণ হয়ে বের হয় না। কন্ঠস্বর কাঁপতে থাকে তার। অনিন্দিতা তার এই দশা দেখে ভ্রু উঁচিয়ে বলে…..
–“কথা আর বের হচ্ছে না? হবেও না। যাকে ভালোবাসা যায় না তাকে ভালোবাসি বলতেও হৃদয় বারণ করে। কন্ঠস্বর কাঁপে। একবার আমার কথা শোন। তুই ঐশানীকে ভালোবাসিস এই কথা জোরে বল।”

অভয় চোখ খিঁচে ঐশানীকে স্মরণ করে এক নিশ্বাসে বলে ফেলে…..
–“আমি ঐশানীকে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি।”
বলেই নিজের ওপর চমকে গিয়ে চোখ খোলে অভয়। নিজেকে প্রশ্ন করে….
–“এটা আমি বললাম?”
অনিন্দিতা অট্টহাসি হাসতে শুরু করে। হাসি কোনোমতে থামিয়ে বলে….
–“তুই চোখ বন্ধ কর। ধরে নে ভাবির সঙ্গে তোর বিচ্ছেদ হয়েছে। তুই সায়রাকে বিয়ে করবি। ওদিকে ভাবির ফ্যামিলি বসে থাকবে না। ভাবির বয়স কম। ওকেও তো বিয়ে দেবে তাই না? তোর তখন কেমন লাগবে?”

চোখ বন্ধ করারও প্রয়োজন হয় না অভয়ের। সঙ্গে সঙ্গে আগুনের লাভার মতো জ্বলে ওঠে সে। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। অতি মাত্রায় উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
–“ও এটা কি করে করতে পারে? কখনোই না। আমি ওকে করতে দেব না। ও তো আমার সঙ্গে বিয়ে করেছে না? তাহলে কি করে অন্য কারো সাথে বিয়েতে বসতে পারে?”
অনিন্দিতা নিজেও আশ্চর্য হয়ে যায়। তার ভাইয়া ঐশানীর জন্য এতোটা ডেস্পারেট? তাকে আশ্বস্ত করে বলে….
–“শান্ত হ ভাইয়া। উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম। আমি বলাতেই তোর এতো রাগ। যখন সামনা-সামনি এই ঘটনা ঘটবে সেদিন তুই চেয়েও কিন্তু কিছু করতে পারবি না।”

অভয় অনেকটাই বুঝে যায়। এই মাত্র কয়েকদিনে ঐশানী ওর লাইফের জন্য কতটা ইম্পরট্যান্ট হয়ে উঠেছে সে বুঝতে পারছে। হয়ত ওর লাইফটাই এখন ঐশানী হয়ে উঠেছে। ঢক গিলে নেয় সে। অনিন্দিতা আবার বলে…..
–“কিন্তু সায়রা যদি অন্য কাউকে বিয়ে করে তবে তোর কেমন লাগবে?”
অভয় কিছুক্ষণ সায়রার জন্য ভাবে। চেয়েও যেন খারাপ লাগা আনতে পারছে না। চেয়েও উত্তেজিত হতে পারছে না।
–“জানি না। আমার মাঝে কোনো খারাপ লাগা সৃষ্টি হচ্ছে না।”

–“এটাই মোহ আর ভালোবাসার পার্থক্য। এখনো সময় আছে ভাইয়া। বিয়ের পরেও স্ত্রী এর সাথে ভালোবাসা হয়। এটাকে আসল ভালোবাসা বলে। মোহের দিকে হাত বাড়াস না। জেদ কে জিততে দিস না। আর যদি ভাবিস তুই আমার চ্যালেঞ্জের জন্য স্বীকার করবি না তাহলে যাহ তুলে নিলাম আমার চ্যালেঞ্জ।”
অভয় হঠাৎ করেই নিরব হয়ে যায়। যেন সে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। সামান্য বিকেলের ঘটনা তাকে এতোকিছু বুঝিয়ে দেবে তা তার ভাবনার ঊর্ধ্বে ছিল। মিনিট দশেক চুপচাপ কেটে যায় তাদের। অভয় মুখ খুলে বলে……

–“কিন্তু তোর কি মনে হয় না? আমাদের আরেকটু সময় দেওয়া উচিত? ঐশানী এখনো আমার সাথে অ্যাটাচড হতে চায় না। আরেকটু ভাবা উচিত সেটা কি মনে হয় না?”
–“না হয় না। হয়ত কথায় আছে ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না। কিন্তু এতোই ভাবোন্মাদ হয়ে পড়িস না যে জীবন থেকে সুযোগ হারিয়ে যায়। জীবন বার বার সুযোগ দেবে না। মনে রাখিস।”
অভয়কে একা থাকতে দিয়ে ছাঁদ থেকে নেমে আসে অনিন্দিতা। সে ছেড়ে দিয়েছে বাকিটা তার ভাইয়ের হাতে।

বর্তমানে…..
সন্ধ্যায় চারিদিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে। অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছে সূর্যকে। উঠেছে স্নিগ্ধ একটি চাঁদ। বেলকনির রেলিংয়ে মাথা লাগিয়ে বসে আছে ঐশানী। মনটা ভীষণ খারাপ। আগের মতো খুশি থাকতে পারছে না। সেই রেস্টুরেন্টের ঘটনার পর সবটা যেন পাল্টে গেছে। আর অভয়ের থাপ্পড়ের কথা মনে পড়লে আরো মন খারাপ হয়ে যায় ঐশানীর। তাদের বেলকনিটা বাড়ির পেছন দিকে। এদিকে নানানরকম বড় বড় গাছ। বাতাসে হালকা ঘুমও পাচ্ছে তার। পেছনে অনিন্দিতার কন্ঠে ঘুম ঘুম চোখে পেছন ফিরে তাকায় সে।
–“ভাবি একটু বাইরে যাবে?”

–“হঠাৎ বাইরে কেন? কোনো কাজ আছে?”
অনিন্দিতা মাথা নাড়িয়ে বলে….
–“না আসলে ভাইয়া তোমায় ডাকতে বলল বাইরে।”
অভয়ের কথা শুনে আবারও ঘটনাগুলো মনে পড়ে তার। বেশ শান্ত সুরে বলে….
–“ঘরে এসে যা বলার বলতে বলো না।”
–“আহা! চলো না। তোমায় নাকি বাইরেই যেতে হবো। ভাইয়া জোর গলায় বলেছে।”
মানা করার পরেও অনিন্দিতার জোরাজুরিতে আর পারল না ঐশানী। কাঁপা কাঁপা পায়ে হেঁটে যায় বাড়ির বাইরে। কি কারণে লোকটা এমন করছে কে জানে?

বাইরে পা রাখতেই অভয়কে দেখতে পায় ঐশানী। বাড়ির ওপরে লাগানো সোডিয়াম আলোয় অভয়ের ক্লান্তিমাখা মুখ ভেসে ওঠে। গলা শুকিয়ে আসে ঐশানীর। অভয় ক্লান্তি চাহনি আর মলিন হাসি নিয়ে দুটো হাত দিয়ে ধরে আছে হাওয়াই মিঠাই এর লেগে থাকা বড় লাঠির ওপর। ঐশানী অবাক নয়নে তাকায় সেটা দেখে। আশ্চর্য হয়ে বলে….
–“এসব….…!!”
–“প্রায় তিনঘণ্টা ধরে খুঁজে এনেছি। তোমার জন্য।”

চলবে…..

#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২১

ঐশানী শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার ঠোঁটের কোণে হাসি হাসি ভাব। তার মনে এক চিলতে অনুভূতি কড়া নাড়ে। মনটা বলে ওঠে…..
–“লোকটা কেন তার জন্য এতো পরিশ্রম করে তার সব থেকে পছন্দের জিনিস আনতে গেল? তবে কি দুপুরে বলা কথাগুলো সত্যি ছিল?”
অভয় ঐশানীর নিরবতা দেখে চোখজোড়া সরু করে ফেলে। হাওয়াই মিঠাইগুলো লেগে থাকা বড় স্টিলের লাঠি এক হাত দিয়ে ধরে অন্যহাতে চুটকি বাজিয়ে বলল….
–“ও হ্যালো? কোথায় হারিয়ে গেলে? পছন্দ হয়নি?”
ঐশানী হালকা চমকে গিয়ে মুচকি হেসে তাকায়। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বলে….
–“আপনি সত্যি আমার জন্য এনেছেন এতোক্ষণ ধরে খুঁজে?”

–“তবে কি মনে হচ্ছে? আমি মিথ্যে বলছি?”
–“না আসলে…. (একটু থেমে) মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। শ্যামলা ঘোড়া আমার জন্য এতোক্ষণ ধরে খুঁজে হাওয়াই মিঠাই এনেছে। এটা অবিশ্বাস্য। তবে যান বিশ্বাস করলাম।”
বলেই নিজের ঠোঁটের হাসি প্রসারিত করে ঐশানী। বেরিয়ে আসে তার গজদাঁত। যেটা হাসির সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম। অভয়ও প্রতিত্তোরে হাসে। হাওয়াই মিঠাই গুলো দেখিয়ে বলে…..
–“আমি কি বাহিরেই দাঁড়িয়ে থাকব? নাকি ভেতরেও যেতে দেওয়া হবে?”
–“আমি এতোটাও মোটা নই যে আপনার ভেতরে যেতে সমস্যা হবে।” (নাক ফুলিয়ে)

–“বাট এটা নিয়ে তো ঘরে ঢোকা সম্ভব নয় তাই না?”
ঐশানী এতো বড় লাঠিটা ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে। এতো বড় জিনিস সদর দরজা অবধি ঢোকানো সম্ভব নয়। ছুটে গিয়ে একটা একটা করে হাওয়াই মিঠাই নিজের হাতের ভাঁজে নিতে থাকে সে। এতোগুলো প্যাকেট তো কম কথা নয়। একসময় তার দুহাত সহ মুখও ভর্তি হয়ে যায়। তবুও হাওয়াই মিঠাইয়ের প্যাকেট শেষ হয় না। অসহায় পানে চেয়ে থাকে ওপরে থাকা হাওয়াই মিঠাইয়ের দিকে। অভয় তা লক্ষ্য করে একটু মজা নিয়ে নিজের দুইহাতে বাকি প্যাকেট নিয়ে বলে…..
–“হ্যাপি?”
ঐশানী দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে সদর দরজা পেরিয়ে আসে।

সেখান থেকে ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই মিসেস. তনয়া ও রেনু গল্প করা অবস্থায় ঐশানীর দিকে তাকায়। হাত ও মুখ ভর্তি হাওয়াই মিঠাই দেখে থতমত খেয়ে তাকান উনারা। পেছন পেছন অভয়কেও একইভাবে দেখে আরো চমকে উঠেন।
–“তোমরা এভাবে? এতোগুলো হাওয়াই মিঠাই কি করবে?”
মিসেস. তনয়ার প্রশ্নের উত্তর দিতে ঐশানীর মুখে হাওয়াই মিঠাইয়ের প্যাকেট থাকায় শুধু উম…উম… শব্দ করতে থাকে। অভয়ও চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। মিসেস. তনয়া অভয়কে কটাক্ষ করে বলেন…..
–“ঐশানীর তো বলতে পারছে না। তুই তো বলতে পারবি। এতো হাওয়াই মিঠাই কি পুরো শহরে বিতরণ করবি?”

–“ওই আ…আসলে মা…. ”
অভয়ের আমতা আমতা করা দেখে ভ্রু কুঁচকান মিসেস. তনয়া। হালকা ধমকে সুরে বলেন….
–“কি আসলে নকলে? স্ট্রেটকাট কথা বলতে পারিস না?”
–“মা তোমার বউমা হাওয়াই মিঠাই খাদক। এতোগুলো ও একাই খেতে পারবে। এজন্য নিয়ে এসেছি।”
এক নিশ্বাসে গড়গড় করে কথাগুলো বলে ঝড়ের গতিতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায় অভয়। মিসেস. তনয়ার বুঝতে বাকি থাকে না বউয়ের জন্য এসব এনেছে বলতে তার লজ্জা লেগেছে। তাই মিটমিটিয়ে হাসতো থাকেন উনি।

ঐশানী ঠাঁই সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে ঢক গিলতে থাকে লজ্জায়। অভয় কি বলে গেল? সে কিনা হাওয়াই মিঠাই খাদক? মিসেস. তনয়া তার দিকে তাকাতেই সে এগিয়ে এসে হাতে থাকা হাওয়াই মিঠাই এগিয়ে দিয়ে ইশারাই বলে খেতে। মিসেস. তনয়া এবার হেসেই বলেন…..
–“আমাদের এসব খাওয়ার বয়স পার হয়ে গেছে। তোমার বর তোমার জন্য এনেছে তুমিই বরণ খাও। আমরা কেউ এসব খাই না।”
লজ্জায় মিইয়ে পড়ে গটগট করে রুমের দিকে চলে যায় ঐশানী।

রেনু সবটা খেয়াল করে খুশিতে গদগদ হয়ে বলে….
–“বড় আম্মা দেখছেন আপনে? আমি বলছিলাম আপনার পোলা একদিন ঠিকই বউয়ের কদর করবে। করতাছে তো! আইজ বউয়ের জন্য ওর পছন্দের জিনিস আনছে। আপনার পোলা বউয়ের প্রেমে ফাঁসছে।”
বলেই খিলখিল করে হাসে রেনু। মিসেস. তনয়াও না হেসে পারেন না। আসলেই ঠিক বলেছে রেনু। তার ছেলেরও কি এবার সুবুদ্ধি হলো? হলে তো মন্দ নয়।
–“বউয়ের প্রেমেই তো জড়িয়ে যাওয়া উচিত রেনু। এটা তো নিয়ম। প্রকৃতির নিয়ম। ওপরওয়ালা দুটো মানুষকে যখন এক করেছেন তখন দুজনকে তো দুজনের কাছে আসতেই হয়।”

রুমের বেডের একপ্রান্তে বসে হাওয়াই মিঠাই খেতে ব্যস্ত ঐশানী। ইতিমধ্যে ফ্লোরে প্রায় পনেরোটা খালি প্যাকেট পড়ে রয়েছে। ওয়াশরুম থেকে একেবারে শাওয়ার নিয়ে বের হয় অভয়। গায়ে তার সাদা বাথরোব। বেশ বড় বড় চুলগুলো নেতিয়ে কপাল থেকে চোখ পর্যন্ত নেমে এসেছে। চুলের ফাঁক দিয়ে সে দেখতে পায় ঐশানীকে। মেয়েটার কোনোদিকে খেয়ালই নেই। রুমের মধ্যে আরেকজনও উপস্থিত রয়েছে সেটা কি সে ভুলে গেছে? স্যান্ডেল পড়া পায়ে দুইধাপ এগোতেই দুর্ভাগ্যবশত তার পা পড়ে খালি প্যাকেটের ওপরে। সঙ্গে সঙ্গে স্লিপ কেটে চোখের পলকেই ফ্লোরে উপুড় হয়ে পড়ে যায়। মৃদু চিৎকার দিয়ে ওঠে ‘আহহ’ শব্দ করে।

খেতে খেতে আঁতকে তাকায় ঐশানী। অভয়কে পড়ে থাকতে দেখে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হয় তার। অভয়ের বাথরোব পায়ের বেশ খানিকটা ওপরে উঠে যেতে দেখে ঐশানীও এক চিৎকার দিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। অন্যদিকে অভয়ের অবস্থা নাজেহাল। একার পক্ষে দাঁড়ানো অসম্ভব হয়ে যাবে। চোখমুখ জড়িয়ে অসহায় ভঙ্গিতে ঐশানীর দিকে তাকিয়ে বলে….
–“আরে হৃদয়হীনা উঠাতে সাহায্যও তো করতে পারো নাকি!”
–“আ…আপনি আগে নিজের কাপড়চোপড় ঠিক করুন।”
চিল্লিয়ে বলে ঐশানী। অভয় ভ্রু কুঁচকে নিজের দিকে তাকায়। নিজের অবস্থা থেকে বাথরোব ঠিকঠাক করে হালকা কাশি দিয়ে বলে…..

–“এতোটাও কাপড় উপরে উঠে যায়নি যে এভাবে বলতে হবে। স্টুপিড গার্ল!”
ঐশানী পিটপিটিয়ে চাইলো। হাত ঝেড়ে এসে অভয়কে টেনে তুলল। পায়ে ভালোই ব্যাথা পেয়েছে সে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে বেডে বসল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে পা ধরে এদিক ওদিক নাড়াতে থাকল সে। রাগি চাহনি নিয়ে ঐশানীকে বলল….
–“হাওয়াই মিঠাই খাবে খুব ভালো কথা। কিন্তু প্যাকেট এদিক-সেদিক ফেলে দিয়েছো কেন? আমার পায়ে যা ব্যাথা লেগেছে ঠিকঠাক হাঁটতে পারছি না। এখন কি আমাকে কোলে নিয়ে চলতে পারবে তুমি?”

ঐশানী হাওয়াই মিঠাই মুখে দিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বলল….
–“কোনোদিন দেখেছেন পিঁপড়া হাতিকে কোলে নিতে?”
–“আমার রুমে এসব চলবে না।”
–“বাইরে যেতে পারেন!”
রাগে ফোঁসফোঁস করে তাকালো অভয়। অতঃপর রাগটাকে নিমিষেই শান্ত করে নিল। এখন তার রাগলে মোটেও চলবে না। বড় একটা শ্বাস নিয়ে উপুড় হয়ে বসে গালে হাত রেখে ঐশানীর খাওয়া দেখতে দেখতে বলল…..
–“ঐশানী?”

–“হু?”
খেতে খেতে ছোট্ট করে জবাব দিল ঐশানী। অভয় চেহারা গম্ভীর হয়ে এলো…..
–“আই এম সরি।”
–“কেন?” (খাওয়া থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে)
–“আমার বোঝা উচিত ছিল তুমি সেই সিচুয়েশনে কতটা ভড়কে গিয়েছিলে। কিন্তু সেসব না বুঝেই তোমায় রাগে ভুলবশত চড় মেরে বসেছি।”
–“এটা আর নতুন কি? আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার দ্বিতীয় দিনই তো চড় দিবস পালন করেছিলেন। আমি তো এখন আপনার হাতে চড় খেয়ে ভাবলাম আজও হয়ত চড় দিবস।”
খেতে খেতে স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিল ঐশানী। অভয় এবার অনুনয়ের সাথে বলে…..

–“আই এম রিয়েলি সরি। প্লিজ এক্সেপ্ট মাই সরি। জাস্ট তোমার রাগ ভাঙানোর জন্য এতোক্ষণ ধরে খুঁজে খুঁজে হাওয়াই মিঠাই এনেছি।”
ঐশানী খাওয়া থামিয়ে দিল। অভয়ের চোখের দিকে তাকালো। তার চোখে সত্যিই অপরাধবোধ রয়েছে। ঐশানী উঠে দাঁড়িয়ে বলল….
–“ওকে সরি এক্সেপ্টেড।”
অভয়ও খুশি হয়ে উঠে দাঁড়ায়। চেহারাই হাসিখুশি ভাব এনে বলে…..
–“সত্যি?”
–“হুমম। কিন্তু হ্যাঁ সরি এক্সেপ্ট করেছি আপনার ভালোবাসা নয়। আগে আমরা যেমন ছিলাম তেমনই থাকব। হতে পারে সারাজীবন এমনই থাকব। আপনিও সময় নিন। বুঝতে শিখুন যে আপনার আসল ভালোবাসা কে। তারপর ভালোবাসা প্রকাশ করবেন।”

অভয় কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলে….
–“চলবে। এখন শুধু সরি এক্সেপ্ট করে আগের মতো হলেই চলবে।”
ঐশানী ভাব নিয়ে হাসল। স্টাইল করে চুল অন্যদিকে দিয়ে ভাব নিয়েই বলল….
–“আপনার সরি এক্সেপ্টেড। আমি আবার দয়ালু মানুষ। কেউ এভাবে সরি চাইলে তাকে ফেরাতে পারি না।”
এই মেয়েটা কি ধাতু দিয়ে তৈরি তা জানা নেই অভয়ের। তবে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে সে কি দিয়ে তৈরি? কি করে পারে অভয় খানের মতো গুরুগম্ভীর মানুষকেও হাসাতে? চোখ বন্ধ করে হাসে অভয়। বিড়বিড়িয়ে বলে…..
–“এক্টিং কুইন একটা!”

পরেরদিন……
সকালের আলো ফুটেছে সবে। অভয় ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে তার জিনিস প্যাকিং করছে। ঐশানী নিজের জিনিস প্যাকিং করতে করতে ঘুমে ঢলে পড়েছে। টেবিলে মাথা লাগিয়ে ঘুমিয়ে চলেছে ও। আর ঘুমের মাঝেই ‘শাহরুখ খান’ এর নাম নিয়ে চলেছে যেটা ভীষণই বিরক্ত লাগছে অভয়ের কাছে। কারই বা ভালো লাগে নিজের স্ত্রী এর মুখে অন্য কোনো পুরুষের নাম শুনতে? সে হক যতই সিলেব্রিটি! একসময় অভয় বিরক্তির চরমে পৌঁছে ধমক দিয়ে ডাকে ঐশানীকে।
–“এই মেয়ে! উঠো।”
ঘুমের মাঝে এতো জোরে ধমক পেয়ে হুড়মুড়িয়ে উঠে আশেপাশে তাকিয়ে বলে…..

–“শাহরুখ খান, শাহরুখ খান? কোথায় শাহরুখ খান?”
–“এটা শাহরুখ খান নয় অভয় খান। সারাদিন মুখে শুধু শাহরুখ খান আর শাহরুখ খান। ব্যাগ প্যাকিং করেছো নিজের?”
হাই তুলে উঠে দাঁড়ায় সে। ঘুমে জড়ানো কন্ঠে বলে….
–“শেষদিকে।”
আজ ওরা সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। ৭ টার দিকে বাস ছাড়বে। তার আগেই পৌঁছাতে হবে বাস স্ট্যান্ডে। সবটা প্যাক করে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অভয় ও ঐশানী। নিচে ইশান সহ সবাই রয়েছে। তারা অপেক্ষায় করছিল এই দুজনের জন্যই।

নিচে নামতেই ইশান এগিয়ে গিয়ে অভয়কে প্রশ্ন করল…..
–“কিরে এতো দেরি হলো কেন?”
–“ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে গেছে।”
লাগেজ ঠিক করতে করতে স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিল অভয়। এতে ইশান দুষ্টু হাসি দিয়ে ফিসফিস করে বলে…..
–“হয় হয়। বিয়ের পর এমনটা হয়। আমিও বুঝি।”
থতমত খেয়ে ইশানের দিকে তাকায় অভয়। ছেলেটা কি বুঝাতে চেয়েছে সেটা খুব ভালো করে বুঝেছে। তার মাথায় গাট্টা মেরে অভয় দাঁতে দাঁত চেপে বলে….
–“ফাইজলামি অন্য কোথাও করবি। আমার এখানে চলবে না।”
–“আজকাল সত্যি কথার ভাত আছে? নো প্রবলেম এই ইশান রুটি খেয়ে থাকতে রাজি আছে। তাও সত্যি বলা ছাড়তে রাজি নেই।”
ইশানের অদ্ভুত কথায় কিছু বলতে গিয়েও বলে না অভয়। ওর এই ফাইজলামি কখনো যাবার নয়। তার থেকে কথা না বাড়ানোই ভালো।

সকলে মিলে বেরিয়ে পরে বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। ইশান সেখানেই থাকে অভয়ের দাদির সঙ্গে। অভয়ের দাদি মা শহরে আসতে নারাজ। একা বয়স্ক মানুষ তো চলতে পারবেন না তাই ইশানের পরিবারসহ সেখানেই থাকে ইশান। বলতে গেলে নানিবাড়িই তার আসল বাড়িতে রুপান্তরিত হয়েছে।

বাস চলছে নিজের গতিতে। সামনের সিটে বসেছেন মিসেস. তনয়া এবং রাহাত সাহেব। ইশান ও অনিন্দিতা বসেছে এক সিটে। আর পেছনে বসেছে অভয় ও ঐশানী। যদিও ঐশানী অভয়ের কাছে বসতে চায়নি। তবে কায়দা করে বসেছে অভয় নিজেই। তবে এখন কেন জানি তার মনে হচ্ছে সে ঐশানীর পাশে বসে ভুলই করেছে। মেয়েটা অভয়ের কাঁধে মাথা রেখে বারংবার অস্পষ্ট ভাবে শাহরুখ খানের নাম জপ করছে। যেটা শুনে রাগে ফুলেফেঁপে উঠছে অভয়। ঐশানী ঘুমিয়েছে বলে কিছুও বলতেও পারছে না সে। তবে এতোকিছুর মাঝেও ঐশানী অভয়ের কাছে তো এসেছে! এটাই যেন অভয়ের সফলতা। চুলগুলো আলতো উড়ে এসে অভয়ের শ্যামলা চেহারায় দাঁড়ি ভর্তি গাল ছুঁইয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা আবার চুলে খোঁপা করে রেখেছে। ছোট চুলগুলোই শুধু অভয়কে ছুঁতে সক্ষম হচ্ছে। অভয় মনে মনে বলে….”চুলগুলো বাঁধার কি খুব দরকার ছিল?”

ফোনের রিংটোনের শব্দ শুনে ফোন বের করে অভয়। স্ক্রিনের নামে সে অতিমাত্রায় বিব্রত হয়। সায়রা তাকে কল করেছে। আগে যখন সে সায়রাকে কল করত কখনোই সায়রাকে পেতো না কলে। এখন কি না সায়রা নিজে থেকেই কল করছে? তবে এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। সায়রা নামক ভূত তার মস্তিষ্ক থেকে নেমে গেছে। অভয় কেটে দেয় সায়রার কল। ফোনটা ওফ করে ঢুকিয়ে রাখে পকেটে।
একসময় শাহরুখ খানের নাম শুনতে শুনতে কান পঁচে যাবার উপক্রম হয় অভয়ের। এখনো ৩ ঘন্টার পথ বাকি। অভয়ের কানও যেন এখন হতাশ গলায় বলছে……
–“এতোদিন কি করলি অভয়? তোর বউ এখনো কিনা তোর নাম ব্যতীত অন্য পুরুষের নাম নেয়?”

রাগে-দুঃখে অভয় নিজের ডান হাত ঐশানীর মুখের ওপর আলতো চেপে ধরে। তাও যেন ওই শাহরুখ খান নামটা শুনতে না হয়। কান পর্যন্ত আর পৌঁছায় না সেই নামটা। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাইরের দিকে চেয়ে থাকে ঐশানীর মুখ চেপে ধরে। কিন্তু বিপত্তি ঘটে তখন যখন বাসের কন্ডাক্টর বিষয়টি লক্ষ্য করে।
–“আরে ভাই, মেয়েটার মুখ এমনে চেপে ধরে আছেন ক্যান? মেয়েটারে পালাইয়া লইয়া যাইতেছেন নাকি?”

কন্ডাক্টর এতোই জোরে কথাগুলো বলল যে আশেপাশের সব লোক শুনে তাকালো তার দিকে অদ্ভুত ভাবে। বিরক্ত হয়ে বলল…..
–“আরে ভাই না। ও আমার বউ। কানের কাছে বিড়বিড় করছিল তাই মুখ চেপে ধরছিলাম।”
–“এইটা কেমন কথা? আমার মনে হচ্ছে মেয়েটাকে আপনি জোর করে কোথাও নিয়ে যাচ্ছেন।”
অন্য সিট থেকে আরেক লোক কথাটা বলে উঠল। অভয়ের তো কপাল চাপড়ানোর উপক্রম।
–“কি মুশকিল! আরে ভাই না। ও আমার বউ। সবাইকে সাক্ষী রেখে বিয়ে করছি।”
তবুও কেউ দমল না। কন্ডাক্টর বলে উঠল….
–“আমার তো মনে হইতাছে এই লোকটা ছেলেধরা। কিডন্যাপ করে।”
অভয় বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। শেষমেশ কিনা সে কিডন্যাপার প্রমাণিত হলো? তাও নিজের বউকে কিডন্যাপ??

চলবে……