শিকড় পর্ব-০৭

0
205

শিকড়
পর্ব -৭

আবিদ যে এরকম ভাববে দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি তারা।
-কি বলছিস তুই? সবটা শুনে তোর এটা মনে হলো?
-মনে হওয়ার তো কিছু নেই?এটাই বাস্তবতা।
-কিসের বাস্তবতা? মনগড়া কথা বললেই তো হবে না বাবা।
-কোন কিছুর বিনিময় ছাড়া কেউ কখনো সন্তান দান করে,শুনেছো কখনো?
-ভূল করছিস তুই। মহান দুজন মানুষকে এতো নিচে নামানোর কোন অধিকার নেই তোর।
-এইতো এলে আসল কথায়।ম হা ন।সবার কাছে মহান হওয়াই ওদের উদ্দেশ্য ছিলো।দেখো গিয়ে,তাদের হয়তো ঘটা করে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে। আচ্ছা, আমাকে তোমরা বলো তো,জীবনের ত্রিশ বছর পর আমার কি এসব জানার খুব দরকার ছিলো। না জেনেতো আমি ভালোই ছিলাম। কেন এমন করলে তোমরা।

এই প্রথমবার কান্নায় ভেঙে পরে আবিদ।শাহেদ, রেহনুমাও নিজেকে সামলাতে অক্ষম।কান্নাজড়ানো গলায় রেহনুমা বলেন
-বাবারে,আমরা এতোগুলা বছর যে অন্যায় বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি, সেটার তো শেষ হওয়া দরকার।ওরা তোর আব্বুকে ভাই ডেকেছিলো।তাদের সন্তান দিয়ে আমাদের পূর্ণ করলো,আর আমরা ভূল করেও একদিন তাদের কোন খোঁজ নিলাম না।আমরা তো ওদের নাম,ঠিকানা সবই জেনে গিয়েছিলাম হাসপাতাল থেকে। তবুও স্বার্থপরের মতো শুধু পালিয়ে বেড়িয়েছি। এবার তোকে নিয়ে গিয়ে ক্ষমা চাইবো,ওরা ক্ষমা না করলেতো আল্লাহও ক্ষমা করবেন না আমাদের।
-আর আমি???আমার কথাটা একবারও ভাবলেনা আম্মু?
-তুই ছাড়া আমাদের আর কে আছে বল?তুইতো আমাদেরই সন্তান।
-আম্মু আমি এসব মানতে পারছি না।তোমরা বলো,সব মিথ্যা। তোমরাই আমাকে জন্ম দিয়েছো।বলো না আম্মু, প্লিজ বলো।

ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন রেনু।আবিদও শক্ত করে জড়িয়ে আছে ওর মাকে।

শাহেদ বলেন,
-পরের অংশটাও তোর জানা থাকা দরকার। আজই সব বলে শেষ করবো, আর কোনদিন এসব নিয়ে আমরা কোন কথা বলতে চাইনা।যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলবে সব।
-এখন কি আর এসব বললে হবে আব্বু?? আমার সবতো ওলট-পালট করে দিলে তোমরা।
-আমার ছেলেতো এতো অবুঝ না,তবে কেন নিজে শক্ত হতে পারছো না?
নীরবে কাঁদতে থাকে আবিদ।কথা বলতে ইচ্ছে করছে না মোটেও।শুধু মন চাইছে দুহাত দিয়ে ওর আব্বু আম্মু দুজনকে জড়িয়ে ধরতে।সবসময় যা করতে অভ্যস্হ আজ কেন যেন তা করতে পারছে না।

-পরদিনই আমরা বাচ্চা নিয়ে কোয়ার্টারে ফিরি।সবাইকে ছেলে হওয়ার খবরও দেই।আমার মা বোনতো কিছুতেই বিশ্বাস করবে না,বারবার বলছে,বাসায় নিয়ে আসো না কেন? বললাম রেনু শারীরিক -মানষিক ভাবে ঠিক হলেই আসবো।পরদিন ভোরে দেখি ওরা এসে পরেছে কোয়ার্টারে।নিজ চোখে তোকে দেখে তাদের বিশ্বাস হয়।তোর দাদীতো কি খুশি!!!রেনুর সাথে আচরণও রাতারাতি বদলে গেল।ওকে যেন মাথায় করে রাখছে সবাই।
এরমধ্যে আমিও বদলি হয়ে যাই ঢাকায়।সবাই মিলে একসাথে হাসি আনন্দে কাটতে লাগলো দিনগুলো। সবার প্রানভ্রোমরা তুই।ধীরে ধীরে রেনু স্বাভাবিক হয়ে উঠল,কিন্তু শরীরে বাসা বাধা অসুখের জন্য প্রায়ই দূর্বল থাকতো।একরাতে তুই ঘুমিয়ে পরার পর আমি রেনুকে বললাম
-রেনু,আমার কথা খুব মন দিয়ে শুনবে।
-বলো
-ও কার বাচ্চা?
-কার মানে?আমাদের ( খিলখিলিয়ে হেসে বলে)
-ভেবে বলো
-তোমার কি হয়েছে বলোতো?
-রেনু,মনটা শান্ত করে একটু ঠান্ডা মাথায় ভাব,কিছু মনে হয় কি না দেখ তো।
-কি মনে হবে?
-তুমি আবিদের জন্মের সময়ের কথা মনে করার চেষ্টা করো,আমি তোমাকে সাহায্য করবো।
-কিছু তো মনে পরছে না।
-তুমি চোখ বন্ধ করে আমার কথা মন দিয়ে শুনবে, দেখবে ঠিক মনে পরবে।
অনেকক্ষণ ও চোখ বন্ধ করে আমার কথা শুনল,আমিও সবরকম চেষ্টা করলাম, কিন্তু সফল হতে পারলাম না।ওদিকে রেনু কেঁদেকেটে একাকার। সারারাতই কেটে গেল।ভোরের দিকে রেনু বললো,
-আমি তোমাকে নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি,তোমার সব কথা আমি মেনে নিলাম, যদিও আমি কিছু মনে করতে পারছি না।
-ধন্যবাদ রেনু।একটা পাথর নেমে গেল বুক থেকে।ওদের নাম-ঠিকানা আমি নিয়ে এসেছি। একবার আসতে বলবো ভাবছি। মা কে বলবো আমার ওখানকার প্রতিবেশী ওরা।

মুহূর্তে ও আমার পায়ের কাছে বসে যায়,
-তোমার কাছে অনুরোধ আমার,এ কাজ করবে না।
-কিন্তু
-ওরা তো নিজে থেকেই দিয়েছে,আমরা তো জোরে আনিনি,তবে আর পিছুটান কেন রাখবে।
-এটা অন্যায় রেনু।
-কিসের অন্যায়,তুমি আমার কথাটা বুঝো।
-ওদের দান নিয়ে আজ আমরা ভূলে যাবো??
-ভূলে যাবো কেন বলছো? শুধু ওদের সাথে যোগাযোগ না করলেই কি ভূলে যাওয়া হলো?
-ওরা আমাকে ভাই বলে ডেকেছে।
-শুনো তুমি,ওদের কথা আমরা রাখবো।ছেলেকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করবো।নামাজ-কালামও শিক্ষা দিবে।আমরা নিজেরাও আর কখনো নামাজ ছাড়বো না।শুধু আমার অনুরোধটা তুমি রাখো,প্লিজ।না রাখলে কিন্তু আমি বাসা থেকে চলে যাব, কেউ জানবে না আমার খোঁজ।

সেই থেকে রেনু বদলে যায়।তার সবকিছু শুধু তোকে ঘিরেই চলতে থাকে। তোর শিক্ষায় যেন কোন ঘাটতি না থাকে।
দিনে দিনে ও ধার্মিক হয়ে উঠে। আমার অবশ্য অনেক সময় লেগেছিল কিন্তু ও আমাকে বলতো বাবা মার দেখেই সন্তান শিখবে।
আমি আরও কয়েকবার চেষ্টা করেছিলাম ওকে বুঝাতে, বার বার বিফল হয়ে পরে হাল ছেড়ে দেই।এরমধ্যেই ওর অসুখটা সনাক্ত হয় আর আমরাও জড়িয়ে পরি নতুন যুদ্ধে।তুই নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিস আজ তুই যা জানলি তা আর কেউ জানে না।আমার আর রেনুর জীবনটা যে তোকে ঘিরেই বাবা।

শাহেদের দিকে তাকিয়ে রেনু বললেন
-কিন্তু আমি ব্যর্থ।তোমাকে দেয়া কথা আমি রাখতে পারিনি। আমি পারিনি ওকে সঠিক শিক্ষা দিতে।
-আম্মু!!!!!!!
-হ্যাঁ,যদি পারতাম,তাহলে তুই ওদের নিয়ে এমন ভাবতে পারতি না।যাইহোক, কাল আমরা ওখানে যাবো, আমার ক্ষমা চাওয়ার আছে ওদের কাছে, আশা করছি কোন ঝামেলা করবি না তুই।
-না আম্মু, আগে আমি একা যেতে চাই, প্লিজ।
-কেন,ওদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে?
-না,আমার নিজের সাথে কিছু বোঝাপড়া করতে।
-কক্ষনো না।।
-আম্মু প্লিজ।
-তাহলে আমাকে ছুঁয়ে কথা দে,কোন খারাপ আচরন তুই করবি না।ওরা যখন তোকে দিয়েছিল কতোটা কষ্ট পেয়েছে আমি বুঝি,তাই তোর কাছ থেকে কোন কষ্ট ওদের আমি পেতে দিবো না।
-আচ্ছা।
-কি আচ্ছা, কথা দে।
-ঠিক আছে। কথা দিলাম আম্মু।

নিজের রুমে এসে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না আবিদ।বিছানায় উপুর হয়ে অনেকক্ষণ শুধু কান্নাকাটিই করলো।ধীরে ধীরে নিজেকে ধাতস্থ করলো।মনে মনে বলল
-আব্বু আম্মু যাই বলুক ওরা কোন কারন ছাড়া অথবা কোন লেনদেন ছাড়া আমাকে এমনি এমনি দিয়ে দিলো,এটা আমি বিশ্বাস করিনা।কেন দিলো আমাকে জানতে হবে। আর তাদের সত্যিকারের চেহারাটা সবার সামনে তুলে ধরবো আমি।এটা আমার নিজের সাথে বাজি।তবে হ্যাঁ, আম্মুকে দেয়া কথা আমি রাখবো।যত কষ্টই হোক হাসিমুখে থাকবো আমি।ক্লান্ত বিধ্বস্ত আবিদও একসময় ঘুমিয়ে পরে।

খোলা জানালা দিয়ে বাতাস আসছে। বেশ ভালো লাগছে। একদম টাটকা বিশুদ্ধ বাতাস।সময় বেশি হয়নি অথচ সব যেন সুনসান। ও এতো তাড়াতাড়ি ঘুমায় না কখনো, বেশ রাত জাগার অভ্যাস।দুই দেশের সময়ের যে পার্থক্য তাতে এখন তার ঘুমানোর কথাও না।ও ভেবেছিল,গত দুইদিনের ধকলে তেমন ঘুম হয়নি,আজ হয়তো তাড়াতাড়ি ঘুম পাবে,সে গুড়েবালি।ঘুম যেন ছুটিতে গেছে। একটা চেয়ার নিয়ে জানালার পাশে বসলো।হঠাৎ ফিসফিস কথা শুনতে পায় আবিদ। একটা নারী কন্ঠ, একটা পুরুষ কন্ঠ। পুরুষ কন্ঠ সে চিনতে পারে,এটা আসাদের গলা।
-আমি এহন ডাক্তার সাবরে ডাকতে পারুম না,চল যাইগা,সকালে আসুমনে।
-কি যে কন,সকালে কেমনে আসুম।আসলেই তো তাগো সামনে পরতে হইবো।
-তা তো হইবোই। তাদের ইতো মেহমান।
-আমাগোর ঘরে উনারে মেহমান কইরা নিয়া গেলে কেমন হয়?
-বুদ্ধির ঢেকি একখান।

হাসে আবিদ।ওর সাথে দেখা করবে অথচ সামনে আসছে না।থাক,ওদের সময় হলে ওরাই আসবে,ও ডাকবে না।এমনিতেও কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না ওর।সব কেমন যেন ধোয়াশার মতো লাগছে। গতকালও যে হিসাবটা সহজ করে নিয়েছিলো, আজ কেন যেন তা মিলাতে পারছেনা।ওদিকে আব্বু আম্মুর জন্যও মনটা অশান্ত হয়ে আছে। কোন কিছুই ভালো লাগছেনা আর।এ গোলকধাঁধা থেকে ও কি করে বের হবে?আবার আসাদের কথায় কান খাড়া করে ও
-কতোবার না বলছি,এসব কথা না বলতে।
-হাছা কথা কইতে আমি ডরামু ক্যান?
-এতো হাছা মিছার কাম নাই।এহন লও ঘরে, দিনে একবার আইসো।
-আবার কয় দিনে,আরে দিনে কি আমি লুকাইয়া আইতে পারুম।
-লুকানোর কি আছে, তারা দেখলে কি মারবো।তোমারে তো কইছিলই রাইতে আইতে।তুমিই তো আইলা না।
-হ,আমার আর খাইয়া কোন কাম নাই।এহনও হিসাবের আটখানা দিন বাকি।
-আবার শুরু করলা?
-কি যন্ত্রণা, বুঝেন না ক্যান।এতোগুলা দিন ঔ বাজা বেডির চেহারা না দেইখা আছি,আটখানা দিনের লাইগা নষ্ট করুম।আমার তো মনে হইতাছে এইবার আর ঐ বাজা আমারে নজর দিবার পারবো না।

শীতল স্রোত নেমে গেল আবিদের মেরুদণ্ড বরাবর। ওর গর্ভধারিনীকে বাজা বলছে।কিন্তু কেন?

(চলবে)